বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ইউরোপ যাত্রা—বিলাতে ছাত্রজীবন——ভারত বিষয়ক প্রবন্ধ

(Essay on India)—‘হাইল্যাণ্ডে’ ভ্রমণ

 আমি এখন বিলাত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম এবং হেয়ার স্কুলে আমার ভূতপূর্ব সহাধ্যায়ী দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র ক্রয় করিলাম। জীবন যাপন প্রণালী সহসা এরূপ পরিবর্তিত হইতে চলিল যে, তাহা ভাবিয়া আমি প্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। শিক্ষানবিশ হিসাবে আমি দুই একটা সস্তা রেস্তোরাঁতে গিয়া কিরূপে ‘ডিনার’ খাইতে হয় শিখিতে লাগিলাম। বখশিস পাইয়া তুষ্ট খানসামারা আমাকে দেখাইয়া দিত কিরূপে ছুরি কাঁটা ধরিতে হয় এবং কখন কি ভাবে তাহা ব্যবহার করিতে হয়।

 শীঘ্রই আমি জানিতে পারিলাম যে ডাঃ পি, কে, রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দ্বারকানাথ রায় বিলাতে ডাক্তারী পড়িবার জন্য যাইতেছেন। আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলাম। ঠিক হইল যে, আমরা দুইজনে এক জাহাজে বিলাত যাইব। পরিণামে ইনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

 আমরা ‘কালিফোর্নিয়া’ নামক জাহাজে প্রত্যেকে ৪০০৲ টাকা হিসাবে প্রথম শ্রেণীর সেলুন ভাড়া লইলাম। জাহাজের কাপ্তেন ছিলেন ‘ইয়ং’ নামক জনৈক সাহেব। ঐ সময় পূরা ‘মনসূনের’ সময় এবং আমরা সরাসরি কলিকাতা হইতে লণ্ডন যাইতেছিলাম। সুতরাং জাহাজের যাত্রী সংখ্যা কম ছিল। আমার বন্ধুরা জাহাজে যাইয়া যখন আমাকে বিদায় দিলেন এবং জাহাজের উপরে উঠিলাম, তখন আমার মনে বেশ স্ফূর্তি হইল এবং একজন ইংরাজ যাত্রীর সঙ্গে আমি মহোৎসাহে গল্প জুড়িয়া দিলাম। যাত্রীটি বলিলেন যে, কথাবার্তায় আমি বড় বড় ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিতেছি। আমি স্বীকার করি যে, সেকালে আমি জনসনের রচনারীতির একটু ভক্ত ছিলাম। আমাদের জাহাজ ‘পাইলটের’ নেতৃত্বে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং ফল্‌তা হইতে কিছুদর গেলেই, আমি আমার দেহে একটা নূতন রকমের অসুখ বোধ করিতে লাগিলাম। বমনোদ্রেক হইতে লাগিল। বস্তুত আমি “সমুদ্ররোগের” দ্বারা আক্রান্ত হইলাম। ডাঃ ডি, এন, রায় তাঁহার ভ্রাতার বাড়ীতে ইউরোপীয় জীবনযাপন প্রণালী অভ্যাস করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার “সমুদ্ররোগ” হইল না। তিনি জাহাজে আগাগোড়া বেশ সুস্থই ছিলেন। তাঁহার প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল এবং তিনি বেশ খাইতেও পারিতেন। ‘সুপ’ বা ঝোল, আলু ভাজা ও আলু সিদ্ধ এবং ‘পূডিং’ ইহাই ছিল আমার সম্বল। যখন আমি “সমুদ্ররোগের” জন্য খাবার টেবিলে বসিতে যাইতাম না, হেড ষ্টুয়ার্ড আমার উপর সদর হইয়া আমার কেবিনে জমাট দুধ এবং পাউরুঢ়ী দিয়া আসিতেন।

 ৫।৬ দিন পরে আমাদের ষ্টীমার কলম্বো পৌঁছিল। ভূমি দেখিয়া আমাদের আনন্দ হইল এবং আমরা তীরে উঠিয়া সহরের দৃশ্যাদি দেখিলাম। আমার যতদূর স্মরণ হয়, এই স্থানে আমরা জানিতে পারিলাম যে, ‘টেল-এল-কেবির’-এর যুদ্ধে পরাজিত হইয়া আরবী পাশা বন্দী হইয়াছেন এবং সুয়েজখালের পথে আর কোন বিপদের আশঙ্কা নাই। আমার মনে পড়ে, একখানি সিংহলী পত্রে সিংহলের ভূতপূর্ব গবর্নর স্যার উইলিয়ম গ্রেগরীকে ভর্ৎসনা করিয়া লেখা হইয়াছিল যে মিশরী জাতীয়তার নেতা বলিয়া আরবী পাশাকে প্রশংসা করিয়া তিনি (গ্রেগরী) অন্যায় করিয়াছেন।

 কলম্বো হইতে এডেন পর্যন্ত আমার পক্ষে আর একটা অগ্নিপরীক্ষা। এই সময়ে জাহাজ খুব দুলিতেছিল। কখন কখন মনে হইতেছিল—এইবার বুঝি সে সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়া যাইবে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যখন সমুদ্র শান্ত হইল, তখন অবিলম্বে আমার ‘বিবমিষাও’ দূর হইল। পরে আমার আর মনেই রহিল না যে, আমার কখনও “সমুদ্ররোগ” হইয়াছিল। ষ্টীমার এডেনে পৌঁছিল। আরব-বালকেরা জাহাজের নিকট ভিড় করিয়া চেঁচাইতে লাগিল। “পয়সা দাও—ডুবিব” ইত্যাদি। কেহ কেহ কৌতূহলী হইয়া সমদ্রের জলে সিকি দুয়ানী প্রভৃতি ফেলিয়া দিল—ডুবুরী বালকেরা তৎক্ষণাৎ তাহা জলে ডুবিয়া তুলিয়া আনিল। তীরে উঠিয়া দেখিলাম বাজারের দোকান প্রভৃতি প্রধানত বোম্বাইওয়ালাদের।

 লোহিত সাগর ও সুয়েজখালের মধ্য দিয়া আমাদের জাহাজ নির্বিঘ্নেই পথ অতিক্রম করিল। ইসমালিয়াতে আমরা শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম যে, তীর হইতে আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করিয়া কেহ গুলি ছুঁড়িবে না। পোর্ট সৈয়দের অধিবাসীরা মিশ্রজাতি এবং তথাকার মিশরীরা ফরাসী ভাষায় বেশ কথা বলিতেছে। কিন্তু কতকগুলি দৃশ্য দেখিয়া আমাদের বড় ঘৃণা হইল। মাল্টার কথা আমার অল্প অল্প মনে পড়ে এবং জিব্রাল্টারে গিয়া আমাদের জাহাজ শেষবার পথিমধ্যে থামিল। এখানে ফেরীওয়ালারা আঙ্গুর বিক্রী করিতেছিল—দাম প্রতি পাউণ্ড ওজনের এক গোছা এক পেনী। আমরা যখন অন্তরীপ ঘুরিয়া পার হইতেছিলাম তখন শুনিলাম যে, বিশ্বে উপসাগরে জাহাজ চলাচল অত্যন্ত বিপদপূর্ণ। কয়েক বৎসর পরে (১৮৯২) ঐ কোম্পানীরই আর একখানি জাহাজ ঠিক ঐস্থানে এই কাপ্টেন ও বহু যাত্রীসহ ডুবিয়া গিয়াছিল। এই সব যাত্রীদের মধ্যে মুয়র সেন্‌ট্রাল কলেজের অধ্যাপকের পত্নী মিসেস বাউটফ্লাওয়ার এবং তাঁহার সন্তানেরাও ছিলেন। অধ্যাপক বাউটফ্লাওয়ার ‘ষ্টেটস্‌ম্যানের’ মিঃ পল নাইটের ভগ্নীপতি ছিলেন।

 সমুদ্রভ্রমণের সময় ডেক-চেয়ারে শুইয়া নানারূপ দিবাস্বপ্ন দেখা সময় কাটাইবার একটা প্রিয় উপায়।[] কোন কোন যাত্রী ‘সেলুনের’ লাইব্রেরী হইতে বই লইয়া পড়েন। কিন্তু এইসব বইয়ের অধিকাংশই অসার ও লঘুপাঠ্য। সৌভাগ্যক্রমে আমি নিজে কয়েকখানি ভাল বই সঙ্গে আনিয়াছিলাম। স্মাইলসের “Thrift” আমার প্রিয় সঙ্গী ছিল। বাল্যকাল হইতেই আমি স্বভাবতঃই মিতব্যয়ী ছিলাম— স্মাইল্‌সের’ বই পড়িয়া আমার সেই অভ্যাস দৃঢ়তর হইয়াছিল। স্পেন্‌সারের Introduction to the Study of Sociology আমার মনের উপর খুব প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘প্রভাতচিন্তা’ও আমার সঙ্গে ছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যজগতে পরিচিত হন নাই। আমার দুই বৎসর পূর্বে তিনি বিলাত গিয়াছিলেন এবং ‘ইউরোপযাত্রীর ডায়েরী’ নামক তাঁহার একখানি প্রকাশিত বহি সঙ্গে ছিল। সেলুনের লাইব্রেরিতে বসওয়েলের “জন্‌সনের জীবনচরিত”ও একখণ্ড ছিল—উহা পড়িয়া আমি মুগ্ধ হইতাম।

 আমরা যথাসময়ে গ্রেভসেণ্ডে পৌঁছিলাম। কলিকাতা হইতে গ্রেভসেণ্ডে পৌঁছিতে আমাদের ৩৩ দিন লাগিয়াছিল। সেখান হইতে লণ্ডনের ফেন চার্চ ষ্টীট ষ্টেশনে গেলাম। প্ল্যাটফর্মে জগদীশচন্দ্র বসু এবং সত্যরঞ্জন দাশ (ভারত গবর্ণমেণ্টের ভূতপূর্ব আইন সচিব মিঃ এস, আর, দাশের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) আমাদের অভ্যর্থনা করিলেন। ডি, এন, রায় এবং আমি প্রায় এক সপ্তাহ তাঁহাদের নিকট থাকিয়া লণ্ডনের অনেক দৃশ্য দেখিলাম। সিংহভ্রাতারা (পরলোকগত কর্ণেল এন, পি, সিংহ আই, এম, এস এবং পরলোকগত লর্ড সিংহ) সৌজন্য সহকারে আমাদের পথপ্রদর্শক ‘পাণ্ডা’ হইলেন।

