আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
১৮৬০ ও তৎপরবর্তী কালে বাংলার গ্রামের আর্থিক অবস্থা
“এই ধরণের অনুসন্ধান কার্য সহরে করা যায় না। পুঁথিপত্র কাগজে এ সব সংবাদ পাওয়া যায় না। দেশের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া এ সব তথ্য জানিতে হইবে অথবা অজ্ঞই থাকিতে হইবে; দশ হাজার গ্রন্থে পরিবৃত হইয়াও কোন ফল হইবে না।” Arthur Young’s Travels.
আর্থিক ক্ষেত্রে বাংলা দেশ কিরূপে বিজিত হইল, তাহা বুঝিতে হইলে, ১৮৬০ খৃঃ এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহা জানা প্রয়োজন।
চাউল বাংলার প্রধান খাদ্য। নিরক্ষর শ্রমিকেরাও বেশী মজুরী দাবী করিতে হইলে বাজারে চাউলের দরের কথা উল্লেখ করে: “বাবু, চালের সের এক আনা, দিন দুই আনায় চার জন লোককে খাইতে দেই কিরূপে?” আমার বাল্যকালে মজুরদের মাসিক বেতন ছিল ৩॥০ টাকা কি ৪৲ টাকা, চাউলের মণ ছিল দেড় টাকা।[১] আমাদের জেলায় মজুরেরা বেশীর ভাগ মুসলমান। তাহাদের সাধারণতঃ দুই এক বিঘা জমি থাকিত, তাহাতে ধান, শাকসব্জী প্রভৃতি হইত। বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা ছাগল, মুরগী প্রভৃতি পালন করিয়া কিছু কিছু আয় বৃদ্ধি করিত। পয়সায় কুড়িটা ভাল বেগুন পাওয়া যাইত। এক আনায় এক পুঁজি (নয়টা) গলদা চিংড়ি, টাকায় ১২টা মুরগী পাওয়া যাইত। বাজারে দুধের দর ছিল টাকায় ৩২ সের। প্রত্যেক গৃহস্থেরই গোশালা এবং ঢেঁকিশালা থাকিত; ধানের তুষ, ক্ষুদ কুঁড়া সবই কাজে লাগিত।
বিভিন্ন রকমের ডাল গৃহস্থদের জমিতেই হইত, অথবা এক বৎসরের উপযোগী ডাল কিনিয়া বড় বড় মাটীর হাঁড়িতে রাখা হইত। প্রত্যেক গৃহস্থই এক বৎসরের খোরাকী ধান গোলায় মজুত রাখিত, তা ছাড়া অজন্মার আশঙ্কায়, আরও এক বৎসরের জন্য অতিরিক্ত ধান জমা থাকিত।
ভাল সগন্ধি ঘৃত—আট আনা সেরে পাওয়া যাইত। বর্তমানে কলিকাতা অঞ্চল হইতে যে কলের তেল চালান হয়, গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাহার পরিচয় ছিল না। গ্রামের ঘানিতে সরিষার তেল হইত, এবং প্রত্যেক গ্রামেই উহা প্রচুর পরিমাণে মিলিত। এই খাঁটী সরিষার তেল বাঙালীর খাদ্যের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল। কলুরাই তখন বংশানুক্রমে সরিষার তেলের ব্যবস্থা করিত। সরিষার তেলের দর ছিল তিন আনা সের। তেলের খইল গরুর খাদ্য এবং জমির সার রূপে ব্যবহৃত হইত।
গো-পালন হিন্দুর ধর্মের একটা অঙ্গ ছিল। আমার এখনও মনে আছে, আমার মা নিজে গরুর খাওয়ার তদারক করিতেন। নানা জাতির গরু আমাদের বাড়ীতে ছিল। আমাদের বাড়ীর নিয়ম ছিল যে, ছেলে মেয়েরা পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত প্রধানতঃ দুধ খাইয়া থাকিবে। ধনী ভদ্র গৃহস্থেরা এবং তাঁহাদের বাড়ীর মেয়েরা পর্যন্ত সকালবেলা গোয়ালঘর পরিষ্কার করা অপমানের কাজ মনে করিতেন না। গোয়াল ঘরের ঝাঁটালি গোবর ইত্যাদি জমিতে ভাল সারের কাজ করিত। তুষ, জাউ, কলার খোসা প্রভৃতি গরুদের খাওয়ানো হইত। প্রত্যেক গ্রাম্য পঞ্চায়েতের গোচর জমি[২] ছিল,—সেখানে নির্বিবাদে গরু চরিয়া খাইত। ধান কাটা ও মলা হইলে প্রচুর খড় পাওয়া যাইত এবং তাহা গরুর খাদ্যের জন্য গাদা দিয়া রাখা হইত। গ্রীষ্মকালে ঘাস দুর্ল্লভ হইলে, এই খড় খুব কাজে লাগিত। এক কথায়, প্রত্যেক পরিবারই কিয়ৎ পরিমাণে আত্মনির্ভর ছিল।
এখনকার মত সাবানের এত প্রচলন ছিল না, বড় লোকেরাই কেবল ইহা ব্যবহার করিতেন। কাপড় কাচা প্রভৃতির জন্য সাজিমাটির খুব প্রচলন ছিল। গরীব গৃহস্থেরা কলাপাতার ক্ষারের সঙ্গে চুণ মিশাইয়া গরম জলে সিদ্ধ করিয়া কাপড় ধুইত। ঢাকাতে এক প্রকারের গোলা সাবান হইত। পর্টুগীজেরা ঢাকায় ১৬শ শতাব্দীতে বসতি করে, তাহাদের নিকট হইতেই সম্ভবতঃ লোকে এই সাবান তৈরী করার কৌশল শিখিয়াছিল। বাংলা ও হিন্দী ‘সাবান’ শব্দ খুব সম্ভব পর্টুগীজ ‘Savon’ হইতে আসিয়াছে।
বাংলার নৌ-বাণিজ্য তখন কোষ, বালাম, সোদপুরী প্রভৃতি নানা প্রকারের দেশী নৌকা যোগে হইত। যাত্রীবাহী নৌকা স্বতন্ত্র রকমের ছিল। বজরাতে বড় লোকেরা যাইতেন, সাধারণ লোকে ‘পান্সী’ ‘তাপুরী’ প্রভৃতিতে চড়িত। প্রত্যেক গ্রামেই এরূপ শত শত নৌকা থাকিত। বন্দর ও গঞ্জে ঘাটে নৌকার ভিড় লাগিয়া থাকিত এবং সে দৃশ্য বড় সুন্দর দেখাইত। কলিকাতা হইতে গ্রামে এই সব নৌকাতে যাতায়াতের সময় বড় আনন্দ বোধ হইত। স্রোতের মুখে নৌকাগুলি যখন সারি বাঁধিয়া দাঁড় টানিয়া যাইত অথবা উজানে পাল তুলিয়া ছুটিত, তখন বড়ই মনোহর দেখাইত। এখন এসব অতীতের কথা বলিলেই হয়। ব্রিটিশ কোম্পানী সমূহের ষ্টীমার বাংলার নদীপথ আক্রমণ করিয়া এই বিপর্যয় ঘটাইয়াছে।
বেভারিজ তাঁহার ‘বাখরগঞ্জ’ গ্রন্থে ১৮৭৬ সালে এদেশের নদীবাহী নৌকা ও তাহাদের নির্মাণ প্রণালীর নিম্নলিখিত রূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—
