বিষয়বস্তুতে চলুন

আফগানিস্থান ভ্রমণ/গজনী

উইকিসংকলন থেকে

গজনী

 গজনী এবং সোমনাথ পাশাপাশি চলছে। গজনীর নাম শুনা মাত্র যে কোন ভারতবাসী বলবে, “সেই গজনী যেখান থেকে সুলতান মামুদ সতেরবার সোমনাথ আক্রমণ করেছিলেন।” যদি কথাটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ওঠে তবে অমনি দুঃখের কালিমা সকলের মুখে ফুটে উঠবে। মুসলমান যদি একই বিষয় আলোচনা করে তবে উদ্দীপনার ভাব দেখা দিবে। যেদিন কাবুল হতে কান্দাহার রওন হই সেদিন আমার মনে গজনী সম্বন্ধে কি ধারণা হয়েছিল তাই বলা, অন্যের কথা চিন্তা করে কি লাভ হবে।

 ভাবছিলাম আসামাই মন্দিরের ভেতর দিয়ে যে নালা বয়ে যায় তাতে হিন্দু এবং মুসলমান বসন্ত হতে রক্ষা পাবার জন্য ঘোল ঢালে। এই দেশের লোকই গজনীর সুলতান ছিলেন। তারপর ভাবছিলাম আফগানিস্থানের যে দরিদ্র লোক না খেয়ে মরছে, তারা হিন্দু না মুসলমান? আগে বাঁচতে হবে তারপর ধর্মের প্রশ্ন। কিন্তু পুরোহিত, মোল্লা এবং পাদ্রী সেকথা মানুষকে ভাবতে দেয় না, পরজন্মের চিন্তায় ডুবিয়ে রাখে এবং তাদেরই সামনে ধরে তুলে সুলতান মামুদের মত ধর্মোন্মাদের বীরত্ব কাহিনী। আমার মনে গজনীর সুলতান অথবা সোমনাথ রেখাপাতও করতে পারছিল না। আমি ভাবছিলাম দেখতে হবে কি করে এদেশ হতে দ্রাবীড় সভ্যতা লোপ পেল, দ্রাবীড়গণ কি করে শ্বেতকায়দের সংগে মিশে গেল। যাকে ধর্ম বলে এত হাল্লা করা হয় সেটাত হল সেদিনকার সৃষ্ট কতকগুলি রীতি এবং নীতি। কিন্তু যখন ধর্ম বলতে কিছু ছিল না, যখন ছিল শুধু গোষ্টি তখন কি করে একে অন্যকে ধ্বংস করে জাতের সৃষ্ট করেছিল?

 তারপর বর্তমান যুগ। বাস্তবিকই আফগানিস্থানের পাহাড়িয়া অঞ্চল স্বাস্থ্যপূর্ণ স্থান। এদেশে কেন এখনও আর্থিক উন্নতি হয় নি? অথচ এরা ইন্দো-এরিয়ান্। ইন্দো-এরিয়ান্‌রা সর্বত্র উন্নতি করেছে। এখানে কোন দোষে তারা একেবারে আদিমযুগে পড়ে আছে?

 বাস্তবিক পক্ষে ভারতে নানা জাতের বাস। ভারতে দ্রাবিড়কৃষ্টির প্রাধান্য ছিল। আফগানিস্থানেও দ্রাবিড়দের প্রাধান্য ছিল এবং সেখানেও দ্রাবিড় এবং ইন্দো এরিয়াম-এ মিশ্রণ হয়েছিল। তাই দেখছিলাম এবং পথ চলছিলাম। যখনই দেখতাম একজন ইংলিশম্যান্ পাজামা, কামিজ এবং মাথায় পাগড়ী বেঁধে খালি পায়ে বসে আছে তখনই ভাবতাম এরূপ কেন হয়? এরা ইংলেণ্ডের ইংলিশ না হয়ে মালা টপকাচ্ছে কেন? ভাবতাম এদের কাছে বোধহয় সাগর নেই সেজন্যই নরডিক্ হয়েও দ্রাবিড় সভ্যতার কাছে মাথা নত করছে। দ্রাবিড় সভ্যতায় আছে শুধু গঠন। কিন্তু ছিল না বিপ্লব এবং এখনও নেই বিপ্লব। আফগানিস্থানে অনেক যুদ্ধের সংবাদ পাওয়া যায়। সিয়া-সুন্নিতে যুদ্ধের ইতিহাস আছে, সুলতান মামুদের সোমনাথ আক্রমণের কথা আছে কিন্তু সামাজিক অন্তর্বিপ্লবের কোন নিদর্শন দেখতে পাই নি।