 টেমস নদীর উপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীর জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য আমি আমার সম্মুখে প্রত্যক্ষ দেখিলাম। এই সহর এতদূর ব্যাপিয়া যে, দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। আমরা রিজেণ্ট পার্কের নিকটে প্লষ্টার রোডে বাসা লইলাম। এই অঞ্চল রাস্তার গাড়ীঘোড়ার কোলাহল হইতে মুক্ত ছিল। এই রাস্তা এবং ইহার নিকটবর্তী রাস্তায় ঠিক একই ধরণে তৈয়ারী বাড়ী, দেখিতে ঠিক একই রকম। ল্যাণ্ডলেডী তোমাকে একটা বাহিরের দরজার চাবি দিবেন। কিন্তু তুমি যদি সহরে নবাগত হও, কিম্বা অনেক রাত্রিতে বাড়ীতে ফিরিবার পথে বাড়ীর নম্বর ভুলিয়া যাও, তাহা হইলে তোমার দুর্দশার শেষ নাই। যদি তোমাকে সহরের কোন দূরবর্তী স্থানে যাইতে হয়, তাহা হইলে তোমাকে Vade-mecum বা লণ্ডনের মানচিত্র দেখিতেই হইবে। এবং তারপর যথাস্থান ঠিক করিয়া নির্দিষ্ট বাস গাড়ী বা ভূ-নিম্নস্থ রেলগাড়ীতে চড়িতে হইবে। নতুবা তোমার গোলকধাঁধায় পড়িয়া হাবডুবু খাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। ১৮৮২ সালের প্রথম ভাগেও লণ্ডনে ‘টিউব’ রেল ছিল না। লণ্ডনে যাঁহারা জীবনের অধিকাংশ সময় যাপন করিয়াছেন, এমন কি যাঁহারা সেখানে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন ও লালিতপালিত হইয়াছেন, তাঁহারাও ‘ম্যাপ’ না দেখিয়া লণ্ডনের রাস্তাঘাট ঠিক করিতে পারেন না। সৌভাগ্যক্রমে লণ্ডন পুলিশম্যান সর্বদাই তোমাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত। বিদেশীর প্রতি সে বিশেষরূপ মনোযোগ দেয় ও সৌজন্য প্রদর্শন করে। তাহার পকেটে ম্যাপ থাকে এবং রাস্তাঘাট তাহার নখদর্পণে। তুমি যে সংবাদই চাওনা কেন, তাহার জানা আছে। “এই পথে গিয়া বামদিকে তৃতীয় রাস্তার মোড় ঘুরিয়া সোজা গেলেই আপনি গন্তব্যস্থানে পৌছিবেন”। এই প্রসঙ্গে সেক্সপীয়রের “মার্চেণ্ট অব ভেনিস্” নাটকে ল্যন্সেলট্ গোবের অঞ্চলের রাস্তার বর্ণনা স্বভাবতই আমাদের মনে আসে।

 কখন লণ্ডন পুলিশম্যান তোমাকে ঠিক বাস গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করিতে বলিবে এবং গাড়ী আসিলে ড্রাইভারকে বলিয়া দিবে তোমাকে যেন ঠিক জায়গায় নামাইয়া দেয়। আমার ছাত্রাবস্থায় লণ্ডনের লোকসংখ্যা ৪০ লক্ষ ছিল—প্রায় স্কটল্যাণ্ড দেশের লোকসংখ্যার সমান। চতুর্থবার (১৯২০) আমি যখন বিলাত যাই, তখন দেখিলাম লণ্ডনের লোকসংখ্যা বাড়িয়া সত্তর লক্ষ হইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে সহরের আয়তনও বাড়িয়াছে। গ্রেটব্রিটেনের কয়েকটি বন্দর ও পোতাশ্রয়েরও বিরাট উন্নতি হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে লণ্ডন ছাড়া লিভারপুল, গ্লাসগো, গ্রীনক প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে।

 এ বিষয়ে আর বেশী বলিবার দরকার নাই। লণ্ডন সহরে আমার অবস্থিতির প্রথম সপ্তাহেই আমার সঙ্কোচ ও ভয়ের ভাব অনেকটা কাটিয়া গিরাছিল। কোন নূতন স্থানে প্রথম গেলে, অপরিচিত আবহাওয়ার মধ্যে লোকের মনে এইরূপ সঙ্কোচ ও ভয়ের ভাব আসে। আমি লণ্ডন হইতে এডিনবার্গ যাত্রা করিলাম। এডিনবার্গ বহুদিন হইতে বিদ্যাপীঠরূপে বিখ্যাত। মনস্তত্ত্ববিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষতঃ শেষোক্ত বিদ্যা শিখিবার জন্য দেশ বিদেশ হইতে ছাত্রেরা এডিনবার্গে আসিত। কয়েকজন বিখ্যাত অধ্যাপক রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা অধ্যাপনা করিতেন। কতকগুলি চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার্থী ভারতীর ছাত্রের সহিত আমার পরিচয় হইল। এডিনবার্গে এরূপ ছাত্রের সংখ্যা খুব কম ছিল না। মিস ই, এ, ম্যানিংও এডিনবার্গের কয়েকটী ভদ্রপরিবারের নিকট আমার জন্য পরিচয়পত্র দিয়াছিলেন। তখনকার দিনে লণ্ডনে ও বিলাতের অন্যান্য স্থানে যে সব ভারতীয় ছাত্র থাকিতেন, মিস, ই, এ, ম্যানিং তাহাদের উপকার করিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।

 এডিনবার্গ লণ্ডনের চারিশত মাইল উত্তরে, সতরাং লণ্ডন অপেক্ষা এখানে বেশী শীত। আমার লণ্ডনের বন্ধুরা এডিনবার্গের আবহাওয়ার কথা জানিতেন, সতরাং তাঁহারা আমার সঙ্গে প্রচুর গরম জামা প্রভৃতি দিয়াছিলেন, একটী “নিউমার্কেট” ওভারকোটও তাহার মধ্যে ছিল। এই সময়ে বিলাতী দর্জি ও পোষাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়, তাহা বেশ কৌতূহলপ্রদ। আমার সাধারণ পোষাক পরিচ্ছদের জন্য টটেনহাম কোর্ট রোডের দর্জির দোকান চার্লস বেকার এণ্ড কোম্পানীতে গেলাম। কিন্তু সান্ধ্য সম্মিলন, ডিনার, বল নাচ প্রভৃতির জন্য আমাকে বিশেষ “সুট” তৈরী করিবার পরামর্শ দেওয়া হইল। সেই কুৎসিত “টেইল-কোট” আমি কিছুতেই পছন্দ করিতে পারিলাম না। ইংরাজদের সাধারণ বুদ্ধি ও সহজজ্ঞান যথেষ্ট আছে। তৎসত্ত্বেও তাহারা এই বর্বর পোষাকের ‘ফ্যাশন’ কেন যে ত্যাগ করিতে পারে নাই, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। এ বিষয়ে তাহাদের ‘গেলিক’ ভ্রাতাগণের জিদও আশ্চর্য। সৌন্দর্যবোধের জন্য বিখ্যাত এবং চতুর্দশ লুইয়ের সময় হইতে ‘ফ্যাশনের’ পথ-প্রদর্শক ফ্রান্সের নিকট আমি এ সম্বন্ধে বেশি আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাকে নিরাশ হইতে হইল। ইংরাজেরা পোষাক পরিচ্ছদ এবং ডিনার (dinner) বিষয়ে যেভাবে ফরাসীদের অন্ধ অনুকরণ করে, তাহা আমার নিকট চিরদিনই নির্বুদ্ধিতা বলিয়া মনে হইয়াছে।

 সে যাহা হউক, এখন আমার কাহিনী বলি। চোগা ও চাপকানযুক্ত ভারতীয় লম্বা পোষাক সুপ্রসিদ্ধ রাজা রামমোহন রায় যাহা বিলাতে থাকিতে পরিতেন তাহাই ভারতীয়দের পক্ষে উপযোগী। আমাকে অক্সফোর্ড স্ট্রীটের চার্লস কীন এণ্ড কোম্পানীর দোকানে লইয়া যাওয়া হইল। বন্ধুদের নিকট ধার করিয়া একটা পোষাকের (চোগাচাপকানের) নমুনাও সঙ্গে লইলাম। দোকানে আমার গায়ের মাপ লইল এবং পোষাক তৈয়ারী হইলে পুনর্বার যাইয়া মাপ ঠিক করিয়া লইয়া আসিতে অনুরোধ করিল। পোষাক তৈরী হইলে আমাকে তাহারা সংবাদ দিল এবং দোকানে গেলাম। পোষাক পরিলে দেখা গেল যে যদিও মোটামটি গায়ে লাগিয়াছে, তবুও স্থানে স্থানে একটু ঢিলা হইয়াছে। দর্জি প্রথমে আমাকে এই ত্রুটি দেখাইয়া দিয়া কৈফিয়ৎ স্বরূপ বলিল— “মশায়, আপনি এত সরু ও পাতলা যে আপনার শরীরের জন্য মাপসই জামা করা শক্ত।” কোন কোন পাঠক হয়ত আমার এই দুর্দশায় হাসিবেন। সম্ভবতঃ আমার চেহারা অনেকটা ‘আইকাবড ক্রেনের’ মত ছিল। আমি এপিকটেটাসের শিষ্য এবং ডাইওজিনিসের অনুরাগী,—কৌপীনধারী মহাত্মা গান্ধীও আমার শ্রদ্ধার পাত্র,—অনাড়ম্বর সরল জীবন এবং জ্ঞান চর্চাই জীবনের আদর্শ, সতরাং এইরূপ লঘু বিষয়ের উল্লেখ করার জন্য পাঠকদের নিকট আমার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

 আমি আমার পাঠ্যস্থান এডিনবার্গে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌঁছিলাম। শীতের সেসন আরম্ভ হইবার তখন কয়েকদিন বাকী আছে। এডিনবার্গ সুন্দর সহর, লণ্ডনের আকাশ যেমন কুয়াশায় আচ্ছন্ন, এস্থান তেমন নহে। গ্লাসগোর মত এখানে কলকারখানা নাই, সুতরাং ধোঁয়ার উপদ্রবও কম, রাস্তার যানবাহনের অত্যাচারও তেমন নাই। এডিনবার্গের চারিদিকেই সুন্দর দৃশ্য, এবং সমদ্র খুবে নিকটে, আমি একটি মাঠের নিকটে এবং “আর্থার্স সিট” হইতে অল্পদূরে বাসা করিলাম। ছুটীর সময়ে “আর্থার্স সিট” আমার বড় প্রিয় স্থান ছিল। রবিবার দিন আমি পল্লীর মধ্য দিয়া হাঁটিয়া দূরবর্তী পাহাড়ে যাইতাম ও তাহার চূড়ায় উঠিতাম। সেই সময়ে সপ্তাহে ১২ শিলিং ৬ পেন্স দিলে, বেশ পছন্দসই একখানি বসিবার ঘর ও একখানি শয়নঘর পাওয়া যাইত। কয়লার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া লাগিত না। কয়লা স্তূপাকার করা থাকিত এবং ইচ্ছামত “ফায়ার প্লেসে”[] জ্বালানো যাইত। এক পেনীতে ‘পরিজ’ ও মিল্ক দিয়া পুষ্টিকর প্রাতরাশ মিলিত।

 সৌভাগ্যক্রমে আমার “ল্যাণ্ড লেডী” বড় ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁহার স্বামী ও সন্তানদের লইয়া বাড়ীর পিছনের অংশে থাকিতেন, রাস্তার ধারে সম্মুখের অংশ ভাড়া দিতেন। অন্যান্য স্কচ ‘ল্যাণ্ড লেডী’দের মত তিনি খুব সৎ ছিলেন এবং আমার নিকট সিকি পয়সাও অতিরিক্ত লইতেন না। মোজা প্রভৃতি ধোপাবাড়ী হইতে যতবার ধুইয়া আসিত, ল্যাণ্ড লেডীর মেয়ে প্রত্যেকবার মেরামত করিয়া দিতেন।

