বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

ভারতীয় রসায়ন গোষ্ঠী—প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে

অবসর গ্রহণ—অধ্যাপক ওয়াটসন এবং তাঁহার

ছাত্রদের কার্যাবলী—গবেষণা বিভাগের

ছাত্র—ভারতীয় রসায়ন সমিতি

 আমি যথারীতি প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার কাজ করিতে লাগিলাম। জে, সি, ঘোষ, জে, এন, মুখুয্যে এবং মেঘনাদ সাহা এই সময় উদীয়মান বৈজ্ঞানিক। বিদেশের বৈজ্ঞানিকেরা এই সময়ে দত্ত ও ধরের আবিষ্কার সমূহের উল্লেখ করিতেছিলেন। পরবর্তীগণের মনে যে তাহা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দান করিতেছিল, তাহা সন্দেহ নাই। ক্রমশঃই অধিক সংখ্যক কৃতবিদ্য ছাত্র এই দিকে আকৃষ্ট হইতে লাগিল এবং গবেষণার প্রতি তাহাদের আগ্রহ দেখা যাইতে লাগিল। ইহাদের মধ্যে মাণিকলাল দে, এফ, ভি, ফার্নাণ্ডেজ এবং রাজেন্দ্রলাল দে-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা কেহ কেহ স্বতন্ত্র ভাবে এবং কখনও বা যুক্তভাবে মৌলিক গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন।

 ১৯১৪ সালে ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইল। উহার প্রভাব আমাদের লেবরেটরিতে শীঘ্রই আমরা অনুভব করিলাম, কেননা বাহির হইতে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানী বন্ধ হইয়া গেল। সৌভাগ্য ক্রমে, আমাদের প্রবীণ ডেমনস্ট্রেটর পরলোকগত চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী মহাশয়ের দূরদৃষ্টি বশতঃ আমাদের ভাণ্ডারে যথেষ্ট রাসায়নিক দ্রব্য মজুত ছিল। আমরা তাহারই উপর নির্ভর করিয়া কাজ চালাইতে লাগিলাম। আমাদিগকে অবশ্য বাধ্য হইয়া গবেষণা কার্যের জন্য কতকগুলি বিশেষ দ্রব্য তৈরী করিয়া লইতে হইল। ইহা আমাদের পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপই হইল, কেননা ইহার ফলে অনেক নূতন ছাত্র রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত প্রণালীর রহস্য অবগত হইবার সুযোগ লাভ করিলেন।

 ১৯১১ সালে আর একজন উৎসাহী ও শক্তিমান যুবক আমার লেবরেটরিতে যোগদান করিলেন। ইহার নাম প্রফুল্লচন্দ্র গুহ। তিনি সেই সময়ে ঢাকা কলেজ হইতে রসায়নে স-সম্মানে বি, এস-সি, পরীক্ষায় পাশ করিয়াছিলেন। সাধারণ ব্যবস্থা অনুসারে অধ্যাপক ওয়াটসনের অধীনেই তাঁহার গবেষণা করিবার কথা। কিন্তু অধ্যাপক ওয়াটসন সেই সময় ছুটী লইয়া বিলাত গিয়াছিলেন। হতাশ হইয়া প্রফুল্ল আমার নিকট করুণ আবেদন করিয়া একখানি পত্র লিখিলেন যে, তাঁহার ছাত্রজীবন অকালে শেষ হইবার উপক্রম এবং তিনি আমার অধীনে গবেষণা করিতে চাহিলেন। আমি তাঁহাকে আমার লেবরেটরিতে সাদরে আহ্বান করিলাম এবং তিনি আমার সহকর্মীরূপে কাজ করিতে আরম্ভ করিলেন। গুহ অক্লান্ত পরিশ্রমী ছিলেন এবং রাসায়নিক গবেষণায় তাঁহার স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল। যথাসময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও সগৌরবে উত্তীর্ণ হইলেন। এম, এস-সি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করিলেন এবং তিন বৎসর পরে ডক্টর উপাধি লাভ করিলেন। তিনি ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ’ বৃত্তিও পাইলেন।

 এই সময়ে আমার কর্মজীবনে একটি নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইল। প্রেসিডেন্সি কলেজেই আমার কার্যজীবনের প্রধান অংশ অতিবাহিত হইয়াছিল। এখন আমাকে সেই কার্যক্ষেত্র হইতে বিদায় গ্রহণ করিতে হইল। ঐ কলেজের প্রত্যেক স্থানেই আমার কর্ম জীবনের অতীত স্মৃতি জড়িত। কিন্তু কলেজ হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার পূর্বে, ভূতপূর্ব প্রিন্সিপাল এইচ, আর, জেমসের যোগ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিতে আমি বিস্মৃত হইব না। তিনি অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজের ফেলো ছিলেন এবং বঙ্গীয় শিক্ষাবিভাগের জন্যই বিশেষ ভাবে তিনি আহূত হইয়াছিলেন। তাঁহার পাণ্ডিত্য উচ্চাঙ্গের এবং দৃষ্টিও উচ্চাঙ্গের ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজকে কেবল নামে নয়, কার্যতঃ দেশের শ্রেষ্ঠ কলেজরূপে পরিণত করাই তাঁহার লক্ষ্য ছিল।