 আমানউল্লা অন্তর্বিপ্লবের সূচনা করেন, বৃটিশ সেই অন্তর্বিপ্লব দাবিয়ে দেয়। এরূপ হল কেন? এটা কি দ্রাবিড় সভ্যতার প্রভাব না আর কিছু? সিমেটিক সভ্যতার উপর দ্রাবিড় প্রভাব প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে এবং সেজন্যই আমরা মক্কাতে কাবা মসজিদ দেখতে পাই, এখানেও কি তাই? কাবুল হতে হিরাত পর্যন্ত বেড়িয়ে দেখলাম আমার ধারনাই ঠিক। যে সভ্যতা সিমেটিক সভ্যতার উপর প্রবল আঘাত করেছিল সেই সভ্যতা ও ইন্দো-এরিয়ান সভ্যতা এখানে এমনি আঘাত করেছিল যে সাংখ্য নামে প্রবল প্রতাপান্বিত দার্শনিকও সেই প্রভাব এড়াতে পারেন নি। অবশেবে বলেছেন, “কি জানি, এক্স পরে-ত কিছুই বলতে পারি না।”

 অধিকরাত্রে আমরা গজনী পৌঁছলাম। কোথাও না থেমে সরকারী হোটেলের দরজায় গাড়ি থামানো হল, ইচ্ছা সেখানে রাত্রিবাস করা। গজনী শহরের এটাই হল একমাত্র হোটেল। ফ্রেঞ্চ ধরনে পরিচালিত। আমার কাছে কাবুলের প্রধান মন্ত্রী মহাশয়ের চিঠি থাকায় হোটেলের ভাড়া বাবত কিছুই দিতে হয় নি। বাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্য কয়েকটি মাত্র টাকা খরচ করতে হয়েছিল। খাবার আনবার জন্য হোটেলের বয়কে বাজারে পাঠালাম। ইত্যবসরে আমি জ্যোৎস্নালোকিত গজনী শহরের নয়ন মনোমুগ্ধকর নৈশ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চেষ্টা করলাম।

 কিন্তু পায়ের গোড়ালিতে এমন ব্যথা বোধ করতেছিলাম যে সৌন্দর্য উপভোগ বেশীক্ষণ করা চল্‌ল না। পা থেকে জুতাজোড়া পর্যন্ত খুলতে আমার কষ্ট বোধ হচ্ছিল। বয় খাবার নিয়ে ফিরে এলে তাকে পায়ের ব্যথার কথা বললাম। বয় খাবারগুলি টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রেখে একখানা ছুরি নিয়ে এল। তারপর সে ছুরির সাহায্য জুতার ফিতাগুলি কেটে খুলে ফেলল। আগের দিন ফ্রস্ট-বাইট-এর কথা শুনেছিলাম। আজ বয় আমাকে শুনাল আমার পায়ে ফ্রস্ট-বাইট হয়েছে। কথাটা শুনামাত্রই পায়ের ব্যথা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। চিন্তা হল হয়তো পা দুখানা চির জীবনের মত কেটেই ফেলতে হবে। ভ্রমণ হয়তো এ জীবনের মত এখানেই শেষ করতে হবে। আমাকে চিন্তিত দেখে বয় বললে, চিন্তা করবার কিছুই নেই। আমি এখনি ঔষধ আনছি। এই কথা বলেই বয় একটা বেসিনে করে খানিকটা ফুটন্ত জল এনে তাতে নুন মিশিয়ে দিল। জলটা যখন একটু ঠাণ্ডা হল তখন সে আমাকে গরম জলে পা ডুবিয়ে রাখতে বলল। গরম জলে পা দুখানা ডুবিয়ে রাখার পর ব্যথা অর্ধেকটা কমে গেল। খাবার খেয়ে ফের জলে পা ডুবিয়ে রাখলাম।

