আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/বিংশ পরিচ্ছেদ
বিংশ পরিচ্ছেদ
শিল্পবিদ্যালয়ের পূর্বে শিল্পের অস্তিত্ব—শিল্পসৃষ্টির
পূর্বে শিল্পবিদ্যালয়—ভ্রান্ত ধারণা
“পণ্ডিত চীন কোন শিল্প সৃষ্টি করিতে পারে নাই।
“কিরূপে অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পের উন্নতি করা যায়, ষাট বৎসর পূর্বে জাপানের সম্মুখে এই সমস্যা উপস্থিত হইয়াছিল। জাপান কয়েক বৎসরের জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞদিগকে নিযুক্ত করিয়াছিল এবং সমস্ত নবপ্রতিষ্ঠিত কলকারখানার কর্তৃত্ব তাহাদের হাতেই দিয়াছিল। কিন্তু প্রত্যেক বিদেশী ম্যানেজার এবং তাহাদের প্রধান প্রধান বিদেশী সহকারীদের সঙ্গে একজন করিয়া জাপানী সহকারী নিযুক্ত হইল। এই সব জাপানী সহকারী কেবল শোভাবর্ধনের জন্য ছিল না। বিদেশী বিশেষজ্ঞেরা যেভাবে কার্য পরিচালনা করেন, সেই বিদ্যা অধিগত করাই ছিল জাপানী সহকারীদের কর্তব্য।” Baker: Explaining China.
(১) যুদ্ধ ও শিল্প
১৯১৪ সালের আগষ্ট মাসে ইয়োরোপীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং রাসায়নিক জগতের উপর উহার প্রভাব বহদূরপ্রসারী হয়। রাসায়নিক গবেষণা ও উহার প্রয়োগবিদ্যায় জার্মানীর শ্রেষ্ঠত্ব ইংলণ্ড এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে লাগিল। ইংলণ্ডের সাম্রাজ্য জগতের সর্বত্র বিস্তৃত এবং জার্মান সাবমেরিন ইংলণ্ডের বাণিজ্যপোতগুলির ঘোর অনিষ্ট করিলেও, ইংলণ্ড তাহার সাম্রাজ্যের নানা স্থান হইতে কাঁচামাল সংগ্রহ করিতে লাগিল। আমেরিকা ও ভারতবর্ষ হইতে গম, মাংস এবং ফল বোঝাই জাহাজ ইংলণ্ডে নিয়মিতভাবে আসিতে লাগিল। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র হইতে অস্ত্রশস্ত্রও সে আমদানী করিতে লাগিল। কিন্তু জার্মানী শত্রু কর্তৃক চারিদিকে অবরুদ্ধ হইয়া অত্যন্ত বিপদে পড়িল। এই সময়ে জার্মানীর রাসায়নিকগণ অসাধারণ কর্মশক্তির পরিচয় দিয়াছিলেন বলিয়াই জার্মানী অনেকদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালাইতে পারিয়াছিল। নাইট্রিক অ্যাসিড ও নাইট্রেট্স বিস্ফোরক পদার্থ তৈরীর প্রধান উপাদান। নাইট্রেট অব সোডিয়াম বা চিলি সল্ট্পিটারও এজন্য খুব প্রয়োজন। বাহির হইতে এসব জিনিসের আমদানী বন্ধ হওয়াতে জার্মান রাসায়নিকেরা নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরী করিবার অন্য উপায় উদ্ভাবন করিতে লাগিলেন। সুইডেনে এই সময়ে বাতাস হইতে নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরীর প্রণালী আবিষ্কৃত হইয়াছিল। জার্মানীও এই উপায়ে নাইট্রিক অ্যাসিড পাইতে পারিত কিন্তু তাহাতে ব্যয় বোধ হয় বেশী পড়িত। জার্মান রাসায়নিক হাবার এই সময়ে অ্যামোনিয়া হইতে নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরীর প্রণালী উদ্ভাবন করিলেন।
ফরাসী বিপ্লবের সময়, ইংলণ্ড অন্যান্য কয়েকটি ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়া ফ্রান্সের চারিদিক অবরুদ্ধ করিয়াছিল এবং সেই সময়ে ফ্রান্সকেও এইরূপে বিপদে পড়িতে হইয়াছিল। ফ্রান্সে বাহির হইতে সোডা ও চিনির আমদানী বন্ধ হইল। এই দুই প্রয়োজনীয় পদার্থ যাহাতে ফ্রান্সেই তৈরী হইতে পারে, সাধারণতন্ত্র দেশপ্রেমিক বৈজ্ঞানিকদের নিকট তদুদ্দেশ্যে অনুরোধ করিলেন। ইহার ফলে লে-ব্ল্যাঙ্ক লবণ হইতে সোডা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিকগণ বীটমূল হইতে চিনি তৈরীর প্রণালী আবিষ্কার করিলেন। এই সমস্ত দৃষ্টান্ত সেই প্রাচীন প্রবাদবাক্যেরই সমর্থন করে—প্রয়োজন হইতেই নব নব উদ্ভাবনের জন্ম।
ব্রিটিশ রাসায়নিক ও বৈজ্ঞানিকরাও পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহেন। তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দী জার্মানী রাসায়নিক শিল্পে বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে এবং তাহার সমকক্ষতা লাভ করিতে হইলে প্রবল প্রচেষ্টা করিতে হইবে। ইংলণ্ডের স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হইয়া উঠিল। যে দেশ নিউটন, ফ্যারাডে এবং র্যামজের জন্ম দিয়াছে, সে দেশ রাসায়নিক সংগ্রামে পশ্চাৎপদ হইয়া থাকিতে পারে না। এই সন্ধিক্ষণে ইংলণ্ড কি করিল, তাহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ইংলণ্ড এই সংগ্রামে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়াছেন। লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেণ্ট এই সময়ে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করিয়া একখানি পত্র লিখেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক বিভাগে আমাদের সাধারণ কাজের অথবা ছাত্রদের গবেষণা সংক্রান্ত কাজের মোটের উপর কোন ক্ষতি হয় নাই। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী প্রায় পঁচিশ বৎসরকাল প্রেসিডেন্সি কলেজে ডেমনস্ট্রেটর ছিলেন। তিনি বেশ হিসাব করিয়া রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির বার্ষিক সরবরাহের ব্যবস্থা করিতেন। আমাদের লেবরেটারীতে ঐ সমস্ত জিনিস যথেষ্ট পরিমাণে মজুত ছিল। কতকগুলি রাসায়নিক দ্রব্য আমরা নিজেরাই প্রস্তুত করিলাম, ঐগুলি পূর্বে জার্মানী হইতে আমদানী করা হইত। কিন্তু আমাদের ফার্ম ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ হইতেই এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হইয়াছিল। এখান হইতে গবর্ণমেণ্টকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রিক অ্যাসিড সরবারহ করা হইল। সামরিক বিভাগে আমাদের জনৈক রাসায়নিকের প্রস্তুত ‘অগ্নি নির্বাপক’ এর খুব চাহিদা হইল। মেসোপটেমিয়ায় বারুদ ও বিস্ফোরকের গুদামের জন্য এগুলি চালান দেওয়া হইয়াছিল,— আমাদের রাসায়নিকগণের উদ্ভাবিত প্রণালীতে থাইওসাল্ফেটও প্রচুর পরিমাণে প্রস্তুত হইয়াছিল। চায়ের গুঁড়া হইতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফিনও তৈরী করা হইত। আমাদের কারখানায় অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে রাসায়নিক তুলাদণ্ডও তৈরী হইত। মোটের উপর, যুদ্ধের ফলে কারখানার কয়েকটি বিভাগের কাজ আশাতীতরূপে বাড়িয়া গিয়াছিল।
ভারত ইউরোপীয় যুদ্ধে কম সাহায্য করে নাই। ভারতীয় সৈনিকরাই ইপ্রেসের যুদ্ধের সন্ধিক্ষণে মিত্রশক্তিকে রক্ষা করিয়াছিল। ভারতই মেসোপটেমিয়াতে শ্রমিক সরবরাহ করিয়াছিল। ভারত হইতেই রেলওয়ে লাইন, মালমশলা প্রভৃতি জাহাজে করিয়া লইয়া বাসরাতে বসানো হইয়াছিল। ছোট-বড় সমস্ত দেশীয় রাজারাই সৈন্য ও অর্থ দিয়া ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টকে সাহায্য করিয়াছিলেন। টাটা আয়রন ওয়ার্কসও যথেষ্ট কাজ করিয়াছিলেন; ইউরোপ ও আমেরিকা হইতে ইস্পাতের আমদানী বন্ধ হইয়া গিয়াছিল এবং টাটার কারখানার প্রস্তুত সমস্ত জিনিস গবর্ণমেণ্টের আয়ত্তাধীন হইয়াছিল।