 স্কচ ‘ব্রথে’র তুলনা নাই,—ইহা যেমন সস্তা, তেমনি উৎকৃষ্ট। ‘স্কচ ব্রথের’ সম্পর্কে একটি ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। আমি একবার বড়দিনের সপ্তাহে সীমান্তে “বারউইক আপন টুইড” সহরে কাটাইয়াছিলাম। নিকটে জেডবার্গে পুরাতন গীর্জার ধ্বংসাবশেষ দেখিতে গেলাম। তুষারাচ্ছন্ন পথে পায়ে হাঁটিয়া গেলাম। অতীতের ধর্মমন্দির দেখিয়া ফিরিবার পথে কোন রেষ্টোরাঁর সন্ধান করিতে লাগিলাম। লোকে সামান্য একখানি ঘর আমাকে দেখাইয়া দিল এবং আমিও কতকটা দ্বিধা সঙ্কুচিত চিত্তে সেখানে প্রবেশ করিলাম। স্থানটী অনাড়ম্বর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাকে এক প্লেট ‘স্কচ ব্রথ’ ও বড় একখণ্ড রুঢ়ী পরিবেশন করিল। আমার জলযোগের পক্ষে সেই যথেষ্ট। মাত্র এক পেনি মূল্য আমাকে দিতে হইল। আমার সময়ে অতীতের ছাত্রদের সম্বন্ধে অনেক কাহিনী শোনা যাইত। কৃষকের ছেলেরা বাড়ী হইতে হাঁটিয়া, অথবা শকটে চড়িয়া বহুদূরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িতে যাইত। বাড়ী হইতে সঙ্গে ওটমিল (জই), ডিম, মাখন প্রভৃতি আনিত, এবং সেগুলি ফুরাইয়া গেলে, মাঝে মাঝে বাড়ী হইতে পুনর্বার আনাইয়া লইত। কার্লাইলের ‘জীবনী’ যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, তাঁহার ছাত্রাবস্থায়, এডিনবার্গে ছেলেরা কতদূর মিতব্যয়িতার সঙ্গে জীবনযাপন করিত। গত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে এডিনবার্গে, এমন কি, কলিকাতায় পর্যন্ত ছাত্রজীবনের বহু পরিবর্তন হইয়াছে। সুতরাং সেকালের ছাত্রজীবনের বর্ণনামূলক নিম্নলিখিত উদ্ধৃতাংশ পাঠকের নিকট কৌতূহলপ্রদ বোধ হইতে পারে:—

 “ইংরাজদের নিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বলিতে বুঝায় বড় বড় ইমারত, সুসজ্জিত গৃহ, বহু টাকার বৃত্তি; ১৯ বৎসর হইতে ২৩ বৎসর বয়স্ক তরুণ ছাত্রগণ; তাহাদের বাড়ী হইতে খরচের জন্য প্রচুর অর্থ আসে—জেমস কার্লাইলের জীবনের কোন এক বৎসরে যাহা সর্বোচ্চ আয় ছিল,—প্রত্যেক ছাত্র তাহার দ্বিগুণ অকাতরে ব্যয় করে। তখনকার দিনে টাইড নদীর উত্তর দিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোন আর্থিক পুরস্কার, ফেলোসিপ বা বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল না—ছিল শুধু বিদ্যা শেখার ব্যবস্থা এবং আত্মত্যাগ ও দারিদ্র্যের ব্রত। এইখানে যাহারা যাইত, তাহাদের অধিকাংশেরই পিতামাতা কার্লাইলের পিতার মতই দরিদ্র ছিল। ছাত্রেরা জানিত কত কষ্ট করিয়া তাহাদের পড়িবার খরচ পিতামাতারা যোগাইতেন। এবং ছাত্রজীবনের সদ্ব্যবহার তথা জ্ঞানার্জনের দৃঢ়সঙ্কল্প লইয়াই তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইত। বৎসরে পাঁচ মাস মাত্র তার ক্লাসে পড়িতে পারিত, বাকী সময় ছেলে পড়াইয়া অথবা গ্রামে ক্ষেতের কাজ করিয়া নিজের পড়িবার ব্যয় সংগ্রহ করিত।

 “সাধারণতঃ, যে সকল ছাত্র তাহাদের পরিবারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মেধাবী হইত এবং যাহাদের উপর পরিবারবর্গের যথেষ্ট আস্থা ছিল, চৌদ্দ বৎসর বয়সে সেই ছাত্রগণ এডিনবার্গ, গ্লাসগো প্রভৃতি সহরে প্রেরিত হইত। বাড়ী হইতে বাহির হইলে পথে অথবা গন্তব্য সহরে তাহাদের দেখাশুনা করিবার কেহ থাকিত না। যানের ভাড়া দিতে পারিত না বলিয়া তাহারা বাড়ী হইতে পায়ে হাঁটিয়া আসিত। কলেজে নিজেরাই নাম ভর্তি করাইত। নিজেরা বাসা ঠিক করিত এবং স্বভাবচরিত্রের জন্য কেবলমাত্র নিজেদের উপরেই নির্ভর করিত। গ্রামের বাড়ী হইতে মাঝে মাঝে লোক আসিয়া ওট মিল (ছাতু), আদা, লবণাক্ত মাখন প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য দিয়া যাইত। কখন কখন কিছু ডিমও দিত। তাহাদের মিতব্যয়িতার গুণে অন্য কোন খাদ্য আর তাহাদের দরকার হইত না। যাহারা খাদ্যদ্রব্য আনিত তাহাদের সঙ্গেই ময়লা পোষাক বাড়ীতে মায়েদের নিকট ধোওয়া ও মেরামতীর জন্য পাঠাইত। বিষাক্ত আমোদ প্রমোদের হাত হইতে দারিদ্র্যই তাহাদিগকে রক্ষা করিত। নিজেদের মধ্যে তাহারা বন্ধুত্ব করিত, পরস্পর পানভোজন ও ভাববিনিময় করিত। কথাবার্তা ও আলোচনার জন্য তাহাদের নিজেদের ক্লাবও থাকিত। “টারম্” শেষ বা কলেজ বন্ধ হইলে তাহারা দল বাঁধিয়া পদব্রজে বাড়ী যাইত, প্রত্যেক জেলারই ২। ৪ জন ছাত্র সেই দলে থাকিত। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সুপরিচিত ছিল, পথে তাহাদের আতিথ্য এবং আদর অভ্যর্থনার অভাব হইত না।

 “স্বাবলম্বনের শিক্ষা হিসাবে, এমন উৎকৃষ্ট শিক্ষালাভের ব্যবস্থা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আর দেখা যাইত না।” (Froude’s Life of Carlyle).

 তাহার পরে কয়েকবার আমি এডিনবার্গ ও অন্যান্য স্কচ সহরে গিয়াছি। কিন্তু সহরের জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। হাইল্যাণ্ড এখন আর শান্তিপূর্ণ নির্জন স্থান নহে। ঔপন্যাসিক স্কটের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা, বিচিত্র পার্বত্য দৃশ্য, রেলওয়ে, মোটরবাস—এই সকলের ফলে দলে দলে ভ্রমণকারীরা এখন ‘হাইল্যাণ্ডে’ যায়, তাহাদের মধ্যে কোটিপতি আমেরিকাবাসীরাও থাকে। তাহারা প্রত্যেক ‘সিজনে’র জন্য বাড়ীভাড়াও করে। স্কচেরা কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাহসিক ও পরিশ্রমী জাতি। পাটের কল, পাটের ব্যবসা ডাণ্ডিসহরের একচেটিয়া; হুগলী নদীর উপরে প্রায় ৭০। ৮০টী পাটের কল আছে, তাহার অধিকাংশ সুচতুর স্কচদের দ্বারাই পরিচালিত। গ্লাসগো লণ্ডনের পরেই গণনীয় সহর। গত ৫০ বৎসরে স্কটল্যাণ্ডের ঐশ্বর্য প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এডিনবার্গ সহরেরও দ্রুত পরিবর্তন হইয়াছে। এডিনবার্গ ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র নহে; কিন্তু প্রচুর পেন্সনভোগী অবসরপ্রাপ্ত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান এবং বিদেশে প্রভূত ধনসঞ্চয়কারী ব্যবসায়ী প্রভৃতি এডিনবার্গে বাস করাই পছন্দ করেন।

 এডিনবার্গ সহরের চারিদিকে সুন্দর বাসভবন গড়িয়া উঠিতেছে—নূতন সহর, দ্রুত বিস্তৃত হইতেছে। অধিবাসীদের সরল মিতব্যয়ী জীবন অদৃশ্য হইয়াছে এবং বর্তমান যুগের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন প্রণালী গ্রহণ করিতে তাহারা পশ্চাৎপদ হইতেছে না। স্কটল্যাণ্ডের জাতীয় কবি বার্নস বিলাসিতার যে তীব্র নিন্দা করিয়াছিলেন, তাহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে।

 শীতের সেসনের প্রথমেই আমি ভর্তি হইলাম এবং প্রাথমিক বি, এস্-সি, পরীক্ষার জন্য রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা অধ্যয়ন করিতে লাগিলাম। গ্রীষ্ম সেসনের জন্য উদ্ভিদবিদ্যা রহিল, কেন না শরৎকালে ঐ দেশে গাছপালার পত্রপুষ্প সব ঝরিয়া পড়ে। শীতকালে গাছগুলি একেবারে পত্রশূন্য হয় এবং তাহাদের কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখা অনেক সময় তুষারাচ্ছন্ন থাকে। অধ্যাপক টেইট পদার্থবিদ্যার মূল সূত্র চমৎকার বুঝাইতেন। কিন্তু আমি স্বীকার করিতে বাধ্য যে পদার্থবিদ্যার পাঠ্য হিসাবে টেইট ও টমসনের Natural Philosophy নামক যে পুস্তক নির্দিষ্ট ছিল, তাহা একটু দূরূহ এবং আমার পক্ষে দুর্বোধ্য বলিয়া মনে হইত। আমি পর পর দুই সেসনে টেইটের দুইটি ধারাবাহিক বক্তৃতা শুনিয়াছিলাম কিন্তু আমি শীঘ্রই বুঝিতে পারিলাম রসায়নই আমার মনোমত বিদ্যা। কলিকাতায় থাকাতেই আমি এই বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হই। এক্ষণে আমি নিষ্ঠা সহকারে এই বিদ্যার সেবা করিতে লাগিলাম, যদিও অন্যান্য বিদ্যাও অবহেলা করি নাই।

