বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ষড়্‌‍বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

কামধেনু বঙ্গদেশ

রাজনৈতিক পরাধীনতার জন্য বাংলার ধন শোষণ

 “প্রথম হইতেই বাংলা ভারতের কামধেনু স্বরূপ ছিল এবং অন্যান্য সকল প্রদেশ বাংলা হইতেই অর্থ শোষণ করিত।”—উইলিয়ম হাণ্টার

(১) বাংলা সকলের মহাজন

 ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, মোগল সম্রাটদের ঐশ্বর্যের যুগেও বাংলা দেশ তাহার নিজের শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না। বাংলার সামরিক ব্যয় অন্যান্য সুবা হইতে সংগ্রহ করিতে হইত! আওরঙজেব রাজ সংক্রান্ত কার্যে মুর্শিদ কুলি খাঁর যোগ্যতা বুঝিতে পারিয়া তাঁহাকে বাংলাদেশের দেওয়ান নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁর সুবন্দোবস্তের ফলে শীঘ্রই বাংলার রাজস্ব এক কোটী টাকায় দাঁড়াইল। দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযান করিবার নিমিত্ত আওরঙজেবের তখন অর্থের বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছিল, এবং মুর্শিদ কুলি খাঁ এই অর্থ যোগাইয়া সম্রাটের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন। বাংলার নামমাত্র সুবেদার সুলতান আজিম ওসান দিল্লী যাইবার সময়ে পথিমধ্যে সম্রাট আওরঙজেবের মৃত্যুসংবাদ শুনিলেন (১৭০৭)। বাংলা হইতে সংগৃহীত রাজস্ব প্রায় এক কোটী টাকা তাঁহার হস্তগত হইল। খুব সম্ভব এই টাকা দিল্লীর সম্রাটকে দেয় বাংলার বার্ষিক রাজস্ব।[]

 ম্যাণ্ডেভিল ১৭৫০ খৃঃ লিখেন যে, সম্রাটের রাজস্ব দিবার জন্য বাংলার সমস্ত রৌপ্য শোষণ করিতে হইত। ইহা দিল্লীতে যাইত, কিন্তু সেখান হইতে আর ফেরত আসিত না! সুতরাং এই শোষণের পর মুর্শিদাবাদের ধনভাণ্ডারে কিছুই থাকিত না এবং বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালান বা বাজার হাট করাই কঠিন হইত। পরবর্তী জাহাজে বিদেশ হইতে রৌপ্যের আমদানী না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলিত।[]

 ১৭৪০—৫০ খৃঃ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রীয়েরা বাংলাদেশ হইতে যে ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং চৌথ আদায় করিয়াছিল, তাহার পরিমাণ কয়েক কোটী টাকা হইবে। সৈয়র মুতাখেরিনের মতে, প্রথম মারাঠা অভিযানের সময়ে মুর্শিদাবাদ সহরের চারিদিকে প্রাচীর ছিল না। সেই সময়ে মীর হাবিব এক দল অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া আলিবর্দী খাঁর আগমনের পূর্বেই মুর্শিদাবাদ সহর আক্রমণ করেন এবং জগৎশেঠের বাড়ী হইতে দুই কোটী টাকার আর্কট মুদ্রা লইয়া যান। কিন্তু এই বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের ফলেও জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের কিছুমাত্র সম্পদ ক্ষয় হয় না। তাঁহারা পূর্বের মতই সরকারকে এক এক বার এক কোটী টাকার হুণ্ডী বা ‘দর্শনী’ দিতে থাকিতেন।

 বাংলার ইতিহাসের যুগসন্ধি পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে,—লুণ্ঠন, শোষণ প্রভৃতি আকস্মিক বা সাময়িক ছিল এবং লোকে তাহার কুফল হইতে শীঘ্রই সারিয়া উঠিতে পারিত। কিন্তু বর্তমানে এই প্রদেশ ক্রমাগত যে ভাবে শোষিত হইতেছে, তাহা উহাকে একেবারে নিঃস্ব করিয়া ফেলিয়াছে। উহা হইতে উদ্ধার লাভের তাহার উপায় নাই। পলাশীর যুদ্ধের পর, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা আসিয়া পড়িল এবং রোমের প্রিটোরিয়ান গার্ডদের মত তাঁহারাও মুর্শিদাবাদের মসনদ নীলামে সর্বোচ্চ দরে বিক্রয় করিলেন। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির তৃতীয় রিপোর্ট অনুসারে (১৭৭৩) দেখা যায় যে, ১৭৫৭—১৭৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলার “ওয়ারউইকেরা” বাংলার মসনদে নূতন নূতন নবাবকে বসাইয়া ৫।৬ কোটী টাকার কম উপার্জন করেন নাই। এই বিপুল অর্থের অধিকাংশই কোন না কোন আকারে ইংলণ্ডে প্রেরিত হইয়াছিল।[]