এই সন্ধিক্ষণে, ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ যেরূপ কাজ করিয়াছিল, তাহার জন্য শাসকেরা খুব প্রশংসা করিয়াছিলেন। ১৯১৬—১৮ সালের শিল্প কমিশন ভারত যাহাতে শিল্প সম্বন্ধে আত্মনির্ভরশীল হইতে পারে, তাহার সপক্ষে বহু যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন। “যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফলে গবর্ণমেণ্ট এবং প্রধান শিল্প ব্যবসায়ীদের মত পরিবর্তন হইয়াছে। তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন, ভারতকে শিল্পজাত বিষয়ে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মরক্ষায় সক্ষম করিবার জন্য কলকারখানা স্থাপন করা প্রয়োজন। যুদ্ধের সময়ে বিদেশ হইতে শিল্পজাত আমদানীর প্রতীক্ষায় নিশ্চেষ্টভাবে বসিয়া থাকা এ যুগে আর সম্ভবপর নহে।”
এখানে বলা প্রয়োজন যে, কেমিক্যাল সার্ভিস কমিটিতে আমি যে স্বতন্ত্র মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম, তাহাতে আমি দেখাইয়াছিলাম যে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমাদের দেশের লোকের কিরূপে ভ্রান্ত ধারণা আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালর ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সমূহে যে শিক্ষা দিয়া থাকে, তাহা অতিমাত্রায় সাহিত্যগন্ধী, অতএব কতকগুলি লোকের মতে উহার পরিবর্তে শিল্প-শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করিলেই, চারিদিকে যাদুমন্ত্র বলে শিল্পবাণিজ্য কলকারখানা গড়িয়া উঠিবে।
স্যার এম, বিশ্বেশ্বরায়া যে একটি শিল্প মহাবিদ্যালয় বা টেকনলজিক্যাল ইউনিভারসিটি স্থাপন করিবার জন্য ব্যগ্র, তাহারও কারণ এই ভ্রান্ত ধারণা; তিনি বলিয়াছেন:—
“শিক্ষা-ব্যবস্থা এমন করিতে হইবে, যাহার ফলে দেশের কর্মক্ষেত্রে সমস্ত বিভাগে কতকগুলি নেতা তৈরী হইয়া উঠিবে,—শাসক, শিল্প-বিশেষজ্ঞ, ইত্যাদি। যে সমস্ত যুবকদের যেদিকে রুচি ও যোগ্যতা আছে, তাহাদিগকে সেই সেই বিষয়ে এইভাবে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। যাহাদের নেতৃত্ব করিবার যোগ্যতা আছে এবং যাহারা শ্রমিক জনসাধারণ সেই দুই শ্রেণীই দেশের আর্থিক ব্যাপারের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই দুই শ্রেণীর সহযোগে ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠে। মধ্যবর্তী শ্রেণী যথা ফোরম্যান, কারিগর প্রভৃতি ইহারা স্বভাবতঃই তৈরী হইয়া উঠিবে,—ইহাদেরও প্রয়োজন আছে এবং তাহাদের উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থাও করিতে হইবে।” (অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত পঞ্চম বার্ষিক কনভোকেশান অভিভাষণ)
ইহা অপেক্ষা ভ্রান্ত ধারণা আর কিছুই হইতে পারে না। প্রত্যেক দেশেই শিল্পবাণিজ্যের উন্নতি হইয়াছে, তাহার পরে বিজ্ঞান ও বিবিধ শিল্পবিদ্যা প্রভৃতি আসিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মৃৎপাত্র এবং মৃৎশিল্পের কথা ধরা যাক। এগুলির চল্তি নাম চীনামাটির বাসন এবং এই নাম হইতেই অনুমান করা যাইতে পারে,—যে অতি প্রাচীন কাল হইতে চীনদেশে এই শিল্প প্রচলিত ছিল। চীনারা ঐ শিল্পে বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছে এবং জাপান তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছে।
“মৃৎশিল্প রোমকদের অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু চীনারা অতি প্রাচীনকাল হইতেই এ বিষয়ে দক্ষতা লাভ করে। (সান-ইয়াট-সেন তাঁহার Memories of a Chinese Revolutionary গ্রন্থে ইহার বিবরণ দিতে গিয়া বলিয়াছেন—“যে চীনা শিল্পীরা এই সব মৎশিল্প তৈরী করিত, তাহারা পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র জানিত না”)। প্রাচীন মিশরের কবরগুলির মধ্যে যে সব পাত্রের অবশেষ আছে, তাহাও মৃৎশিল্পজাতীয়। ইউরোপে মধ্যযুগে মৃৎপাত্রে রং করা খুবেই প্রচলিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে আলকেমিষ্ট পিটার বোনাস এবং আলবার্টাস ম্যাগনাস্, ঐ সময়ে যে প্রণালীতে মৃৎপাত্রে রং করা হইত, তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। পরবর্তী শতাব্দীতে এই শিল্পের খুব উন্নতি হয়। অ্যাগ্রিকোলা এই শিল্প সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
“যাঁহারা মৃৎ শিল্পের উন্নতি সাধন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে বার্নার্ড প্যালিসির নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। রঙীন ও উজ্জ্বল মৃৎ শিল্প নির্মাণের জন্য তিনি বহু ত্যাগ স্বীকার করেন এবং এইরূপে আধুনিক মৃৎ শিল্পের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তাঁহার প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ দ্বারা ইয়োরোপে তাঁহার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রণালী সম্বন্ধে বহু তথ্য প্রচারিত হয়। কিন্তু L’Art de Terre et des Terres d’Argilé নামক তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে কেবল মৃৎশিল্পের কথাই আছে। ১৭০৯ খৃষ্টাব্দে বাটিকের মৃৎশিল্প সম্বন্ধে নূতন প্রণালী আবিষ্কার করেন এবং তাহার পর বৎসরে স্যাক্সনির মিসেন সহরে প্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পের কারখানা স্থাপিত হয়।
“মিসেনের কারখানার মৃৎশিল্পের নির্মাণ প্রণালী গোপন রাখা হইয়াছিল। সেইজন্য প্রাসিয়ার রাজা প্রসিদ্ধ রাসায়নিক পটকে উহার তথ্য নির্ণয় করিবার জন্য আদেশ দেন। কিন্তু পট বহু চেষ্টা করিয়াও কিছুই জানিতে পারেন নাই। তখন তিনি নিজেই এ সম্বন্ধে নানা পরীক্ষা করিতে থাকেন। কথিত আছে যে এজন্য পট প্রায় ত্রিশ হাজার বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন খনিজ পদার্থে তাপ দিলে কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, এই সমস্ত এবং মৃৎশিল্প সম্পর্কে আরও অনেক মূল্যবান তথ্য মিসেনের পরীক্ষা হইতে আমরা জানিতে পারিয়াছি। এই সময়ে রোমারও মৃৎশিল্প নির্মাণ রহস্য আবিষ্কার করিতে চেষ্টা করেন। তিনি দেখিতে পান দুই বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকার সংযোগে উহা তৈরী হয়।
