বিষয়বস্তুতে চলুন

আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

বাংলা ভারতের কামধেনু (পূর্বাণুবৃত্তি)

বাঙালীদের অক্ষমতা এবং অবাঙালী কর্তৃক বাংলার আর্থিক বিজয়

(১) ব্যর্থতার কারণ— অক্ষমতা

 ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করিতে হইলে, যে দুইটি প্রধান গুণের প্রয়োজন, তাহা বাঙালীর চরিত্রে নাই; সে দুইটি গুণ ব্যবসায়বুদ্ধি এবং নূতন কর্ম প্রচেষ্টায় অনুরাগ। বাঙালী ভাবুক ও আদর্শবাদী, সেই তুলনায় বাস্তববাদী নয়,—এই কারণে ব্যবসায় ক্ষেত্রে সে পশ্চাৎপদ। ১৭৫৩ সালে ঢাকার বস্ত্রব্যবসায়ের অবস্থা সম্বন্ধে টেলর যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা হইতে এ সম্বন্ধে অনেক রহস্য জানিতে পারা যায়। আলিবর্দীর শাসনকালে বাঙালী ছাড়া আর যে সব জাতির লোক বাংলাদেশে বাণিজ্য করিত, এই বিবরণ হইতে তাহাদের সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগৃহীত হইতে পারে। যথা- (১) তুরাণীগণ (অক্‌সাস্ নদীর পরপারে তুরাণ দেশ হইতে আগত বণিকগণ); (২) পাঠানগণ—ইহারা প্রধানতঃ উত্তর ভারতে বাণিজ্য করিত; (৩) আর্মাণীগণ—ইহারা বসোরা, মোচা এবং জেড্ডায় বাণিজ্য করিত; (৪) মোগলগণ—ইহারা অংশতঃ ভারতে এবং অংশতঃ বসোরা, মোচা ও জেড্ডায় বাণিজ্য করিত; (৫) হিন্দুগণ—ভারতে বাণিজ্য করিত; (৬) ইংরাজ কোম্পানী; (৭) ফরাসী কোম্পানী; (৮) ওলন্দাজ কোম্পানী।[]বলা বাহুল্য, ইয়োরোপীয় কোম্পানী গুলি ইয়োরোপে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে পণ্য রপ্তানী করিত। আর্মাণীগণ সমুদ্র বাণিজ্যে প্রধান অংশ গ্রহণ করিত। সিরাজদ্দৌলার পতনের পর মীর জাফরের সঙ্গে ইংরাজদের যে সন্ধি হয়, তাহাতে একটা সর্ত ছিল ‘কলিকাতার অনিষ্ট হওয়াতে যাহাদের ক্ষতি হইয়াছে’ তাহাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই সর্তে ক্ষতিগ্রস্ত ইংরাজদের ৫০ লক্ষ টাকা এবং আর্মাণীদের জন্য ৭ লক্ষ টাকা দেওয়া হইয়াছিল।[]১৬শ শতাব্দীতে সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ সামান্য ছিল না। কেননা তৎসাময়িক বৃত্তান্তে লিখিত আছে যে, ১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে মালদহের সেখ ভিক তিন হাজার মালদহী কাপড় পারস্য উপসাগর দিয়া রাশিয়াতে পাঠাইয়াছিলেন। হেষ্টিংসের সময়ে বাংলার বহির্বাণিজ্য প্রায় সমস্ত ইয়োরোপীয়দের হাতে ছিল।[]  ঢাকার বস্ত্র ব্যবসায়ের উপরোক্ত বিবরণের পঞ্চম দফায় লিখিত হইয়াছে যে, হিন্দুরা স্বদেশের বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করিত। কিন্তু মোট ২৮ / লক্ষ টাকা মূল্যের বস্ত্রের মধ্যে, তাহারা মাত্র ২ লক্ষ টাকার বস্তু লইয়া কারবার করিত। অর্থাৎ চৌদ্দ ভাগের এক ভাগেরও কম বাণিজ্য হিন্দুদের ভাগে পড়িত। এই হিন্দুরাও আবার বাংলার লোক ছিল না।

 সকলেই জানেন, ব্যবসা বাণিজ্য এবং ব্যাঙ্কের কারবার ঘনিষ্ঠরূপে সংসৃষ্ট। ইয়োরোপে মধ্যযুগে, বিশেষতঃ ১৫শ, ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে, ভিনিস, আমষ্টার্ডম, হামবার্গ, লণ্ডন প্রভৃতি সহরে—যেখানেই সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার ছিল, সেখানেই ‘রিয়াল্টো’ বা একশ্চেঞ্জ ব্যাঙ্ক থাকিত এবং ব্যবসায়ীরা ঐ সব স্থলে ভিড় জমাইত।

 বাঙালীরা ব্যবসায়ে উদাসীন ছিল বলিয়া উত্তর ভারতের লোকেরা তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া বাংলার সমস্ত ব্যাঙ্কের কারবার হস্তগত করিয়াছিল। ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্থানীগণ মুর্শিদাবাদের নিকটে ব্যাঙ্কিং এজেন্সি সমূহ স্থাপন করিয়াছিল।

 যথা,—“ইয়োরোপীয় প্রথায় ব্যাঙ্কের কাজ ভারতে আধুনিক কালে প্রচলিত হইয়াছে। ইয়োরোপীয়েরা আসিবার বহু পূর্বে সপরিচালিত স্বদেশী ব্যাঙ্ক সমূহ ছিল। প্রত্যেক রাজ দরবারেই রাজ ব্যাঙ্কার বা শেঠী থাকিত, অনেক সময় ইহাদের মন্ত্রীর ক্ষমতা দেওয়া হইত।”—[]

 অন্যত্র,—“এই সব হিন্দুদের আর্থিক ব্যাপারে বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল, কেননা, এই প্রদেশের বাণিজ্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে বড় বড় বণিকদের হাতে ছিল এবং তাহাদের মধ্যে অনেকে উমিচাঁদ ও জগৎ শেঠদের ন্যায় উত্তর ভারত হইতে আগত। কোজা ওয়াজিদ ও আগা ম্যানুয়েলের ন্যায় অল্প সংখ্যক আর্মাণীরাও ছিল।”[]—S. C. Hill: Bengal in 1756—1757, Ch. I, Intro.

 সম্রাট ফরুক সিয়ারের সময়ে জগৎ শেঠেরা সাফল্য ও ঐশ্বর্যের উচ্চ শিখরে উঠিয়াছিলেন। মানিকচাঁদ নামক একজন জৈন বণিক এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। মানিকচাঁদের ১৭৩২ সালে মৃত্যু হয়, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁহার কারবারের ভার ভ্রাতুষ্পুত্র ফতেচাঁদের হস্তে অর্পণ করিয়া যান। ১৭১৩ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার শাসক নিযুক্ত হইলে ফতেচাঁদ সরকারী ব্যাঙ্কার নিযুক্ত হন। তাঁহাকে “জগৎশেঠ” এই উপাধি দেওয়া হয়। ১৭৪৪ খৃষ্টাব্দে ফতেচাঁদ তাঁহার পৌত্রদ্বয় শেঠ মহাতাপ রায় ও মহারাজা স্বরূপচাঁদের হস্তে কারবারের ভার অর্পণ করিয়া পরলোক গমন করেন। এই দুই জন শেঠকে বাংলার রাষ্ট্র বিপ্লবের ইতিহাসের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ ভাবে সংসৃষ্ট দেখিতে পাই। ইংরাজ লিখিত ইতিহাসে ফতেচাঁদের দুই পৌত্রের নাম পৃথকভাবে উল্লিখিত হয় নাই, তাঁহাদের উভয়কে “জগৎ শেঠ” অথবা “শেঠ” মাত্র এই নামে অভিহিত করা হইয়াছে। মুর্শিদাবাদে এই জগৎ শেঠের গদীর প্রভাব অসামান্য ছিল।

 “জগৎ শেঠ এক হিসাবে বাংলার নবাবের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তাঁহার ভাণ্ডারে প্রেরিত হয় এবং গবর্ণমেণ্ট প্রয়োজন মত জগৎ শেঠের উপরে চেক দেন,— যেমন ভাবে বণিকেরা ব্যাঙ্কের উপরে চেক দেন। আমি যতদূর জানি, শেঠেরা এই ব্যবসায়ে বৎসরে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন।”

 মহাতাপচাঁদের আমলে জগৎ শেঠের গদী ঐশ্বর্ষের চরম শিখরে উঠে। নবাব আলিবর্দী খাঁ জগৎ শেঠকে প্রভূত সম্মান করিতেন এবং ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দে নবাবের সৈন্যদল যখন ইংরাজ বণিক ও আর্মাণী বণিকদের মধ্যে বিবাদের ফলে কাশিমবাজারে ইংরাজদের কুঠী ঘেরাও করে, সেই সময়ে ইংরেজরা জগৎ শেঠদের মারফৎ ১২ লক্ষ টাকা দিয়া নবাবকে সন্তুষ্ট করে। ইয়োরোপীয়দের পরিচালিত ব্যাঙ্ক তখনও এদেশে স্থাপিত হয় নাই এবং ইংরাজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকেরা শেঠদের নিকট হইতে টাকা ধার করিতেন। “তাঁহাদের (শেঠদের) এমন বিপুল ঐশ্বর্য ছিল যে, হিন্দুস্থান ও দাক্ষিণাত্যে তাঁহাদের মত ব্যাঙ্কার আর কখনও দেখা যায় নাই এবং তাঁহাদের সঙ্গে তুলনা হইতে পারে, সমগ্র ভারতে এমন কোন বণিক বা ব্যাঙ্কার ছিল না। ইহাও নিশ্চয় রূপে বলা যাইতে পারে যে, তাঁহাদের সময়ে বাংলাদেশে যে সব ব্যাঙ্কার ছিল, তাহারা তাঁহাদেরই শাখা অথবা পরিবারের লোক।” অবশ্য, সে সময়ে আরও ব্যাঙ্কার ছিল, যদিও তাহারা জগৎ শেঠদের মত ঐশ্বর্যশালী ছিল না। কোম্পানীর শাসনের প্রথম আমলে, মফঃস্বল হইতে মুর্শিদাবাদে, পরবর্তী কালে কলিকাতাতে—এই সব ব্যাঙ্কারদের মারফতই ভূমি রাজস্ব প্রেরণ করা হইত। ১৭৮০ সাল হইতে জগৎ শেঠদের গদীর অবনতি হইতে থাকে এবং ১৭৮২ সালে গোপাল দাস এবং হরিকিষণ দাস তাঁহাদের স্থানে গবর্ণমেণ্টের ব্যাঙ্কার নিযুক্ত হন।

 এই সময়ের প্রতিপত্তিশালী ব্যাঙ্কারদের মধ্যে রামচাঁদ সা এবং গোপালচরণ সা ও রামকিষণ ও লক্ষ্মীনারায়ণের নাম শোনা যায়। আরও দেখা যায় যে, কলিকাতার প্রধান ব্যাঙ্কিং ফার্ম নন্দীরাম বৈদ্যনাথের গোমস্তা রামজী রাম ১৭৮৭ সালে কারেন্সী কমিটির সম্মুখে সাক্ষ্য দিতে গিয়া বলেন যে, তাঁহাদের ফার্মের প্রধান কারবার হুণ্ডী লইয়া ছিল এবং এই হুণ্ডী যোগে বিবিধ স্থান হইতে রাজস্ব প্রেরিত হইত। ১৭৮৮ সালে শাগোপাল দাস এবং মনোহর দাস[] এবং কলিকাতার অন্যান্য ২৪ জন কুঠিয়াল (দেশীয় ব্যাঙ্কার), মোহরের উপর বাট্টা হ্রাস করিবার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপক পত্র লিখেন। Economic Annals of Bengal এর গ্রন্থকার এইভাবে বিষয়টি উপসংহার করিয়াছেন— “কুঠিয়ালদের নাম ও অন্যান্য লোকের স্বাক্ষর হইতে দেখা যায় যে, তাহারা সকলেই অবাঙালী ছিল। কলিকাতার বাঙালীদের তখন কোন ব্যাঙ্ক ছিল না। বাঙালী ব্যাঙ্কারেরা বোধ হয় পোদ্দার মাত্র ছিল।”

 বাংলা দেশ ও উত্তর ভারতে দেশীয় ব্যাঙ্কের কারবার কিরূপ প্রসার লাভ করিয়াছিল, তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। রেলওয়ে হইবার পূর্বে, প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে, আমার পিতামহ গয়া ও কাশীতে তীর্থ করিতে যান। সে সময়ে গরুর গাড়ী বা নৌকাতে যাইতে হইত, এবং সঙ্গে বেশী নগদ টাকা লওয়া নিরাপদ ছিল না। আমার পিতামহ বড়বাজারের একটি ব্যাঙ্কের গদীতে টাকা জমা রাখেন এবং সেখান হইতে উত্তর ভারতের ব্যাঙ্ক সমূহের উপর তাঁহাকে হণ্ডী দেওয়া হয়।

 পূর্বেই বলিয়াছি যে, ব্যাঙ্ক ও ব্যবসা বাণিজ্য ঘনিষ্ঠভাবে সংসৃষ্ট। ১২৫ বৎসর পূর্বে, রামমোহন রায় যখন রংপরে সেরেস্তাদার ছিলেন, তখন তিনি ধর্ম সম্বন্ধীয় সমস্যা আলোচনার জন্য সন্ধ্যাকালে সভা করিতেন। ঐ সব সভায় মাড়োয়ারী বণিকেরা যোগ দিত। []

 আসাম ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হইবার পূর্বেই মাড়োয়ারীরা ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থান সদিয়া পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেছিল। তার পর এক শতাব্দীরও বেশী অতীত হইয়াছে এবং বর্তমানে মাড়োয়ারীরা আসামের সর্বত্র নিজেদের ব্যবসায়, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি বিস্তার করিয়াছে। তাহারা ইয়োরোপীয় চা-বাগান গলিতেও মূলধন যোগাইতেছে, যদিও আসামীদের তাহারা টাকা দেয় না।[]

 দার্জিলিং, কালিম্পং,—[] সিকিম ও ভুটান সীমান্তে, মাড়োয়ারীরা পশম, মৃগনাভি, ঘি, এলাচি প্রভৃতির রপ্তানী ব্যবসা করে এবং লবণ, বস্ত্রজাত প্রভৃতি আমদানী করে। এই সব ব্যবসায়ে তাহাদের কয়েক কোটী টাকা খাটে, এবং এ ক্ষেত্রে তাহারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাঙালীরা এই ব্যবসায়ের ক্ষেত্র হইতে নিজেদের দোষে হঠিয়া গিয়াছে। মাড়োয়ারীরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও পল্লীর আর্থিক অবস্থার উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইবে। কর্মাটার ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে ষ্টেশনের সন্নিকটে একটি হাট বা বাজার আছে। এখানকার সমস্ত আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্য মাড়োয়ারীদের হাতে। কর্মাটার হইতে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে কারো নামক একটি স্থানে একবার আমি গিয়াছিলাম। এখানেও ২/১টি মাড়োয়ারী বণিক সমস্ত ব্যবসায় দখল করিয়া বসিয়া আছে, দেখিলাম। নিকটবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের টাকা ধার দিয়াও তাহারা বেশ দু’পয়সা উপার্জন করিতেছে।

 বাংলা দেশেও অবস্থা ঠিক ঐরূপ। উত্তর বঙ্গে বগুড়ার নিকটে তালোরাতে একজন মাড়োয়ারীই প্রধান চাউল ব্যবসায়ী। সে একটি চাউলের কল স্থাপন করিয়াছে। টাকা লগ্নীর কারবার করিয়াও সে প্রভূত উপার্জন করে। খুলনার দক্ষিণাংশে কপোতাক্ষী তীরে বড়দল গ্রাম। এখানে প্রতি সপ্তাহে হাট বসে এবং বহুল পরিমাণে আমদানী রপ্তানীর কাজ হয়। কিন্তু এখানকার সমস্ত বড় বড় গদীই মাড়োয়ারীদের। বাঁকুড়ার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর তসর বস্ত্রের কেন্দ্র। কয়েক বৎসর পূর্বেও বাঙালীদের হাতে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। কিন্তু উদ্যোগী মাড়োয়ারীরা এখন বাঙালীদের এই ব্যবসা হইতে বহিষ্কৃত করিয়াছে। মুর্শিদাবাদ ও মালদহের রেশম কাপড়ের ব্যবসাও মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া ব্যবসায়ীদের দাদনের টাকায় চলিতেছে। তাহারাই প্রধানতঃ এই রেশমের বস্ত্রজাত রপ্তানী করে।  বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু বাংলার কৃষিজাত —চাল, পাট, তৈল-বীজ, ডাল প্রভৃতির ব্যবসায় মাড়োয়ারীদের হস্তগত। তাহারা চামড়ার ব্যবসাও অধিকার করিত, কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধী বলিয়া এ কার্য তাহারা করে না। বাংলার আমদানী পণ্যজাত প্রধানতঃ মাড়োয়ারীদের হাতে। তাহারা—আমদানীকারক বড় বড় ইয়োরোপীয় সওদাগরদের ‘বেনিয়ান’ তো বটেই, তাহা ছাড়া, এই সম্পর্কে যত কিছু ছোট, বড়, ‘মধ্যবর্তী’ ব্যবসায়ীর কাজ তাহারাই করিয়া থাকে। কালক্রমে এখন (১৯৩৭) মাড়োয়ারীগণ বৃহৎ চর্মশালা (tannery) খুলিয়াছেন।

 অবশ্য, স্বীকার করিতে হইবে যে, আমদানী ও রপ্তানী সম্পর্কীয় মধ্যবর্তী ব্যবসায়ের কাজে বহু বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানও নিযুক্ত আছে। তবে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদের এই ব্যবসায়ে কোন অংশ নাই। হিন্দুদের মধ্যে প্রধানতঃ তিলি, সাহা কাপালী জাতির লোকেরাই এই সব কাজ করে। কিন্তু ইহাদের মধ্যে অনেকে এখন জমিদার ও মহাজন হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তাহাদের ব্যবসা—বুদ্ধি ক্রমে লোপ পাইতেছে। যদিও তাহারা, উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভের জন্য উম্মত্ত হইয়া উঠে নাই, তবু অধ্যবসায়ী অবাঙালীদের দ্বারা পৈতৃক ব্যবসায় হইতে চ্যুত হইতেছে। মুসলমান যুবক ব্যবসায় ক্ষেত্রের এই প্রতিযোগিতায় আরও পশ্চাৎপদ। মুসলমান ব্যাপারী ও আড়তদার আছে বটে, কিন্তু তাহারা প্রায় সকলেই অশিক্ষিত নিম্নস্তরের লোক। হিন্দুদের গোচর্মের ব্যবসায়ের প্রতি একটা স্বাভাবিক ঘৃণার ভাব আছে, সুতরাং এই ব্যবসায় মুসলমানদেরই একচেটিয়া।[১০] কিন্তু রপ্তানীকারক প্রায় সকলেই ইয়োরোপীয়।

(২) বহমুখী কর্মতৎপরতা ও অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের অভাবই

বাঙালীর ব্যর্থতার কারণ

 ব্যবসায়ে বাঙালীদের অসহায় ভাব ও অক্ষমতা নিম্নলিখিত কয়েকটি দৃষ্টান্ত দ্বারা পরিস্ফুট হইবে। বরিশাল ও নোয়াখালী জেলায় সুপারির চাষ আছে, কিন্তু উৎপাদনকারীরা অলসের মত বসিয়া থাকে; এবং সুপারির বিস্তৃত ব্যবসায় মগ, চীনা, এবং গুজরাটীদের হাতে; তাহারা ইহাতে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।[১১]  বরিশালে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কয়েকটি স্থানে সীমাবদ্ধ যথা, বানরীপাড়া, বাটাজোড়, গইলা, গাভা ইত্যাদি। ইহাদের মধ্যে অনেকেরই ভূসম্পত্তি কিছু নাই। তাহারা অধিকাংশই চাকরীজীবী। যদি তাহাদের শক্তি ও অধ্যবসায় থাকিত, তবে এই সুপারির ব্যবসায় হস্তগত করিতে পারিত এবং বৎসরে স্বীয় জেলার ১০।১৫ লক্ষ টাকা ঘরে রাখিতে পারিত। এই উপায়ে তাহাদের নিজেদের গ্রামেই বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারিত, চাকুরীর জন্য বিদেশে গৃহহীন ভবঘুরের মত বেড়াইত না।

 ভারতে বাহির হইতেও (সিঙ্গাপুর দিয়া) বৎসরে প্রায়  / কোটী টাকার সুপারী আমদানী হয়। যদি কলেজে শিক্ষিত যুবকেরা বৈজ্ঞানিক কৃষির দ্বারা উন্নত প্রণালীতে সুপারির চাষ বাড়াইত, তাহা হইলে আরও কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করিতে পারিত। মিঃ জ্যাক ক্ষোভের সঙ্গে বলিয়াছেন,—“এই জেলার অধিবাসীদের ব্যবসায় বুদ্ধি অতি সামান্যই আছে।.......এই জেলার লোকদের আর্থিক দুর্গতির একটা প্রধান কারণ, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা সদর মহকুমা প্রভৃতি স্থানে সংখ্যায় বেশী, সুতরাং চাকরী পাওয়া তাহাদের পক্ষে কঠিন এবং ইহার ফলে তাহাদের মধ্যে বেকার সমস্যা প্রবল। তাহারা এ পর্যন্ত কোন কর্মতৎপরতা দেখাইতে পারে নাই, অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করিবার ক্ষমতাও তাহাদের নাই।”

 সুপারির ব্যবসায়ের কথা বলিলাম। আর একটি শোচনীয় দৃষ্টান্ত দিতেছি। রংপুরের উত্তরাংশে (প্রধানতঃ নীলফামারী মহকুমায়) উৎকৃষ্ট তামাক হয়। বর্মাতে চুরুট তৈয়ারীর জন্য এই তামাকের চাহিদা খুব আছে। বাংলার ফসলের রিপোর্ট (১৯২৮-২৯) হইতে দেখা যায়, সাধারণতঃ ১,৩৮,২০০ একর জমিতে তামাকের চাষ হয়। ১৯২৪-২৯ এই পাঁচ বৎসরের উৎপন্নের উপর মণ প্রতি গড়ে ১৬।৵৹ দাম এবং প্রতি একরে ৬ মণ উৎপন্নের পরিমাণ ধরিয়া, উৎপন্ন তামাকের মোট মূল্য ১ কোটী ৩৬ লক্ষ টাকা দাঁড়ায়।[১২] কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, তামাকের বাজার সবই বর্মী ও বেম্বাইওয়ালা খোজাদের হাতে। [১৩] রংপুরের জমিদার ও উকীলেরা তাঁহাদের ছেলেদের কলিকাতায় কলেজে পড়িতে পাঠান এবং ৪।৫ বৎসর ধরিয়া প্রতি ছেলের জন্য মাসিক ৪৫।৫০ টাকা ব্যয় করেন। যাঁহারা কলিকাতায় ছেলে পাঠাইতে পারেন না, স্থানীয় কলেজে ছেলে পাঠান! এই সব যুবকেরা লেখাপড়া শেষ করিয়া যখন জীবন সংগ্রামে প্রবেশ করে, তখন চারিদিকে অন্ধকার দেখে। উপায়ান্তর না দেখিয়া হয় তাহারা বেকার উকীল অথবা সামান্য বেতনের শিক্ষক বা কেরাণী হয়। আমি বহুবার বলিয়াছি যে, ঐ সব জমিদার ও উকীলেরা যদি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কৃষি কার্যের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিতেন অথবা কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসা করিতেন, তাহা হইলে তাঁহারা ও তাঁহাদের সন্তানেরা নিজেদের জেলায় ও গ্রামে থাকিয়াই লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিতে পারিতেন। তামাক বা পাটের মরসুম বৎসরের মধ্যে তিন মাসের বেশী থাকে না, অবশিষ্ট কয়েক মাস তাঁহারা লেখাপড়া, কৃষিকার্য এবং অন্যান্য কাজ করিতে পারিতেন।

 ইংলণ্ডের অভিজাতদের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরাই ‘জ্যেষ্ঠাধিকার আইন’ অনুসারে পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, কনিষ্ঠ পুত্রেরা সাইরেনসেণ্টার বা অন্যান্য স্থানের কৃষিকলেজে পড়িতে যায় এবং সেখানে কৃষিবিদ্যা শিখিয়া অস্ট্রেলিয়া অথবা কানাডায় গিয়া ধনী কৃষক হইয়া বসে। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত লোকেরা হাত পা চোখ নিজেরাই যেন বাঁধিয়া ফেলিয়াছেন এবং ধাঁধা রাস্তা ছাড়া অন্য কোন পথে চলিতে পারেন না। তাঁহাদের একথা কখনই মনে হয় না যে, ভাল সার ও বীজ প্রয়োগ করিয়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কৃষিকার্যের দ্বারা, চাষের উন্নতি ও উৎকৃষ্ট ফসল উৎপন্ন করা যায়। সুতরাং তাঁহারা গতানুগতিক ভাবেই চলিতে থাকেন এবং আবহমান কাল হইতে যে ভাবে চাষ হইতেছে, তাহাই হইয়া থাকে।

 রংপুরে বুড়ীহাটে একটি সরকারী তামাকের ফার্ম আছে এবং সেখানে ভাল জাতের তামাকের চাষ হয়—জমিতে যথাযোগ্য সার প্রভৃতিও দেওয়া হয়। কৃষি বিভাগের ভূতপূর্ব সাপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট রায় সাহেব যামিনীকুমার বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে উৎপন্ন বুড়ীহাট ফার্মের তামাক অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ‘তামাকের চাষ’ গ্রন্থে তিনি তাঁহার অভিজ্ঞতা ও গবেষণা বিশদ ভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, স্থানীয় জমিদারদের ছেলেরা এই সুযোগ গ্রহণ করা আবশ্যক মনে করে না। সরকারী তামাকের ফার্মের সুপারিন্‌টেণ্ডেণ্টের নিকট পত্র লিখিয়া আমি যে উত্তর পাইয়াছি, তাহাতেও এই কথা সমর্থিত হয়;—“আমি দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাইতেছি যে—ভদ্রলোকের ছেলেরা উন্নত প্রণালীর তামাকের চাষ শিখিবার জন্য আজকাল এখানে খুব কমই আসে।” বাঙালী যুবকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মোহে এতদূর অধঃপতন হইয়াছে যে, তাহাদের ঘরের কাছে যে সব সুযোগ সুবিধা আছে, তাহাও তাহারা গ্রহণ করিতে পারে না। এ কথা ভাবিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়।

 আমি দেখিতেছি, প্রতি বৎসর নূতন নূতন রেলপথ খোলা হইতেছে, কিন্তু ইহার ঠিকাদারীর কাজ সমস্তই কচ্ছী[১৪], গুজরাটী এবং পাঞ্জাবীরা একচেটিয়া করিয়া রাখিয়াছে। বাঙালী কোথায়? প্রতিধ্বনি বলে—বাঙালী কোথায়?’ কবি কালিদাস বলিয়াছেন—

রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্ণাদা মনোর্বর্ত্মনঃ পরম্।
ন ব্যতীয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তুনের্মিবৃত্তয়ঃ॥