 যদিও বয় বেশ ভালভাবেই আমার পরিচর্যা করছিল কিন্তু তার মন ছিল পাপে পরিপূর্ণ। এমন অবস্থাতেও সে আমার কাছে কতকগুলি কুপ্রস্তাব করতে কুণ্ঠা বোধ করে নি। অর্থের অভাবই যে তার একমাত্র কারণ ছিল সে কথা আমি জানতাম।

 পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হল পায়ে ব্যথা আর নেই। আনন্দে বিছানা হতে নেমেই পোশাক-পরিচ্ছদ পরে সুলতান মামুদের কবর এবং অন্যান্য দ্রষ্টব্য দেখতে বের হয়ে পড়লাম। সুন্দর শাদা বরফের ওপর প্রভাত-সূর্যের আরক্ত রশ্মিমালা পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছিল। রংগিন চশমা থাকায় সেই চোখ ঝলসানো সূর্যালোক আমার সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাঘাত জন্মাতে পারছিল না। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে একজন লোক সংগে নিয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করলাম।

 অনেকগুলি পুরাতন ইটের স্তূপ, ভাংগাচোরা পাথর এবং স্থানে স্থানে ইমারতের ভগ্নাবশেষ দেখে মনে হল একদিন যা পরম যত্নে নৈপুণ্য সহকারে গড়া হয়েছিল তাই আর একদিন সময়ের পরিবর্তনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আজ যা ভাল কাল তা মন্দ। আজ যিনি পূজিত কাল তিনি অবহেলিত। পুরাতন চিরকালই নূতনকে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। আমি নূতনকে ভালবাসি। পুরান ধ্বংস হয়েছে বলে আমার মনে কোন দুঃখ ছিল না। যে শিবমন্দিরে হয়তো মুষ্টিমেয় কয়েকজন উপাসনা করত আজ সেস্থানে বিরাট মসজিদ সৃষ্টি হয়েছে। সহস্র সহস্র লোক সেখানে সেই ঈপ্সিত পরমারাধ্যেরই নাম উচ্চারণ করছে। ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডী ঘুচে গিয়েছে, তার পটভূমি হয়েছে বিরাট। পরিবর্তনকে এই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই বিচার করি। কোনো বিষয়েই সংকীর্ণতা আমার অন্তরের সমর্থন লাভ করে না। এটাও জানি অবতারবাদ চিরস্থায়ী নয়।

 পাহাড়ের ওপর আছে একটি প্রকাণ্ড সমতল ভূমি। তারই ওপর পুরাতন একটা স্তম্ভ। স্তম্ভটি সুলতান মামুদ তাঁর জয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ গড়েছিলেন। যুক্ত গাত্রে চিত্রকলার বহু নিদর্শন ছিল। চিত্র দেখে প্রাচীন দ্রাবিড় যুগের বলেই মনে হচ্ছিল। আরব সভ্যতার কোন ছাপ তাতে ছিল না। স্তম্ভটি দেখে মনে হল উন্নত শীর্ষে দাঁড়িয়ে থেকে এটি জয়ের বার্তাই ঘোষণা করছে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে যখন সুলতান মামুদের কীর্তিস্তম্ভ দেখছিলাম তখন একজন পাঠান বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় আমাকে নমস্কার জানিয়ে বললেন “ঐ যে স্তম্ভটা দেখছেন এটা সুলতান মামুদ ভারত-বিজয়ের চিহ্নম্বরূপ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।”