“রোমারের পরে ১৭৫৮ সালে লোরাগোয়ে, ডা’রসেট এবং লিগেসী ফ্রান্সে এই বিষয়ে পরীক্ষা আরম্ভ করেন, এবং তাঁহারা ম্যাকারের সহযোগে মৃৎশিল্প নির্মাণ প্রণালী পুনরাবিষ্কারে সক্ষম হন। ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে সেভার্সের বিখ্যাত মৃৎশিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত আসল মৃৎশিল্প দুর্ল্লভ ছিল। বর্তমানে ইহা সুলভ হইয়াছে, এবং সাধারণ দৈনন্দিন কাজেও এই সব পাত্র ব্যবহৃত হয়।” রস্কো এবং শোলের্মার ২য় খণ্ড, ১৯২৩।
উদ্ধৃত বিবরণ হইতে বুঝা যাইবে, এদেশে কোন শিল্প প্রবর্তকের পথ কিরূপ বাধাবিঘ্ন সঙ্কুল। জাপান ও ইয়োরোপের পশ্চাতে বহু বৎসরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং তাহারা ঐ সমস্ত সুবিধার বলে অতি সুলভে পণ্য আমদানী করিয়া আমাদের বাজার দখল করিতে পারে।[১] কলিকাতা পটারী ওয়ার্কস এবং অন্যান্য কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে এবং সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা হইতে আমি বুঝিতে পারিয়াছি, কোন শিল্প ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিতে হইলে, কত অর্থ, সময় ও শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন।
কোন কোন মেধাবী ছাত্রকে বিদেশে শিল্প শিক্ষার্থ প্রেরণ করা হইত; তাহারা দেশে ফিরিয়া আসিয়া কোন নূতন শিল্প প্রবর্তন করিতে পারিবে, এইরূপ আশা আমরা মনে মনে পোষণ করিতাম। কিন্তু এইরূপ সোজা বাঁধা রাস্তায় কোন কাজ হইতে পারে না; এ দেশেও বহু শিল্প প্রবর্তনের চেষ্টা এই ভাবে ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে।
বিদেশ হইতে কোন শিল্পে বিশেষজ্ঞ হইয়া যখন কোন যুবক ফিরিয়া আসে, তখন সে যেন অগাধ জলে পড়িয়া যায়। তাহাকে মূলধন সংগ্রহ করিতে হইলে, কোম্পানী গঠন করিতে হইবে। ব্যবসায় গড়িয়া তুলিতে হইলে, কাঁচা মাল সংগ্রহ এবং বাজারে তৈরী শিল্পজাত বিক্রয় করা, সবই তাহাকে করিতে হইবে। এক কথায়, তাহার মধ্যে বিবিধ বিরোধী গুণের সমাবেশ থাকা চাই। যদিও সৌভাগ্যক্রমে সে মুলধনী সংগ্রহ করিতে পারে, তাহা হইলেও যখন কাজ আরম্ভ হয়, তখনই সত্যকার বাধাবিঘ্ন, অসুবিধা প্রভৃতি দেখা দেয়। যুবকটি যে দেশে শিক্ষা লাভ করিয়া আসিয়াছে, সেখানকার জলবায়ু, কাঁচামাল এবং অন্যান্য অবস্থা, ভারতবর্ষ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। নিজের দেশের স্থানীয় অবস্থা সম্বন্ধে তাহার হয় ত কোন জ্ঞান নাই। ইয়োরোপে সে বহু টাকা মূলধনে বিরাট আকারে পরিচালিত ব্যবসা দেখিয়া আসিয়াছে। ঐ দেশে শিক্ষিত দক্ষ কারিগরও সর্বদা পাওয়া যায়। মৃৎশিল্পের কথাই ধরা যাক। ইউরোপে বালি, মাটী প্রভৃতি উপকরণ ভারতের তুলনায় সম্পূর্ণ বিভিন্ন।
আরও একটা কথা, যুবকটি হয়ত বিদেশের কোন টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করিয়াছে। বিদ্যালয়ে অধীত বিদ্যার সঙ্গে হাতেকলমে ঐরূপ কিছু ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে শিল্পজাত তৈরী করিতে হইলে ঐ শিক্ষা বিশেষ কাজে আসে না। কোন কারখানায় প্রবেশ করিয়া, তাহার শিল্প প্রস্তুত প্রণালী অবগত হওয়া বড়ই কঠিন কাজ। ব্যবসায়ী ফার্ম প্রভৃতি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের মত উদার নহে। যে সমস্ত গূঢ় রহস্য তাহারা বহুবৎসরের সাধনা ও পরিশ্রমের ফলে অবগত হইয়াছে, সেগুলি বাহিরের লোককে শিখাইবার জন্য তাহারা ব্যগ্র নহে।
এমার্সন বলেন, ব্যবসায়ীদের পরস্পরের মধ্যে বেশ ঈর্ষার ভাব আছে। একজন রাসায়নিক একজন সূত্রধরের নিকট তাহার ব্যবসায়ের গূঢ় কথা বলিতে পারে, কিন্তু তাহার সমব্যবসায়ী আর একজন রাসায়নিককে কিছুতেই তাহা বলিবে না।
বিদেশে শিক্ষালাভার্থ যে সব যুবককে পাঠানো হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে অনেকেই সাফল্য লাভ করিতে পারে নাই। এমন কি কোন কোন প্রথম শ্রেণীর এম, এস-সি ডিগ্রীধারীরও এই দশা হইয়াছে। চীন দেশেও এইরূপ ভ্রান্ত ধারণার পরিণাম শোচনীয় হইয়াছে। একজন চিন্তাশীল লেখক কর্তৃক লিখিত চীন সম্বন্ধীয় গ্রন্থ হইতে কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি। এ বিষয়ে আমাদের দেশের সঙ্গে চীনের অবস্থার আশ্চর্য সাদৃশ্য দৃষ্ট হইবে।
“প্রণালী উপনিবেশ (স্টেট্স, সেট্সমেণ্ট) এবং তাহার নিকটবর্তী অঞ্চলে চীনারা ব্যবসায়ে নহে, পণ্য উৎপাদনেও প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। টিন শিল্পের কথাই ধরা যাক। এই সব স্থানে নির্দিষ্ট আইন কানুন আছে, করের হারও অত্যধিক নয়; এবং মামলা মোকদমা নিষ্পত্তিরও সুব্যবস্থা আছে। এরূপ ক্ষেত্রে চীনারা ব্যবসায়ে এবং পণ্য উৎপাদনে অন্য সমস্ত জাতিকে পরাস্ত করিয়াছে।
“তৎসত্ত্বেও একথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বিদেশে এই সমস্ত স্থানে যে সমস্ত চীনা সাফল্য লাভ করিয়াছে, তাহারা খুব দরিদ্র অবস্থায় গিয়াছিল! এমন কি প্রথমতঃ কুলীর কাজ করিতেও গিয়াছিল। তারপর নিজেদের যোগ্যতা বলে তাহারা উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে। এই সব স্থানে তাহাদের অসংখ্য জাতিকুটুম্বের কবল হইতে তাহারা অনেকটা মুক্ত; সুতরাং সহজে টাকা খাটাইতে পারে। শীঘ্রই কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়া ছোটখাট ঠিকা কাজ নেয়। তাহারা তাহাদের অধীনস্থ লোকদের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে থাকিয়া বুঝিতে পারে, কাহারা যোগ্য ফোরম্যান, কাহাদের উপর বেশী দায়িত্ব দেওয়া যায়, কাহারা কাজ করিতে ভয় পায়, কাহাদের সাহস বেশী ইত্যাদি। এইভাবে গোড়া হইতে কাজ করিতে করিতে তাহারা তাহাদের ব্যবসা গড়িয়া তোলে। হয়ত তাহারা ইংরাজী বা ডাচ ভাষাও কিছু কিছু শিখিয়া ফেলে এবং তাহার দ্বারা ব্যবসায়ের সুবিধা হয়। এইভাবে সুদীর্ঘ কালের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তাহারা ব্যবসায় চালাইবার উপযোগী এমন কতকগুলি বিধিব্যবস্থা গড়িয়া তোলে, যাহার ফলে কোন নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট বা ম্যানেজার সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করিতে পারে।” (বেকারঃ ১৭৯-৮০ পৃঃ)