 আমাদের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক আলেকজাণ্ডার ক্রাম ব্রাউনের বয়স তখন ৪৪ বৎসর। জুনিয়র ক্লাসে ৪০০ হইতে ৫০০ পর্যন্ত medical ছাত্র থাকিত, তাহাদের প্রায় সকলেই পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইত। গৃহ হইতে সদ্য আগত স্কচ যুবকেরা স্বভাবতই তেজ ও উৎসাহে জীবন্ত; অধ্যাপক ক্লাসে আসিতেই তাহারা মহা আড়ম্বরে তাঁহার অভ্যর্থনা করিত। তাঁহার আসিবার পূর্বে হইতেই তাহারা গান গাহিতে আরম্ভ করিত। এত বড় ক্লাস ঠিক রাখা শক্ত কাজ, ক্রাম ব্রাউনও ক্লাসে এতগুলি ছেলের সম্মুখে আসিয়াই একটু চঞ্চল হইয়া পড়িতেন। ছাত্রেরা তাঁহার এই দৌর্বল্য শীঘ্রই ধরিয়া ফেলিত, ফলে মাঝে মাঝে নাটকীয় ঘটনা এমন কি শোচনীয় ব্যাপারও ঘটিত। ক্রাম ব্রাউন যখনই চাঞ্চল্য দেখাইতেন, তখনই ছেলেরা তাহার সুযোগ লইত। তাহারা মেজের উপর বুট ঘষিত, মেজে ঠুকিত বা ঐরূপ আরও কিছু করিত। ইহার ফলে অধ্যাপকের চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাইত। “ভদ্রগণ, তোমরা এমন করিতে থাকিলে, আমি বক্তৃতা করিতে পারিব না।” এই আবেদনে সুফল হইত, ছেলেরা শান্ত হইত। ক্রাম ব্রাউন অমায়িক ও উদারমনা এবং খাঁটি ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি চীনা ভাষাও কিঞ্চিৎ জানিতেন। তাঁহার তীক্ষ মেধা জটিল গণিতের সমস্যা সহজেই সমাধান করিতে পারিত, শরীর তত্ত্বে কর্ণ সম্বন্ধে তাঁহার কিছু নূতন দানও ছিল। তাঁহার সহযোগী টমাস ফ্রেজার ও তাঁহাকে ‘ফার্মাকোলজী’র একটা নূতন শাখার প্রতিষ্ঠাতা রূপে গণ্য করা যাইতে পারে। উচ্চতর ক্লাসে, Crystallography প্রভৃতি জটিল বিষয়ের অধ্যাপনাতেই তাঁহার গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় ভাল করিয়া পাওয়া যাইত। তখনকার দিনে কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড প্রভৃতি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পারিশ্রমিকের তুলনায় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পারিশ্রমিক “রাজোচিত” ছিল বলিলেই হয়। সমস্ত ‘ফিস’ অর্থাৎ ছাত্রদত্ত বেতন তাঁহারা পাইতেন। বেতনের পরিমাণ সাধারণ ক্লাসের জন্য ৪ গিনি এবং প্র্যাকটিক্যাল বা ফলিত বিষয়ের জন্য ৩ গিনি ছিল।

 ক্রাম ব্রাউন তখন মোটা ও অলস হইয়া পড়িতেছিলেন। তিনি চিন্তা করিতে ভাল বাসিতেন এবং জৈব রসায়নের ছাত্রেরা তাঁহারা আবিষ্কৃত Graphic formula-র জন্য তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিবে, কেননা ইহা রসায়ন শাস্ত্রের উন্নতিতে বহুল পরিমাণে সহায়তা করিয়াছে। তিনি ব্যবহারিক ‘ক্লাসে’ বা লেবরীটরীতে কাজ করিতেন না বটে, কিন্তু সেজন্য যোগ্য ডিমনস্ট্রেটর ও সহকারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত ডাঃ জন গিবসন ও ডাঃ লিওনার্ড ডবিনের নাম উল্লেখযোগ্য। গিবসন হাইডেলবার্গে প্রসিদ্ধ রসায়নবিৎ বুনসেনের নিকট পড়িয়াছিলেন, এবং তাঁহার পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ প্রণালী উক্ত জার্মান অধ্যাপকের রীতি অনুযায়ীই ছিল আমার পড়াশুনো বেশ ভাল হইতে লাগিল—এই দুইজন ডিমনস্ট্রেটরের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হইল। কিরপ আনন্দ ও উৎসাহ সহকারে আমি আমার প্রিয় বিজ্ঞানসমূহ অধ্যয়ন করিতাম তাহা এই ৫০ বৎসর পরেও মনে পড়িতেছে। আমি জার্মান ভাষা মোটামুটী শিখিলাম, তাহার ফলে উক্ত ভাষায় লিখিত রসায়ন শাস্ত্র বুঝিতে পারিতাম। আমার একজন সহাধ্যায়ী ছিলেন জেমস ওয়াকার (পরে স্যার জেমস ওয়াকার)। তিনি ডাণ্ডীর অধিবাসী ছিলেন। ক্রাম ব্রাউন অবসর গ্রহণ করিলে, ওয়াকারই ঐ পদ লাভ করেন। আমার সমসাময়িক ‘জুনিয়র’ ছাত্র আর দুইজন খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। একজন আলেকজাণ্ডার স্মিথ, ইনি পরে চিকাগো ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। অন্য একজন হিউ মার্শাল, ইনি ‘কোবাল্ট অ্যালাম’ আবিষ্কার এবং ‘পারসালফারিকা অ্যাসিড’ সম্বন্ধে গবেষণা করিবার জন্য বিখ্যাত। মার্শাল মাত্র ৪৫ বৎসর (১৯১৩ খৃঃ) বয়সে মারা যান। ৫৭ বৎসর বয়সে (১৯২২ খৃঃ) স্মিথের মৃত্যু হয়।[]

 আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতেছিলাম তখন এমন একটি ঘটনা ঘটে, যাহার দ্বারা আমার সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবন প্রভাবাম্বিত হয়। সতরাং ঐ ঘটনাটি এখানে উল্লেখযোগ্য। স্যার ষ্ট্যাফোর্ড নর্থকোট ১৮৬৭-৬৮ সালে ভারতসচিব ছিলেন। ইনিই পরে লর্ড ইড্‌স্‌লি উপাধি লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টাররূপে ইনি ঘোষণা করেন যে “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা” সম্বন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধের জন্য একটী পুরস্কার দেওয়া হইবে। তখন আমি লেবরীটরীতে বিশেষ পরিশ্রম করিতেছিলাম এবং বি, এস্-সি, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। তৎসত্ত্বেও আমি প্রবন্ধপ্রতিযোগিতায় যোগ দিলাম। আমার ইতিহাসচর্চার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পুনরায় জাগ্রত হইল এবং কিছুকালের জন্য রসায়ন শাস্ত্রের স্থান অধিকার করিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী হইতে আমি ভারত সম্বন্ধে বহু গ্রন্থ আনিয়া অধ্যয়ন করিতে লাগিলাম। রুসেলের “L’Inde des Rajas”, Lanoye’s “L’Inde contemporaine”, “Revue des deux mondes” এ ভারত সম্বন্ধে প্রবন্ধাবলী প্রভৃতি ফরাসী ভাষায় লিখিত গ্রন্থও এই উদ্দেশ্যে পড়িলাম। আমি শীঘ্রই দেখিলাম যে বাজেট আলোচনা এবং রাজনীতি, বিনিময়নীতি প্রভৃতি বুঝিতে হইলে অর্থনীতি (Political Economy) কিছু জানা দরকার। আমি সেইজন্য ফসেটের Political Economy এবং Essays on Indian Finance গ্রন্থ পড়িলাম। এই অন্ধ অর্থনীতিবিৎ হ্যাকনীর প্রতিনিধিরূপে পার্লামেণ্টে প্রবেশ করেন এবং ভারতীয় সমস্যা সম্বন্ধে তাঁহার গভীর জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বাল্যকালে “হিন্দু পেট্রিয়টে” আমি পড়িয়াছিলাম, মিঃ ফসেট পার্লামেণ্টে ভারতের বহু উপকার করিয়া ভারতবাসীদের ভালবাসা লাভ করেন। সাধারণের নিকট হইতে তাঁহার ভারতপ্রীতির জন্য “Member for India” বা ‘ভারতের প্রতিনিধি’ এই আখ্যাও তিনি লাভ করেন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে ভারত সম্বন্ধে বহু প্রামাণিক গ্রন্থই আমি পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। “ফর্ট নাইট্‌লি রিভিউ”, “কনটেম্‌পোরারি রিভিউ”, ‘নাইনটিথ সেঞ্চুরী’ প্রভৃতি মাসিকপত্রে প্রকাশিত ভারত সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ আমার দৃষ্টি এড়াইত না। কতকগুলি প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক সমস্যা সম্বন্ধে পার্লামেণ্টে তর্কবিতর্ক ও আলোচনাও আমি পুরাতন “হ্যানসার্ডে” (পার্লিয়ামেণ্টে ঐ বক্তৃতার রিপোর্ট) পড়িয়াছিলাম।

 গ্রন্থ রচনায় বিশেষতঃ এই শ্রেণীর রচনায় আমি নূতন ব্রতী। কিন্তু ভারতবাসী হিসাবে আমি এই সুযোগ পরিত্যাগ করা সঙ্গত মনে করিলাম না। আমি বহু উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলাম, এখন সেইগুলি সাজাইয়া লিখিতে আরম্ভ করিলাম। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আলোচ্য বিষয়ের সার বস্তু গুছাইয়া বলিতে পারাতেই প্রবন্ধ লেখকের কৃতিত্ব। বহু ভাষণ ও বহুবিস্তৃতি সর্বদা পরিহার করাই কর্তব্য। আমি আলোচ্য বিষয় দুই ভাগে বিভক্ত করিলাম। প্রথম ভাগে ৪টি অধ্যায় এবং দ্বিতীয় ভাগে ৩টি অধ্যায় সন্নিবিষ্ট করিলাম। আমার চিন্তাস্রোত দ্রুত প্রবাহিত হইতে লাগিল এবং আমি দেখিয়া বিস্মিত হইলাম যে, “টেস্ট টিউবের” ন্যায় লেখনীও আমি বেশ সহজভাবে চালনা করিতে পারি।

 যথাসময়ে আমি আমার প্রবন্ধ দাখিল করিলাম। উপরে একটি “মটো” থাকিল এবং সঙ্গে একটি সিলমোহর করা খামে আমার নাম রহিল। প্রবন্ধ পরীক্ষার ফল ঘোষিত হইলে আমি একপ্রকার “বিষাদ মিশ্রিত আনন্দ” অনুভব করিলাম। পুরষ্কার আমি পাই নাই, অন্য একজন প্রতিযোগী তাহা লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু আমার এবং অন্য একজনের প্রবন্ধ proxime accesserunt অর্থাৎ আদর্শের কাছাকাছি বলিয়া গণ্য হইয়াছিল।

 আমার হাতের লেখা খারাপ, সেকালে টাইপরাইটারও ছিল না। এদিকে আমি প্রবন্ধের কোন নকলও রাখি নাই। আমি প্রবন্ধটি নিজব্যয়ে প্রকাশ করিব বলিয়া ফেরত চাহিয়া পাঠাইলাম। আবেদন গ্রাহ্য হইল। প্রবন্ধ ফেরত পাইলে দেখিলাম উহাতে প্রবন্ধপরীক্ষকদের একজনের মন্তব্য লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। আমি তাহা হইতে কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করিতেছি। কেন না কথাকয়টি আমার মনে গাঁথা রহিয়াছে।