 পাঠানকে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললাম “গজনী ভারতের বাইরে নয়। ভারতের ভেতরে থেকে ভারত-জয়ের স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলবার কোন মানে

হয় না। আবার যখন নৰ প্রাণশক্তি নিয়ে নতুনের আবির্ভাব হবে তখন এই গুজকে নিশ্চিহ্ন করে, আর একটা নতুন স্তম্ভ তৈরি হবে। পুরাতন আইডিয়া আজ ঝাকে জয়ন্তঙ্কের সম্মান দিচ্ছে, আগামী দিনের সেই নতুন আইজি তাকে হয়তো ধূলিসাৎ করে দেবে। আমানউল্লা ছিলেন নতুনের অগ্রদূত। তিনি নতুনের ভিত্তি পত্তন করে গেছেন মাত্র। আবার যখন নতুন এলে প্রচণ্ড আঘাত হানবে তখন পুরাতন চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। আপনারা নতুনের জন্য অপেক্ষা করুন। আমার কথা শুনে পাঠান রুষ্ট হলেন না। আমার হাত ধরে নিকটস্থ মন্দিরে নিয়ে গেলেন।”

 পুরাতন মন্দির—শিবের মন্দির। মন্দিরটি পাথরের আর শিবও পাথরের। মন্দির ও দেবতা আমার প্রাণে যে ভক্তিরসের সঞ্চার করল না, একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ঐ যে পূজারী ঠাকুরটি মন্দিরের একপাশে বসে গাঁজার কলকেতে দম দিচ্ছেন, তাঁকে দেখে আমার মনে প্রচুর কৌতুক রসের উদ্রেক হল। দীর্ঘকালব্যাপী ইসলামিক প্রাধান্যের পরিচয়স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে সুলতান মামুদের যে জয়স্তম্ভ তারই কাছে এসে গাঁজা ফুঁকাও বীরত্বের পরিচায়ক। গাঁজাখোরের সংগে কথা বলতে ইচ্ছা হল। কিন্তু গেঁজেলকে কথা বলতে খুব আগ্রহান্বিত বলে মনে হল না। যা হোক আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম মন্দির সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য তিনি কিছু জানেন কি না? তখন তিনি পোস্ত ভাষায় জবাব দিলেন “সুলতান মামুদের জয়স্তম্ভের ইতিহাস আছে, কিন্তু এই শিবমন্দিরের ইতিহাস কিছুই নেই। মানুষের সভ্যতার সংগে সংগে এর জন্ম হয়েছিল এবং মানুষের ধ্বংসের সংগে সংগেই এরও ধ্বংস হবে।” গেঁজেলের কথায় হাসি পেল খুব কিন্তু শুনে যাওয়াই আমার কাজ। যা শুনেছি তাই যদি ঠিক মত বলতে পারি তবেই আমার কাজের পরিসমাপ্তি হবে।

