আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না/মানবতা-সুনীতি-দুর্নীতি
কারণ: পঁয়তাল্লিশ
কোন্ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঈশ্বর ভক্তকে স্বর্গ দিতে পারে?
প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই সোচ্চারে বলে—স্রেফ তাদের ঈশ্বরই পারে স্বর্গে নিয়ে যেতে, তাদের ধর্মীয় অনুশাসনই স্বর্গের একমাত্র দিশা। শুধু এটুকু বলেই তারা ক্ষান্ত হয় না। পরন্তু এ'ও বলে, তাদের ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্মে বিশ্বাস রাখলে নরক ছাড়া গতি হবে না। অন্য ধর্মের অনুশাসন কাঁটায় কাঁটায় মেনে চললেও সে'সব ধর্মের সাধ্য হবে না স্মরণাগত ভক্তদের স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার। সত্যি বলতে কি, স্বর্গে যাওয়া তো দূরস্থান, সাধ্য হবে না ভক্তদের অনিবার্য নরকবাস থেকে বাঁচাবার।
মনুসংহিতায় ও ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে—বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাকপন্থী সহ সমস্ত বেদ-বিরোধী (অর্থাৎ মুসলিম, খ্রিস্ট সহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম) নাস্তিক পাষণ্ডদেরই ভগবান জন্মে জন্মে বার বার নরকে নিক্ষেপ করবেন।
তাহলে কি হিন্দু ভিন্ন অন্য যে কোনও ধর্মই জীবাণুর ভূমিকা গ্রহণ করে? এবং জীবাণু আক্রমণের ফল ভুগতে হয় মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে?
হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কাছে প্রশ্ন দু'টি এলে তিনি দুবারই 'হ্যাঁ' বলতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতীয় সমাজে ইসলামের আগমন, সুস্থ মনুষ্যদেহে জীবাণুর আক্রমণের সঙ্গে তুলনীয়। [বাণী ও রচনা, স্বামী বিবেকানন্দ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩]
সমস্ত হিন্দু ধর্মগুরুদের চোখে হিন্দু ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম। কিন্তু এই জাতীয় বিশ্বাসে বাধ সেধেছে মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাস। তাদের সাফ কথা—না, এ'সব বিলকুল বকওয়াস। হিন্দু কাফেরদের জন্য পরলোকে আছে শুধুই নরকের ব্যবস্থা। ইসলামই একমাত্র সত্যধর্ম। শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাই যেতে পারে স্বর্গে।
কোরআন-এর সূরা আল এমরান ৮৫ তে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্ম অবলম্বন করে আছে, তার ধর্মপালন সৎ কাজ হিসেবে গৃহীত হবে না। পরলোকে তার ক্ষতিই হবে।
সূরা এনাম ১১৩-তে বলা হয়েছে, কাফের (অ-ইসলামী) মানুষরা শয়তানরূপী মানুষ (প্রিয় পাঠক-পাঠিকা লক্ষ্য করুন, এখানে অন্যান্য ধর্মের মানুষরা জীবাণুর পরিবর্তে শয়তান)। তারাও শয়তানের মত ঈশ্বর অনুগ্রহে বঞ্চিত।
সূরা এনাম ৭১-এ আছে, ইসলাম ধর্মই ঈশ্বরের ধর্ম, সে-ই সত্যধর্ম।
বলুন তো,কার কথায় বিশ্বাস করি? কোন্ ধর্মকে জীবাণু বিবেচনায় ধ্বংস করতে সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য? কোন্ ধর্মের ঈশ্বর বেশি শক্তিশালী?
প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় যখন তাদের কল্পনার ঈশ্বরকেই স্বর্গের টিকিট বিলোবার একমাত্র ‘অথরিটি' বলে প্রচার করে চলেছে, তখন যে জরুরী প্রশ্নটা স্বর্গের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ধার্মিকদের আসা উচিত ছিল, কিন্তু আসছে না, তা হল—কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দাবি ঠিক? কোন যুক্তিতে দাবিটি ঠিক বলে গণ্য করা হবে? ‘নিজের ধর্ম' এই যুক্তিতে? কেউ ধর্মান্তরিত হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ধর্মান্তরিতের ছেড়ে আসা ধর্মের ঈশ্বর ‘ফালতু' হয়ে যাবেন? আর ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে যে ঈশ্বর ছিলেন নেহাতই ফালতু, তিনি মুহূর্তে হয়ে উঠবেন স্বর্গ-নরকে পাঠাবার দণ্ডমুণ্ডের একমাত্র কর্তা?
একটি মানুষের ধর্ম পাল্টাবার ক্ষমতার উপর যদি ঈশ্বরের ক্ষমতা একান্তভাবেই নির্ভরশীল হয়, তবে বলতেই হয়—মানুষই ঈশ্বরকে ‘ফালতু' ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তৈরি করার কারিগর।
কেউ ধর্মান্তরিত হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ধর্মান্তরিতের ছেড়ে আসা ধর্মের ঈশ্বর ‘ফালতু' হয়ে যাবেন? আর ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে যে ঈশ্বর ছিলেন নেহাতই ফালতু, তিনি মুহূর্তে হয়ে উঠবেন স্বর্গ-নরকে পাঠাবার দণ্ডমুণ্ডের একমাত্র কর্তা?
