বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

নবযুগের আবির্ভাব—বাংলাদেশে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা—

ভারতবাসীদিগকে উচ্চতর শিক্ষাবিভাগ হইতে বহিষ্করণ

 জগদীশচন্দ্র বসু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ বি, এ উপাধিধারী। ১৮৮০ সালে তাঁহার পিতা তাঁহাকে বিলাতের প্রসিদ্ধ বিদ্যাপীঠ কেম্‌ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভার্থ প্রেরণ করেন। সেখানে জগদীশচন্দ্র লর্ড র‍্যালের পদতলে বসিয়া বিজ্ঞান অধ্যয়নের সংযোগ লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিলে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ-বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। স্যার জন ইলিয়ট পদার্থ-বিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। তারপর বার বৎসরের মধ্যে অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের নাম জগত জানিতে পারে নাই। তাঁহার ছাত্রেরা অবশ্য তাঁহার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগগুলি দেখিয়া মুগ্ধ হইতেন। কিন্তু তিনি এই সময়ে চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন না। তাঁহার শক্তিশালী প্রতিভা নূতন সত্যের সন্ধানে নিযুক্ত ছিল এবং হার্জিয়ান বিদ্যুৎতরঙ্গ সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়াছিলেন। ১৮৯৫ সালে এসিয়াটিক সোসাইটিতে The Polarisation of Electric Ray by a Crystal বিষয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। মনে হয়, এই নূতন গবেষণার মূল্য তিনি তখনও ভাল করিয়া বুঝিতে পারেন নাই। এই প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত করিয়া লর্ড র‍্যালে ও লর্ড কেলভিনের নিকট প্রেরিত হয়। পদার্থ-বিজ্ঞানের এই দুই বিখ্যাত আচার্য বসুর গবেষণার মূল্য বুঝিতে পারেন এবং লর্ড র‍্যালে “ইলেক্‌ট্রিসিয়ান” পত্রে উহা প্রকাশ করেন। লর্ড কেলভিনও বসুর উচ্চপ্রশংসা করিয়া মন্তব্য প্রকাশ করেন। এই সময়ে আমিও ‘মার্কিউরাস নাইট্রাইট’ সম্বন্ধে নূতন আবিষ্কার করি এবং ঐ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ ১৮৯৫ সালে এসিয়াটিক সোসাইটিতে প্রেরিত হয়।

 পর্বেই বলিয়াছি—বসু সম্পূর্ণ অজ্ঞাতপূর্ব একটি আবিষ্কার করিয়াছিলেন এবং প্রথম পথপ্রদর্শকের ন্যায় প্রভূত খ্যাতিও লাভ করিয়াছিলেন। তিনি এই বিষয়ে একটির পর একটি নূতন নূতন প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলেন, অধিকাংশই লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটির কার্যবিবরণে প্রকাশিত হইয়াছিল। তাঁহার যশ এখন সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। বাংলা গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে ইউরোপে পাঠাইলেন। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের সভায় তিনি তাঁহার গবেষণাগারে নির্মিত ক্ষুদ্র যন্ত্রটি প্রদর্শন করিলেন। তখন বৈজ্ঞানিক জগতে অপূর্ব সাড়া পড়িয়া গেল। এই যন্ত্রদ্বারা তিনি বৈদ্যুতিক তরঙ্গের গতি ও প্রকৃতি নির্ণয় করিতেন। বসু পরে উদ্ভিদের শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে যে গবেষণা করেন, অথবা জড়জগৎ সম্বন্ধে যে যুগান্তরকারী সত্য আবিষ্কার করেন, তৎসম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বলিবার স্থান এ নহে। সে বিষয়ে কিছু বলিবার যোগ্যতাও আমার নাই। এখানে কেবল একটি বিষয়ে বলাই আমার উদ্দেশ্য, ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের অপূর্ব আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক জগত কর্তৃক কি ভাবে স্বীকৃত হইয়াছিল এবং নব্য বাংলার মনের উপর তাহা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