 প্রবল বেগে হাওয়া চারিদিকে বয়ে চলছিল। উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকতে মোটেই ভাল লাগছিল না। শিবমন্দির দেখে ফেরবার কালে পাঠান আমাকে বললেন, আসুন এবার আমাদের গ্রামে যাই। পাঠানের গ্রামে গেলাম। পাঠান আমাকে একজোড়া হাতমোজা উপহার দিলেন এবং তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তাঁর সংগে কথা হল। পাঠান বললেন “গজনী শহরের কাহিনী বড়ই বিচিত্র। এখানে অনেক বিদেশী এসে বসবাস করেছে বটে, কিন্তু কেউ বেঁচে থাকতে পারে নি। পুরাতন অধিবাসীদের মাত্র কয়েকজন হিন্দুই টিঁকে আছে। আর অন্যান্য যাদের দেখছেন তারা অন্যান্য স্থান হতে এসে নতুন বসবাস করছে। কতবার যে এ শহরের লোক মরে উজাড় হয়েছে তার হিসাব করা যায় না। শেষবার যখন বরফপাতে গজনীর লোকক্ষয় হয় তখন এমনি ভাবে বরফ পড়েছিল যে, কেউ ঘরের চালের ওপরের বরফও পরিষ্কার করতে পারেনি। মাত্র একটি মুসলমান পরিবার বেঁচেছিল। আর বেঁচেছিল কতকগুলি হিন্দু। হিন্দুদের বাড়ীগুলি পাথরের ছিল তাই তারা রক্ষা পায়। যে মুসলমানটি বেঁচেছিল সে ছিল একজন কসাই। সে এক একটি করে দুম্বা কাটত আর তাই ছেলেদের খাইয়ে চালের ওপরকার বরফ পরিষ্কার করতে পাঠাত। এই করেই সে তার ঘর রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।”

 গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলিও রক্ষা পেয়েছিল। হিন্দুদের ঘরের ছাদ কখনও সমান থাকত না ক্রমশ উচু থাকায় বরফ আপনি গড়িয়ে পড়ত। হিন্দুদের অনুকরণে মুসলমানেরা ঘর তৈরী করত না। কি জানি হিন্দুর অনুকরণে ঘর করলে যদি ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হয়। এখানেও মোল্লাইজমের ব্যভিচার ফুটে উঠেছিল।

 যদিও গজনীর একটি হিন্দুও বরফপাতে মারা যায় নি তবুও হিন্দুর সংখ্যা অতি সামান্যই ছিল। অন্যস্থান হতে হিন্দুরা আসেও নি এবং হিন্দুদের সামাজিক কুপ্রথা পরিত্যাগ ও করে নি। মুসলমানেরা অন্যস্থান হতে এসে খালি বাড়ীতে বসবাস করছিল।

 বরফপাত হওয়াটা ধরে নিলাম আল্লার মরজি, কিন্তু ঘর বানানো তো আপনাদের ওপরই নির্ভর করে। পাথরের ঘর তৈরি করেন না কেন?

 পাঠান আমার কথার উত্তর দিতে পারছিলেন না। বুঝলাম আসল কথাটা কি? যেহেতু হিন্দুরা পাথরের ঘর তৈরি করে বাস করে, অতএব মুসলমানের সেরূপ ঘরে বাস করতে নেই, এ ছিল কয়েকজন মোল্লার বিধান। সেই বিধান মানতে গিয়েই এই বিপদকে ডেকে আনা হয়েছিল। আমি যখন পাঠানের সংগে কথা বলছিলাম তখন মোটর ড্রাইভার বললেন “এদিকে আসুন বিশেষ দরকার আছে। হোটলে গিয়াই শুনলাম, বয় নাকি বলেছে আজ যদি আমি এখানে থাকি তবে আমাকে হত্যা করবে। হোটেলের কেরাণী কথাটা নাকি ফাঁস করে দিয়েছে। বয় কেন আমাকে হত্যা করবে তার কারণ আমি জানতাম। গতরাত্রে সে আমার কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। টাকা পায় নি এটাই হল তার আক্রোশের কারণ। কেরাণী বিষয়টি গোপন রাখা ভাল মনে করে নি বলেই বলে দিয়েছিল। হোটেলে পৌঁছে দেখলাম বয় কাঁপছে। সান্ত্বনা দিয়ে বল্‌লাম তুমি আজ এখান থেকে চলে যাও আমরা চলে গেলে ফিরে এস। বয় তৎক্ষণাৎ হোটেল ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