 অর্থাৎ প্রচলিত পথ হইতে এক চুলও এদিক ওদিক যাইতে পারে না।

(৩) বাংলার ব্যবসায়ে অবাঙালী

 কিন্তু দুই একটা দৃষ্টান্ত দিয়া লাভ কি? মাড়োয়ারী ও গুজরাটীরা সমস্ত ব্যবসা অধিকার করিয়া আছে। কোথায় টাকা উপার্জন করা যায়, সে সম্বন্ধে তাহার যেন একটা স্বাভাবিক বোধশক্তি আছে। যেখানেই সে যায়, সেইখানেই খুঁটী গাড়িয়া স্থায়ী ভাবে বসে এবং স্থানীয় তিলি, সাহা প্রভৃতি জাতীয় আবহমানকালের ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় পরাস্ত হয়।

 আমি এই শোচনীয় অবস্থার অসংখ্য দৃষ্টান্ত দিতে পারি। উহা হইতে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হইবে, বাঙালীরা নিজেদের কি শোচনীয় অবস্থার মধ্যে টানিয়া নামাইয়াছে।

 বাঙালীরা বাংলার ব্যবসাক্ষেত্র হইতে ক্রমে ক্রমে বিতাড়িত হইতেছে। অ্যালুমিনিয়মের টিফিনের বাক্স, রান্নার পাত্র, বাটী, থালা প্রভৃতি বাঙালীর গৃহে আজকাল খুব বেশী ব্যবহার হইতেছে। কিন্তু এ সমস্তই ভাটিয়ারা তৈরী করে। ভারতের সর্বত্র এই অ্যালুমিনিয়ম বাসনের ব্যবসা তাহাদের একচেটিয়া। ইহার তৈরী করিবার প্রণালী অতি সহজ। বিদেশ হইতে পাৎলা অ্যালুমিনিয়মের পাত যন্ত্রযোগে পিটিয়া বিবিধ আকারে পাত্র তৈরী হয়। এম. এস-সি., ডিগ্রীধারী বাঙালী গ্রাজুয়েট যুবক অ্যালুমিনিয়মের দ্রব্যগুণ মুখস্থ বলিতে পারে, উহাদের রাসায়নিক প্রকৃতিও তাহারা জানে। কিন্তু ভাটিয়ারা এসব কিছুই করে না, তবু এই ধাতু হইতে নানা দ্রব্য তৈরী করিয়া তাহারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।

 খনিশিল্পেও বাঙালীদের স্থান অতি নগণ্য। এই শিল্পে ইয়োরোপীয়েরাই সর্বাগ্রগণ্য। ভারতবাসীদের মধ্যে মাড়োয়ারী এবং কচ্ছীরাই প্রধান। তাহারা ভূতত্ত্ব ও খনিজতত্ত্বের কিছু জানে না; তৎসত্ত্বেও তাহারাই সর্বদা খনি ব্যবসায়ের সুযোগ সন্ধান করে। তাহারা অনেক খনির ইজারা লইয়াছে এবং বহু কয়লা ও অভ্রখনির তাহারা মালিক। এই সব খনির কাজ তাহারা নিজেরাই পরিচালনা করে। খনিবিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভূতত্ত্বে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধি ধারী বাঙালী গ্রাজুয়েটরা ঐ সব ব্যবসায়ীদের অধীনে চাকরী পাইলে সৌভাগ্য জ্ঞান করে। লাক্ষা শিল্পেও বাঙালীর স্থান নাই। মাড়োয়ারীরা ইয়োরোপীয়দের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া এই ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেছে। কোদারমাতে (বিহার) অভ্রের বড় খনি আছে। অভ্রের ব্যবসায়ের প্রবর্তকদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালীর নাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু বর্তমানে এই ব্যবসায় ইয়োরোপীয় ও মাড়োয়ারীদের একচেটিয়া। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে ভারত হইতে যে অভ্র রপ্তানী হইয়াছে, তাহার মূল্য এক কোটী টাকারও বেশী। (Indian Mica—R. R. Chowdhury)

 মোটর যানের ব্যবসা পাঞ্জাবীদেরই একচেটিয়া হইয়া দাঁড়াইতেছে। তাহারা বৈদ্যুতিক মিস্ত্রীর কাজও ভাল করে। প্লাম্বিং ব্যবসায়ে শ্রমশিল্পের কাজ উড়িয়ারাই করে। কলিকাতার জুতানির্মাতারা চীনা কিম্বা হিন্দুস্থানী চর্মকার। কলিকাতায় এবং মফঃস্বল সহরে, চাকর, রাঁধুনী বামুন প্রভৃতি হিন্দুস্থানী অথবা উড়িয়া। সমস্ত মজুর, রেলওয়ে কুলী এবং হুগলী ও অন্যান্য নদীতে নৌকার মাঝি, বিহারী কিবা হিন্দুস্থানী। ঢাকা, কলিকাতা এবং অন্যান্য সহরের নাপিতেরা প্রধানতঃ অ-বাঙালী। কলিকাতায় রাজমিস্ত্রীর কাজও অ-বাঙালীরা অধিকার করিতেছে। কলিকাতায় একজনও গাড়োয়ান বা কুলী বাঙালী নয়।

 বাংলার শ্রমশিল্প সম্বন্ধীয় সরকারী রিপোর্টে (১৯০৬) দেখা যায় যে, ২০ বৎসর পূর্বে পাটের কলে সব বাঙালী মজুর ছিল, কিন্তু ১৯০৬ সালে তাহাদের দুই-তৃতীয়াংশ অ-বাঙালী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বাঙালী মজুরের সংখ্যা ক্রমেই কমিতেছে এবং বর্তমানে তাহাদের সংখ্যা শতকরা ৩ জনের বেশী নহে। অর্দ্ধ শতাব্দী পূর্বেও রাঁধুনী, মিষ্টান্নবিক্রেতা, নাপিত ও মাঝি সবই বাঙালী ছিল।

 কলিকাতা সহরে এখন মিষ্টান্নবিক্রেতা, হালুইকর ও মুদীর দোকান প্রভৃতি মাড়োয়ারী ও হিন্দুস্থানীরা চালাইয়া থাকে। শিয়ালদহ হইতে গোয়ালন্দ পর্যন্ত, ওদিকে উত্তরবঙ্গে সান্তাহার, পার্বতীপুর এবং জলপাইগুড়ি প্রভৃতি পর্যন্ত, ই. বি. রেলওয়ের শাখা বাঙালী অধ্যুষিত স্থানের মধ্য দিয়াই গিয়াছে। কিন্তু ষ্টেশনে মিষ্টান্নবিক্রেতা ও খাবার দোকানওয়ালারা গুজরাটী এবং পার্শী। বস্তুতঃ যে সব কাজে গঠনশক্তির বা তদারকী করিবার প্রয়োজন আছে, তাহা বাঙালীর ধাতে যেন সহ্য হয় না।

 আমার বাল্যকালে, কলিকাতার গোয়ালারা সব বাঙালী ছিল। কিন্তু এখন আর ঐ ব্যবসায়ে বাঙালী দেখা যায় না। হিন্দুস্থানী গোয়ালারা বাঙালীদের ঐ ব্যবসায় হইতে বিতাড়িত করিয়াছে। হিন্দুস্থানী গোয়ালারা ভাল জাতের গরু, ও মহিষ রাখে, তাহাদের পুষ্টিকর ভাল খাদ্য খাওয়ায়। সুতরাং বাঙালী গোয়ালাদের গরুর চেয়ে তাহাদের গরু বেশী দুধ দেয়। কেবল কলিকাতা নয়, মফঃস্বল সহরেও বাঙালী ধোবা নাপিত বিরল হইয়া পড়িতেছে এবং হিন্দুস্থানীরা তাহাদের স্থান অধিকার করিতেছে।

 বাঙালীরা কেন এই শ্রমশিল্পী চাকর ও মজুরের কাজ হইতে বিতাড়িত হইতেছে, তাহার নানা কারণ দেখানো হয়, তাহার মধ্যে একটি ম্যালেরিয়ার জন্য বাঙালীজাতির জীবনী শক্তির ক্ষয়। ইহার প্রমাণ স্বরূপ বলা হয় যে, বর্দ্ধমান, হুগলী ও দিনাজপুর জেলার কোন কোন অংশে, সাঁওতালেরা স্থায়ীভাবে বসবাস করিয়াছে এবং চাষের কাজ বহুল পরিমাণে তাহাদের দ্বারাই করা হইয়া থাকে। এই যুক্তির মধ্যে কিছু সত্য আছে বটে, কিন্তু ইহা সত্যকার কারণ বা সন্তোষজনক কারণ নয়। বর্দ্ধমান, প্রেসিডেন্সী এবং রাজসাহী বিভাগের পক্ষে ম্যালেরিয়ার যুক্তি কিয়ৎপরিমাণে খাটে, কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ এখনও ম্যালেরিয়ার আক্রমণ হইতে অনেকাংশে মুক্ত। কিন্তু এই সব স্থানেও অবাঙালীদের প্রাধান্য যথেষ্ট। বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলে এত বেশী বিহারী শ্রমিকেরা কিরূপে আসিল? পূর্ব বঙ্গের খেয়াঘাটগুলিও এই বিহারীদের দ্বারা চালিত হয়।

 খুলনা, বাগেরহাট এবং তৎসংলগ্ন ফরিপুর জেলায় বড় বড় খেয়া ঘাটগুলি নীলামে সর্বোচ্চ ডাকে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বাঙালীরা এই সব খেয়াঘাট চালাইতে পারে না। এস্থলে বলা যাইতে পারে যে, শ্রীহট্ট ও ময়মনসিংহ জেলার সমস্ত খেয়া ঘাটের ইজারাদার হিন্দুস্থানী ছত্রপৎ সিং, এই সব খেয়াঘাট জেলা বোর্ড হইতে নীলামে ইজারা দেওয়া হয় এবং জেলা বোর্ডগুলি সম্পূর্ণরূপে বাঙালীদেরই পরিচালিত। কিন্তু কোন বাঙালী যদি খেয়া ঘাটের ইজারা নেয়, তাহা হইলে আলস্য ও ব্যবসা বুদ্ধির অভাবে তাহার কর্তব্য সম্পাদন করিতে পারে না এবং শীঘ্রই সে দেনাদার হইয়া পড়ে। এই কারণে খেয়া ঘাটগুলি হিন্দুস্থানীদের একচেটিয়া হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহারা হয়ত কুলী বা ভূত্যরূপে কাজ আরম্ভ করে এবং শেষে নিজেদের শ্রম ও অধ্যবসার বলে বাঙালীদের মুখের অন্ন কাড়িয়া লয়।

 পূর্ব বঙ্গে বর্ষার পর যখন জল শুকাইয়া যায়, সেই সময় ঐ অঞ্চলের বহু স্থানে ভ্রমণ করিয়াছি। আমি লক্ষ্য করিয়াছি যে, সেই সময় বিহার হইতে পাল্কীর বেহারারা আসিয়া বেশ পয়সা উপার্জন করে। বাংলার দূরবর্তী নিভৃত গ্রামেও আমি বাঙালী বেহারা কমই দেখিয়াছি। পূর্বে, কৃষকেরা অবসর সময়ে পাল্কী বহিয়া অর্থ উপার্জন করিত, কিন্তু এখন তাহারা অনাহারে মরিবে, তবু বেহারার কাজ করিবে না। বস্তুতঃ, একটা অবসাদ, মোহ এবং শ্রমের মর্যাদা জ্ঞানের অভাব বাঙালীর চিত্তকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে।

 নিম্ন জাতিদের মধ্যে কয়েক বৎসর হইল একটা নূতন ধরণের জাতির গর্ব ও মর্যাদা জ্ঞান দেখা যাইতেছে। তাহারা ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলিয়া দাবী করে এবং এই ধারণার বশবর্তী হইয়া কোন মাল বহন করিতে চায় না, নৌকা বাহিতে চায় না। ফলে অসংখ্য হিন্দুস্থানী মজুর ও নৌকার মাঝি আসিয়া বাংলাদেশ দখন করিয়া বসিয়াছে, আর বাঙালীরা না খাইয়া মরিতেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিতে রায়তদের অনেকটা স্থায়ী স্বত্ব জন্মে, খাজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা তেমন নাই। তাহার উপর বাংলা দেশের জমিও স্বভাবতঃ উর্বরা, এই সমস্ত কারণ সমবায়ে বর্তমান শোচনীয় আর্থিক অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু পূর্বেই আমি দেখাইয়াছি যে, জমির উৎপন্ন ফসলে বাংলার সমস্ত লোকের পোষণ হয় না এবং কোন বৎসর অজন্মা হইলে, লোকে অনাহারে মরে।[১৫]

 ১৯২২ সালে উত্তর বঙ্গের বন্যাপীড়িতের সেবা কার্যের সময়ে সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনের জমিতে সেবা সমিতির প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। চারিদিকের গ্রামের লোকের যে দুর্দশা হইয়াছিল, তাহা অবর্ণনীয় এবং সেই সময়ে শীতের উত্তর বাতাসে লোকের কষ্ট আরও বাড়িয়াছিল। লোকেরা শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে আসিত এবং কম্বল, কাপড় ও খাদ্য শস্য চাহিত। সেই সময়ে সান্তাহারে ৪।৫ হাজার হিন্দুস্থানী কুলী থাকিত। তখনও পার্বতীপুর হইতে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ‘ব্রড্‌গেজ’ বা বড় লাইন খোলা হয় নাই। সুতরাং ‘বড় লাইন’ হইতে ‘ছোট লাইনে’ মাল বহন করিবার জন্য এবং লাইন মেরামত করিবার জন্য এই কুলীদের প্রয়োজন হইত। কিন্তু ঐ অঞ্চলের বন্যা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামবাসীদের বাড়ী ষ্টেশন হইতে অল্প দূরে হইলেও, তাহাদের দ্বারা কুলীর কাজ করানো যাইত না, তাহারা বলিত যে উহাতে তাহাদের ‘ইজ্জত’ যাইবে। সেবা সমিতির প্রধান কার্যালয় যখন সান্তাহার হইতে আত্রাইয়ে স্থানান্তরিত হইল, তখন মাসিক ২০ টাকা মাহিয়ানায় কতকগুলি হিন্দুস্থানী কুলীকে চাউলের বস্তা ও অন্যান্য জিনিষপত্র বহন করিবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইল। স্থানীয় লোকেরা সেবা সমিতি হইতে ভিক্ষা লইলেও, তাহারা ঐ সব ‘কুলীর কাজ’ করিতে কিছুতেই রাজী হইল না। সময়ে সময়ে ২।৪ জন স্থানীয় লোক পাওয়া যাইত বটে, কিন্তু তাহারা অত্যন্ত বেশী মজুরী দাবী করিত এবং কাজও আন্তরিক ভাবে করিত না।

(৪) শ্রমের অনভ্যাস ও অধ্যবসায়ের অভাবই ব্যর্থতার কারণ

 চীনা মিস্ত্রীরা বাঙালী মিস্ত্রীদিগকে ক্রমেই কার্যক্ষেত্র হইতে হঠাইয়া দিতেছে। ইহার কারণ চীনা মিস্ত্রীদের উচ্চশ্রেণীর কারিগরি, পরিশ্রমপটুতা ও দক্ষতা। ব্যক্তিগত ভাবে তুলনা করিলে বাঙালীরা দক্ষতা ও পরিশ্রমপটুতায় হিন্দুস্থানীদের নিকট দাঁড়াইতে পারে না, হিন্দস্থানীরা আবার চীনাদের নিকট দাঁড়াইতে পারে না।[১৬] বাঙালী মিস্ত্রী ও চীনা মিস্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করিলে, উভয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ দেখা যাইবে, যদিও তাহারা সমাজের একই স্তরের লোক এবং উভয়েই অশিক্ষিত। চীনা মিস্ত্রীরা ধীরে ধীরে কলিকাতায় প্রভাব বিস্তার করিয়াছে এবং রেলওয়ে ও P. W. D. হইতে ঠিকাদারী লইতেছে। তাহারা নিজের কারখানা স্থাপন করে, কিন্তু বাঙালী মিস্ত্রীরা (তাহাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান) দিন মজুরী পাইয়াই সন্তুষ্ট এবং স্বীয় অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য কোন চেষ্টা করে না। একথা সকলেই জানে যে, বাঙালী মিস্ত্রীরা যে মুহূর্তে বুঝিতে পারে যে, তাহাদের কাজ তদারক করিবার জন্য কেহ নাই, সেই মুহূর্তেই তাহারা কাজে ঢিলা দিতে আরম্ভ করে। তাহাদের এই কদভ্যাস একরূপ প্রবাদ বাক্যের মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।

 হিন্দুস্থানীরা বাঙালীদের চেয়ে বেশী কর্মঠ, কিন্তু চীনারা ইহাদের সকলের চেয়ে কর্মঠ; তা ছাড়া, চীনারা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। কোন চীনা কখনও তাহার কর্তব্যে অবহেলা করে না। তাহার প্রভুর নজর তাহার কাজের উপর থাকুক আর না-ই থাকুক, তাহাতে কিছু আসে যায় না। সে বেশী মজুরী নেয় সত্য, কিন্তু প্রতিদানে ভাল কাজ করে এবং বেশী কাজ করে। আর একটি প্রভেদ এই যে, বাঙালী বা হিন্দুস্থানী শ্রমশিল্পীর উন্নতির জন্য কোন চেষ্টা নাই, সে তাহার চিরাচরিত পথে চলে, যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে। কিন্তু একজন চীনা যে কেবল ভাল কাজ করে, তাহাই নয়, কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবাইয়া দেয় এবং উহাতে গর্ব বোধ করে। দিনের পর দিন সে তাহার কাজে উন্নতি করে, যতদূর সম্ভব তাহার কাজে কোন ত্রুটী হইতে সে দেয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহার চরিত্রে নানা দোষও আছে। আফিং খাওয়ার অভ্যাস সে ক্রমে ত্যাগ করিতেছে বটে, কিন্তু সে এখনও জুয়া খেলায় অত্যন্ত আসক্ত। কিন্তু চীনারা অশিক্ষিত হইলেও বেশী কৌশলী অধ্যবসায়ী। রেঙ্গুন, মালয় উপনিবেশ এবং আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে তাহারা নিজেদের বসতি বিস্তার করিয়াছে। পারি, আমস্টার্ডাম এবং ম্যান্‌চেষ্টারেও চীনাদের দেখা যায়। সেখানে তাহারা দোকানদার, শ্রমিক ইত্যাদি রূপে জীবিকা নির্বাহ করে। বস্তুতঃ, চীনারা হিমশীতল মেরু প্রদেশেই হোক আর রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই হোক, যে কোন জল বায়ুর মধ্যে টিকিয়া থাকিতে পারে। পক্ষান্তরে, বাঙালী শ্রমশিল্পীদের অধ্যবসায় নাই; এই পরিবর্তনশীল যুগে বিচিত্র অবস্থার সঙ্গে সে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারে না। সে অনাহারে মরিবে, তবু পৈতৃক বাসস্থান ত্যাগ করিবে না। পূর্ব বঙ্গের মুসলমানেরা জাতিগত কুসংস্কার না থাকার দরুণ, অধিকতর সাহসী ও অধ্যবসায়শীল। নদী বক্ষের ষ্টীমারে তাহারাই সারেঙ এবং লস্করের কাজ করে। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান, পি এণ্ড ও কোং এবং অন্যান্য কোম্পানীর সমুদ্রগামী জাহাজেও তাহারাই প্রধানতঃ লস্করের কাজ করে। তাহারা অনেক সময়ে জনবহুল পৈতৃক বাসস্থান ত্যাগ করিয়া পদ্মার চরে অথবা আসামের জঙ্গলে যাইয়া বসতি করে এবং সেখানে তাহারা প্রচুর ধান ও পাট উৎপন্ন করে। তৎসত্ত্বেও তাহারা চীনাদের সঙ্গে তো দূরের কথা, উত্তর ভারত হইতে আগত হিন্দুস্থানীদের সহিতও প্রতিযোগিতায় টিকিতে পারে না।

 কলিকাতায় ছোট ছোট চামড়ার কারখানা এবং জুতার দোকান সমস্তই চীনা, জাঠ মুসলমান এবং হিন্দুস্থানী চামারদের হস্তগত। নিম্নোদ্ধৃত বিবরণটি হইতে আমার উক্তির সত্যতা বুঝা যাইবে:—

 “কলিকাতায় চীনাদের প্রায় ২৫০ শত জুতার দোকান আছে, উহারা সকলে মিলিয়া প্রায় ৮।১০ হাজার মুচীকে কাজে খাটায়। প্রচলিত প্রথা এই যে, জুতার উপরের অংশ চীনারা তৈরী করে এবং সুকতলা ও গোড়ালি মুচীরা সেলাই করিয়া দেয়। এই কাজে মুচীদের মজুরী সাধারণতঃ দৈনিক ৸৹ আনা হইতে ৸৵৹ আনা। বেশী কারিগরির কাজ হইলে মজুরী এক টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।” The Statesman, Oct., 1930.

 মুচীদের সংখ্যা যদি গড়ে ৯ হাজার এবং প্রত্যেকের মজুরী দৈনিক তের আনা ধরা যায়, তাহা হইলে মুচীদের আয় বৎসরে ২৬ লক্ষ টাকা দাঁড়ায়। হিন্দুস্থানীদের জুতার দোকানে আরও কয়েক হাজার মুচী নিজেরা জুতা নির্মাণের ব্যবস্থা করে; এবং পূর্বোক্ত হারে তাহারাও বৎসরে প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা উপার্জন করে। সুতরাং কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হইলেও, ইহা সত্য যে, অবাঙালী মুচীরা এই বাংলা দেশে বসিয়া বৎসরে ৫২ লক্ষ টাকা অথবা অর্দ্ধ কোটী টাকার অধিক উপার্জন করে।

 ঢাকা সহরের নিকটে যে সব চামার বাস করে, তাহাদের ব্যবসা নাই, সুতরাং তাহারা অনশনক্লিষ্ট জীবন যাপন করে। বাংলার অনুন্নত জাতিদের মধ্যে তাহারাই সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ও নিপীড়িত। তাহারা জীবিকার জন্য ভিক্ষা করিতে লজ্জা বোধ করে না। যদি তাহারা জুতা মেরামত বা জুতা সেলাইয়ের কাজও করিত, তাহা হইলেও দৈনিক বার আনা এক টাকা উপার্জন করিতে পারিত। কিন্তু এই কাজ হিন্দুস্থানী বা বিহারী চামারেরা দখন করিয়া লইয়াছে। অবশ্য এই কর্মে অপ্রবৃত্তিই ঢাকার চামারদের এই দুর্দশার কারণ। শ্রীরামপুরের বিখ্যাত পাদরী কেরী সাহেব একথা বলিতে লজ্জা বোধ করিতেন না যে, তিনি এক সময়ে চর্মকারের কাজ করিতেন; লেনিনের পদাধিকারী স্ট্যালিন তাঁহার দারিদ্র্যের দিনে মুচীর কাজ করিতেন। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আগাগোড়া একটা কাল্পনিক গর্বে আচ্ছন্ন।

 একজন শিক্ষিত অধ্যবসায়শীল বাঙালী সরকারী রিসার্চ ট্যানারীতে তিন বৎসর শিক্ষা লাভ করিয়া জুতার ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি সাধারণতঃ তাঁহার কারখানাতে দশ জন হিন্দুস্থানী চামার নিযুক্ত করেন, উহারা দিন ১০।১২ ঘণ্টা কাজ করিয়া প্রত্যহ গড়ে এক জোড়া করিয়া জুতা তৈরী করে। তাহাদের আয় দৈনিক গড়ে ১৷৷৵৹ অথবা মাসে ৫০ টাকা। বাঙালী যুবকটি আমাকে বলিয়াছিল যে, একজন চীনা মুচী যদিও মাসিক এক শত টাকার কমে কাজ করিতে রাজী হইবে না, তবুও তাহার দ্বারা কাজ করানো শেষ পর্যন্ত লাভজনক। কেননা সে বেশী পরিশ্রম করে এবং তাহার কাজও ভাল হয়। চীনারা মৌমাছিদের মত পরিশ্রমী। তাহারা দিনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত কাজে লাগায়, এক মিনিট সময়ও নষ্ট করে না। তাহাদের মেয়েরাও সমান পরিশ্রমী, এবং বাঙালী মেয়েদের মত তাহারা দিবানিদ্রায় সময় নষ্ট করে না। দোকানের পিছনে নিজেদের বাড়ীতে তাহারা হয় কাপড় কাচায় ব্যস্ত অথবা জামা সেলাই করে। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে যে, কলিকাতায় চীনারা জুতা ও চামড়ার ব্যবসায়ে বৎসরে প্রায় এক কোটী টাকারও বেশী উপার্জন করে। তা ছাড়া, চীনা ছুতারেরাও বৎসরে কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করে।

(৫) অধ্যবসায় ও উদ্যামের অভাব ব্যর্থতার কারণ

 আমি যখন প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন সমস্ত মশলা ব্যবসায়ীরা বাঙালী ছিল। এখন গুজরাটীরা এই ব্যবসায় বাঙালীদের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়াছে।[১৭] আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়, প্রথম যখন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন আরম্ভ হয়, তখন স্বদেশী সিগারেট বা বিড়ির প্রচলন হয়। তখন কলিকাতায় বহু ভবঘুরে এই বিড়ির ব্যবসা করিয়া সাধু উপায়ে দুই পয়সা উপার্জন করিত। কিন্তু সমাজের নিম্ন স্তরের লোকেরাই, যথা, গাড়োয়ান, ছ্যাকড়া গাড়ীওয়ালা, কুলী প্রভৃতি সাধারণতঃ বিড়ি খাইত। উচ্চ স্তরের লোকেরা বিড়ি পছন্দ করিত না। গুজরাতীরা সর্বদা নূতন সুযোগের সন্ধানে থাকে, তাহারা চট করিয়া বুঝিতে পারিল যে, যেখানে বিড়ির পাতা পাওয়া যায় এবং শ্রমের মূল্য কম, সেই স্থানে যদি বৃহৎ আকারে বিড়ির ব্যবসা ফাঁদা যায়, তবে খুব ভাল ব্যবসা চলিবে। তদনুসারে তাহারা মধ্যপ্রদেশকে কার্যক্ষেত্র করিয়া লইল। বি, এন, রেলওয়ে এই কাজের উপযুক্ত স্থান। এখানে জমি শুষ্ক অনুর্বর, অধিবাসীদের জীবিকা সংগ্রহ করিতে বেগ পাইতে হয়, কাজেই মজুরী খুব কম। তা ছাড়া ঐ স্থানের বনে শাল ও কেন্দুয়া গাছ আছে, উহার পাতায় মোড়ক ভাল হয়। বোম্বাই অঞ্চল হইতে তামাক আমদানী করা হয়। কিন্তু গণ্ডিয়া কলিকাতা বা লাহোরের চেয়ে বোম্বাইয়ের বেশী কাছে, সুতরাং তামাক পাতা আনিতে রেলের মাশুল কম পড়ে। এই বিড়ি তৈরীর ব্যবসা সম্পূর্ণরূপেই কুটীর শিল্প, কোন কল ইহাতে ব্যবহৃত হয় না। বড় বড় বিড়ির ফার্ম ও আছে, ১৯২৬ সালে ইহার একটি আমি পরিদর্শন করি। এগুলি কেবল বিড়ি পাতার এবং তৈরী বিড়ি সংগ্রহের গুদাম। এইরূপে একটি বৃহৎ ব্যবসা গড়িয়া উঠিয়াছে এবং ইহার দ্বারা প্রায় ৫০ হাজার লোকের অন্ন সংস্থান হইতেছে। কারখানা হইতে বৎসরে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের বিড়ি তৈরী হইতেছে। আধুনিক স্বদেশী আন্দোলনের ফলে এই ব্যবসায়ের জোর হইয়াছে, কেননা অন্ততঃপক্ষে বাংলাদেশে সর্বশ্রেণীর লোক বিড়ি খাওয়া আরম্ভ করিয়াছে এবং বিড়ির ব্যবসায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ হইতেছে।[১৮]

