আফগানিস্থান ভ্রমণ/কান্দাহার

উইকিসংকলন থেকে

কান্দাহার

 কান্দাহার, একটি ছোট্ট শহর। কিন্তু এই সহরের গুরুত্ব এবং বিশেষত্ব কাবুল হতে কোন অংশে কম নয়। কান্দাহার বাস্তবিক পক্ষে ইণ্ডিয়ার প্রবেশ পথ। ইরাণ হতে যে সকল উপনিবেশকারী ভারতে প্রবেশ করেছিল তারা কান্দাহার হয়েই এসেছিল বেশি। হিরাত হতে একটি বড় রাস্তা কান্দাহার হয়ে বেলুচিস্থানের চামন পর্যন্ত এসেছে। এই পথ দিয়েই অনেক বিশিষ্ট পরিব্রাজক এবং গজনীর সুলতান বার বার সোমনাথ আক্রমণ করেছিলেন। ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদ থাকবে না, ধর্মের প্রতিহিংসা থাকবে না, অতএব আমাদের পক্ষে কান্দাহার পুনরায় দখল করার দরকারও হবে না, নতুবা আমিও ফরাসী পর্যটকদের মতে বলতাম কান্দাহার ভারতের “লাইফ লাইন”। কান্দাহার ভারতের চাই। শুধু তাই বলতাম না, ফরাসী পর্যটকদের ডিঙ্গিয়ে আরও অগ্রসর হতাম এবং বলতাম দক্ষিণ পাশেরও কতকটা চাই, কারণ সেখানকার লোকও পোস্তভাষা বলে এবং তারাও জাতে ইন্দো-এরিয়ান। বুঝতে পেরেছিলাম এশিয়াতে ইউরোপীয়ানরা যে সাম্রাজ্যবাদ চালাচ্ছে সেই সাম্রাজ্যবাদ অতি সত্বর ধ্বংস হবে। চীনের সাম্রাজ্যবাদী মতলব ছিল শুধু চীনা ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতা পাবার ইচ্ছা সকলের মনে আলোকায়িত, ইন্দোচীনের অবস্থাও তাই—অতএব এশিয়া আর পরাধীন থাকবে না। এখন বুঝতে পেরেছি বহুপূর্বে আমি যে ধারণা করেছিলাম তাই ফলবতী হয়েছে। আমরা স্বাধীন হয়েছি এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর কি হতে পারে?

 এখন এসব সাম্রাজ্যবাদী তথ্যের কথা পরিত্যাগ করে কাজের কথা বলা চাই। কান্দাহারে পৌঁছেছিলাম গভীর রাত্রে। আফগান্ মোটর ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করেছিল কোনও সরাই অথবা হোটলে আমাকে রেখে যাবে কি? তাকে বলেছিলাম “এসব হতে পারে না, আমার পায়ের অবস্থা ভাল নয়, অতএব কোনও হিন্দুর বাড়ীতে রেখে যাও।” আমার আদেশ অনুযায়ী সে একটি হিন্দু-পরিবারে আমাকে রেখে যাবার জন্য গভীর রাত্রে একটি দরজার কড়া নাড়ল। বাড়ীর মালিক দরজা খুলে একজন অপরিচিত লোকের মুখ দেখা মাত্র মুখ ফিরিয়ে নিলেন কিন্তু মোটর ড্রাইভার ছাড়বার পাত্র নয়। সে বললে, “আমি ত এঁকে তোমার দরজায় রেখে যাচ্ছি তারপর তুমি যা হয় করো।” যেমন কথা তেমন কাজ। আমাকে রেখে মোটর ড্রাইভার তখনই চলে গেল। বর্জনশীল মনোবৃত্তিসম্পন্ন হিন্দু মহাশয় আমাকে ঘরে স্থান দিতে বাধ্য হলেন এবং তার পরের দিন সকালে উঠেই নিকটস্থ শিব-মন্দিরে আমার থাকবার এবং খাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে কৃতার্থ করলেন। শিব-মন্দিরে আসার পর পায়ের রোগ সেরেছিল, শরীরের গ্লানি অপসরণ হয়েছিল, জানবার মত সুযোগ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বাবা ভোলানাথ নামক মন্দির-রক্ষকের সাহায্য পেয়ে আফগানিস্থান সম্বন্ধে যা কিছু জানবার ছিল, সবই জেনে নিয়েছিলাম।

 কান্দাহারের অন্য কিছু বলবার পূর্বে সহরটির প্রাকৃতিক অবস্থা বিশেষ করে বলা চাই। আমরা যখন দারজিলিং যাই তখন সেখানে যেয়েও পাহাড়িয়া পথে চলাফেরা করি। কান্দাহার সেরূপ নয়। বেশ সুন্দর সমতল ভূমি। শহরের মধ্যে প্রবেশ করলে মনে হয় না আশেপাশে পাহাড় রয়েছে। অথচ চামনের দিক থেকে যদি কান্দাহার যাওয়া যায় তবে বুঝতে পারা যাবে কত পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তারপর কান্দাহার পৌঁছান যায়। কত বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে তারপর কান্দাহার পৌঁছবার সৌভাগ্য হয়। অবশ্য যে পথটার কথা আমি বললাম তার সবটা আমি দেখি নি কিন্তু পিসিন পর্যন্ত দেখেছি এবং তাতেই ধারণা হয়েছে তথা বাথিব বেলুচিস্থানের পার্বত্য অঞ্চল কত বন্ধুর। এখানে তথাকথিত শব্দটি ব্যবহারের কারণ হল, বেলুচিদের পাঠান হতে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি একই তাদের বিচ্ছিন্ন করবে এবং শাসন ওশোষণ করবে পুঁজিবাদীর দাস সাম্রাজ্যবাদী। আমি কেন এই পাপে পা বাড়াব? আমার কোন দাবী নাই সে দেশে। হাঁ, দাবী থাকত এবং থাকবে যদি ইণ্ডিয়া সাম্রাজ্যবাদী হয়। ইণ্ডিয়া সাম্রাজ্যবাদী হবার পূর্বে যদি অন্য কোন বাদ গ্রহণ করে অথবা আমি পৃথিবী হতে বিদায় নেই তবে কে এই পাপঅর্জিত অপর দেশের অপহরণ করা সুখ-সম্পদ ভোগ করবে? কতকগুলি দস্যু এবং জুয়াচ্চোর। আমি তাদের মধ্যে থাকব না। অতএব এখানে তথাকথিত শব্দটি ব্যবহার করলে কোন দোষ নাই।