“এই জেলায় নৌকা নির্মাণ একটি চমৎকার শিল্প। মেন্দিগঞ্জ থানার এলাকার দেবাইখালি ও শ্যামপুর গ্রামে উৎকৃষ্ট ‘কোষ’ নৌকা তৈরী হয়। আগরপুরের নিকট ঘণ্টেশ্বরে, এবং পিরোজপুর থানার এলাকায় বর্ষাকাটী গ্রামে ভাল পান্সী নৌকা তৈরী হয়। শেষোক্ত স্থানে উৎকৃষ্ট মালবাহী নৌকাও তৈরী হয়। সুন্দরবনে মগেরা কেরুয়া গাছের গুড়ি হইতে ডিঙী তৈরী করে; শুঁদরী কাঠের ডিঙী সর্বত্রই হয়; ঝালকাঠী, কালিগঞ্জ, বাখরগঞ্জ, ফলাগড় প্রভৃতি স্থানও নৌকা তৈরীর জন্য বিখ্যাত।”
এইরূপে নৌকা তৈরীর কাজ করিয়া বহু লোক জীবিকা নির্বাহ করিত।
আমার বাল্যকালে কোন বাড়ীতে আমি চরকা কাটিতে দেখি নাই। ম্যানচেষ্টারের কাপড় তখনই সুদূর গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল এবং জোলা ও তাঁতিরা তাহাদের মৌলিক বৃত্তি হইতে বিতাড়িত হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ বিলাতী কাপড় বিক্রী করিয়া কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করিত, এবং অন্য অনেকে বাধ্য হইয়া কৃষিকার্য করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। ইহার ফলে জমির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়িয়াছিল।
তখনকার দিনে গ্রাম্য কর্মকার একটা প্রধান কাজ করিত।[৩] তাহার দোকানে সন্ধ্যাবেলা আড্ডা বসিত এবং গ্রামের রাজনীতি আলোচনা হইত। কর্মকার লাঙ্গল, কোদাল, দা, দরজার কব্জা, বড় কাঁটা, তালা প্রভৃতি তৈরী করিত। বাহির হইতে আমদানী লৌহপিণ্ড ও লোহার পাত হইতেই এ সব অবশ্য তৈরী হইত। নাটাগোড়িয়া (কলিকাতার নিকট), ডোমজুড়, মাকড়দহ, বড়গাছিয়া (হাওড়া) প্রভৃতি স্থানে লোহার তালা চাবি তৈরী হইত। কিন্তু জার্মানী হইতে আমদানী সস্তা জিনিষের প্রতিযোগিতায় এই দেশীয় শিল্প লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। শেফিল্ডের ছুরি, কাঁচি প্রভৃতিও এদেশ ছাইয়া ফেলিতেছে। ক্ষুর, ছুরি প্রভৃতি সমস্তই বিদেশ হইতে আমদানী।
চাউলের পরেই গুড় ও চিনি যশোরের সর্বাপেক্ষা প্রধান শিল্প ছিল। খেজুর রস হইতেই প্রধানতঃ গুড় ও চিনি হইত। বর্তমানে জাভা হইতে আমদানী সস্তা চিনির প্রতিযোগিতায় এদেশের চিনি শিল্প লোপ পাইতে বসিয়াছে। কিন্তু এক সময়ে এই চিনি শিল্প যশোরে কিরূপ উন্নতি লাভ করিয়াছিল, ওয়েষ্টল্যাণ্ডের “যশোর” নামক গ্রন্থে (১৮৭১) তাহার চমৎকার বর্ণনা আছে।
“যশোর জেলার সর্বত্রই চিনি তৈরী হয় বটে কিন্তু জেলার পশ্চিম অংশে নিম্নলিখিত স্থানগুলিতেই চিনি তৈরীর বড় কেন্দ্র:—কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, ত্রিমোহিনী, কেশবপুর, যশোর ও খাজুরা এই সব স্থানে চিনি তৈরী হয় ও তথা হইতে বাহিরে রপ্তানী হয়। কলিকাতা ও নলচিটি এই দুই স্থানেই প্রধানতঃ চিনি রপ্তানী হয়। নলচিটি বাখরগঞ্জ জেলার একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। পূর্বাঞ্চলের প্রায় সমস্ত জেলার সঙ্গে ইহার কারবার আছে। এখানে ‘দলুয়া’ চিনির খুব চাহিদা এবং কোটচাঁদপুর ব্যতীত যশোর জেলার অন্যান্য স্থানে উৎপন্ন অধিকাংশ ‘দলুয়া’ নলচিটি ও তাহার নিকটবর্তী ঝালকাটিতে রপ্তানী হয়। কোটচাঁদপুর ব্যতীতও ঐ দুই স্থানে ‘দলুয়া’ চালান হয় বটে, কিন্তু সেখানকার বেশীর ভাগ ‘দলুয়া’ কলিকাতাতেই চালান হয়। কলিকাতায় দুই প্রকার চিনির চাহিদা আছে। প্রথমতঃ, কলিকাতায় বিক্রয়ের জন্য ‘দলুয়া’ চিনি। দ্বিতীয়তঃ, উৎকৃষ্ট পাকা (সাফ) চিনি, ঐগুলি কলিকাতা হইতে ইয়োরোপ ও অন্যান্য স্থানে চালান হয়। এই পাকা বা সাফ চিনি যশোর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে কেশবপুরে ও অন্যান্য স্থানে তৈরী হয়, এবং ‘দলুয়া’ চিনি প্রধানতঃ কোটচাঁদপুরে হয়।”
১৮০০ শত খৃষ্টাব্দে বাংলা দেশে কিরূপে চিনি তৈরী হইত, তাহার একটি সুন্দর বিবরণ নিম্নে উদ্ধৃত হইল:—
“গ্রেট ব্রিটেনে চিনির দাম হঠাৎ বাড়িয়া যায়, উহার কারণ, প্রথমতঃ ওয়েষ্ট ইণ্ডিসে ফসল জন্মে না, এবং দ্বিতীয়তঃ ইয়োরোপের সর্বত্র চিনির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এইভাবে চিনির মূল্য বৃদ্ধি ব্রিটিশ জাতি বিপদরূপে গণ্য করিল। তাহাদের দৃষ্টি তখন বাংলার উপরে পড়িল এবং তাহারা নিরাশ হইল না। অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা হইতে ব্রিটেনে চিনি রপ্তানী হইল। বাংলা হইতে ইয়োরোপে কয়েক বৎসর পূর্বেই চিনি রপ্তানী সুরু হইয়াছিল। এখনও উহা রপ্তানী হইতেছে এবং এই রপ্তানীর পরিমাণ প্রতি বৎসর বাড়িয়া যাইবে ও ইয়োরোপের বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লাভ হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। ওয়েষ্ট ইণ্ডিসও এই লাভের কিয়দংশ পাইবে।