 এই শোচনীয় কাহিনী আমি এখন শেষ করি। লোহালক্কড়ের শত শত দোকান গড়িয়া উঠিয়াছে। কয়েক বৎসর পূর্বেও যে সমস্ত হিন্দুস্থানী মজুরের কাজ করিত, তাহারা নীলামে নানাবিধ পুরোনো কলকব্জা বা তাহার অংশ কিনিতে থাকে। এখন তাহারা রীতিমত ব্যবসায়ী এবং তাহাদের সব আছে। তাহারা সর্বদাই পুরাতন কলকব্জা প্রভৃতি জিনিষ কিনিবার সন্ধানে থাকে, কোন কোন সময়ে টাকা সংগ্রহ করিয়া পুরাতন ষ্টীমার পর্যন্ত কিনিয়া ফেলে। ইহাদের দোকানে সর্বপ্রকার পুরানো কলকব্জা, লোহালক্কড় প্রভৃতি দেখিতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এই ব্যবসায়ে বাঙালী নাই।

 দুর্ভাগ্যক্রমে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুতর ভ্রম, এমন কি অপরাধ করিয়াছে—কমার্স বা বাণিজ্য বিদ্যায় উপাধি দানের ব্যবস্থা করিয়া। ছাত্রেরা মনে করে কতকগুলি পুস্তক পড়িয়া, বি. কম. ডিগ্রীর যোগ্যতা লাভ করিয়া তাহারা ব্যবসা জগতে সাফল্য অর্জন করিবে। কিন্তু বি. কম. উপাধিধারীর মস্তিষ্ক কতকগুলি বড় বড় কেতাবী কথায় পূর্ণ হয়। পরে সে তাহার ভ্রম বুঝিতে পারে, কিন্তু তখন আর সংশোধনের সময় থাকে না। সে তাহার অধীত পুস্তকাবলী হইতে পাতার পর পাতা মুখস্থ বলিতে পারে। সে অর্থনৈতিক ভূগোল এবং অর্থনীতি পড়ে, এবং তূলা, পাট, প্রভৃতি কিরূপে সরবরাহ হয় এবং কিরূপেই বা তাহা চালান হয়, এসব তথ্য তাহার নখাগ্রে থাকে। কিন্তু অশিক্ষিত বিড়িওয়ালা ভারতবর্ষের মানচিত্রের প্রতি কখনও দৃষ্টিপাত করে নাই, তৎসত্ত্বেও ভারতের কোথায় সস্তায় কাঁচা মাল ও মজুর পাওয়া যায় ঐ সমস্ত তথ্য তাহার মানস দর্পণে ভাসিতেছে এবং সেগুলি কাজে লাগাইতেও সে জানে। হতভাগ্য বি. কম. ডিগ্রীধারী কোন মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া ফার্মে কেরাণীগিরি পাইবার জন্য অতিমাত্র ব্যগ্র। তাহার বিদ্যার গর্ব ধোঁয়ায় পরিণত হয়। অন্ধ ভাবে ইয়োরোপীয় ধারার অনুসরণ করার ফলেই আমাদের যুবশক্তির এইরূপ শোচনীয় অপব্যয় হইতেছে। ইংলণ্ড ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিশালী জাতি, একথা আমরা ভুলিয়া যাই। সেখানে শিল্প বাণিজ্য অর্থনীতি বিজ্ঞান হিসাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক যুগের ব্যবসা বাণিজ্য বাঙালীরা এখনও শিখে নাই। তা ছাড়া লণ্ডনে দিবাভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে যে সব বক্তৃতা দেওয়া হয়, সন্ধ্যাকালে ব্যাঙ্ক, রেলওয়ে, ব্যবসায়ী ফার্ম প্রভৃতিতে নিযুক্ত শিক্ষানবিশ যুবকদের উপকারের জন্য সেগুলি পুনরাবৃত্তি করা হয়। আমাদের দেশে উহার অনুকরণ করিলে ঘোড়ার সম্মুখে গাড়ী জুতিবার মত অবস্থা হইয়া দাঁড়াইবে।

 পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে (১৯শ পরিচ্ছেদ) দেখাইয়াছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভের মোহ আমাদের বেকদের কিরূপ অকর্মণ্য করিয়া ফেলিয়াছে। তাহারা ব্যবসা ক্ষেত্রে কষ্ট ও পরিশ্রম করিতে বিমুখ।[১৯]

 বাংলাদেশে আগত মাড়োয়ারী বা অবাঙালী তাহার ব্যবসার প্রথম অবস্থায় সামান্য ভাবে জীবন যাপন করে, সে যতদূর সম্ভব কম ব্যয়ে জীবন ধারণ করে। সে কায়িক পরিশ্রম করিতে সর্বদা প্রস্তুত এবং সকাল হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত ক্রমাগত পরিশ্রম করে এবং ইহার ফলে সে দেশীয় ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা সস্তায় জিনিষ বিক্রয় করিয়া প্রতিযোগিতায় তাহাদের পরাস্ত করিতে পারে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এসিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে কেন নানারূপ কঠোর আইন করিয়াছে, তাহা এখন বুঝা শক্ত নহে। ‘জন চীনাম্যান, এক মুষ্টি অন্ন খাইয়া থাকে, মদ্য পানও করে না, সুতরাং কম মজুরীতে কাজ করিয়া তাহার শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের সে প্রবল প্রতিযোগী হইয়া দাঁড়ায়। হকার বা ছোট ব্যবসায়ীদের কাজে সে অল্প লাভে জিনিষ বিক্রয় করিতে পারে।’ বস্তুতঃ, এসিয়াবাসীরা যতই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হোক না হোক, আত্মরক্ষার জন্যই আমেরিকাকে ‘ইমিগ্রেশান’ আইন করিতে হইয়াছে। ইহার মধ্যে অর্থনৈতিক কারণই বেশী, বর্ণবিদ্বেষ ততটা নাই।

 বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্র হইতে বাঙালীরা ক্রমেই বিতাড়িত হইতেছে, ইহা বড়ই আক্ষেপের কথা। অবশ্য দোষ তাহাদের নিজেরই। ১৯৩১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় জনৈক পত্রলেখক বলিয়াছেন:—

 “১৮৯০ সালের কোঠায় আমি যখন বোম্বাই হইতে প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্যই বাঙালীদের হাতে ছিল। কিন্তু উদ্যোগ, অধ্যবসায় এবং সাধুতার অভাবে তাহারা ব্যবসা ক্ষেত্র হইতে ক্রমে ক্রমে ইয়োরোপীয়, মাড়োয়ারী, খোজা, ভাটিয়া, মাদ্রাজী এবং পার্শীদের দ্বারা বহিষ্কৃত হইয়াছে।... বাঙালী ব্যবসায়ীরা, প্রায় সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়ে যথা চাউল, পাট, চিনি, লবণ প্রভৃতিতে—প্রধান ছিল। কিন্তু ১৮৯০ সালের পর র‍্যালি ব্রাদার্স পূর্বেকার বাঙালী ফার্মের স্থলে মাড়োয়ারী ফার্মকে তাহাদের দালাল নিযুক্ত করিল। ঐ মাড়োয়ারী ফার্ম স্যার হরিরাম গোয়েঙ্কার সুদক্ষ পরিচালনায় এখনও কাপড়ের ব্যবসায়ে র‍্যালি ব্রাদার্সের দালালের কাজ করিতেছে। মাড়োয়ারী ফার্ম একটি বড় ব্যবসায়ী ফার্মের দালালী হস্তগত করায়, মাড়োয়ারী দোকানদার প্রভৃতি স্বভাবতই উহাদের নিকট হইতে নানারূপ সুবিধা পাইতে লাগিল এবং মাড়োয়ারীরা ক্রমে ক্রমে প্রায় সমস্ত ব্যবসা হইতে বাঙালীদিগকে বিতাড়িত করিতে লাগিল। সকলেই জানে যে, বর্তমান পাটের ব্যবসায় শতকরা ৮০ ভাগ মাড়োয়ারীদের হাতে।

 “বাঙালীরা নিজেদের দোষে কিরূপে ব্যবসা বাণিজ্য হইতে স্থানচ্যুত হইতেছে, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। রাধাবাজার স্ট্রীটে পূর্বে সমস্ত পশম ব্যবসায়ী বাঙালী ছিল। কিন্তু তাহারা দ্বিপ্রহরের পূর্বে তাহাদের দোকান খুলিত না। উহার ফলে কচ্ছী মুসলমান বোরারা—বাঙালী পশম ব্যবসায়ীদিগকে রাধাবাজার হইতে বিতাড়িত করিয়াছে। বোরারা অত্যন্ত পরিশ্রমী, তাহারা সকালে ৭।৮টার সময় তাহাদের দোকান খুলে। সুতরাং যাহারা সকালে জিনিষ কিনিতে চায় তাহারা ঐ বোরাদের দোকানেই যায়।”

 ৬০।৭০ বৎসর পূর্বে ইয়োরোপীয় সদাগরদের বেনিয়ান বা মুচ্ছুদ্দীরা সমস্তই বাঙালী ছিল। এইরূপ কয়েকজন প্রসিদ্ধ বাঙালী মুচ্ছুদ্দীর নাম নিম্নে দেওয়া যাইতেছে—গোরাচাঁদ দত্ত (ক্রুক রোম অ্যাণ্ড কোং); তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র চণ্ডী দত্ত চুঁচুড়ার চন্দ্র ধর নামক একজনের সঙ্গে যৌথ কারবার চালাইতে থাকেন। পরে তাঁহাদেরই একজন সাব-এজেণ্ট ঘরশ্যামল ঘনশ্যামদাস, উক্ত ইয়োরোপীয় ফার্মের বেনিয়ান নিযুক্ত হয়,—বাঙালীরা এইরূপে স্থানচ্যুত হয়।

 প্রাণকৃষ্ণ লাহা অ্যাণ্ড কোং, গ্রেহাম অ্যাণ্ড কোং, পিকফোর্ড গর্ডন অ্যাণ্ড কোং, অ্যাণ্ডারসন অ্যাণ্ড কোং প্রভৃতি আটটি ইয়োরোপীয় ফার্মের মুচ্ছুদ্দী ছিলেন। শিবচরণ গুহের পুত্র অভয়চরণ গুহ, গ্রেহাম অ্যাণ্ড কোং, পিল জ্যাকব, সাইনি কিলবার্ন অ্যাণ্ড কোং, স্যাকারষ্টীন অ্যাণ্ড কোং প্রভৃতি নয়টি ইয়োরোপীয় ফার্মের মুচ্ছুদ্দী ছিলেন। ললিতমোহন দাস (১৮৯০ সালে তাঁহার মৃত্যু হয়) জর্জ হেণ্ডারসন অ্যাণ্ড কোং, চার্টার্ড মার্ক্যাণ্টাইল ব্যাঙ্ক লিঃ, রোজ অ্যাণ্ড কোং এবং র‍্যালি ব্রাদার্সের মুচ্ছুদ্দি ছিলেন। দ্বারকানাথ এবং তাঁহার পুত্র ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত র‍্যালি ব্রাদার্সের (কাপড়ের ব্যবসা বিভাগ) মুচ্ছুদ্দী ছিলেন।

 আমার নিকটে একখানি চিত্তাকর্ষক পুস্তিকা আছে—A Short Account of the Residents of Calcutta in 1822 by Baboo Ananda Krishna Bose (রাজা রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র)।[২০] এই পুস্তিকায় তদানীন্তন কলিকাতা সহরের ধনী ব্যক্তিদের নামের তালিকা আছে। কলিকাতার যে সমস্ত বাসিন্দা ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া ধনী হইয়াছিলেন, তাঁহাদের নামও ইহাতে আছে। তাহা হইতে আমি কয়েকটি নাম উদ্ধৃত করিতেছি:—

 ১। বৈষ্ণবদাস শেঠ—তিনি কলিকাতার একজন প্রাচীন অধিবাসী, সাধু-প্রকৃতি, সম্ভ্রান্ত এবং ধনী ছিলেন। তিনি ও তাঁহার পূর্বপুরুষেরা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বস্ত্র ব্যবসা বিভাগের দেওয়ান ছিলেন। কলিকাতার সমস্ত শেঠ ও বসাকেরা তাঁহার আত্মীয় কুটুম্ব।

 ২। আমিরচাঁদ বাবু—তিনি প্রথমে রপ্তানী মাল গুদামের জমাদার ছিলেন। পরে অর্থ সঞ্চয় করিয়া তিনি ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হন এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সমস্ত পণ্যজাতের ঠিকাদারী পান। একক ব্যবসায়ীরা বিদেশ হইতে যে সব মাল আমদানী করিত, তিনি সেগুলির খরিদ্দার ছিলেন। এইরূপে তিনি এক কোটী টাকার উপরে উপার্জন করেন। তিনি বদান্য প্রকৃতির লোক ছিলেন, বাগবাজারে থাকিতেন এবং স্ব-সম্প্রদায়ভুক্ত শিখদের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

 ৩। লক্ষ্মীকান্ত ধর—তিনি খুব ধনী ছিলেন এবং কয়েকজন ভূতপূর্ব গবর্ণর এবং কর্ণেল ক্লাইভের মুচ্ছুদ্দী ছিলেন। তাঁহার কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁহার মৃত্যুর তাঁহার দৌহিত্র মহারাজা সুখময় রায় তাঁহার উত্তরাধিকারী হন। সুখময় রায় মার্কুইস অব ওয়েলেস্‌লির সময় রাজা উপাধি পান, তিনি ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের একজন ডিরেক্টরও ছিলেন।

 ৪। শোভারাম বসাক—ইনি বড় বাজারের একজন ধনী অধিবাসী। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নিকট কাপড়ের বিক্রেতা ছিলেন এবং আরও নানা রূপে ব্যবসা করিতেন।

 ৫। রামদুলাল দে সরকার—তিনি প্রথমে মদন মোহন দত্তের চাকরী করিতেন। তার পর মেসার্স ফেয়ারলি অ্যাণ্ড কোং ও আমেরিকাদেশীয় কাপ্তেনদের চাকরী করিয়া এবং নিজে ব্যবসা করিয়া প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেন। তিনি সূতানটী সিমলায় থাকিতেন।[২১]

 ৬। গোবিনচাঁদ ধর—নীলমণি ধরের পুত্র, ব্যাঙ্কার। ইয়োরোপীয় জাহাজী কাপ্তেনদের কাজ করিয়া প্রভূত ধন সঞ্চয় করেন।

 এই তালিকায় লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, মাত্র একজন অ-বাঙালী ধনীর নাম আছে।

 ইহা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, হুগলী নদীর তীরে প্রথম পাটের কল এবং আধুনিক যুগোপযোগী প্রথম ব্যাঙ্ক, প্রধান বাঙালী ধনীদের মূলধন ও সহযোগিতার দ্বারাই স্থাপিত হইয়াছিল। কিন্তু এখন সেই বাঙালীদের স্থান কোথাও নাই।

 “জর্জ অকল্যাণ্ড হুগলী নদীর তীরে প্রথম পাটের সূতা বোনার কল স্থাপন করেন। তিনি ১৮৫২—৫৩ সালে কলিকাতায় আসেন এবং বিশ্বম্ভর সেন নামক একজন দেশীয় বেনিয়ানের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হয়।......১৮৫৫ সালে রিশড়াতে প্রথম ভারতীয় পাটের সূতার কল প্রতিষ্ঠিত হয়। অকল্যাণ্ড তিন বৎসর কাল তাঁহার ভারতীয় অংশীদারের সহিত কারবার করেন।”—D. R. Wallace: The Romance of Jute, PP. 7 & 11.

 “১৮৬৩ সালে কলিকাতা ব্যাঙ্কিং করপোরেশান স্থাপিত হয়। ২রা মার্চ, ১৮৬৪ তারিখে উহার নূতন নাম করণ হয়—ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়া। কলিকাতাতেই প্রথমে ইহার প্রধান কার্যালয় ছিল, ১৮৬৬ সালে উহা লণ্ডনে স্থানান্তরিত হয়। ইহার ফলে ব্যাঙ্কের ভারতীয় বৈশিষ্ট্য লোপ পায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, লণ্ডনে কার্যালয় স্থানান্তরিত করিবার সময়, ৭ জন ডিরেক্টরের মধ্যে ৪ জন ছিলেন ভারতীয়, যথা—বাবু দুর্গাচরণ লাহা, হীরালাল শীল, পতিতপাবন সেন এবং মানিকজী রস্তমজী। দুইজন অডিটারের একজন ছিলেন বাঙালী, তাঁহার নাম শ্যামাচরণ দে। ঐ সময়ে ব্যাঙ্কের প্রদত্ত মূলধন ৩১,৬১,২০০ টাকা হইতে বাড়িয়া ৪,৬৬,৫০০ পাউণ্ডে দাঁড়াইল,—সুতরাং অ-ভারতীয় অংশীদারদের প্রতিনিধি অধিক সংখ্যায় নির্বাচিত হইবার প্রয়োজন হইয়াছিল।” Report of Bengal Provincial Banking Enquiry Committee, 1929 ―30, vol. i., p. 45.

(৬) কেরাণীগিরি এবং বাঙালীর ব্যর্থতা

 এখন আমরা দেখিতেছি যে, বাঙালী সমস্ত ক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত হইতেছে। তাহার জন্য কেবল গোটা কয়েক সামান্য বেতনের কেরাণীগিরি আছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও মাদ্রাজীরা আসিয়া আজ কাল ভাগ বসাইতেছে এবং শীঘ্রই তাহারা এ কাজ হইতেও বাঙালীদের বহিষ্কৃত করিবে। বলা যাইতে পারে যে, কেরাণীগিরি আমাদের অতীত জীবনের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত যে, ইহা আমাদের জীবন ও চরিত্রের অংশ বিশেষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে।[২২] কেরাণীগিরি বাঙালী চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে, ধনী অভিজাত বংশের ছেলেরাও এ কাজ করিতে সঙ্কোচ বোধ করে না। গত অর্দ্ধ শতাব্দী ধরিয়া বাঙালীদের মধ্যে, বিশেষতঃ সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যাইতেছে। তাহারা ইয়োরোপীয় সদাগর আফিসে বা ব্যাঙ্কে লক্ষ টাকা মূল্যের কোম্পানীর কাগজ জমা দিয়া ক্যাশিয়ার বা সহকারী ক্যাশিয়ারের চাকরী গ্রহণ করে, কিন্তু তবু ব্যবসায়ে নামিবে না, কেননা তাহাতে ঝুঁকি আছে। যে কোন ঝুঁকি বা দায়িত্ব নেয় না, সে কোন লাভও করিতে পারে না, ইহা একটা সুপরিচিত কথা। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরা একথা স্মরণ রাখে না। এই ফর্মা প্রেসে দিবার সময় নিম্নলিখিত পত্রখানির প্রতি আমার দৃষ্টি পড়িল:—

সদাগরের কেরাণী

“সম্পাদক মহাশয়,

 লর্ড ইঞ্চকেপ প্রভৃতির মত বড় বড় ব্যবসায়ী এবং দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলেন যে, ভারত তাঁহাদের নিকট অশেষ প্রকারে ঋণী, বহু ভারতবাসীর জন্য তাঁহারা অন্নসংস্থান করিয়াছেন। ইয়োরোপীয় বণিকেরা গরীব ভারতীয় কেরাণীদিগকে এই ভিক্ষুক বৃত্তি দিবার জন্য গর্ব অনুভব করেন বটে, কিন্তু তৎপরিবর্তে ইহাদের নিকট তাঁহারা যে কাজ আদায় করিয়া লন, তাহা যৎকিঞ্চিৎ বেতনের তুলনায় ঢের বেশী। ৩০ টাকা মাহিনার একজন কেরাণী তাহার প্রভুর চিঠিপত্র লেখে, তাঁহার ব্যাকরণের ভুল সংশোধন করে, উহা ‘ফাইল’ করে, প্রয়োজনীয় পুঁথিপত্র গুছাইয়া রাখে; তাহার স্মরণ শক্তি প্রখর, কারবারে ১০।২০ বৎসর পূর্বে যাহা ঘটিয়াছে, তাহাও মনে রাখিতে হয়, ক্লিকেট ক্লাব, বোটিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব, বয়-স্কাউট সংক্রান্ত কার্যের সেক্রেটারী হিসাবে প্রভুর ব্যক্তিগত কাজও সে করে। প্রভু কহিলে সে দৌড়ায়, চেঁচাইতে বলিলে চেঁচায়, ‘মহিলা সভার’ চিঠিপত্র লেখা প্রভৃতি মেম সাহেবের ঘরের কাজও সে করে—এবং এ সমস্তই মাসিক ত্রিশ টাকা মাহিনার পরিবর্তে!—ইহাকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ব্যভিচার ভিন্ন আর কি বলিব?

* * * *

 “যে সব বিদেশী ফার্ম ভারতে ব্যবসায় করিয়া ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছে, তাহারা ভারতীয় কেরাণীদের বুদ্ধি, পরিশ্রম এবং কর্মশক্তি সহায়েই তাহা করিয়াছে। যাহারা ইয়োরোপ বা আমেরিকা হইতে এদেশে আসিয়া ধনী হইয়াছে, ভারতীয় কেরাণীদের অধ্যবসায় ও বিশ্বস্ততাই তাহাদের উন্নতির প্রধান কারণ।........

 “পাশ্চাত্যের বণিকেরা আসিয়া ভারতীয় কেরাণীদের বুদ্ধি ও কর্মশক্তি কাজে খাটাইয়া, নিজেরা ধনী হয় এবং এ দেশ ত্যাগ করিবার সময় ঐ হতভাগ্য কেরাণীদের অকর্মণ্য, রুগ্নদেহ, দরিদ্র অক্ষম করিয়া ফেলিয়া যায়।

(অমৃতবাজার পত্রিকা, ২১। ৫। ৩২)

 এই পত্রে বাঙালী চরিত্রের সর্ব প্রধান দৌর্বল্য ও ত্রুটি সুষ্পষ্টরূপে প্রকাশিত হইয়াছে। ব্যবসা বাণিজ্যে বাঙালীর স্বাভাবিক অক্ষমতা সম্বন্ধে একটি কথাও এই পত্রে নাই। পত্রলেখকের একমাত্র অভিযোগ এই যে, ইয়োরোপীয় প্রভুরা ভারতীয় কেরাণীর বুদ্ধি ও কর্মশক্তি কাজে খাটায় অথচ তদুপযুক্ত বেতন দেয় না। অর্থাৎ বাঙালী যে ‘জন্ম-কেরাণী’ একথা পত্রলেখক স্বীকার করিয়া লইয়াছেন এবং যদি তাহাকে বেশী বেতন দেওয়া হইত, তাহা হইলেই তিনি সন্তুষ্ট হইতেন। তাঁহার মনে হয় নাই যে, কেবল ইয়োরোপীয়েরা নয়, মাড়োয়ারী ও গুজরাটীরাও তাহাদিগকে এইভাবে খাটাইয়া নেয়। একজন এম. এস-সি., বি. এল. বৈজ্ঞানিক বৃত্তিতে কিছু করিতে না পারিয়া, বেকার উকীলের দল বৃদ্ধি করে, পরে হতাশ হইয়া ‘কমার্স স্কুলে’ ঢুকিয়া টাইপ রাইটিং পত্রলিখন প্রভৃতি শিখে এবং কোন ইয়োরোপীয়, মাড়োয়ারী বা গুজরাটী ফার্মে সামান্য বেতনে কেরাণীগিরি চাকুরী নেয়। পত্রলেখক আর একটি কথা ভুলিয়া গিয়াছেন,—চাহিদা ও যোগানের অর্থনীতিক নিয়ম অনুসারেই পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়। অনাহার ক্লিষ্ট শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত বাঙালীর দৃষ্টি সংবাদপত্রের ‘কর্মখালি’ বিজ্ঞাপনের দিকে সর্বদা থাকে। যখন একটি ৩০।৪০ টাকা বেতনের পদের জন্য শত শত গ্রাজুয়েট দরখাস্ত করে এবং দরখাস্তে এমন কথাও লেখা থাকে যে, কাজ না পাইলে তাহার পরিবার অনাহারে মরিবে,তখন বেশী বেতনের আশা করাই যাইতে পারে না। তা ছাড়া, প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে মাদ্রাজীরাও দেখা দিয়াছে,—কিরূপে অতি সস্তায় দেহ ও প্রাণকে একত্র রাখা যায়, সে বিদ্যায় তাহারা সিদ্ধহস্ত। এই মাদ্রাজী কেরাণীরাও অনেকস্থলে গ্রাজুয়েট, ইংরাজীতে বেশী দখল আছে এবং অতি কম বেতনে কাজ করিতে রাজী। এক কথায়, অসহায় বাঙালী কেরাণীর মনোবৃত্তি অনেকটা “টমকাকার কুটীরের” ক্রীতদাসের মনোবৃত্তির মত। সে তাহার ভাগ্যে সন্তুষ্ট,—তাহার একমাত্র দাবী এই যে, তাহার প্রভু তাহার প্রতি একটু সদয় ব্যবহার করিবে। তাহাকে যদি একটা বাঁধা বেতন দেওয়া যায় তবে ক্রীতদাসের মত, কলুর ঘানির বলদের মত দিনরাত কাজ করিতে রাজী। কিন্তু তাহার সমস্ত বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও সে স্বাধীন ভাবে জীবিকার্জনের চেষ্টা কখনই করিবে না, ইয়োরোপীয় ও অবাঙালীরাই তাহা করিবে। “বাঙালীর মস্তিষ্কের অপব্যবহার” সম্বন্ধে কয়েক বৎসর পূর্বে আমি যাহা লিখিয়াছিলাম, এই কেরাণীরা তাহার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

 সেক্সপীয়র তাঁহার “জুলিয়াস সিজার” নাটকে বাঙালী কেরাণীদের কথা মনে করিয়াই যেন লিখিয়াছেন:—

 অ্যাণ্টনি: গদর্ভ যেমন স্বর্ণ বহন করে, সে তেমনি ভার বহন করিবে। আমরা তাহাকে যে ভাবে চালাইব, সেই ভাবে চলিবে। এবং আমাদের ধনরত্ন নির্দিষ্ট স্থানে যখন সে বহিয়া আনিবে, তখন আমরা তাহার ভার নামাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিব। ভারবাহী গর্দ্দভকে যেমন ছাড়িয়া দিলে সে তাহার কান ঝাড়িয়া মাঠে চরিতে যায় এও তেমনি করিবে।

 অক্টেভিয়াস: আপনি যেরূপ ইচ্ছা করিতে পারেন, কিন্তু সে বিশ্বস্ত ও সাহসী যোদ্ধা।

 অ্যাণ্টনি: আমার ঘোড়াও সেইরূপ, অক্টেভিয়াস। সেইজন্য আমি ভার বহনে তাহাকে নিযুক্ত করি। এই সৈনিককে আমি যুদ্ধ করিতে শিখাই, চলিতে, দৌড়াইতে, থামিতে বলি,—তাহার দৈহিক গতি ও ভঙ্গী আমার মনের শক্তিতেই চালিত হয়।”