 পূর্বে বলেছি বাবা ভোলানাথের সাহায্য পেয়ে আফগানিস্থানের সব কিছু জানতে পেরেছিলাম। বাবা ভোলানাথ একজন যুবক। যদিও তাঁর বৈদেশিক ডিগ্রী ছিল না অথবা থাকবার কথাও নাই তবুও তিনি একজন শিক্ষিত লোক। যদিও তিনি তখনও বিয়ে করেন নি তবুও তিনি যে বিয়ে করবেন না তার কোনও প্রমাণ ছিল না। সাধারণ গৃহস্থ যেমন করে জীবন কাটায় তিনিও তেমনি জীবন কাটাচ্ছিলেন। অতএব কেউ যেন ভূল করে বাবা ভোলানাথকে, ঠাকুর, শ্রীমা বা সন্ন্যাসী না মনে করেন। যেখানে হিন্দুর খাদ্যের এবং অর্থের প্রাচুর্য রয়েছে সেখানে এসব সং সেজে লাভ কি?

 বাবা ভোলানাথের এবং তার সহকর্মীদের সাহায্যে কয়েক দিনের মধ্যেই আমার পা ভাল হয়েছিল। চলাফেরা করার সুযোগ পেয়ে ভেবেছিলাম এবার পৃথিবী ভ্রমণের পথ পরিষ্কার হল, কিন্তু সেই সংগে এটাও ঠিক করলাম, যতদিন আকাশ পরিষ্কার না হবে, যতদিন শীতের প্রবলতা অপসরণ না হবে, ততদিন এই মন্দিরেই থাকব। পথ সুগম হলে বের হওয়া যাবে। খামখেয়ালী প্রকৃতি যেমন শুনবে না, পথও তেমনি সুযোগ সুবিধা দেবে না। ভোলানাথকে পরিষ্কার করে বিষয়টা বুঝিয়ে দেবার পর তিনি বলছিলেন মন্দিরের মধ্যেই তিনি এমনি রকমের আবহাওয়ার সৃষ্টি করবেন যাতে আমার কোনও কষ্ট হবার কারণ থাকবে না। চলাফেরা করার সুযোগ পেয়েই যিনি আমাকে প্রথমদিন স্থান দিয়েছিলেন তাঁর বাড়ীতে যাই। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন যে দিন তাঁর বাড়িতে আমি প্রবেশ করি সে রাত্রেই তাঁর ভাই নিমোনিয়া রোগে মারা যান এবং সেজন্যই আমাকে তিনি স্থানান্তরিত করে ছিলেন। আমাদের দেশের মত আফগানিস্থানেও কুসংস্কার আরও একটু বেশি করে রয়েছে। তাদের ধারণা হয়েছিল আমিই মৃত্যুকে সংগে করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মৃত্যু ভদ্রলোকের ভাইকে নিয়ে গেছে, আর কাকেও না নিলেই রক্ষা।

 প্রথমদিন সহর বেড়িয়ে বুঝতে পারলাম এখানে অনেক জাতের লোক বাস করে। জাতবিচার নৃতত্ব মতে করেছিলাম। বাস্তবিক পক্ষে যাকে হরেক রকমের জাত বলেছি সেটি সকলের চোখে ধরা পড়বে না। এ সংবাদটি নৃতত্ববিদদের জন্য। অবশ্য ধর্মের দিক দিয়ে তিনটি ধর্মের লোক দেখলাম। হিন্দু, মুসলমান এবং ইহুদী। এখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিল, বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মের নাম-গন্ধ নাই, শুধু রয়েছে কয়েকটি পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তিগুলিকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু এখনও সেই পাথরের মূর্তি পুরাতন যুগের মানুষের হস্ত শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে দাড়িয়ে আছে। অবশ্য পাথরগুলির বিকলত্ব হয়েছে। আজ যদি কেউ এই পুরাতন পাথরের মূর্তিগুলিতে মানুষের চোখের অন্তরাল করতে চায়, তবে হাজার লোক মিলে যে কাজটি দশ দিনেই শেষ করতে সমর্থ হবে।

 সহরদেখা শেষ করে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলাম। গ্রামের দিকে যেয়েই পাথরের পাশেই চুনাপাথর দেখে মনে হল, যদি ভূমিকম্প হয়, তবে এই সহর হ্রদে পরিণত হতে কতক্ষণ। কিন্তু সে দৃশ্য চিন্তা করতেও ইচ্ছা হল না। গ্রাম ছেড়ে শহরে ফিরে এলাম।

 সেই বৎসরই কোয়েটাতে ভূমিকম্প হয়ে অনেক ধন এবং মানুষ নষ্ট হয়েছিল। আমি মনে করেছিলাম কান্দাহার সহর লোপ হয়ে একটি হ্রদে পরিণত হবে, তা হয় নি এমন কি কম্পনও হয় নি। কিন্তু নিশ্চয় করে বলতে পারি যদি হিমালয় পর্বতের কোনও অংশ সাগরে পরিণত হয় তবে বেলুচিস্থানের কোয়েটা অঞ্চলের সংগে কান্দাহারও ডুবে যাবে।

 সেদিনই সহরের গভর্ণরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। গভর্ণরের নামে আমার কাছে প্রধান মন্ত্রীর এক খানা পত্রও ছিল। পত্র দেবার পর তিনি আমাকে আদর যত্ন করেছিলেন এবং তাঁর দেওয়া মস্ত বড় একটি বাড়ীতে থাকতে বলেছিলেন। সেখানে খাওয়া থাকা ত পেতামই, উপরন্তু ভোগ বিলাসের ত্রুটি হত না। ভোগ বিলাস মানুষ চায়, আমিও চাই কিন্তু সকল সময় ভোগ-বিলাসের দিকে তাকালে যা চাওয়া যায় সেটা পাওয়া যায় না সেজন্যই গভর্ণরের বাড়ীতে থাকি নি। বাবা ভোলানাথের বাড়ীতেই থাকতে পছন্দ করেছিলাম। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কোনও মুসলমানের বাড়িতে থাকিনি কেন, তারও উত্তর দিয়ে দিচ্ছি। সহরে কোনও প্রগতিশীলের সংগে দেখা হয় নি বলেই অন্যত্র যেতে পারি নি।