“বেনারস হইতে রংপুর, আসামের প্রান্ত হইতে কটক পর্যন্ত, বাংলা ও তৎসংলগ্ন প্রদেশে প্রায় সকল জেলায় আখের চাষ হয়। বেনারস, বিহার, রংপুর, বীরভূম, বর্ধমান এবং মেদিনীপুরেই আখের চাষ হয়। বাংলা দেশে প্রভূত পরিমাণে চিনি উৎপন্ন হয়। যত চাহিদাই হোক না কেন, বাংলা দেশ তদনুরূপ চিনি যোগাইতে পারে বলিয়া মনে হয়। বাংলার প্রয়োজনীয় সমস্ত চিনি বাংলা দেশেই তৈরী হয় এবং উৎসাহ পাইলে বাংলা ইয়োরোপকেও চিনি যোগাইতে পারে।
“বাংলায় খুব সস্তায় চিনি তৈরী হয়। বাংলায় যে মোটা চিনি বা দলুয়া তৈরী হয়, তাহার ব্যয় বেশী নহে—হন্দর প্রতি পাঁচ শিলিংএর বেশী নয়। উহা হইতে কিছু অধিক ব্যয়ে চিনি তৈরী করা যাইতে পারে। ব্রিটিশ ওয়েষ্ট ইণ্ডিসে তাহার তুলনায় ছয় গুণ ব্যয় পড়ে। দুই দেশের অবস্থার কথা তুলনা করিলে এরূপ ব্যয়ের তারতম্য আশ্চর্যের বিষয় বোধ হইবে না। বাংলা দেশে কৃষিকার্য অতি সরল স্বল্পব্যয়-সাধ্য প্রণালীতে চলে। অন্যান্য বাণিজ্য-প্রধান দেশ হইতে ভারতে জীবনযাত্রার ব্যয় অতি অল্প। বাংলা দেশে আবার ভারতের অন্যান্য সকল প্রদেশ হইতে অল্প। বাঙালী কৃষকের আহার্য ও বেশভূষায় ব্যয় অতি সামান্য, শ্রমের মূল্যও সেই জন্য খুব কম। চাষের যন্ত্রপাতি সস্তা। গো-মহিষাদি পশুও সস্তায় পাওয়া যায়। শিল্পজাত তৈরীর জন্য কোন বহুব্যয়সাধ্য যন্ত্রপাতির দরকার হয় না। কৃষকেরা খড়ের ঘরে থাকে, তাহার যন্ত্রপাতি উপকরণের মধ্যে, একটিমাত্র সহজ যাঁতা, কয়েকটি মাটীর পাত্র। সংক্ষেপে, তাহার সামান্য মূলধনেরই প্রয়োজন হয় এবং উৎপন্ন আখ ও গুড় হইতেই তাহার পরিশ্রমের মূল্য উঠিয়া যায় এবং কিছু লাভও হয়।” কোলব্রুক—Remarks on the Husbandry and Internal Commerce of Bengal, pp. 78—79.
এই কথাগুলি প্রায় ১৩০ বৎসর পূর্বে লিখিত হইয়াছিল এবং যে বাংলাদেশ এক কালে সমস্ত পৃথিবীর বাজারে চিনি যোগাইত তাহাকেই এখন চিনির জন্য জাভার উপর নির্ভর করিতে হয়। উন্নত বৈজ্ঞানিক কৃষি প্রণালীর ফলে কিউবা ও জাভা এখন অত্যন্ত সস্তায় চিনি রপ্তানী করিয়া পৃথিবীর বাজার ছাইয়া ফেলিয়াছে। বর্তমানে (১৯২৮—২৯) জাভা হইতে ভারতে বৎসরে প্রায় ১৫।১৬ কোটী টাকার চিনি আমদানী হয় এবং এই চিনির অধিকাংশ বাংলা দেশই ক্রয় করে। বর্তমান সময়ে চিনি এদেশেই প্রধানতঃ প্রস্তুত হইতেছে, অতিরিক্ত শুল্ক বসাইয়া জাভার চিনি একবারে বন্ধ হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে বাংলার কোন লাভ নাই। এই চিনি বিহার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হইতে আমদানী হয়, সুতরাং বাংলার টাকা বাংলার বাহিরে যায়।
পাট এখন বাংলার, বিশেষতঃ উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের প্রধান ফসল! কিন্তু ১৮৬০ সালের কোঠায় পাট যশোরে অল্প পরিমাণ উৎপন্ন হইত এবং তাহা গৃহস্থের দড়ি, বস্তা প্রভৃতি তৈরী করার কাজে লাগিত। এই সব জিনিষ হাতেই সূতা কাটিয়া তৈরী হইত। ভদ্র পরিবারের পুরুষরাও অবসর সময়ে পাটের সূতা বোনা, দড়ি তৈরী প্রভৃতির কাজ করিত। বাজারে পাটের দর ছিল ১৷০ মণ। কিন্তু পাটের চাষ ক্রমশঃ বাড়িয়া যাওয়াতে বাংলার আর্থিক অবস্থার ঘোর পরিবর্তন ঘটিয়াছে।
উত্তর বঙ্গের রংপুর প্রভৃতি জেলায় “পাটের সূতা কাটা ও বোনা খুব প্রচলিত ছিল। উহা হইতে গৃহস্থের ব্যবহারোপযোগী বিছানার চাদর, পর্দা, গরীব লোকদের পরিচ্ছদ প্রভৃতি তৈরী হইত। ১৮৪০ সালের কোঠায়, কলিকাতা হইতে উত্তর আমেরিকা ও বোম্বাই বন্দরে তুলার গাঁইট বাঁধিবার জন্য চট রপ্তানী হইত; কিন্তু চিনি ও অন্যান্য জিনিষ রপ্তানী করিবার জন্য বস্তা তৈরীর কাজেই পাট বেশী লাগিত।”
ডাঃ ফরবেশ রয়েল তাঁহার “Fibrous Plants of India” (১৮৫৫ খৃঃ প্রকাশিত) নামক গ্রন্থে হেন্লি নামক জনৈক কলিকাতার বণিকের নিকট হইতে প্রাপ্ত নিম্নলিখিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই বর্ণনা হইতে বুঝা যায়, পাট শিল্প বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্প হইয়া উঠিয়াছিল এবং এখানকার হাতে বোনা চট ও বস্তা পৃথিবীর দেশ দেশান্তরে রপ্তানী হইত।
“পাট হইতে যে সমস্ত জিনিষ তৈরী হইত, তাহার মধ্যে চট ও চটের বস্তাই প্রধান। নিম্ন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলির ইহাই সর্বাপেক্ষা প্রধান গার্হস্থ্য শিল্প। সমাজের প্রত্যেক সম্প্রদায় ও প্রত্যেক গৃহস্থই এই শিল্পে নিযুক্ত থাকিত। পুরুষ, স্ত্রীলোক, বালক, বালিকা সকলেই এই কাজ করিত। নৌকার মাঝি, কৃষক, বেহারা, পরিবারের ভৃত্য প্রভৃতি সকলেই অবসর সময়—এই শিল্পে নিযুক্ত করিত। বস্তুতঃ, প্রত্যেক হিন্দু গৃহস্থই অবসর সময় টাকু হাতে পাটের সূতা কাটিত। কেবল মুসলমান গৃহস্থেরা তুলার সূতা কাটিত। এই পাটের সূতা কাটা ও চট বোনা হিন্দু বিধবাদের একটা প্রধান কাজ ছিল। এই হিন্দু বিধবারা অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, বিনম্র, চিরসহিষ্ণু; আইন তাহাদিগকে চিতার আগুণ হইতে রক্ষা করিয়াছে বটে, কিন্তু সমাজ তাহাদিগকে অবশিষ্ট কালের জন্য অভিশপ্ত সন্ন্যাসিনী জীবন যাপন করিতে বাধ্য করিয়াছে। যে গৃহে একদিন সে হয়ত কর্ত্রী ছিল, সেই গৃহেই এখন সে ক্রীতদাসী। এই পাট শিল্পের কল্যাণেই তাহাদিগকে পরের গলগ্রহ হইতে হইতেছে না। ইহা তাহাদের অন্ন সংস্থানের প্রধান উপায়। পাট শিল্পজাত যে বাংলায় এত অল্প ব্যয়ে প্রস্তুত হয়, এই সমস্ত অবস্থাই তাহার প্রধান কারণ এবং মূল্য সুলভ হওয়াতেই বাংলার পাট শিল্পজাত সমস্ত পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।” Wallace: The Romance of Jute.
