আত্মপরিচয়/সংযোজন

উইকিসংকলন থেকে

সংযােজন

সম্মান

যখন বালক ছিলেম তখন চন্দননগরে আমার প্রথম আসা। সে আমার জীবনের আরেক যুগে। সেদিন লোকের ভিড়ের বাইরে ছিলেম প্রচ্ছন্ন, কোনো ব্যক্তি, কোনো দল আমাকে অভ্যর্থনা করে নি। কেবল আদর পেয়েছিলেম বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে। গঙ্গা তখন পূর্ণগৌরবে ছিলেন, তাঁর প্রাণধারায় সংকীর্ণতা ঘটে নি, ছায়া স্নিগ্ধ শ্যামলতায় তাঁর দুই তীরের গ্রামগুলি শান্তি ও সন্তোষের রসে ভরা ছিল।

 তার পূর্বে শিশুকাল থেকে সর্বদাই ছিলেম কলকাতার ইঁটের খাঁচায়। মুক্ত আকাশে অলোকের যে সদাব্রত, তার নানা বাধা-পাওয়া দাক্ষিণ্যের খণ্ড অংশ পৌঁছত আমার ভাগে। আমার অর্ধাশনক্লিষ্ট মন এখানে এসে মুক্তির অমৃত অঞ্জলি ভ’রে পান করেছে। চিরদিন যারা এই শ্যামলার আঁচলে বাঁধা হয়ে থাকত, তারা একে তেমন সম্পূর্ণ দেখে নি। আমি এসেছিলেম যেন দূরের অতিথি, তাই আমার জন্যে ছিল বিশেষ আয়োজন। সেদিন গঙ্গাতীরের পূর্ব দিগন্তে বনরেখার উপরের পথে প্রতিদিন সকালে সোনার আলোয় মাধুর্যের যে ডালি আসত সে আর কারো চোখে তেমন করে পড়ে নি আর সূর্যাস্তের নানা রঙের তুলিতে গঙ্গার জলধারায় রেখায় রেখায় যে লেখন দেখা দিত সে বিশেষ করে আমারই জন্যে।

 সেই অতিথিবৎসলা বিশ্বপ্রকৃতি তাঁর অবারিত আঙিনায় সেদিন যখন বালককে বসালেন, তাকে কানে কানে বললেন, ‘তোমার বাঁশিটি বাজাও।’ বালক সে দাবি মেনেছিল।

 ছেলেমানুষের বাঁশি ছেলেমানুষি সুরে যেখানে বাজত সে আমার মনে আছে। মেরান সাহেবের বাগানবাড়ি বড়ো যত্নে তৈরি, তাতে আড়ম্বর ছিল না কিন্তু সৌন্দর্যের ভঙ্গি ছিল বিচিত্র। তার সর্বোচ্চ চুড়ায় একটি ঘর ছিল, তার দ্বারগুলি মুক্ত, সেখান থেকে দেখা যেত ঘন বকুলগাছের আগ্‌ডালের চিকন পাতায় আলোর ঝিলিমিলি। চারি দিক থেকে দুরন্ত বাতাসের লীলা সেখানে বাধা পেত না। আর ছাদের উপর থেকে মনে হত মেঘের খেলা যেন আমাদের পাশের আঙিনাতেই। এইখানে ছিল আমার বাসা, আর এইখানেই আমার মানসীকে ডাক দিয়ে বলেছিলেম―

এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার।

 সে ঘর নেই, সে বাড়ি আজ লৌহদন্তদন্তুর কলের কবলে কবলিত। সে গঙ্গা আজ অবমাননায় সংকুচিত, বন্দী হয়েছে কল-দানবের হাতে— ত্রেতাযুগে জানকী যেমন বন্দী হয়েছিলেন দশমুণ্ডের দুর্গে। দেবী আজ শৃঙ্খলিতা।