 গজনীতে মুসলমানই বেশি তবুও হিন্দুর প্রতি এদের এত বিদ্বেষ কেন তা অবগত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। তারা বলেছিল যে, হিন্দুদের প্রকৃতি পয়মালের মত। পয়মাল মানে শূকর। শূকর জানে আক্রমণ করতে, মরতে এবং মারতে। এখানে হিন্দুরাও সেরূপ। তারা দরকার হলে আক্রমণ করে, মরে এবং মারে। অতএব এরূপ লোকের রীতিনীতি গ্রহণ করা নিশ্চয়ই অন্যায়।

 বিকালে গজনীর পুলিশ অফিসারের সংগে সাক্ষাৎ করি। তিনি বেশ আদর-যত্ন করলেন। আমিই আফগানিস্থানের মোল্লাইজমের কথা উঠাই। তিনি বললেন “এখন আফগানিস্থানের মোল্লাইজম বিদেশীর দ্বারা পরিচালিত হয়। যত বৎসর আমানউল্লা রাজা ছিলেন তত বৎসর মোল্লারা মানুষের মতই কথা বলত এবং সমাজের রীতি-নীতি মেনে চলত, এখন তারা সমাজ পরিচালনা করছে। মোল্লারা অপরকে উস্‌কিয়ে দেয় মাত্র, নিজেদের কোন শক্তি নাই। শুধু তাই নয় এরা প্রথম শ্রেণীর ভীরু এবং কাপুরুষ। এদের দমন করতে এক মিনিট সময়ও লাগে না। সব সময়ই এরা রাজশক্তির পেছনে থেকে রাজার আদেশ সাধারণ লোকের কাছে প্রচার করে।

 সন্ধ্যা হতে চলেছে দেখে পুলিশ অফিসার আমাকে বিদায় দিয়ে বললেন এখন হোটেলে যান। কতক্ষণ পরই নেকড়ে বাঘ বের হবে, তখন হোটেলে যাওয়া সম্ভব হবে না। রাত্রে যদি কোনরূপ বিপদ-আপদ হয় তবে আমাকে ডাকলেই শুনতে পাব। আমার কাছে মেশিনগান আছে। নেকড়ে বাঘের উপর আমরা মেশিনগানও চালিয়ে থাকি।

 সন্ধ্যার পরই পায়ের ব্যথা বাড়ে। সেদিনও বেশ ব্যথা আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু পায়ের ব্যথার চেয়ে নূতন ব্যথা দেখা দিল। দ্বিতীয় হোটেল-বয় আমাকে বিরক্ত করতেছিল। অবশেষে তাকে বলতে বাধ্য হলাম যে এদেশে কাম রিপু চরিতার্থ করবার জন্য আসা হয় নি, তোমরা এ বিষয়টা ধনী লোকের জন্য ব্যবস্থা করো। বেশি বিরক্ত করলে এখনই কুমিদাসকে ডাকব এবং তুমি জেলে যাবে। বয় তখন শান্ত হল। বয় বাবুর্চিদের ধারণা বিদেশীরা টাকার কুমির এবং বিদেশ ভ্রমণের একমাত্র কারণ হল কাম রিপু চরিতার্থ করা।

 পরদিন অসুস্থ শরীর নিয়েই গাড়িতে বসলাম।

 আজ আমরা যাব মুকুর নামক স্থানে। পথের অবস্থা খারাপ ছিল। যে দিকে তাকাচ্ছিলাম সর্বত্রই বরফে ঢাকা দেখতে পাচ্ছিলাম।

 কিন্তু এক অভিনব চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়লাম। মুকুরের কাছে একটি বহুপুরাতন শিবমন্দির দেখতে পাব। মুকুরে পৌঁছবার পর আমার একটি সরাইএ উঠলাম। সকল কাজ স্থগিত রেখে একজন মাত্র লোক সংগে নিয়ে শিবমন্দির দেখতে গেলাম। অনেক বৌদ্ধমন্দির শিবমন্দিরে পরিণত হয়েছে জানতাম। কিন্তু এ মন্দির দেখে মনে হল এটা বৌদ্ধযুগেরও আগে তৈরী হয়েছিল। এতে বৌদ্ধযুগের স্থাপত্যবিদ্যার কোন নিদর্শন ছিল না।