“চীনা মূলধনীরা সাংহাই, ক্যাণ্টন প্রভৃতি স্থানে যে সমস্ত কারখানা স্থাপন করিয়াছে, সেগুলির সঙ্গে পূর্বোক্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলির বিস্তর প্রভেদ। এই সমস্ত মূলধনীরা তাহাদের ছেলেদের বিদেশে শিক্ষার্থ প্রেরণ করে। ছেলেরা সেখানে ব্যবসা পরিচালনা প্রণালী ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষা করে। তাহারা স্পষ্ট দেখিতে পায়, চীন হইতে যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচা মাল বিদেশে রপ্তানী করা এবং বিদেশ হইতে শিল্পজাতরূপে ঐগুলি আমদানী করার মত অস্বাবাভাবিক ব্যাপার আর কিছু হইতে পারে না। তাহারা বুঝিতে পারে যে, বিদেশী শুল্ক এবং বিদেশী শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরী বাদ দিয়া যদি মাল রপ্তানীর খরচা বাঁচানো যায়, তবে যথেষ্ট লাভ হইতে পারে। পিতাকে এই সব কথা তাহারা সহজেই বুঝাইয়া দেয়। তাহারা এ কথাও বলে যে, তাহারা ব্যবসায় জানে। তাহারা কি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় গ্রাজুয়েট হয় নাই? দুই বৎসর ফ্যাক্টরীতে কাজ করে নাই? পিতা সন্তুষ্ট হইয়া কারখানা স্থাপন করিবার জন্য মূলধন দেন। কারখানা তৈরীর কাজ আরম্ভ হয়। ঠিকাদারদের লইয়া গোলমাল হয়, কাজে বিলম্ব হয়, ভাল কাজ হয় না এবং সেরূপ অবস্থায় কাজ অগ্রাহ্য করিলে ঠিকাদারেরা ধর্মঘট করিয়া কাজ বন্ধ করে। কারখানা তৈরী করিতে বরাদ্দের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশী পড়ে, এরূপ প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। পিতা বিরক্ত হইয়া উঠেন। তবু তিনি কারখানা তৈরী শেষ করিতে আরও টাকা দেন। কারখানা তৈরী হইলে, আসল কাজ আরম্ভ হয়। তখন কলকব্জার গোলযোগ ঘটিতে থাকে, নূতন কলকব্জায় প্রথম প্রথম এমন একটু আধটু গোলযোগ হয়ই। লোকে নানা কথা বলিতে থাকে। কাজ চালাইবার জন্য যথেষ্ট মূলধন পাওয়া যায় না। চীনা কারখানাগুলিতে মূলধন সম্বন্ধে বরাদ্দ প্রায়ই খুব কম করিয়া ধরা হয়। আমেরিকা অপেক্ষা চীনে মূলধন উঠিয়া আসিতে দেরী লাগে, আদায় হইতে বিলম্ব হয়। বকেয়া বাকী আদায় হওয়াও বেশী কঠিন। ইহার উপরে, ফোরম্যানদের মধ্যে বিবাদের ফলে যদি ধর্মঘট হয়, তবে এই সব অনভিজ্ঞ তরুণ কর্মাধ্যক্ষেরা নিশ্চয়ই কাজ ছাড়িয়া দিবে। তাহাদের ‘মুখ দেখানো ভার’ হইয়া পড়ে, তাহাদের পরিবারেরও সেই অবস্থা। তাহাদের অন্য নানা সুযোগ আছে। তাহারা সরকারী কাজের জন্য চেষ্টা করিতে থাকে। আর একটা পরিত্যক্ত শূন্য কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
“কিন্তু যদি এই সব যুবক নিঃসম্বল অবস্থায় কাজ আরম্ভ করিয়া কারখানা স্থাপন করিত, নিজের উপার্জিত এবং অতিকষ্টে সঞ্চিত অর্থ ব্যবসায়ে খাটাইত, মালমশলা, ঠিকাদার, মজুর প্রভৃতির সম্বন্ধে যদি তাহাদের বহু বৎসরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকিত, তাহা হইলে তাহাদের কাজে অসুবিধা ও গোলযোগ কম ঘটিত, ব্যবসায়ের উপরও তাহাদের এমন প্রাণের মায়া জন্মিত যে, উহাকে রক্ষা করিবার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার, সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বন করিতে ত্রুটী করিত না। প্রথম আঘাতেই বিচলিত হইয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ ছাড়িয়া পলাইত না। প্রায় প্রত্যেক বড় বড় ব্যবসায়েই একটা দুর্যোগের সময় আসে; তাহা অতিক্রম করিতে পারিলে, সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ইহার জন্য যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা আবশ্যক, তাহা বর্তমান যুগের শিক্ষিত চীনা যুবকদের মধ্যে নাই। আমি পুনর্বার বলিতে চাই, শিক্ষিত ও পণ্ডিত চীন শিল্প গড়িয়া তুলিতে পারে নাই।” (বেকারঃ ১৮০—৮২ পৃঃ)
শিক্ষিত কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা ব্যবসা আরম্ভ করিয়া কিরূপে অকৃতকার্য হয়, তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছি। জার্মানী ও আমেরিকাতে শিক্ষিত বিজ্ঞানে কৃতবিদ্য (পি-এইচ, ডি) কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রকে আমি জানি। তাহারা ঐ সব দেশে রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক কারখানায় শিক্ষানবীশ হইয়া প্রবেশ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল। দেশে ফিরিয়া তাহারা ঐ সব বিদেশী ফার্মের ‘ভ্রাম্যমান’ ক্যান্ভাসার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
(২) “ট্রাস্ট” ও “ডাম্পিং”
ইয়োরোপ ও আমেরিকাতে শিল্পপতিরা প্রচুর পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করে। এক একটা কারখানায় দৈনিক যে পরিমাণে পণ্য উৎপন্ন হয়, তাহা শুনিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। দুনিয়ার বাজার তাহাদের করতলগত, সুতরাং এরূপ বিরাট আকারে পণ্য উৎপাদন করা তাহাদের পক্ষে পোষায়। সুয়েজ খাল তৈরী ও ষ্টীমারের প্রচলন হওয়ায় তাহারা পৃথিবীর সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত সহজে মাল রপ্তানী করিতে পারে। তাহারা লোকসান দিয়াও কম দামে মাল বিক্রয় করিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দেশীয় শিল্পকে পিষিয়া মারিতে পারে।[২]
দৃষ্টান্তস্বরূপ সাবান শিল্পের কথা ধরা যাক্। ইহার সঙ্গে সম্বন্ধ থাকার দরুণ আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সাবানের একটা প্রধান উপাদান ‘অ্যালকালি’ বিদেশ হইতে আমদানী করিতে হয়। তেলের বাজারেও দরের ওঠানামা প্রায়ই হয়। এই দরের ওঠানামা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা চাই এবং সুযোগমত যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচা মাল কিনিয়া মজুত রাখা চাই। তাহা হইলে, হাতে কোন কন্ট্রাক্ট পাইলে মাল যোগাইয়া লোকসান পড়ে না। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ী যখন বিদেশী ব্যবসায়ীর সঙ্গে আত্মরক্ষার জন্য কঠোর প্রতিযোগিতা করিতেছে, সেই সময়ে উক্ত বিদেশী ব্যবসায়ী সস্তায় জিনিষ যোগাইয়া দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিষিয়া মারিতে পারে। বস্তুতঃ, এ যেন ঠিক বামন ও দৈত্যের মধ্যে লড়াই।
‘ইম্পিরিয়াল রসায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান’ সম্বন্ধে নিম্নে যে দুইটি বিবরণ উদ্ধৃত হইল, তাহাতে এ সম্বন্ধে অনেক রহস্য জানা যাইবে।
“বর্তমান যুগে লোক যে ব্যয়বহুল ও বিলাসপূর্ণ জীবন যাপন করে, তাহা বর্তমান যুগের কার্যপ্রণালী ও অভিজ্ঞতার দ্বারাই সম্ভবপর হয়। রসায়ন শিল্পের এমন কতকগুলি লক্ষণ আছে, যাহা শিল্পসমবায় (amalgamation) সম্পর্কীয় সমস্যার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করিতে পারে। রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত প্রণালীর দ্রুত পরিবর্তন হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে। ত্রিশ বৎসর পূর্বে এই শিল্পের অবস্থা কিরূপ ছিল এবং এখন কিরূপ হইয়াছে, তাহা তুলনা করিলেই বুঝা যাইবে।