 স্বাধীন দেশে যুবকগণের বুদ্ধি জীবনের সর্ববিভাগে বিকাশের ক্ষেত্র পায়, কিন্তু পরাধীন জাতির মধ্যে উচ্চ আশা ও আকাঙ্ক্ষার পথ চারিদিক হইতেই রুদ্ধ হয়। সৈন্যবিভাগে ও নৌবিভাগে তাহার প্রবেশ করিবার সুযোগ থাকে না। বাংলার মস্তিষ্ক এ পর্যন্ত কেবল আইন ব্যবসায়ে স্ফূর্তিলাভ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল, সেই কারণে বাঙালীদের মধ্যে বড় বড় আইনজ্ঞের উদ্ভব হইয়াছিল। যাঁহারা নব্যন্যায়ের জন্ম দিয়াছিলেন, এবং তর্কশাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই বংশধরেরা স্বভাবত আইন ব্যবসায়ে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন। তর্ক-শাস্ত্র এবং আইনের কূট আলোচনার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। সুতরাং গাঙ্গেয় উপকূলের মেধাবী অধিবাসীরা ইংরাজ আমলে স্থাপিত আইন আদালতে আইন ব্যবসায়কে যে তৎপরতার সহিত গ্রহণ করিয়াছেন তাহা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে। সমস্ত তীক্ষ্ণ ঝদ্ধি মেধাবী ছাত্রই এই পথ অবলম্বন করিত। যদিও আইন ব্যবসায় শীঘ্রই জনাকীর্ণ হইয়া উঠিল এবং নব্য উকীলেরা বেকার অবস্থায় কালযাপন করিতে লাগিল, তথাপি শীর্ষস্থানীয় মুষ্টিমেয় আইন ব্যবসায়ীরা প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেন বলিয়া, এই ব্যবসায়ের প্রতি লোকে বহ্ণিমুখে পতঙ্গের মত আকৃষ্ট হইত। প্রায় ২০ বৎসর পূর্বে “বাঙ্গালীর মস্তিষ্কের অপব্যবহার” নামক পুস্তিকায় আমি দেশবাসীর দৃষ্টি এই দিকে আকৃষ্ট করি; এবং দেখাইয়া দেই যে কেবলমাত্র একটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উন্মাদের মত ধাবিত হইয়া এবং জীবনের অন্য সমস্ত বিভাগ উপেক্ষা করিয়া বাংলার যুবকরা নিজেদের এবং দেশের কি ঘোর সর্বনাশ করিতেছে! একজন বিখ্যাত আইন ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতা—বাংলা কাউন্সিলে একবার বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, আইন এদেশের বহু প্রতিভার সমাধি ক্ষেত্র স্বরূপ হইয়াছে।

 বাঙালী প্রতিভার ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে বসুর আবিষ্ক্রিয়া সমূহ বৈজ্ঞানিক জগতে সমাদর লাভ করিল। বাঙালী যুবকদের মনের উপর ইহার প্রভাব ধীরে ধীরে হইলেও, নিশ্চিতরূপে রেখাপাত করিল। এযাবৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকরা শিক্ষাবিভাগকে পরিহার করিয়াই চলিত। শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর ইউরোপীয়দের একচেটিয়া ছিল। দুই একজন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী প্রসিদ্ধ ভারতীয় প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া উহাতে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। শিক্ষাবিভাগকে এখন পুনর্গঠন করা হইল এবং একটি স্বতন্ত্র নিম্নস্তরের শাখা ভারতবাসীদের জন্য সৃষ্ট হইল। কিন্তু উচ্চস্তর কার্যত ইউরোপীয়দের জন্যই সুরক্ষিত থাকিল। ইহার ফলে প্রতিভাশালী মেধাবী ভারতবাসীরা শিক্ষাবিভাগ যথাসাধ্য বর্জন করিতে লাগিল। আমি এখানে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিব।

 আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধারণ কৃতী ছাত্র ছিলেন। অল্পবয়সেই গণিত শাস্ত্রে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। সেই কারণে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর স্যার আলফ্রেড ক্রফ্‌ট তাঁহাকে ডাকিয়া একটি সহকারী অধ্যাপকের পদ দিতে চাহেন। উহার বেতন মাসিক ২০০ হইতে ২৫০ টাকা। স্থানীয় গবর্ণমেণ্টের উহার বেশি মঞ্জুর করিবার ক্ষমতা ছিল না। আশুতোষ যদি মুহূর্তের দৌর্বল্যে ঐ পদ গ্রহণ করিতেন, তবে তাঁহার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ রুদ্ধ হইত। তিনি যথানিয়মে প্রাদেশিক সার্ভিসের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত উঠিতে পারিতেন। ২৫ বৎসর কাজ করিবার পর, মাসিক সাত আট শত টাকা মাহিয়ানাও হইত। কিন্তু বেতনের পরিমাণ এখানে বিবেচনার বিষয় নহে। সরকারী কর্মচারী হিসাবে তাঁহার স্বাধীনতা প্রথম হইতেই সঙ্কুচিত হইত এবং প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ মিলিত না। পরবর্তী জীবনে তিনি যে পৌরুষ ও তেজস্বিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইত। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমলাতন্ত্রের প্রভাব হইতে যেটুকু স্বাতন্ত্র্য ভোগ করিতেছে, তাহা ভবিষ্যতের স্বপ্নে পর্যবসিত হইত। বিজ্ঞান কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য পোষ্ট গ্রাজুয়েট বিভাগ, এ সমস্ত সম্ভবপর হইত না।

 ১৮৯৬ সালে কলিকাতার ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির দ্বাদশ অধিবেশন হয়। উহাতে স্বর্গীয় আনন্দমোহন বসু নিম্নলিখিত প্রস্তাব উপস্থিত করেন;—“এই কংগ্রেস ভারত সচিবের অনুমোদিত শিক্ষাবিভাগের পুনর্গঠন ব্যবস্থার প্রতিবাদ করিতেছে। যেহেতু ইহার উদ্দেশ্য ভারতবাসীকে শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর হইতে বঞ্চিত করা।” আনন্দমোহন এই প্রস্তাব উপলক্ষে যে সারগর্ভ বক্তৃতা করেন, তাহার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ দিতেছি।

 “এই প্রস্তাবের প্রবর্তকদিগকে আমি বলিতে চাই যে, তাঁহারা অত্যন্ত অসময়ে দেশের শিক্ষা বিভাগে এইরূপ অধোগতিসূচক নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। যদি মহারাণীর ঘোষণার মহৎ বাণী অবজ্ঞা করিতেই হয়—জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার প্রতি সমব্যবহার করিবার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়াছিলেন, তাহা যদি ভঙ্গ করিতেই হয়, তাহা হইলে তাঁহার রাজত্বের ষষ্টিতম বার্ষিক উৎসবের বৎসরে উহা করা উচিত ছিল না। মহারাণীর উদার শাসনের ষষ্টিতমবর্ষে এই নিকৃষ্ট নীতি প্রবর্তন করা অত্যন্ত অদূরদর্শিতার কার্য হইবে। আর একটি কারণে আমি বলিতেছি এই বৎসরে এরূপ অশোভন চেষ্টা করা তাঁহাদের পক্ষে উচিত হয় নাই। ‘লণ্ডন টাইমস’ সে দিন বলিয়াছেন ১৮৯৬ সাল ভারতের প্রতিভার ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করিয়াছে। আমরা সকলেই জানি একজন বিখ্যাত ভারতীয় অধ্যাপকের অদৃশ্য আলোকের ক্ষেত্রে—তথা ইথর তরঙ্গের রাজ্যে— অপূর্ব গবেষণা ইংলণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিনেরও বিস্ময় ও প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। আমাদের আর একজন স্বদেশবাসী গত সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। আমরা আরও জানি যে, রাসায়নিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের আর একজন স্বদেশবাসীর প্রতিভা ও অধ্যবসায় বৈজ্ঞানিক জগতে সমাদর লাভ করিয়াছে। সুতরাং বর্তমান বৎসরে প্রমাণ হইয়াছে যে, ভারত তাহার অতীত গৌরবের অবদান বিস্মৃত হয় নাই,—সে তাহার ভবিষ্যতের মহৎ সম্ভাবনা সম্বন্ধে সম্যক্ সচেতন হইয়াছে এবং পাশ্চাত্য মনীষীরাও তাহার এই দাবী স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। আর এই বৎসরই এইরূপ নিকৃষ্ট নীতি প্রবর্তনের কি যোগ্য সময়? আমরা বিনা প্রতিবাদে এইরূপ ব্যবস্থা কখনই মানিয়া লইব না। ভদ্রমহোদয়গণ, এই ভাবে বর্ণ-বৈষম্যমূলক নূতন অপরাধ সৃষ্টি করা ও মহারাণীর উদার ঘোষণার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।