 মন্দিরটি পাহাড়ের গায়ে নির্মিত ছিল না। পাহাড় হতে একটু দূরে তবে মন্দিরের চারিদিকে পাহাড়ের আবেষ্টন ছিল। দেখলেই মনে হয় এখারে মন স্থির করবার পক্ষে প্রশস্ত। একদিকে একটি প্রস্রবণ। যদিও প্রস্রবণের জল বরফ হয়েছিল তবুও চারিদিকের পর্বতমালা হতে উষ্ণ জল বরফের নীচ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। শিবলিংগটি আমাদের দেশের শিবলিংগের মত নয়। একটি লম্বা পাথর মাত্র, প্রকৃতপক্ষে মন্দিরটি পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছিল। তাতে অন্য পাথরের কোনরূপ সংযোগ ছিল না। এরূপ মন্দির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কি না বলা যায় না। তাজমহলের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে যোগ বিয়োগের নিপুণতায়, কিন্তু এ মন্দির সে পদ্ধতিতে প্রস্তুত নয়। এই মন্দিরের বিশেষত্ব সংযোগ নয় বিয়োগে। অতি কষ্টে মন্দির দেখা শেষ করে গ্রামে ফিরে এলাম। রাত্রে যদিও পায়ের ব্যথা বেড়েছিল, তবুও মুসাফিরখানার পাঠানদের মাসাজে এবং ক্রমাগত গরম জল ব্যবহারে পায়ের অবস্থা বেশ ভালই ছিল।

 মুকুর হতে রওয়ানা হয়ে খালাত নামক স্থানে পৌছলাম। এখানে দুদিন বিশ্রাম করি। আমরা যে ঘরটাতে ছিলাম সেখানে একজন পাঞ্জাবী হিন্দুও আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনিও আমার মতই পায়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, সেজন্য আফগান ড্রাইভার আমাকে তাঁর পাশেই বিছানা করে দিয়েছিল। ভদ্রলোক বড়ই অমায়ীক। নিজের পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে আমি যাতে আরাম পাই তারই ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে দু’জন রুশিয়ান্ ছিলেন। তাঁরাও বোধহয় তাঁরই সহকারী। এই দু’জন রুশদেশীয় ভদ্রলোকের সাহায্য পেয়ে শরীরটাকে সুস্থ রাখতে পেরেছিলাম।

 পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বলছিলেন তিনি সোভিয়েট প্রজা হয়েছিলেন এবং বর্তমানে আফগানিস্থানে সরকারী কাজেই নিযুক্ত আছেন। আমাদের দেশের লোক সরকারী কাজের নাম শুনলেই মনে করে মস্তবড় একটি দাও অর্থাৎ সুযোগ এবং সুবিধা। রুশিয়ার সরকারী কাজ অথবা সাধারণ কাজ একই ধরণের।

 প্রথমত দুটি রুশ ভদ্রলোকের প্রতি আমার সন্দেহ হয়, এরা কি “সাদা রুশ?” পাঞ্জাবী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম। এরা white guard নন্, ইহুদিদের আফগানিস্থান হতে ফিরে নেবার জন্য তাকে সাহায্য করছেন। ইহুদিরা হয়ত রুশিয়ায় যাবে না, তারা পেলেষ্টাইন যাওয়াই পছন্দ করে, কিন্তু সাদা রুশরা বুঝতে পেরেছে, ধর্মের নামে অথবা রাজার নামে পেট ভরবে না, বরং পেটের ক্ষুধা বাড়ে এবং অকালে মৃত্যু হয়।

