বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

বিজ্ঞান কলেজ

 ১৯১৬ সালে পূজার ছুটীর পর আমি বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করিলাম। তীক্ষ্ণদৃষ্টি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দেখিলেন, জ্ঞান ঘোষ, জ্ঞান মুখার্জী, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু প্রত্যেকেই যথাযোগ্য সুযোগ পাইলে বিজ্ঞান জগতে খ্যাতিলাভ করিবেন। তাঁহাদিগকে নূতন প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যাপক রূপে আহ্বান করা হইল। কিন্তু প্রথমেই একটা গুরুতর বাধা দেখা দিল।

 ঘোষ ও পালিত বৃত্তির সর্ত অনুসারে বৃত্তির আসল টাকা বা মূলধন খরচ করিবার উপায় ছিল না। সর্তে স্পষ্ট লিখিত ছিল যে লেবরেটরির ইমারত, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এবং উহার সংস্কার ও রক্ষা করিবার ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হইবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের স্বচ্ছলতা ছিল না। রসায়নবিভাগে আমি অজৈব রসায়নের ভার লইয়াছিলাম এবং আমার সহকর্মী অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র জৈব রসায়নের ভার লইয়াছিলেন। যে সব যন্ত্রপাতি ছিল, তাহা দিয়াই আমরা কাজ চালাইতাম। কিন্তু ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রি ও ফিজিক্‌স বিভাগে কার্যতঃ কোন যন্ত্রপাতি ছিল না। ওদিকে, ইউরোপে যুদ্ধ চলিতেছিল বলিয়া সেখান হইতে কোন যন্ত্রপাতি আমদানী করাও অসম্ভব ছিল।

 আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিব্রত হইয়া পড়িলেন। পরীক্ষার্থিগণের নিকট ‘ফি’-এর টাকার উদ্বৃত্ত অংশ গত ২৫ বৎসর ধরিয়া জমাইয়া একটা ফণ্ড করা হইয়াছিল। কিন্তু বিজ্ঞান কলেজের জন্য গৃহনির্মাণ করিতেই তাহা ব্যয় হইয়া গেল। এ যেন তাঁহার উপর মালমশলা ব্যতীত ইঁট তৈরী করিবার ভার পড়িল। কিন্তু আশুতোষ পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহেন। তিনি জানিতে পারিলেন যে, কাশীমবাজারের মহারাজা স্যার মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী তাঁহার বহরমপুরস্থিত নিজের কলেজে পদার্থবিদ্যায় ‘অনার্স কোর্স’ খুলিবার জন্য কতকগুলি মূল্যবান যন্ত্রপাতি কিনিয়াছিলেন, কিন্তু শেষে ঐ প্রস্তাব পরিত্যক্ত হইয়াছে। আশুতোষের অনুরোধে মহারাজা তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ঔদার্যের সহিত সমস্ত যন্ত্রপাতি বিজ্ঞান কলেজের জন্য দান করিয়াছিলেন। শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ব্রুলও কিছু যন্ত্রপাতি ধার দিলেন। আমি নিজে সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ হইতে একটি “কনডাক্‌টিভিটি” যন্ত্র ধার লইলাম।

 এইরূপে সামান্য যন্ত্রপাতি লইয়া, ফিজিক্স ও ফিজিক্যাল কেমিস্ত্রীর দুই বিভাগ খোলা হইল। কিন্তু অধ্যাপকগণ পদে পদে বাধা অনুভব করিতে লাগিলেন, নিজেদের কোন মৌলিক গবেষণা করাও তাঁহাদের পক্ষে কঠিন হইল। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে যে, মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কোন ব্যক্তিকে যদি বাহিরের সাহায্য হইতে বঞ্চিত হইয়া সম্পূর্ণরূপে নিজের উপরে নির্ভর করিতে হয়, তবে জ্ঞানজগতে সম্পূর্ণ নূতন জিনিষ দিবার সৌভাগ্য তাঁহার ঘটে। জন বুনিয়ানের কোন সাহিত্যিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছিল না। কিন্তু বেডফোর্ডের কারাগারে বসিয়া তিনি তাঁহার অমর গ্রন্থ The Pilgrim’s Progress লিখিয়াছিলেন। নিউটনের বয়স যখন মাত্র ২৩ বৎসর তখন লণ্ডনে প্লেগ মহামারী হয় এবং তাঁহাকে বাধ্য হইয়া ট্রিনিটি কলেজ ছাড়িয়া স্বগ্রাম উলস্‌থর্প যাইতে হয়। সেইখানেই যন্ত্রপাতির সাহায্য ব্যতীত তিনি তাঁহার মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।