ইহা হইতে বুঝা যাইবে যে, হাতে তৈরী পাট শিল্প বাংলার কৃষক ও গৃহস্থদের একটি প্রধান গৌণ শিল্প ছিল। ১৮৫০—৫১ সালে কলিকাতা হইতে ২১,৫৯,৭৮২ টাকার চট ও বস্তা রপ্তানী হইয়াছিল।
বাংলার পাট এখন চাউলের পরেই প্রধান কৃষিজাত পণ্য। কিন্তু বাঙালীদের ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যর্থতা ও অক্ষমতার দরুণ, পাট হইতে যে প্রভূত লাভ হয়, তাহার বেশীর ভাগই ইয়োরোপীয়, আর্মানী বা মাড়োয়ারী বণিকদের উদরে যায়।[৪]
প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ একজন বিদেশী পাঠক হয় ত মনে করিতে পারে, ব্যবসায়ীদের এই বিপুল লাভের টাকাটা বাঙালীরাই পায়। কিন্তু তাহা সত্য নহে। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, পাটের কল কোম্পানীগুলির অধিকাংশ অংশীদার ভারতবাসী। তাহারা ভারতবাসী বটে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালী নয়। অবশ্য, একথা অস্বীকার করা যায় না যে, পাট বিক্রয়ের টাকার একটা প্রধান অংশ কৃষকেরাও পায়। যে সব জমিতে পূর্বে কেবল ধান চাষ হইত, সেই সব জমিতে—বিশেষভাবে ত্রিপুরা, ময়মনসিং, ঢাকা, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায়—এখন পাট উৎপন্ন হয়। যেখানে যত জমি পাওয়া যায়, তাহা এই পাটচাষের কাজে লাগানো হইতেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, গোচারণ তথা দুগ্ধ সরবরাহের পক্ষে ইহা অত্যন্ত ক্ষতিকর হইতেছে।
বাংলার কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উপর পাট যেরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহা পানাণ্ডিকরের Wealth and Welfare of the Bengal Delta নামক গ্রন্থে সুন্দররূপে বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার যে বিষয়টি নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা করিয়াছেন, তাহা বর্ণনা হইতে সহজেই বুঝা যায়।
“বাংলায় পাটচাষের বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বাজারে পাটের চাহিদা বাংলার লোকদের পক্ষে প্রভূত কল্যাণকর হইত, যদি তাহারা বুদ্ধিমান ও হিসাবী হইত এবং এই লাভের টাকা হইতে দেনা শোধ, জমির উন্নতি, পথঘাটের উন্নতি এবং জীবনযাত্রার আদর্শ উন্নত করিতে পারিত। তাহাদের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য সামান্য কিছু বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু বেশীর ভাগ টাকাই মামলা মোকদ্দমায়, নানারূপ বিলাসব্যসনে এবং বাহির হইতে মঞ্জুর আমদানী করিয়া তাহাদের খরচা বাবদ তাহারা অপব্যয় করিয়া ফেলিয়াছে। কৃষকেরা বিলাসী ভদ্রলোক হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং আলস্যে সময় কাটাইতে শিখিয়াছে। তাহারা আর নিজে মাটীর কাজ করে না, ধান ও পাট কাটে না, জলে পাট ডুবায় না, ক্ষেত হইতে শস্য বাড়ীতে লইয়া যায় না; এই সমস্ত কাজের জন্য তাহারা বিহার ও যুক্তপ্রদেশ হইতে আগত মজুরদের নিয়োগ করিতেছে। ইহার ফলে মজুরের চাহিদা ও মূল্য বাড়িয়া গিয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে চাষের খরচাও বাড়িয়া গিয়াছে। এইভাবে কৃষকদের লাভের একটা মোটা অংশ একদিকে উকীল মোক্তার, অন্যদিকে হিন্দুস্থানী মজুরদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। বর্তমানে ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা হওয়ার দরূণ কৃষিজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস পাইয়াছে। কিন্তু কৃষকেরা একবার যে মজুর খাটাইবার অভ্যাস করিয়া ফেলিয়াছে, তাহা আর ছাড়িতে পারিতেছে না[৫], এখনও তাহারা বাহিরের মজুর সমভাবেই খাটাইতেছে। যদি এইভাবে চাষের খরচা না বাড়িয়া যাইত, তবে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস হওয়া সত্ত্বেও চাষীদের যথেষ্ট লাভ থাকিত।”