 গভর্ণরের সেক্রেটারী খরকা সরিফ এবং বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখে যেতে বলছিলেন। বুদ্ধদেবের মূর্তি পরে দেখেছিলাম এবং খরকা সরিফ ফেরবার পথেই দেখেছিলাম। খরকা সরিফ বলতে একটি মস্‌জিদকে বুঝায়। এই মস্‌জিদের বিশেষত্ব আছে। আমান উল্লার সময়ে খরকা শরিফের বিশেষত্ব ছিল না, নাদীর খানের রাজত্বের আরম্ভেই খরকা সরিফের বিশেষত্ব ফিরে আসে।

 যদি কোন লোক কোনও লোককে হত্যা করে এবং সে জানে লোকহত্যা অন্যায়ভাবে করেছে তবে সে খরকা সরিফে আশ্রয় নেয়। খরকা সরিফের আশ্রিত নরহত্যাকারীকে পুলিশ কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। এখানে ধর্মের বিচার নাই। যে কোন ধর্মের লোক খরকা সরিফ নামীয় মস্‌জিদে আশ্রয়ে নিতে পারে, মুসলমান মোল্লা সেই আশ্রিত লোককে তাড়িয়ে দেবার অধিকার রাখে না। এই হল খরকা শরিফের বিশেষত্ব। এমন বিশেষ স্থান না দেখলে আমার পক্ষে আফগানিস্থান ভ্রমণই পণ্ড হয়ে যেত।

 আফগানিস্থানে সমাজের শাসন কড়া বলে সেখানকার ভিক্ষাজিবীদের বড়ই দুর্দশা। ভিক্ষাতে ভিক্ষুকের পেট ভরে না। বস্ত্রের যোগাড় হয় না। মাথা গুঁজবার উপযুক্ত আশ্রয়ও তাদের মেলে না। এরূপ অবস্থায় শীতপ্রধান দেশের গরিব লোকদের ভয়ানক কষ্ট পেতে হয়। এ কথাটা আমান উল্লা ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন, সেজন্যই দেশের দারিদ্র্য যাতে দূর হয় তার চেষ্টা তিনি বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। আমার মনে হয় বাচ্চা-ই-সাক্কো দারিদ্রকে আরও বেশি টের পেয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি আমান উল্লার চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে এবং দ্রুত দেশের দারিদ্র্য মোচন করতে গিয়ে বিদেশীর বিরাগভাজন হন। লোকে বলে একদিন জনৈক হিন্দু পুঁজিপতি নাকি বাচ্চা-ই-সাক্কোকে ভয় দেখিয়ে বলছিলেন রাজ্য-দখল করতে পার কিন্তু রাজ্য চালাতে হলে আমার কাছে তোমাকে আসতেই হবে। বাচ্চা-ই-সাক্কো তার দ্বারস্থ যাতে না হতে হয় সেজন্য নোট তৈরী করেন এবং সেই নোট নিতে সর্বসাধারণকে বাধ্য করেন। আফগানিস্থানে তখনও নোটের চলন হয় নি, বর্তমানে অবশ্য হয়েছে।

 কয়েকদিন পরে পুরাতন বৌদ্ধ-যুগের স্থাপত্যশিল্প দেখার জন্য বেরিয়েছিলাম। পথে দেখা হয়েছিল কয়েকজন পাঞ্জাবী মোটর ড্রাইভারের সংগে। ওদের কথায় বুঝলাম, এরা আর দেশে ফিরে যাবে না, সুযোগ পেলেই রুশ দেশে যাবে। দেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তারা বললে, পাঞ্জাব যদিও বেশ সুন্দর দেশ, খাদ্যের অভাব নেই, তবুও অভাব-গ্রস্তদের পক্ষে কোন মতেই সেখানে বাস করা উচিত নয়। কটা মাত্র সরকারী চাকুরি আছে, তাই নিয়ে সেখানে কামড়া কামড়ি চলছে। কাজ আছে, মজুরি নেই। সিনেমা আছে, দেখবার পয়সা নেই। শরীরে শক্তি আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে কিন্তু সদ্ব্যবহারের পস্থা নেই। ড্রাইভারগুলি সবাই মুসলমান। তাদের বললাম “দেশ ছেড়ে চলে বাওয়া ভাল নয়, দেশকে অন্যান্য দেশের মত গড়ে তোলা তাদের কর্তব্য এবং এসম্বন্ধে স্থিরচিত্তে চিন্তা করা উচিত। রুশ দেশকে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আপনারা চাইবেন সাজানাে বাগানে বসতে, হ্মেপ সাজানাে বাগান নিজদেশে তৈরি করলেই সকল দুঃখের অবসান হবে।”

 একজন রাগ করে বললেন “আরে বাবু তুম সমজতা নেই, মুলুকমে মজা বদখেয়াল হটানা বহুত মুস্কিল।”

 ওদের কথা শুনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, ভারতের সমাজে ধর্মের কি অপ্রতিহত প্রতাপ। দেশবাসীকে তা বিদেশে পর্যন্ত পালাতে বাধ্য করছে। কিন্তু এই দুষ্ট প্রভাব থাকবে না, থাকতে পারে না।

 সহরের বাইরে পাহাড়ের ওপর প্রকাণ্ড একটি বুদ্ধমূর্তিটির মুখের দিকটা ভেঙে ফেলেছে। লােকে বলে শঙ্করাচার্যের মতবাদ প্রচার হবার পর এই মূর্তির অনেকটা ভাঙা হয়েছিল। মুসলমান ধর্মের অভ্যুদয়ের পর আরও। ভাঙা হয়েছে। আজ যাকে বহু যত্নে গড়া হয়েছিল কাল তাকে নির্মমহন্তে বিধ্বস্ত করা হল। এটা হবেই। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না। ধর্মগত বিদ্রোহের সংগে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিদ্রোহের যােগ আছে। অর্থনীতি যাতে ভাল ব্যবস্থার কাহারে বুদ্ধের একটি মূর্তি ওপর গড়ে ওঠে তারই চেষ্টার সংগে আমরা দেখতে পাই ধর্মের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহের সূচনা। বাস্তবিক, ধর্ম হল মানুষের গড়া, তার পরিবর্তন হয়েছে হবেও; সম্বন্ধ রয়েছে পরিবর্তনশীল সমাজের সংগে।