 কিন্তু পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার তুলনায় ইহা অতি সামান্য অনিষ্ট করিয়াছে। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর নামমাত্রে পর্যবসিত সম্রাটের নিকট হইতে দেওয়ানী পাইয়া, কোম্পানী—আইনতঃ ও কার্যতঃ—বাংলার শাসন কর্তা হইয়া বসিলেন। বাংলার মোট রাজস্ব হইতে মোগল সম্রাটের কর (২৬ লক্ষ টাকা), নবাবের ভাতা এবং আদায় খরচা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিত, তাহা মূলধন রূপে খাটানো হইত।

 ইষ্টি ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষ্টক হোল্ডারগণ এমন কি ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টও বাংলার রাজস্বের ভাগ দাবী করিতে লাগিলেন। এই উদ্বৃত্ত অর্থের অধিকাংশ দ্বারাই পণ্য ক্রয় করিয়া রপ্তানী করা হইতে লাগিল, কিন্তু তাহার পরিবর্তে বাংলার কিছুই লাভ হইত না।

 একটি দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা পরিষ্কার হইবে। ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দেও, “রাজস্ব আদায় করা কালেক্টরের প্রধান কর্তব্য ছিল এবং উহার সাফল্যের উপরই তাঁহার নাম নির্ভর করিত, তাঁহার শাসনের আমলে প্রজাদের অবস্থা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না” (হাণ্টার)। বীরভূম ও বিষ্ণুপর এই দুই জেলার নিট রাজস্ব এক লক্ষ পাউণ্ডেরও বেশী হইত, এবং গবর্ণমেণ্টের শাসন ব্যয় ৫ হাজার পাউণ্ডের বেশী হইত না। অবশিষ্ট ৯৫ হাজার পাউণ্ডের কিয়দংশ কলিকাতা বা অন্যান্য স্থানের তোষাখানায় পাঠানো হইত এবং কিয়দংশ জেলায় জেলায় কোম্পানীর কারবার চালাইবার জন্য ব্যয় করা হইত।

 রাজস্বের উদ্ধৃত্তাংশ মূলধন রূপে (ইনভেস্টমেণ্ট) খাটানোর কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ব্যাপারটা কি এবং তাহার পরিণামই বা কিরূপ হইয়াছিল তাহা হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির ৯ম রিপোর্টে (১৭৮৩) বিশদরূপে বর্ণনা করা হইয়াছে:—

 “বাংলার রাজস্বের কিয়দংশ বিলাতে রপ্তানী করিবার উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করিবার জন্য পৃথক ভাবে রাখা হইত এবং ইহাকেই ‘ইনভেষ্টমেণ্ট’ বলিত। এই ‘ইনভেস্টমেণ্ট’এর পরিমাণের উপরে কোম্পানীর প্রধান কর্মচারীদের যোগ্যতা নির্ভর করিত। ভারতের দারিদ্র্যের ইহাই ছিল প্রধান কারণ, অথচ ইহাকেই তাহার ঐশ্বর্ষের লক্ষণ বলিয়া মনে করা হইত। অসংখ্য বাণিজ্য পোত ভারতের মূল্যবান পণ্যসম্ভারে পূর্ণ হইয়া প্রতি বৎসর ইংলণ্ডে আসিত এবং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে ঐ ঐশ্বর্যের দৃশ্য প্রদর্শিত হইত। লোকে মনে করিত, যে দেশ হইতে এমন সব মূল্যবান, পণ্যসম্ভার রপ্তানী হইয়া আসিতে পারে, তাহা না জানি কতই ঐশ্বর্যশালী ও সেখানকার অধিবাসীরা কত সুখী! এই রপ্তানী পণ্যের দ্বারা এরূপও মনে হইতে পারিত যে, প্রতিদানে ইংলণ্ড হইতেও পণ্য সম্ভার ভারতে রপ্তানী হয় এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের মূলধন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইহা প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যসম্ভার নয়, ভারতের পক্ষ হইতে প্রভু ইংলণ্ডকে দেয় বার্ষিক কর মাত্র, এবং তাহাই লোকের মনে ঐশ্বর্যের মিথ্যা মায়া সৃষ্টি করিত।”

 বাংলার ঐশ্বর্য সরাসরি বিলাতে যাইত অথবা অন্য উপায়ে পরোক্ষভাবে বিলাতে পৌছিত,—উহার ফল বাংলার পক্ষে একই প্রকার। হাণ্টার বলেন:—

 “ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ব্যবসাদার হিসাবে প্রতি বৎসর প্রায় ২ ১/২ লক্ষ পাউণ্ড বাংলা হইতে চীনে লইত; মাদ্রাজ তাহার মূলধনের জন্য বাংলা হইতে অর্থ সংগ্রহ করিত; এবং বোম্বাই তাহার শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না, বাংলা হইতেই ঐ ব্যয় যোগাইতে হইত। কাউন্সিল সর্বদা এই অভিযোগ করিতেন যে, একদিকে অন্তর্বাণিজ্য চালাইবার মত মুদ্রা দেশে থাকিত না, অন্যদিকে দেশ হইতে ক্রমাগত অজস্র রৌপ্য বাহিরে রপ্তানী হইত।”