পাঁচ বৎসরের হিসাব ধরিয়া দেখা গিয়াছে যে, বাংলাদেশে উৎপন্ন পাটের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৪ কোটী ৭৫ লক্ষ মণ। বাংলাদেশের লোকসংখ্যাও প্রায় ৪ কোটী ৭৫ লক্ষ। সুতরাং মাথাপিছু গড়ে বার্ষিক এক মণ পাট উৎপন্ন হয়; প্রতি মণ পাটের মূল্য প্রায় আট টাকা।[৬] স্যার ডি. এম. হ্যামিলটন ১৯১৮ সালে কলিকাতায় একটি বক্তৃতা করেন, এই প্রসঙ্গে তাহা হইতে আমি কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি। তিনি বলেন:—“আমার কয়েকটি পাটকলের অংশ আছে, সেই হিসাবে আমি পাট উৎপন্নকারী কৃষকদের মুখের দিকে চাহিতে লজ্জা বোধ করি। আমরা শতকরা ১০০ ভাগ লাভ করিব। আর ঐ কৃষকেরা কোনরূপ ব্যাঙ্কের ব্যবস্থার অভাবে, দুর্দিনে না খাইয়া মরিবে, ইহা ব্রিটিশ বিচার বুদ্ধি ও ন্যায়ের আদর্শ সম্মত নহে। ডাণ্ডির মহাজনদের বিবেকের অভাবই ইহাতে সূচিত হইতেছে। কিন্তু পাট উৎপাদনকারী কৃষকেরা আজ যে দুর্গতি ভোগ করিতেছে, ভারতের জনসাধারণ দিনের পর দিন জীবনের আরম্ভ হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সেই দুর্গতি ভোগ করে। এই অবস্থা আর বেশীদিন সহ্য করা যাইতে পারে না, এবং এতদিন যে সহা করা হইয়াছে, ইহা ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে সুনাম নহে। ভারতের অধিবাসীরা এইভাবে চির অভাবগ্রস্ত হইরা ও ঋণের পাথর গলায় বাঁধিয়া, দেহ ও আত্মা কোন কিছুর উন্নতি করিতে পারিবে, এরূপ চিন্তা করাই মূর্খতা।”
১৯২৫—২৬ সালে পাটের মূল্য খুব বেশী চড়িয়া গিয়াছিল, তাহার পর দুই বৎসর পাটের মূল্য অস্বাভাবিকরূপে কমিয়া গিয়াছে। ফলে পাটচাষীদের অত্যন্ত দুর্গতি হইয়াছে। পাট চাষ অনেক স্থলে ধান চাষের স্থল অধিকার করিয়াছে। সুতরাং পূর্ব বঙ্গের চাষীরা তাহাদের খাদ্যশস্য খরিদ করিবার জন্য শতকরা বার্ষিক ২৫৲ টাকা হইতে ৩৭॥০ টাকা সুদে ঋণ করিতে বাধ্য হয়। দুর্দিনের জন্য যে সঞ্চয় করিতে হয়, এ শিক্ষা কখনও তাহাদের হয় নাই।[৭] পূর্বে হঠাৎ পাটের দর চড়িয়া ধনাগম হওয়াতে পূর্ব বঙ্গের কৃষকদের মানসিক স্থৈর্য নষ্ট হইয়াছে। ফলে শিয়ালদহ ষ্টেশন ও জগন্নাথ ঘাট রেলওয়ে ষ্টেশনের গুদাম ঘর (কলিকাতায়) করোগেট টিন, বাইসাইকেল, গ্রামোফোন, নানারূপ বস্ত্রজাত, জামার কাপড় প্রভৃতিতে ভর্তি হইয়া উঠিতেছে। গ্রামবাসী কৃষকেরা এই সব খেলনা, পুতুল, সখের জিনিষ কিনিবার জন্য যেন উন্মত্ত। জাপানী বা কৃত্রিম রেশমের চাদর প্রতি খণ্ডের মূল্য ৭৲ টাকা; এদেশের সাধারণ ভদ্রলোকেরাও এগুলি ব্যয়সাধ্য বিলাসদ্রব্য বলিয়া কিনিতে ইতস্ততঃ করেন, কিন্তু এগুলি বাংলার বাজার ছাইয়া ফেলিতেছে এবং গ্রাম্য কৃষকেরা কিনিতেছে। ছেলেরা যেমন নূতন কোন রঙীন জিনিষ দেখিলেই তাহা কিনিতে চায়, আমাদের কৃষকদের অবস্থাও সেইরূপ। সুদূর পল্লীতেও জার্মানীর তৈরী বৈদ্যতিক ‘টর্চ্চ’ খুব বিক্রয় হইতেছে। তাহারা এগুলি ব্যবহার করিতে জানে না, ফলে ভিতরকার ব্যাটারী একটু খারাপ হইলেই উহা ফেলিয়া দেয়।
এদেশের কৃষকেরা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাহাদের দৃষ্টি অতি সঙ্কীর্ণ, এক হিসাবে তাহারা “কালকার ভাবনা কাল হইবে”—যীশু খৃষ্টের এই উপদেশবাণী পালন করে। তাহারা ভবিষ্যতের জন্য কোন সংস্থান করে না। ঘরে যতক্ষণ চাল মজুত থাকে, ততক্ষণ সেগুলি না উড়াইয়া দেওয়া পর্যন্ত তাহাদের মনে যেন শান্তি হয় না। মনোহর বিলাতী জিনিষ দেখিলেই তাহাদের কিনিবার প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া উঠে। বেপারীরা সর্বদাই তাহাদের কানের কাছে টাকা বাজাইতে থাকে, সুতরাং তাহারা তাহাদের কৃষিজাত বিক্রয় করিয়া ফেলিবার প্রলোভন ত্যাগ করিতে পারে না। অনেক সময় এই সব সখের বিলাতী জিনিষ কিনিবার জন্য তাহারা তাহাদের গোলার ধান প্রভৃতিও বিক্রয় করিয়া ফেলে। পূর্বে কৃষকেরা চলতি বৎসরের খোরাকী তো গোলায় মজুত রাখিতই, অজন্মা প্রভৃতির আশঙ্কায় আরও এক বৎসরের জন্য শস্যাদি সঞ্চয় করিয়া রাখিত। বর্তমানে, কৃষকদের মধ্যে শতকরা পাঁচ জনও বৎসরের খাদ্যশস্য মজুত রাখে কি না সন্দেহ, রাখিবার ক্ষমতাও তাহাদের নাই। অবশিষ্ট শতকরা ৯৫ জনই ঋণজালে জড়িত। জমিদার ও মহাজনের কাছে তাহারা চিরঋণী হইয়া আছে।
আমি বাংলার ষাট বৎসর পূর্বেকার গ্রাম্য জীবনের যে বর্ণনা করিলাম, বর্তমান অবস্থার কথা বর্ণনা না করিলে, তাহা সম্পূর্ণ হইবে না। জাতীয় আন্দোলনের ফলে উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার অনেক স্থলেই গত কয়েক বৎসর আমি ভ্রমণ করিয়াছি; খুলনা, রাজসাহী ও বগুড়ার দুর্ভিক্ষ ও বন্যা সাহায্য কার্যের জন্যও অনেক স্থলে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে। সুতরাং বাংলার আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার আমার যথেষ্ট সুযোগ ঘটিয়াছে।
পূর্ব বঙ্গের প্রায় প্রত্যেক বড় বড় নদীতেই ডাক ষ্টীমার চলে, সুন্দরবন ও আসাম ডেসপ্যাচ ডাক, যাত্রী ও মাল প্রভৃতি বহন করিয়া থাকে। অনেক স্থলে ইহার সঙ্গে রেলওয়ে সার্ভিসও আছে। পূর্বে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল হইতে নৌকাযোগে কলিকাতায় আসিতে হইলে প্রায় পনর দিন সময় লাগিত। মালবাহী নৌকায় আসিলে আরও বেশী দিন লাগিত। কিন্তু এখন এই সব স্থানে সহজে ও অল্প সময়ে যাতায়াত করা যায়। কলিকাতা হইতে চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ও ঢাকায় ১৪।১৫ ঘণ্টায় যাওয়া যায়। কোন অর্থনীতির ছাত্র, যে বাংলার আভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রার খবর রাখে না, সে উল্লাসের সঙ্গে বলিবে যে, ইহার ফলে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়িয়া গিয়াছে, জাতির ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পাইয়াছে; কিন্তু ইহার অন্তরালে যে দারিদ্র্য ও দুর্দশার ইতিহাস আছে, তাহা সে চিন্তা করে না।