 বৃহৎ জিনিষের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জিনিষের তুলনা করিলে বলা যায়, ‘ঘোষের নিয়ম’-এর (Ghosh’s Law) পশ্চাতেও এইরূপ একটা ইতিহাস আছে। ঘোষ যন্ত্রপাতির সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইয়া বিজ্ঞান কলেজে তাঁহার নিজের কক্ষে ‘ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী’র রাশীকৃত পুস্তক ও পত্রিকা লইয়া কাল কাটাইতেন। এইখানেই তিনি তাঁহার বিখ্যাত “ঘোষের নিয়ম” আবিষ্কার করেন এবং তাহা শীঘ্রই বৈজ্ঞানিক জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মেঘনাদ সাহা গণিত এবং জ্যোতিষ সম্পর্কীয় পদার্থবিদ্যায় (Astro-physics) অসাধারণ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাকেও এই দুর্দশায় পড়িতে হইয়াছিল। উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে পদার্থবিদ্যা সম্বন্ধে গবেষণা করিতে না পারিয়া তিনিও খুব মনঃকষ্ট ভোগ করিতেছিলেন। তৎসত্ত্বেও তিনি ‘ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিন’, ‘জার্নাল অব ফিজিক্স’ (আমেরিকা), ‘রয়েল সোসাইটির কার্য বিবরণী’ প্রভৃতিতে বহু মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশ করিতে থাকেন এবং অবশেষে বিখ্যাত “Saha’s Equation” আবিষ্কার করেন। এদিকে আশুতোষ গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে বিজ্ঞান কলেজের জন্য সাহায্য লাভার্থ প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে বহুদিনের একটা প্রথা ছিল যে, যখনই কোন লোকহিতাকাঙ্ক্ষী মহানুভব ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কোন মহৎ দান করেন, গবর্ণমেণ্টও সরকারী তহবিল হইতে অনুরূপ দান করিয়া দাতার ইচ্ছা কার্যে পরিণত করিতে সহায়তা করেন। আমি এস্থলে দুইটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিব। পরলোকগত জে, এন, টাটার মহৎ দানের ফলে বাঙ্গালোর “ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্স” প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত গভর্ণমেণ্ট এই প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক লক্ষাধিক টাকা সাহায্য দিয়া থাকেন। কিন্তু ভারত গবর্ণমেণ্টের শিক্ষানীতি যাঁহারা পরিচালনা করিতেন তাঁহারা রাজনৈতিক কারণে বিজ্ঞান কলেজের প্রতি বিরূপ হইলেন। মিঃ শার্প (পরে স্যার হেনরী শার্প) ভারত গবর্ণমেণ্টের শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটারী ছিলেন। বঙ্গবিচ্ছেদের পর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারের আমলে ইনি শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন। সিরাজগঞ্জ হাই স্কুলের ছাত্রেরা ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি করিয়া মিঃ শার্পের কোপদৃষ্টিতে পড়ে। মিঃ শার্প এবং গবর্ণর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার সিরাজগঞ্জ স্কুলের এই ‘বিদ্রোহী’ ছাত্রদিগকে শাস্তি দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হন। তাঁহাদের মতে উক্ত স্কুল রাজদ্রোহের আড্ডা ছিল। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট শার্প ও ফুলারের হাতের পাতুল হইতে সম্মত হইলেন না। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের এই ঔদ্ধত্যে ক্রোধে জ্ঞানহারা হইলেন। তিনি বড়লাট লর্ড মিণ্টোকে লিখিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাধ্য সিণ্ডিকেটকে যদি সায়েস্তা করা না হয়, তবে তিনি (ফুলার) পদত্যাগ করিবেন। লর্ড মিণ্টো যদিও নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘রৌদ্রদগ্ধ’ ব্যুরোক্রাটদের মতে সায় দিতেন, তাহা হইলেও, ইংরাজ অভিজাত বংশের একটা সহজ উদারতার ভাব তাঁহার মধ্যে ছিল। তিনি সিণ্ডিকেটের কাজে হস্তক্ষেপ করিতে অস্বীকৃত হইলেন এবং ফুলারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিলেন।