 যখন আমি মূর্তিটি পর্যবেক্ষণ করছিলাম তখন কয়েক জন লোক আমাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছিল। আমার দেখা শেষ হয়ে গেলে পাহাড় থেকে নেমে আসার পর দর্শকগণ জিজ্ঞাসা করলেন “এই মূর্তিতে কি কিছু আছে?” এটা কি একটা ভূত? এটাকে এখনও আফগান সরকার রক্ষা করছেন কেন? এটা তত হিন্দুরও দেবতা নয়?” আমি তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুধু বলেছিলাম “লেখাপড়া শিখুন তারপর সবই জানতে পারবেন। সে দিনের কর্মতালিকা সেখানেই শেষ করি।”

 বুদ্ধদেবের মূর্তির পাশ দিয়েই একটা বড় রাস্তা চলে গেছে। সেই পথ ধরে চলায় সময় একটি বিদ্যালয় দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে শুনলাম এখানে যে-কটি বিদ্যালয় আছে তাতে উচ্চশিক্ষার বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই দেওয়া হয়। কয়েকটি বিদ্যালয় বেড়িয়ে এসে বুঝলাম শিক্ষার মান এখানে বড়ই নীচু। হিন্দুদের ছেলেরা স্কুলে যায় না, তারা ঘরে বসেই লেখাপড়া করে। এটা কেন করে তা জানতে গিয়ে বুঝেছিলাম আভিজাত্য এর কারণ নয়, ইসলামধর্মের প্রতি বিতশ্রদ্ধাই তার একমাত্র কারণ। সাধারণ মজুরের ছেলের সংগে বসে লেখাপড়া শিক্ষা করাটাও ভাল নয় বলেই এখানকার হিন্দুরা মনে করে। সেটাও সাধারণ হিন্দু ছেলেদের স্কুলে না যাবার কারণ হতে পারে। আমি একদিন জনৈক হিন্দুকে বলছিলাম “ঘরে বসিয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনাদের ছেলেরা লোকের সংগে মেলামেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদ্যালয়ে ব্যায়াম শিক্ষার সুবন্দোবস্ত আছে, সেখানেও তারা স্বাস্থ্য-চর্চার সুযোগ লাভ করতে পারত। হিন্দু ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া অনাবশ্যক মনে করেন।

 আফগানিস্থানেও মধ্য-ইউরোপীয় প্রথামত ছাত্রদের পৃথক পোশাক পরতে হয়। প্রত্যেক ছেলের মাথায় ফেজ অথবা পাগড়ীর বদলে মধ্য-ইউরোপীয় প্রথায় টুপি পরতে হয়। নিয়মটি বড়ই সুন্দর। এখানে কিন্তু কোন ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে হয় না। প্রত্যেক ছেলেকে বুট-পট্টি লাগিয়ে স্কুলে যেতে হয়। আফগানিস্থানের শিক্ষাবিভাগে জার্মান, তুর্কি এবং আংশিক ভাবে ফ্রেঞ্চ প্রথা প্রচলিত হওয়ায় স্কুলে সাম্প্রদায়িক ভাব মোটেই জাগতে পারে না। উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে হিন্দু ছেলেরাও যায়।

 কান্দাহারে যখন নানা বিষয়ের তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম একদিন সকাল বেলা একটি হিন্দু পথে চীৎকার করে বলে যাচ্ছিল, “এক বাংগালী বন্দী মর গিয়া, শ্মশানমে চলিয়ে।” কথাটা শুনেই ভোলানাথকে জিজ্ঞাসা করলাম “এখানে বাংগালী বন্দী এল কোথা হতে?”

 ভোলানাথ বললেন, যে লোকটি মরেছে সে বাংগালী বলে কোন প্রমাণ নেই, তবে সবাই অনুমান করে লোকটি বাংগালীই হবে নতুবা এরূপভারে মরত না। ভোলানাথ বলছিলেন “দুটি সন্ন্যাসী সীমান্ত পার হয়ে আফগানিস্থানে প্রবেশ করে। প্রচলিত আইন মতে এসব আইন-ভংগকারীদের কয়েকদিন জেলে রেখে আবার চামন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব লোকের আহারাদির বন্দোবস্ত আমরাই করে থাকি এবং যখনই এরূপ লোকের আগমন সংবাদ আমাদের দেওয়া না হয় তখনই আমরা মনে করি নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। এরূপ অনেক ঘটনা ঘটেছে। তারপর কি হয়ে গেল বলতে পারি না, একদিন সব কয়েদী মিলে এদের দুজনকে খুব এক চোট প্রহার করল। তারই ফলে একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই লোকটি মনের দুঃখেই বোধ হয় কোন ঔষধ না খেয়ে শীতের রাত্রে বরফের ওপর শুয়ে থেকে শেষটায় নিমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। যখন লোকটি শীতে বরফের উপর বসে থাকত তখন কয়েকজন প্রহারকারী কয়েদী তাদের অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চায়। তাই আমাদের সে সংবাদ দেয়। আমরা তাদের জন্য খাবার পাঠাতে থাকি কিন্তু যাকে বাংগালী বলে সন্দেহ করা হয়েছিল সে আর কিছু খায় নি। এরই মাঝে এই লোকটিকে আবার প্রহার করবার জন্য যখন কয়েকটা কয়েদী পরামর্শ করছিল, তখন অন্যান্য কয়েদীরা তাতে বাধা দেয় এবং তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে। সবাই বুঝতে পেরেছিল, জেলের বার থেকে অন্য কেহ বাংগালী কয়েদীর জীবননাশের চেষ্টা করছিল।

 একদিন স্থানীয় হিন্দুরা যখন আধমরা লোকটির কাছে খাবার নিয়ে রেখেছিল, তখন কোথা হতে একটা কয়েদী এসে খাদ্য কেড়ে নিয়ে যায়। অন্যান্য কয়েদী সেই সংবাদ অবগত হয়ে তাকে শাস্তি দেবার জন্যই অর্ধমৃত লোকটির শুশ্রুষায় তাকে নিযুক্ত করে। তাতে ফল খারাপই হয়েছিল। অর্ধমৃত লোকটি দণ্ডিত কয়েদীকে কাছে দেখলেই অবোধ্য ভাষায় কি গালি দিত এবং হিন্দিতে বলত “তুই আমার সামনা হতে চলে যা, তুই পশু, টাকার গোলাম, তোর মুখ দেখতে ঘৃণা হয় ইত্যাদি।” অন্যান্য কয়েদীরা শেষটায় ঐ কয়েদীকে আর তার কাছে যেতে দিত না। বিনা চিকিৎসায় অনশনে থেকেই লোকটির মৃত্যু হয়েছিল।