 “আর একটী উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ যেটিতে মটো আছে। ...... ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইহা শ্লেষপূর্ণ আক্রমণে পূর্ণ।” পরে আমি জানিতে পারি সার উইলিয়ম মুয়র এবং প্রোফেসার ম্যাসন প্রবন্ধপরীক্ষক ছিলেন। মুয়র একজন খ্যাতনামা আংলোইণ্ডিয়ান শাসক ছিলেন। তিনি যুক্ত প্রদেশের গবর্ণরপদেও কিছুকাল সমাসীন ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর কিছুদিন ভারত সচিবের কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। স্যার আলেকজেণ্ডার গ্রাণ্টের মৃত্যুর পর তাঁহাকেই এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হইয়াছিল। মুয়র Life of Mahomet (মহম্মদের জীবনী) লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করেন। এই গ্রন্থে তাঁহার আরবী ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

 ১৮৮৫ সালে সেসনের উদ্বোধন করিবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্বোধন করিয়া মুয়র যে বক্তৃতা করেন তাহাতে তিনি অন্য দুইটি প্রবন্ধ ও আমার প্রবন্ধের উল্লেখ করিয়া বিশেষ প্রশংসা করেন। আমি প্রধানতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রবন্ধটি পুস্তকাকারে ছাপাই। উহার সঙ্গে ছাত্রদের প্রতি একটি নিবেদনপত্রও ছিল। পরে সাধারণ পাঠকদের জন্যও আমি পুস্তকের একটি সংস্করণ প্রকাশ করি। তৎকালে “ভিক্ষা নীতি”তে আমি বিশ্বাসী ছিলাম এবং শিশু সুলভ সরলতার সহিত আমি ভাবিতাম যে, ভারতের দঃখ দুর্দশার কথা যদি ব্রিটিশ জনসাধারণের গোচর করা যায় তাহা হইলেই সেগুলির প্রতিকার হইবে। আমার এই মোহ ভঙ্গ হইতে বেশী দিন লাগে নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি দৃষ্টান্ত নাই যে, প্রভুজাতি স্বেচ্ছায় পরাধীন জাতিকে কোন কিছু অধিকার দিয়াছে। ইংলণ্ডের মত স্বাধীন দেশেও ব্যারনেরা কৃষকদের সঙ্গে মিলিত হইয়া রাজা জনের অনিচ্ছুক হস্ত হইতে “ম্যাগ্‌না কার্টা” কাড়িয়া লইয়াছিল। No taxation without representation—পার্লামেণ্টে নির্বাচনের অধিকার ব্যতীত দেশবাসীরা ট্যাক্স দিবে না—শাসনতন্ত্রের এই মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করিতে ব্রিটিশ জাতিকে গৃহযুদ্ধ করিয়া রক্তস্রোত বহাইতে হইয়াছিল। আমার বহিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি যে নিবেদন ছিল, তাহা হইতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি।

 “ভারত-ব্যাপারে ইংলণ্ডের গভীর অবহেলা ও ঔদাসীন্যের ফলেই ভারতের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার উৎপত্তি; ইংলণ্ড এ পর্যন্ত ভারতের প্রতি তাহার পবিত্র কর্তব্য পালন করে নাই। তোমরা গ্রেটব্রিটেন ও আয়র্লাণ্ডের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ, ভারতে অধিকতর উদার, ন্যায়সঙ্গত ও সহৃদয় শাসন নীতি অবলম্বনের জন্য তোমাদের দিকেই আমরা চাহিয়া আছি। সেই শাসননীতির উদ্দেশ্য কতকগুলি মামুলী বুলি হইবে না, তাহার উদ্দেশ্য হইবে ইংলণ্ড ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন। তোমাদের উপরই আমাদের সমস্ত আশা ভরসা। শীঘ্রই এমন দিন আসিবে যে তোমাদিগকেই সেই সাম্রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনার ভার গ্রহণের জন্য আহ্বান করা যাইবে—যে সাম্রাজ্যে সূর্য কখন অস্ত যায় না এবং যাহার রাষ্ট্রিক বলিয়া আমরা গৌরবান্বিত। অদূর ভবিষ্যতে তোমরাই ২৫ কোটী মানবের ভাগ্যবিধাতা হইবে। আমরা আশা করি যে তোমরা যখন রাজ্যশাসনের ক্ষমতা পাইবে, তখন বর্তমান অ-ব্রিটিশ নীতির অবসান হইবে এবং ভারতে এখনকার চেয়ে উজ্জ্বল ও সুখময় যুগের উদয় হইবে।”

 আমি জন ব্রাইটের নিকট বহির একখণ্ড পাঠাইলাম। ঐ সঙ্গে একটী পত্রে ভারতের সঙ্গে ব্রহ্মদেশভুক্তি এবং তাহার ফলে ভারতবাসীদের উপর লবণশুল্ক বাবদ ট্যাক্সবৃদ্ধির অন্যায় নীতির প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলাম। ব্রাইট সুন্দর একখানি পত্রে আমাকে প্রত্যুত্তর দিলেন। উহার সঙ্গে পৃথক একখানি কাগজে লেখা ছিল— “এই পত্র আপনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করিতে পারেন।” আমি তৎক্ষণাৎ টাইম্‌স্ ও অন্যান্য সংবাদপত্রে জন ব্রাইটের পত্রের নকল পাঠাইয়া দিলাম। একদিন সকালে উঠিয়া দেখি যে, আমি কতকটা বিখ্যাত লোক হইয়া পড়িয়াছি। খবরের কাগজের বড় বড় ‘পোষ্টারে’ বাহির হইল— “ভারতীয় ছাত্রের নিকট জন ব্রাইটের পত্র”। রয়টারও ঐ পত্রের নিম্নলিখিত সারমর্ম ভারতে তার করিয়া পাঠাইলেন।

 “আমি আপনারই মত লর্ড ডাফরিনের বর্মানীতির জন্য দুঃখিত এবং তাহার তীব্র নিন্দা করি। পুরাতন পাপ ও অপরাধের নীতির ইহা পুনরাবৃত্তি—যে নীতি চিরদিনের জন্য পরিত্যক্ত হইয়াছে বলিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম। ভারতে আমাদের প্রকৃত স্বার্থ কি, তৎসম্বন্ধে এখানকার জনসাধারণের মধ্যে গভীর অজ্ঞতা—সঙ্গে সঙ্গে ঘোর স্বার্থপরতাও রহিয়াছে। সন্নীতি এবং প্রকৃত রাজনীতিজ্ঞতা হইতে ভ্রষ্ট হইলে আমাদের বিপদ ও ধ্বংস অনিবার্য এবং আমাদের বংশধরগণের তাহার জন্য আক্ষেপ করিতে হইবে।”

 অর্ধশতাব্দী পূর্বে লিখিত আমার Essay on India পুস্তিকা হইতে কয়েকছত্র এখানে উদ্ধৃত করিলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। ঐ প্রবন্ধ ১৮৮৬ সালে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। আমার মনে হয়, পরবর্তীকালে আমার রচনাশক্তির অধোগতি হইয়াছে। ৫০ বৎসর পূর্বে আমার রচনারীতি যেরূপ স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ছিল, এখন আর সেরূপ নাই। সম্ভবতঃ রাসায়নিক গবেষণায় নিমগ্ন থাকিবার জন্যই এইরূপে ঘটিয়াছে।

(Essay on India (ভারত বিষয়ক প্রবন্ধ) হইতে উদ্ধৃত)

 “ইংলণ্ড ভারতের সামাজিক উন্নতির জন্য যাহা করিয়াছে তাহা ইঙ্গ-ভারতীয় ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। রাশিয়া মধ্যে মধ্যে তাহার বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দের, কিন্তু ইংলণ্ড অর্ধ-শতাব্দীরও অধিক কাল ধরিয়া সরকারী কলেজ সমূহে লক, বার্ক, হ্যালাম এবং মেকলের গ্রন্থাবলী বিনা দ্বিধায় পাঠ্য পুস্তকরূপে নির্দিষ্ট করিয়াছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মন এইরূপে নিয়মতন্ত্রের মূল সূত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছে। তাঁহাদের প্রত্যেকে এখন রাজনৈতিক বৃদ্ধির এক একটি কেন্দ্রস্বরপ এবং তাহা হইতে নানারূপ চিন্তাধারা বিকীর্ণ হয় এবং অপেক্ষাকৃত অশিক্ষিত লোকেরা তাহা গ্রহণ করে। ভারতে এখন যে সব ঘটনা ঘটিতেছে, বিলাতের জনসাধারণকে তৎসম্বন্ধে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে। সমাজের উচ্চস্তরে যে সমস্ত চিন্তা ও ভাব বিস্তৃত হইয়াছে, তাহা এখন নিম্নস্তরে প্রবেশ করিতেছে। জনসাধারণ তাহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতেছে। ইহাকে নগণ্য বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে ইংলণ্ড এখন অপরিহার্য তথ্য ও যুক্তি স্বীকার করিতে প্রস্তুত নয় এবং ভারতের নব উদ্বোধিত জাতীয়তার ভাবকে সে পিষিয়া মারিতে চেষ্টার ত্রুটী করিতেছে না। বিদেশী শাসনের স্বার্থপর কঠোর ও নিষ্ঠুর নীতির ফলে দেশবাসীর উপর নানারূপ অযোগ্যতা ও অক্ষমতার ভার চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে। যে মুহূর্তে কোন ভারতবাসী নিজেদের সম্বন্ধে চিন্তা করিতে আরম্ভ করে, সেই মুহূর্তেই সে সম্ভবতঃ নিজের জন্য লজ্জা অনুভব করে। আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে সে আকাশ পাতাল প্রভেদ দেখে। ব্রিটিশ রাজনীতিকদের কথা ও কার্যের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠে। দূরদৃষ্টি বলে পূর্ব হইতে সময়ের গতি বুঝা, অন্ততঃপক্ষে উহা অনুমান করা—এবং তদনুসারে কার্য করা বিজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞের লক্ষণ। ফরাসী বিপ্লব যে এত শক্তিশালী হইয়াছিল, তাহার কারণ তাহার মূলে ছিল মানসিক বিদ্রোহ। ডল্‌টেয়ার স্বদেশ হইতে নির্বাসিত হইয়া একজন বিদেশী রাজার অনুগ্রহে জীবন ধারণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি জগতের মনের উপর অধিকতর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। রুসোর জীবনই বা কি? কঠোরতম দারিদ্র্যও তাঁহার আত্মার শক্তি ও ভাবধারাকে রোধ করিতে পারে নাই। কার্লাইল বলিয়াছেন—‘প্যারিসের গ্যারেটে (চিল কুঠুরীতে) নির্বাসিত, নিজের দুঃখময় চিন্তামাত্র সঙ্গী, স্থান হইতে স্থানান্তরে বিতাড়িত, উত্যক্ত, নির্যাতিত হইয়া রুসো গভীরভাবে চিন্তা করিতে শিখিয়াছিলেন যে, এই জগত তাঁহার বন্ধু নহে, জগতের বিধিবিধানও তাঁহার সহায় নহে। তাঁহাকে গ্যারেটে বন্দী করা যাইতে পারিত, উম্মাদ ভাবিয়া তাঁহাকে উপহাস করা যাইতে পারিত, বন্য পশুর মত খাঁচায় পুরিয়া তাঁহাকে অনাহারে শুকাইয়াও মারা যাইত,—কিন্তু সমস্ত জগতে বিদ্রোহের অনল প্রজ্বলিত করিতে কেহ তাঁহাকে বাধা দিতে পারে নাই। ফরাসী বিদ্রোহ রুসোর মধ্যেই তাহার প্রচারকের সন্ধান পাইয়াছিল।’