 মিঃ শার্প ও তাঁহার প্রভু ফুলার যে আঘাত পাইয়াছিলেন, তাহা তাঁহারা ভুলিতে পারেন নাই। লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে মিঃ শার্প ভারত গবর্ণমেণ্টের শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। সুতরাং এখন তিনি তাঁহার পূর্ব ‘অপমানের’ প্রতিশোধ লইবার সুযোগ পাইলেন। মিঃ শার্প জানিতেন যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিণ্ডিকেটের কার্যনীতি পরিচালনা করিতেন। সুতরাং মিঃ শার্প স্যার আশুতোষ ও তাঁহার প্রিয় বিজ্ঞান কলেজের বিরদ্ধে দণ্ডায়মান হইলেন। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রথমে বিজ্ঞান কলেজের পক্ষপাতী ছিলেন, তারকনাথ পালিতের মহৎ দানের জন্য তাঁহাকে ‘স্যার’ উপাধিও দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু যেরূপেই হোক মিঃ শার্প লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর প্রভাব বিস্তার করিলেন এবং লর্ড হার্ডিঞ্জের মতের পরিবর্তন হইল। সেই সময়ে ইহাও শোনা গিয়াছিল যে বিজ্ঞান কলেজের দানসর্তের একটি ধারা পড়িয়া লর্ড হার্ডিঞ্জ ভ্রুকুঞ্চিত করিয়াছিলেন। ধারাটি এই:—“ভারতবাসী ব্যতীত কেহ অধ্যাপকের পদ পাইবে না।”[] ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ কলিকাতায় আসিলে, টাউন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশান সভা হইল। লর্ড হার্ডিঞ্জ কনভোকেশানে যে বক্তৃতা দেন, তাহাতে তিনি এমন ভাব প্রদর্শন করেন যেন বিজ্ঞান কলেজের জন্য যে প্রাসাদোপম গৃহ নির্মিত হইয়াছে, তাহার কথা তিনি কিছুই জানেন না। যে রকমেই হোক ভারত গবর্ণমেণ্টের মতিগতি পরিবর্তিত হইয়াছিল এবং বিজ্ঞানের জন্য গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে সাহায্য পাইবার কোন আশা ছিল না।

 লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে অ্যাসেম্বলীতে গোখেল তাঁহার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিল উপস্থিত করেন, কিন্তু শিক্ষাসচিব স্যার হারকোর্ট বাটলার অর্থাভাবের অজুহাতে উহার বিরোধিতা করেন এবং বিলটি অগ্রাহ্য হয়। এই ব্যাপারে আমাদের শাসকদের ‘উদার উদ্দেশ্য’ সম্বন্ধে স্বভাবতঃই সন্দেহ জন্মে। গোখেল তাঁহার শেষজীবনে এই বিলের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়াতে একরকম ভগ্ন হৃদয় লইয়াই তাঁহার মৃত্যু হয়।

 ভারত গবর্ণমেণ্ট যে রাজনৈতিক প্রভাবে পড়িয়াই বিজ্ঞান কলেজে সাহায্য দান করেন নাই, তাহার প্রমাণ দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম ভারতে দুইটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি গবর্ণমেণ্টের অতিরিক্ত উদারতা হইতেই বুঝা যায়। ইহার কারণ নির্ণয় করিবার জন্য বেশীদূর যাইতে হইবে না। এই দুইটি প্রতিষ্ঠানই ব্রিটিশ অধ্যাপকে পূর্ণ এবং তাঁহাদের দ্বারাই উহা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হইয়া থাকে। ভারতীয়েরা ওখানে আছেন বটে, কিন্তু নিম্নতর কাজে এবং তাঁহাদের বেতন অতি সামান্য। বাঙ্গালোরের প্রতিষ্ঠানটির মূলধন প্রায় এক কোটী টাকা এবং উহার বার্ষিক আয় প্রায় ৬ লক্ষ টাকা, তন্মধ্যে গবর্ণমেণ্ট বার্ষিক দেড় লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়া থাকেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি সাফল্য লাভ করে নাই এবং যেভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হইতেছে, দেশের জনমত তাহার বিরোধী। এতদ্বারা ইহাও প্রমাণিত হয় যে বড় বড় পদগুলি ইয়োরোপীয়দের দ্বারা পূর্ণ করিলেই কোন প্রতিষ্ঠান সাফল্য লাভ করিতে পারে না।

 অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা বাঙ্গালোর ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্সের “পঞ্চবার্ষিক রিভিউ কমিটির” সদস্য হিসাবে উহার কার্যাবলী পরিদর্শনের বিশেষ সুযোগ পাইয়াছিলেন। সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া তিনি লিখিয়াছেন:—

 “পরলোকগত মিঃ টাটা এবং দেওয়ান স্যার শেষাদ্রি যে উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত করিয়াছিলেন, তাহা সফল হয় নাই। তাহার অনেক কারণ আছে, কিন্তু প্রধান কারণ, শিল্পবাণিজ্য, কলকারখানার সংশ্রব হইতে দূরে বাঙ্গালোরের মত সহরে ইহার অবস্থান। এই প্রতিষ্ঠানটি বাঙ্গালোরে না হইয়া কোন শিল্পবাণিজ্যপ্রধান সহরের নিকট প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। কেননা তাহা হইলেই, প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও কর্মিগণের আবিষ্কৃত তত্ত্বসমূহ কার্যে পরিণত করিবার সুযোগ হইত। কিন্তু আমি জানি, বর্তমানে যে সব যুবক এখানে শিক্ষালাভ করে, তাহারা কলিকাতা বা বোম্বাই সহরে কাজের চেষ্টায় যাইতে বাধ্য হয়।