 আমি ইতিপূর্বে বলিয়াছি যে, গবেষণাবৃত্তি স্থাপনের সঙ্গে মৌলিক গবেষণা কার্যের কিছু উন্নতি হইয়াছিল। কিন্তু এই উক্তিরও সীমা আছে। ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, দুই একজন ব্যতীত আমার ছাত্রদের মধ্যে যাঁহারা ইউরোপে খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন, তাঁহাদের কেহই উক্ত বৃত্তিধারী ছিলেন না। গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখিয়া এম, এস-সি ডিগ্রী লাভ করিবার পর তাঁহারা কোন বৃত্তি বা সাহায্য নিরপেক্ষ হইয়াই নিজেদের কর্তব্যে নিযুক্ত হইলেন। যাঁহার মনে মৌলিক গবেষণার আগ্রহ জন্মে এবং কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা হয়, তিনি কোন বৃত্তি বা সাহায্য না পাইলেও, তাঁহার কর্তব্য ত্যাগ করেন না। উইলিয়াম র‍্যামজে একবার বলিয়াছিলেন যে, বৃত্তি কতকটা উৎকোচের মত। বৃত্তিধারী তিন বৎসরের একটা স্থায়ী আয় লাভ করিয়া যেন তেন প্রকারে গবেষণা কার্য করিতে থাকেন, কিন্তু তাঁহার মন থাকে অন্য দিকে এবং অধিকতর অর্থকরী কার্যের জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করিতে থাকেন। এইরূপ ব্যক্তি সুযোগ পাইলেই গবেষণাক্ষেত্র ত্যাগ করেন। এরূপ বহু দৃষ্টান্তের সঙ্গে আমি পরিচিত। কিন্তু যিনি মনের ভিতরে সত্যানুসন্ধানের প্রেরণা পাইয়াছেন, তিনি যেরূপ অবস্থাতেই হউক না কেন, কর্তব্যে দৃঢ় থাকেন। যদি তিনি দরিদ্র হন, তবে সকাল সন্ধ্যায় গৃহশিক্ষকের কাজ করিয়াও অর্থ উপার্জন করেন এবং অন্য সমস্ত সময় গবেষণার জন্য ব্যয় করেন। এমার্সন যথার্থই বলেন, “তাহার (মানুষের) চরিত্রের মধ্যে কি কর্তব্যের আহ্বান নাই? প্রত্যেকেরই নিজ কর্তব্য আছে। প্রতিভাই কর্তব্যের আহ্বান।” যাঁহার ভিতরে গবেষণা কার্যের কোন অনুপ্রেরণা জাগে নাই, কেবল মাত্র বৃত্তির লোভে তাঁহার পক্ষে গবেষণার কার্যে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নহে।

 রসিকলাল দত্ত, নীলরতন ধর, জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সী কলেজে গবেষণাবৃত্তিধারী ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এম, এস-সি, পাশ করিবার পরও কলেজের লেবরেটরিতে তাঁহাদিগকে গবেষণা করিবার অনুমতি দেওয়া হইয়াছিল। প্রিন্সিপ্যাল জেমস অনেক সময়ে বলিতেন, এরূপ কৃতী ছাত্রেরা যে কলেজের সঙ্গে কিছুকালের জন্য সংসৃষ্ট থাকিবেন, ইহা কলেজের পক্ষে সৌভাগ্যের কথা। তিনি কলেজের এইসব কৃতী ছাত্রদের গবেষণা কার্যে গৌরব অনুভব করিতেন।

 এই সময় প্রচার হইতে লাগিল, যে একটি স্কুল অব কেমিষ্ট্রী বা ‘রসায়ন গোষ্ঠী’ গড়িয়া উঠিতেছে। আমি পূর্বেই বলিয়াছি, দত্ত, রক্ষিত, এবং ধরের মৌলিক গবেষণা ইংলণ্ড, জার্মানি ও আমেরিকার রাসায়নিক পত্র সমূহে ঐ সব দেশের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা উল্লিখিত হইতেছিল। ইহাতে মনে মনে আমি বেশ আনন্দ অনুভব করিতাম। আমার ইংলণ্ড হইতে ফিরিবার কিছুদিন পরে বিহারের শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর মিঃ জেনিংস আমাদের রসায়ন বিভাগ দেখিতে আসিলেন। নানাবিষয়ে কথা বলিতে বলিতে তিনি প্রসঙ্গতঃ বলিলেন, “আমার বিশ্বাস, আপনি রসায়ন বিদ্যাগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার মূল কারণ।” এই প্রথম এই বিষয়টির প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল এবং এখন পর্যন্ত আমার স্মৃতিপথ হইতে উহা লুপ্ত হয় নাই।