“বর্তমান কালের রাসায়নিক শিল্প নির্মাতারা যদি বাঁচতে চাহেন, তবে তাঁহাদিগকে নিজেদের শিল্পজাত সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক জগতের আধুনিকতম সংবাদ রাখিতে হইবে। তাঁহাদের এমন সব শিক্ষিত লোক রাখা প্রয়োজন, যাঁহারা লেবরেটরীতে ক্ষুদ্রাকারে পরীক্ষাকার্য করিতে পারেন। মাঝে মাঝে বৃহদাকারে পরীক্ষাকার্য চালাইবার জন্য তাঁহাদিগকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিতে হইবে। ৪। ৫টি পরীক্ষার মধ্যে অন্ততঃ তিনটিও যদি সফল হয়, তবুও আশার কথা। এইরূপ বৃহদাকারে পরীক্ষার ব্যাপার ব্যয়সাধ্য এবং যখন অনেকগুলি কর্ম প্রতিষ্ঠান হাতে থাকে, তখনই এরূপ ভাবে কাজ করা সহজ। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্রভাবে ও গোপনে কাজ করিয়া সকলে মিলিয়া যাহাতে চাহিদার তিন গুণ বেশী মাল উৎপাদন না করে, সে সম্বন্ধেও নিঃসন্দেহ হওয়া চাই। শিল্পসমবায়, পরস্পর সংযুক্ত কোম্পানী প্রভৃতি নূতন জিনিষ নয়। ১৮৯০ সালে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমবায়ে ‘ইউনাইটেড অ্যালকালি কোম্পানী’ গঠিত হয়। আমরা ‘ডাই-ষ্টাফ্স করপোরেশানের’ অভ্যুদয়ও দেখিয়াছি; ১৯০২ সালে এমন অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যেগুলি পরে একত্র করিয়া ‘দি ব্রুনার মণ্ড গ্রুপ’ গঠিত হইয়াছে। ‘নোবেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কিরূপে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাও আমরা দেখিয়াছি। সীসক এবং শ্বেত সীসকের শিল্পে আমরা বহু শিল্পব্যবসায়ের সমবায় দেখিয়াছি। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যাঁহারা ২৫ বৎসর পূর্বে শিল্প-সমবায়ের কার্য আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাঁহারা এখনও উহা চালাইতে ইচ্ছুক। ইহার অনেক কারণ আছে। এস্থলে মাত্র একটি কারণের উল্লেখ করিব। কোন একক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিল্পসমবায়ের পক্ষে গবেষণা ও পরীক্ষাকার্য অনেক সহজ।
“বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোম্পানী তথ্য সংগ্রহ করিবে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সাহায্য করিবে, এবং নবগঠিত শিল্পসমবায় কোম্পানী তাহার বিনিময়ে, আর্থিক ব্যাপারে এবং কর্ম পরিচালনা বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে সংযোগসূত্ররূপে কাজ করিবে। এইরূপে ব্রিটিশ রাসায়নিক শিল্প সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া অন্যান্য দেশের শিল্পসমবায়ের সঙ্গে সমকক্ষভাবে কাজ করিতে পারিবে। প্রত্যেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্ররূপে দুনিয়ার বাজারে প্রতিযোগিতা করিতে হইবে না। একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠিত শিল্পসমবায়ের অন্তর্ভুক্ত থাকিয়া তাহারা অনেক সুবিধা ভোগ করিতে পারিবে।
বর্তমান কালে রাসায়নিক শিল্পের জন্য কলকব্জা যন্ত্রাদি বসাইবার জন্য বহু মূলধনের প্রয়োজন। কোন বিশেষ শিল্প নির্মাণে দক্ষতা, মূলধনের সদ্ব্যবহার, নির্মাণপ্রণালীর উৎকর্ষ—এই সমস্ত সাফল্যের পক্ষে অপরিহার্য। কেবল রাসায়নিক শিল্প নয়, আধুনিক সমস্ত শিল্পের পক্ষেই এ কথা খাটে।
“সুদক্ষ ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত হইলে, বর্তমান যুগের শিল্পসমবায় কোন ব্যবসা একচেটিয়া করিতে অথবা কৃত্রিম উপায়ে মূল্য বৃদ্ধি করিতে চেষ্টা করে না। যাহাতে ব্যবসায় লাভজনক হয় এবং মূলধনী ও শ্রমিক উভয়েই তাহার সুবিধা ভোগ করে, বিভিন্ন শিল্পকে বাজারের দরের হ্রাস বৃদ্ধির উপর নির্ভর করিতে না হয়,—তাহার প্রতিই এই সমবায়ের লক্ষ্য থাকে। সুদক্ষ পরিচালকের অধীনেও বিভিন্ন শিল্পকে যে সব ঝড়-ঝাপ্টা সহ্য করিতে হয়, শিল্প সমবায় সে সমস্ত বিপদ হইতে অংশীদার ও শ্রমিকদিগকে রক্ষা করে।
“যে শিল্প-সমবায় গঠিত হইয়াছে, তাহার দ্বারা রাসায়নিক শিল্পে ইংলণ্ড ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সর্বাগ্রগণ্য হইতে পারে। বলা বাহুল্য, এই শিল্প জাতির আত্মরক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন এবং ইহার উপর অন্যান্য বহু শিল্পের প্রসার নির্ভর করে।” Chemistry and Industry, 1926. pp. 789-91.
(৩) রাসায়নিক শিল্প উৎপাদন এবং বর্তমান যুগের শিল্প
“রাসায়নিক শিল্প উৎপাদন প্রণালীর উন্নতির ফলে বর্তমান যুগের শিল্পে যুগান্তর উপস্থিত হইয়াছে। ইম্পিরিয়াল কেমিক্যাল ইনডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লর্ড মেলচেট এবং তাঁহার সহকর্মিগণ একথা খুব ভাল রূপেই বুঝেন। এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই কার্যতঃ এখন ইংলণ্ড এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত অধিকাংশ স্থানের রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত করিতেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাহিরে জার্মানী, আমেরিকা প্রভৃতি দেশেও এই কোম্পানী কার্যক্ষেত্র বিস্তৃত করিয়াছে। ১৯২৬ সালে দি ইম্পিরিয়াল কেমিক্যাল ইনডাষ্ট্রিজ কোম্পানী গঠিত হয়। প্রথমতঃ ইহার মধ্যে চারটি কোম্পানী ছিল—ব্রুনার মণ্ড অ্যাণ্ড কোং, ইউনাইটেড অ্যালকালি কোং, নোবেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং ব্রিটিশ ডাই-ষ্টাফ্স কর্পোরেশান লিমিটেড।
“বর্তমানে এই সমবায় অন্ততঃপক্ষে ৭৫টি কোম্পানী নিয়ন্ত্রণ করিতেছে। ইহার মূলধনের পরিমাণ ৯ ১/২ কোটী পাউণ্ড, তাহার মধ্যে ৭ কোটী ৬০ ৩/৪ লক্ষ পাউণ্ড মূলধন বণ্টন করা হইয়াছে।
“১৯২৮ সালে সমবায়ের লাভ হইয়াছিল ৬০ লক্ষ পাউণ্ড।”
কোন শিল্প-প্রবর্তকের সম্মুখে কি বিরাট বাধা-বিপত্তি উপস্থিত হয়, ভারতে লোহা ও ষ্টীলের কারখানার প্রতিষ্ঠাতা পরলোকগত জে, এন, টাটার জীবনে তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যায়; তিনি এই বিরাট প্রচেষ্টার সাফল্য দেখিয়া যাইতে পারেন নাই বটে, কিন্তু তিনিই ইহার পরিকল্পনার কারণ, এবং ইহার উদ্যোগ আয়োজন করিতে কঠোর পরিশ্রম করেন। এজন্য তাঁহার প্রায় ৪ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। সুদক্ষ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় টাটা কারখানা স্থাপনের উপযোগী স্থান নির্বাচন করেন। এই স্থানের সন্নিকটেই লোহার খনি এবং কয়লা ও চুনা পাথরও ইহার নিকটে পাওয়া যায়।