 প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অন্যতম প্রবর্তক মহর্ষি সুশ্রুত সংক্ষেপে সেক্সপীয়রের এই ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন। ভারবাহী গর্দ্দভ সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন,—‘খরশ্চন্দনভারবাহী ভারস্য বেত্তা ন তু চন্দনস্য’—অর্থাৎ ভারবাহী গর্দ্দভ কেবল চন্দনের ভারের কথাই জানে, তাহার সুগন্ধি জানে না।

 ‘সদাগরের কেরাণী’ ভুলিয়া যায় যে, খাঁটি ভারতীয় ফার্মেও (যথা বোম্বাইয়ে) কেরাণীদের বাজার দর অনুসারে অতি সামান্য বেতন দেওয়া হয় এবং ব্যবসায়ীরা তাহাদের কাজে খাটাইয়া নিজেরা ধনী হয়।

 দশ বৎসর পূর্বে (১৯২২, জানুয়ারী ২৫শে) ‘ইংলিশম্যান’ ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, বাঙালী কেরাণী লোপ পাইবে।

কলিকাতার পরিবর্তনশীল জনসংখ্যা

 উপরোক্ত শিরোনামায় একটি প্রবন্ধে ‘ইংলিশম্যান’ লিখিয়াছিলেন বাঙালীরা কিরূপে তাহাদের কার্যস্থান হইতে ক্রমশই বে-দখল হইতেছে:—

 “লোকে যখন বলে যে, গত ২০ বৎসরে কলিকাতার লোকসংখ্যার প্রভূত পরিবর্তন হইয়াছে, তখন তাহারা সাধারণতঃ কলিকাতার যে সব উন্নতি হইয়াছে, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পাইয়াছে, রাস্তা ঘাট, দালান কোঠা, আলো ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা উন্নততর হইয়াছে, সেই সব কথাই ভাবে। তাহারা সর্বপেক্ষা যে বড় পরিবর্তন তাহাই লক্ষ্য করে না। কলিকাতা ক্রমেই অ-বাঙালী সহর হইয়া দাঁড়াইতেছে, এবং প্রতি বৎসরই অজস্র বিদেশী কলিকাতায় আমদানী হইতেছে—উহাদের উদ্দেশ্য কলিকাতায় বসবাস করিয়া জীবিকার্জন করা। ইহারা যে কেবল ভারতের অন্যান্য প্রদেশ হইতে আসে, তাহা নয়, পৃথিবীর সমগ্র অঞ্চল হইতেই আসে। যুদ্ধের সময় ভারতের বাহির হইতে লোক আসা বন্ধ হইয়াছিল, কিন্তু যুদ্ধের পর হইতে উহাদের সংখ্যা দ্রুতবেগে বাড়িয়া যাইতেছে। একথা সত্য যে, জার্মানেরা ভারত হইতে একেবারে বিদায় হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের পরিবর্তে আমেরিকাবাসীরা আসিতেছে। তাহারাও জার্মানদের মতই কর্মশক্তিসম্পন্ন এবং কলিকাতায় বাস করিবার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প। আর এক স্তরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী স্থান সমূহ হইতে আগত লোকদের ধরিতে হইবে, উহারা বাঙালী দোকানদারদের সঙ্গে রীতিমত প্রতিযোগিতা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তৃতীয় শ্রেণীর লোক মধ্য এসিয়া ও আর্মেনিয়া হইতে আগত, উহারাও কলিকাতায় বাঙালীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়া অন্ন সংস্থান করিয়া লইতেছে। চীনা পাড়াতেও লোক বাড়িতেছে এবং জুতা তৈরী ও ছুতারের কাজ বাঙালী মিস্ত্রীদের নিকট হইতে তাহারা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বে-দখল করিয়াছে।

 “কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেই বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান বেশী মার খাইতেছে। ২০ বৎসর পূর্বেও কলিকাতা সহরের ঘন বসতিপূর্ণ জায়গা গুলি বাঙালীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কলিকাতার কোন অঞ্চল সম্বন্ধেই এমন কথা আর বলা যায় না। যুদ্ধের পূর্ব হইতেই অবশ্য মাড়োয়ারীদের আমদানী হইয়া আসিতেছে, কিন্তু এখনও উহা পঞ্চাশ বৎসরের বেশী হয় নাই। তৎপূর্বে মুচ্ছুদ্দী, দালাল, মধ্যস্থ ব্যবসায়ী, দোকানদার যাহারা কলিকাতার ঐশ্বর্য গড়িয়া তুলিতেছিল, তাহারা সকলেই ছিল বাঙালী। বড়বাজার বাঙালী কেন্দ্র ছিল এবং সেখান হইতেই সহরের ব্যবসা বাণিজ্য চারি দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িত। বর্তমানে বড়বাজারের কথা বলিলেই মাড়োয়ারীদের কথা বুঝায়। মাড়োয়ারীরা কলিকাতার বড় বড় অর্থনীতিক সমস্যার মীমাংসা করে, এবং শেয়ার বাজারে, পাইকারী বাজারে সর্বত্রই তাহাদের প্রভাব। খুচরা দোকানদারীতেও পাঞ্জাবী বেনিয়া এবং হিন্দুস্থানী মুদীদের আমদানী হইয়াছে। উহারা অলি গলির মধ্যে নিজেদের ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড টাঙাইয়া পরম উৎসাহে ব্যবসা করিতেছে। কলিকাতার বিদেশী বস্ত্র বর্জনের সুযোগ লইরা বোম্বাইয়ে বোরা এবং পাঠান ব্যবসায়ীরা কিরূপে বাজারে স্থান করিয়া লইয়াছে, তাহা আমরা ইতিপূর্বে দুই একবার বলিয়াছি। তাহাদিগকে স্থানচ্যুত করা কঠিন হইবে। যে কাজে বাঙালীদের প্রতিপত্তি ছিল, সেই কেরাণীগিরির কাজ হইতেও পার্শী ও মাদ্রাজীরা তাহাদের বে-দখল করিতেছে।

 “সে দিন বেশীদূর নয়, যে দিন বাঙালী দালালের মত বাঙালী কেরাণীও বিরল হইবে। এই সহরের শ্রমশিল্পী ও যান্ত্রিকের কাজে শিখেরা বাঙালীদের স্থানচ্যুত করিতেছে। সাধারণ শ্রমিকের কাজ প্রায় সম্পূর্ণরূপেই উড়িয়া ও পূরবিয়াদের হস্তগত। ২০ বৎসর পূর্বে গৃহের ভৃত্য প্রভৃতির কাজ বাঙালী মুসলমানেরাই করিত। এখন গুর্খা ও পাঠানেরা সেই সব কাজ করিতেছে। কলিকাতার সমস্ত কাজ কর্ম ও ব্যবসার হিসাব লইলে, এই অবস্থাই দেখা যাইবে। বড় বড় ইমারত মাড়োয়ারীদের দখলে এবং ফটকে রাজপুতেরা পাহারা দিতেছে। কলিকাতা যে আন্তর্জাতিক বসতি স্থল হইয়া উঠিতেছে, ইহা তেমন ভাবে লক্ষ্য না করিলেও, বাঙালীরা যে এখান হইতে স্থানচ্যুত হইতেছে, এ কথা বাঙালীরা নিজেই বলিতেছে। বাঙালীরা “ধ্বংসোন্মুখ জাতি”—ইহা বাঙালীদেরই উক্তি।”

 এস্থলে বলা যাইতে পারে যে, গত ৮ বৎসরে কলিকাতায় মাদ্রাজী ও পাঞ্জাবীদের আমদানী ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিয়াছে।

(৭) বাঙালীর বিলোপ

 এইরূপে বাঙালীরা জীবন সংগ্রামে অন্য প্রদেশের লোকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পারিয়া ক্রমেই ধ্বংস প্রাপ্ত হইতেছে। রাজনীতি ও অর্থনীতি ক্ষেত্রেও তাহারা হটিয়া যাইতেছে। সম্প্রতি ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান’-এর ভারতস্থিত সংবাদদাতা একটি প্রবন্ধে বাঙালীদের এই দুরবস্থা লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। উক্ত পত্রের ভারতস্থিত সংবাদদাতা সাধারণতঃ যেরূপ বিচার বুদ্ধি ও সহানভূতির পরিচয় দিয়া থাকেন, এই প্রবন্ধেও তাহার অভাব নাই। এতদিন ধরিয়া যে সব কথা বলিতেছি, প্রবন্ধে সেই সমস্ত কথার সার সংগ্রহ করা হইয়াছে। প্রবন্ধটি মূল্যবান, কেননা ইহাতে বুঝা যাইবে, বিদেশীরা আমাদের কি দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে:—

 “গত বৎসরের ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করিলে দেখা যাইবে বাঙালীরা সেখানে লোপ পাইতে বসিয়াছে।

 “কলিকাতা হইতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হইবার কয়েক বৎসর পরেও বাঙালীরা ভারতের চিন্তানায়ক ছিল। পশ্চিম ভারতে জি. কে. গোখলে এবং বাল গঙ্গাধর তিলকের মত লোক জন্মিয়াছিল বটে, কিন্তু সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং রাজনীতিতে বাঙালীরা এ দাবী অবশ্যই করিতে পারিত যে, তাহারা আজ যাহা চিন্তা করে, সমগ্র ভারত পর দিন তাহাই চিন্তা করিবে। কিন্তু বাঙালীরা এখন সচেতন হইয়া দেখিতেছে যে, তাহাদের নেতারা বৃদ্ধ, তাঁহাদের স্থান অন্য কেহ গ্রহণ করিতে পারিতেছে না; এবং দিল্লীর ব্যবস্থা পরিষদে অথবা কংগ্রেসে বাঙালী প্রতিনিধিদের প্রভাব খুবই কম।—রাজনৈতিক ভারকেন্দ্র বাংলা হইতে উত্তর ও পশ্চিমে সরিয়া যাইতেছে।

পশ্চিম ভারতের প্রাধান্য

 “পশ্চিম ভারতের ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ভারতীয় রাজনীতিতে একটা নূতন জিনিষ। চিতপাবন ব্রাহ্মণেরা পূর্বে এই অঞ্চলের সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রাধান্য করিত। গোঁড়া ব্রাহ্মণ তিলকের মৃত্যুর পর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। মিঃ গান্ধীর অভ্যুদয়ে নিশ্চিতই তাহাদের লাভ হইয়াছে,—কেন না তিনি গুজরাটী এবং ঐ সব ব্যবসায়ীদেরই স্বজাতি। তিনি তাহাদের কংগ্রেসে যোগদানের সুবিধা করিয়া দিয়াছেন এবং দলের ফাণ্ডে বহু অর্থ দান করিয়া তাহারা নিজেদের স্থান সুদৃঢ় করিয়া লইয়াছে। একবার যখন তাহারা আবিষ্কার করিল যে, ধনীদের পক্ষে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন, তখন তাহারা ক্রমশঃই অধিকতর ক্ষমতা হস্তগত করিতে লাগিল। কংগ্রেসের ভিতরে, তাহারা বিদেশী বর্জনের মূল শক্তি। তূলাজাত বস্ত্রাদির উপর ঐ বিদেশী বর্জন নীতির ফল সংরক্ষণ শুল্কের মতই। গান্ধী-আরুইন চুক্তির পরেও যাহাতে ঐ বিদেশী বর্জনের অজুহাত থাকে, সেদিকে তাহারা বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াছিল।

 “স্মরণ রাখিতে হইবে যে, গান্ধী-আরুইন চুক্তি ব্রিটিশ দ্রব্য ‘পিকেটিং’ করা বন্ধ করিয়াছে, বিদেশী বর্জন আন্দোলন বন্ধ করে নাই। সম্ভবতঃ মিঃ গান্ধী বাজারে সর্ব প্রকার পিকেটিং বন্ধ হইলে সন্তুষ্ট হইতেন, কেন না উহার ফলে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ ব্যবসায়ীরা তাঁহার বিরদ্ধে ছিলেন এবং ‘প্যাক্টের’ সর্তের বাহিরে তিনি যাইতে পারেন না। ‘বোম্বে ক্রনিকল’ বোম্বাইয়ের কলওয়ালাদের মুখপত্র রূপে এ বিষয়ে মিঃ গান্ধীর বিরোধী।

বাঙালী ও কলওয়ালাগণ

 “বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা হাতে বোনা খদ্দরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছে, কিন্তু মাড়োয়ারী বা গুজরাটী কলওয়ালা ও ব্যবসায়ীদের লাভের জন্য তাহারা বেশী দামী কাপড় কিনিতে রাজী নয়। বাংলার প্রধান শিল্প পাট; উহা প্রায় সমস্তই বিদেশে রপ্তানী হয় এবং কলিকাতার সকল জাতির ব্যবসায়ীরা দেখিতেছে যে, তাহারা ভারতের ‘কামধেনু’। পশ্চিম ভারতের ব্যবসায়ীরা যে ভাবে ‘ফেডারেটেড চেম্বার অব কমার্স’ দখল করিয়াছে এবং গবর্ণমেণ্টের উপর নিজেদের মতামতের প্রভাব বিস্তার করিতেছে, তাহাতে এই ধারণা দৃঢ়তর হইয়াছে। করাচী ও বোম্বাইয়ের কয়েক জন পার্শী বণিককে সাহায্য করিবার জন্য নূতন লবণ শুল্ক নীতির দ্বারা বাংলার উপর অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা পড়িবে।

কালো কোটধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি—কর্মপ্রেরণার অভাব

 “বাংলার এই অবনতি এমন সুস্পষ্ট যে, ভারতবাসীরা নিজেদের মধ্যেই ইহা লইয়া খুব আলোচনা করিতেছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষ দিয়া থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যবি‍ৎ ভদ্রলোক বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। বর্তমান বাংলার পক্ষে ইহা একটা দুর্লক্ষণ। বহু বৎসর হইল জমিদার শ্রেণী পল্লী হইতে সহরে চলিয়া আসিতেছে এবং তাহাদের সন্তানদের সামান্য বেতনে কেরাণীগিরি করা ছাড়া আর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাই বলিয়া মনে হয়। ইহা একটা অদ্ভুত ব্যাধি যে, এই প্রদেশের ভদ্রলোক যুবকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাই, এমন কি ধনীর ছেলেরাও সামান্য কেরাণীগিরি প্রভৃতি কাজ পাইলেই সন্তুষ্ট হয়; পক্ষান্তরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা আসিয়া বাঙালীদের প্রত্যেক ব্যবসায় হইতে স্থানচ্যুত করিতেছে এবং যে সমস্ত কাজে শক্তি ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, সে সমস্ত তাহারাই করিতেছে। শিক্ষাপ্রণালীর উপর সমস্ত দোষ চাপানো নির্বুদ্ধিতা;—বাঙালীর চরিত্রে এমন কিছু ত্রুটী আছে, যাহার ফলে অতীতের গৌরবে মসগুল হইয়া অকর্মণ্য অবস্থায় কাল যাপন করিতেছে।”

 এই অংশ ছাপাখানায় পাঠাইবার সময় আমি “লিবার্টি” পত্রে (১১-৮-৩২) N. C.R স্বাক্ষরিত একটি প্রবন্ধ পড়িলাম। ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানের’ পত্রপ্রেরকের অধিকাংশ কথার তিনি পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন:—

 “বর্তমান শতাব্দীর আরম্ভ হইতে বাঙালীরা কেবল অনুচরের দল সৃষ্টি করিয়াছে, নেতার জন্ম দিতে পারে নাই, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সাগরেতী মাত্র করিয়াছে,—একথা বলিলে ভুল বলা হইবে। ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলা দেশ ভারতের নেতৃত্ব করিয়াছে। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে ও সার্বজনীন আন্দোলনে বাঙালীরই প্রাধান্য ছিল। উহার পর এই প্রাধান্য হইতে নামিয়া বাংলা অন্যান্য প্রদেশের সম পর্যায়ে দাঁড়ায়। ঐ সমস্ত প্রদেশের লোক তখন নিজেদের রাজনৈতিক জীবনকে সঙ্ঘবদ্ধ ও উন্নততর করিয়াছে এবং যে সমস্ত রাজনীতিক নেতা তাহাদের মধ্যে দেখা দিয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙালী নেতাদের সঙ্গে বাদ প্রতিবাদে সমান ভাবে প্রতিযোগিতা করিতে পারিতেন। ইয়োরোপীয় যুদ্ধের সময় পর্যন্ত এই অবস্থা বর্তমান ছিল।...... কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঙালীরা ভারতের নেতৃত্ব করিয়াছেন, একথা অস্বীকার করাও যেমন ভুল,—‘ভিকটোরিয়ান যুগে’ বাঙালীদের যে প্রাধান্য ছিল, তাহা হইতে তাহারা চ্যুত হইয়াছে, ইহা অস্বীকার করাও তেমনি ভুল।”

(৮) বাঙালীদের ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ হইতে বার্ষিক অর্থশোষণ

 এ বিষয়ে অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই। বিগত আদমসুমারীর বিবরণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২২ লক্ষ অ-বাঙালী (অর্থাৎ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক) আছে। তাহারা মন্দার সময়ে কিম্বা ২।৩ বৎসর অন্তর স্ব-প্রদেশের বাড়ীতে যায়। বাংলায় কাজ চালাইবার জন্য নিজেদেরই কোন লোক রাখিয়া যায়। ই. আই. রেলওয়ের যাত্রীসংখ্যা পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে, অন্য প্রদেশ হইতে বাংলাদেশে ক্রমাগত লোক আমদানী হইতেছে। তাহাদের মধ্যে অল্প লোকেই স্ত্রীপুত্রাদি সঙ্গে আনে। মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতিদের মধ্যে যাহারা এদেশে সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসতি করিয়াছে তাহাদের সংখ্যা বেশী নহে এবং তাহারা সাধারণতঃ কলিকাতাতেই থাকে। ২২ লক্ষের মধ্যে ২ লক্ষ স্ত্রীলোক ও শিশুদের সংখ্যা ধরা যাইতে পারে, ইহারা উপার্জন করে না। একজন কুলী, ধোবা বা নাপিত পর্যন্ত মাসে ২৫।৩০ টাকা উপার্জন করে। একশ্চেঞ্জ গেজেট বা ক্যাপিট্যালের পাতা উল্টাইয়া যদি দৈনিক ব্যবসায়ের হিসাব এবং “ক্লিয়ারিং হাউসের” কার্যাবলী পরীক্ষা করা যায়, তাহা হইলে স্পষ্ট দেখা যাইবে বাংলার চলতি কারবারের টাকা এবং স্থায়ী সম্পদের কত অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য সংসৃষ্ট মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতিদের হাতে আছে। তাহাদের মধ্যে অনেকে লক্ষপতি।[২৩] বাঙালীদের সেখানে স্থান নাই।

 যদি এই সমস্ত লোকের মাসিক আয় গড়ে ৫০ টাকা ধরা যায়, তাহা হইলে উহারা বিশ লক্ষ লোকে মাসে অন্ততঃপক্ষে ১০ কোটী টাকা উপার্জন করিতেছে। অর্থাৎ বৎসরে প্রায় ১২০ কোটী টাকা বাংলাদেশ হইতে শোষিত হইতেছে[২৪]। আমি যতদূর সম্ভব তথ্য দ্বারা আমার কথা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য, সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না এবং আমার হিসাব কতকটা অনুমান মাত্র, যদিও তাহার ভিত্তি সুদৃঢ়। বিশেষজ্ঞেরা যে সব হিসাব দিয়াছেন, তাহার দ্বারা আমার অনুমান অনেক সময়ই সমর্থিত হয়। বাংলা হইতে কত টাকা বোম্বাই, রাজপুতানা, বিহার এবং যুক্তপ্রদেশে বাহির হইয়া যাইতেছে, তৎসম্বন্ধে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য নির্ণয় করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু যে হিসাব এখানে দেওয়া যাইতেছে, তাহা ধীর ভাবে বিবেচনা করিবার যোগ্য।

 সকলেই জানেন যে, মাড়োয়ারী এবং অন্যান্য স্বচ্ছল অবস্থার হিন্দুস্থানীরা আটা, ডাল, ঘি খাইয়া থাকে, ঐ সব জিনিষ তাহারা বাংলার বাহির হইতে নিজেরাই আমদানী করে। কেবল উড়িয়ারা ভাত খায়। সুতরাং আমরা বলিতে পারি যে—অবাঙালীরা যাহা উপার্জন করে, তাহা তাহাদের নিজেদের পকেটেই যায়। সুতরাং মাড়োয়ারী, ভাটিয়া বা পাঞ্জাবী যদিও কলিকাতায় থাকিয়াই অর্থ উপার্জন করে, তবু তাহাদের অর্থে বাংলার সম্পদ বৃদ্ধি হয় না, কিম্বা তাহারা বাংলার অধিবাসী হওয়াতে বাংলার কোন আর্থিক উন্নতি হয় না।[২৫] তাহারা কামস্কাটকা বা টিম্বাক্‌টোর অধিবাসী হইলেও বাংলার বিশেষ কোন ক্ষতি হইত না।

 মাড়োয়ারীরা বাংলার চারি দিকে তাহাদের জাল বিস্তার করিয়াছে। তাহারা চতুর, বেশ জানে যে, বাঙালীদের চোখ একবার খুলিলে এবং ব্যবসার দিকে তাহাদের মতি গেলে, তাহাদের (মাড়োয়ারীদের) স্থানচ্যুত হইতে হইবে এবং বাংলাদেশে এ সকল সুবিধা আর তাহারা ভোগ করিতে পারিবে না। এই আত্মরক্ষার প্রেরণাতেই তাহারা কোন বাঙালী যুবককে তাহাদের ফার্মে শিক্ষানবিশরূপে লইতে চায় না। বাঙালী যুবকেরা কখন কখন ইয়োরোপীয় ফার্মে শিক্ষানবিশ হইতে পারে এবং ক্রমশঃ উচ্চতর পদ লাভ করিয়া অবশেষে অংশীদার পর্যন্ত হইতে পারে। কিন্তু একজন বাঙালীর পক্ষে মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া ফার্মে শিক্ষানবিশ হওয়া অসম্ভব। কেবল ইহাই নহে। আমি এমন অনেক দৃষ্টান্ত জানি যে, বাঙালী যুবকেরা যে সব ছোটখাট ব্যবসা করিয়াছিল, তাহা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। মাড়োয়ারী প্রতিযোগীরা অত্যন্ত কম দরে মাল বিক্রয় করিয়া ঐ সব বাঙালী ব্যবসায়ীর আর্থিক ধ্বংস সাধন করিয়াছে! এই কারণে বলিতে হয় যে, মাড়োয়ারীরা নামে কলিকাতার অধিবাসী হইলেও তাহারা বাংলার স্বার্থের বিরোধী, এক কথায় এই সব অ-বাঙালী অধিবাসীদের ব্যবসার স্বার্থ ছাড়া বাংলার সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ নাই, এবং তাহারা বাংলার অর্থে পুষ্ট হইয়া বাংলারই আর্থিক উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে।

 আমি স্বীকার করি যে, পাট ও চা’এর ব্যবসায়ে পৃথিবীর বাজার তাহাদের আয়ত্ত। এই দুই ব্যবসায়ে যে লাভ হয়, তাহাতে বাংলার অর্থ শোষিত হয় না, কিন্তু তদ্ব্যতীত যে ১ কোটী ২০ লক্ষ টাকার কথা আমি উল্লেখ করিয়াছি, তাহা বাংলারই শোষিত অর্থ। বাংলা হইতে অ-বাঙালীদের উপার্জিত প্রত্যেকটি টাকা বাংলার হতভাগ্য সন্তানদের মুখ হইতে ছিনাইয়া লওয়া খাদ্যের সমান।

 যখনই কোন যুবককে উপদেশ দেওয়া হয় যে, কেরাণীগিরি বা স্কুল মাষ্টারী না করিয়া ব্যবসা বাণিজ্য কর,—তখনই সে মামুলী জবাব দেয়—“কোথায় মূলধন পাইব?” ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার সময় হইতে, দেশহিতকামী ব্যক্তিরা বহু যুবককে ব্যবসা করিবার জন্য মূলধন দিয়াছেন, একথা আমি জানি। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়াছে, ঐ সব যুবকেরা ব্যবসায়ে সফলকাম হইতে পারে নাই। বস্তুতঃ, ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রথমতঃ রীতিমত শিক্ষানবিশী করা প্রয়োজন। আগে ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা আরম্ভ করিয়া অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতে হইবে এবং যদি প্রথমাবস্থায় সাফল্য লাভ করা নাও যায়, তবু ব্যবসায় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হইতে পারা যায়। ব্যর্থতাই সাফল্যের অগ্রদূত। আমাদের সাধারণ যুবকেরা ব্যবসার আরম্ভেই যদি ব্যর্থ হয়, তাহা হইলে তাহারা ভগ্নহৃদয় হইয়া পুনরায় সেই পুরাতন বাঁধা পথ (চাকরী) অবলম্বন করে।

 বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে যে, মাড়োয়ারীরা প্রথমতঃ লোটা কম্বল ও ছাতু লইয়া ব্যবসা আরম্ভ করে। রেলওয়ে হইবার পূর্বে মারবারের মরুভূমি হইতে তাহারা পায়ে হাঁটিয়া বাংলাদেশে আসিত। এখনও তাহারা ঐরূপই করে, প্রভেদের মধ্যে পায়ে হাঁটার পরিবর্তে রেলগাড়ীতে চড়ে। আর আমাদের যুবকেরা বিলাসী ও অলস; তাহারা চায় কোন কষ্ট না করিয়া ফাঁকি দিয়া কার্যসিদ্ধি করিতে। কোটীপতি ব্যবসায়ী কার্নেগী যুবকদিগকে যে উপদেশ দিয়াছেন, এই প্রসঙ্গে তাহা উল্লেখযোগ্য:—

 “আজকাল দারিদ্র্যকে অনিষ্টকর বলিয়া আক্ষেপ করা হয়। যে সমস্ত যুবক ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করে না, তাহাদের জন্য করুণা প্রকাশ করাও হয়। কিন্তু এ বিষয়ে প্রেসিডেণ্ট গারফিল্ডের উক্তি আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করি—‘যুবকের পক্ষে সর্বাপেক্ষা বড় পৈতৃক সম্পত্তি দারিদ্র্য।’ আমি ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছি যে, এই দরিদ্রদের মধ্য হইতেই মহৎ এবং সাধু ব্যক্তিরা জন্মগ্রহণ করিবেন। আমার এ ভবিষ্যদ্বাণী অর্থশূন্য অতিরঞ্জন নহে। কোটীপতি বা অভিজাতদের বংশ হইতে পৃথিবীর লোকশিক্ষক, ত্যাগী, ধর্মাত্মা, বৈজ্ঞানিক, আবিষ্কারক, রাজনীতিক, কবি বা ব্যবসায়ীরা জন্মগ্রহণ করেন নাই। দরিদ্রের কুটীর হইতেই ইঁহারা আসিয়াছেন।...... সকলেই বলিবেন যে, যুবকের প্রথম কর্তব্য আত্মনির্ভরশীল হইবার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করিয়া তোলা।”—The Empire of Business.