 বিলাতের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পত্র “নেচার” এই বিষয়টি স্বীকার করেন; উক্ত পত্রের ২৩শে মার্চ, ১৯১৬ তারিখের সংখ্যায় লিখিত হইয়াছিল—

 “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিবিধ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদত্ত হইতেছে। গত ১০ই জানুয়ারী তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ‘ডীন’ যে বক্তৃতা করেন, তাহা আমাদের হস্তগত হইয়াছে। গত ২০ বৎসরে বাংলাদেশে রসায়ন সম্বন্ধে যে সব মৌলিক গবেষণা করা হইয়াছে, এই বক্তৃতায় তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। পরিশিষ্টে ১২৬টি গবেষণার নাম দেওয়া হইয়াছে; কেমিক্যাল সোসাইটি, জার্ণাল অব দি আমেরিকান সোসাইটি প্রভৃতিতে এই সকল মৌলিক গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। এই সমস্ত প্রবন্ধের মধ্যে অনেকগুলি খুব মূল্যবান এবং নব প্রতিষ্ঠিত রসায়নবিদ্যাগোষ্ঠীর কার্যাবলীর পরিচয় এইগুলিতে পাওয়া যায়। অধ্যাপক রায়ের কার্য এবং দৃষ্টান্তের ফলেই এই ‘বিদ্যাগোষ্ঠীর’ প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। অধ্যাপকের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস” ১৩ বৎসর পূর্বে লেখা হইয়াছিল। উহাতে তিনি প্রমাণ করেন যে প্রাচীন হিন্দুদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভাব ছিল। হিন্দুদের ধর্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ‘তন্ত্র’ প্রভৃতিতে ইহার পরিচয় আছে। অধ্যাপক রায়ের মত লোক—যিনি প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রে পণ্ডিত এবং নব্য রসায়নী বিদ্যাতেও পারদর্শী—তিনিই কেবল এইরূপ গ্রন্থ লিখিতে পারেন। এই গ্রন্থে অধ্যাপক রায় দুঃখ করেন যে, ভারতে বৈজ্ঞানিক ভাবের অবনতি ঘটিয়াছে এবং যে জাতি স্বভাবতঃই দার্শনিকতা-প্রবণ, তাহাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান-স্পৃহার অভাব হইয়াছে। এখন অধ্যাপক রায় বলিতেছেন, ‘দশ বার বৎসরের মধ্যেই আমাদের দেশবাসীর শক্তি সম্বন্ধে আমার ধারণা যে পরিবর্তিত হইবে, এবং জাতির জীবনে নূতন অধ্যায়ের সূচনা হইবে, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই।’ বাংলাদেশে বর্তমানে যে সব মৌলিক রাসায়নিক গবেষণা হইতেছে, তাহাতে নিশ্চয়ই বুঝা যায় যে একটা নূতন ভাব জাগ্রত হইয়াছে এবং আশা করা যায় যে এই ভাব ক্রমশঃ ভারতের অন্যান্য অংশেও বিস্তৃত হইবে এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য বিভাগ সম্বন্ধেও এই মৌলিক গবেষণা-স্পৃহার উদ্ভব হইবে।”

 পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রীর অধ্যাপক এস, এস, ভাটনগরও তাঁহার একটি বক্তৃতায় ভারতে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রীর প্রবর্তকগণের অতি উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন।

 প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে এখন আমার অবসর গ্রহণ করিয়া নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করিবার সময় আসিল। সাধারণ নিয়মে আরও এক বৎসর আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের কাজে থাকিতে পারিতাম, কেন না আমার বয়ঃক্রম তখনও ৫৫ বৎসর পূর্ণ হয় নাই।

 আমার অবসর গ্রহণের সময় ছাত্রেরা আমাকে যে সম্বর্ধনা করিয়াছিলেন, এবং আমি তাহার যে প্রত্যুত্তর দিয়াছিলাম, তাহা উল্লেখযোগ্য।

“মহাত্মন্

 “প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে আপনার অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে আপনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন গ্রহণ করুন।

 “কলেজে আপনার যে স্থান ছিল, তাহা পূর্ণ হইবার নহে। ভবিষ্যতে আরও অনেক অধ্যাপক আসিবেন; কিন্তু আপনার সেই মধুর প্রকৃতি, সেই সরলতা, অক্লান্ত সেবার ভাব, উদার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা, তর্ক ও আলোচনায় সেই গভীর জ্ঞান, এই সমস্ত গুণ আমরা কোথায় পাইব? গত ৩০ বৎসর ধরিয়া এই সমস্ত দুর্লভ গুণেই আপনি ছাত্রদের প্রীতি অর্জন করিয়াছেন।