বস্তুতঃ, আমাদের শাসকেরা নানা তথ্য সহকারে লোকের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির কথা সর্বদাই প্রমাণ করিতে ব্যস্ত। অর্থনীতিবিদেরা তাঁহাদের সেই পুরাতন বুলি আওড়াইয়া বলেন যে, দ্রুতগামী যানবাহনের ফলে রপ্তানীবাণিজ্য বৃদ্ধি পাইয়াছে, অতএব লোকের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হইতেছে। তাহাদের হিসাব মত অতিরিক্ত কৃষিজাত বিক্রয় করিয়া কৃষকদের এখন বেশ লাভ হয়।
ইহার উত্তর স্বরূপে আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডার্লিং-এর অভিমত উদ্ধৃত করিতেছি। ডার্লিং বলেন,—“যাহা সহজে পাওয়া যায়, তাহা সহজেই নষ্ট হয়। সুতরাং কৃষকদের নব লব্ধ ঐশ্বর্যের অনেকখানিই তাহাদের হাত গলিয়া অন্যের পকেটে যায়। ত্রিশ বৎসরে কৃষকদের ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটী টাকা বাড়িয়া গিয়াছে এবং এখনও বৃদ্ধি পাইতেছে।”—The Punjab Peasant, p. 283.
কৃষকদের আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও, তাহাদের দারিদ্র্য ক্রমেই কিরূপ বৃদ্ধি পাইতেছে, তৎসম্বন্ধে মেমনও বলিয়াছেন,—
“ইহা খাঁটী সত্য কথা যে, ৫০ বৎসর পূর্বে যদিও যশোরের কৃষকদের ভাল বাড়ী ছিল না, ভাল পোষাক ছিল না, তবু তাহারা দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইত; তাহাদের আয় অল্প ছিল বটে, কিন্তু ব্যয়ও সামান্য ছিল। তাহারা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য উৎপন্ন করিত, এবং নগদ টাকার জন্য তাহারা ব্যস্ত হইত না, অথবা এখনকার মত সস্তা বিলাসদ্রব্য কিনিত না। তাহাদের আয়বৃদ্ধি হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা নামে মাত্র, ইহা সত্যকার আয় নহে; কেননা তাহাদের মধ্যে শতকরা ৫০ জনই অত্যাবশ্যকীয় জিনিষের জন্য ব্যতীত মোটেই ধান বিক্রয় করিতে পারে না, সুতরাং শস্যের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার দরুণ তাহাদের কোনই লাভ হয় না। পক্ষান্তরে তাহাদের জীবনযাত্রার আদর্শ উচ্চতর হইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়িয়াছে এবং তাহাদের আয় হইতে সর্বপ্রকার অভাব পূরণ না হওয়াতে, ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে।” (কৃষি কমিশনের রিপোর্ট, ৩২৮ পৃঃ)
মিঃ ডার্লিং-এর হিসাব অনুসারে ভারতের কৃষকদের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০০ শত কোটী টাকা। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যাঙ্কিং তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে (১৯৩০—৩১) কেবলমাত্র বাংলাদেশের গ্রামবাসী কৃষকদের ঋণের পরিমাণ ৯৩ কোটী টাকা। উক্ত রিপোর্ট হইতে নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত করিবার যোগ্য:—
“মহাজনদের সুদের হার শতকরা ৫॥০ টাকা হইতে শতকরা ৩০০ টাকা পর্যন্ত। ঋণের পরিমাণ, বন্ধকীর প্রকৃতি, ঋণ দেওয়ার জন্য মূলধন সুলভ কি না ইত্যাদি বিষয়ের উপর সুদের হার নির্ভর করে। অধিকাংশ ঋণের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হয়, এবং ৬ মাস পরে চক্রবৃদ্ধি হয়, কোন কোন স্থলে ৩ মাস পরেই চক্রবৃদ্ধি হয়। এই প্রদেশের (বাংলায়) প্রত্যেক জেলার মহাজনী ব্যবসা বহুলভাবে প্রচলিত। ইহার মূলে নানা কারণ আছে, যথা—খাতকদের শোচনীয় আর্থিক অবস্থা, মূলধন যোগাইবার মত অন্য কোন লোকের অভাব, মহাজনদের মূলধনের স্বল্পতা, সমবায় সমিতি ও লোন অফিস সমূহে প্রয়োজন মত টাকা ধার দিবার অক্ষমতা, খাতকদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা, ইত্যাদি।”
উন্নত প্রণালীর যানবাহনের ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইয়াছে। ইহা যে দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষে অবিমিশ্র কল্যাণকর হয় নাই, তাহা নিঃসন্দেহ প্রমাণিত হইয়াছে। মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড বলেন:—
“রেলওয়েগুলি অবস্থা আরও জটিল করিয়া তুলিয়াছে, দুর্ভিক্ষের এলাকা বৃদ্ধি করিয়াছে।.......এক একটি ফার্ম গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সূর্যের মত সমস্ত শুষিয়া নেয়, পড়িয়া থাকে নীরস মরভূমি। ফসলের দুই এক সপ্তাহ পরেই, ভারতের উদ্বৃত্ত গম ও চাল কারবারীদের হাতে চলিয়া যায় এবং পর বৎসর যদি অনাবৃষ্টি হয়, তবে কৃষক না খাইয়া মরে।”—Awakening of India, P. 165.