 সেদিনই আমি বৃটিশ কনসালের নিকট বাংগালী বলে কথিত কয়েদীর মৃত্যুর কথা উত্থাপন করি। কনসাল ছিলেন একজন ভারতীয়। তিনি মৃত লোকটিকে বাংগালী বলে অস্বীকার করেন। তাঁর কথার ওপর আমার কোন তর্কই খাটে না। সেজন্য এ বিষয়ে আর ব্যর্থ চেষ্টা না করে গভর্ণরকে বলে কয়ে অন্য কয়েদীটিকে জেল হতে খালাস করে চামন পাঠিয়ে দিলাম। এই কয়েদীটি সত্যই বাংগালী ছিল কি না কে জানে, তবে কান্দাহারের লোকের ধারণা মৃত লোকটি বাংগালী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেই সময়ে অনেক বাংগালী যুবক স্বদেশ হতে বিদেশে যেয়ে শিক্ষার পথ প্রশস্ত করতেন। সেই শিক্ষা বি, এ, এম, এ, পাশ নয়। রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন। বৃটিশ সেই জিনিসটা বুঝতে পেরেছিল এবং তার ফলে কৌশলে বাঙ্গালী এবং পাঞ্জাবী বিপ্লবীদের প্রতি যখনই সন্দেহ হ’ত তখনই হত্যার ব্যবস্থা করত।

 এখানে হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকারের বেশ সুন্দর বন্দোবস্ত আছে। স্থানটা সহরের কাছেই। দারওয়ান মুসলমান। সৎকার-স্থানের চারদিকে ফল ও ফুলের বাগান এবং বসবার সুবন্দোবস্ত ও রয়েছে। স্নানের জন্য গরম জলের বড় টব মজুত ছিল। কাঠও অনেক জমা করে রাখা ছিল। সহরের এত কাছেই হিন্দুদের সৎকারের স্থান থাকা সত্বেও স্থানীয় মুসলমানরা কোনরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করে না। দারওয়ান শ্মশানভূমির চারদিকের ফলের-বাগান বিক্রি করে বৎসয়ে প্রচুর টাকা পেয়ে থাকে। আমাকে দেখা মাত্র সে ভেবেছিল আমি হয়তো একজন সেপাই হব, তাই প্রবেশ করতে দিতে আপত্তি করছিল। কিন্তু অন্য লোক এসে আমার পরিচয় দেওয়ায় প্রবেশপথ উন্মুক্ত হল।

 কান্দাহার এক আজব সহর। এখানে নানারূপ গুজব দেশ-বিদেশ হতে আমদানি হয়ে নতুন আকৃতি ধারণ করে। আমি আড্ডায় বসে তাই শুনতাম। একদিন একজন হিন্দু ভদ্রলোক বললেন, গুজব বিশ্বাস করে ১৯১৭ সালে তিনি প্রায় দুই লক্ষ রুশদেশীয় কাগজের রুবুল কিনেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন একদিন কাগজের রুবুল বদলি করে সোনা যোগাড় করবেন, কিন্তু দুঃখের সহিত জানালেন এসব কাগজ বর্তমানে দেরাজেই আছে, এক পয়সা দিয়েও তা কেউ কিনবে না। মনের দুঃখে তিনি আমাকে একখানা একশত রুকূলের নোট দিয়েছিলেন।

 আড্ডায় বসে নানারূপ গল্প শুনতাম আর পেয়ালার পর পেয়ালা চা খেতাম। একদিন আড়াতে একটা মজার ঘটনা ঘটল। পূর্বেই বলেছি বাবা ভোলানাথ বতর্মান যুগের লোক। তিনি অতীতকে ভুলতে চান আর বতর্মানকে বরণ করতে চান। একজন ভদ্রলোক এসে বাবা ভোলানাথের পা ছুঁয়ে কি বললেন তার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। ওদের কথা যখন শেষ হয়ে গেল তখন ভোলানাখ বললেন, কি করব ভাই মাথার মাঝে আক্কেল নেই বললেও চলে। ঐ লোকটিও হিন্দু। সে গোপনে একটি বিধবার প্রতি আসক্ত ছিল। স্ত্রীলোকটির সন্তান হবার সম্ভাবনা হয়েছে অথচ এদিকে বিয়ে হবার নামটি নেই। এখন এদের একটিমাত্র পথ খোলা রয়েছে, যদি সন্তানটি রক্ষা করতে হয় তবে প্রকাশ্যে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান প্রথামতে বিয়ে করা, এ ছাড়া আর কোন পথ নেই। এখানে আর্যসমাজীও নেই যে এর বন্দোবস্ত করতে পারে।

 যারা আড্ডাতে বসেছিলেন তাদের সকলকেই জিজ্ঞাসা করলাম। বলুন ত এ সম্বন্ধে এখানকার আইন কি বলে?

 এখানকার প্রথা এই যে, যদি কেউ গোপনে অন্য স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট করে তবে আইনমতে সে স্ত্রীলোকটিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

 আইন জেনে নিয়ে বল্‌লাম “স্ত্রীলোকটি বিচারপ্রার্থী হোক এবং কাজি যখন পুরুষটিকে বিয়ে করতে বলবেন তখন সে যেন তৎক্ষণাৎ রাজি হয়। তখন কথা হবে কোন্ ধর্মমতে বিয়ে হবে?” আমি বল্‌লাম “সে যেন তখন মুসলিম ধর্ম মতে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তা হলে কাজি হিন্দুমতে বিয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে বাধ্য হবেন।”

 আমার প্রস্তাব মত স্ত্রীলোকটি বিচারপ্রার্থী হয়েছিল। কাজি হিন্দুদের হিন্দুমতে বিয়ে করিয়ে দিতে আদেশ করেন। হিন্দুটি রাজি হয়েছিল, বিয়ে হয়ে গেছে বলে স্বীকারও করেছিল, কিন্তু কাজে কিছুই করেনি বলে শুনেছিলাম।

 অতি কম লোকই ঐসব ব্যাপারে বিচারপ্রার্থী হয়। অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে। এরূপ করেই কান্দাহারে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমার মনে হয় পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যেই কান্দাহার হতে হিন্দু লোপ পাবে। কারণ এখানে কোনরূপ সামাজিক পরিবর্তন হিন্দুদের মধ্যে মোটেই আসছেনা।