 “দ্বিতীয় কারণ এই যে, যদিও প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও অতীত ডিরেক্টরগণকে এবং বিভাগীয় কর্তাদিগকে আশাতীত বেতন দেওয়া হইয়াছে ও হইতেছে, তথাপি যাঁহাদের যোগ্যতার উপর নির্ভর করা যাইতে পারে, অথবা যাঁহারা ইনষ্টিটিউটের কার্যে প্রাণসঞ্চার করিতে পারেন, দুই একজন ছাড়া এমন লোককে প্রতিষ্ঠানের কাজে পাওয়া যায় নাই। কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কার্যের জন্য ডিরেক্টরকে এত অতিরিক্ত বেতন দেওয়া কোন ক্রমেই সঙ্গত নহে।

 “তৃতীয়তঃ, যেভাবে এই ইনষ্টিটিউটের কাজে লোক নিযুক্ত করা হয়, তাহাও ইহার ব্যর্থতার একটি কারণ। এই প্রণালীতে যথেষ্ট গলদ আছে এবং সহকারী অধ্যাপকগণকে অত্যন্ত কম বেতন দেওয়া হয়।

 “* * * আমি তুলনামূলক একটি দৃষ্টান্তে এবং কতকগুলি তথ্যের উল্লেখ করিয়া এই কথা বুঝাইতে চেষ্টা করিব।

 “লণ্ডনের নিকটবর্তী টেডিংটনে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল ফিজিক্যাল লেবরেটরি’-র কথাই ধরা যাক। গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে ইহা একটি বৃহৎ এবং বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান। ইহার ডিরেক্টরের বেতন বার্ষিক ১২০০ শত পাউণ্ড এবং অধিকাংশ সহকারী অধ্যাপকের (প্রায় সকলেই নূতন লোক) বেতন বার্ষিক ২৪০ পাউণ্ড। অর্থাৎ ডিরেক্টর এবং সহকারিগণের বেতনের অনুপাত ধরিলে ১: ৫ দাঁড়ায়। কিন্তু বাঙ্গালোরে ডিরেক্টরের বেতন মাসিক ৩৫০০ টাকা (অর্থাৎ বিলাতী হিসাবে বার্ষিক প্রায় ৪০০০ পাউণ্ড)[] এবং তাঁহার সহকারিগণ বা গবেষকগণ মাসিক বেতন পান ১৫০ টাকা (অর্থাৎ বার্ষিক প্রায় ১২০ পাউণ্ড)। সুতরাং এক্ষেত্রে ডিরেক্টর ও তাঁহার সহকারিগণের বেতনের অনুপাত ১: ৩০। দেখা যাইতেছে, প্রতিষ্ঠানের আয়ের অধিকাংশ ডিরেক্টর এবং অধ্যাপকগণের বেতনেই ব্যয় হয়। গবেষণাকারী তরুণ কর্মীদের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আমার মনে হয়, এই প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি গবেষণাকারী কর্মী থাকার দরকার এবং তাঁহাদিগকে এখনকার চেয়ে বেশী বেতন বা বৃত্তি দেওয়া প্রয়োজন। তাহা হইলে তাঁহারা একনিষ্ঠভাবে তাঁহাদের কাজ করিতে পারেন। উচ্চতর পদগুলির বেতন হ্রাস করিয়া ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বেতনের সমান করা উচিত।”

 স্যার সি, ভি, রামন পোপ কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি ইনস্টিটিউটের কাউন্সিলেরও সদস্য। তিনিও ইনষ্টিটিউটের কার্যপ্রণালীর অধিকতর তীব্র ভাষায় নিন্দা করিয়াছেন।

 “বাঙ্গালোরের ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স তথা দেরাদুনের ফরেষ্ট রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হইয়াছে, তদনুপাতে ঐগুলির দ্বারা কোনই কাজ হয় নাই। এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা আমাদের ব্যবস্থাপক সভার সদস্যগণকে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করিয়া দিবে।”