মিঃ হোরেস বেল এক সময়ে ষ্টেট রেলওয়ে সমূহের জন্য ভারত গবর্ণমেণ্টের কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ১৯০১ সালে সোসাইটি অব আর্টসে পঠিত একটি প্রবন্ধে তিনি ঠিক এই কথাই বলিয়াছেন। ১৮৭৮ সালে স্যার জর্জ ক্যাম্বেলও বলেন,—
“চলাচলের ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে খাদ্য শস্যাদি সমস্ত রপ্তানী হইয়া যাইতেছে, এবং শস্য সঞ্চয় করিয়া রাখিবার পুরাতন অভ্যাস লোপ পাইয়াছে। এই অভ্যাসই পূর্বে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ স্বরূপ ছিল।”
বিশ বৎসর পরে ১৮৯৮ সালে দুর্ভিক্ষ কমিশনও এই মত সমর্থন করিয়াছেন,—“রপ্তানী বাণিজ্যের প্রসার এবং চলাচলের উন্নততর ব্যবস্থা শস্য সঞ্চয় করিয়া রাখিবার প্রবৃত্তি হ্রাস করিয়াছে। অজম্মার বিরূদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় স্বরূপ এই প্রথা পূর্বে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল।”
সুতরাং স্পষ্টই দেখা যাইতেছে রেলওয়ে দ্বারা ভারতে দুর্ভিক্ষ নিবারিত হয় নাই। বস্তুতঃ, আনুষঙ্গিক আত্মরক্ষার উপায় ব্যতীত, রেলওয়ের দ্বারা অবিমিশ্র কল্যাণ হয় না। কিন্তু এক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা তোতাপাখীর মত ক্রমাগত আবৃত্তি করিয়া থাকেন যে, রেলওয়ে ভারত হইতে দুর্ভিক্ষ দূরীভূত করিয়াছে।[৮]
মিঃ র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড যথার্থই বলিয়াছেন যে, রেলওয়ে দুর্ভিক্ষের এলাকা বৃদ্ধি করিয়াছে। আর একটা কথা। পূর্বে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য রায়ত ও গ্রামবাসীরা বিবাদ বিসম্বাদে গ্রামের মাতব্বরদের সালিশীতেই সন্তুষ্ট থাকিত। কিন্তু এখন তাহারা রেল, মোটর বাস ও দ্রুতগামী ষ্টীমারে জেলা ও মহকুমা সহরে মামলা মোকদ্দমা করিতে ছুটে, বাংলাদেশে বহু সংখ্যক লাইট রেলওয়ে ও তৎসংসৃষ্ট ষ্টীমার সার্ভিস মামলাবাজদের অর্থে পুষ্ট হইতেছে। সুতরাং চলাচলের উন্নত ব্যবস্থা রায়তদের অবস্থার উন্নতি করিয়াছে বৈ কি!!
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, পূর্বে আমাদের গ্রাম্য জীবনে যে উৎসাহ ও জীবনের স্পন্দন ছিল, তাহা এখন লোপ পাইয়াছে। পক্ষী ও মৎস্যদের মধ্যে জীবনের যে সহজ সরল আনন্দ দেখা যায়, পূর্বে আমাদের গ্রামবাসীদের মধ্যেও সেইরূপ আনন্দের প্রাচুর্য ছিল। তরুণেরা জাতীয় ক্রীড়া কৌতুকে যোগদান করিত। জন্মাষ্টমী উৎসবে কুন্তী, মল্লক্রীড়া প্রভৃতি হইত, কুস্তীগীরেরা তাহাতে যোগ দিত। অমৃতবাজার পত্রিকা সেই অতীত গ্রাম্য জীবনের একটি সুন্দর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন:—
“ম্যালেরিয়া, কলেরা ও কালাজ্বর গ্রামকে তখন ধ্বংস করিত না। দারিদ্র্য (যাহার কারণ সুবিদিত) তখন লোককে কঙ্কালসার, নিরানন্দ করিয়া তুলিত না। বিদেশী ভাষায় লিখিত পুস্তকের চাপে এবং অসঙ্গত পরীক্ষাপ্রণালীর ফলে, তরুণ বয়স্কেরা শিশুকাল হইতে এইভাবে নিষ্পেষিত হইত না। প্রত্যেক গ্রামে আখড়া ছিল এবং সেখানে লোকে নিয়মিত ভাবে কুস্তী, লাঠিখেলা, অসিক্রীড়া ও ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করিত; অন্যান্য শারীরিক ব্যায়ামও শিখিত। বৎসরে অন্ততঃ দুইবার—দুর্গাপূজা ও মহরমের সময়,—বড় রকমে, খেলাধূলা ও ব্যায়াম প্রদর্শনী হইত। স্ত্রী পুরুষ সকলেই সানন্দে এই উৎসবে দর্শকরূপে যোগদান করিত। আমাদের বড়লোকেরা এখন মোটর গাড়ী ও কুকুরের জন্য জলের মত অর্থ ব্যয় করিয়া আনন্দলাভ করেন। কিন্তু সেকালে স্বতন্ত্র প্রথা ছিল। বড়লোকেরা পালোয়ান ও কালোয়াতদের পোষণ করা কর্তব্যজ্ঞান করিতেন। সুতরাং পূর্বকালে ধনীদের বাসভূমি যে সঙ্গীত ও মল্লবিদ্যার কেন্দ্রস্থান ছিল, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। লোকে কালোয়াত ও পালোয়ানদের ভালবাসিত ও শ্রদ্ধা করিত।
“বর্তমানে এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে। পাঞ্জাব এবং যুক্তপ্রদেশের কোন কোন অঞ্চল ব্যতীত অন্যত্র পালোয়ানদের সংখ্যা অতি সামান্য। লোকে তাহাদের বড় একটা খাতিরও করে না। বাংলাদেশের অবস্থা আরও শোচনীয়। এখানে লোকের ধারণা যে, পালোয়ানেরা গুণ্ডা, এবং দারোয়ান শ্রেণীর লোকেরাই ডন বৈঠক কুস্তী প্রভৃতি করিয়া থাকে। সুতরাং বাংলার লোকেরা এরূপ অক্ষম ও দুর্বল হইবে এবং যাহারা জোর করিয়া তাহাদের ধনপ্রাণের উপর চড়াও করিবে, তাহাদেরই পদতলে পড়িবে, ইহা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে।”
