আনন্দ-তুফান/পূজা

উইকিসংকলন থেকে
পূজা।

লভি’ মলয়-সমীরে—মধুমাসে,
হাসে যথা কোকিলের প্রাণ;
উঠে উচ্চরবে সে হাস্যের ছটা মধুভরা!
প্রেমিকের মনঃ প্রাণ হরি;—
তেমতি কেন রে আজি শুভ প্রাতঃকালে,
ঘরে ঘরে শুনি শঙ্খধ্বনি—মধুভরা?
উঠে নাদ, অম্বর ভেদিয়া, কি আমোদে?
শুনি সাধুমুখে—ভারতের কথা;—
“ভগীরথ, নিস্তারিতে পিতৃকুল,
সাধি’ কতমতে, এনেছিলা মর্ত্তধামে যবে,
সুরধুনী পতিতপাবনী; করেছিলা শঙ্খধ্বনি তবে,—
জানাইতে সে শুভ বারতা,
বধির এ মর্ত্ত্যবাসি-জনে—উচ্চনাদে।”
কিন্তু শুনি আজি, লক্ষ লক্ষ শঙ্খনাদ,
যথা ভীমনাদ-বজ্র-নাদে নাদে প্রতিধ্বনি;—
নাহি জানি কারণ ইহার।
আহা, আজি কিবা শোভে তরুণ তপন,
নব রাগে! হাসিমুখে অনুরাগে ভরি’।
যেন, হেন রাগ হেরে নাই কভু আঁখি মোর!

হাসে রামাকুল, হেরি তপনের হাসি;
কহে, একজন অন্য জনে কাণাকাণি করি,—
কি বুঝি হাসির কথা;
কর্ণে কিন্তু না পশে সে ধ্বনি।
ভাবে ব্যক্ত হয় শুধু—
“বড় সুখ, আজি এ সংসারে!”—
শিশুদল, শঙ্খনাদ শুনি’,
শশব্যস্তে উঠি’ শয্যা ছাড়ি’, পরে নব-বাস;
বলে মুখে,—“বড় সুখ আজি এ সংসারে!”
না বুঝি কারণ কিন্তু কিছু।
দেখিতে দেখিতে বাদ্য উঠিল বাজিয়া,
মধুর আরাবে পূর্ণ হইল সংসার!
ছুটিল দিগন্ত ভেদি’ সাধ্বী প্রতিধ্বনি
ধরি গান—“জয় ব্রহ্মময়ী”।—
ঘুচিল জীবের জ্বালা ভাবি’ ভক্তগণ,
আরম্ভিলা দুর্গা আরাধনা,
ঈশানীরে নিরথি নয়নে,—এইরূপে।
“এস মা আনন্দময়ি। দুর্গতিনাশিনি!
ভগ্ন এই হৃদয়-আসনে;
ব’স দুর্গে। দুঃখ যা’ক দূরে।
রাখ মা, বাহিরে পা দু’খানি ক্ষণকাল—

নিরখিবে নয়ন আমার।
‘অনুতাপ’ পেতেছে অঞ্চল,
মুছা’তে মা রাঙ্গা-পদ-ধূলি;
মুছিতে মা, কলুষ-কালিমা।
তন্ত্র মন্ত্র নাহি জানি আমি,
ফুল-দল নাহিক সম্বল,
নারিব মা পূজিতে তোমারে—বিধিমতে।
মন কিন্তু না শুনে সে কথা।
বলে,—“কর পূজা যা’আছে সম্বল তাহে;
না পূজিলে নাহিক নিস্তার,
ভবে পার বিষম সঙ্কট।”
ভয় তা’ই হয় গো ভবানি—অভয়ে!
কি আছে সম্বল মোর? জান ত সকলি!
ছিল যে আশার ফুল ফুটি’ হৃদুদ্যানে,
ভকতি-সৌরভ মাখি গায়,
স্ব-বলে তুলেছে তা’রে মায়া;
ফেলেছে মা, সন্দেহ-সাগরে।
নিষ্ঠা-বিল্বদল, আহা! কিশলয়-কালে
চিন্তা-কীটে কেটেছে শঙ্করি। আঁখি-কুম্ভ
অশ্রু-গঙ্গাজলে নিয়তই ছিল মা পূরিত;
পাপানল শুকায়েছে প্রায় তাহা।

বিন্দু যদি থাকে অবশেষ,
তপ্ত এত, ধরা নাহি যায়;
প্রাণ তাহা না পারে মা দিতে,
দগ্ধ পাছে হয় ও চরণ—সাগর পারের তরি।
‘বাসনা’-আমান্ন আছে বটে
সুসজ্জিত বড়ই সুন্দর!
কিন্তু শিবে! কা’র তরে রয়েছে সঞ্চিত তাহা,
না বুঝি’, দিয়াছি পঞ্চভূতে।
ভূতে খায়, খায় রিপুদলে,
তবু না ফুরায় সে ‘বাসনা’।
কিন্তু গো মা! ভয় করে তোমারে তা’দিতে;
উচ্ছিষ্ট-করেছে তা’রা সবে।
পূজা মোর হ’ল না জননি।
ক্ষমা কর তনয়ে এবার।
“পূজি আমি”, সাধ যদি হয় তব চিতে,
দেখাও মা ‘আমারে’[১] সম্মুখে
‘আমি’ হয়ে পূজিব তোমায়; বড় আশা।


  1. আমি যাহা, তাহা আমার জ্ঞান-চক্ষুর গোচর কর।