তিনি ইংলণ্ড ও জার্মানীতে স্থানীয় খনিজ লৌহ ও কয়লার নমুনা পরীক্ষা করান এবং জীবনের অপরাহ্ণে ক্লেশ স্বীকার করিয়া জার্মানী ও আমেরিকাতে গিয়া তথাকার লোহা ও ইস্পাত শিল্প সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। টাটার পরবর্তিগণ এই স্কীম কার্যে পরিণত করিবার জন্য কি করিয়াছিলেন, তাহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ১৯০৮ সালে সাক্চীতে কারখানা নির্মাণ কার্য আরম্ভ হয় এবং ১৯১১ সালের ২রা ডিসেম্বর সর্ব প্রথম ঐ কারখানাতে লৌহ তৈরী হয়। যুদ্ধের সময়ে টাটার কারখানা দেশ ও গবর্ণমেণ্টের জন্য খুব কাজ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রমাণ করেন বাহির হইতে কোন অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানী যখন বন্ধ হয়, তখন স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান সে অভাব কিরূপে পূরণ করিতে পারে
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র, জার্মানী ও বেলজিয়ম ভারতের বাজার সস্তা দরের ইস্পাতে ছাইয়া ফেলিল। টাটার কারখানার ইস্পাত উহার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পারিল না। কোম্পানীর অস্তিত্ব রক্ষা করিবার জন্য আমদানী ইস্পাতের উপর শুল্ক বসাইতে হইল। ইহার মধ্য হইতে প্রায় ১ ১/২ কোটী টাকা দুই বৎসরে টাটার কারখানার সাহায্যার্থে দেওয়া হইয়াছে। ইহার অর্থ, টাটার লোহা ও করোগেট টিনের জন্য প্রত্যেক দরিদ্র করদাতাকে শতকরা ১২ ১/২ টাকা অতিরিক্ত দিতে হইতেছে।[৩]
টাটার লোহার কারখানা, তাহাদের বিপুল মূলধন, যথেষ্ট প্রাকৃতিক সুবিধা, সুশিক্ষিত বিশেষজ্ঞগণ—সত্ত্বেও যদি গবর্ণমেণ্টের সাহায্য ব্যতীত বাজারে প্রতিযোগিতা করিতে অক্ষম হয়, তবে ভারতের অন্যান্য স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কিরূপ, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।
(৪) বিশেষজ্ঞের জ্ঞান বনাম ব্যবসা
কিন্তু ভারতে বিজ্ঞান ও শিল্প বিদ্যার উন্নতির পথে গুরুতর বাধা—অন্য প্রকারের। আমাদের জাতীয় চরিত্রে, বিশেষতঃ বাঙালীদের চরিত্রে শিল্প ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইবার অনিচ্ছা মজ্জাগত। ইয়োরোপ ও প্রাচীন ভারতে ধাতুশিল্প, রঞ্জনবিদ্যা প্রভৃতি সংসৃষ্ট রাসায়নিক প্রণালী, বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমূহ জ্ঞাত হইবার বহু পর্বেই অভিজ্ঞতাবলে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। মৎপ্রণীত ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ গ্রন্থে আমি ইহার কতকগুলি প্রধান প্রধান দৃষ্টান্ত দিয়াছি। ইস্পাত-নির্মাণ শিল্প ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রসিদ্ধ ডামাস্কাসের ইস্পাত এই প্রণালীতেই তৈরী হয়। ভারতে প্রায় হাজার বৎসর ধরিয়া এই শিল্প এক ভাবেই ছিল এবং কিছুদিন পূর্বে পাশ্চাত্যদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইহা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।[৪]
ইয়োরোপে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান শিল্পকার্যে নিয়োজিত হইবার জন্য ধাতু শিল্পে আশ্চর্য রকমের উন্নতি হইয়াছে। প্রায় বর্তমানে ‘বেসেমারের’ প্রণালীতে এক এক বারে ২০ টন ইস্পাত উৎপন্ন হয়। প্রত্যহ নূতন নূতন উন্নত প্রণালী উদ্ভাবিত হইতেছে। ক্রোমিয়াম, টাংষ্টেন এবং ভ্যানাডিয়াম ইস্পাতের সঙ্গে মিশ্রিত করিবার ফলে কামান ও মোটরকার নির্মাণ সম্পর্কে ইস্পাত শিল্পে যুগান্তর হইয়াছে। গে-লুসাক, গ্লোভার্স টাওয়ার্স এবং ‘কনট্যাক্ট’ প্রণালী আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে সালফিউরিক অ্যাসিড উৎপাদনের পরিমাণ বহু গুণে বাড়িয়া গিয়াছে।
বর্তমান রবার শিল্পের কথাও উল্লেখ করা যাইতে পারে। টায়ার নির্মাণ প্রভৃতি কার্যে রবারের চাহিদা বৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রবারের উৎপাদনের পরিমাণও বাড়িয়া গিয়াছে। কাঁচামাল হইতে ‘ভাল্কানাইজ্ড’ রবার প্রস্তুত করিতে নানাবিধ রাসায়নিক প্রণালী অবলম্বন করিতে হয়। জার্মানীর রংএর কারখানাসমূহের কথা উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র। ইহার এক একটি কারখানাতে ২৫০ শতেরও অধিক রাসায়নিক নিযুক্ত আছেন। আমি কিছুদিন পূর্বে (১৯২৬) ডার্মষ্টাডে মার্কের কারখানা দেখিয়া আসিয়াছি। ঐ কারখানার বিরাট কার্য দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়াছিলাম। কিন্তু গবেষণা বিভাগ দেখিয়াই আমি বেশী মুগ্ধ হইয়াছিলাম। এখানে প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞগণ কেবল যে নূতন নূতন ঔষধ তৈরী করিতেছেন, তাহা নহে, তাহার ফলাফলও পরীক্ষা করিতেছেন।
আমেরিকা, ইংলণ্ড ও ইয়োরোপের বৈদ্যুতিক কারখানাগুলির কথাও উল্লেখযোগ্য। বার্ষিক যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি তাহারা তৈরী করে, তাহার মূল্য কয়েক শত কোটী টাকার কম হইবে না। এখানেও, বর্তমান শিল্প কারখানার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক গবেষণা মিলিত হওয়াতে এরূপ বিরাট উন্নতি সম্ভবপর হইয়াছে।
লর্ড মেলচেট আন্তরিক বিশ্বাস করিতেন “রাসায়নিকেরা বর্তমান জগতের আর্থিক ও শিল্পসম্বন্ধীয় সমস্যার সমাধান করিবেন।”
“আমাদের ব্যবসায়ের প্রত্যেক অঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত যুবকদের প্রয়োজন আছে।......সমস্ত ব্যবসায়েই বৈজ্ঞানিক প্রণালীর প্রবর্তন করিতে হইবে।” “গ্রেট ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহ দিতে হইবে এবং ঐ উপায়ে যে সমস্ত শিক্ষিত যুবক তৈরী হইবে, তাহারা দেশের শিল্পোন্নতিতে সহায়তা করিবে”—লর্ড মেলচেট এই নীতির সমর্থক ছিলেন।—Journal of Chemical Society, 1931.
লর্ড মেলচেটের মন্তব্য ইয়োরোপ ও আমেরিকার শিল্প ব্যবসায়গুলির সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যাইতে পারে। উহাদের অধিকাংশ প্রায় দুই শত বৎসর হইল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং এগুলির জন্য শিক্ষিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকারীর প্রয়োজন আছে। বর্তমান রং শিল্পের জন্য এরূপ বৈজ্ঞানিকের কাজ অপরিহার্য।
আধুনিক রাসায়নিক শিল্প, ধাতুশিল্প, অথবা বৈদ্যুতিক কারখানাকে জগতের বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হইতে হয়, সুতরাং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাহাদিগকে সুদক্ষ বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের কাজে নিযুক্ত করিতে হয়। ইহার অর্থ এরূপ নহে যে— মালিকদের নিজেই বৈজ্ঞানিক হইতে হইবে। তবে বর্তমান যুগে যে সেকেলে প্রণালীতে আর কাজ চলিতে পারে না, একথা বুঝিবার মত বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা তাঁহাদের থাকা চাই এবং আধুনিকতম উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রণালীর সুযোগ গ্রহণ করিবার জন্য সর্বদা সজাগ থাকা প্রয়োজন। অ্যানড্রু কার্নেগী, জে, এন, টাটা, লর্ড লেভারহিউলম্, এবং স্বরূপচাঁদ হকুমচাঁদ ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, কেননা তাঁহারা প্রথম হইতেই বিশেষজ্ঞদের সাহায্য লইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু বর্তমান কালে ব্যবসায় আরম্ভ করিবার কাজে বিশেষজ্ঞেরা সামান্য অংশই গ্রহণ করিয়া থাকেন। আমি প্রসিদ্ধ ধনী ব্যবসায়ী পিয়ারপণ্ট মরগ্যানের উক্তি পর্বেই উদ্ধৃত করিয়াছি। তিনি বলেন,—