 অনেক সাদা রুশ আমাদের দেশে আসবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বৃটিশ সরকার তাদের ইণ্ডিয়াতে প্রবেশ করতে দেন নি। এদের কাজই ছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লেক্‌চার দেওয়া। কিন্তু তারা জানত না যে বৃটিশ সরকার তাদের চেয়েও চতুর। কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলতে হলেই প্রথমত বলতে হবে কমিউনিজম্ কি? ভারতের লোক আপনা হতেই সে জিনিসটা জানবার সুযোগ পাবে। অনেকে হয়ত যার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে সেই মতই গ্রহণ করবে। অতএব এই মতবাদ ভারতের লোক যত কম জানতে পারে ততই ভাল। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে বৃটিশ সরকার পলাতক রুশদের ভারতে প্রবেশ করতে দেন নি।

 এই সংবাদ কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশ হবে না; সোজন্যই চাই স্বাধীন মতাবলম্বী পর্যটক—যে না খেয়ে, পথশ্রমে আধমরা হয়েও স্বদেশের এবং বিদেশের গোপন তথ্য সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরতে পারে। এতে সর্বসাধারণ জ্ঞাতসারে নিজেদের মতামত গঠন করতে পারে।

 কোন এক ধর্মযাজক বলেছেন বেশি বই পড়া ভাল নয়। আমার ত মনে হয় না যে মানুষ বেশি বই পড়ে, বই পড়ার সময় কোথায়? অন্নচিন্তায় যারা অস্থির তাদের হাতের কাছে বই ফেলে দিলেও তারা বই পড়বে না, সেজন্য সুধীজন বই লেখা বন্ধ করবেন না এটাই আমার ধারণা এবং পর্যটকগণ ধর্মযাজকদের কথায় নিশ্চয়ই কান দেবেন না।

 পাঞ্জাবী এবং দুজন রুশিয়ার যুবকের পরিশ্রম ফলবতী হতে চলছিল।

 পলাতক রুশদের মতিগতি ফিরছিল। পাঞ্জাবী ভলোক এবং অন্য দুজন রুশ-দেশীয় লোক—এই তিন জনে মিলে পলাতকদের খাদ্য, বস্ত্র এবং অর্থ বিতরণ করছিলেন। কাবুলে এদের দুরবস্থা দেখতে পেয়ে শিউরে উঠেছিলাম। স্বীয় মতবাদ বজায় রাখতে গিয়ে মানুষ যে কত দুর্দশা অম্লান বদনে বরণ করতে পারে, সাদা (পলাতক) রুশরা একের নম্বর দৃষ্টান্ত। কিন্তু এদের হঠাৎ মত বদলাবার কারণ কি জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলাম রীতিমত শিক্ষা পাবার পর এর মত বদলিয়েছে।

 ভারতীয় ভদ্রলোেক বললেন, এ দুজন ভদ্রলোকই পলাতক রুশদের মত পরিবর্তন করিয়েছেন। এদের আমি মনপ্রাণে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি আরও বললেন আফগানিস্থানে যত পলাতক রুশ আছে তারা সত্বরই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবে। কান্দাহারে একজন পলাতক রুশের পোশাক পরিবর্তন দেখে মনে হল, সে যেন নবজীবন ফিরে পেয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রুশ দেশে যাবার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছে কি? সে বলেছিল “মানুষ চায় কাজ এবং কাজের উপযুক্ত মজুরী। রুশদেশে তা পাওয়া যায়।” এখন ধর্ম সম্বন্ধে কি করবে জিজ্ঞাসা করায় লোকটি বলেছিল “এটা হল ব্যক্তিগত ব্যাপার।” আমি যদি মনে মনে প্রার্থনা করি কেউ জানবে না। একদা ধর্মের দরকার ছিল, বর্তমানে দরকার নেই। জ্ঞান অর্জন মনের উপযুক্ত অনুশীলন দ্বারাই হয়, বাইরের বেখাপ্পা আচার-ব্যবহারের ভেতর প্রকাশ পায় না।

 দুদিন এদের সংগে কাটিয়ে তৃতীয় দিন রাত্রি দশটার সময় কান্দাহার পৌঁছলাম।