 বোম্বাইয়ের রয়েল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সও সহরবাসীদের দানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। গবর্ণমেণ্ট এই প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করেন। সাধারণের দানের পরিমাণ ২৪.৭৫ লক্ষ টাকা এবং গবর্ণমেণ্টের সাহায্য ৫ লক্ষ টাকা। ২২ লক্ষ টাকা মূলধনরূপে ব্যয় হয় এবং এক লক্ষ টাকা ছাত্রবৃত্তির জন্য পৃথক রাখিয়া দেওয়া হয়। এই সমস্ত বাদ দিয়া, সরকারের নিকট ৬.৭৫ লক্ষ টাকা গচ্ছিত আছে। শতকরা ৩ ১/২ টাকা হারে উহার সুদ বার্ষিক ২৫০০০ টাকা। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রায় ১.৫ লক্ষ টাকা। সুতরাং প্রাদেশিক গবর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য বার্ষিক ১.২৫ লক্ষ টাকা দিয়া থাকেন। সুতরাং ইহার জন্য গবর্ণমেণ্ট ৫ লক্ষ টাকা মূলধন যোগাইয়াছেন এবং যথেষ্ট পরিমাণে বার্ষিক সাহায্যও করিতেছেন। ইহার তুলনায় কলিকাতার বিজ্ঞান কলেজের প্রতি গবর্ণমেণ্টের ব্যবহার অত্যন্ত কার্পণ্যসূচক। বোম্বাইয়ের শিক্ষিত সমাজ কিন্তু উক্ত রয়েল ইনস্টিটিউটকে ব্যর্থ মনে করেন। সম্প্রতি বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে এ সম্বন্ধে যে আলোচনা হইয়াছে, তাহাতেই ইহার পরিচয় পাওয়া যায়।

 “ডাঃ ভিগাসের প্রস্তাব এবং তাহার উপর মিঃ গোখেলের সংশোধন প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনায় যে সব তথ্য প্রকাশ পায়, তাহা উপেক্ষণীয় নহে।...”

 “...রয়েল ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্সের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা এত কম যে, ইনষ্টিটিউটের পরিচালকগণকে স্বেচ্ছাচারী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। দেশবাসী এই ইনস্টিটিউটের কার্যাবলী সম্পর্কে যে নৈরাশ্যের ভাব পোষণ করে, গবর্ণমেণ্টের তাহার প্রতি লক্ষ্য নাই। যাঁহারা এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নিশ্চয়ই এরূপ অভিপ্রায় ছিল না যে, প্রতিষ্ঠানটি একটা সেকেণ্ড গ্রেড কলেজে পরিণত হইবে।”—বোম্বে ক্লনিক্‌ল্, ২৫শে আগষ্ট, ১৯৩০।

 প্রতিষ্ঠানটিতে শুধু সেকেণ্ড গ্রেড কলেজের কাজ হয়, এ কথা বলা অবশ্য ঠিক নয়। কিয়ৎ পরিমাণে পোষ্ট-গ্রাজুয়েট শিক্ষাও ইহাতে দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু ইহার বিরদ্ধে যে তীব্র সমালোচনা হইয়াছে, তাহা মোটের উপর ন্যায়সঙ্গত।

 একথা বলা হইতেছে না যে, ভারতীয়েরা ইয়োরোপীয়দের চেয়ে বুদ্ধি ও মেধায় শ্রেষ্ঠ। ব্যর্থতার কারণ অন্য দিকে অন্বেষণ করিতে হইবে। পরলোকগত মিঃ জি, কে, গোখেল বলিতেন—“তৃতীয় শ্রেণীর ইয়োরোপীয় এবং প্রথম শ্রেণীর ভারতীয়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হইয়া থাকে।”

 গবর্ণমেণ্ট বিজ্ঞান কলেজকে কেন প্রীতির চক্ষে দেখেন না, এমন কি অপ্রসন্ন দৃষ্টিতেই দেখিয়া থাকেন, তাহার আর একটি কারণ এই যে, এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণরূপে ভারতবাসীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা গবর্ণমেণ্টের কার্যনীতির সঙ্গে মিলে না। তাঁহাদের ধারণা এই যে, এদেশের জন্য যাহা কিছু ভাল তাহা সমস্তই ‘মা বাপ’-রূপী আমলাতন্ত্র গবর্ণমেণ্টের দয়াতেই হইবে।

 আশুতোষকে এইরূপে নিজের চেষ্টার উপরই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিতে হইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফি বাবদ প্রাপ্ত টাকা হইতে যাহা কিছু সামান্য বাঁচানো যাইত, তাহা বিজ্ঞান কলেজের লেবরেটরির যন্ত্রপাতি ইত্যাদির জন্য দেওয়া হইত। পালিত এবং ঘোষ বৃত্তির বাবদ উদ্বৃত্ত অর্থ ও কিয়ৎপরিমাণে এই কার্যে ব্যয় করিতে হইয়াছিল। এই সমস্ত উপায়ে লব্ধ মোট প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা বিজ্ঞান কলেজের জন্য ব্যয় হইয়াছে।