 ১৭৮০ খৃঃ প্রধান সেনাপতি স্যার আয়ার কুট সপরিষদ গবর্ণর জেনারেলকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেন:—

 “মাদ্রাজের ধনভাণ্ডার শূন্য, অথচ ফোর্ট সেণ্ট জর্জের ব্যয়ের জন্য মাসিক ৭ লক্ষ টাকার বেশী আশু প্রয়োজন। ইহার প্রত্যেক কড়ি বাংলা হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে, অন্য কোন স্থান হইতে এক পয়সাও পাইবার সম্ভাবনা আমি দেখিতেছি না।”

 ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে প্রধান সেনাপতি বিলাতের ‘ইণ্ডিয়া হাউসে’ লিখেন,—“রাজ্যের অধিবাসী ও সৈন্য সকলকেই প্রধানতঃ বাংলার অর্থেই পোষণ করিতে হইতেছে।”

 হাণ্টার লিখিয়াছেন—“মারাঠা যুদ্ধ চালাইবার জন্য কলিকাতার ধনভাণ্ডার শূন্য করা হইয়াছিল।......১৭৯০ খৃষ্টাব্দের শেষে টিপু সলতানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোম্পানীর ধনভাণ্ডার শোষিত হইয়াছিল।”

 লর্ড ওয়েলেস্‌লি মারাঠাদের সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং তাহার ফলে শেষ পর্যন্ত মারাঠা শক্তি ধ্বংস হইয়াছিল। কিন্তু এই যুদ্ধের ব্যয় বাংলাকেই যোগাইতে হইয়াছিল। স্মরণাতীত কাল হইতে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাই ছিল ভারতের মহাজন।

(২) পলাশী শোষণ

 এই অধ্যায়ের প্রথমে দিল্লী কর্তৃক বাংলার ধনশোষণের কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু এই শোষণের সহিত ‘পলাশী শোষণ’ রূপে যাহা পরিচিত, তাহার যথেষ্ট প্রভেদ আছে; যে আর্থিক শোষণের ফলে বাংলার ধন ক্রমাগত ইংলণ্ডে চলিয়া যাইতেছে, তাহারই নাম ‘পলাশী শোষণ’।

 “১৭০৮ খৃঃ—১৭৫৬ খৃঃ পর্যন্ত বাংলায় ইংরাজ কোম্পানীর আমদানী পণ্যের শতকরা ৭৪ ভাগই ছিল স্বর্ণ এবং ইহার পরিমাণ ছিল ৬৪,০৬,০২৩ পাউণ্ড। ইংরাজ কোম্পানীর কথা ছাড়িয়া দিলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয়ই বেশ উন্নতিশীল ছিল। হিন্দু, আর্মানী এবং মুসলমান বণিকেরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এবং আরব, তুরস্ক ও পারস্যের সঙ্গে প্রভূত পরিমাণে ব্যবসা চালাইত।” (সিংহ)

 ইহার পর, ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে এডমাণ্ড বার্ক, ফক্সের ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া বিলের’ আলোচনাকালে, একটি স্মরণীয় বক্তৃতা করেন। ‘পলাশী শোষণের’ ফলে ভারতের (কার্যতঃ বাংলার) ধন কিরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছিল, এই বক্তৃতায় তিনি তাহার জ্বলন্ত চিত্র অঙ্কিত করেন:—

 “এশিয়ার বিজেতাদের হিংস্রতা শীঘ্রই শান্ত হইত, কেননা তাহারা বিজিত দেশেরই অধিবাসী হইয়া পড়িত। এই দেশের উন্নতি বা অবনতির সঙ্গে তাহাদের ভাগ্যসূত্র গ্রথিত হইত। পিতারা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আশা সঞ্চয় করিত, সন্তানেরাও পূর্বে পুরুষগণের স্মৃতি বহন করিত। তাহাদের অদৃষ্ট সেই দেশের সঙ্গেই জড়িত হইত এবং উহা যাহাতে বাসযোগ্য বরণীয় দেশ হয়, সেজন্য তাহারা চেষ্টার ত্রুটি করিত না। দারিদ্র্য, ধ্বংস ও রিক্ততা—মানুষের পক্ষে প্রীতিকর নয় এবং সমগ্র জাতির অভিশাপের মধ্যে জীবন যাপন করিতে পারে, এরূপ লোক বিরল। তাতার শাসকেরা যদি লোভ বা হিংসার বশবর্তী হইয়া অত্যাচার, লুণ্ঠন প্রভৃতি করিত, তাহা হইলে তাহার কুফলও তাহাদের ভোগ করিতে হইত। অত্যাচার উপদ্রব করিয়া ধন সঞ্চয় করিলেও তাহা তাহাদের পারিবারিক সম্পত্তিই হইত এবং তাহাদেরই মুক্তহস্তে ব্যয় করিবার ফলে অথবা অন্য কাহারও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য ঐ ধন প্রজাদের হাতেই পুনরায় ফিরিয়া যাইত। শাসকদের স্বেচ্ছাচার, সর্বদা অশান্তি প্রভৃতি সত্ত্বেও, দেশের ধন উৎপাদনের উৎস শুকাইয়া যাইত না, সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রভৃতির উন্নতিই দেখা যাইত। লোভ ও কার্পণ্যও একদিক দিয়া জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করিত ও তাহাকে কাজে খাটাইত। কৃষক ও শিল্পীদের ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ দিতে হইত, কিন্তু তাহার ফলে মহাজনদের ঐশ্বর্য-ই বর্দ্ধিত হইত এবং কৃষক ও শিল্পীরা পুনর্বার ঐ ভাণ্ডার হইতে ঋণ করিতে পারিত। তাহাদিগকে উচ্চ মূল্যে মূলধন সংগ্রহ করিতে হইত, কিন্তু উহার প্রাপ্তি সম্বন্ধে তাহাদের মনে কোন সংশয় থাকিত না এবং এই সকলের ফলে দেশের আর্থিক অবস্থাও মোটের উপর উন্নত হইত।