(৯) বোম্বাই কি ভাবে বাংলার অর্থ শোষণ করিতেছে

 বাংলার বাজারে বোম্বাই মিলের কার্পাস বস্ত্রজাত কি পরিমাণে চলিতেছে, তাহার সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন। যতদূরে হিসাব সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তাহাতে মনে হয়, কলিকাতা বন্দরে বাহির হইতে প্রায় ১২৫.২ কোটী গজ কাপড় আমদানী হয়, আর স্থানীয় উৎপন্ন বস্ত্রজাতের পরিমাণ মাত্র ১৩.৪ কোটী গজ। কলিকাতা বন্দরে যে কাপড় আমদানী হয় তাহা সমস্ত বাংলা, বিহার, আসাম এবং যুক্ত প্রদেশেরও কতকাংশে যায়। ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, কলিকাতা বন্দরে আমদানী স্বদেশী মিলের কাপড় বাংলাদেশেই বেশী বিক্রয় হয়। অন্যান্য স্থানে, বিশেষতঃ বিহারে হাতে বোনা কাপড় (খদ্দর) বেশী চলে। বিশেষ সতর্কতার সহিত হিসাব করিয়া আমরা দেখিয়াছি যে, ১৯২৭-২৮ সালে যে ১২৫.২ কোটী গজ কাপড় কলিকাতা বন্দরে আমদানী হইয়াছিল (মিঃ হার্ডির হিসাবে), তাহার মধ্যে ১০০ কোটী গজ কাপড়ই বাংলাদেশে বিক্রয় হইয়াছিল। এই সম্পর্কে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে অন্যান্য প্রদেশ অপেক্ষা জীবন যাত্রার আদর্শ উচ্চতর, কেন না এখানে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশী। বাংলাদেশে বিক্রীত এই ১০০ কোটী গজ কাপড়ের মূল্য ১০ কোটী টাকা ধরা যাইতে পারে। সরকারী বিবরণে দেখা যায় যে, ১৯২১ সালে বাংলাদেশে যে ভারতীয় বস্ত্রজাত আমদানী হয়, তাহার মূল্য ৬ কোটী টাকা হইবে। ইহার সঙ্গে পূর্বোক্ত হিসাবের সামঞ্জস্য আছে বলা যাইতে পারে। কেন না ১৯২১ সাল হইতে স্বদেশী আন্দোলনের প্রসারের ফলে ভারতীয় মিলের বস্ত্রজাত ক্রমেই বেশী পরিমাণে বিদেশী বস্ত্রজাতের স্থান অধিকার করিতেছে।[২৬]

 ‘ক্যাপিট্যাল’ (১০ই ডিসেম্বর, ১৯৩১) পত্রে এই সম্পর্কে কয়েকটি সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে:—

 “কার্পাস শিল্প সম্বন্ধে এই বলা যায় যে, আরও ১৫০।২০০ মিল তৈরী করিলে ভারতের চাহিদা মিটিবে। সুতরাং বাংলা যদি তাহার নিজের কাপড়ের চাহিদা নিজে মিটাইতে চায়, তাহা হইলে তাহাকে বিশেষরূপে উদ্যোগী হইতে হইবে। অন্যথা তাহাকে চিরকাল বোম্বাইয়ের তাঁবেদারীতে থাকিতে হইবে, কেন না এখন যে সব কাপড়ের কল আছে, সেগুলি বোম্বাইয়ের এলাকার মধ্যেই অবস্থিত। কার্পাস শিল্পের কেন্দ্র হইবার সুযোগ সুবিধা বোম্বাইয়ের চেয়ে বাংলার কম নহে। এ বিষয়ে বাধা বাংলায় উপযুত্ত মূলধন ও উৎসাহের অভাব। কয়লা, তূলা, শ্রম এবং চাহিদা এ সবই পাওয়া যায়, কিন্তু বৃটিশদের কর্মশক্তি অন্য পথে গিয়াছে এবং বস্ত্রশিল্পে বোম্বাই প্রদেশ তাহার আর্থিক সম্পদ ও রাজনৈতিক প্রভাবের বলে একরূপ একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করিয়াছে। ইহার ফলে স্বদেশী আন্দোলন ও সংরক্ষণ শুল্ক নীতি প্রসূত সমস্ত লাভের কড়ি বোম্বাইয়ের ভাণ্ডারে যাইতেছে। এ বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা নাই। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া ভারত আমদানী বস্ত্রজাতের জন্য বৎসরে ৬০ কোটী টাকা ব্যয় করিয়াছে। ঐ ব্যবসা নানা কারণে ভারতীয়দের হাতে যাইয়া পড়িতেছে এবং দেখা যাইতেছে যে, অধিকাংশ কাপড়ের কলই বোম্বাই প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। ইহার ফলে কেবল বস্ত্রশিল্পে নয়, সমস্ত প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য ও আর্থিক ব্যাপারে বোম্বাই প্রদেশই ভারতে প্রভুত্ব করিবে। বোম্বাইয়ের এই আর্থিক অভিযান এখনই আরম্ভ হইয়াছে। যদিও ইহা এখন প্রাথমিক অবস্থায় আছে এবং কয়েক বৎসর পরে কলিকাতা ও ব্রিটিশ সম্প্রদায়, কংগ্রেস কার্যপ্রণালী অনুসারে, আর্থিক ব্যাপারে বোম্বাইয়ের অধীন হইয়া পড়িবে। জামশেদপুরে যাহা ঘটিয়াছে, কলিকাতাতেও তাহারই পুনরভিনয় হইবে। আর বোম্বাই যদি বস্ত্রশিল্পে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহার কার্যক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়, তবে সে ব্যবসা বাণিজ্যে ও আর্থিক ব্যাপারে ভারতের রাজধানী হইয়া দাঁড়াইবে এবং কলিকাতা বিজয় করিতে তাহার পক্ষে ২০ বৎসরের বেশী লাগিবে না। আমাদের এই অনুমান যদি সত্য হয়, তবে স্বরাজের আমলে, বাংলাদেশ আর্থিক ব্যাপারে পরাধীনই থাকিয়া যাইবে, কেবল ব্রিটিশ বণিকদের পরিবর্তে বোম্বাইয়ের ব্যবসায়ীরা তাহার প্রভু হইবে।”— ডিচারের ডায়েরী।

 বোম্বাইয়ের কলওয়ালারা বাঙালীদের দেশপ্রেমের সুযোগ লইয়া যেভাবে বাংলাকে শোষণ করিয়াছে, তাহার পরিচয় নিম্নলিখিত কথোপকথনের ভিতর দিয়া পাওয়া যাইবে। বোম্বাইয়ের একজন কলওয়ালার সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর এইরূপ কথাবার্তা হইয়াছিল:—

 “আপনি জানেন যে, ইহার পূর্বেও স্বদেশী আন্দোলন হইয়াছিল?”

 “হাঁ, তাহা জানি।”—আমি উত্তর দিলাম।

 “আপনি ইহাও অবশ্য জানেন যে, বঙ্গভঙ্গের সময়ে বোম্বাইয়ের কলওয়ালারা স্বদেশী আন্দোলনের সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করিয়াছিল? যখন ঐ আন্দোলন বেশ জোরে চলিতেছিল, তখন আমরা কাপড়ের দাম চড়াইয়া দিয়াছিলাম। আরও অনেক কিছু অন্যায় কাজ করিয়াছিলাম।”

 “হাঁ, আমি এ সম্বন্ধে কিছু শুনিয়াছি এবং তাহাতে বেদনা বোধ করিয়াছি।”

 “আমি আপনার দুঃখ বুঝিতে পারি, কিন্তু ইহার কোন সঙ্গত কারণ দেখি না। আমরা দান খয়রাতের জন্য ব্যবসা করিতেছি না। আমরা লাভের জন্য ব্যবসা করি, অংশীদারদের লভ্যাংশ দিতে হয়। আমাদের পণ্যের মূল্য চাহিদা অনুসারে নির্দ্ধারিত হয়। চাহিদা ও যোগানের অর্থনীতিক নিয়ম কে লঙ্ঘন করিতে পারে? বাঙালীদের জানা উচিত ছিল যে, তাহাদের আন্দোলনে স্বদেশী বস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাইবে ও উহার মূল্য বাড়িয়া যাইবে।”

 আমি বাধা দিয়া কহিলাম,—“বাঙালীদের প্রকৃতি আমার মতই বিশ্বাস-প্রবণ। তাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল যে, কলওয়ালারা দেশের সঙ্কটসময়ে স্বার্থপরতার বশবর্তী হইয়া বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না। কলওয়ালারা এত দূর চরমে উঠিয়াছিল যে, বিদেশী কাপড়ও প্রতারণা করিয়া দেশী বলিয়া চালাইতে কুণ্ঠিত হয় নাই।”

 “আমি আপনার বিশ্বাসপ্রবণ ভাবের কথা জানি, সেই জন্যই আপনাকে আসিতে বলিয়াছিলাম। আমার উদ্দেশ্য আপনাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া—যাহাতে সরলহৃদয় বাঙালীদের মত আপনিও বিভ্রান্ত না হন।” Gandhi: Autobiography, vol. II.

 অন্য প্রদেশের লাভের জন্য বাংলাদেশ ও তাহার দরিদ্র কৃষকদের কি ভাবে শোষণ করা হইতেছে, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। বিদেশ হইতে আমদানী করোগেট টিনের (ইস্পাতের) উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাইয়া টাটার লৌহশিল্পজাতকে যে ভাবে সংরক্ষিত করা হইয়াছে, তাহাতে বাংলার স্বার্থকেই বলি দেওয়া হইয়াছে, ইহা আমি নানা তথ্য সহকারে প্রমাণ করিতে পারি। ইম্পিরিয়াল প্রেফারেন্স বা সাম্রাজ্যবাণিজ্য নীতির জন্য কেবল মাত্র ব্রিটিশ লৌহজাত এই অতিরিক্ত শুল্ক হইতে নিষ্কৃত পাইয়াছে। বর্তমান আমদানী শুল্কের ফলে বাংলাদেশকে দ্বিগুণ ক্ষতি সহ্য করিতে হইয়াছে। বাংলা করোগেট টিনের প্রধান খরিদ্দার,—বাংলার দরিদ্র লোকেরা বিশেষ পূর্ব বঙ্গের কৃষকেরা এই আমদানী শুল্ক বৃদ্ধির জন্য করোগেট টিনের জন্য বেশী মূল্য দিতে বাধ্য হয়। যখন প্রতি টনে দশ টাকা শুল্ক ছিল, তখন করোগেট টিনের দাম ছিল—প্রতি টন ১৩৭ টাকা। ১৯২৫—২৬ সালে টাটা কোম্পানীর চীৎকারের ফলে ঐ শল্ক বৃদ্ধি পাইয়া টন প্রতি ৪৫, টাকা হইল। ১৯২৬ হইতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ঐ শুল্ক কিছু কমিয়া টন প্রতি ৩০ টাকা থাকে। ১৯৩১ সালে ঐ শুল্ক হঠাৎ বাড়িয়া টন প্রতি ৬৭ টাকা হইয়া দাঁড়ায়, ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শতকরা ২৫ টাকা ‘সার চার্জের’ দরুণ উহা বৃদ্ধি পাইয়া টন প্রতি ৮৩৸৹ আনায় উঠে। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাংলার দরিদ্র কৃষকদের বিষম ক্ষতি হইল। এদিকে টাটা কোম্পানী শুল্ক বৃদ্ধির সুযোগ লইয়া করোগেট টিনের দাম টন প্রতি ২১৮ টাকা চড়াইয়া দিয়াছে। সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত এই দেশীয় শিল্পের সঙ্গে বিদেশী শিল্পের মূল্যের এত বেশী তফাত যে, দেশবাসী দাবী করিতে পারে কেন এই দেশীয় শিল্পের উন্নতি সাধন করিয়া মূল্য সুলভ করিবার ব্যবস্থা হইবে না? করোগেট টিনের ব্যবসা পূর্বে বাঙালী ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল, কিন্তু অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির ফলে ঐ সমস্ত বাঙালী ব্যবসায়ীরা ধ্বংস পাইতে বসিয়াছে। এখন অ-বাঙালী ব্যবসায়ীরা বাঙালীদের স্থানচ্যুত করিয়া ক্রমে ক্রমে এই ব্যবসা হস্তগত করিতেছে। কেননা টাটারা এখন আর বাঙালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কারবার করিতে প্রস্তুত নহে। সুতরাং আমি যে বলিয়াছি, বোম্বাইওয়ালাদের লাভের জন্য বাঙালীদের শোষণ করা হইতেছে, তাহাদের স্বার্থ বলি দেওয়া হইতেছে, তাহা এক বর্ণও মিথ্যা নয়। অদৃষ্টের পরিহাসে বাংলা বোম্বাইয়ের শোষণক্ষেত্র হইয়া উঠিয়াছে, ঐ প্রদেশের ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসিয়া বাঙালীদের স্কন্ধে চড়িয়া ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিতেছে।

 টাটা কোম্পানী এত কাল ধরিয়া সংরক্ষণ নীতি ও সরকারী সাহায্যের সুবিধা ভোগ করিবার ফলে যদি নিজেদের পায়ে দাঁড়াইতে এবং বিদেশী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইত, তবে বাংলার লোকেরা যে স্বার্থ ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছে, তাহার একটা সার্থকতা থাকিত। অর্থনীতি শাস্ত্রের ইহা একটা সুপরিচিত সত্য যে, কোন শিশু শিল্পকে রক্ষা করিবার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংরক্ষণ নীতি অবলম্বন করা যাইতে পারে। কিন্তু চিরকাল ধরিয়া এরূপ সংরক্ষণ করা যাইতে পারে না, কেননা তাহাতে অযোগ্যতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং পরিণামে তাহার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক দুর্গতি ঘটে। টাটা কোম্পানীর দৃষ্টান্তে ইহা প্রমাণিত হইয়াছে। এই দরিদ্র দেশের অধিবাসীদের অবস্থার তুলনায় ব্রিটিশ শাসন ব্যয়সাধ্য বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু টাটারা তাহার উপর টেক্কা দিয়াছে। বহু বৎসর পূর্বে স্যার দোরাব টাটা গর্ব করিয়া বলিয়াছিলেন, তাঁহার কারবারে বিদেশ হইতে আনীত বিশেষজ্ঞদিগকে কোন কোন ক্ষেত্রে বড় লাটের চেয়েও বেশী বেতন দেওয়া হয়; এবং এই জন্যই বুঝি বাংলাদেশকে এরূপ ভাবে শোষণ করা হইয়াছে!—আমদানী শুল্কের বৈধতা বা অবৈধতা ল‍ইয়া বিচার করা আমার উদ্দেশ্য নহে, আমি বলিতে চাই যে, বোম্বাইকে রক্ষা ও তাহার ঐশ্বর্য বৃদ্ধির অর্থ বাংলার দুর্গতি। এই শোষণ কার্যের বিরাম নাই এবং ইহা ক্রমেই বাংলার পক্ষে বেশী অনিষ্টকর হইয়া উঠিতেছে।

 তারপর, চিনি শিল্পের কথা ধরা যাক। ট্যারিফ বোর্ডের সুপারিশে ভারতে আমদানী সাদা চিনির উপর মণ করা ছয় টাকা শুল্ক বসিয়াছে এবং এই ভাবে সংরক্ষিত হইয়া দেশীয় চিনি শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করিতেছে। যে সব চিনির কল আছে, তাহারা বার্ষিক শতকরা ২৫ টাকা হইতে ৫০ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ দিতেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও বিহারে প্রতি বৎসর গড়ে ২৫টি করিয়া চিনির কল স্থাপিত হইতেছে এবং আশা করা যাইতেছে যে কয়েক বৎসরের মধ্যে যে লভ্যাংশ পাওয়া যাইবে, তাহাতেই মূলধন উঠিয়া আসিবে। পূর্বেই দেখাইয়াছি, বাংলাদেশ ভারতে আমদানী সাদা চিনির বড় খরিদ্দার ছিল। সুতরাং যুক্ত প্রদেশ এবং বিহারের চিনি যে বাংলাদেশেই সর্বাপেক্ষা বেশী বিক্রয় হইবে, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সব চিনির কলের কোনটাই বাঙালীর উদ্যোগে বা মূলধনে স্থাপিত হয় নাই। এখানেও আমাদের জাতির অক্ষমতা ও কর্মবিমুখতার পরিচয় পাওয়া যায়।

 বোম্বাই মিল সমূহে ম্যানেজিং এজেণ্টদের অযোগ্যতা প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। তাহারাও তাহাদের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছুক নহে। আমরা দেখিতেছি ইণ্ডিয়ান টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশান গবর্ণমেণ্টের নিকট প্রস্তাব করিয়াছেন যে, ভারতে আমদানী জাপানী বস্ত্রের উপর শতকরা এক শত ভাগ শুল্ক বসানো হোক। তাহাদের আবেদন তদন্তের জন্য ট্যারিফ বোর্ডের নিকট প্রেরিত হইয়াছে এবং খুব সম্ভব গবর্ণমেণ্ট আমদানী শুল্ক যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করিবেন।

 একথা বলা বাহুল্য যে, টাটার লোহার কারখানা, বস্ত্র শিল্প, লবণ শিল্প এবং চিনি শিল্পের একটা বৃহৎ অংশ, বোম্বাইয়ের মূলধনীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। বর্তমানে গবর্ণমেণ্টের আর্থিক অবস্থা যেরূপ, তাহাতে তাঁহারা ভারতের করদাতাদের অর্থে নিজেদের তহবিল ভর্তি করিবার সুযোগ পাইলে খুসী হন। সতরাং ‘সাম্রাজ্যের স্বার্থের’ যদি ক্ষতি না হয়, তবে গবর্ণমেণ্ট সংরক্ষণ নীতি সমর্থন করিতে সর্বদাই প্রস্তুত। বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে যে, এই সংরক্ষণ শুল্কের বোঝা বেশীর ভাগ বাঙালী ক্রেতাদেরই বহন করিতে হয়। যে ‘ট্রাষ্ট প্রথা’ আমেরিকার সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যকে করতলগত করিয়াছে, স্পষ্টই বুঝা যায়, তাহা আমাদের দেশেও তাহার বিষাক্ত প্রভাব বিস্তার করিতেছে। অতিরিক্ত রক্ষণ শুল্কের দ্বারা বোম্বাইয়ের শিল্পের কোন উন্নতি হয় নাই, বরং উহার ফলে বাংলার দরিদ্র ক্রেতাগণ ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। এক কথায় আমাদের অক্ষমতার জন্য বাংলাদেশ শিল্প বাণিজ্যে বোম্বাইয়ের মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছে। এমন কি, কলিকাতা ব্যবসা বাণিজ্যে বোম্বাইয়ের ‘লেজুড়’ হইয়া দাঁড়াইতেছে, একথা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

ইন্‌সিওরেন্স কোম্পানী কর্তৃক বাংলার অর্থ শোষণ

 ভারতীয় এবং বিদেশী উভয় প্রকার ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলি মিলিয়া বাংলাদেশের অর্থ নিয়মিত ভাবে শোষণ করিতেছে। ‘ভারতীয়’ বলিলেই ‘বোম্বাই প্রদেশীর’ বুঝিতে হইবে,—ইনসিওরেন্স কোম্পানীর পক্ষে একথা বিশেষ ভাবেই খাটে।

 কতকগুলি দেশে বিদেশী ইনসিওরেন্স কোম্পানী সমূহের উপর নানারূপ বিধি নিষেধ প্রয়োগ করা হইয়াছে,—উদ্দেশ্য, দেশীয় ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলি যাহাতে অবৈধ প্রতিযোগিতার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া উন্নতি লাভ করিতে পারে। মেক্সিকো, চিলি, ব্রেজিল, বুলগেরিয়া, পর্টুগাল, ডেনমার্ক, এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশে, এইরূপ বিধি নিষেধ আছে। কিছু দিন হইল তুরস্কের ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলির উন্নতি বিধানের জন্য ঐ দেশে আইন হইয়াছে। ভারতের নিকট প্রতিবাসী ক্ষুদ্র রাজ্য শ্যামে পর্যন্ত স্বদেশী ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলিকে রক্ষা করিবার জন্য আইন হইয়াছে। আত্মমর্যাদা ও স্বার্থের দিক হইতে ভারতবাসীদেরও ভারতীয় কোম্পানী সমূহেই বীমা করা উচিত।

 কিন্তু ভারতে দুর্ভাগ্যক্রমে এই উভয়েরই অভাব। অধুনাতম “ইনসিওরেন্স ইয়ার বুক” বা বীমা জগতের বর্ষপঞ্জীতে দেখা যায় যে, আমরা প্রতি বৎসর বিদেশী ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলিকে ৫ কোটী টাকা প্রিমিয়াম দিয়া থাকি; অর্থাৎ যে সব লোকের স্বার্থ আমাদের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী, তাহাদের হাতেই আমরা এই বিপুল অর্থ দিয়া থাকি। যাহাদের সঙ্গে সব দিক দিয়াই স্বার্থের সঙ্ঘর্ষ—তাহাদের হাতে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তুলিয়া দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?

 ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলি বাংলাদেশের অর্থ কি ভাবে শোষণ করিতেছে, এই দিক দিয়া যখন দেখি, তখন স্তম্ভিত হইতে হয়।

 নিম্নে উন্নতিশীল ভারতীয় ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলির নামের তালিকা, তাহাদের ব্যবসায়ের প্রসার, মূলধন প্রভৃতির হিসাব দেওয়া হইল:—

কোম্পানীর নাম কত টাকা মূল্যের
ইনসিওরেন্স ছিল
নূতন কাজ মোট আয় মোট ফাণ্ড
এসিয়ান ১,০০,৪৮,৩১০ ৩১,২৯,৭৫০ ৫,৮৬,৪৬৯ ১২,৫০,১১২
ভারত ৫,১৫,৭২,৩৮৭ ১,৫০,১৮,৫৪২ ২৭,৭৩,৫৭৪ ১৬,১১,৫৬৬
বোম্বে মিউচুয়াল ৬১,৯১,৮৮৭ ১৮,৫৯,০০০ ৩,৬৮,৬৮০ ১১,৫৩, ৮৪৮
বোম্বে লাইফ ১,৫৮,৯৬,০২৯ ৪২,৬২,০০০ ৭,৩৮,৫২৯ ২১,৫২,৪৩২
কো-অপ অ্যাস্যু ৩১,২২,৫৫৩ ৪,১৯,৫০০ ১,৮৬,০৭৩ ৭,৪৩,০২৫
ইস্ট অ্যাণ্ড ওয়েস্ট ২৮,৩৬,৮৩৩ ১০,৪০,০০০ ১,৬৭,০৩২ ২৯৫,৫৪৯
এম্পায়ার ৯,৪১,৭২,৭৫৩ ১,২৭,০০,০০০ ৫৯,৫৯,৮৪২ ৩,২৮,৪১,২৭৯
জেনারেল ১,৬৯,৬৬,৪৪৪ ৬০,০০,০০০ ১,২৯,৪৪৯ ২০,১১,১১৫
হিন্দুস্থান কো অপাঃ ৩,০০,০০,০০০ ১,০১,১১,০০০ ১৪,৭৮,০০০ ৭৫,০০,০০০
হিন্দু মিউচুয়াল ২১,৪০,৪৫৭ ৩,৫৬,২৫০ ১,২০,১৭০ ৪০০,৯৬২
ইণ্ডিয়ান লাইফ ১,৬০,৫২,০০৪ ৯,১৫,৫০০ ৮,৪৯,৬৪১ ৫৩,৯৪,৬২৬
আই, অ্যাণ্ড প্রজেন ১,১৫,৫৪,৭৩৮ ৩৬,১৯,০০০ ৭,০৬,০২৬ ১৯,০৫,৭০২
ইণ্ডিয়া ইকুই ৫৪,৩১,৭৫২ ১২,৩৩,৫০০ ৩,১২,২৭৬ ১১,৫১,০০৪
লক্ষ্মী ১,৬৬,১৮,৬২০ ৬৬,২৭,৩৫০ ৮,২৫,১৬৬ ৯,৩২,৮৭৯
ন্যাশনাল ৫,১৮,০৫,০২৭ ১,০০,৩৪,৪০০ ৩১,৬৯,০০০ ১,৩৫,০০,০০০
নিউইণ্ডিয়ান ১,২৫,৯৬,৫৫৪ ২৩,৭১,৫০০ ৮,৮৯,০২৯ ২১,৮৭,৪১৩
ওরিয়েণ্টাল ৩১,৬৭,৫৯,৪৫৬ ৫,৮৫,৫২,২০১ ১,৮৪,৪৩, ১৭৭ ৮,৭৩,২৫,৭৪৭
পিপ্‌ল্‌স ২৭,৫৭,৭৫০ ১৭,৩৮,৫০০ ৯৮,৪৭৭ ৭৯৩
ইউনাইটেড ইণ্ডিয়া ১,২৪,৬১,৬৭৯ ৩৩,৬৫,৫০০ ৭,৮২,৯০১ ২৯,৪২,৯৬১
ওয়েস্ট ইণ্ডিয়া ১,০০,৮৩,৪৭৪ ২২,৩১,৭৫০ ৬,১৭,১১৮ ১৮,৫৭,৬৩৯
জেনিথ ৩৭,১৪,৫৩৯ ২৫,৪৬,৫০০ ৩,১২,১৮০ ৫,৬৬, ০১১
 উপরে যে ২১টি কোম্পানীর নাম করা হইল, তাঁহাদের মধ্যে মাত্র তিনটি কোম্পানীকে খাঁটি বাঙালী কারবার বলা যাইতে পারে। কিন্তু তালিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই দেখা যাইবে যে, তাহারা নগণ্য। যে সব কোম্পানী সাফল্য লাভ করিয়াছে, তাহাদের অধিকাংশই বাংলার বাহিরের—বিশেষভাবে বোম্বাই প্রদেশের। বাংলার যে কোম্পানীটির সব চেয়ে ভাল অবস্থা, অ-বাঙালীরা তাহার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। নূতন সাময়িক পত্র “ইনসিওরেন্স ওয়ালর্ড্‌” এ বিষয়ে বলিতেছেন—“এ কথা সুবিদিত যে, প্রতি বৎসর যত টাকার নতুন কাজ সমগ্র ভারতে হয়, তাহার প্রধান অংশ বাংলাতেই হইয়া থাকে। যে সমস্ত ইনসিওরেন্স কোম্পানী ভারতে কারবার করে, তাহারা বাংলাকে প্রধান কর্মক্ষেত্র রূপে গণ্য করিয়া থাকে এবং এখানেই এজেন্সি ও শাখা আফিস প্রভৃতি স্থাপন করে। তাহাদের মধ্যে অনেক কোম্পানী বাংলাতেই তাহাদের কাজের দুই-তৃতীয়াংশ পাইয়া থাকে। ইহার দ্বারা বুঝা যায় যে, বাংলা দেশের লোকেরা বীমার তাৎপর্য অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে ভাল বুঝে।”—কিন্তু পক্ষান্তরে ইহাতে বাঙালীর ব্যবসায়ে অক্ষমতা আরও ভালরূপে প্রকাশ পায়।

 বাংলার সম্পদ ক্রমাগত শোষিত হইতেছে; উহা বিদেশীরাই করুক, আর অ-বাঙালীরাই করুক—ফল সমানই।