 “ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আর একটা কথা বলিতে ইচ্ছা করি। আমি এই অবনতিসূচক অ-ব্রিটিশ কার্য-নীতির কথা আলোচনা করিয়াছি, সুতরাং সরকারী ইস্তাহারে উল্লিখিত কয়েকটি শব্দের প্রতি আপনাদের মনোযোগ বিশেষভাবে আকৃষ্ট করা আমি প্রয়োজন মনে করি। সেই শব্দগুলি এই—‘অতঃপর যে সমস্ত ভারতবাসী শিক্ষাবিভাগে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা করিবেন, তাঁহারা সাধারণতঃ ভারতবর্ষে এবং প্রাদেশিক শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইবেন।’ এই সরকারী প্রস্তাবের রচয়িতাগণ হয়ত মনে করিয়াছেন যে, ‘সাধারণতঃ’ এই শব্দের একটা বিশেষ গুণ আছে। কিন্তু এই ‘সাধারণতঃ’ শব্দের পরিণাম কি হইবে, তৎসম্বন্ধে আমি ভবিষ্যদ্‌বাণী করিতে চাই। আমি যে ভবিষ্যদ্‌বক্তার শক্তি পাইয়াছি, তাহা নহে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা হইতেই ভবিষ্যৎ অনুমান করা যায় এবং বহু অজ্ঞাত বিষয় স্পষ্ট হইয়া উঠে। সেই অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমরা মিলাইয়া দেখিব। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, বাংলাদেশের কথাই আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করিতেছি এবং সেই বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে আমরা কি দেখিতেছি? আমি সভার শোতৃগণকে দূর অতীতে লইয়া যাইব না। কিন্তু কংগ্রেসের জন্মের পর হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত কি ঘটিয়াছে, তাহা আলোচনা করিলে দেখিতে পাই, গত বার বৎসরের মধ্যে ইউরোপে শিক্ষিত ছয়জন যোগ্য ভারতবাসী শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইয়াছেন। এই ছয়জন শিক্ষিত ভারতবাসী সকলেই ভারতবর্ষেই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন। তাঁহারা যে ইংলণ্ডে নিয়োগলাভ করিতে চেষ্টা করেন নাই, তাহা নহে। এই ছয়জন ভারতবাসী ব্রিটিশ ও স্কচ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে উপাধিলাভ করিয়া এবং বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়া (যে সমস্ত ইংরাজ শিক্ষাবিভাগে আছেন, তাঁহাদের অপেক্ষা ইঁহাদের যোগ্যতা কোন অংশেই কম নহে, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি) ইংলণ্ডে ভারতসচিবের দপ্তর হইতে নিয়োগলাভ করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বহুদিন অধীরহৃদয়ে অপেক্ষা করিবার পর তাঁহাদিগকে সত্বর ভারতে প্রত্যাবর্তন করিতে এবং সেইখানেই গবর্ণমেণ্টের নিকট কাজের চেষ্টা করিতে বলা হইল। সুতরাং এই ‘সাধারণতঃ’ শব্দ থাকা সত্ত্বেও, অতীতে যাহা হইয়াছে, ভবিষ্যতেও যে তাহা হইবে, ইহা অনুমান করা কঠিন নহে। বর্তমানে যে অবনতিসূচক ধারাটি নির্দেশ করা হইয়াছে, তাহা পূর্বে না থাকা সত্ত্বেও কার্যতঃ এইরূপে ঘটিয়াছে। সতরাং ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা ধরিয়া লইতে পারেন যে ‘সাধারণতঃ’ শব্দের অর্থ এখানে ‘অপরিহার্যরূপে’, এবং আমাদের দেশবাসীর পক্ষে এখন শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তরে প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ।