 “কিন্তু ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের আমলে ঐ সমস্তই উল্টাইয়া গিয়াছে। তাতার অভিযান অনিষ্টকর ছিল বটে, কিন্তু আমাদের ‘রক্ষণাবেক্ষণই’ ভারতকে ধ্বংস করিতেছে। তাহাদের শত্রুতা ভারতের ক্ষতি করিয়াছিল আর আমাদের বন্ধুতা তাহার ক্ষতি করিতেছে। ভারতে আমাদের বিজয়—এই ২০ বৎসর পরেও (আমি বলিতে পারি ১৭৫ বৎসর পরেও—গ্রন্থকার) সেই প্রথম দিনের মতই বর্বরভাবাপন্ন আছে। ভারতবাসীরা পক্ককেশ প্রবীণ ইংরাজদের কদাচিৎ দেখিয়া থাকে; তরুণ যুবক বা বালকেরা ভারতবাসীদের শাসন করে; ভারতবাসীদের সঙ্গে তাহারা সামাজিকভাবে মিশে না, তাহাদের প্রতি কোন সহানভূতির ভাবও উহাদের নাই। ঐ সব ইংরাজ যুবক ইংলণ্ডে থাকিলে যে ভাবে বাস করিত, ভারতেও সেইভাবে বাস করে। ভারতবাসীদের সঙ্গে যেটুকু তাহারা মিশে, সে কেবল রাতারাতি বড়মানুষ হইবার জন্য। তাহারা যুবকসুলভ দুর্নিবার লোভ ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া এক দলের পর আর এক দল ভারতে যায়, এবং ভারতবাসীরা এই সব সামরিক অভিযানকারী ও সুবিধাবাদীদের দিকে হতাশনেত্রে চাহিয়া থাকে। এক দিকে ভারতের ধন যতই ক্ষয় হইতেছে, অন্য দিকে এই সব যুবকদের লোভ ততই বাড়িয়া চলিয়াছে। ইংরাজদের লাভের প্রত্যেকটি টাকা, ভারতের সম্পদকে ক্ষয় করিতেছে।”

 কোম্পানীর কর্মচারীরা ভারত হইতে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিত এবং বিলাতে ফিরিয়া অসদুপায়ে লব্ধ সেই ঐশ্বর্যে নবাবী করিত। তাহারা যতদূর সম্ভব জাঁকজমক ও বিলাসিতার মধ্যে বাস করিত। সমসাময়িক ইংরাজী সাহিত্যে এই সব ‘নবাব’দের বিলাসব্যসনের প্রতি তাঁর শ্লেষ ও বিদ্রূপ আছে।

“Rich in the gems of India’s gaudy zone,
And plunder, piled from kingdoms not their own,

* * * *

Could stamp disgrace on man’s polluted name,
And barter, with their gold, eternal shame.”

 ১৭৫৭ খৃঃ হইতে ১৭৮০ খৃঃ পর্যন্ত ভারত হইতে যে ধন ইংলণ্ডে শোষিত হইয়াছিল তাহার পরিমাণ ৩ কোটী ৮০ লক্ষ পাউণ্ডের কম নহে। ইহাই ‘পলাশী শোষণ’ নামে পরিচিত। বাংলার লোকের পক্ষে এই ব্যয়ের বোঝা যে অত্যন্ত দুর্বহ ও কষ্টকর হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। টাকার শক্তি বর্তমানের চেয়ে তখন পাঁচ গুণ ছিল, সেই জন্য এখনকার চেয়ে সে যুগে ঐ শোষণের ফলে দুঃখ ও দুর্দশা আরও বেশী হইবার কথা।[]