 বিজ্ঞান কলেজে সর্বপ্রকার আধুনিকতম ব্যবস্থা করিবার জন্য কয়েকটি নূতন বিভাগ খুলিবার প্রয়োজন ছিল। রাসবিহারী ঘোষের দ্বিতীয় দান এবং খয়রা রাজার দানে এই প্রয়োজন কিয়ৎপরিমাণে সিদ্ধ হইল। ঐ দুই দানের অর্থে, ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা, ব্যবহারিক রসায়ন বিজ্ঞান, ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী এবং বেতার টেলিগ্রাফী বিদ্যার অধ্যাপকপদ প্রতিষ্ঠিত হইল। বিজ্ঞান কলেজের গৃহ নির্মাণ করিবার সময় এই সমস্ত পরিকল্পনা ছিল না, সুতরাং আমাদের স্থানাভাব হইতেছিল। অর্থাভাবে সমস্ত বিভাগে যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম প্রভৃতিও পাওয়া যাইতেছিল না, সতরাং আশানুরূপে কাজ হইতেছিল না।

 ১৯২৬ সালে লর্ড বালফুরের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়, তাহাতে আমি প্রতিনিধিরূপে প্রেরিত হইয়াছিলাম। প্রথম দিনের আলোচনার বিষয় ছিল—‘রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়’। আমি এই প্রসঙ্গে বলিয়াছিলাম—

 “আমি এই বিষয়ে কিছু বলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসি নাই। কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, আমাদের হাই কমিশনার (তিনি আমার ভূতপূর্ব ছাত্র) অসুস্থতার জন্য আসিতে পারেন নাই, আরও কয়েকজন সদস্য অনুপস্থিত আছেন। সেই কারণে আমি আপনাদের সম্মুখে বক্তৃতা করিতে উপস্থিত হইয়াছি। এখানে বক্তৃতা করিবার সুযোগ লাভ করা আমি সৌভাগ্য বলিয়া মনে করি।

 “১৯১২ সালে প্রথম সাম্রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেসে আমি বক্তৃতা করিবার জন্য আহূত হইয়াছিলাম। সতরাং এখানে আমি নূতন নহি। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমাদের চেয়ারম্যান মহাশয়ও সেই সময়ে কোন এক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন।

 “আজ আমার বক্তৃতার প্রধান উদ্দেশ্য, বাংলা দেশে শিক্ষার অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হইয়াছে, তাহাই ব্যক্ত করা। আমাদের সম্মানিত সভাপতি মহাশয় অক্সফোর্ড ও এডিনবার্গ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। আমি আশা করি, তিনি যে সব সারগর্ভ কথা বলিয়াছেন, তাহা ভারত গবর্ণমেণ্ট ও বাংলা গবর্ণমেণ্ট বিশেষ ভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।

 “আপনারা জানেন, ১৯১৯ সালের মণ্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের অবস্থা কি ভাবে পরিবর্তিত করিয়াছে। উহার দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গগুলি প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে যখন আমরা ভারত গবর্ণমেণ্টের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁহারা আমাদিগকে বাংলা গবর্ণমেণ্টের নিকট যাইতে বলেন; অন্যদিকে বাংলা গবর্ণমেণ্ট মেষ্টনী ব্যবস্থার দোহাই দেন। সুতরাং আমরা উভয় সঙ্কটে পড়িয়াছি। গবেষণা কার্যের জন্য ব্যক্তিগত দানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাঙ্গালোর ইনষ্টিটিউট অব সায়েন্স। প্রধানতঃ বোম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ ধনী পরলোকগত মিঃ জে, এন, টাটার বিরাট দানেই উহার প্রতিষ্ঠা। বোম্বাই বহু লক্ষপতির আবাসস্থল। যদিও বাংলাদেশ বহু ধনীসন্তানের গর্ব করিতে পারে না, তবুও সে বিষয়ে আমরা একেবারে দরিদ্র নহি। আমাদের বিজ্ঞান কলেজ দুইজন মহানুভব ধনীর দানে প্রতিষ্ঠিত। প্রধানত স্যার তারকনাথ পালিত। তিনি মৃত্যুর পূর্বে এজন্য ১৫ লক্ষ টাকা দান করিয়া যান। উহা প্রায় একলক্ষ পাউণ্ডের সমান। তিনি আইনজীবী এবং এই দানের দ্বারা তিনি তাঁহার সন্তানদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অংশ হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন, কেন না বলিতে গেলে তাঁহার সর্বস্বই তিনি বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন।

 “ভারতের অন্য একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন। তাঁহার নাম স্যার রাসবিহারী ঘোষ। তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রায় দেড়লক্ষ পাউণ্ড দান করিয়া যান। ভারতীয়দের নিকট হইতে আমরা যতদূর সম্ভব সাহায্য পাইয়াছি। তাঁহাদের দানের পরিমাণ মোট প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা।