 কান্দাহারে একমাস থাকার পর শরীর সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু হিরাতের পথ তখনও জলে ভর্তি ছিল। সেজন্য আরও এক সপ্তাহ কান্দাহারের পথে-ঘাটেই বেড়িয়ে কাটাতে হল। এই একটি সপ্তাহ হিন্দুদের সংশ্রব পরিত্যাগ করে মুসলমানদের পাড়ায় এবং নিকটস্থ গরিব লোকদের গ্রামেই কাটিয়েছিলাম। গ্রামের লোক ইউরোপীয় পোশাক অনেকেই পছন্দ করত না এবং আমার কাছে অনেকেই বলত এ পোশাক এদেশে ভাল মানায় না। আমি ওদের ধর্মযাজকদের সামনেই বলতাম, ইউরোপীয়ান পোশাকই এদেশের পক্ষে উপযুক্ত এবং যুক্তি দিয়ে তা বুঝিয়েও দিতাম। কতৃপক্ষ একদিনও আমার এরূপ উক্তির কোনরূপ প্রতিবাদ করেন নি, কিন্তু একটি ভারতীয় চাপরাশি একদিন আমার কথার প্রতিবাদ করেছিল।

 বনভোজন করার জন্য সেদিন আমরা এক গ্রামে গিয়েছিলাম। সংগে করে একটা জ্যান্ত মোরগও নিয়েছিলাম। মোরগটা হত্যা না করে সংগে নিয়ে যাবার একমাত্র কারণ গ্রামে মোরগটার গলা না কেটে এক কোপে কাটলে গ্রামবাসী রাগ করে কি না দেখতে চেয়েছিলাম। আমার সংগীরা এক কোপে কখনও মোরগ কাটে নি; সেজন্য আমাকেই সে-কাজটি সম্পন্ন করতে হয়েছিল। দুএকজন গ্রামের লোেক মোরগ-হত্যা দেখেও ছিল, কিন্তু তারা কেউ কিছু বলেনি। কান্দাহারের হিন্দুরা বলে, মুসলমানরা তাদের অমতে কোন জীবকে হত্যা করতে দেয় না সেজন্য তারা জীবহত্যা করা বন্ধ করে দিয়েছে। পরে বুঝেছিলাম হিন্দুরা মাংস খেতে খুব ভাল করেই জানে কিন্তু ঠেকায় পড়লেও তারা মোরগ হত্যা করতে সক্ষম হয় না। এরূপ যাদের দুর্বল মন তারাই নিপাত যাবার উপযুক্ত। এরূপ আয়েসী লোকের বেঁচে থাকা মানে ভূ-ভার বৃদ্ধি করা।

 যে গ্রামে বনভোজন করতে গিয়েছিলাম সেই গ্রামের লোক দেখতে বড়ই নিরীহ কিন্তু তাদের মন ভীরু নয়, সজাগ এবং সাহসী। আবাদি-ভূমি কোন মতেই কারো কাছে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। আবাদি-ভূমি নিজের হাতে রাখবার জন্য সর্বদাই শস্যবীজের মত ঘরে অস্ত্রও মজুত রাখে। দরকার হলে গ্রামকে গ্রাম ছাউনীতে পরিণত করতে পারে। গ্রামের লোক সুখী তবে তাদের প্রাচুর্য নেই। গ্রামে ধর্মের গোঁড়ামি ছিল না। তারা সহরের মোল্লাদের মত মালা টপকাবার ফুরসত পায় না। মালা টপকানোটা আফগানিস্থানে একটি ফেশন এবং এখনও সেটা আছে। যে কেউ একটু আরামের মুখ দেখে সেই অমনি মালা কিনে টপকাতে শুরু করে দেয়। রাজকর্মচারী হতে সাধারণ ধনী পর্যন্ত সবাইকে এই কর্মে লিপ্ত দেখা যায়। যে কয়েক দিন গ্রামে ছিলাম সেই দিনগুলি আনন্দেই কেটেছিল।

 গ্রাম হতে ফিরে এসে আড্ডায় বসে কান্দাহার ছেড়ে হিরাতের দিকে যাবার কথাই ভাবছিলাম এমন সময় ইয়াকুব এসে হাজির। তাকে দেখেই আমার ইচ্ছা হল তাকে কাছে এনে বসাই কিন্তু আমাকে সে যে পরিচয় দিল তাতে তার ওপর মন বিরূপ হয়ে উঠল। সে সহকারী মোটর ড্রাইভারের কাজ নিয়েছিল। এখন সে সাধারণ মজুর কিম্বা কৃষকও নয়। সহকারী মোটর ড্রাইভারের কাজ যারা করে, তাদের অনেক সময়ই লোকে অসৎ চরিত্র বলে গণ্য করে। সুতরাং এ ধারণা মনে বদ্ধমূল হওয়া অসংগত নয়, এবার ইয়াকুবের চরিত্র কলুষিত করতে বসেছে। সে আমাকে বললে “শুনেছি, আপনি নাকি হিরাত যাবার মোটর খুঁজেন, আমাদের একখানা মোটর আছে। যদি আপনি আমাদের মোটরে হিরাত যান তবে সুখী হব। তৎক্ষণাৎ তার সংগে মোটরের ভাড়া ঠিক করে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে তার মোটর কোথায় আছে দেখবার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। আড্ডা হতে বের হয়ে এসেই ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কেমন আছে, এতদিন কোথায় ছিল—ইত্যাদি?

 সে আমাকে জানালে লেখাপড় যা শিখেছে তাই যথেষ্ট। এখন সমুদয় আফগানিস্থান বেড়িয়ে তারপর সীমান্ত দেশগুলি দেখে রাজনীতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। সেজন্যই সে এই রকমের কাজ জুটিয়েছে। ছাত্র হয়ে ঘুরে বেড়ানো সন্দেহ উৎপাদন করে।