 ১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ পার্লামেণ্টারী কমিটীর সম্মুখে তাঁহার সাক্ষ্যে বলেন:—

 “মুর্শিদাবাদ সহর লণ্ডন সহরের মতই বিশাল, জনবহুল ও ঐশ্বর্যশালী। প্রভেদ এই যে, প্রথমোক্ত সহরে এমন সব প্রভূত ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি আছেন, যাঁহাদের সঙ্গে লণ্ডনের কোন ধনী ব্যক্তির তুলনা হইতে পারে না।”

 কিন্তু ২৫ বৎসরের মধ্যেই ঐ মুর্শিদাবাদ সহরের অবস্থা ‘গজভুক্ত কপিত্থবৎ’ হইয়াছিল। ‘পলাশী শোষণের’ ফলে উহার সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল।

 ডিন ইন্‌জে তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ স্পষ্টবাদিতার সঙ্গে বলিয়াছেন:—

 “বাংলাদেশের ধনলুণ্ঠনের ফলেই প্রথম প্রেরণা আসিল। ক্লাইভের পলাশী বিজয়ের পর ৩০ বৎসর ধরিয়া বাংলা হইতে ইংলণ্ডে ঐশ্বর্ষের স্রোত বহিয়া আসিয়াছিল। অসদুপায়ে লব্ধ এই অর্থ ইংলণ্ডের শিল্প বাণিজ্য গঠনে শক্তি যোগাইয়াছিল। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের পরে ফ্রান্সের নিকট হইতে লুণ্ঠিত ‘পাঁচ মিলিয়ার্ড’ অর্থ জার্মানীর শিল্প বাণিজ্য গঠনে এই ভাবেই সহায়তা করিয়াছিল।”—Outspoken Essays, p. 91.

 ১৮৮৬ সালে উত্তর ব্রহ্ম বিজয়ের ফলও ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। ২০ বৎসর পর্যন্ত এই দেশ তাহার শাসনব্যয় যোগাইতে পারিত না এবং অন্যান্য প্রদেশ হইতে সেজন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে হইত। কিন্তু উত্তর ব্রহ্মবিজয়ের পূর্বেও দক্ষিণ বা নিম্ন ব্রহ্মও তাহার শাসনব্যয় যোগাইতে পারিত না। গোখেল বলেন যে, প্রায় ৪০ বৎসর ধরিয়া মহাদেশ ভারতের শ্বেতহস্তীরূপে ছিল এবং “ইহার ফলে বর্তমানে (২৭শে মার্চ, ১৯১১) ভারতের নিকট ব্রহ্মদেশের ঋণ প্রায় ৬২ কোটী টাকা।” কিন্তু এই বিপুল অর্থের প্রধান অংশই বাংলাকে বহন করিতে হইয়াছিল। ইহার কারণ কেবল লবণের উপর শুল্কবৃদ্ধি নয়, ভারত গবর্ণমেণ্টের রাজকোষে বাংলাই সবচেয়ে বেশী টাকা দেয়। এ কথাও স্মরণ রাখিতে হইবে, ব্রহ্ম বিজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য, ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্রজাত বিক্রয়ের বাজার তৈরী করা এবং ব্রহ্মের ঐশ্বর্যশালী বনভূমি, রত্নখনি ও তৈলের খনি। এই সমস্ত দিকে শোষণ কার্য প্রবল উৎসাহে চলিতেছে। এইরূপে ভারতের দরিদ্র প্রজারা ব্রহ্ম বিজয় এবং তাহার শাসনব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ যোগাইয়াছে, আর ব্রিটিশ ধনী ও ব্যবসায়ীরা উহার ফলে ঐশ্বর্যশালী হইয়াছে। কিছু দিন হইল, ব্রিটিশ শোষণকারীরা ব্রহ্মকে ভারত হইতে পৃথক করিবার জন্য এক আন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছে। কতকগুলি নির্বোধ অদূরদর্শী ব্রহ্মবাসী গোটা কয়েক সরকারী চাকরীর প্রলোভনে তাহাদের আন্দোলনে যোগ দিয়াছে।[]

(৩) মেষ্টনী ব্যবস্থার কল্যাণে বাংলার ধন শোষণ

 মেষ্টনী ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তাহার রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ হইতেই বঞ্চিত হইতেছে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব জাতিগঠনমূলক কার্যের জন্য অবশিষ্ট থাকিতেছে। এই ব্যবস্থায়, বাংলাদেশের রাজস্বের প্রধান প্রধান দফাগুলি—বাণিজ্যশুল্ক, আয়কর, রেলওয়ে প্রভৃতি—তাহার হাতছাড়া হইয়াছে। বাণিজ্যশুল্কের আয় ১৯২১-২২ সালে ৩৪ কোটী টাকা ছিল, ১৯২৯—৩০ সালে উহার পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে প্রায় ৫০ কোটী টাকায়। আর রাজস্বের যে সমস্ত দফা সর্বাপেক্ষা অসন্তোষজনক এবং যাহাতে আয় বাড়িবারও বিশেষ সম্ভাবনা নাই, সেই গুলিই মন্ত্রীদের অধীনস্থ তথাকথিত ‘হস্তান্তরিত’ বিভাগগুলির জন্য রাখা হইয়াছে। ইহার ফলে দেশে মাদক ব্যবহার এবং মামলা মোকদ্দমা বৃদ্ধির সহিত সংসৃষ্ট আবগারী শুল্ক ও কোর্ট ফি প্রভৃতির দরুণ নিন্দা ও গ্লানি দেশীয় মন্ত্রীদেরই বহন করিতে হইতেছে।