 “আপনার কৃতিত্ব অসামান্য। আপনার সরল জীবন যাপন প্রণালী আমাদিগকে প্রাচীন ভারতের গৌরবময় যুগকে স্মরণ করাইয়া দেয়। আপনি চিরদিনই আমাদের বন্ধু, গুরু ও পথ-প্রদর্শক ছিলেন। সকলেই আপনার কাছে প্রবেশ করিতে পারে। আপনার প্রকৃতি সর্বদাই মধুর। দরিদ্র ছাত্রদিগকে কেবল সৎপরামর্শ দিয়া নহে, অর্থ দ্বারাও আপনি সহায়তা করিতে সর্বদাই প্রস্তুত। কঠোর ব্রহ্মচর্যপূত অনাড়ম্বর জীবন আপনার, আপনার দেশপ্রেমের বাহ্য আড়ম্বর নাই। কিন্তু উহা গভীর,—আপনার মধ্যে আমরা প্রাচীন ভারতের গুরুর আদর্শেরই পুনরাবির্ভাব দেখিতেছি।

 “যখন ভারতের বর্তমান যুগের জ্ঞানোন্নতির ইতিহাস লেখা হইবে, তখন ভারতে নব্য রসায়নী বিদ্যার প্রবর্তক রূপে আপনার নাম সর্বাগ্রে সগৌরবে উল্লিখিত হইবে। এদেশে মৌলিক রাসায়নিক গবেষণার জন্মদাতা এবং বৈজ্ঞানিক ভাবের জন্মদাতারূপে যশ ও গৌরব আপনারই প্রাপ্য। আপনার ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ গ্রন্থ ভারতীয় কীর্তি-মালার এক নূতন অধ্যায় খুলিয়া দিয়াছে ও অতীতের অন্ধকারের উপর আলোকের সেতু রচনা করিয়াছে, এবং তাহার ফলে নবীন বৈজ্ঞানিকগণ প্রাচীন নাগার্জুন ও চরকের সঙ্গে জ্ঞানরাজ্যে মৈত্রী স্থাপনের সংযোগ লাভ করিয়াছেন।

 “আপনি এর চেয়েও বেশি করিয়াছেন। রাসায়নিক গবেষণাকে আপনি দেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়াছেন এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও শিল্প প্রচেষ্টা বাহিরের সাহায্য নিরপেক্ষ হইয়াও কিরূপে সাফল্য লাভ করিতে পারে, বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস, তাহার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

 “জীবন সায়াহ্নে লোকে সাধারণতঃ যখন অবসর অন্বেষণ করেন, তখনও আপনি কার্যক্ষেত্রে থাকিতেই সঙ্কল্প করিয়াছেন। এক যুগ পূর্বে আপনি যে বিজ্ঞানের আলোক প্রজ্জ্বলিত করিয়াছিলেন, তাহা অনির্বাণ রাখিবার জন্য আপনি আগ্রহান্বিত। বিজ্ঞান কলেজ এবং রাসায়নিক গবেষণা যেন দীর্ঘকাল ধরিয়া আপনার অক্লান্ত সেবা ও উৎসাহে শক্তি লাভ করে। আপনার আশীর্বাদে আরও বহু বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু যেন এই পথে অগ্রসর হয় এবং আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রগণ ও পরবর্তীগণ যেন আপনার উদার স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের ভালবাসা হইতে বঞ্চিত না হই।” এই বিদায় সম্বর্ধনা সত্যই বেদনাদায়ক! মানুষ যখন আত্মীয় স্বজনের শোকাশ্রুর মধ্যে ইহলোক হইতে বিদায় গ্রহণ করে সেইদিনের কথা ইহাতে স্মরণ হয়। আবেগকম্পিতকণ্ঠে গভীর বাষ্পরুদ্ধ স্বরে আমি ইহার উত্তর দিলাম:—