“আমি যে কোন বিশেষজ্ঞকে ২৫০ ডলার মূল্যে কার্যে নিযুক্ত করিতে পারি, এবং তাহার প্রদত্ত তথ্য হইতে ২৫০ হাজার ডলার উপার্জন করিতে পারি। কিন্তু ঐ বিশেষজ্ঞ আমাকে নিযুক্ত করিয়া অর্থ উপার্জন করিতে পারে না।”
কলিকাতার নিকট একমাত্র বৈজ্ঞানিক ইস্পাত শিল্পের কারখানা স্যার স্বরূপচাঁদ হুকুমচাঁদের উৎসাহ ও বুদ্ধিকৌশলে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। স্যার হকুমচাঁদের কোন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নাই। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী এবং তিনি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাইয়াছেন। তিনি কারখানা আরম্ভ করিবার পূর্বে রসায়নবিদ্যা বা বৈদ্যুতিক ধাতুশিল্পের জ্ঞানলাভের জন্য অপেক্ষা করেন নাই।
আমি শার্লোটেনবার্গে (বার্লিন) Technische Hochschule (শিল্প মহাবিদ্যালয়) দেখিয়াছি, জুরিচ ও ম্যান্চেষ্টারেও ঐরূপ প্রতিষ্ঠান দেখিয়াছি। সুতরাং এই শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানকে লঘু করিবার চেষ্টা, আমার দ্বারা সম্ভবপর নহে; কিন্তু আমার দৃঢ় অভিমত এই যে, শিল্প প্রস্তুত প্রণালীর মূলসূত্রগুলি মাত্র এইসব শিল্পবিদ্যালয়ে শেখা যায়। কিন্তু শিল্প উৎপাদনের যে কার্যকরী জ্ঞান,—কিরূপে এমন শিল্পজাত উৎপন্ন করা যায়, যাহা জগতের বাজারে প্রতিযোগিতায় বিক্রয় করা যাইতে পারে, সে অভিজ্ঞতা কেবল শিল্প ব্যবসায়ের মধ্যে থাকিয়াই লাভ করা সম্ভবপর।
সম্প্রতি বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসে ইহার একটি দৃষ্টান্ত আমি দেখিয়াছি। তাহাতে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, টেকনোলজিক্যাল ইনষ্টিটিউটে লব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা কারখানায় হাতেকলমে জ্ঞান লাভ করা অধিকতর ফলপ্রদ। কিছুদিন হইল, আমাদের একটি সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরীর যন্ত্র বসাইতে হয়। সাধারণতঃ যন্ত্রনির্মাতা কোন ইংরাজ শিল্পীকেই যন্ত্রটি বসাইবার জন্য ডাকা হইত এবং তিনি কোন বিশেষজ্ঞকে ঐ উদ্দেশ্যে পাঠাইয়া দিতেন। বিশেষজ্ঞকে অনেক টাকা পারিশ্রমিক, পাথেয় এবং হোটেলের ব্যয় দিতে হইত। ১৫ বৎসর পূর্বে আমরা একজন যুবককে কারখানার কাজে নিযুক্ত করি। তিনি তখন কেবল জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘জুনিয়র কোর্সে’ শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। রাসায়নিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর সংস্পর্শে থাকার দরুণ, আমাদের ব্যবসায়ের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও বৃদ্ধি পাইয়াছিল। তাঁহার নিজের বিভাগে তিনি বিশেষরূপে দক্ষতা লাভ করেন। আমরা বিনা দ্বিধায় তাঁহার হস্তে নূতন অ্যাসিড প্ল্যাণ্ট তৈরীর ভার ন্যস্ত করিলাম। যন্ত্রনির্মাতা যে প্ল্যান ও বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছিলেন, তিনি বিশেষ যত্ন সহকারে তাহার তাৎপর্য বুঝিয়া লইয়াছিলেন। এই কার্যে কৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শন করিয়া তিনি আমাদের সকলেরই প্রশংসা অর্জন করেন। যন্ত্রনির্মাতা যে প্ল্যান দাখিল করেন, তাহার মধ্যে কয়েকটি ত্রুটিও তিনি প্রদর্শন করেন এবং সেগুলি যন্ত্রনির্মাতা নিজেও মানিয়া লন। ভারতবর্ষে বোধহয় ইহাই অন্যতম বড় অ্যাসিড তৈরীর কল। টেকনোলজিক্যাল ইনষ্টিটিউটে, ছাত্রদের সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা দিবার জন্য কলের একটি ক্ষুদ্র নমুনা দেখান হয়। এইভাবে প্রদর্শনীতে তাজমহলের নমুনাও দেখান হয়। সেই তাজমহলের নমুনা দেখিয়া যেমন কেহ তাজমহল তৈরী করিতে পারে না, তেমনি ক্ষুদ্র একটি নমুনা দেখিয়া অ্যাসিড তৈরীর কলও কেহ বসাইতে পারে না।
(৫) ব্যবসায়ে কলেজের গ্রাজুয়েট
তবে কি শিল্প ব্যবসায়ে কলেজে শিক্ষিত যুবকের স্থান নাই? স্থান নিশ্চয়ই আছে, তবে তাহা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। তজ্জন্য তাহাকে ছাত্রজীবনের অদ্ভুত ধারণাসমূহ ত্যাগ করিতে হইবে এবং নূতন করিয়া শিক্ষানবীশ হইয়া গোড়া হইতে কাজ আরম্ভ করিতে হইবে। এইরূপ অবস্থায় সে তাহার যোগ্যতা সপ্রমাণ করিতে পারে। কার্নেগী বলেন,—
“পূর্বে আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবকেরা অল্ই বয়সেই গ্রাজুয়েট হইত। আমরা এই নিয়মের পরিবর্তন করিয়াছি। এখন যুবকেরা বেশী বয়সে গ্রাজুয়েট হইয়া জীবন সংগ্রামে প্রবেশ করে—অবশ্য তাহারা পূর্বেকার গ্রাজুয়েটদের চেয়ে অনেক বেশী বিষয় শিখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকেরা যদি তাহাদের মুখ্য কর্মক্ষেত্রে সমস্ত শক্তি ও সময় দিয়া জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করিতে চেষ্টা না করে, তবে তাহারা যে সব যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করে নাই, অথচ অল্পবয়সে ব্যবসায়ে প্রবেশ করিয়াছে, তাহাদের অপেক্ষা বেশী অসুবিধা ভোগ করিবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
“অধিক বয়স্ক গ্রাজুয়েটরা উন্নতিশীল ব্যবসায়ে আর এক প্রকারের অসুবিধায় পতিত হয়। ঐ ব্যবসায়ে চাকরীর ব্যবস্থা সুশৃঙ্খলিত, যোগ্যতা অনুসারে ‘প্রোমোশান’ দেওয়া হয়। সুতরাং সেখানে কাজ নিতে হইলে, সর্বনিম্ন স্তরে প্রবেশ করিতে হয়। তাহাকে গোড়া হইতেই কাজ আরম্ভ করিতে হয় এবং এই নিয়ম তাহার নিজের পক্ষে ও অন্য সকলের পক্ষেই ভাল।—The Empire of Business, pp. 206-8.
“মেধাবী গ্রাজুয়েট মেধাবী অ-গ্রাজুয়েটের চেয়ে নিশ্চয়ই যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ। সে বেশী শিক্ষা পাইয়াছে এবং অন্য সমস্ত গুণ সমান হইলে, শিক্ষা দ্বারা নিশ্চয়ই যোগ্যতা বৃদ্ধি হইবে; দুইজন লোকের সাধারণ যোগ্যতা, কর্মশক্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি একই প্রকারের হয়, তবে তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিকতর উদার ও উচ্চাঙ্গের শিক্ষা লাভ করিয়াছে, সে নিশ্চয়ই কর্মক্ষেত্রে বেশী সুবিধার অধিকারী হইবে।” (The Empire of Business).