 জীবন বীমার প্রয়োজনীয়তা বাঙালীরাই প্রথম ধরিতে পারিয়াছে। ভারতবর্ষ হইতে প্রায় পাঁচ কোটী টাকা বিদেশী বীমা কোম্পানী গুলির পকেটে যাইতেছে, উহার প্রধান অংশ বাঙালীরাই দেয়। যে ২১টি ভারতীয় ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কথা বলা হইল, তাহারাও বহু কোটী টাকা বাংলা হইতে টানিয়া লইতেছে। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বিদেশী কোম্পানীর চেয়ে ভারতীয় কোম্পানী গুলিরই প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়া গিয়াছে বলিয়া ভারতীয় কোম্পানী গুলির বিশেষ সুবিধা হইয়াছে। সতরাং দেখা যাইতেছে, ব্যবসায়ে বাঙালীর অযোগ্যতা ও অক্ষমতার দরুণবাংলা কয়েক কোটী টাকা বোম্বাইকে দিতে বাধ্য হইতেছে। গত অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া এই ভাবে বাংলা যত টাকা দিয়াছে, তাহার পরিমাণ বিপুল।

 নিম্নে যে তালিকা প্রদত্ত হইল, তাহা হইতে বাংলার শোচনীয় দুরবস্থা প্রতীয়মান হইবে। এই তালিকার জন্য মিঃ এস. সি. রায়ের নিকট আমি ঋণী।

প্রিমিয়ামের আয়

১৯২৯
বোম্বাইয়ের কোম্পানী টাকা ২,৫৪,৩৩,০০০
বাংলার কোম্পানী টাকা ৬৫,৮৫,০০০[২৭]
মাদ্রাজের কোম্পানী টাকা ১২,৭২,০০০
পাঞ্জাবের কোম্পানী টাকা ৪১,৬০,০০০
যুক্তপ্রদেশ, আজমীর ও দিল্লীর কোম্পানী টাকা ১১,৯৩,০০০

লাইফ ফাণ্ড

১৯২৯
বোম্বাইয়ের কোম্পানী টাকা ১৪,৭৩,২৭,০০০
বাংলার কোম্পানী টাকা ২,৭০,২২,০০০[২৮]
মাদ্রাজের কোম্পানী টাকা ৪৬,২৩,,০০০
পাঞ্জাবের কোম্পানী টাকা ১,২৮,৬৬,০০০
যুক্তপ্রদেশ, আজমীর ও দিল্লীর কোম্পানী টাকা ২৪,০৯,০০০

 দেখা যাইতেছে, যে, খাঁটি বাঙালী কোম্পানী গুলির প্রিমিয়ামের আয় ৩৫ লক্ষ টাকা এবং লাইফ ফাণ্ড ১/ কোটী টাকা মাত্র। ইনভেষ্টরস্ রিভিউয়ের নব প্রকাশিত সংখ্যায় দেখা যাইবে, ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলি কিরূপে কারবার চালায় এবং লাভ করে। ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলির হাতে প্রভূত মলধন থাকে এবং এই টাকার অধিকাংশ ইংলণ্ড ও আমেরিকার রেলওয়ে, ইলেকট্রিক কোম্পানী, গ্যাস কোম্পানী, লোহা ও ইস্পাত কোম্পানী, কয়লার ব্যবসায়, জাহাজের ব্যবসায় এবং টেলিগ্রাফ কোম্পানী সমূহের কারবারে খাটান হয়। গ্রেট ব্রিটেনে বহু জাতিগঠনমূলক কার্যে ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ফাণ্ডের টাকা এই ভাবে খাটান হইয়া থাকে। ইহা একটি লাভজনক পন্থা এবং তাহারা এই ভাবে তাহাদের শিল্প সম্ভার বাড়াইয়াছে, শিল্প বাণিজ্য, অর্থনীতি ব্যাপারে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ইনসিওরেন্স ফাণ্ডের শতকরা ৩৫ ভাগ রেলওয়েতে, ৩০ ভাগ স্থাবর সম্পত্তিতে এবং ৯ ভাগ মাত্র গবর্ণমেণ্ট সিকিউরিটিতে খাটানো হইয়া থাকে। পূর্বেই বলিয়াছি যে, বোম্বাইয়ের তথা বিদেশী কোম্পানীগুলির অধিকাংশ প্রিমিয়াম ও ফাণ্ডের টাকা বাংলা হইতেই প্রাপ্ত এবং ঐ টাকা তাহারা নিজেদের শিল্প বাণিজ্যের উন্নতির জন্য নিয়োগ করিয়া থাকে। এই সমস্ত ব্যাপারে বাংলার প্রায় ২৷৩ কোটী টাকা শোষিত হয় এবং ইহা আমাদের আর্থিক স্বাতন্ত্র্যের পক্ষে প্রবল অন্তরায়।

 নিম্নোদ্ধৃত পত্রখানিতে অনেক চিন্তা করিবার কথা আছে। লেখক আমার সপরিচিত এবং তিনি বাংলার শোচনীয় অবস্থা উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন:—

প্রাদেশিক পক্ষপাত

 ক্যাপিট্যালের সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,

১০ই ডিসেম্বর, ১৯৩১

মহাশয়,

 ১৯৩১ সালের ৩রা ডিসেম্বরের “ডিচার্স ডায়েরীতে” স্যার পি. সি. রায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রকাশিত “স্বরাজ এবং বাংলার আর্থিক অবস্থা” শীর্ষক পুস্তিকার বিস্তৃত সমালোচনা করা হইয়াছে। আপনার যুক্তিপূর্ণ সমালোচনায় কিন্তু দেখান হয় নাই, বাংলা কিরূপে আর্থিক ধ্বংস হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিবে। প্রাদেশিক পক্ষপাত যতদূর সম্ভব বর্জন করিতে হইবে, এবং উহা আমাদের নিকট রুচিকরও নহে। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি, ইহা ছাড়া আর কি পথ আছে?

 বাংলার বর্তমানের প্রধান সমস্যা তাহার কর্মহীন যুবকদের জন্য কর্মের সংস্থান করা। ডাক্তারী, ওকালতী ব্যবসায়, কেরাণীগিরি—সর্বত্রই বেজায় ভিড়। এক মাত্র পথ শিল্প ব্যবসায়ের উন্নতি করা। বাংলা গ্রীষ্মপ্রধান স্থান, ইহার লোকসংখ্যা ৫ কোটী। সুতরাং বাংলার অধিবাসীদের পরিচ্ছেদের জন্য প্রচুর কার্পাসজাত বস্ত্রের প্রয়োজন। প্রচুর লবণও তাহার পক্ষে প্রয়োজন। বাংলাদেশে অন্ততঃপক্ষে ৪০।৫০টি কাপড়ের কল এবং ১২টি লবণের কারখানা স্থাপন করিতে হইবে। এবং বাংলা যদি ইহা করিতে পারে তবে তাহার শিশু শিল্পের জন্য অন্ততঃ পক্ষে ১০।২০ বৎসরের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 এরূপ অবস্থায় বাংলার পক্ষ হইতে ‘টার্মিনাল ট্যাক্স’ বসানো কেবল সঙ্গত নয়, অত্যাবশ্যক। ভারতের ভিন্ন প্রদেশের প্রতিযোগিতার পথ বাংলাদেশ একেবারে রুদ্ধ করিতে চায় না। কিন্তু সে চায় যে, তাহার শিশু শিল্প গুলি গড়িয়া উঠিবার সুযোগ লাভ করে এবং ভিন্ন প্রদেশের প্রবল প্রতিযোগিতায় পরাস্ত না হইয়া আত্মরক্ষা করিতে পারে। যদি বোম্বাই অভিযোগ করে, তবে যুদ্ধের সময় বাংলাকে সে কিরূপে নির্লজ্জ ভাবে শোষণ করিয়াছে, তাহা তাহাকে স্মরণ করিতে বলি। সে তাহার কার্পাসজাত বস্ত্রের মূল্য শতকরা ২০০ ভাগ বাড়াইয়া দিয়াছিল এবং অংশীদারগণকে প্রভূত লভ্যাংশ দিয়াছিল। বাংলার শ্রমিকেরা এই দুর্মূল্যের জন্য কাপড় কিনিতে না পারিয়া লজ্জায় আত্মহত্যা করিয়াছে। কিছুদিন হইল, বোম্বাই ও এডেনের ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য, বাংলার তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও, বাংলার আমদানী লবণের শুল্ক বৃদ্ধি করা হইয়াছে।

 বাঙালীদের যে দোষই থাক, তাহারা দেশপ্রেমিক জাতি এবং তাহাদেরই জন্য ভারতে, বিশেষভাবে বোম্বাইয়ে কার্পাস শিল্পের উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু বোম্বাই তাহার কি প্রতিদান দিয়াছে? স্বদেশী বাঙালীর মজ্জাগত, তাহারা যদি বলে যে, আমরা সর্বাগ্রে আমাদের নিজেদের শিল্প রক্ষা করিব, তাহা হইলে কেহই এই সঙ্গত ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে পারে না; ব্রিটিশেরা তো পারেই না, কেন না তাহারা নিজেদের দেশে শিল্প রক্ষার জন্য শতকরা ১০০ ভাগ শুল্ক বসাইবার প্রস্তাব করিতেছে।

—ভবদীয় নৃপেন্দ্রকুমার গুপ্ত

 স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, আর্থিক ক্ষেত্রে অবাঙালীর হস্তে পরাজিত ও ধূল্যবলুণ্ঠিত, মন্দভাগ্য বাঙালীর রক্তমোক্ষণ চলিয়াছে। সে রক্তস্রাব বন্ধ করিবার কিংবা ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিবার কোন চেষ্টাই হইতেছে না।

(১০) নিরপেক্ষ প্রামাণিক ব্যক্তিদের অভিমত

 এ বিষয়ে যাঁহারা বিশেষজ্ঞ এবং কথা বলিবার অধিকারী এমন কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিমত আমি উদ্ধৃত করিতেছি।

 আমার ভূতপূর্ব ছাত্র এবং হাইকোর্টের একজন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার, ব্যবসা ক্ষেত্রে বাঙালীর ব্যর্থতা সম্বন্ধে বহু চিন্তা করিয়াছেন। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমার নিকট নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়াছেন:—

 “আশা করি আমার এই দীর্ঘ পত্রের জন্য আপনি কিছু মনে করিবেন না। আমি যখন দেখি যে, বাঙালীদের মস্তিষ্ক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হইলেও তাহারা প্রতিযোগিতার সর্বত্র পরাস্ত হইতেছে, তখন আমি গভীর বেদনা বোধ করি।

 “আমি বহু মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করিয়াছি, জেরা করিয়াছি। আইনজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে আমি তাহাদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার পরিচয় ভালরূপেই জানি। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, এই অবনতির অবস্থাতেও বাঙালীরা ঐ সব লোকেদের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিতে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ। মাড়োয়ারীরা ব্যবসায়ে কেন সাফল্য লাভ করে এবং বাংলার বাজার এমন ভাবে কিরূপে তাহারা দখল করিয়াছে, আমি অনেক সময় তাহার কারণ বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। তাহাদের কোন শিক্ষা নাই, কোন বিশেষ জ্ঞান নাই এবং তাহাদের সামাজিক প্রথা ও আচার ব্যবহার অত্যন্ত অনুদার ও সঙ্কীর্ণ। তবে কেন তাহারা এমন সাফল্য লাভ করে? আমার বিশ্বাস যে, মাড়োয়ারীদের নিজেদের মধ্যে এমন বিশ্বাস ও সহযোগিতার ভাব বর্তমান যাহা বাহিরের লোকে ধারণা করিতে পারে না। বাঙালীদের মধ্যে আমি তাহা দেখিতে পাই না।

 “মাড়োয়ারীদের মধ্যে হাজার হাজার টাকার লেন দেন হইতেছে, তাহার কোন দলিল পত্র রাখা হয় না, এমন কি রসিদও নেওয়া হয় না। জহরতের প্যাকেট, হীরা মুক্তা প্রভৃতি দালালদের ও দর-দালালদের হাতে হাতে ঘুরে, তাহার কোন রসিদ থাকে না।

 “দ্বিতীয়তঃ, নূতন নূতন চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার মোহে তাহারা শক্তি ক্ষয় করে না। আমি জানি না এ বিষয়ে কি করা যাইতে পারে। আমি ভদ্র যুবকদের ব্যবসায় শিখাইবার জন্য নিজে একটি ‘ডেয়ারী’ স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। কয়েকজন বন্ধু মিলিয়া এজন্য ৩৫ হাজার টাকা দিয়াছিলাম। দেখিলাম—বাঙালী যুবকদের অসাধুতা এবং কর্ম বিমুখতা ভয়াবহ। ৩৫ হাজার টাকাই নষ্ট হইল আরও পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া আমাদিগকে ঋণ শোধ করিতে হইল।

 “আর একটি প্রচেষ্টায় আমার পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট হইয়াছে—সেখানেও অবস্থা একই রকম। আমি লাভের জন্য এই সব প্রচেষ্টা করি নাই। বস্তুতঃ যদি চেষ্টা সফল হইত, আমার কোন লাভ হইত না। তাহাদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল যে, পাঁচ বৎসর তাহারা আমার টাকা খাটাইবে, তাহার পর ক্রমশঃ বিনা সুদে ঐ টাকা পরিশোধ করিবে। আমি জানি, এই সব সমালোচনা করা সহজ—কিন্তু কি উপায় আছে, তাহাও আমি দেখিতে পাইতেছি না।

 “আপনি দেশের কাজে আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন, আর আমি বিলাসিতার মধ্যে বাস করিতেছি। আপনিই আমার চেয়ে এ বিষয়ে ভাল বিচার করিতে পারিবেন। আমরা যদি কৃষি ও শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি করিতে পারি, রাজনৈতিক ক্ষমতা স্বভাবতই আমাদের হাতে আসিবে। কিন্তু আমাদের সমস্ত শক্তি শাসনসংস্কার, মন্ত্রীত্ব এবং ভোটের জন্য ব্যয় হইতেছে। এই সব অসার জিনিষ অসঙ্গত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে।

 “সম্ভবতঃ যে সব বিষয় সকলেই জানে তৎসম্বন্ধে বাজে বকিয়া আমি নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতেছি। আমি এ বিষয়ে নূতন কিছু বলিতে পারি নাই। আশা করি, আপনি আমাকে এই সব অসংলগ্ন কথার জন্য ক্ষমা করিবেন।”

 মিঃ বি. এম. দাস ন্যাশনাল ট্যানারী এবং সরকারী ট্যানিং রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ট্যানারীর কাজে বিশেষজ্ঞ হিসাবে সমগ্র ভারতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ব্যবসায়ে বাঙালীদের ব্যর্থতা সম্বন্ধে আমার নিকট নিম্নলিখিত অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন:—

 “আপনার পত্র পাইয়াছি। অবাঙালীদের তুলনায় বাঙালীদের ব্যবসায়ে যোগ্যতা কিরূপ তাহা আপনি জানিতে চাহিয়াছেন।

 “আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে যে, কলেজ হইতে বাহির হইয়াই আমি এই কাজে যোগদান করি। ইহাতে প্রায় ১৫ বৎসর আছি। কলিকাতার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের সহিত কারবারের অভিজ্ঞতা আমার পূর্বে ছিল না। সুতরাং আমি খোলা মন লইয়াই কাজ আরম্ভ করি, কোন সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। পক্ষান্তরে, নিজে বাঙালী বলিয়া, আমি স্বভাবতঃ বাঙালীদের সঙ্গেই কারবার করিতে ভালবাসিতাম এবং তাহাদিগকে কাজের বেশী সুযোগ দিতাম।

 “কিন্তু শীঘ্রই আমি বুঝিতে পারিলাম, যে কারবার আমি করিতাম তাহাতে বাঙালী ব্যবসায়ী খুব কমই ছিল, অধিকাংশই অবাঙালী। আমি ইহাতে সন্তুষ্ট হইতাম না এবং ইচ্ছা করিতাম, এই কাজে বাঙালী ব্যবসায়ীরা বেশী আসে। সেই জন্য আমি বাঙালী ব্যবসায়ীদিগকে আমাদের সঙ্গে কারবার করিতে উৎসাহ দিতে লাগিলাম এবং তাহাদিগকে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা দিলাম। আমার মনের ভাব ছিল যে, অবাঙালী ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে বাঙালীদের সঙ্গে যদি আমি কারবার করিতে পারি, তবে আমি অধিকতর নিরাপদ হইতে পারিব। কিন্তু বাঙালীদের সঙ্গে কয়েকটি কারবার করিয়াই আমার এ মোহ দূর হইল।

 “গত তের বৎসরের মধ্যে আমি পাঞ্জাবী মুসলমান, খোজা, হিন্দুস্থানী, বিহারী মুসলমান এবং বাঙালীদের সঙ্গে কারবার করিয়াছি এবং তাহাদের ব্যবসায়ে যোগ্যতা, ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান হইয়াছে। এই জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়াই আমি এখন কারবার করি। আমি দৃষ্টান্ত স্বরূপ, কেবল একটি সম্প্রদায়ের কথা বলিব।

 “পাঞ্জাবী মুসলমান—আমার অভিজ্ঞতায় তাহারা ব্যবসায়ে সাধু, বিশ্বাসী, ছলচাতুরীহীন। তাহারা বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস লাভ করিতে চায়। তাহারা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং মিতব্যয়ী।

 “গত ১৫ বৎসরে আমি পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের নিকট বিশ্বাসের উপর প্রায় এক কোটী টাকার মাল বিক্রয় করিয়াছি। ব্যবস্থা এইরূপ যে, মাল সরবরাহ করিবার ৬০ দিন পরে মূল্য দিতে হইবে। তাহারা সাধারণতঃ ঠিক সময়ে মূল্য দেয়, ইহাই আমার অভিজ্ঞতা। যদি কোন বিশেষ কারণে তাহারা নির্দিষ্ট দিনে মূল্য না দিতে পারে, তবে তাহারা পূর্ব হইতে খবর দেয় এবং আরও সময় চায়। পাঞ্জাবী মুসলমান ব্যবসায়ীর নিকট হইতে বাকী টাকা আদায় করিবার জন্য আমাকে কখন আদালতে যাইতে হয় নাই।

 “তাহারা কখন চুক্তি ভঙ্গ করে না, চুক্তির সর্ত মানিয়া যদি লোকসান হয়, তাহা হইলেও নয়। একবার যে মাল তাহাদের নিকট বিক্রয় করা হয়, উহা খারাপ বলিয়া তাহারা কখন মাল ফেরত দেয় না। তাহারা বরং তজ্জন্য ‘রিবেট’ চাহে এবং আমরাও সন্তুষ্টচিত্তে ‘রিবেট’ দিই।

 “তাহারা ক্বচিৎ চাকরী লইয়া থাকে। যাহারা অত্যন্ত গরীব, তাহারাও চাকরী করা অপেক্ষা রাস্তায় ফিরি করিয়া মাল বিক্রয় করা শ্রেয়ঃ জ্ঞান করে। সাধারণতঃ তাহারা সকাল ৬টার সময় কাজ আরম্ভ করে এবং রাত্রি ১০টা পর্যন্ত কাজ করে। আহারের জন্য তাহারা মধ্যাহ্নে আধ ঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় আধ ঘণ্টা ব্যয় করে। তাহারা মিতাহারী, কখনও বেশী খাইয়া পেট ভর্তি করে না।

 “তাহারা স্বল্পব্যয়ে সাদাসিধা ভাবে জীবন যাপন করে। ২০।৩০ জন একত্রে কোন বাড়ী ভাড়া করে, সেখানে রাত্রিকালে তাহারা শয়ন করে। দৈনন্দিন কাজের জন্য যেখানে থাকে, দিনের আহার সেইখানেই সমাধা করে। আমাদের ন্যায় স্কুল কলেজে তাহারা পড়ে না। যখন কোন বাঙালী ভদ্রলোক ব্যবসা আরম্ভ করে, তখন সে কাজে তাহার কোন যোগ্যতা থাকে না। সে অলস অমিতব্যয়ীর ন্যায় কাজ করে এবং ফলে সমস্ত গুলাইয়া ফেলে, ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়। তাহার মধ্য যুগের জীবন যাপন প্রণালী, অলস প্রকৃতি, শ্রমসাধ্য কর্মে অনিচ্ছা, বাধা বিপত্তি ও কঠোরতা সহ্য করিতে অপ্রবৃত্তি, বাল্যবিবাহ এবং যৌথ পরিবার প্রথা—এই সমস্ত জালে জড়িত হইয়া তাহার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠে। যখনই কোন যুবক কোন ছোট খাট ব্যবসা আরম্ভ করে, তখনই তাহার পরিবারের লোকেরা তাহার নিকট সাহায্য দাবী করিয়া চীৎকার করিতে থাকে। ফলে যুবক ব্যবসায়ী তাহার সমস্ত টাকা, এমন কি মহাজনের টাকা পর্যন্ত খরচ করিয়া ফেলে এবং ব্যবসা বন্ধ করিতে বাধ্য হয়। এ কাহিনী করুণ, বেদনাদায়ক, কিন্তু সত্য।

 “সাফল্য লাভ করিতে হইলে, ব্যবসাবুদ্ধির বিকাশ করিতে হইবে। যুবকদিগকে পরিশ্রমপটু, কঠোরকর্মী, বিশ্বস্ত হইতে হইবে। তাহাদের সাধাসিধা জীবন যাপন করিতে হইবে, পারিবারিক বাধা বিপত্তি হইতে মুক্ত হইতে হইবে। এই সমস্ত তাহার গলায় পাষাণভারের মত ঝুলিয়া থাকে।”

 জনৈক অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক আমাকে জানাইয়াছেন,—“কয়েক বৎসর পূর্বে ঢাকার একজন প্রধান পাটের ব্যবসায়ীকে আমি জিজ্ঞাসা করি, বাঙালীরা কেন পাটের ব্যবসা হইতে বিতাড়িত হইতেছে। তিনি দুইটি কারণ প্রদর্শন করেন—(১) মাড়োয়ারীদের নিম্নতর জীবিকার আদর্শ; (২) নিজেদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে কারবারে মাড়োয়ারীগণ অন্যান্য বিদেশীদের তুলনায় সাধু।” সকল ব্যবসায় সম্পর্কেই এই কথাগুলি খাটে বলিয়া আমার বিশ্বাস।

 শ্রীযুত যোগেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পাঁচ টাকা মাহিনায় রাঁধুনীর কাজে জীবন আরম্ভ করেন। এখন তিনি কলিকাতা বিল্‌ডার্স ষ্টোরস লিমিটেডের ম্যানেজিং এজেণ্ট! তিনি সম্প্রতি এক খানি বাংলা সাময়িক পত্রে “বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে বাঙালীর স্থান” শীর্ষক কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। তিনি যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাহা অতীব শোচনীয়। আমি নিম্নে তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

 ‘৩৫ বৎসর পূর্বে ঘৃত ও চিনির ব্যবসা—প্রধানতঃ বাঙালীদের হাতেই ছিল। বর্তমানে মাড়োয়ারীরা তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে স্থানচ্যুত করিয়াছে। পেঁয়াজের ব্যবসাতেও বাঙালী তাহার স্থান হারাইয়াছে। বোম্বাই, মাদ্রাজ, এবং বিহার প্রদেশ হইতে যে পেঁয়াজ আমদানী হয়, তাহা অবাঙালীদেরই একচেটিয়া; বাংলায় উৎপন্ন পেঁয়াজও অবাঙালীদেরই হস্তগত। ৮।১০ বৎসর পূর্বেও বেলেঘাটায় (কলিকাতা) ১৫। ১৬টি পেঁয়াজের গুদাম ছিল, বর্তমানে ঐ স্থানে মাত্র ৭।৮টি পেঁয়াজের গুদাম আছে। গম বাঙালীর খাদ্য দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া পড়িতেছে। অন্ততঃপক্ষে অবস্থাপন্ন বাঙালীরা উহা খায়। এই গমের ব্যবসা—অবাঙালীদের, প্রধানতঃ মাড়োয়ারীদের, হস্তগত। কলিকাতার অলিগলিতে বৈদ্যুতিক শক্তি পরিচালিত বহু ছোট ছোট আটা ভাঙ্গার কল আছে। ঐ গুলি অশিক্ষিত হিন্দুস্থানীদের। তাহারা প্রথমে হয়ত সামান্য শ্রমিক বা মজুর রূপে কলিকাতায় আসিয়াছিল। ইহা ছাড়া কলিকাতায় তিনটি বড় আটার কল আছে, উহার প্রত্যেকটিতে দৈনিক প্রায় আট শত মণ আটা ভাঙ্গা হয়। এই তিনটির মধ্যে মাত্র একটি কল বাঙালীর। ময়দার ব্যবসাও সম্পূর্ণ রূপে অবাঙালীদের হাতে। এই ময়দা কলিকাতা হইতে বাংলার মফঃস্বলে সর্বত্র চালান হয়। প্রত্যহ বিহার ও যুক্ত প্রদেশ হইতে গাড়ী গাড়ী ডাল আমদানী হইতেছে। এই ব্যবসাও অবাঙালীদের হাতে। কলিকাতায় আহিরীটোলা অঞ্চলে ডালের বড় বড় আড়ত আছে। এগুলিও হিন্দুস্থানীদের হাতে। তৈল বীজের ব্যবসাতেও অবাঙালীদের একচেটিয়া অধিকার। সরিষার তৈল বাঙালীদের একটি প্রধান খাদ্য, অবস্থাপন্ন লোক ছাড়া অন্য লোকে সাধারণতঃ ঘি ব্যবহার করিতে পারে না। বাংলার পাঁচ কোটী অধিবাসীর মধ্যে বোধ হয় দশ লক্ষ লোক ঘি ব্যবহার করিতে পারে। ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই সরিষার তৈল এবং অন্যান্য তেলের কল বাঙালীদের ছিল। এখন এই গুলি অবাঙালীদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। কোচিন, আন্দামান দ্বীপ প্রভৃতি স্থান হইতে প্রায় সওয়া কোটী টাকার নারিকেল তৈল আমদানী হয়। এই নারিকেল তৈলের ব্যবসা গুজরাটী কচ্ছী এবং মেমনদের হাতে।”

 শ্রীযুত মখোপাধ্যায় আরও লিখিয়াছেন:—

 “স্কুল কলেজ ব্যবসাশিক্ষার স্থান নহে। ঐ সব স্থানে অর্থনীতি, হিসাব রাখা ইত্যাদির মূলসূত্রগুলিই কেবল শেখা যাইতে পারে। জগতের সর্বত্র নিম্ন স্তর হইতেই ব্যবসা আরম্ভ করিতে হয় এবং নানা রূপ বাধা বিপত্তি ও নৈরাশ্যের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে হয়। কিন্তু বাঙালীরা অলস ও আয়েসী। তাহারা কোন রূপে কষ্ট করিতে বা ঝুঁকি লইতে অনিচ্ছুক; ফলে অবাঙালীরা তাহাদিগকে সমগ্র কর্মক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত করিতেছে।

 “বাঙালী জাতি যেন পক্ষঘাতগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। কয়েক বৎসর হইল আলুর ব্যবসায়ের খুব প্রসার হইয়াছে। শিলং, দার্জিলিং ও নৈনিতাল হইতে প্রচুর আলু আমদানী হয়, কিন্তু বাঙালী কোন ব্যবসাই বড় আকারে করিতে পারে না। সতরাং আলু আমদানীর ব্যবসা যে মাড়োয়ারী ও হিন্দুস্থানীদের হাতে পড়িবে, ইহা বিচিত্র নহে।”