 “কিন্তু যখনই আমরা ভারত গবর্ণমেণ্ট বা বাংলা গবর্ণমেণ্টের নিকট অগ্রসর হই, তাঁহারা অর্থাভাবের অজুহাত দেখান,—অথচ বড় বড় ইম্পিরিয়াল স্কীমের জন্য জলের মত অর্থব্যয় করিতে তাঁহাদের বাধে না। গবর্ণমেণ্টের এই কার্পণ্যের সমালোচনা বহুবার আমাকে করিতে হইয়াছে। আমাদের সঙ্গে উপন্যাসের ‘অলিভার টুইষ্টের’ মত ব্যবহার করা হয়। আমি আশা করি সভাপতি মহাশয় যে সারগর্ভ বক্তৃতা করিয়াছেন, তাহা বেতার যোগে প্রচারিত হইবে এবং রয়টার উহা ভারতে প্রেরণ করিবেন; তাহা হইলে ঐ বক্তৃতা সমস্ত সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হইবে এবং উহা ভারতের সর্বত্র পঠিত হইবে। ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রধান অংশ। সুতরাং উচ্চতর বিজ্ঞানের প্রসার সম্বন্ধে একই নীতি সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে ও ভারতে কেন অনুসৃত হইবে না, তাহা আমি বুঝিতে অক্ষম।

 “আমি বিশেষভাবে একটি তথ্যের প্রতি সভার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। এই ভারতীয় জাতি অতীতে গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে। ম্যাক্সমূলার এক স্থলে বলিয়াছেন যে, হিন্দুরা যদি আর কিছু না করিয়া ইয়োরোপকে শধু দশমিক পদ্ধতি দান করিত—উহা আরবীয় নহে, আরবেরা কেবল মধ্যস্থরূপে ইয়োরোপে ঐ বিদ্যা প্রচার করিয়াছেন,—তাহা হইলেও, ভারতের নিকট ইয়োরোপের ঋণ অসীম হইত। হিন্দুদের অন্তর্নিহিত মানসিক শক্তি যে অসাধারণ অতীতের স্মৃতিমণ্ডিত এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট তাহা অজ্ঞাত নহে। হিন্দু প্রতিভা সূযোগ ও উৎসাহ লাভ করিলে কি করিতে পারে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আপনারা পাইয়াছেন। এই প্রসঙ্গে, পারাঞ্জপে, রামানুজ এবং জগদীশচন্দ্র বসুর নাম করিলেই যথেষ্ট হইবে। তাঁহারা সকলেই এই কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন।

 “আমি মনে করি, দুইটি কারণে এখানে বক্তৃতা করিবার আমার অধিকার আছে। পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের সম্মানিত সভাপতি মহাশয়ের নেতৃত্বে আমি ইতিপূর্বে আর একবার বক্তৃতা করিয়াছি। দ্বিতীয়তঃ প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে, উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এডিনবার্গে) আমি ছয় বৎসর ছাত্র রূপে শিক্ষালাভ করিয়াছিলাম। সভাপতি মহাশয় বর্তমানে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। সুতরাং রাসায়নিকের ভাষায় বলিতে পারি, আমি তাঁহার সঙ্গে দ্বিবিধ বন্ধনে আবদ্ধ।

 “আমি আশাকরি ভারত গবর্ণমেণ্ট অথবা বাংলা গবর্ণমেণ্ট এখন বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজের সাহায্যার্থ অগ্রসর হইবেন। আমি হিসাব করিয়া দেখিয়াছি যে, বিজ্ঞান কলেজের জন্য আমরা গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে শতকরা দুই ভাগ মাত্র সাহায্য পাইয়াছি। অবশিষ্ট—শতকরা ৯৮ ভাগ সাহায্য আসিয়াছে আমাদের দেশবাসীর নিকট হইতে।”