পরলোকগত লর্ড মেলচেটের (আলফ্রেড মণ্ড) জীবনে ইহার সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখা গিয়াছে। লর্ড মেলচেট একজন কৃতী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দুইটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন, ব্যারিষ্টারও হইয়াছিলেন। তাঁহার পিতা লাডুইগ মণ্ড একটি সুবৃহৎ অ্যালকালি কারখানার মালিক ছিলেন। লাডুইগ মণ্ডও জার্মানীর হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছিলেন এবং কোলবে ও বুনসেনের নিকট রসায়ন বিদ্যা অধ্যয়ন করেন। তিনি তাঁহার বন্ধু জন টি, ব্রুনারের অংশীদার রূপে ব্যবসায়ে প্রবেশ করেন। ব্রুনার মেসার্স হাচিনসনের রাসায়নিক কারবারের কর্তা ছিলেন।
কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে (১৯৩১) লিখিত হইয়াছে:—
“১৮৭৩—১৮৮১ সাল পর্যন্ত আট বৎসর ব্যবসায়টিকে নানা বিঘ্ন বিপত্তির মধ্যে কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল; কেবল অংশীদার দুইজনের প্রতিভা, দৃঢ় সঙ্কল্প এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই সাফল্য লাভ হইয়াছিল।
“এইরূপে জীবনের ষোল বৎসর কাল ধরিয়া তরুণ আলফ্রেড মণ্ড তাঁহার চোখের সম্মুখে একটি বৃহৎ ব্যবসায়কে গড়িয়া উঠিতে দেখিয়াছিলেন, এবং বৈজ্ঞানিক কর্মশালার আবহাওয়ার মধ্যে তিনি বাস করিয়াছিলেন।”
ইয়োরোপ ও আমেরিকাতে ব্যবসায়ের ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে কিরূপ সীমাবদ্ধ, তাহা আমি দেখাইয়াছি। আমাদের দেশে, আবার ততোধিক বিপুল বাধা বিঘ্নের সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হয়। সাধারণ ইয়োরোপীয় বা আমেরিকান, গ্রাজুয়েটের সাহস, কর্মোৎসাহ এবং সর্বপ্রকার বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া জয়লাভের জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প আছে, কিন্তু ভারতীয় গ্রাজুয়েটদের চরিত্রে ঐ সব গুণ নাই। আমাদের রাসায়নিক কারখানায় প্রায় ৬০ জন বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট আছে। তাহারা তাহাদের দৈনন্দিন নির্দিষ্ট কাজ বেশ চালাইতে পারে। কিন্তু তাহারা নিজের চেষ্টায় বা কর্মপ্রেরণায় প্রায়ই কিছু করিতে পারে না।
বর্তমানে বাংলা দেশে আমাদের একটি গুরুতর সমস্যা উপস্থিত। বাঙালীকে তাহার কৃষিজাত দ্রব্য যথা পাট, শস্য, তৈল-বীজ, প্রভৃতি বিক্রয়ের জন্য অবাঙালীর উপর নির্ভর করিতে হয়। সুতরাং তাহাদের পক্ষে ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করা কঠিন। কেননা, তাহা করিতে হইলে তাহাদিগকে (বাঙালীকে) কেবল যে উচ্চাঙ্গের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ করিতে হইবে, তাহা নহে; ব্যবসায় পরিচালনার বিশেষ ক্ষমতাও থাকা চাই এবং এই শেষোক্ত গুণটি দুর্ভাগ্যক্রমে বাঙালীদের চরিত্রে এখনও বিকাশ লাভ করে নাই। সে ব্যবসায় পত্তনের জন্য মূলধন সংগ্রহ করিতে পারে না, সে এখনও এমন কোন প্রতিষ্ঠাবান্ ব্যাঙ্ক স্থাপন করিতে পারে নাই, যাহার নিকট হইতে আর্থিক সহায়তা লাভ করিতে পারে। বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প বিদ্যালয়গুলি অসংখ্য গ্রাজুয়েট বা ডিপ্লোমাধারী সৃষ্টি করিতেছে। শিক্ষাব্যবসায়েও যথেষ্ট লোকের ভিড়। সুতরাং শিক্ষিত যুবকদের জীবিকা সমস্যা কিরূপে সমাধান করা যায়, সেই চিন্তাই আমাদের পক্ষে গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে।[৫]
পূর্বোক্ত আলোচনা হইতে আমরা একটা সুস্পষ্ট শিক্ষা লাভ করিতে পারি। কোন নির্দিষ্ট কাজে বা চল্তি কারবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকেরা অনেক সময় বেশ দক্ষতা দেখাইতে পারে। কিন্তু যাহাদের ব্যবসায় বুদ্ধি আছে এবং নানা বাধা বিঘ্নের সঙগে সংগ্রাম করিয়া স্বীয় চেষ্টায় সাফল্য লাভ করিয়াছে, সেই শ্রেণীর লোকই কেবল কোন ব্যবসায় গড়িয়া তুলিতে পারে।
বর্তমান চীন সম্বন্ধে একজন চিন্তাশীল ও দূরদর্শী ব্যক্তির মন্তব্য উদ্ধৃত করিয়া আমি অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছি। আর একজন দূরদর্শী লেখকের সারগর্ভ মন্তব্য উদ্ধৃত করিয়া আমি এই অধ্যায় শেষ করিব।
“একথা সত্য যে, চীন এখনও কৃষিপ্রধান দেশ, কিন্তু গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে চীনে বহু ব্যবসায় ও কলকারখানার কেন্দ্র গড়িয়া উঠিয়াছে এবং যেখানে ঐগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সেখানেই দেখা গিয়াছে যে চীনা ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা আধুনিক প্রয়োগ কৌশল আয়ত্ত করিয়া লইয়াছে। চীনারা পাশ্চাত্য শিল্পকৌশল প্রয়োগ করিতে পারে। তাহারা কারখানা, রেলপথ, ব্যবসায়ী সঙ্ঘ এবং সামরিক বিভাগ গড়িয়া তুলিতে পারে।” Scott Nearing: Whither China? P. 182.
দেখা যাইতেছে, এই উভয় গ্রন্থকারেরই সুচিন্তিত অভিমত এই যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সহযোগিতা চাই। তাহারা এমন সমস্ত বিশেষজ্ঞদের নিযুক্ত করিবে, যাহারা পাশ্চাত্য শিল্প কৌশল কাজে লাগাইতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট বা শিল্প বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাধারীরা এই শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ নহে।
- ↑ বর্তমানে জাপান ও জেকোশ্লোভাকিয়া কলিকাতার বাজারে দেশীয় শিল্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দী।
- ↑ বিদেশ হইতে সস্তায় পণ্য আমদানী বন্ধ করিবার জন্য এবং বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য আইন করিবার ক্ষমতা প্রত্যেক প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রেরই আছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ হইতে এরূপ কোন আইন করিবার প্রচেষ্টায় প্রবলভাবে বাধা দেওয়া হইয়াছে। আপ্টন ক্লোজ: The Revolt of Asia, pp. 104-5.
- ↑ ইহা ৪।৫ বৎসর পূর্বে লিখিত। পরবর্তী সময়ে, ‘ইম্পিরিয়াল প্রেফারেন্স’ বা সাম্রাজ্য বাণিজ্য শুল্কের নীতি অনুসারে টাটার কারখানা বৎসরে ৮০ লক্ষ টাকা বা তাহারও বেশী ‘রয়াল্টি’ পাইতেছে।
- ↑ “দিল্লীর স্তম্ভ যে লৌহ দ্বারা নির্মিত, স্যার রবার্ট হ্যাড্ফিল্ড তাঁহার কারখানায় উহা বৈজ্ঞানিক ভাবে পরীক্ষা করেন। এই স্তম্ভ এক হাজার বৎসর পূর্বে নির্মিত হইয়াছিল বলিয়া প্রসিদ্ধ। স্যার রবার্ট বলেন, পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, এই লৌহ অতি আশ্চর্য রকমের বস্তু। ইহাতে এমন কোন বিশেষ গুণ নিশ্চয়ই ছিল, যাহার ফলে এই এক হাজার বৎসর ইহা টিকিয়া আছে, কোনরূপ মরিচা পড়ে নাই; বর্তমান যুগে যে সমস্ত লৌহ প্রস্তুত হয়, তাহা অপেক্ষা উহা শ্রেষ্ঠ। * * *
“বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে ধাতু শিল্প সম্বন্ধে প্রভূত উন্নতি হইলেও, দিল্লীর স্তম্ভের লৌহ এখনকার কারখানায় প্রস্তুত লৌহ অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ। তিনি বৈজ্ঞানিকের দায়িত্ব জ্ঞান লইয়াই এই কথা বলিয়াছেন। ধাতু শিল্পের কতকগুলি গূঢ় রহস্য লুপ্ত হইয়াছে।” (মৎপ্রণীত Makers of Modern Chemistry.)
এই স্তম্ভ সম্বন্ধে রস্কো ও শোর্লেমার তাঁহাদের রসায়ন সম্বন্ধীয় গ্রন্থে লিখিয়াছেন— “বর্তমান যুগে আমাদের বৈজ্ঞানিক কারখানার বাষ্পীয় শক্তি দ্বারা চালিত বড় বড় হাতুড়ী ও রোলার দ্বারাও এরূপ প্রকাশনা লৌহ পিণ্ড তৈরী করা কঠিন। হিন্দুরা হাতে কাজ করিয়া কিরূপে এরূপ বিশাল লৌহপিণ্ড তৈরী করিয়াছেন, তাহা আমরা বুঝিতে অক্ষম।” - ↑ ১৯৩০ সালের ২৭শে আগষ্ট তারিখে, বোম্বাই সহরে শিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষে, আমি বলিয়াছিলাম;—“১৬ বৎসর পূর্বে মডার্ণ রিভিউয়ের প্রবীণ সম্পাদক আমাকে ‘ডক্টরদের ডক্টর’ উপাধি দিয়াছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল এই যে আমি বহু বৈজ্ঞানিক ‘ডক্টরের’ সৃষ্টি করিয়াছি। এখন আমি হতভম্ভের ন্যায় দেখিতেছি যে, বৎসরের পর বৎসর কেবল যে আমার লেবরেটরী হইতেই অসংখ্য ‘ডক্টরের’ সৃষ্টি হইতেছে তাহা নহে, আমার পুরাতন ছাত্রেরা—কলিকাতা, ঢাকা, এলাহাবাদ, লাহোর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রূপে অসংখ্য ‘ডক্টর’ সৃষ্টি করিতেছেন। বস্তুতঃ যদি আমার রাসায়নিক শিষ্য ও অনুশিষ্য ‘ডক্টর’দের একটি তালিকা প্রস্তুত করা যায়, তবে তাহা সত্যই বিস্ময়কর হইবে। কিন্তু তবু রাসায়নিক শিল্প সম্বন্ধে আমরা ভারতবাসীরা শিশুর মতই অসহায়!”