 “একদিকে রূঢ়, কঠোর, অনমনীয় ঔদ্ধত্য, অন্যদিকে হেয় আত্মসমর্পণ, এই দুয়ের মধ্যবর্তী কোন সম্মানজনক পন্থা কি নাই? আমরা অদ্ভুত যুগে বাস করিতেছি। শত শতাব্দীর পুরাতন প্রতিষ্ঠানও কয়েকদিনের মধ্যে “সুবিধাবাদীদের সংরক্ষিত দুর্গ” রূপে কলঙ্কিত হইতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে আর একজন হাওয়ার্থ আবির্ভূত হইয়া ইণ্ডিয়া কাউন্সিল এবং সেই শ্রেণীর অন্যান্য ‘ব্যুরো’কে যে তীব্র ভাষায় নিন্দা করিবেন না, তাহা কে বলিতে পারে? জোড়াতালি বা গোঁজামিল দেওয়া সংশয়পূর্ণ নীতি অন্যত্র পরীক্ষিত ও ব্যর্থ হইয়াছে। ৫০ বৎসর ধরিয়া আয়র্লাণ্ডকে “অনুগ্রহ করিবার নীতি” তাহাকে অধিকতর বিদ্বেষভাবাপন্ন করিয়া তুলিয়াছে। আয়র্লাণ্ডের শিক্ষা কি ভারত সম্বন্ধে কোনই কাজে লাগিবে না?

 “আমরা দেখিতেছি, এক শ্রেণীর লেখক কোন কোন স্বেচ্ছাচারী ধর্মান্ধ মুসলমান রাজাকে খাড়া করিয়া তাহাদের শাসননীতির সঙ্গে বর্তমান ব্রিটিশ শাসনের তুলনা করিতে ভালবাসেন। ইহা ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত বটে। কিন্তু মুসলমান শাসন কি ব্রিটিশ শাসনের তুলনায় হীন প্রতিপন্ন হইবে? একথা ভুলিলে চলিবে না, যখন রাণী মেরী ধর্মসম্বন্ধীয় মতভেদ ও গোঁড়ামির জন্য নিজের প্রজাদিগকে অগ্নিকুণ্ডে বা কারাগারে নিক্ষেপ করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে পরাক্লান্ত মোগল বাদশাহ আকবর সর্বধর্মের প্রতি উদারনীতি ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং মৌলবী, পণ্ডিত, রাবি, এবং মিশনারীকে দরবারে আহ্বান করিয়া তাঁহাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের সম্বন্ধে দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কেহ হয়ত একথা বলিতে পারেন যে, আকবরের কথা স্বতন্ত্র, তাঁহাকে মোগলদের প্রতিনিধি গণ্য করা যাইতে পারে না। ইহা অত্যন্ত ভ্রান্ত কথা। ধর্ম বিষয়ে উদারতা মোগল বাদশাহদের পক্ষে সাধারণ নিয়ম ছিল, বিরল ঘটনা ছিল না।”

 উত্তর প্রদেশের প্রধান সংবাদ পত্র “স্কটসম্যান” এই প্রবন্ধ সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলেন,—“এই ক্ষুদ্র বহিখানি খুবই চিত্তাকর্ষক। ইহাতে ভারত সম্বন্ধে এমন অনেক তথ্য আছে, যাহা অন্যত্র পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থের প্রতি সকলের দৃষ্টি আমরা বিশেষভাবে আকর্ষণ করিতেছি।” কিন্তু এই ঐতিহাসিক আলোচনার উৎসাহ আমাকে সংযত করিতে হইল। আমার শীঘ্রই বি, এস্-সি, পরীক্ষা দিবার কথা, এবং রসায়নশাস্ত্রের দাবী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য উপেক্ষা করা যায় না। আমি গভীরভাবে আমার প্রিয় রসায়নশাস্ত্রের আলোচনায় আত্মনিয়োগ করিলাম। বি, এস্-সি, ডিগ্রী পাওয়ার পর আমাকে ‘ডক্টর’ (D. Sc.) উপাধির জন্য প্রস্তুত হইতে হইল; এজন্য কোন মৌলিক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ দাখিল করা প্রয়োজন। লেবরেটরীতে গবেষণা এবং ইংরাজী, ফরাসী, ও জার্মাণ ভাষায় লিখিত রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন—ইহাতেই আমার সময় কাটিতে লাগিল। ১৮৮৫—১৯২০ পর্যন্ত আমার সমগ্র সময় বলিতে গেলে রসায়নশাস্ত্রের চর্চাতেই ব্যয় হইয়াছে।

 এডিনবার্গের শীতল, স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে আমাদের দেশের অপেক্ষা বেশী পরিশ্রম করা যায়, অথচ কোন ক্লান্তি বোধ হয় না। লেবরেটরীতে কাজ শেষ হইবার পর গৃহে ফিরিবার পূর্বে আমি খুব খানিকটা বেড়াইয়া আসিতাম।

 আমি সমাজে বড় বেশী মেলামেশা করিতাম না। কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু যে কারণেই হউক ঐ সমস্ত পরিবারের বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গই তরুণীদের সঙ্গ অপেক্ষা আমার ভাল লাগিত। বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে আমি নানা বিষয়ে আলোচনা করিতে পারিতাম। কিন্তু যখনই তরুণীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হইত, আমার কেমন সঙ্কোচ বোধ হইত এবং মামুলী আবহাওয়া, জলবায়ু, ইত্যাদি বিষয় ছাড়া আর কোন বিষয়ে কথা বলিতে পারিতাম না। ঐরূপে দুই চারিটা কথা শীঘ্রই শেষ হইয়া যাইত এবং নূতন কোন বিষয় খুঁজিয়া না পাইয়া আমি অপ্রতিভ হইয়া পড়িতাম। আমার কোন কোন ভারতীর বন্ধু নারীমহলে আলাপ পরিচয়ে বেশ সপটু ছিলেন। ঘটনাক্রমে কোন সমাজের মধ্যে পড়িলে তাহার ‘ধাত’ বুঝিয়া আলাপ জমাইয়া তুলিবার মত দক্ষতা আমার ছিল না। কেহ যেন মনে না করেন যে, আমি নারীবিদ্বেষী ছিলাম অথবা নারী জাতির সৌন্দর্য ও মাধুর্য অনুভব করিবার শক্তি আমার ছিল না। বস্তুতঃ রসায়নশাস্ত্রের খ্যাতনামা প্রবর্তক ক্যাভেন্‌ডিশের চেয়ে এ বিষয়ে যে আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম, এজন্য নিজকে ধন্য মনে করি।

 ডাঃ এবং মিসেস কেলী (ক্যাম্পো ভার্ডি, টিপারলেন রোড) প্রতি শনিবারে ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশী ছাত্রদের স্বগৃহে অভ্যর্থনা করিতেন। প্রবীণ দম্পতীর সঙ্গে আমার বেশ সৌহার্দ্য ছিল। একবার আমার পুরাতন ব্যাধি উদরাময়ে আমি ভুগিতেছিলাম। তখন সেই সহৃদয় দম্পতী আমাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন এবং আমার জন্য বিশেষভাবে লঘুপাচ্য অথচ সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন। একথা আজ সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করিতেছি। আমি কোন কোন অভিজাত ও ‘ফ্যাশন’ওয়ালা লোকদের সঙ্গে পরিচিত হইয়াছিলাম, এমন কি, কখন কখন ‘বলনাচে’ও যোগ দিয়াছিলাম। আমার ভারতীয় পোষাক বন্ধুরা অনেকেই চাহিয়া লইত। একবার একজন উত্তর ভারতীয় মুসলমান বন্ধু তাঁহার জমকাল পোষাক ও পাগড়ী দ্বারা আমাকে সাজাইয়াছিলেন। তাহার ফলে আমি সকলেরই লক্ষ্যের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। খুব সম্ভব লোকে আমাকে কোন ভারতীয় প্রিন্স বা রাজকুমার বলিয়া মনে করিয়াছিল। ‘ফ্যাশনেবল’ সমাজের সঙ্গে পরিচিত হইতে গিয়া আমি দুই একবার এইরূপ কঠিন পরীক্ষায় পড়িয়াছিলাম।

 যথাসময়ে আমি আমার ‘থিসিস’ বা মৌলিক প্রবন্ধ দাখিল করিলাম, একটা বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষাও দিতে হইল। আমার পরীক্ষকগণ সন্তুষ্ট হইলেন এবং ‘ডক্টর’ উপাধির জন্য আমাকে সুপারিশ করিলেন। এরূপ যে হইবে, তাহা পূর্ব হইতেই আমি জানতািম। ঐ বৎসর আমিই একমাত্র ডক্টর উপাধি প্রার্থী ছিলাম এবং অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। তাঁহাদের চোখের উপর তাঁহাদেরই পরিচালনাধীনে আমি রসায়ন শাস্ত্রে কতদূর অগ্রসর হইয়াছি এবং আমার মৌলিক গবেষণার মূল্য কি, তাহা তাঁহারা ভালই জানিতেন।

 এই সময়ে রসায়নশাস্ত্রের প্রতি আমি এতদূর অনুরক্ত হইয়াছিলাম যে, আমি আরও এক বৎসর এডিনবার্গে থাকিয়া মনোমত উহার চর্চা করিব, স্থির করিলাম। আমি হোপ প্রাইজ স্কলারশিপ পাইয়াছিলাম, গিলক্রাইষ্ট এনডাউমেণ্টের ট্রাস্টিরাও আমার বৃত্তি শেষ হুইলে আরও ৫০ পাউণ্ড আমাকে সানন্দে পুরস্কার দিয়াছিলেন। তখনকার দিনে বিজ্ঞানে ‘ডক্টর’ উপাধি খুব কম লোকেই পাইত, এখনকার মত তাহাদের সংখ্যা এত বেশী ছিল না। সমাজে আমার একটু প্রতিষ্ঠা হইল বলিয়া আমার বোধ হইল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটীর ভাইস প্রেসিডেণ্ট নির্বাচিত হইলাম এবং প্রেসিডেণ্টের (অধ্যাপক ক্রাম ব্রাউন) অনুপস্থিতিতে সভায় আমিই সভাপতির আসন গ্রহণ করিতাম।[] আমার ছয়মাস পূর্বে ওয়াকার “ডক্টর’ উপাধি পাইয়াছিলেন। তিনি তখন হইতেই ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রির প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। ঐ বিজ্ঞানের তখন কেবল চর্চা সুরু হইয়াছিল। ওয়াকার জার্মানীতে গিয়া ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির তিনজন প্রবর্তকের অন্যতম অস্‌টোয়াল্ডের নিকট অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। উক্ত বিজ্ঞানের অন্য দুইজন প্রবর্তকের নাম,—ভাণ্ট হফ এবং আরেনিয়াস্। জার্মানী হইতে প্রত্যাগমন করিয়া তিনি ইংলণ্ডে ফিজিক্যাল কেমিষ্টি চর্চার প্রধান প্রবর্তক হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। গ্লাসগোর অধ্যাপক ডিট্‌মার, এক সময়ে ক্রাম ব্রাউনের সহকারী ছিলেন। তিনি আমাদের লেবরীটরী পরিদর্শন করিতে প্রায়ই আসিতেন। আমি তাঁহাকে একবার জিজ্ঞাসা করি, আমিও ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রির চর্চা আরম্ভ করিব কি না? ডিট্‌মার উত্তর দেন—“আগে কেমিক্যাল কেমিষ্ট হও!”