 “সভাপতি মহাশয়, আমার সহকর্মিগণ এবং তরুণ বন্ধুগণ,

 “আপনারা যে ভাবে আমার প্রতি উচ্চপ্রশংসাসূচক বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন, তাহাতে আমি কুণ্ঠিত ও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছি। সতরাং যদি মনের রুদ্ধ ভাব আমি যথোচিত প্রকাশ না করিতে পারি, আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি জানি, এইরূপে বিদায় সম্বর্ধনার ক্ষেত্রে আপনারা আমার বহু ত্রুটী বিচ্যুতি ক্ষমা করিবেন এবং আমার মধ্যে যদি কিছু ভাল দেখিয়া থাকেন, তাহারই উপর জোর দিবেন। ভদ্র মহোদয়গণ, আমি ইহা ভগবানের নির্দেশ বলিয়া মনে করি যে আমার বন্ধু ও সহকর্মী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও আমি গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া এক সঙ্গে কাজ করিয়াছি। আমরা প্রত্যেকে আমাদের স্বতন্ত্র বিভাগে কাজ করিয়াছি, পরস্পরকে উৎসাহ দান করিয়াছি, এবং আমি আশা করি যে আমরা যে অগ্নি মৃদুভাবে প্রজ্জ্বলিত করিয়াছি, তাহা ছাত্রপরম্পরাক্রমে অধিকতর উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় হইতে থাকিবে এবং অবশেষে তাহা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আলোকিত করিবে। আপনাদের কেহ কেহ হয়ত জানেন যে যাহাকে পার্থিব বিষয় সম্পত্তি বলে, তাহার প্রতি আমি কোন দিন বিশেষ মনোযোগ দিই নাই। যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার কার্যকাল শেষ হইবার সময় আমি কি মূল্যবান সম্পত্তি সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা হইলে প্রাচীন কালের কর্ণেলিয়ার কথায় আমি উত্তর দিব। আপনারা সকলেই সেই আভিজাত্য-গৌরব-শালিনী রোমক মহিলার কাহিনী শুনিয়াছেন। জনৈক ধনী গৃহিণী একদিন তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া নিজের রত্ন অলঙ্কার প্রভৃতি সগর্বে দেখাইলেন এবং কর্ণেলিয়াকে তাঁহার নিজের রত্নালঙ্কার দেখাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। কর্ণেলিয়া বলিলেন—‘আপনি একট অপেক্ষা করুন, আমার মণি-মাণিক্য আমি দেখাইব।’ কিছুক্ষণ পরে কর্ণেলিয়ার দুই পত্রে বিদ্যালয় হইতে ফিরিলে তিনি তাহাদিগকে দেখাইয়া সগর্বে বলিলেন,—‘এরাই আমার রত্নালঙ্কার।’ আমিও কর্ণেলিয়ার মত, রসিকলাল দত্ত, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী প্রভৃতিকে দেখাইয়া বলিতে পারি, ‘এরাই আমার রত্ন।’ ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের কলেজ ম্যাগাজিনের বর্তমান সংখ্যায় ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের শতবার্ষিকী’ নামক যে প্রবন্ধ আমি লিখিয়াছি, তাহাতে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, আপনাদের এই কলেজ নব্য ভারত গঠনে কি মহান্ অংশ গ্রহণ করিয়াছে। আমি আশাকরি, আপনারা কলেজের এই গৌরব রক্ষা করিবেন।

 “ভদ্রমহোদয়গণ, প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে আমি সম্বন্ধ ছিন্ন করিতেছি, এ চিন্তা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার জীবনের সমস্ত গৌরবময় স্মৃতি ইহার সঙ্গে জড়িত; এই রাসায়নিক গবেষণাগারের প্রত্যেক অংশ, ইহার ইঁট চুন-সুরকী পর্যন্ত অতীতের স্মৃতিপূর্ণ। আরও যখন মনে পড়ে যে আমার বাল্যজীবনের চার বৎসর ইহারই শাখা হেয়ার স্কুলে আমি কাটাইয়াছি এবং পরে চার বৎসর এই কলেজেই পড়িয়াছি, তখন দেখিতে পাই, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ দীর্ঘ ৩৫ বৎসর কালব্যাপী। এবং আমার মৃত্যুকালে এই ইচ্ছাই আমার মনে জাগরূক থাকিবে যে, আমার চিতাভস্মের এক কণা যেন এই পবিত্রভূমির কোথাও রক্ষিত থাকে। ভদ্রমহোদয়গণ, আমার আশঙ্কা হইতেছে, বক্তৃতায় যেটুকু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম,—তাহার সীমা আমি অতিক্রম করিয়াছি। আপনাদের চিত্তাকর্ষক অভিনন্দনের জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল হইতে ধন্যবাদ দিতেছি। আপনাদের এই অনুষ্ঠানের স্মৃতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি বহন করিব।”

 এখানে পরলোকগত ডাঃ ই, আর, ওয়াটসনের স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা কর্তব্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকরূপে, তিনি একদল নবীন রাসায়নিক গড়িয়া তুলিয়াছিলেন এবং তাহাদের প্রাণে মহৎ অনুপ্রেরণা জাগাইয়াছিলেন।