 “আমি আর বেশিক্ষণ বলিতে চাই না, আমার বক্তৃতা করিবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে। আমি কেবল একটি কথা বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিব। কংগ্রেসের সদস্যগণের নিকট শিক্ষার চেয়ে প্রিয় বিষয় আর কিছু হইতে পারে না—ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারাই সেই শিক্ষার ও জাতীয় মনের মহৎ জাগরণের ফলস্বরূপ। ইহা কি সম্ভব যে, আমাদের ভারত ও ইংলণ্ডস্থিত বন্ধুদের তথা সকল স্থানের মানব সভ্যতার উন্নতিকামীগণের সাহায্যে যাহাতে আমাদের স্বদেশবাসিগণ শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর হইতে বহিষ্কৃত না হয়, তজ্জন্য আপনারা যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন না? ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতবাসীদের নিয়োগের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কথা বলা হইয়া থাকে, সত্য হোক মিথ্যা হোক, সেই সমস্ত কথা শিক্ষাবিভাগের সম্বন্ধে খাটে না। সুতরাং এই ব্যাপক বহিষ্কার নীতির পক্ষে কি যুক্তি থাকিতে পারে? ভদ্রমহোদয়গণ, আমি ভারতের প্রতিভায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে ভারতে যে বহ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছিল, তাহা এখনও সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হয় নাই। আমি বিশ্বাস করি, সেই বহ্নির স্ফুলিঙ্গ এখনও বর্তমান এবং তাহাকে সহানভূতির বাতাস দিলে এবং যত্ন করিলে আবার গৌরবময় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইতে পারে। সেই প্রদীপ্ত বহ্নি অতীতে কেবল ভারতে নয় জগতের সর্বত্র জ্যোতিঃ বিকীরণ করিয়াছিল এবং শিল্প, সাহিত্য, গণিত, দর্শনের আশ্চর্য সৃষ্টি করিয়াছিল, যাহা এখন পর্যন্ত জগতের বিস্ময় উৎপাদন করিতেছে। এখনও চেষ্টা করিলে তাহার পুনরাবির্ভাব হইতে পারে। এই মহৎ উদ্দেশ্যে আপনারা দ্বিগুণ উৎসাহে সংগ্রাম করুন এবং তাহা হইলে ভগবানের কৃপায়, ন্যায় ও নীতি জয়যুক্ত হইবে এবং এই প্রাচীন দেশের অধিবাসীদের ললাটে যে কলঙ্কের ছাপ অঙ্কিত করিবার চেষ্টা হইতেছে, তাহা ব্যর্থ হইবে।”