বাংলার গ্রামবাসী ধীবরদের মধ্যে, দুই একখানি করিয়া “মালকাঠ” থাকিত[৯] তাহারা মাটী হইতে এগুলিকে ঊর্ধ্বে তুলিবার জন্য সকলকে বল পরীক্ষায় আহ্বান করিত। প্রত্যেক গ্রামেই এইরূপ দুই একখানি “মালকাঠ” থাকিত। বসন্তাগমে এবং চড়ক উৎসবে যাত্রার[১০] দল গঠিত হইত এবং সঙ্গীত সম্বন্ধে যাহার একটু জ্ঞান থাকিত, সেই ঐ সব দলে ভর্তি হইতে পারিত। জাতিধর্মের ভেদ লোকে এ সময় ভুলিয়া যাইত। আমার বেশ স্মরণ আছে,—নিরক্ষর মুসলমান কৃষকদেরও এই সব যাত্রার দলে লওয়া হইত। আমার পিতা ভাল বেহালা বাজাইতে পারিতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামের ভাল ভাল গায়কদের নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইতেন। তাঁহার বিচারে যাহাদের গান ভাল উৎরাইত, তাহারা তাঁহার বৈঠকখানায় সসম্মানে স্থান পাইত, এবং সেখানে বসিয়া নিজেদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করিত! এখনও সেই বেহালা, সেতার প্রভৃতির সুর যেন আমার কানে ভাসিয়া আসিতেছে। স্মরণাতীত কাল হইতে বাংলাদেশে “বার মাসে তের পার্বণ” হইত এবং সর্ব প্রধান জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজার কথা আমার এখনও মনে আছে; দুর্গাপূজা যতই নিকটবর্তী হইত, ততই লোকের মনে কি আনন্দের স্পন্দন হইত! প্রচুর পরিমাণে মিষ্টান্ন তৈরী হইত এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে আমাদের প্রজাদের মধ্যে, উহা অকাতরে বিতরণ করা হইত নিমন্ত্রিত অতিথিদের ভূরিভোজন করান হইত। রাত্রে যাত্রা অভিনয় হইত—তখন পর্যন্ত সুদূর গ্রামে থিয়েটারের আবির্ভাব হয় নাই। দশ বার দিনে আমোদ প্রমোদে মাতিয়া উঠিতাম, তারপর বিসর্জনান্তে বিষাদভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ী ফিরিতাম। কপোতাক্ষ নদীর তীরে যাঁহার জন্মভূমি সেই কবি (মাইকেল মধুসূদন দত্ত) এই পূর্বস্মৃতি হইতেই লিখিরাছিলেন,—
‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে।’ হায়, কাল আমাদের মনের কি ঘোর পরিবর্তনই সাধন করিয়াছে।
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত আমিও অনুভব করি—“এমন এক সময় ছিল, যখন মাঠ, বন, নদী, পৃথিবীর সমস্ত সাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যই আমার নিকট স্বর্গীয় আলোকে প্রতিভাত হইত। স্বপ্নের মাধূর্য ও গৌরবে তাহা যেন মণ্ডিত বোধ হইত। কিন্তু এখন আর অতীতের সে ভাব নাই। দিনে বা রাত্রে যখনই যে দিকে চাই, যে দৃশ্য পূর্বে একদিন দেখিয়াছি, এখন আর তাহা দেখিতে পাই না!
★ ★ ★ ★
“হায়, সেই স্বপ্নময় দৃশ্য কোথায় গেল? অতীতের সেই মাধুর্য ও গৌরব কোথায় অন্তর্হিত হইল?”
- ↑ নবাবী আমল—কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়।
- ↑ পূর্বাবস্থার তুলনায় বাংলায় গোজাতির কিরূপ অবনতি এবং দুধের অভাব ঘটিয়াছে, তাহার প্রমাণ স্বরূপ নিম্নোদ্ধৃত বিবরণী উল্লেখ করা যাইতে পারে।
“বাংলার অধিকাংশ জেলার গোচর জমি বলিয়া কিছু নাই। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির দরুণ জমিদারেরা প্রায় সমস্ত কর্ষণযোগ্য জমিই প্রজাদের নিকট বিলি করিয়াছেন এবং এগুলিতে চাষ হইতেছে।......অধিকাংশ গ্রামে গরুগুলিকে ক্ষেতে, আমবাগানে অথবা পকুরের ধারে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। সেখানে তাহারা কোন রকমে চরিয়া খায়। গরুর খাদ্যশস্য বাংলা দেশে চাষ করা হয় না বলিলেই হয়।” মোমেন,—কৃষি কমিশনে সাক্ষ্য। - ↑ লালবিহারী দে তাঁহার Bengal Peasant Life গ্রন্থে গ্রাম্য কর্মকারের নিম্নলিখিতরূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—
“কুবের ও তাহার পুত্র নন্দ সমস্ত দিন কার্যে নিরত থাকে, এবং রাত্রি দ্বিপ্রহরের পূর্বে তাহারা বিশ্রাম নেয় না। দিনের বেলায় তাহাদের নিকটে যাহারা কাজের জন্য আসে, তাহারা অবশ্য সন্ধ্যার পর থাকে না। কিন্তু বন্ধু বান্ধবেরা ঐ সময় আলাপ করিতে আসে। কিন্তু বন্ধুরা থাকুক আর না থাকুক, পিতা ও পুত্র তাহাদের কাজে কখনো অমনোযোগী হয় না। পিতা ও পুত্র উভয়েই আগুণে পোড়া একখণ্ড লাল লোহা লইয়া হাতুড়ী দিয়া পিটিতে থাকে এবং চারিদিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াইতে থাকে।” - ↑ অনুসন্ধানে জানা যায় যে, পাটের মূল্য হইতে প্রায় ১২ই কোটী টাকা এই সব ব্যবসায়ীদের হাতে যায়।
- ↑ Cf. Renan—Habits of Idleness.
- ↑ বর্তমানে (জুন, ১৯৩২) গ্রাম অঞ্চলে পাট ২॥০ টাকা মণ দরে বিক্রয় হইতেছে।
- ↑ “সাধারণতঃ, রায়তদের যখন সুযোগ ও সুবিধা থাকে, তখনও তাহারা অর্থ সঞ্চয় করিতে পারে না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ১৯২৫ সালে পাটের দর চড়া ছিল, এবং রায়তেরা ইচ্ছা করিলে ঋণ শোধ করিতে পারিত। কিন্তু তাহারা সে সুযোগ গ্রহণ করে নাই, সমস্ত টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছিল। কৃষি কমিশনের রিপোর্ট,—ভারতীয় পাটকল সমিতির সাক্ষ্য।
- ↑ কিন্তু সরকারী বিবরণ অনুসারে—রেলওয়ে দেশ হইতে দুর্ভিক্ষ দূর করিয়াছে। যথা,—“পূর্বে যে সব প্রেতমূর্তি ভারতীয় কৃষকদের পশ্চাদনুসরণ করিত, এখন তাহার একটি সৌভাগ্যক্রমে পরাস্ত হইয়াছে, দুর্ভিক্ষ এখন আর পূর্বেকার মত ভয়াবহ নহে—রেলওয়ে, খাল এবং ভারতগবর্ণমেণ্টের সতকর্তা, নানারূপ কার্যকরী উপায়ের ফলেই ইহা সম্ভবপর হইয়াছে। কোটম্যান, ইণ্ডিয়া ১৯২৬—২৭।
- ↑ মল্লকাষ্ঠ বড় একটি গাছের গুঁড়ির খণ্ড বিশেষ।
- ↑ যাত্রা সম্বন্ধে পাঠক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পুস্তিকা (লণ্ডন, ১৮৮২) দেখিতে পারেন।