 ইতিপূর্বে দেখাইয়াছি যে, পলাশীর যুদ্ধের সময় হইতেই, বাংলা ভারতের কামধেনু স্বরূপ ছিল এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ জয়ের জন্য সামরিক ব্যয় যোগাইয়া আসিয়াছে। নূতন শাসন সংস্কারের আমলে, মেষ্টনী ব্যবস্থার ফলে বাংলারই সর্বাপেক্ষা বেশী ক্ষতি হইয়াছে এবং ইহার অর্থ নির্মমভাবে শোষণ করা হইতেছে। আমি আরও দেখাইয়াছি যে, বাংলার আর্থিক দারিদ্র্য পলাশীর যুদ্ধের সময় হইতেই আরম্ভ হইয়াছে। মেষ্টনী ব্যবস্থা, অবস্থা আরও শোচনীয় করিয়াছে মাত্র।

 বাংলার ভূতপূর্ব লেঃ গবর্ণর স্যার আলেকজাণ্ডার ম্যাকেঞ্জি ১৮৯৬ সালে ইম্পিরিয়াল বাজেট আলোচনার সময় বলেন,—“এই প্রদেশরূপী মেষকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার লোমগুলি নির্মূল করিয়া কাটিয়া লওয়া হইতেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় রোমোদ্গম না হয়, ততক্ষণ সে শীতে থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে।” (অবশ্য, রোমোদ্গম হইলেই পুনরায় উহা কাটিয়া লওয়া হয়।)

 সুতরাং বাংলাদেশ ইম্পিরিয়াল গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে ক্রমাগত অবিচার সহ্য করিয়া আসিতেছে।

 বাংলা ভারতের প্রধান পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী ও জন-বহুল, অথচ এই প্রদেশকেই সর্বাপেক্ষা কম টাকা দেওয়া হইতেছে! ফলে তাহার জাতিগঠনমূলক বিভাগগুলি সর্বদা অভাবগ্রস্ত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ শিক্ষার কথাই ধরা যাক। ১৯২৪—২৫ সালের সরকারী রিপোর্টের হিসাব হইতে বিভিন্ন প্রদেশে শিক্ষার ব্যয় নিম্নে দেওয় হইল:—

প্রদেশ সরকারী সাহায্য ছাত্রবেতন
মাদ্রাজ ১,৭১,৩৮,৫৪৮ ৮৪,৩২,৯৯১
বোম্বাই ১,৮৪,৪৭,১৬৫ ৬০,১৩,৯৬৯
বাংলা ১,৩৩,৮২,৯৬২ ১,৪৬,৩৬,১২৬
যুক্তপ্রদেশ ১,৭২,২৮,৪৯০ ৪২,১৪,৩৫৪
পাঞ্জাব ১,১৮,৩৪,৩৬৪ ৫২,৮৭,৪৪৪

 শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বিভাগ, শিল্প ও কৃষি, এই পাঁচটা ‘জাতি গঠনমূলক’ বিভাগের হিসাব করিয়া আমরা নিম্নলিখিত তথ্যে উপনীত হইয়াছি। ইহা হইতে বাংলার আর্থিক দুর্দশা সহজেই উপলব্ধি করা যাইবে।

১৯২৮-২৯

জাতিগঠনমূলক কার্যের জন্য বাংলার জন প্রতি ব্যয়

প্রদেশ মোট ব্যয় জন প্রতি ব্যয়
মাদ্রাজ ৪.২৫ কোটী টাকা ১.০০ টাকা
বোম্বাই ৩.০৭ কোটী টাকা ১.৫৯ টাকা
বাংলা ২.৭৩ কোটী টাকা ০.৫৮ টাকা
যুক্তপ্রদেশ ২.৯৮ কোটী টাকা ০.৬৫ টাকা
পাঞ্জাব ২.৯০ কোটী টাকা ১.৪০ টাকা
বিহার-উড়িষ্যা ১.৪৭ কোটী টাকা ০.৪২ টাকা
মধ্যপ্রদেশ ১.০৮ কোটী টাকা ০.৭৭ টাকা
আসাম ০.৫৮ কোটী টাকা ০.৭৬ টাকা