 এস্থলে আমি একটি ঘটনার উল্লেখ করিব, যাহা আমার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। বহু প্রত্যাশিত “পুনর্গঠন ব্যবস্থা” ভারত সচিব কর্তৃক অবশেষে অনুমোদিত হইল এবং আমি শিক্ষা বিভাগের নির্দিষ্ট “গ্রেডে” স্থান লাভ করিলাম। আমি উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন সিনিয়র অফিসার ছিলাম,—এইজন্য আমাকে আমার কর্মক্ষেত্র প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করিয়া রাজসাহী কলেজের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করিতে বলা হইল। একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজের অধ্যক্ষপদ এবং বিনা ভাড়ার কলেজের সংলগ্ন প্রশস্ত আবাসবাটী অনেকের পক্ষে লোভনীয়। শাসনক্ষমতা পরিচালনা করিবার মোহ মানব প্রকৃতির মধ্যে এমনভাবে নিহিত যে বহু সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিককে ইহার জন্য নিজের কর্মজীবন নষ্ট করিতে দেখা গিয়াছে। তৎকালে মফঃস্বল কলেজগুলিতে গবেষণা করিবার উপযুক্ত লেবরেটরি, যন্ত্রপাতি বিশেষ কিছুই ছিল না। তাহা ছাড়া, রাজধানীর বাহিরে “বিদ্যার আবেষ্টনী” বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা ছিল না। আমি তখন ‘হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাসের’ জন্য উপাদান ও তথ্য সংগ্রহে ব্যাপৃত ছিলাম, সুতরাং এসিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরী আমার পক্ষে অপরিহার্য ছিল। কিন্তু আমার সর্ব প্রধান আপত্তি ছিল শাসনকার্যের প্রতি বিতৃষ্ণা, রাশি রাশি চিঠিপত্র দেখা, ফাইল ঘাঁটা কিংবা কমিটির সভায় যোগ দেওয়া; এই সমস্ত কাজে এত সময় ও শক্তি ব্যয় হয় যে অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য অবসর পাওয়া যায় না। এই সমস্ত কারণে আমি শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ডাঃ মার্টিনকে জানাইলাম যে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করিতে অনিচ্ছুক, এখানে বরং আমি জুনিয়র অধ্যাপক রূপেও সানন্দে কাজ করিব। আমার অনুরোধে ফল হইল। কয়েক দিন পরেই কলিকাতা গেজেটে নিম্নলিখিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হইল।

 ডঃ মার্টিন মনে করেন যে এই প্রস্তাব অননুমোদিত হইলে, তাহার পরিণাম অপ্রীতিকর হইবে। তিনি ডাঃ পি, সি, রায়কে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে (ডাঃ রায়কে) প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করিতে হইবে। এই সংবাদে ডাঃ রায় শঙ্কিত হইলেন। ডাঃ মার্টিন জানেন যে ডাঃ রায় একজন প্রথিতযশা রাসায়নিক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণায় ব্যাপ্ত আছেন। সুতরাং সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া তিনি এই প্রস্তাব পরিত্যাগ করাই সমীচীন মনে করেন। লেঃ গবর্ণরও মনে করেন যে কয়েকজন কর্মচারীর পক্ষে কোন বাঁধা-ধরা নিয়ম প্রয়োগ করা সঙ্গত হইবে না।” গবর্ণমেণ্টের প্রস্তাব, ১২৪৪নং তারিখে ২৬-৩-১৮৯৭।

 আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমাদের শ্রেষ্ঠ যুবকগণ আইন ব্যবসায়েই নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিবার স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। কিন্তু আইন ব্যবসায়ে লোকের ভিড় অত্যন্ত বাড়িয়া যাইতেছিল এবং তাহাতে সাফল্য লাভের আশা খুব কমই ছিল। যদিও বৈষয়িক হিসাবে শিক্ষাবিভাগে ঐশ্বর্যের স্বপ্ন দেখিবার সুযোগ ছিল না, তাহা হইলেও এখন প্রমাণিত হইল যে কোন একটি বিজ্ঞানের ঐকান্তিক সাধনার ফলে নূতন সত্যের আবিষ্কার এবং যশোলাভ করা যাইতে পারে।