 মোটরের আড্ডা দেশি দূরে ছিল না। আমরা সেখানে কয়েকজন আফগান ড্রাইভারকে জুয়া খেলায় ব্যস্ত দেখলাম। তারা অনেকেই আমাকে একজন সহকারী কর্মচারী বলে মনে করেছিল কিন্তু ইয়াকুব আমার পরিচয় দেওয়ায় তারা আবার নিশ্চিন্ত মনে জুয়ায় মেতে উঠল। মোটরের আড্ডায় বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। পথে ইয়াকুবকে বললাম, এদের হাত হতে তোমাকে বাঁচতে হবে। যদি আত্মরক্ষায় অক্ষম হও তবে ভবিষ্যতের আশা-ভরসা চিরজীবনের তরে লোপ পাবে। সে ঘাড় নেড়ে জানালে, তথাকথিত হীনবৃত্তি অবম্বন করলেও মহান আদর্শবাদ দ্বারা সে অনুপ্রাণিত, কলুষ-কালিমা তার চরিত্রকে স্পর্শও করতে পারবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে স্ব-ইচ্ছায় হীনবৃত্তি অবলম্বন করেছে নিজের দেশকে জানাবার জন্য। এমন লোকের সহযাত্রী হওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।

 এখানকার হিন্দু যুবকদের একাদশী ক্লাব নামে একটি ক্লাব আছে, কান্দাহার ছাড়বার পূর্বে ক্লাবের মেম্বারগণ আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন। আমিও নিয়ম রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। আসরে হাজির হবার পর সর্বপ্রথম স্বাগত করা হল কিন্তু সত্বরই আমি বিদায় নেব জেনে সমবেত যুবকগণ দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তখনও আমি একাদশী ক্লাবের স্বরূপ বুঝতে সক্ষম হইনি।

 আমার কথা শেষ হবার পর, পেয়ালাভর্তি করে সবাই ভাং খেতে আরম্ভ করল। আমাকেও খেতে দেওয়া হয়েছিল, আমি কিন্তু এই নিকৃষ্ট পানীয় গ্রহণে রাজি ছিলাম না। গাঁজাও শুরু হল। গাঁজার গন্ধ অসহ্য হয়ে ওঠায় সভা ত্যাগ করলাম। পর্যটককে নানা প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়। পর্যটকের স্বাস্থ্য ঠিক না রাখতে পারলে পর্যটন অসম্ভব। দুর্গমপথে চলবার পক্ষে স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি। সেজন্যই অভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে একাদশী ক্লাব পরিত্যাগ করতে হল।

 একাদশী ক্লাবে যেতে হিন্দু যুবকদের কোনরূপ নিষেধ নাই। সবাই জানে একাদশী ক্লাবে কি হয়, অথচ হিন্দু সমাজ এই ক্লাবকে বিনা প্রতিবাদে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এদের সভা ছেড়ে পথে দাঁড়ালাম এবং কতক্ষণ মুক্ত বাতাস সেবন করে আশ্রমে ফিরলাম। ভোলানাথ আমাকে দেখেই বললেন “আমি ভাল করেই জানি আপনি বেশিক্ষণ বসতে সক্ষম হবেন না। কি জঘন্য মনোবৃত্তি এখানকার হিন্দু যুবকদের! যাদের যৌবন শুধু ইন্দ্রিয় সুখভোগে, সেই মেকাণ্ড হীন যুবক তার দেশ বা জাতির কি কোন কার্য হতে পারে?”

 ভোলানাথকে ছেড়ে আসতে আমার বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তা হলে কি হবে। আমার কাছে ঘরের মায়ায় চেয়ে পথের আকর্ষণই প্রবল; তাই পথেই এসে পড়লাম। সাথী পেলাম ইয়াকুবকে। আমার সাইকেল চালিয়ে ইয়াকুব মোটমের সংগে পাল্লা দিচ্ছিল। ভাবি নি সাইকেল মোটরের সংগে টেক্কা দিয়ে আগে যেতে পারবে। শহর হতে বের হয়ে বড় জোর দু’ মাইল পথ ভাল পেয়েছিলাম তারপরই মোটরের চাকা কাদায় ডেবে যাচ্ছিল। দেখলাম এরূপ অবস্থায় যদি মোটরে বসে থাকি তবে হয়তো আবার পায়ে ব্যথা শুরু হবে। সেজন্য ইয়াকুবের কাছ হতে সাইকেল নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম। কথা রইল সন্ধ্যার পূর্বে আমার কাছে মোটর না পৌছলে আমিই ফিরে আসব।

 সেদিন আমাদের গৃস্ক নামক স্থানে পৌছবার কথা ছিল; কি গৃস্ক পৌঁছান হয় নি, পথেই রাত কাটাতে হয়েছিল। আমাদের সংগে প্রচুর খাদ্য ছিল, পথে কোনও কষ্ট হয় নি। গৃস্ক ও কান্দাহারের মধ্যে কোন গ্রাম ছিল না। কাঁকর এবং কাদায় পূর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তর। এমন পথে চলা কত আরামের! এর প্রথম কারণ উন্মুক্ত প্রান্তরে চলা এবং অপরিচিত লোকের সংগে পরিচয় করা একটি আর্ট। এই আর্ট যার জানা নাই সে কখনও পথের সুখ অনুভব কতে পারবে না। আমার চলার সময় সংগে ছিল একটি শিক্ষিত আফগান যুবক; তার সংগে কথা বলে আমার সময় আনন্দের সহিত অতিবাহিত হ’ত। পথে দুদিন কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকাল বেলা আমরা গৃস্ক পৌছলাম। সেখানে আমরা একটি ছোট ঘর ভাড়া করে সারাদিন বিশ্রাম করলাম। ড্রাইভার বিশ্রাম করবার ফুরসৎ পেল না। সে মোটর পরিষ্কার করতে লাগল।

 গৃস্ক ছোট গ্রাম, লোকসংখ্যা হাজারের বেশি নয়। বেলুচিস্থান হতে উটের পিঠে পণ্যদ্রব্য আমদানি-রপ্তানির ফলে এ স্থানটি একটি বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। গ্রামের মাঝ দিয়ে একটা প্রশস্ত পথ, তারই দুদিকে ছোট ছোট মেটে ঘর। কোনটাতে দোকান আর কোনটাতে ছোট ছোট কারখানা। কারখানা গুলিতে দুম্বার লোমের কম্বল, দস্তানা, পৌস্তিন এসব প্রস্তুত হচ্ছিল। ইয়াকুবের সংগে গ্রামখানা বেড়িয়ে আসলাম। গ্রামে দ্রষ্টব্য বিশেষ কিছুই ছিল না। দেখলাম গ্রামবাসীরা সবাই দারিদ্র এবং অজ্ঞানতার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। ইয়াকুব বল্‌ছিল এখান হতে একটি পথ বেলুচিস্তান পেরিয়ে সাগরতীর পর্যন্ত গিয়েছে।

 গৃস্কের পর হতেই শুরু হল কর্দমাক্ত পথ। পথে মোটর চলতেও পারে না। সেজন্য সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তিরিশ মাইল পথ এগিয়ে গিয়েও এমন একটা স্থান পাইনি যেখানে আশ্রয় নেওয়া যায়। উত্তর দিকে ঢেউ-খেলানো সারি সারি পাহাড়, দক্ষিণ দিকে যতদূর দেখা যায় অনন্ত প্রসারিত প্রান্তর ক্রমনিম্নভাবে। দিগন্তে মিশেছে। দুদিকের দৃশ্যাবলীই নয়নমুগ্ধকর। কিন্তু ভাবনা হল তিরিশ মাইল পথ অতিক্রম করে মোটরকার আসতে সক্ষম হবে কি না?