মধ্যবিত্ত বাঙালী ভদ্রলোকদের মধ্যে বেকার সমস্যা

 শ্রীযযুত রাজশেখর বসু একজন কৃতী বাঙালী। গত পচিশ বৎসর তাঁহারই পরিচালনাধীনে থাকিয়া বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়াছে। আমার অনুরোধে রাজশেখর বাবু মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে বেকার সমস্যার কারণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে নিম্নলিখিত অভিমত জ্ঞাপন করিয়াছেন:—

মধ্যবিত্ত বাঙালী—প্রাচীন ও নবীন

 “একশত বৎসর পূর্বে বাংলার কয়েকটি উচ্চ জাতিই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উহাদের জীবিকা প্রায় বর্তমানের মতই ছিল, যথা—জমিদারী, চাষবাস, জমিদারের চাকরী, কৃষি ও মহাজনী। বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতী ও পুরোহিতগিরি করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিত। বৈদ্যেরা জাত ব্যবসা হিসাবে কবিরাজী করিত। অল্পসংখ্যক লোক সরকারী অথবা ইয়োরোপীয় সওদাগরদের অফিসে কাজ করিত। ব্যবসা বাণিজ্য সাধারণতঃ নিম্নজাতীয় লোকদের হাতেই ছিল। শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের প্রতি ভদ্রলোকদের একটা অবজ্ঞার ভাব ছিল এবং সমাজিক সঙ্কীর্ণতা বশতঃ ভদ্রলোকেরা তাহাদের প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদের কোন খবর রাখিত না। সাধারণ মধ্যবিৎ বাঙালীদের অবস্থা এখনকার চেয়ে ভাল ছিল না। কিন্তু সে তাহার অবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল, কেন না তাহার জীবন যাপন প্রণালী সরল ছিল, অভাবও এত বেশী ছিল না।

 “নূতন শিক্ষাব্যবস্থার আমদানী হওয়াতে, মধ্যবিৎ বাঙালীদের উপার্জনের ক্ষমতা বাড়িয়া গেল। সে এই নূতন ক্ষেত্রে অগ্রদূত, এবং অন্যান্য প্রদেশেও তাহার কাজের খুব চাহিদা হইতে লাগিল। তাহার নবলব্ধ ঐশ্বর্য এবং সহুরে জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে, তাহার জীবিকার আদর্শের পরিবর্তন হইল। তাহার প্রতিবাসীরা এই পরিবর্তন লক্ষ্য করিল এবং তাহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে লাগিল! ‘নিম্নজাতীয়’ লোকেরাও শীঘ্রই আকৃষ্ট হইল এবং নিজেদের পৈতৃক ব্যবসা ত্যাগ করিয়া দলে দলে চাকরীর অন্বেষণে ধাবিত হইল। বর্তমানে যে কেহ ইংরাজী শিখে এবং ভদ্রলোকদের আচার ব্যবহার অনুসরণ করে, সেইই মধ্যবিৎ সম্প্রদায়ভুক্ত বলিয়া গণ্য হয়।

 “দেখা যাইবে, মধ্যবিৎ সম্প্রদায়ের বাঙালীদের জীবিকার ক্ষেত্র এখন তাহাদের পূর্ব পুরুষদের চেয়ে বিস্তৃত। তৎসত্ত্বেও তাহারা কেবল কতক গুলি বিশেষ শ্রেণীর জীবিকাই পছন্দ করে। সাধারণ ভদ্রলোক এমন কাজ করিতে চায় না,—যাহাতে লেখাপড়ার প্রয়োজন হয় না। সে অল্প বেতনের কেরাণীগিরি সাগ্রহে গ্রহণ করিবে অথবা ওকালতী ব্যবসায়ে ভিড় জমাইবে; কিন্তু মুদী, ঠিকাদার অথবা পুরোনো মালের ব্যবসায়ী হইবার কল্পনা সে করিতে পারে না। অশিক্ষিত অথচ ঐশ্বর্যশালী হিন্দুস্থানীদের অবলম্বিত ব্যবসায়ের প্রতি তাহার ঘোর অবজ্ঞা,—কিন্তু সে ঐ সব অশিক্ষিত ব্যবসায়ীদের অধীনেই কেরাণীগিরি করিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করে না। নিতান্ত কষ্টে পড়িলে সে কোন ‘অশিক্ষিতের ব্যবসা’ অবলম্বন করিতে পারে, কিন্তু তখনও সে এমন ব্যবসা বাছিয়া লইবে যাহা অপেক্ষাকৃত নূতন এবং নিম্নজাতীয় লোকদের পৈতৃক ব্যবসা নয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সে মোটর ড্রাইভার, ঘড়ি মেরামতকারী অথবা যান্ত্রিকও হইতে পারে, কিন্তু দর্জী, ছুতার বা কামারের কাজ কখনই করিবে না।

 “ইহার অবশ্য ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু উপরে যাহা বলিলাম, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর পক্ষে তাহা মোটামুটি খাটে। নিম্ন স্তর হইতে লোকের আমদানী হইয়া এই মধ্যবিৎ শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিতেছে এবং প্রতিযোগিতায় ভদ্র জীবনের আদর্শ উচ্চ হইতে উচ্চতর হইতেছে। এই শ্রেণীর লোক মাত্র কতকগুলি জীবিকা পছন্দ করে, কিন্তু তাহাতে সকলের স্থান সঙ্কুলান হইতে পারে না। সেকালে এক এক জন উপার্জনশীল ব্যক্তি বহু দরিদ্র ও বেকার আত্মীয়দের ভরণপোষণ করিতেন। কিন্তু জীবিকার আদর্শ বাড়িয়া যাওয়াতে উপার্জনশীল ব্যক্তিদের নিজেদের কথাই বেশী চিন্তা করিতে হয়। দরিদ্র আত্মীয়দের কথা তাঁহারা ভাবিতে পারেন না। ফলে যৌথ পরিবার প্রথা ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, এবং যৌথ পরিবারভুক্ত বহু ব্যক্তি অলস জীবন যাপন অসম্ভব দেখিয়া কাজ খুঁজিতে বাধ্য হইতেছে।

বর্তমান বেকার অবস্থার কারণ

 “প্রধান কারণ গুলি এই ভাবে বিভক্ত করা যাইতে পারে:—

 (১) মধ্যবিৎ শ্রেণীর লোকদের বিশেষ কতকগুলি জীবিকার প্রতি আসক্তি; যথা, (ক) ডাক্তারী, ওকালতী, প্রভৃতি ‘বিদ্বৎ ব্যবসা’; (খ) যে সব কাজে স্কুল কলেজের শিক্ষা প্রয়োজনীয়; (গ) যে সব কাজের সঙ্গে নিম্ন জাতির নাম জড়িত নহে।

 (২) নূতন বৃত্তি শিখিবার সুযোগের অভাব,—নূতন জীবিকার অভাব।

 (৩) ব্যবসায়ীদের সহিত সংস্পর্শ না থাকার দরুণ ব্যবসা বাণিজ্যে অজ্ঞতা।

 (৪) যৌথ পরিবার প্রথা ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় বহু বেকার লোকের সৃষ্টি।

 (৫) নিম্ন স্তর হইতে বহু লোক আমদানী হইয়া মধ্যবিৎ শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে; এই সব নূতন লোকের মনোবৃত্তি ভদ্রলোকদেরই মত।

 (৬) বিদেশী এবং ভারতের ভিন্ন প্রদেশ হইতে আগত লোকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। উহারা চরিত্র ও অভ্যাসের গুণে, বাঙালীদের চেয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে বেশী যোগ্যতা প্রদর্শন করে।

প্রতিকারের উপায়

 “এইরূপে প্রায়ই বলা হইয়া থাকে যে, গবর্ণমেণ্ট বা বিশ্ববিদ্যালয় যদি ব্যাপক ভাবে বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, তাহা হইলেই এই বেকার সমস্যার সমাধান হইতে পারে। ‘বিদ্বৎ ব্যবসা’ (ওকালতী, ডাক্তারী প্রভৃতি) শিখাইবার সুবন্দোবস্ত আছে। বাঙালীদের মধ্যে আইন শিক্ষা বরং অতিরিক্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু ডাক্তারী ও ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষার এখনও অবসর আছে। কিন্তু এই সব বৃত্তি কেবল স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষিতদেরই যোগ্য। যাহাদের যোগ্যতা মধ্যম রকমের, তাহাদের জন্য হিসাব রাখা, স্টেনোগ্রাফী ও কেরাণীর কাজ শিখাইবার কয়েকটি স্কুল আছে। কৃষি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, জরীপ বিদ্যা, অঙ্কন বিদ্যা, মোটর গাড়ীর ড্রাইভারী ও মেরামতের কাজ, টেলিগ্রাফ সিগন্যালিং, তাঁতের কাজ, চামড়ার কাজ এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য বৃত্তি শিখাইবার জন্যও কয়েকটি স্কুল আছে। এই সব স্কুল ভাল কাজ করিতেছে এবং এইগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে কার্যকরী শিক্ষা দান করিবারও প্রস্তাব হইয়াছে। কিন্তু যে সব বিষয় শিখাইবার প্রস্তাব সাধারণতঃ করা হয়, তাহার মধ্যে বৈচিত্র্য নাই, যথা,—ছুতারের কাজ, প্রাথমিক যন্ত্রবিদ্যা এবং বড় জোর সূতা কাটা ও বুননের কাজ। অবশ্য, এ সব বিষয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না,—ছেলেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কর্মকুশলতা শিখানোই যদি ইহার উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু ছেলেরা এই শিক্ষার ফলে সাধারণ শ্রমশিল্পীর জীবিকা গ্রহণ করিবে, ইহা যদি কেহ আশা করেন, তাহা হইলে তিনি ‘ভদ্রলোকদের’ প্রকৃতি জানেন না। কেহ কেহ বলেন যে, আধুনিক যুগের শিল্পাদি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা দিবার জন্য কলেজের সঙ্গে টেকনোলজিক্যাল ক্লাস খুলিতে হইবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এদেশে এখনও শিল্প কারখানা প্রভৃতি বেশী গড়িয়া উঠে নাই। সতরাং এরূপ লোকের চাহিদা খুবই কম। ছাত্রেরা কলেজে ‘বৈজ্ঞানিক শিক্ষা’ সমাপ্ত করিয়া নিজেরা শিল্প কারখানা প্রভৃতি খুলিবে, এরূপ আশা করা ভ্রম। কলেজের ক্লাসে শিক্ষা লাভের দ্বারা ব্যবসা গড়িয়া তোলা যায় না। কয়েকজন উৎসাহী ও উদ্যোগী ছাত্র এই ভাবে শিক্ষা লাভ করিয়া ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ স্থলে নবশিক্ষিত শিল্পবিৎ (টেকনোলজিষ্ট) যথাযোগ্য সমর্থন না পাইয়া ব্যবসায়ে নামিলে, উহাতে সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না।

 “সুতরাং এখন কর্তব্য কি? ভবিষ্যতের আশায়, ছেলেদের শিল্প, কার্যকরী বৃত্তি প্রভৃতি শিক্ষা দিবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হোক, আপত্তির কারণ নাই। কিন্তু বর্তমান বংশীয়েরা যেন এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ না করে যে, ‘টেকনিক্যাল’ শিক্ষার দ্বারাই সকল সমস্যার সমাধান হইবে, যেমন তাহাদের পূর্বগামীরা মনে করিত যে, সাধারণ স্কুল ও কলেজে শিক্ষালাভই জীবিকা সংস্থানের নিশ্চিত উপায়। যুবকদের বুঝা উচিত যে, পণ্য উৎপাদনের উপায় জানা ভাল বটে, কিন্তু পণ্য বিক্রয় করিতে জানাই অনেক স্থলে বেশী লাভজনক। বাংলার বাহির হইতে যে হাজার হাজার লোক আমদানী হইয়াছে, তাহাদের কার্যকলাপের প্রতি মধ্যবিৎ বাঙালীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এই সব লোকের স্বাভাবিক ব্যবসাবুদ্ধি ও সাহস ছাড়া অন্য কোন মূলধন নাই এবং ইহারই বলে তাহারা বাংলার সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত আক্রমণ করিয়াছে এবং এদেশের অন্তর্বাণিজ্য হস্তগত করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেছে।

 “বিদ্বৎব্যবসা ও কেরাণীগিরির প্রতি ভদ্রলোকদের অস্বাভাবিক মোহ ঘুচাইতে হইবে। তাহাদিগকে ব্যবসার সর্বপ্রকার রহস্য শিখাইতে হইবে। কোন একটা অজ্ঞাত জীবিকার সম্বন্ধে যে ভয় ও ঘৃণার ভাব, ভদ্র যুবকদের মন হইতে যখন তাহা দূর হইবে, তখন তাহারা দেশের বিশাল ব্যবসাক্ষেত্রে নিজেদের স্থান করিয়া লইতে পারিবে। যে খুচরা দোকানী অথবা ঠিকাদার হইতে পারে, শিল্পী ও মজুরদের খাটাইতে পারে, বড় ব্যবসায়ী ও খুচরা দোকানদারের মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী হইতে পারে, সে ছোট দোকানদাররূপে কাজ আরম্ভ করিয়া নিজের অধ্যবসায় বলে বড় ব্যবসায়ী হইতে পারে। মিঠাইওয়ালা বা মুদীর ব্যবসায়ের মত ক্ষুদ্র কাজও পরিত্যাগ করা তাহার পক্ষে উচিত নহে। তাহার শিক্ষা ও মার্জিত রুচি কাজে খাটাইয়া সে তাহার গ্রাহকদের অধিকতর সন্তুষ্ট করিতে পারে, তাহার ক্ষুদ্র দোকানই সকলের নিকট আকর্ষণের বস্তু হইয়া উঠিতে পারে।

 “এইরূপে মনোবৃত্তি তাড়াতাড়ি সৃষ্টি করা যায় না। সংস্কারের বাধা অতিক্রম করিয়া মধ্যবিৎ শ্রেণীদের ব্যবসা বাণিজ্য শিখাইতে একটু সময় লাগিবে। ট্রেনিং ক্লাস কোন ব্যবসায়ের প্রাথমিক সূত্রগুলি শিখাইতে পারে মাত্র। কিন্তু যাহারা ব্যবসায়ে নিযুক্ত আছে, তাহাদের সঙ্গে কাজ করিয়াই কেবল ব্যবসায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভবপর। অধিকাংশ ব্যবসায়ের জন্য স্কুলে শিক্ষা লাভ করা যায় না। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি সীমাবদ্ধ, তাহাদের নিকট বেশী আশা করা অনুচিত। পারিবারিক আবহাওয়া এমন ভাবে বদলাইতে হইবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর প্রতি অতিরিক্ত মোহ যেন না থাকে। যুবকরা এখন বুঝিতে পারিয়াছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী জীবন সংগ্রামে বেশী কিছু সাহায্য করিতে পারে না। তবুও তাহারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সে কেবল উপায়ান্তর রহিত হইয়া,—বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া ছাড়িলেই তাহাদিগকে কোন একটা জীবিকার উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, এই আশঙ্কায়। বাছা বাছা মেধাবী ছাত্রদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীগুলি থাকুক। সাধারণ যুবকেরা নিজেদের শক্তি ও পিতামাতার অর্থ লক্ষ্যহীন কলেজী শিক্ষায় অপব্যয় না করিয়া, ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করিবার পর কোন ব্যবসায়ীর অধীনে কয়েক বৎসর শিক্ষানবিশী করিলে অনেক বেশী লাভবান হইবে।”

 শ্রীতে বসরে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা হইতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির অস্বাভাবিক মোহ সম্বন্ধে তিনি যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহা বিশেষরূপে অনুধাবনযোগ্য। আমাদের যুবকেরা ঘটনাস্রোতে যেন লক্ষ্যহীন ভাবে ভাসিয়া চলিয়াছে এবং একবারও চিন্তা করে না কি আত্মহত্যাকর নীতি তাহারা অনুসরণ করিতেছে। এজন্য তাহাদের অভিভাবকরাই বেশী দায়ী।

 আমাদের যুবকেরা বি. এ. বা বি. এসসি. পাশ করিলেই এম. এ. বা এম. এস-সি পড়িতে আরম্ভ করে, কঠোর সংগ্রামের সম্মুখীন হইবার বিপদ যতদিন পারে, এড়াইবার জন্য। তাহারা ভুলিয়া যায় যে, এই উচ্চ শিক্ষার যত উচ্চতর ধাপে তাহারা উঠিবে, জীবন সংগ্রামে ততই তাহারা বেশী অপটু ও অসহায় হইবে।

 হ্যাজলিট The Ignorance of the Learned—(বিদ্বান্‌দের অজ্ঞতা) শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলিয়াছিলেন,—“যাহারা ক্লাসিক্যাল এডুকেশান (উচ্চ শিক্ষা) সমাপ্ত করিয়াও নির্বোধ হয় নাই, তাহারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করিতে পারে। পণ্ডিত ব্যক্তি জীবনের বাস্তব কার্যক্ষেত্রে নামিয়া চারিদিকে নানা বাধা ও অসুবিধা অনুভব করে।”

 এইরূপে হতভাগ্য ডিগ্রীধারীরা নিজেদের যেন অজ্ঞাত দেশে অসহায় শিশুর মত বোধ করে।

 আমি পূর্বে বলিয়াছি যে, যাহারা জানার্জনে সত্যকার প্রেরণা বোধ করে, কেবল তাহাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা উচিত।

 কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এস-সি. পরীক্ষা শেষ হইয়াছে (৯ই আগষ্ট, ১৯৩২)। রসায়ন শাস্ত্রে ২১ জন, পদার্থবিজ্ঞানে ১৭ জন, বিশুদ্ধ গণিতে ৩৮ এবং ব্যবহারিক গণিতে ৩৫ জন পরীক্ষা দিতে গিয়াছিল। তন্মধ্যে রসায়নে ১১ জন দুই একদিন পরীক্ষা দিয়াই চলিয়া আসিয়াছে, পদার্থবিজ্ঞানেও ১০ জন ঐরূপ করিয়াছে; বিশুদ্ধ গণিতে ৯ জন চলিয়া আসিয়াছে এবং ব্যবহারিক গণিতে ১১ জন (তাহারা সকলেই নিয়মিত ছাত্র) প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের পর আর পরীক্ষা দেয় নাই। মোট ১১১ জনের ৪০ জন শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেয় নাই। স্মরণ রাখিতে হইবে কলিকাতায় থাকিয়া একজন এম. এস-সি. ছাত্রের পড়িবার ব্যয় মাসিক ৪০ হইতে ৫০ টাকার কম নহে। সুতরাং দুই বৎসর কাল প্রত্যেক ছাত্রের অভিভাবকের গড়ে এক হাজার টাকা লাগিয়াছে এবং পূর্বোক্ত ৪০ জন ছাত্র মোট ৪০ হাজার টাকা অপব্যয় করিয়াছে। কিন্তু এই নগদ টাকার অপব্যয়েই দুঃখের শেষ নহে। জাতির মনুষ্যত্ব যে ভাবে এই দিকে ক্ষয় হইতেছে, তাহা সত্যই ভয়াবহ।[২৯]

 তারপর এখনও বাঙালী ছাত্রেরা বিদেশে, বিশেষতঃ জার্মানী ও আমেরিকায় যায়, তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ও ডিপ্লোমার মোহে। তাহারা এজন্য নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দেয়, এমন কি বিবাহের বাজারে সর্বোচ্চ দরে নিজেকে নীলাম করিতেও সে লজ্জিত হয় না। কিন্তু দেশে ফিরিয়া সে চারিদিকে অকুল পাথার দেখে। সে ঝোঁকের মাথায় কখন কখন দুঃসাহসিক অভিযান করিতে পারে যথা, সে শ্রমিকদের দোভাষী হইয়া যাইতে পারে, অথবা হংকংএ সৈন্য বিভাগের ডাক্তার কিম্বা কোন সমুদ্রগামী জাহাজের ডাক্তার হইয়া যাইতে পারে। কিন্তু শীঘ্রই বাড়ীর জন্য তাহার মন আকুল হইয়া উঠে। পক্ষান্তরে গুজরাটী, কচ্ছী, সিন্ধীরা, অশিক্ষিত হইলেও সিঙ্গাপুর, হংকং, কিওটো, ইয়োকোহামা, হনলুলু, সান ফ্রান্সিসকো, কোনিয়া, মিশর ও পারিতে থাকিয়া ব্যবসায়ীরূপে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।

 পরিশেষে আমি পুনর্বার বলিতেছি যে, বাঙালী দুর্ভাগ্যক্রমে বড় বেশী আদর্শবাদী হইয়া পড়িয়াছে, ব্যবহারিক জ্ঞান তাহার অত্যন্ত কম। এই বৈজ্ঞানিক যুগে দ্রুত যাতায়াতের সুবিধা হওয়াতে, সে ইয়োরোপীয় ও চীনাদের সংস্পর্শে আসিয়াছে; মাড়োয়ারী, গুজরাটী, বোরা, পার্শী, হিন্দুস্থানী, পাঞ্জাবী, উড়িয়া, কচ্ছী, সিন্ধী প্রভৃতি অ-বাঙালীদের সঙ্গেও তাহার ঘনিষ্ট পরিচয় হইয়াছে। কিন্তু জীবনের প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে সে প্রতিযোগিতায় হঠিয়া যাইতেছে। তাহার পাচক, ভৃত্য, ফিরিওয়ালা, কুলী, ক্ষেতের মজুর, জুতা-নির্মাতা, মুচী, ধোবা, নাপিত এ সমস্তই বাংলার বাহির হইতে আমদানী হইতেছে। দেশের অন্তর্বাণিজ্য, তথা বিদেশের সঙ্গে আমদানী রপ্তানীর ব্যবসা-সমস্তই তাহার হাত হইতে চলিয়া যাইতেছে। এক কথায়, অন্নসংস্থানের ব্যাপারে, বাঙালী তাহার নিজের বাসভূমিতে অসহায় হইয়া পড়িয়াছে। ২২ লক্ষ অ-বাঙালী প্রতি বৎসর বিপুল অর্থ—১২০ কোটী হইতে ১৫০ কোটী টাকা—বাংলা হইতে উপার্জন করিয়া লইয়া যাইতেছে। আর বাঙালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বস্তু বলিয়া মনে করিতেছে, এবং এই ডিগ্রী না পাইলে নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করিতেছে। সে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি চিরদিনই বিরূপ। ইহাকে সে ছোট কাজ বলিয়া মনে করে। সুতরাং অনাহারক্লিষ্ট ডিগ্রীধারীর দল যে বাজার ছাইয়া ফেলিবে, তাহা আর আশ্চর্য কি? খবরের কাগজে যখনই কোন ৫০ হইতে ১০০ শত টাকা মাসিক বেতনের কর্মখালির বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তখনই শত শত দরখাস্ত পড়িতে থাকে। যদি বেতন মাসিক ১৫০ শত টাকা বা বেশী হয় তবে দরখাস্তের সংখ্যা হাজার হাজার হয়। গত ২৫ বৎসর ধরিয়া এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়া আমি মনে গভীর বেদনা বোধ করিতেছি। বস্তুতঃ, আর্থিক ক্ষেত্রে বাঙালীর ব্যর্থতার বিষয়ে চিন্তা ও আলোচনা করা আমার একটা প্রধান কাজের মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। এই কারণেই স্বজাতির এই দৌর্বল্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আমি সকলকে সচেতন করিবার চেষ্টা করিতেছি।

 বাংলার দুর্ভাগ্য এই যে, সে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের সর্বত্রই নিজেকে পরাস্ত হইতে দিয়াছে। কয়েক জন আইনজ্ঞ এবং উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরিয়া ব্যতীত তাহার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, অর্দ্ধাহারক্লিষ্ট স্বল্পবেতনের কেরাণী ও স্কুল মাষ্টারে পরিণত হইয়াছে। আর তাহার দৌর্বল্য ও অক্ষমতার সুযোগ লইয়া, শক্তিশালী, উৎসাহী অ-বাঙালী ব্যবসায়ীরা সমস্ত ধনাগমের পথ দখল করিয়াছে। বিদেশী বা অ-বাঙালীর নিকট বাংলা দেশ অর্থোপার্জনের একটা বিশাল ক্ষেত্র, তাহারা এখানে প্রচুর উপার্জন করে। আর বাঙালীরা এখানে সেখানে এক মুঠা অন্নের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করিয়া বেড়াইতেছে।

 দেশের রপ্তানী ও আমদানী বাণিজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে এমন কি অন্তর্বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিতে না পারিয়া বাঙালীর চরিত্রের অধোগতিও হইতেছে। একজন স্বাবলম্বী ব্যবসায়ীর চরিত্রের সমস্ত দিক আশ্চর্যরূপে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। তাহার কর্মক্ষমতা ও শাসন শক্তি বাড়িয়া যায়। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে তাহার চরিত্রের অল্প বিস্তর সাদৃশ্য আছে। কিন্তু একজন আইনজীবী, কেরাণী অথবা স্কুল মাষ্টার, নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই কৃতী হউক,—যখনই নিজের এলাকার বাহিরের কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখনই সে ঘোর অজ্ঞতার পরিচয় প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে সে একেবারে শিশুর মত সরল ও অজ্ঞ। তাহার দৃষ্টিও অতি সঙ্কীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। এক কথায় নিজের সংঙ্কীর্ণ সীমার বাহিরে আসিলেই তাহার অবস্থা শোচনীয় হয়। কয়েক বৎসর ভারতীয় ব্যবস্থাপরিষদে বাংলার প্রতিনিধিরা একেবারে নগণ্য হইয়া পড়িয়াছেন,—নিরপেক্ষ দর্শকদের এই মত। অর্থনীতি বিষয়ে কোন আলোচনা উপস্থিত হইলেই বাংলার প্রতিনিধিরা চাণক্যের উপদেশ স্মরণ করিয়া নীরব থাকাই শ্রেয়ঃ জ্ঞান করে—“দূরতো শোভতে মূর্খঃ যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে।”

 দালাল, পুরুষোত্তম দাস ঠাকুর দাস, কল্যাণজী নারায়ণজী, বালচাঁদ হীরাচাঁদ, ডেভিড সেসুন, বিড়লা অথবা খৈতান প্রভৃতি ব্যবসা জগৎ অথবা টাকার বাজারের সংস্পর্শে থাকাতে, জটিল অর্থনীতি বিষয়ে মতামত জ্ঞাপনে স্বভাবতই বেশী যোগ্যতা প্রদর্শন করেন। আমাদের কলেজের অর্থনীতির বাঙালী অধ্যাপক কেবল পাখিপড়া পণ্ডিত, ব্যবহারিক জ্ঞান তাহার কম। এক জন কলেজে শিক্ষিত ব্যক্তি “রিভার্স কাউন্সিল বিল” সম্বন্ধে সঠিক মত দিতে পারে না।—তা ছাড়া, একজন ধনী ব্যবসায়ীর পক্ষে সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষ স্বাধীন মত ব্যক্ত করা সহজ। উপরওয়ালাদের ভ্রূকুটী বা অনুগ্রহে সে বিচলিত হয় না। সে দুই কুল বজায় রাখিবার চেষ্টা করে না, বা সময় বুঝিয়া নিজের মত পরিবর্তন করে না। পক্ষান্তরে কেরাণী, চাকরীজীবী এবং অনুগ্রহপ্রার্থীর দল স্বভাবতই দাস মনোবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়। তোষামোদ এবং পরনিন্দাতে সে পাকা হইয়া ওঠে, তাহার চরিত্রের অধোগতি হয়।