 “১৯০৮ সালে ঢাকা কলেজ হইতে প্রথম একদল ছাত্র রসায়নশাস্ত্রে এম, এ, পরীক্ষায় পাশ করে। ডাঃ ওয়াটসন অনকূলচন্দ্র সরকার নামক কৃতী ছাত্রকে বাছিয়া লন এবং তাঁহার সহযোগিতায় গবেষণা করিতে থাকেন। পরে আরও দুইজন ছাত্র এই কার্যে যোগ দিয়াছেন। ঢাকা কলেজে রাসায়নিক গবেষণার ইহাই আরম্ভ। তাহার পর হইতে ডাঃ ওয়াটসনের কানপুর গমন পর্যন্ত, তিন চার জন ছাত্র বরাবর ডাঃ ওয়াটসনের সঙ্গে, তাঁহার তত্ত্বাবধানে কাজ করিয়াছিলেন। ডাঃ ওয়াটসনের কয়েকজন ছাত্র পরবর্তীকালে রাসায়নিক গবেষণা করিয়া যশ ও খ্যাতি লাভ এবং জ্ঞানভাণ্ডারের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে ডাঃ অনুকূলচন্দ্র সরকার, ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, ডাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষ, ডাঃ সুধাময় ঘোষ এবং ডাঃ শিখিভূষণ দত্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ডাঃ ওয়াটসন নিজে অক্লান্ত কর্মী ছিলেন। তাঁহাকে কখনই কর্মে পরিশ্রান্ত হইতে দেখা যায় নাই। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি একাকী অথবা ছাত্রদের সঙ্গে হাসিমুখে কাজ করিতেন। তাঁহার কার্য তালিকা এইরূপ ছিল:—সকাল ৭টা—৯ ১/২টা, লেবরেটরিতে নিজের গবেষণা কার্য, ১০ ১/২টা—১২ ১/২টা, ক্লাসে অধ্যাপনা ও আফিসের কাজ। ১ ১/২টা—৫টা, আই, এস-সি, বি, এস-সি, এবং এম, এস-সি, ক্লাসের ছাত্রদের প্র্যাকটিক্যাল কার্য পরিদর্শন। ৫ ১/২টা—৭টা রিসার্চ ছাত্রদের কার্য পরিদর্শন। তাহার পরেও, রাত্রি ৯টা হইতে ১০টা পর্যন্ত তিনি নিজের গবেষণার কাজ করিতেন। ছুটীর দিনে বা অবকাশকালে ডাঃ ওয়াটসনের সময় তাঁহার নিজের গবেষণায় ও রিসার্চ ছাত্রদের গবেষণার কাজ দেখিবার জন্য ব্যয় হইত।” (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ১৯২৭, মার্চ)

 আমি প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করিলাম। এই সময়ে রসায়নের নূতন ও পূর্বতন কৃতী ছাত্র আসিয়া বিজ্ঞান কলেজে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাদের মধ্যে প্রিয়দারঞ্জন রায়, পুলিনবিহারী সরকার, জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়, যোগেন্দ্রচন্দ্র বর্ধন, প্রফল্লকুমার বসু, গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মনোমোহন সেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায়ের কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। “Complexes & Valency” এবং মাইক্রো-কেমিষ্ট্রী সম্বন্ধে তিনি একজন প্রামাণিক বিশেষজ্ঞ বলিয়া গণ্য। রসায়ন সমিতি সমূহের সম্মুখে আমার নিজের কোন মৌলিক প্রবন্ধ দাখিল করিবার পূর্বে আমি উহা প্রিয়দারঞ্জনকে দেখিতে দেই এবং তাঁহার অভিমত জিজ্ঞাসা করি। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে ভারতীয় রসায়ন সমিতির বার্ষিক অধিবেশনে আমি যে অভিভাষণ পাঠ করি, তাহা প্রধানতঃ প্রিয়দারঞ্জনের ভাব ও সিদ্ধান্তের উপরই প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার মত শান্ত ও নীরব কর্মী বিরল। ইউরোপে গিয়া অধ্যয়ন শেষ করিবার জন্য অতিকষ্টে তাঁহাকে সম্মত করা হয়। Inferiority Complex বা ‘নিকৃষ্ট মনোবৃত্তি’ তাঁহার মনের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করে নাই।

 ‘রাসবিহারী ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ বৃত্তি’ তাঁহার উপর একরকম জোর করিয়াই চাপাইয়া দেওয়া হয়। বার্ন সহরে অধ্যাপক ইফ্রেমের গবেষণাগারে তিনি ৪ মাস কাল গবেষণা করেন। তাঁহার খ্যাতি পূর্বেই বিস্তৃত হইয়াছিল, সুতরাং বার্নে তিনি একজন অভিজ্ঞ সহকর্মী হিসাবেই সম্মান ও অভিনন্দন লাভ করেন। তিনি বহু মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার যে কোন একটির জন্য পৃথিবীর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাকে “ডক্টর” উপাধি দিতে পারেন। কিন্তু এখনও তিনি এ বিষয়ে মনস্থির করেন নাই।

 ঘটনা দুইরকমের—নীরব ও বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ। প্রিয়দারঞ্জনের কার্যাবলী প্রথম শ্রেণী ভুক্ত। তাঁহার অন্য সমস্ত গবেষণার কথা ছাড়িয়া দিলেও, সম্প্রতি তিনি “থায়োসালফিউরিক অ্যাসিড” সম্বন্ধে যে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, তাহাতেই প্রকাশ যে তিনি একজন উচ্চশ্রেণীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কর্তা।

 জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় কলিকাতায় অধ্যয়ন সমাপ্ত করিয়া প্রায় তিনবৎসরকাল মানচেষ্টারে অধ্যাপক রবিন্‌সনের গবেষণাগারে কাজ করেন। তিনি যুক্ত ও স্বতন্ত্রভাবে যে সমস্ত মৌলিক গবেষণার ফল প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, ‘অ্যালকালয়েড’ ঘটিত রসায়ন সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান কত গভীর। ঘোষ, মুখার্জ্জী ও সাহার অন্যতম সহাধ্যায়ী পুলিনবিহারী সরকার এদেশে তাঁহার অধ্যয়ন সমাপ্ত করিয়া পারিতে যান এবং সোরবোনে অধ্যাপক উরবেনের গবেষণাগারে তিনবৎসরকাল “Rare Earths” (দুষ্প্রাপ্য মৃত্তিকা) সম্বন্ধে গবেষণা করেন। ‘কেমিক্যাল হোমলজি’ সম্বন্ধে তাঁহার নূতনতম গবেষণা তাঁহার কৃতিত্বের পরিচায়ক।

 রাজেন্দ্রলাল দে ১৯১৩—১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার শিক্ষাধীনে ‘রিসার্চ্চ স্কলার’ ছিলেন। আমার সঙ্গে একযোগে নাইট্রাইট ও হাইপো-নাইট্রাইট সম্বন্ধে কতকগুলি মৌলিক প্রবন্ধ তিনি প্রকাশ করেন। তিনি নিজে স্বাধীনভাবেও ‘ভ্যালেন্সি’ সম্বন্ধে কতকগগুলি মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ‘লেকচারার’।

 আর একজন কৃতী ছাত্র প্রফুল্লকুমার বসু। রসায়ন শাস্ত্রের উন্নতি ও বিকাশ সম্বন্ধে সম্প্রতি যে বার্ষিক বিবরণী বাহির হইয়াছে তাহাতে বসুর মৌলিক গবেষণার ষথেষ্ট সুখ্যাতি করা হইয়াছে।

 গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী ১৯২২-২৪ সাল পর্যন্ত আমার নিকট রিসার্চ স্কলার ছিলেন এবং ‘সালফার কম্পাউণ্ড’ ও ‘সিনথেটিক ডাই’ সম্বন্ধে বহু মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ তিনি প্রকাশ করিয়াছেন। গোপালচন্দ্র ১৯২৮ সালে ‘ডি, এস-সি’ উপাধি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি বাঙ্গালোরে ইণ্ডিয়ান ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্সে লেকচারার।

 যোগেন্দ্র চন্দ্র বর্দ্ধন অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র মিত্রের শিক্ষাধীনে জৈব রসায়ন সম্বন্ধে অক্লান্তকর্ম্মী ছাত্র ছিলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ করিবার পর তাঁহাকে “পালিত বৈদেশিক বৃত্তি” দেওয়া হয়। ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্সে অধ্যাপক থর্পের নিকট তিনি তিন বৎসরকাল গবেষণা করেন এবং লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ করেন। তারপর তিনি হল্যাণ্ডে গিয়া অধ্যাপক রুজিকার নিকট কিছুকাল শিক্ষা করেন। ‘Balbiano’s Acid’ সম্বন্ধে তাঁহার গবেষণা অতি মূল্যবান।

 মনোমোহন সেনও অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্রের শিক্ষাধীনে থাকিয়া একটি মৌলিক রাসায়নিক গবেষণার জন্য 'ডক্টর' উপাধি লাভ করেন।

 বীরেশচন্দ্র গুহ সায়েন্স কলেজের একজন কৃতী ছাত্র এবং আমার লেবরেটরিতে রিসার্চ স্কলার ছিলেন। তিনি টাটা বৃত্তি লাভ করিয়া ইয়োরোপ গমন করেন। লণ্ডনের ইউনিভারসিটি কলেজে অধ্যাপক ড্রামণ্ডের শিক্ষাধীনে তিনি বাইওকেমিষ্ট্রী সম্বন্ধে বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেন। পরে কেম্ব্রিজে অধ্যাপক হকিসের নিকটও তিনি ঐ বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। লণ্ডনে পি-এইচ, ডি ও ডি, এস-সি, উপাধি লাভ করিয়া তিনি বাইওকেমিষ্ট্রী সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের নিকট শিক্ষালাভ করিবার জন্য বার্লিন ও ভিয়েনায় যান। তিনি ইয়োরোপে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করিয়া সম্প্রতি দেশে ফিরিয়াছেন; বাইওকেমিষ্ট্রী সম্বন্ধে তিনি কয়েকটি মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন।

 সুশীলকুমার মিত্র আমার গবেষণাগারে রিসার্চ স্কলার ছিলেন। তিনিও কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ মৌলিকতার পরিচয় দিয়াছেন।

 আমার সহকর্মী অধ্যাপক জে, এন, মুখার্জী এবং এইচ, কে, সেনের লেবরেটরিতে তাঁহাদের কৃতী ছাত্রদের দ্বারা কয়েকটি মূল্যবান মৌলিক গবেষণা হইয়াছে।