 সেদিন যে বালক জীবনের ঊষালোকে আপনাকে স্পষ্ট করে চেনে নি এবং চেনে নি এই সংসারকে, তার উপরে একে একে অন্তত পঞ্চাশ বছরের চাপ পড়েছে। এই চাপে সেই বালক সম্পূর্ণ লোপ পায় নি। আমি আজ নানা কাজে হাত দিয়েছি, এবং নানা দেশের কাছ থেকে খ্যাতি অর্জন করেছি। কিন্তু অন্তরের মধ্যে সেই বালক এখনো আছে কাঁচা― সংসারের যে হাটে সব জিনিসের দর যাচাই হয় সেখানকার রাস্তাঘাটে ও চালচলনে এখনো সে পাকা হয় নি; প্রকৃতির খেলার প্রাঙ্গণটার দিকে এখনো তার টান― তা ছাড়া খ্যাতির মধ্যে সে আপনার খাঁটি পরিচয় পায় না। খ্যাতির মতো বন্ধন নেই, দশের মুখের কথার জাল থেকে মনকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে রাখা শক্ত। বালকের মনের যে ডানা সেদিন আকাশে ছাড়া পেয়েছিল তার সঙ্গে খ্যাতির দড়ি বাঁধা ছিল না। আজো সেদিনকার সেই খ্যাতিহীন মুক্তির আকাশের জন্যে তার মন ব্যাকুল হয়। সেইজন্যেই এত করে মনে পড়ে চন্দননগরের গঙ্গার তীর, সেই মোরানের বাগানবাড়ির উপরিতলের খােলা ঘরটি যেখানে বাতাস আলো এবং বালকের কল্পনার পরস্পর অবাধ মেলামেশার মাঝখানে জনতার খ্যাতিনিন্দার কলরব আবর্ত তৈরি করে নি।

 মানুষের কাছ থেকে দরদ ও আদর পাবার লােভ আমার নেই। এ কথা বললে অত্যুক্তি করা হবে। মনে ভাবি, বিধাতার স্নেহের দান মানুষের সমাদর বেয়েই ঝরে আসে। যখন মানুষ বলে, তুমি যা দিয়েছ তাতে খুশি হয়েছি― তখন সেই খুশির কথাটা একটা মস্ত পুরস্কার। এ পুরস্কার চাই নে ব’লে স্পর্ধা করতে পারি নে।

 কিন্তু সংসারে যশের পুরস্কার বালকের জন্যে নয়, তার জন্যে মুক্তি। জনসভায় আসন বজায় রাখতে হলে তার উপযুক্ত সাজসজ্জা চাই, জনসভার দস্তুর বাঁচিয়ে চলবার আয়ােজন অনেক। বালকের বসন-ভূষণের বাহুল্য নেই, যেটুকু তার আছে তা যদি ছেঁড়া হয় বা তাতে ধুলাে লাগে তবু সেটা বেমানান হয় না। সার্কাসের খেলােয়াড়ের মতাে সে অন্যের জন্যে খেলে না, তার খেলা তার আপনারই জন্যে। এই কারণে তার খেলাতে কর্মের বাঁধন নেই, খেলাতে তার ছুটি। বিশ্বের মধ্যে যে চিরবালক জলে স্থলে আকাশে আলােতে ছায়াতে অবহেলায় খেলা করেন, যিনি সেই খেলার বদলে শিরােপা চান না, মর্তের বালক তাঁকে না চিনেও না জেনেও তাঁকেই পায় আপন খেলার সাথী, তাই দেশের লােকের কথায় তার কোনাে দরকার হয় না।