 এখানে একটী ঘটনা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য; আকস্মিক ঘটনাও অনেক সময়ে কিরূপে বিজ্ঞানের উন্নতিতে সহায়তা করে, ইহার দ্বারা তাহাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু যাহাদের মন পূর্ব হইতে প্রস্তুত থাকে, তাহারাই কেবল এইরূপ আকস্মিক ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করিতে পারে। হোপ প্রাইজ স্কলার হিসাবে আমাকে লেবরেটরীতে অধ্যাপককে সাহায্য করিতে হইত, ইহাকে বিশেষ সুবিধারূপে গণ্য করা যাইতে পারে, কেননা ইহার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপনার কাজও শেখা যায়। হিউ মারশাল জুনিয়র ছাত্র ছিলেন এবং আমি তাঁহাকে অনেক সময়ে গবেষণা বিষয়ে উপদেশ ও পরামর্শ দিতাম। একবার আমি তাঁহাকে কতকগুলি লবণের নমুনা দিই, উদ্দেশ্য তাঁহার বিশ্লেষণ শক্তি পরীক্ষা করা এবং নিজের পরীক্ষিত বিষয়েও নিঃসন্দেহ হওয়া। লবণগুলি আমি ডক্টরের থেসিসের জন্য তৈরী করিয়াছিলাম। একটীর মধ্যে ডবল সালফেট অব কোবালট, কপার ও পোটাসিয়ম ছিল। ম্যারশাল ইলেকট্রোলিটিক্যাল প্রণালী অবলম্বনে বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখিয়া অতিমাত্র বিস্মিত হইলেন যে নীচে একরকম নূতন দানাদার (Crystalline) পদার্থ জমিয়া গিয়াছে। বিশ্লেষণ করিয়া বুঝা গেল উহা ‘কোবাল্ট অ্যালাম’। প্রতিক্রিয়ায় যে সমস্ত পদার্থ উৎপন্ন হইল, ‘পার সালফ্যারিক অ্যাসিড’ তাহার অন্যতম। এইরূপে একদিনেই বহু দিনের প্রত্যাশিত একটা নূতন পদার্থের আবিষ্কর্তারূপে যুবক ম্যারশাল বিখ্যাত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার অনেক সমসাময়িক এবং পূর্বগামী তাঁহার পশ্চাতে পড়িয়া রহিলেন।

 ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি বা অ-জৈব রসায়নে ডক্টর উপাধি পাওয়ার পর আমি জৈব রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে গ্রন্থাদি পড়িতে লাগিলাম। এই বিষয়ে আমি লেবরেটরীতে গবেষণাতেও প্রবৃত্ত হইলাম। ১৮৮৮ সালে শীতের সেসন শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরিবার কথা আমি ভাবিতে লাগিলাম। কিন্তু এডিনবার্গ ত্যাগ করিবার পূর্বে হাইল্যাণ্ডের দৃশ্যাবলী দেখিবার জন্য আমার বহুদিনের বাসনা পূর্ণ করিতে সঙ্কল্প করিলাম। আমি বার্ষিক এক শত পাউণ্ড বৃত্তি পাইতাম, ইহারই মধ্যে মিতব্যয়িতার সঙ্গে আমাকে চালাইতে হইত। বাড়ী হইতে মাঝে মাঝে সামান্য কিছু টাকা পাইতাম।

 লম্বা গ্রীষ্মের ছুটীর সময়ে আমি ফার্থ অব ক্লাইড, রোথসে এবং ল্যামল্যাশের সুলভ অথচ মনোরম সমুদ্রাবাসে বেড়াইতে যাইতাম। এই সমুদ্র উপকূল ভ্রমণে পার্বতীনাথ দত্ত প্রায়ই আমার সঙ্গী হইতেন। তিনি পরে ভারতীয় জিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগে চাকুরী গ্রহণ করেন। মিতব্যয়িতার জন্য আমরা উভয়ে একত্র থাকিতাম ও আহারাদি করিতাম, এমন কি, অনেক সময় এক শয্যায় শয়ন করিতাম। ইংলণ্ডের ব্রাইটন প্রভৃতি ‘ফ্যাশনেবল’ সমুদ্রাবাসের তুলনায় রোথসে, বিশেষতঃ ল্যামল্যাশ খুবই সুলভ জায়গা এবং সেখানকার দৃশ্যও সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। প্রাতর্ভোজনের পর কিছু পড়াশুনা করিয়া আমরা পকেটে স্যাণ্ডউইচ পুরিয়া দীর্ঘ ভ্রমণে বাহির হইয়া পড়িতাম। পানীয় জলের কখনই অভাব হইত না, কেননা ঐ অঞ্চলে প্রাকৃতিক প্রস্রবণ অনেক আছে। আমার বন্ধু ভূতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গবেষণারও বহু সুযোগ পাইতেন এবং আমাকে পর্বতের স্তর বিভাগ প্রভৃতি দেখাইতেন। সমস্তদিন ব্যাপী এই ভ্রমণ যেমন উপভোগ্য, তেমনি স্বাস্থ্যকর বোধ হইত। ইহার সঙ্গে সমদ্রস্নান অধিকতর আনন্দদায়ক। ৪৫ বৎসর পরে এখনও সেই সমুদ্রতীরে ভ্রমণের কথা মনে পড়িলে, আমার মনে যেন যৌবনের উৎসাহ ফিরিয়া আসে। রোথসে হইতে নিকটবর্তী নানাস্থানে স্টিমারে ভ্রমণ করা যায়। এক শিলিং বার করিয়া আমি ইনভারারে (ডিউক অব আর্গাইলের দুর্গ ও আবাসভূমি) বা আয়ারশায়ারে (এইখানে কবি বার্নসের স্মৃতিস্তম্ভ) যাইতে পারিতাম।

 আমি হাইল্যাণ্ডে পদব্রজে ভ্রমণের সঙ্কল্প করিলাম। আমার সঙ্গী হইলেন একজন মুসলমান বন্ধু। তিনি হায়দ্রাবাদ নিজাম রাজ্যের অধিবাসী, বিলাতে গিয়া মেডিক্যাল ডিগ্রী লইয়াছিলেন। আমরা প্রথমে স্টার্লিং গিয়া একটা সাধারণ কৃষকের গৃহে বাসা লইলাম এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে ভ্রমণ করিলাম। ব্যানাকবার্ণের যুদ্ধক্ষেত্র, স্টার্লিং দুর্গ এবং ওয়ালেসের স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতি আমরা দেখিলাম। স্কটের “লেডী অব দি লেকে” বর্ণিত স্থানগুলির মধ্য দিয়া আমরা ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। আমার পকেটে ঐ বই একখানি ছিল এবং পাহাড়ে উঠিতে উঠিতে স্কটের কবিতা আমার মনে পড়িতে লাগিল—

Bend against the steepy hill thy breast
And burst like a torrent from the crest.

 লক ক্যাটাইনে সাঁতার দিয়া আমি আনন্দ উপভোগ করিলাম। লক লমণ্ডের তীরে ইনভারস্পেইডের একটী হোটেলে আমরা একরাত্রি যাপন করিলাম। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই স্থানে থাকিবার সময়ই তাঁহার বিখ্যাত কবিতা “To a Highland Girl” (একটী হাইল্যাণ্ড বালিকার প্রতি) লিখিয়াছিলেন। আমরা ক্যালেডোনিয়ান খালের তীর ধরিয়া চলিলাম এবং ফোর্ট উইলিয়মে একটী কুটীরে কয়েকদিন অবস্থান করিলাম। একদিন সকালে আমরা ইতিহাস-বিখ্যাত হত্যাকাণ্ডের স্থান প্লেনকোতে যাত্রা করিলাম এবং একটানা ১৮ মাইল ভ্রমণ করিলাম। আমার বন্ধুর পিপাসা লাগাতে একটী হাইল্যাণ্ড বালিকার ষ্টল হইতে এক গ্লাস দুধ চাহিয়া খাইলেন। বিদেশী ভ্রমণকারীর প্রতি আতিথ্যের চিহ্নস্বরূপ বালিকা দুধের জন্য কোন দাম লইল না। চারিদিকের দৃশ্য অতুলনীয়, মনোমুগ্ধকর, ছবির মত সুন্দর। আমরা বেন নেভিসের গিরিশৃঙ্গে উঠিলাম। ইহাই ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ, উচ্চতা ৪৪০০ ফিট। এখানে একটা ‘অবজারভেটরী’ বা মানমন্দির আছে।

 আমরা তথা হইতে ইনভারনেসে গেলাম। সুন্দর শহর। আমি বহু পূর্বেই শুনিয়াছিলাম যে লণ্ডনের শিক্ষিত সমাজের চেয়েও এখানকার শিক্ষিত লোকেরা ভাল ইংরাজী বলে। জিনি ডিন্‌সের সময়েও গেলিক মিশ্রিত স্কচ ভাষা লণ্ডন সমাজে প্রায় গ্রীক ভাষার ন্যায়ই দুর্বোধ্য ছিল। প্রথম জেমস্ তাঁহার পাণ্ডিত্য দেখাইতে ভাল বাসিতেন এবং সেজন্য তাঁহার দরবারের পরিষদবর্গ তাঁহাকে লইয়া ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করিত। কাউণ্ট সালি তাঁহার উপাধি দিয়াছিলেন the most learned fool in Christendom অর্থাৎ খৃস্টান জগতে সব চেয়ে বড় নির্বোধ। দ্রুত যাতায়াতের সুবিধা হওয়াতে এবং হাইল্যাণ্ডবাসীদের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলবাসীদের সর্বদা মিশ্রণের ফলে কথ্য ভাষার বিভিন্নতা প্রায় লোপ পাইয়াছে। অধ্যাপক জন ষ্টুয়ার্ট ব্ল্যাকির দেশপ্রেম প্রণোদিত প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও (ইঁহার চেষ্টায় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলিক ভাষার অধ্যাপক নিয়োগের ব্যবস্থা হইয়াছিল), গেলিক ভাষার লোপ অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষিত লোকদের ভাষা কোথাও আমার বুঝিতে কষ্ট হয় নাই। কেবল স্কচদের উচ্চারণে একটু পার্থক্য আছে এই মাত্র।