 মোটামটি বলা যায়, পাঞ্জাব ও বোম্বাই বাংলার চেয়ে জন প্রতি শতকরা ১৬৬ ও ১৩৩ টাকা ব্যয় করে, মাদ্রাজ শতকরা ৬৬ টাকা এবং আসাম শতকরা ২৫ টাকা বাংলার চেয়ে বেশী ব্যয় করে। একমাত্র বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ জাতিগঠনমূলক কার্যে জন প্রতি বাংলার চেয়ে কম ব্যয় করে।[]

 ইহা অকাট্যরূপে প্রমাণিত হইয়াছে যে, মেষ্টনী ব্যবস্থা আইন দ্বারা সমর্থিত লুণ্ঠন মাত্র এবং ঘোর অবিচার মূলক। সমস্ত পাট রপ্তানী শুল্কের টাকাই বাংলার পাওয়া উচিত। শ্রীযুত ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগীর মতে, ১৯২৭ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ভারত গবর্ণমেণ্ট এই শুল্ক বাবদ মোট ৩৪ কোটী টাকা হস্তগত করিয়াছেন; আর বাংলার জাতিগঠনমূলক বিভাগ গুলি শোচনীয় অভাব সহ্য করিতেছে!

 বাংলার আর্থিক অবস্থার মূলে আর একটি গলদ রহিয়াছে; অন্যান্য অনেক প্রদেশে সেচ বিভাগের উন্নতির জন্য যথেষ্ট মূলধন ন্যস্ত করা এবং তাহা হইতে প্রচুর আয়ও হইতেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এই বাবদ বিশেষ কোন আয় হয় না। অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলার সেচ বিভাগের আয় কিরূপ, তাহা নিম্নের তালিকা হইতে বুঝা যাইবে:—

১৯২৮—২৯

বিভিন্ন প্রদেশের সেচ বিভাগের আয়

প্রদেশ আয় সেচ বিভাগের জন্য ঋণের সুদ
মাদ্রাজ ১.৮৩ কোটী টাকা ০.৫৩
বোম্বাই ০.৬৫ কোটী টাকা ০.৫৫
বাংলা ০.০১ কোটী টাকা ০.১৮
যুক্তপ্রদেশ ০.৮৪ কোটী টাকা ০.৮৮
পাঞ্জাব ৩.৭৪ কোটী টাকা ১.২০
বিহার-উড়িষ্যা ০.২০ কোটী টাকা ০.২০

 বাংলার প্রতি এই আর্থিক অবিচারের মূল কারণ মাদ্রাজ গবর্ণমেণ্টের সদস্য মিঃ ফরবেস নির্লজ্জ ভাবে স্বীকার করিয়াছেন। ১৮৬১ সালে তিনি ভারতীয় ব্যবস্থা পরিষদে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন:—

 “বাংলার লেঃ গবর্ণর মিঃ গ্র্যাণ্ট বলিয়াছেন, জনহিতকর কার্যের জন্য বাংলাকে উপযুক্ত অর্থ দেওয়া হয় না। কিন্তু তিনি একটি কথা বিবেচনা করেন নাই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থাকার ফলে গবর্ণমেণ্ট ঐ প্রদেশের জন্য অর্থ ব্যয় করিবার জন্য উৎসাহ বোধ করেন না, কেননা তাহাতে তাঁহাদের কোন লাভের সম্ভাবনা নাই। অবশ্য, যে পরোক্ষ লাভের সম্ভাবনা আছে, তাহার জন্যও অর্থ ব্যয় করা যাইতে পারে। কিন্তু যে সব প্রদেশে অর্থ ব্যয় করিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় প্রকারেই লাভের সম্ভাবনা আছে, গবর্ণমেণ্ট যদি কেবল সেই সব প্রদেশের জন্যই অর্থ ব্যয় করেন, তবে বিস্মিত হইবার কারণ নাই।”—জে. এন. গুপ্ত কর্তৃক Financial Injustice to Bengal নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত।

 আভ্যন্তরীণ উন্নতি সাধনের জন্য যথেষ্ট অর্থ সম্পদ থাকিলেও, বাংলাকে অর্থ কষ্ট সহ্য করিতে হইতেছে। অন্য কথা ছাড়িয়া দিলেও, কেবলমাত্র পাট শুল্কের আয়ই (বার্ষিক প্রায় ৪ কোটী টাকা) বাংলাকে আর্থিক ধ্বংস হইতে রক্ষা করিতে পারিত। নিম্নের তালিকা হইতে বুঝা যাইবে, বাংলা ইম্পিরিয়াল গবর্ণমেণ্টের ভাণ্ডারে সর্বাপেক্ষা বেশী টাকা দিতেছে:—

প্রদেশ শতকরা কত ভাগ রাজস্ব দিতেছে
১৯২১—২২ ১৯২৫—২৬
বাংলা ৩৬.০ ৪৫.০
যুক্তপ্রদেশ ০০৬.০ ০০১.৬
বিহার-উড়িষ্যা ১২.৩ ০০৯.৬
পাঞ্জাব ০০০.৭ ০০০.৭
বোম্বাই ৩৯.০ ৪০.০
মধ্যপ্রদেশ ০০১.৫ ০০১.০
আসাম ০০০.৫ ০০০.৬