 কিন্তু বয়স্কের কীর্তি তো বালকের খেলার মতো নয়। বহুলােকের সঙ্গে তার বহুতর যােগ। এখানে বন্ধুকে না হলে চলে না, এখানে সহায়কে না পেলে ক্লান্তির ভারে পিঠের হাড় বেঁকে যায়। কাজের দিনে প্রাঙ্গণে ধুলােয় একলা বসে অকিঞ্চনের আয়ােজনে তার শক্তি পাওয়া যায় না, পাঁচজনকে ডাক দিতে হয়। বালককালে যেদিন চন্দননগরে এসেছিলেম সেদিন এসেছিলেম বিশ্বপ্রকৃতির খেলাঘরে! সেদিনকার দান দেবতার প্রত্যক্ষ দান, সে আমি আকাশে বাতাসে, বনের ছায়ায়, গঙ্গার কলস্রোতে পেয়েছি। আজ এসেছি জনসভায় কবিত্ব নিয়ে নয়, কর্মের ভার নিয়ে― এর যোগ্য দান আজ আমি মানুষের কাছে দাবি করতে পারি। যেদিন সেই ছাতের উপর খোলা আকাশের নীচে মনের স্বপ্নকে ছন্দের গাঁথনিতে একলা বসে রূপ দিয়েছি, সেদিন ছিলেম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিখেলার সহযোগী। তিনি আমার মনের আনন্দ জুগিয়েছিলেন। আজ আমি কর্মীরূপে কর্ম ফেঁদে বসেছি। এ কর্ম মানুষের কর্ম, মানুষকে তাই সহযোগিতার জন্যে ডাক দেব। আজ আমাকে আপনারা যে সম্মান দিতে এসেছেন সে যদি সেই সহযোগিতার আহ্বানে সাড়া হয় তবে জানব কর্মের ক্ষেত্রে সার্থক হয়েছি। তা যদি না হয়, এর সঙ্গে যদি সহযোগিতা না থাকে তবে এই সম্মানের ভার দুর্বিষহ। বহুদূর থেকে নারদের পুষ্পমাল্য ইন্দুমতীকে সাংঘাতিক আঘাত করেছিল― বস্তুত সে মালারই ভার নয়, সে দূরত্বের ভার। দূরে থেকে যে সম্মান, সে সম্মানের ভার বহন করে সংসারে মুক্তচিত্তে বিচরণ করতে ক’জন পারে? মানুষ সকলের চেয়ে সুখে থাকে যখন সে আপনাকে ভোলে; যখন খ্যাতির ধাক্কায় ধাক্কায় তার নিজের দিকে তার নিজেকে কেবলই জাগিয়ে রাখে, তখন আত্মার যে নিভৃতে তার গভীরতম কৃতার্থতা সেখানে যাবার পথ অবরুদ্ধ হয়।

 বালককালে বাঁশির উপরে দখল ছিল না; বাজিয়েছিলেম যেমন-তেমন করে, পথে লোক জড়ো হয় নি। তার পরে যৌবনে বাঁশিতে সুর লাগল বলে যখন নিজের মনে সন্দেহ রইল না, তখন সকলকে নিঃসংকোচে বলেছি ‘তোমরা শোনো।’ তেমনি কর্মের আরম্ভে একদিন কর্মকে সম্পূর্ণ চিনি নি। কোন্ রূপের আদর্শে তার প্রতিষ্ঠা হবে সেদিন জানতেম না— সেদিন পথের লোকে উপেক্ষা করে চলে গেছে, আমিও বাইরের লোককে ডাক দিই নি। শেষে কর্ম যখন আপন প্রাণশক্তিতে মূর্তিপরিগ্রহ করলে ভখন তার পরিচয় গোপন রইল না। তখন নিঃসংশয় দৃষ্টিতে তাকে দেখতে পেলেম। তখন সকলকে ডেকে বলেছি ‘তোমরা এসো।’ বাঁশির সুর বিকাশ লাভ করে একদিন যেমন বিশ্বের সকলের হয়— কর্মও তেমনি বিশ্বের পরিণতিতে বিশ্বের সামগ্রী হয়ে ওঠে। সেই বিশ্বের ধর্ম যখন কর্মের মধ্যে দেখা যায় তখন, শুধু সম্মান নয়, সহায়তা দাবি করবার অধিকার জন্মে। সেই অধিকার আজ এই সভায় সকলের কাছে নিবেদন করে বিদায় গ্রহণ করি।

 ২১ বৈশাখ ১৩৩৪