 যাহোক বিকালের দিকে মোটর এসে পৌঁছল। আমি তাতে উঠে বসলাম এবং আরও এগিয়ে গিয়ে একটি রুতবায় আশ্রয় নিলাম। পূর্বাকালে বৈদেশিকরা ভারত আক্রমণের সময় পথে ঘরবাড়ী করেছিল। তার এখন অস্তিত্ব নেই, শুধু ইটের স্তুপ পড়ে আছে। কোন কোন রুতবায় লোকজন নেই, কোথাও বা কয়েকজন লোক এক পয়সার জিনিস পাঁচ পয়সায় বিক্রি করবার জন্য বসেছিল। আমাদের কাছে সকল জিনিসই ছিল। তাদের মনোকষ্ট লাঘব করবার জন্য এক ডজন ডিম কিনলাম।

 এভাবে চলে আমরা সাবজাওয়ার নামক স্থানের কাছে এসে পৌঁছলাম, এদিকের পথও মোটর চলাচলের পক্ষে উপযোগী নয়। এখান হতে ইয়াকুবকে নিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে কখনো বা সাইকেলে চড়ে সাবজাওয়ারের দিকে অগ্রসর হলাম। কতক্ষণ যাবার পর উপর হতে একখানা গাড়ী আসতে দেখলাম। গাড়িখানা আমাদের কাছেই দাঁড়াল। সামনের সিটে বসেছিলেন একজন ইহুদী। তাঁর মাথায় লাল ফেজ। ফেজের নীচটা একটি পাগড়ি দিয়ে বাঁধা। দাড়ি গোঁফ মোল্লা-ফেসনে ছাঁটা। পরনে পাজামা। ভদ্রলোক গাড়ী হতে নেমেই ইংলিশে জিজ্ঞাস করলেন—আপনি ইংলিশ বোঝেন?।

 —নিশ্চয়ই।

 —এই লোকটি কে?

 —এটি আমার সাথী, এ দেশের বাসিন্দা।

 —আপনার দেশ কোথায়?

 —কলিকাতা।

 —মাথায় হ্যাট পরেই আসছেন না কি?

 —হাঁ, মহাশয়।

 —পথে আপনার গলা কেউ কাটতে আসে নি?

 —না মহাশয়।

 —আপনি মুসলমান?

 —না

 —কলিকাতা থেকে হেঁটে এসেছেন?

 —না, কতকটা হেঁটে, কতকটা মোটরে, কতকটা সাইকেলে।

 ভদ্রলোক ড্রাইভারকে চা বানাতে বলে আমাকে টেনে নিয়ে একটা টিলার উপর বসলেন। তিনি একজন আমেরিকান্ কণ্ট্রাকটার, আফগানিস্থানে জলের ডেম্প তৈরী করতে যাচ্ছেন। তাঁকে লণ্ডন, পৈরী ইতাদি স্থানের লোক বলেছে যে আফগানিস্থান এখনও অসভ্যদের দ্বারা অধ্যুষিত। সেখানে খৃষ্টানদের প্রবেশ নিষেধ। যেতে হলে মুসলমান পোশাকে যেতে হবে।

 তাঁকে বললাম তিনি আফগানিস্থান সম্বন্ধে যা শুনেছেন তা একদম মিথ্যা। এখানে চোর ডাকাত পর্যন্ত নেই। আমার কথা আমেরিকান কণ্ট্রাকটারের বিশ্বাস হল এবং আমারই সামনে দাড়ি সাফ করে ফেললেন। পাজামা খুলে ফেললেন। নেকটাইটি এঁটে বাঁধলেন। আমরা তার সংগে চা-পান করে, পথের ঠিক সমাচার জানিয়ে সবজাওয়ারের দিকে রওনা হলাম। আমরা কিছু দূর যেতে না যেতেই আমাদের মোটরও পৌছে গেল।

 সবজাওয়ার ছোট একটি রুতবা। তাতে দশ পনর জন লোকের বাস। রাত কাটিয়ে পরের দিন আমরা ক্রমনিম্ন অথচ ভাল পথ ধরে চলতে থাকি। বহু দূর হতে মনে হচ্ছিল হিরাত সহর একটি কমলালেবুর খোষার ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত। চারি দিকের পাহাড় হতে নির্গত জলরশি বের হয়ে যাবার জন্য একটা পাহাড় যেন ফাঁক হয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে জলরাশি নীচে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা তখনও হিরাত হতে বহু দূরে ছিলাম; সেজন্য নির্গত জলরাশিকে একটি আঁকাবাকা রজতসূত্র বলেই মনে হচ্ছিল। আমাদের গাড়ির তেলের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হল। গাড়ি আপনা হতেই নীচে নামতে আরম্ভ করল। দুঃখের সহিত বলছি পথের দু’পাশে একটিও ফলের বাগান দেখতে পাই নি। জমি উর্বর অথচ বৃক্ষ না থাকার কারণ কিছুই বুঝতে পারি নি। আমাদের লরী ধীরে ধীরে সহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। দু’দিকে মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। আফগানিস্থানে মানুষ এত কম থাকার কারণ বুঝতে বাকি ছিল না। এই দেশটাই হ’ল আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীর দেশ অতএব মানুষ স্বাধীন মনে সর্বত্র বসবাস করতে পারছিল না। পথে যে কয়েকটি লোকালয় পেয়েছিলাম প্রত্যেক বসতিতে মিশ্র জাতের লোকই বেশি দেখতে পেয়েছিলাম। এই বিষয়গুলি ও ইয়াকুবকে বলতে ভুলি নি। অবশেষে আমরা তথাকথিত সহরে পৌছলাম এবং একটি গারাজে সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রাম করলাম।