 অদ্ভূত বোধ হইলেও, একথা সত্য যে, বাঙালী সাহিত্য ও বিজ্ঞানে যতই মৌলিক গবেষণা করিতেছে, ততই জীবিকা সংগ্রহে সে অক্ষমতা প্রদর্শন করিতেছে। কেহ তাহাকে শিক্ষানবিশ রূপে লইতেও সাহস পায় না, কেননা সে বড় বড় কথা বলে। সে নিজেও নিম্ন স্তর হইতে শিক্ষানবিশী আরম্ভ করিতে অনিচ্ছুক। সাধারণ কলেজে শিক্ষিত যুবক মনে করে যে, ব্যবসায়ী হইতে হইলে তাহার সেক্রেটেরিয়েট টেবিল, বৈদ্যুতিক পাখা এবং মোটর গাড়ী চাই। সে আশা করে প্রথম হইতেই তাহার জন্য সর্বপ্রকার আরাম ও সুবিধা প্রস্তুত হইয়া থাকিবে, ফলে শেষ পর্যন্ত সে স্বল্পবেতনের কেরাণী জীবন যাপন করিতে বাধ্য হয় অথবা আত্মহত্যা করিয়া সমস্ত সমস্যার মীমাংসা করে।

  1. J. C. Sinha-Economic Annals.
  2. Stewart’s History of Bengal, (১৮১৩)—পরিশিষ্ট।
     “আর্মাণীরা অতি প্রাচীন কাল হইতেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করিত। তাহারা তাহাদের দূরবর্তী তুষারাচ্ছন্ন পার্বত্য দেশ হইতে বাণিজ্যের লোভেই ভারতে আসিয়াছিল। ভারত হইতে তাহারা মসলা, মসলিন এবং মূল্যবান রত্নাদি লইয়া ইয়োরোপে বাণিজ্য করিত। ইয়োরোপীয় বণিক, ভ্রমণকারী এবং ভাগ্যান্বেষীদের আগমনের পূর্ব হইতেই আর্মাণীরা ভারতের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছিল।”—
    Indian Historical Records Commission, Vol. iii, p. 198.
  3. “সমুদ্র বাণিজ্যের দুইটি বিভাগ ব্যতীত অন্য সমস্ত বিভাগে ইয়োরোপীয়েরা বাঙালীদিগকে স্থানচ্যুত করিয়াছিল। এই দুইটি বিভাগ মালদ্বীপ ও আসাম। ইহার কারণ, মালদ্বীপের জলবায়ু, অস্বাস্থ্যকর এবং আসামে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য খুব বেশী ছিল।” A Raynal: A Philosophical and Political History of the settlements and Trade of the Europeans in the East and West India, vol. i, p. 144 (Ed-Lond. 1783).
  4. Sinha-Early European Banking in India.
  5. কোজা ওয়াজিদ আর্মানী ছিলেন না। ঐ বইয়েরই ৩০৪ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে—“নবাব মূর বণিক (মুসলমান) কোজা ওয়াজিদকে তাঁহার এজেণ্ট নিযুক্ত করিয়াছিলেন।”
  6. বড় বাজারে ‘মনোহর দাসের চক’ খুব সম্ভব ইঁহারই নাম হইতে হইয়াছে।
  7. “প্রাপ্ত বিবরণ হইতে বুঝা যায়, রংপুরে থাকিবার সময়েই রামমোহন বন্ধুবর্গদের সঙ্গে মিলিত হইয়া ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন,—পৌত্তলিকতা তাঁহাদের বিশেষ আলোচ্য বিষয় ছিল। রংপর তখন জনবহুল সহর এবং একটি ব্যবসা কেন্দ্র ছিল—বহু, জৈন ধর্মাবলম্বী মাড়োয়ারী বণিক এখানে থাকিতেন; এই সব মাড়োয়ারীদের মধ্যে কেহ কেহ রামমোহনের সভায় যোগ দিতেন। মিঃ লিওনার্ড বলেন যে, তাঁহাদের জন্য রামমোহনকে ‘কল্পসূত্র’ ও অন্যান্য জৈন্য ধর্মের গ্রন্থ পড়িতে হইয়াছিল।”— Life and Letters of Ram Mohan Ray, London (1900) by Miss Collet.
  8. গেট সাহেবের “আসাম” গ্রন্থে আছে, “১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে আমরা দেখিতে পাই অধ্যবসায়ী মাড়োয়ারী বণিকেরা আসামে তাঁহাদের ব্যবসায় চালাইতেছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ সদিয়া পর্যন্ত যাইয়াও কারবার করিতেন। এই সময়ে গোয়ালপাড়া হইতে কলিকাতা আসিতে ২৫/৩০ দিন লাগিত এবং কলিকাতা হইতে গোয়ালপাড়া যাইতে ৮০ দিনেরও বেশী লাগিত।”
  9. কালিম্পংকে তিব্বতের “অন্তর্বন্দর” বলা হয়, কেননা তিব্বতের সমস্ত আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্য এই স্থানের ভিতর দিয়াই হয়। কালিম্পং এ অবশ্য কয়েকজন বাঙালী আছেন, কিন্তু তাঁহারা সকলেই সরকারী অফিসার, কেরাণী প্রভৃতি।
  10. মুসলমান চামড়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অধিকাংশ অবাঙালী মুসলমান।
  11. “রেঙ্গুন ও কলিকাতায় সুপারি রপ্তানীর ব্যবসা সমস্তই বর্মী, চীনা এবং বোম্বাইয়ের ব্যবসায়ীদের হাতে। তাহাদের সকলেরই এজেণ্ট পাতারহাটে আছে এবং তাহাদের বেতন মাসিক হাজার টাকা হইতে তদূর্দ্ধ। তাহারা সপরিবারে বাস করে এবং রপ্তানীর মরসুমে স্থানটি বর্মা সহরের মত বোধ হয়। ষ্টীমার ঘাটের অনতিদূরে এই সব ব্যবসায়ীদের এলাকা। সেখানে শত শত মণ সুপারি প্রত্যহ শুকানো হইতেছে এবং বস্তাবন্দী করিয়া রপ্তানীর জন্য প্রস্তুত করা হইতেছে। পূর্ব বঙ্গে পাটের ব্যবসায়ের ন্যায় এই সুপারির ব্যবসায়ও একটি প্রধান ব্যবসায়, কেননা ইহাতে বৎসরে প্রায় ৩০/ ৪০ লক্ষ টাকার কারবার হয়। কিন্তু কৃষকদের দুর্ভাগ্য ক্রমে এই ব্যবসায়ের সমস্ত লাভই মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের হাতেই যায়।”— The Bengal Co-operative Journal No. 3, January, 1927.
     লেখক সুপারি ব্যবসায়ের মূল্য কম করিয়া বলিয়াছেন। জ্যাক তাঁহার “বাখরগঞ্জ” গ্রন্থে এই ব্যবসায়ের মূল্য ৭৫ লক্ষ টাকা হিসাব করিয়াছেন।
     বাঙালীদের ঔদাসীন্য ও অক্ষমতার প্রসঙ্গে শিমুগার(মহীশূরের) আরাধ্য লিঙ্গায়েতদের কর্ম তৎপরতার উল্লেখ করা যাইতে পারে। সম্প্রতি আমি ভদ্রাবতী (শিমুগার একটি তালুক) লোহার কারখানা পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলাম।
     আমি দেখিলাম, যদিও লিঙ্গায়েতরা সামাজিক মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, তথাপি তাহারা শস্য চালানী ও সুপারির ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেছে।
  12. ১৯২৮—২৯ সালে তামাকের ফসল খুব ভাল হইয়াছিল; প্রায় ১,৯০,০০০ একর জমিতে তামাকের চাষ হয়। প্রতি একরে ১২ ১/৪ মণ হিসাবে মোট ২৩,২৭,৫০০ মণ তামাক হয়। বাজার দর প্রায় ২০ টাকা মণ ছিল। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে এই হার বেশী। সেই জন্যই ঐ বৎসর মোট উৎপন্ন তামাকের মূল্য প্রায় ৪ কোটী ৬৫ লক্ষ টাকায় দাঁড়াইয়াছিল, অর্থাৎ গত পাঁচ বৎসরের গড় হিসাবে অন্যান্য বৎসরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশী। পাটের ন্যার এই তামাকের চাষও বাজার চলতি দরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  13. কলিকাতা হইতে বর্মায় যাহারা তামাক (কাঁচা) চালান দেয়, তাহাদের মধ্যে কয়েকজন প্রধান প্রধান ব্যবসায়ীর নাম:—
    মেসার্স এইচ. থাই অ্যাণ্ড কোং, ২নং আমড়াতলা স্ট্রীট, কলিকাতা।
    মেসার্স এইচ. টি. এম. এইচ. তায়ুব অ্যাণ্ড কোং, ১২নং আমড়াতলা স্ট্রীট, কলিকাতা।
    মেসার্স এইচ. ই. এন. মহম্মদ অ্যাণ্ড কোং, ১৯নং জ্যাকেরিয়া স্ট্রীট, কলিকাতা।
    মেসার্স এন. জে. চাঁদ, ২৩নং আমড়াতলা স্ট্রীট, কলিকাতা।
    মেসার্স এ. ডি. ব্রাদার্স, ১৪৬নং লোয়ার চীৎপুর রোড, কলিকাতা।
     “রংপুর জেলার কোতোয়ালী থানার কাবারু গ্রামের জমিরুদ্দীন নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে কমিটির সাক্ষাৎ হয়। জমিরুদ্দীন নিজে ১৮ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করে এবং তামাক ব্যবসায়ে সে একজন বড় রকমের দালাল। এই সব দালালের মারফত ব্যবসায়ীরা তামাক পাতা ক্রয় করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে—প্রধানতঃ আকিয়াব, মৌলামিন ও রেঙ্গুন হইতে ব্যবসারীরা আসে। ঐ অঞ্চলে প্রায় ৫০০ দালাল আছে এবং জমিরুদ্দীন তাহাদের মধ্যে ক্ষুদ্র একজন দালাল। কিন্তু সে-ই বৎসরে প্রায় ৫০ হাজার টাকার তামাকের কারবার করে।— Report of the Bengal Provincial Banking Enquiry Committee.-1929-30. আমি নিজে অনুসন্ধান করিয়াও জানিতে পারিয়াছি। জমিরুদ্দীনের মত অসংখ্য দালাল আছে। তাহারা সাধারণ গ্রাজুয়েটদের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশী উপার্জন করে। এবং সামান্য চাকরীর লোভে বাড়ী ছাড়িয়া তাহাদের বিদেশে যাইতে হয় না।
  14. দৃষ্টান্ত স্বরূপ শ্রীযুত জগমল রাজার নাম করা যায়। ইনি কচ্ছদেশবাসী, এবং বালী ব্রিজের ঠিকাদারী লইয়াছিলেন। কয়েকটি কয়লার খনির কয়লা তুলিবার ঠিকাদারীও ইনি লইয়াছেন। শ্রীযুত রাজা এলাহাবাদের একজন বড় ব্যবসায়ী। সেখানে তাঁহার একটি কাচের কারখানা আছে। আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুসারে যে ব্যক্তি অর্দ্ধশিক্ষিত বলিলেও হয়, তিনি একাকী ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত এতগুলি বিভিন্ন রকমের ব্যবসা কিরূপে পরিচালনা করেন, তাহা সাধারণ উপাধিমোহগ্রস্ত বাঙালীর নিকট দুর্বোধ্য প্রহেলিকা মনে হইতে পারে।
  15. ১৯২৮ সালে বাংলার ৭।৮টি জেলা দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হইয়াছিল, যথা—বর্দ্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, দিনাজপুরের কিয়দংশ, মুর্শিদাবাদ এবং যশোর ও খুলনার কিয়দংশ। ১৯৩০-৩১ সালে ব্যবসায়ে মন্দা এবং পাটের মূল্য হ্রাসের জন্য বাংলার কৃষকদের শোচনীয় দুর্দশা হইয়াছিল।
  16. কলিকাতায় পূর্বে হিন্দু ছুতার মিস্ত্রীদেরই প্রাধান্য ছিল, কিন্তু আধুনিক কালে মিস্ত্রীদের ছেলেরা স্ব-ব্যবসারে প্রবেশ করিতে অনিচ্ছুক এবং কেরাণীর কাজ পাইবার জন্য ব্যগ্র হওয়াতে, হিন্দু মিস্ত্রীদের স্থান চীনা ও এদেশীর মুসলমান মিস্ত্রীরা দখল করিতেছে।... ভারতীয় মিস্ত্রীদের প্রধান দোষ, তাহারা সঠিক মাপজোঁক করিতে অনিচ্ছুক, যন্ত্রপাতি ভাল আছে কি না, তাহা দেখে না এবং তাহাদের সময়-জ্ঞানের অত্যন্ত অভাব। এ দেশের প্রচলিত প্রবাদেও ছুতার মিস্ত্রীদের এই সময়-জ্ঞানের অভাবের প্রতি কটাক্ষ আছে।—Cumming: Review of the Industrial Position and Prospects of Bengal in 1908, p. 16.
  17. বাংলায় ‘গন্ধবণিক’ শব্দের অর্থ মশলা ব্যবসায়ী—এ পর্যন্ত এ ব্যবসা তাহাদেরই একচেটিয়া ছিল।
     আমি নিম্নে কয়েকজন প্রসিদ্ধ মশলা ব্যবসায়ীর নাম করিতেছি:—আর্মেনিয়ান স্ট্রীট—রামচন্দ্র রামরিচ পাল, জানকীদাস জগন্নাথ, রাউথমল কানাইয়ালাল। আমড়াতলা স্ট্রীট—রতনজী জীবনদাস, রামলাল হনুমান দাস, গোপীরাম যুগলকিশোর, শুকদেও জহরমল, এন. জগতচাঁদ, জগন্নাথ মতিলাল, যশোরাম হীরানন্দ, সুরজমল সতুলাল, তার মহম্মদ জালু, দৌজী দাদাভাই হোসেন কাসেম দাদা, হাজী আলি মহম্মদ আলি শা মহম্মদ, মতিচাঁদ দেওকরন। সতেরাং দেখা যাইতেছে যে, বাঙালী তাহার বংশান, ক্রমিক ব্যবসা হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছে।
  18. বিড়ি ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা ইহা হইতেই বুঝা যাইবে যে, ১৯২৮—২৯ সালে প্রায় দুই কোটী টাকা মূল্যের বিদেশী সিগারেট আমদানী হইয়াছিল। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে সিগারেটের পরিবর্তে লোকে বিড়ি ব্যবহার করাতে, বিড়ি ব্যবসায়ে খুব লাভ হইতেছে। কাঁচা মাল সরবরাহের ব্যবসাও বেশ জাঁকিয়া উঠিয়াছে; এক শ্রেণীর চূর্ণ তামাক এবং কেন্দুয়া গাছের পাতাই ইহার কাঁচা মাল। যাহারা বিড়ি এবং তৎসম্পর্কীর কাঁচা মালের ব্যবসা করে, এরূপ কয়েকটি প্রধান ফার্মের নাম দেওয়া গেল:—
     মুলজী সিরা এণ্ড কোং, এজরা স্ট্রীট; ভোলা মিঞা, ক্যানিং স্ট্রীট; চুণিলাল পুরুষোত্তম, চিৎপুর রোড; কালিদাস ঠাকুরসী, আমড়াতলা স্ট্রীট; ভাইলাল ভিকাভাই, আমড়াতলা স্ট্রীট; মণিলাল আনন্দজী, হ্যারিসন রোড; সতীশচন্দ্র চন্দ্র, হ্যারিসন রোড।
     দেখা যাইতেছে, বিড়ি ব্যবসায়ে মাত্র একটি প্রধান বাঙালী ফার্ম আছে। অধিকাংশ বিড়ির কারখানাই মধ্যপ্রদেশে বি. এন. রেলওয়ে লাইনের ধারে—সম্বলপুর, বিলাসপুর, চম্পা, হেমগিরি, গণ্ডিয়া, গিধৌড় প্রভৃতি স্থানে অবস্থিত। ঐ সব স্থানে শ্রমের মূল্য কম। ছোট ছোট কারখানা গুলিতে সাধারণতঃ দৈনিক ২০০ শ্রমিক কাজ করে, আর বড় কারখানাগুলিতে দৈনিক গড়ে দুই হাজার পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করে।
  19. একটা লক্ষ্য করিবার বিষয়,—বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মোহ আমেরিকার যুবকযুবতীদেরও সম্প্রতি পাইয়া বসিয়াছে। তাহাদের উদ্যম ও দৃঢ়তার কথা ইতিপূর্বে বহুবার বলা হইয়াছে; কিন্তু তাহারাও আরামের চাকরী ও ব্যবসার মোহিনী প্রলোভনে ভুলিতে আরম্ভ করিয়াছে। ১৯৩২ সালের ২০শে জুলাই তারিখের ‘হিন্দু’ পত্রে লিখিত হইয়াছে;—
     “আমেরিকার সহজসাধ্য ব্যবসায়ের মোহে ফটকাবাজী অত্যন্ত বাড়িয়া গিয়াছে। প্রত্যেকেই ডাক্তার, উকীল, জমিদার, বিজ্ঞাপনের এজেণ্ট অথবা অধ্যাপক হইতে চায়। কঠোর পরিশ্রম করিতে তাহারা অনিচ্ছুক এবং কৃষিকার্যের শ্রম অন্যত্র হইতে আগত শ্বেতেভর লোকেরাই করে। পূর্বোক্ত কালো পোষাক পরা বৃত্তি সমূহে যত লোকের প্রয়োজন, তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী লোক প্রবেশ করিতেছে এবং তাহার ফলে বেকার সমস্যা বাড়িতেছে। কম্যাণ্ডার কেনওয়ার্দি বলেন, আমেরিকায় প্রায় ২০ হাজার উকীল আছে, তাহাদের অধিকাংশেরই কোন কাজ নাই। একজন বিখ্যাত ইংরাজ গ্রন্থকার ও পর্যটক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু স্থান ভ্রমণ করিয়াছেন। তিনি আমাকে বলিয়াছেন যে, আমেরিকায়—আইনের ব্যবসার সর্বাপেক্ষা শোচনীয় অবস্থা। নিউ ইয়র্কের অর্দ্ধেক উকীলেরই পাঁচ সেণ্ট দিয়া একখানি খবরের কাগজ কিনিবার সামর্থ নাই। তথাপি অতীতের মত বর্তমানেও নূতন নূতন লোক আইনের ব্যবসায়ে যোগদান করিতেছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হইতে প্রতি বৎসর প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার গ্রাজুয়েট বাহির হয়। ইহাদের এক চতুর্থাংশও কোন কাজ পায় না। শিক্ষা বিভাগের রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯২৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশানে ৫,৬৩,২৪৪ জন পুরুষ এবং ৩,৫৬,১০০ জন স্ত্রীলোক ডিগ্রী লইয়াছে। এই যে কায়িক শ্রমের প্রতি অনিচ্ছা, ইহাই আমেরিকার প্রবল বেকার সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।”
  20. তাঁহার পৌত্র জে. কে. বসু কর্তৃক প্রকাশিত।
  21. অধিকাংশ বিদেশী ব্যবসায়ীরা কলিকাতাস্থিত ইয়োরোপীয় ফার্ম সমূহের এজেন্সি মারফৎ কারবার করিতেন। কিন্তু আমেরিকার ব্যবসায়ীরা ভারতীয় ব্যবসায়ী ও দালালদের মারফৎ কারবার করিতেন, কেন না ইঁহাদের কমিশন, দালালী প্রভৃতির হার কম ছিল। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে রামদুলাল দে-ই সর্বপ্রধান ছিলেন। এই বাঙালী ভদ্রলোক প্রথমে মাসিক ৪।৫ টাকা বেতনে কেরাণীর কাজ করিতেন, পরে নিজের ক্ষমতায় কলিকাতার একজন প্রধান ব্যবসায়ী হইয়াছিলেন। ১৮২৪ সালে প্রায় ৪ লক্ষ পাউণ্ড বা ৬০ লক্ষ টাকার সম্পত্তি রাখিয়া তিনি পরলোক গমন করেন। J. C. Sinha: Journal of the Asiatic Society of Bengal, N. S. 25, 1929, pp. 209-10.
  22. আমার প্রকাশ্য বক্তৃতায় আমি, মুন্সেফ, ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট, কমিশনারের পার্সন্যাল অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট, ইনস্পেক্টর জেনারেল এমন কি একাউণ্টাণ্ট জেনারেলদেরও “সম্মানার্হ কেরাণী” আখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হই নাই।
  23. ১৯২১ সালের আদমসুমারীর বিবরণে দেখা যায়, রাজপুতানা এজেন্সীর ৪৭,৮৬৫ জন এবং বোম্বাই প্রদেশের ১১,২৩৫ জন লোক বাংলাদেশের অধিবাসী হইয়াছে। প্রথমোক্তদের মধ্যে ১২,৫০৭ জন বিকানীরের লোক এবং ১০,৩১৬ জন জয়পুরের লোক কলিকাতাতেই আছে। আদমসুমারীর বিবরণ লেখক বলিয়াছেন,—“উত্তর ভারতের ব্যবসায়ীরা কলিকাতা সহরের ব্যবসা বাণিজ্যে ক্রমেই অধিক পরিমাণ অংশ গ্রহণ করিতেছে। কলিকাতার বাহিরেও তাহারা নিশ্চয়ই ঐরূপ করিয়া থাকে।” বোম্বাই হইতে এত লোক যে কলিকাতার আমদানী হইতেছে, তাহার কারণ দেখাইতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন, “ঐ প্রদেশের ব্যবসায়ীরা অধিক সংখ্যায় কলিকাতায় আসাতেই এরূপ ঘটিতেছে।”
  24. এই সংখ্যা অনেকের নিকট অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য মনে হইতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ বহু তথ্য আমার হাতে আছে। কলিকাতার নিকটবর্তী পাট কল সমূহের এলাকার যে সব ডাকঘর আছে, উহা হইতে ১৯২৯ সালে ১ কোটী ৭৬ লক্ষ টাকার মনি অর্ডার হইয়াছে।—Indian Jute Mills Association, Report, 1930.
     একজন বিহার প্রবাসী পদস্থ বাঙালী আমাকে লিখিয়াছেন:—“বিহার ও অন্যান্য প্রদেশের বাঙালীদের সম্বন্ধে আপনি যে যত্ন লইতেছেন, সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। গত মাসে ছাপরা ডাকঘরেই বাংলা হইতে ১০ লক্ষ টাকা মনি অর্ডার আসিয়াছে। ইহা এক সারণ জেলাতেই বাংলা হইতে আগত টাকার হিসাব।
     “বাংলা হইতে এখানে যে সব মনি অর্ডার আসিয়াছে, তাহার তিন মাসের হিসাব দিতেছি—
    জানুয়ারী (১৯২৭) ... ... টাকা ১১,৫৮,০০০
    ফেব্রুয়ারী (১৯২৭) ... ... টাকা ১১,০২,৮০০
    মার্চ্চ (১৯২৭) ... ... টাকা ৯,৩৭,৯০১

     তিন মাসের গড় ধরিলে মাসে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা হয়। পক্ষান্তরে ছাপরা হইতে বাংলায় মাসেমাসে গড়ে এক হাজার টাকার বেশী বাংলাদেশে মনি অর্ডার হয় না। এখানে যে কয়েক জন বাঙালী থাকে, তাহারা কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করে,—বিশেষতঃ, আমরা এই প্রদেশের অধিবাসী হইয়াছি বলিয়া এখানেই উপার্জিত অর্থ ব্যয় করি। কিন্তু একটি স্কুলের মাষ্টারীও যদি বাঙালীকে দেওয়া হয় অমনি চারিদিক হইতে চীৎকার উঠে—বিহার বিহারীদের জন্য!”
     “বাংলার সম্পদ শোষণ” এই শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯২৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখিয়াছেন,—“১৯২৬ সালে এক মাত্র কটক জেলাতেই বাংলা হইতে ৪ লক্ষ টাকার মনি অর্ডার হইয়াছিল। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উড়িয়ারা বাংলাদেশে রাঁধুনি, চাকর, প্লাম্বার এবং কুলী হিসাবে অর্থ উপার্জন করে। সুতরাং অন্যান্য অ-বাঙালী অপেক্ষা উড়িয়ারা কম টাকা দেশে পাঠাইতে পারে। কিন্তু মনি অর্ডার যোগে তাহারা তাহাদের সঞ্চিত অর্থের অতি সামান্য অংশই পাঠায়। বেশীর ভাগ অর্থ তাহারা বাড়ী যাইবার সময় সঙ্গে লইয়া যায়।”

  25. স্থানীয় কোন সংবাদপত্রে জনৈক পত্রপ্রেরক লিখিয়াছেন—(৬ই জানুয়ারী, ১৯৩২):
     “অ-বাঙালীদের সাধারণ প্রথা এই যে, তাহারা নিজেদের জাতীয় মুচী, নাপিত, ধোবা, ভৃত্য প্রভৃতি রাখে। তাহার অর্থ এই যে, বাঙালীরা অ-বাঙালীদের নিকট হইতে এক পয়সা লাভ করিতে পারে না। ইয়োরোপীয় ফার্মগুলি কিছু সাধারণতঃ বাঙালী কর্মচারীদের সাহায্যে তাহাদের আফিস ও কাজ কারবার চালাইয়া থাকে।
  26. ইণ্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারী মিঃ এম. পি. গান্ধী একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁহার Indian Cotton Textile Industry গ্রন্থে তিনি হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, প্রতি বৎসর প্রায় ১৫ কোটী টাকা মূল্যের বস্ত্রজাত বাহির হইতে বাংলার আমদানী হয়। আমি কম পক্ষে ১০ কোটী টাকা ধরিয়াছি।
     অবশ্য বোম্বাই যে কাপড় যোগায়, তাহার মূল্য হইতে কাঁচা তূলার মূল্য বাদ দিতে হইবে, কেন না বাংলাতে তূলা উৎপন্ন হয় না।
  27. ‘ন্যাশন্যাল’ কোম্পানী অ-বাঙালী, কেন না ইহা গুজরাটীদের হাতে গিয়াছে। ইহার ইহার দরুণ ৩০ লক্ষ টাকা বাদ দিলে, বিদেশী কারবারের মূল্য ৩৫ লক্ষ টাকা মাত্র হয়। তাহার মধ্যে একটি কোম্পানীর কারবারের মূল্যই ২০ লক্ষ টাকা।
  28. ইহার মধ্যে “ন্যাশনালের” দরুণ ১/ কোটী টাকা। সুতরাং খাঁটী বাঙালী কোম্পানীর ফাণ্ডের পরিমাণ ১/ কোটী টাকা মাত্র।
  29. আরও দুঃখের বিষয় এই যে ২২ জন ছাত্র ব্যবহারিক গণিতে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কেহই ‘নিয়মিত ছাত্র’ নহে, অর্থাৎ কেহই প্রথম বার পরীক্ষা দিতে যায় নাই। যাহারা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেয় না, অথবা পরীক্ষায় ফেল করে, তাহাদের পুনর্বার ‘অনিয়মিত ছাত্র’ রূপে পরীক্ষা হয়। সুতরাং ইহাদের জন্য অভিভাবকদের অতিরিক্ত অর্থবার হয়।