মোট— ১০০.০ ১০০.০

(জে. এন. গুপ্তের গ্রন্থ হইতে)

 এইরূপে দেখা যাইতেছে যে, ভারত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, বিস্তার ও রক্ষা কার্য, বাংলার ভাণ্ডার হইতে ক্রমাগত অর্থ শোষণ করিয়াই সাধিত হইয়াছে। টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ, মারাঠা ও শিখদের সঙ্গে যুদ্ধ চালাইতে এই বাংলারই রক্ত শোষণ করা হইয়াছে এবং ইহার ন্যায়সঙ‍গত অভাব অভিযোগ উপেক্ষা করা হইয়াছে; এবং মেষ্টনী ব্যবস্থায় এই রক্ত শোষণ কার্য এখনও পরমোৎসাহে চলিতেছে।[]

 সাম্রাজ্যবাদরূপী মোলক দেবতার নিকট বাংলাকে প্রাচীন কাল হইতে প্রচলিত “রব রয় নীতি” অনুসারে বলি প্রদান করা হইয়াছে।

 “কেন? যেহেতু সেই প্রাচীন নিয়মই তাহাদের পক্ষে এক মাত্র নীতি—যাহাদের ক্ষমতা আছে তাহারা কাড়িয়া লইবে, এবং যাহারা পারে আত্মরক্ষা করিবে।”

  1. ঐতিহাসিক স্টুয়ার্টের মতে বাংলার বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে (১৭২২) ছিল ১ কোটী ৩০ লক্ষ টাকা। শাসন ব্যয় বাদ দিয়া নিট রাজস্ব এক কোটী টাকার বেশী হইত। অ্যাস্কোলির হিসাবে বাংলার রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১,৪২,৮৮,২৮৬ টাকা।
  2. ম্যাণ্ডেভিল কিন্তু বুঝিতে পারেন নাই যে, দিল্লীতে যে টাকা যাইত, তাহা কোন না কোন প্রকারে প্রদেশ সমূহে ফিরিয়া আসিত। কাটরু, তাঁহার General History of the Mugul Empire নামক গ্রন্থে অবস্থাটা ঠিক ধরিতে পারিয়াছেন। তিনি বলেন—“এই বিপুল অর্থের পরিমাণ বিস্ময়কর বটে, কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, এই অর্থ মোগল রাজকোষে গেলেও, তাহা পুনর্বার বাহির হইয়া প্রদেশ সমূহে অল্প বিস্তর যাইত। সাম্রাজ্যের অর্দ্ধাংশ সম্রাটের সাহায্যের উপর নির্ভর করিত। এতদ্ব্যতীত যে সব অসংখ্য কৃষক সম্রাটের জন্য পরিশ্রম করিত, তাহারা সম্রাটের অর্থেই জীবিকা নির্বাহ করিত; সহরের যে সব শিল্পী সম্রাটের জন্য কাজ করিত, তাহারা রাজকোষ হইতেই পারিশ্রমিক পাইত।”
     “বৎসরে কয়েক লক্ষ টাকা লণ্ডনে বিলাতের জন্য ব্যয় হওয়া এবং মুর্শিদাবাদে বিলাসের জন্য ব্যয় হওয়া—এ দুইএর মধ্যে বিস্তর প্রভেদ আছে।”——Torrens: Empire in Asia.
  3. সিংহ—Economic Annals.
  4. Sinha Economic Annals.
  5. এই পুস্তক যখন (১৯৩৭) ছাপা হইতেছে, তাহার পূর্বেই ব্রহ্ম-বিচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে।
  6. পূর্বে যে হিসাব দেওয়া হইয়াছে তাহা হইতে দেখা যাইবে যে, শিক্ষা ব্যাপারে গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে বাংলা পাঞ্জাবের চেয়ে সামান্য কিছু বেশী সাহায্য পায়, যদিও পাঞ্জাবের লোকসংখ্যা বাংলার অর্দ্ধেক। অন্যান্য তিনটি প্রধান প্রদেশ হইতে বাংলা কম সাহায্য পাইয়া থাকে। এক মাত্র বাংলাই, সরকারী সাহায্যের চেয়ে বেশী টাকা ছাত্রবেতন হইতে যোগাইয়া থাকে। ইহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়।
  7. যুক্তরাষ্ট্র অর্থ কমিটির সিদ্ধান্ত (সদ্য প্রকাশিত, জুন, ১৯৩২) হইতে দেখা যাইতেছে, বাংলা সেণ্ট্রাল গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে আগামী শাসন সংস্কারেও বিশেষ কোন সাহায্যের আশা করিতে পারে না। বাংলার অবস্থা যথা পূর্বং রহিয়াছে।