* * * *

 ভারত গবর্ণমেণ্টের উপর সমস্ত দোষ চাপাইয়া দিয়া আমি যদি ক্ষান্ত হই, তবে অত্যন্ত অবিচার করা হইবে। আমার স্বদেশবাসীরও এ বিষয়ে যথেষ্ট দোষ। তাঁহাদের নিকট পুনঃ পুনঃ অর্থ সাহায্য চাহিয়াও বিশেষ কোন ফল হয় নাই। পালিত ও ঘোষ তাঁহাদের সমস্ত জীবনের সঞ্চিত অর্থ বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য দান করিয়া যে মহৎ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন, আর কেহ বড় একটা তাহার অনুসরণ করেন নাই। বড় বড় ব্যবসায়ী, বণিক প্রভৃতির সহানভূতি সাধারণের হিতার্থ আকৃষ্ট করা যায় নাই—বাংলাদেশের এই দুর্ভাগ্যের কথা আমি অন্যত্র আলোচনা করিয়াছি। কিন্তু বাংলার শিক্ষিত সমাজও আমাদের আবেদনে কর্ণপাত করেন নাই। শ্রেষ্ঠ আইনজীবিগণ, বিচার ও শাসন বিভাগের কর্মচারিগণ, একাউণ্টাণ্ট জেনারেল, সেক্রেটারিয়েটের বড় বড় কর্মচারী, মন্ত্রী, শাসন পরিষদের সদস্য, যাঁহারা নির্লজ্জ ভাবে বার্ষিক ৬৪ হাজার টাকা বেতন গ্রহণ করেন,—নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট যাঁহারা বিশ্বের ঋণী—এ পর্যন্ত তাঁহারা কোন সাড়াই দেন নাই। তাঁহারা কেবল নিজেদের সোণার সিন্দুক বোঝাই করিয়াছেন মাত্র। বিলাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব ছাত্র পর জীবনে কৃতিত্ব লাভ করেন, তাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য বৃত্তি, দান প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন, এরূপ ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।

 আমি বিজ্ঞান কলেজের কথা আর বেশী কিছু বলিব না। ইহার শৈশব উত্তীর্ণ হইয়াছে। এখন সে কৈশোরে পদার্পণ করিয়াছে। আমার যুবক সহকর্মী অধ্যাপক রামন একাই একশ[]; এই বিজ্ঞান কলেজ যদি কেবলমাত্র একজন রামনকেই সৃষ্টি করিত, তাহা হইলেও ইহা সার্থক হইত এবং প্রতিষ্ঠাতার আশা পূর্ণ হইত। (প্রতিষ্ঠাতা এখন আর ইহলোকে নাই।) অধ্যাপক রামনের সহকর্মী ডি. এম. বসু, পি. এন. ঘোষ, এস. কে. মিত্র, বি. বি. রায় এবং আরও অনেকে তাঁহাদের নিজ নিজ আলোচ্য বিদ্যার ভাণ্ডারে বহু মৌলিক তত্ত্ব দান করিয়াছেন। ফলিত গণিতে ডাঃ গণেশপ্রসাদ, এবং তাঁহার পরবর্তী এস. কে. বন্দ্যোপাধ্যায়, এন. আর. সেন এবং ডাঃ বি. বি. দত্ত জ্ঞান জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন।

 সুতরাং দেখা যাইতেছে, বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার কয়েক বৎসরের মধ্যেই, নানা ত্রুটি ও অভাব সত্ত্বেও, ইহার অস্তিত্বের সার্থকতা প্রমাণিত হইয়াছে। এই জাতীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ইহার কৃতিত্ব ও গৌরব কম নহে।

 এই প্রুফ সংশোধন কালে (২৫শে মে, ১৯৩৭) Chemical Society Annual Reports অর্থাৎ বার্ষিক বিবরণী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। এই বিজ্ঞান কলেজে রসায়নশাস্ত্র বিভাগে ক্রমান্বয়ে যে সব অধ্যাপক ও ছাত্র কৃতিত্বের সহিত গবেষণা করিতেছেন তাঁহাদের গবেষণার বিষয় বিশেষ প্রশংসিত হইয়াছে দেখিয়া প্রীতি লাভ করিলাম। নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণের নাম পর্যায়ক্রমে উহাতে উল্লিখিত হইয়াছে, যথা— যোগেন্দ্রচন্দ্র বর্দ্ধন (ইঁহার নাম সাত জায়গায় উল্লিখিত হইয়াছে) এবং প্রফুল্লকুমার বসু, পুলিনবিহারী সরকার, বীরেশচন্দ্র গুহ, নির্মলেন্দু রায়, নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, হরিশ্চন্দ্র গোস্বামী, ভবেশচন্দ্র রায়, জগন্নাথ গুপ্ত ইত্যাদি।

  1. পাঠকদিগকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া নিষ্প্রয়োজন যে, শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর হইতে ভারতবাসীরা একপ্রকার বহিষ্কৃত বলিয়াই, এইরূপে সর্ত লিপিবদ্ধ হইয়াছিল।
  2. অধ্যাপক সাহা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে বর্তমান ডিরেক্টর মাসিক ২০০০ টাকার অতিরিক্ত ভাতা পাইতেছিলেন। “অর্থাৎ তিনি মোট মাসিক ৫০০০ টাকা পাইতেন। পাঁচ বৎসরের জন্য তাঁহার কাজের চুক্তি ছিল। উহার পর হইতে তিনি মাসিক ৩০০০ টাকা বেতন ও ৫০০ টাকা ভাতা পাইতেছেন।
  3. অধ্যাপক রামন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পূর্বে ইহা লেখা।