 ইনভারনেস হইতে আমরা চিরস্মরণীর ‘কালোডেন মূর’ বদ্ধক্ষেত্র দেখিতে গেলাম। মৃত ব্যক্তিদের গোষ্ঠী অনুসারে কবরের উপরে প্রস্তরফলক স্থাপিত হইয়াছে। ইহারা সেই ভীষণ দিনে হতভাগ্য প্রিন্স চার্লির পক্ষ অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ করিয়াছিল। “কসাই” কাম্বারল্যাণ্ডের নিষ্ঠুরতার স্মৃতিও সেই গোষ্ঠীর স্মৃতিতে এখনও জ্বাজ্বল্যমান হইয়া রহিয়াছে।

 এডিনবার্গে ফিরিয়া আমি ক্রাম ব্রাউন ও সার উইলিয়ম মুয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। ক্রাম ব্রাউন রসায়নশাস্ত্রে পারদর্শিতা সম্বন্ধে উচ্চ প্রশংসা করিয়া আমাকে একখানি সুপারিশ পত্র দিলেন। কয়েকখানি পরিচয়পত্রও দিলেন, তন্মধ্যে তাঁহার পূর্ববর্তী রসায়নের অধ্যাপক লর্ড স্লেফেয়ারের নিকট একখানি। সার উইলিয়ম মুয়র আমাকে স্যর চার্লস বার্নার্ডের নিকট একখানি পরিচয়পত্র দিলেন। স্যর চার্লস বার্নার্ড বর্মার প্রথম গবর্ণরের পদ হইতে অবসর লইয়া ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হইয়াছিলেন। বার্নার্ড অতি ভদ্রলোক, সহৃদয় এবং উদার প্রকৃতি ছিলেন। আমি পরে জানিতে পারি যে তিনি একাধিকবার আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত ভারতীয় ছাত্রদিগকে সাহায্য করিয়াছেন। স্যর চার্লস আমাকে জলযোগের জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে আমাকে নিয়োগ করাইবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। লর্ড প্লেফেয়ারও তদানীন্তন ভারতসচিব লর্ড ক্রসকে আমার পক্ষ সমর্থন করিয়া পত্র লিখিলেন। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে নানা বাধা ছিল। সেই যুগে এবং তাহার পর বহু বৎসর পর্যন্ত শিক্ষা বিভাগের উচ্চ পদগুলি (ভারত সচিবই এই সব পদে লোক নিয়োগ করিতেন,) ভারতবাসিগণের পক্ষে দুর্লভ ছিল। দুই একটি ক্ষেত্রে ইহার ব্যতিক্রম হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম মাত্র।

 বার্ণার্ড আমার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোন ফল হইল না। আমি দুই মাসকাল লণ্ডনের সহরতলী হ্যানওয়েলে থাকিলাম। এই সময়ে আমি কেমিক্যাল সোসাইটির লাইব্রেরীতে অধ্যয়ন করিতাম এবং রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে বহু মূল্যবান গ্রন্থ, বিশেষতঃ, জার্মান সাময়িক পত্র হইতে বিস্তৃত ‘নোট’ লইতাম। এগুলি যে কলিকাতায় পাওয়া যাইবে না, তাহা আমি জানিতাম।

 ভারতসচিব যে আমাকে ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে নিয়োগ করিবেন, এরূপ সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বোধ হইল। আমার অর্থসম্বলও ফুরাইয়া আসিতেছিল। সতরাং আর বেশী দিন ইংলণ্ডে থাকা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। স্যর চার্লস বার্নার্ড আমার অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি আমাকে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি আর কত দিন এখানে থাকিতে পারিবেন?” তিনি আমাকে আর্থিক সাহায্য করিতে চাহিলেন। কিন্তু ধন্যবাদসহকারে তাহা গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলাম। দৃশ্যটা কিন্তু বড়ই করুণ। তাঁহার নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহিরে আসিলে আমি প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলাম। ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে কোন কাজ পাইবার আশা নাই জানিয়া আমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করাই স্থির করিলাম। অন্ধকারের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে একটা আলোর রেখা দেখা গেল। কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সি, এইচ, টনী এই সময় ছুটী লইয়া বিলাত ছিলেন। তিনি স্যর চার্লস বার্নাডের কুটুম্ব এবং তাঁহার বাড়ীতেই ছিলেন। আমার লণ্ডন ত্যাগের পূর্বে স্যর চার্লস আমাকে ব্রেকফাস্টে নিমন্ত্রণ করিলেন এবং টনী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়া দিলেন। টনী সাহেব বাঙ্গলার শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টার স্যর আলফ্রেড ক্রফ্‌টের নিকট একখানি পরিচয় পত্র দিলেন। টনী সাহেবের পত্রের শেষে আমার যতদূর স্মরণ আছে এই কথাগুলি ছিল। “ডাক্তার রায়কে নিয়োগ করিলে তিনি যে শিক্ষাবিভাগের অলঙ্কার স্বরূপ হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

 আমি স্বদেশ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইলাম। গিল্‌ক্রাইষ্ট ট্রাষ্ট আমার বৃত্তির সর্তানুসারে ৫০ পাউণ্ড জাহাজ ভাড়া ইত্যাদি পথের ব্যয় বাবদ দিলেন। আমি পি, এণ্ড ও কোম্পানীর জাহাজে ব্রিন্দিসি হইতে ৩৭ পাউণ্ড মূল্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর একখানি টিকিট কিনিলাম। অবশিষ্ট অর্থে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এবং লণ্ডন হইতে ব্রিন্দিসি পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণীর একখানি রেল গাড়ীর টিকিট কিনিলাম। ইতিপূর্বে ‘কনটিনেণ্টে’ ভ্রমণ করিবার আমার কোন সুযোগ হয় নাই। সুতরাং এইবারে রেলের পথে যতদূর সম্ভব কতকগুলি স্থান দেখিয়া যাইব বলিয়া স্থির করিলাম। এই উদ্দেশ্যে একখানি অগ্রগামী ‘ওমনিবাস’ যাত্রী গাড়ীতে উঠিলাম। প্যারিস দেখিয়া আমি দক্ষিণ ফ্রান্সের ভিতর দিয়া আল্পস পর্বতশ্রেণী পার হইলাম। বহ‍ু ‘টানেল’, দ্রাক্ষাক্ষেত্র প্রভৃতি আমার চোখে পড়িল। আমাদের গাড়ী দুই ঘণ্টার জন্য পিসা সহরে থামিল— আমি সেই অবসরে বিখ্যাত (Leaning Tower) দেখিয়া আসিলাম। ইটালী দেশে রেলওয়ে স্টেশনে পানীয় জল সরবরাহ করা হয় না। কিন্তু প্রচুর সস্তা ও হাল্কা মদ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। আমাকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ষ্টেশনের জলের কলের নিকট প্রায়ই দৌড়াইতে হইত। রোমে গাড়ী থামিলে আমি সহরের রাস্তায় ঘুরিয়া ‘ক্যাপিটল’ প্রভৃতি দেখিলাম।

 ইটালীবাসীরা সদানন্দ লোক, কথাবার্তা বেশী বলে। ইংরাজদের মত স্বল্পভাষী নয়। ফরাসী ভাষায় আমার সামান্য জ্ঞান লইয়া আমি কোনরূপে কথাবার্তার কাজ চালাইতে লাগিলাম। আমার সৌভাগ্যক্রমে যাত্রীদের মধ্যে একজন অস্ট্রিয়ান ছিলেন। তিনি ভাল ইংরাজী বলিতে পারিতেন। আমার সঙ্গে তাঁহার বন্ধুত্ব হইল। তিনি ট্রিষ্টে যাইতেছিলেন। তিনি যখন শুনিলেন যে আমি ব্রিন্দিসিতে মেল ষ্টীমার ধরিব তখন তিনি টাইম টেবিল দেখিয়া গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়িলেন। কহিলেন “আমার আশঙ্কা হয়, আপনি ‘মেল’ ধরিতে পারিবেন না, কেন না এই গাড়ী একদিন পরে ব্রিন্দিসিতে যাইয়া পৌঁছিবে।” তিনি আমার জন্য অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন এবং একটী ষ্টেশনে গাড়ী বেশীক্ষণ থামিলে তিনি ষ্টেশন মাষ্টারের সঙ্গে পরামর্শ করিলেন। ষ্টেশন মাষ্টার বলিলেন যে, রেলওয়ে মেলগাড়ী শীঘ্রই পৌঁছিবে। এবং আমাকে আর কিছু অতিরিক্ত ভাড়া দিয়া তৃতীয় শ্রেণীর টিকেটখানি বদলাইয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর একখানি টিকেট লইতে হইবে। এই অতিরিক্ত ভাড়ার পরিমাণ প্রায় ৩ পাউণ্ড। ইহার পর আমার পকেটে মাত্র কয়েক শিলিং থাকিল।

  1. যখন ভারত ও বিলাতের মধ্যে যাতায়াতে কয়েকমাস সময় লাগিত, তখন যাত্রীদের পক্ষে সময় কাটানো বড় কষ্টকর হইত। তাঁহারা তখন সময় কাটানোর নানা বিচিত্র উপায় অবলম্বন করিতেন। মেকলে এ সম্বন্ধে একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়াছেন; Essay on Warren Hastings দ্রষ্টব্য।
  2. শীতপ্রধান দেশে আগুন জ্বালাইয়া দাখিবার চুল্লীরিশেষ।
  3. এস্থলে একটা কৌতুকাবহ ঘটনার উল্লেখ করিতে বাধ্য হইলাম। গত বৎসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গবর্ণর স্যার জন এভার্সন ও আমাকে (অন্যান্যদের মধ্যে) সম্মান সূচক উপাধি দেন। আমি ভাইস্‌চান্‌সেলরের At home তে স্যার জনের ঠিক পাশেই উপবেশন করি এবং তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলাম, “আজ আমরা উভয়েই fellow graduate অর্থাৎ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী”, তাহাতে স্যার জন বলেন, ইহা ঠিক নয়; আমরা বহুপূর্বেই fellow graduates অর্থাৎ তিনিও আমার অনেক পরে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐ টেট ও ক্রাম ব্রাউনএর নিকট অধ্যয়ন করেন এবং Hope Prize (রসায়ন বিদ্যার) লাভ করেন।
  4. সেসন ১৮৮৭-৮৮

    এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির কর্মাধ্যক্ষগণ

    প্রেসিডেণ্ট—প্রোঃ এ, ক্রাম ব্রাউন, এফ, আর, এস।
    ভাইস প্রেসিডেণ্ট—পি, সি, রায় ডি, এস-সি; র‍্যাল্‌ফ্ স্টকম্যান এম, ডি।
    সেক্রেটারী—অ্যানড্রু, কিং। কোষাধ্যক্ষ—হিউম্যারশাল বি, এস সি।
    লাইব্রেরিয়ান—লিওনার্ড ভাবিন, পি-এইচ, ডি, এফ, আর, এম, ই, এফ, আই, সি।
    কমিটির সদস্যগণ—টি, এফ, বারব্যুর; ডি, বি, ডট্, এফ, আর, এস, ই; এফ, মেটল্যাণ্ড গিবসন; জে; গিবসন পি-এইচ, ডি, এফ, আর, এস, ই, এফ, আই, সি, এ, শ্যাণ্ড।