 এ পর্যন্ত ভারতীয় রসায়নবিদেরা সাধারণতঃ ইংলণ্ড, জার্মানি এবং আমেরিকার পত্রিকাসমূহেই তাঁহাদের মৌলিক প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করিবার জন্য পাঠাইতেন। আমাদের এখন মনে হইল যে ভারতেই আমাদের একটি রাসায়নিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করা উচিত এবং তাহার একখানি মুখপত্রও থাকা প্রয়োজন। অধ্যাপক ভাটনগরের যে বক্তৃতা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতেই এইরূপ প্রস্তাব প্রথম করা হয়। নিম্নে যে সমস্ত চিঠিপত্র উদ্ধৃত হইল, তাহাতে এ সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জানা যাইবে।

 ‘কেমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেণ্ট ও কর্তাগণ নবপ্রতিষ্ঠিত ভারতীয় কেমিক্যাল সোসাইটিকে আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছেন’ (টেলিগ্রাম)। ইহার উত্তরে ‘ভারতীয় রাসায়নিক সমিতির’ সভাপতি ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় নিম্নলিখিত পত্র লিখেন:—

বিজ্ঞান কলেজ
৯২, আপার সার্কুলার রোড
কলিকাতা (ভারতবর্ষ)
২৩শে অক্টোবর, ১৯২৪

“প্রিয় অধ্যাপক উইন,

 আপনার ১৭ই অক্টোবরের (১৯২৪) টেলিগ্রামের জন্য ধন্যবাদ। আপনার নিজের এবং কেমিক্যাল সোসাইটির কাউন্সিলের অভিনন্দন ও সদিচ্ছা আমরা কত মূল্যবান মনে করি, বলা নিষ্প্রয়োজন। লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটিকেই আমরা আমাদের সোসাইটির জনক মনে করি। এতদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালই রাসায়নিকদের একমাত্র মুখপত্র ছিল। এই কারণে উক্ত পত্রিকাতে ক্রমবর্দ্ধমান মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধাদি স্থানাভাবে প্রকাশ করা কঠিন হইত এবং তাহার ফলে লেখকদিগকে প্রবন্ধগুলি যতদূর সম্ভব সংক্ষেপ করিবার জন্য অনুরোধ করিতে হইত। একখানি মুখপত্রসহ ভারতে স্বতন্ত্র কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ইহা হইতেই বুঝিতে পারা যাইবে।

 “৪০ বৎসর পূর্বে যখন আমি এডিনবার্গে ছাত্র ছিলাম, সেই সময়ে আমি স্বপ্ন দেখিতাম,—ভগবানের ইচ্ছায় এমন দিন আসিবে যেদিন বর্তমান ভারত জগতের বিজ্ঞান ভাণ্ডারে তাহার নিজস্ব বস্তু দান করিতে পারিবে। আমার সৌভাগ্যক্রমে সে স্বপ্ন সফল হইয়াছে। মৎকৃত ‘ভারতীয় রসায়নের ইতিহাস’ গ্রন্থে আমি দেখাইয়াছি, প্রাচীন ভারতে কিরূপে উৎসাহ ও আগ্রহ সহকারে এই বিজ্ঞানের অনুশীলন করা হইত। বর্তমানে আমি সানন্দে লক্ষ্য করিতেছি যে, ভারতের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ, আমার ছাত্রেরাই অধিকার করিয়াছেন। তাঁহারা সকলেই কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালের নিয়মিত লেখক।

 “মূল সোসাইটির সঙ্গে আমাদের সোসাইটির সৌহার্দ্য রক্ষা করিবার জন্য আমি সর্বদা চেষ্টা করিব এবং তাহার উৎসাহ ও প্রেরণা মূল্যবান সম্পদ রূপে গণ্য করিব। এই পত্র লিখিবার সময় আমার মনে যে ভাবাবেগ হইতেছে তাহা আমি রোধ করিতে পারিতেছি না। স্বভাবতঃই সেই ২৩শে ফেব্রুয়ারীর (১৮৪১) কথা আমার মনে পড়িতেছে—যে দিন আদি সদস্যেরা মিলিত হইয়া লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে পরামর্শ ও আলোচনা করেন। আমি সানন্দচিত্তে আরও স্মরণ করিতেছি যে, লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির আদি সদস্যদের মধ্যে লর্ড প্লেফেয়ারকে (তিনি কিছুকাল এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রতিনিধি ছিলেন) জানিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল, আমার শ্রদ্ধাস্পদ অধ্যাপক ক্রাম ব্রাউন লর্ড প্লেফেয়ারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন।

 আপনার সদিচ্ছার জন্য পুনর্বার বহু ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।

ভবদীয়
(স্বাঃ) পি, সি, রায়”

 (কেমিক্যাল সোসাইটির কার্য-বিবরণী হইতে গৃহীত, তারিখ ২০শে নবেম্বর, ১৯২৪।)