একটি মানুষের ধর্ম পাল্টাবার ক্ষমতার উপর যদি ঈশ্বরের ক্ষমতা একান্তভাবেই নির্ভরশীল হয়, তবে বলতেই হয়—মানুষই ঈশ্বরকে ‘ফালতু’ ও ‘দণ্ডমুণ্ডের কর্তা' তৈরি করার কারিগর।
মসজিদ্ ভাঙার পরও ভগবান রাম কেন নিজের জন্মভূমিতে নিজের সামান্য মন্দিরটুকু পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারছেন না? কেন ভগবান রামের শক্তি ভারত সরকারের কাছে, আইনের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছে?
বাবরি মসজিদ ভাঙল কিছু মানুষ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি পারলেন, সামান্য কিছু মানুষের পেশীশক্তিকে পরাজিত করে বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে? কেনই বা আল্লাহ নতুন করে নিজের মসজিদ্ গড়ে তুলতে পারছেন না? কেন আল্লাহের শক্তি ভারত সরকারের কাছে, আইনের কাছে নতজানু?
যাঁরা ইহ-জগতে নিজেদের অধিকারটুকু, নিজেদের ইজ্জৎটুকু রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না, তাঁরা ইহ-জগতে এবং পর-জগতে দুনিয়ার সমস্ত-কালের মানুষদের রক্ষা ও বিচার করবেন—এমন আজগুবি কথাতে বিশ্বাস রাখবে কারা বলুন তো?”
সৈকতের প্রশ্নের পিঠে মানবতাবাদী সমিতিরই অন্যতম সম্পাদক সুদীপ মৈত্র উত্তর দিয়েছিলেন, “কেন, মা শীতলার বাহনরা!"
কারণ: ছত্রিশ
'স্বর্গ ভোগ' ও 'নরক ভোগ' কি আধ্যাত্মিক, না শারীরিক?
আজ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মের বড়-মেজ-ছোট (জনপ্রিয়তার নিরিখে) বহু ধর্মগুরুদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আর সুযোগ পেলেই তাঁদের টেনে নিয়ে গেছি 'পরলোক' নিয়ে আলোচনায়।
সব ধর্মেই যেহেতু 'আত্মা' আছে এবং আত্মারা অমর, তারই সূত্র ধরে এসেছে মৃত্যুর পর 'পরলোক', এবং পরলোকের বিচারক 'পরমাত্মা', 'ঈশ্বর', 'আল্লাহ'...যে নামেই ডাকুন।
বারবারই তাঁদের প্রতি আমার জিজ্ঞাসা উঠে এসেছে—স্বর্গ বা নরকে অথবা বেহেস্ত বা দোজখে মৃত্যুর পর আত্মারা যে সুখ বা দুঃখ ভোগ করে, সেইসব সুখ বা দুঃখ কি শারীরিক না অধ্যাত্মিক? হলফ করে বলছি, তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রাথমিকভাবে উত্তর ছিল-অধ্যাত্মিক। আপনারা যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সব ধর্মের বাবাজি-মাতাজিরা আপনাদের প্রশ্নের উত্তরেও প্রথমে বলবেন ঐ 'অধ্যাত্মিক' শব্দটিই।
এমন উত্তর শোনার পর প্রত্যেক গুরুদের কাছেই জানতে চেয়েছি—আপনার ধর্মের গ্রন্থেই অতি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা। 'স্বর্গ' বা ‘বেহস্ত' মানেই ভোগের অফুরন্ত ব্যবস্থা। খানা-পিনা, মদ, নারীদেহ সবেরই বিপুল আয়োজন। আর 'নরক' বা 'দোজখ' মানেই শরীরে ধারাল করাতের আসা-যাওয়া, আগুন-গরম শলাকার দেহতে প্রবেশ, পূঁজ-রক্ত খাওয়া, আগুনে বা গরম তেলে দগ্ধ করা ইত্যাদি মধ্যযুগীয় শাস্তির চেয়েও বর্বরোচিত নানা ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু এইসব বর্ণনা থেকে বুঝতে সামান্যতমও অসুবিধে হয় না, সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো আদৌ কোনও অধ্যাত্মিক, আত্মার বা মনের ব্যাপার নয়। অতি স্পষ্টতই শারীরিক ব্যাপার। কারণ, 'আত্মা' বিষয়ে ধর্মের বক্তব্য - আত্মা আগুনে পোড়ে না, অস্ত্রের আঘাতে আহত হয় না। শরীর আহত বা হত হলেও আত্মা আহত বা হত হয় না। ধর্মের এই বক্তব্য মেনে নিলে আত্মাকে কাটা বা ঝলসানো সবই অসম্ভব।
সাধারণ যুক্তিতেই ধর্মের দেওয়া আত্মার সংজ্ঞাকে মেনে নিলে এ'কথাও মেনে নিতে হয়, আত্মাকে আহত করে শাস্তি দেওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। ('আত্মা' বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মগুরুদের মতামত ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ জানতে পড়ুন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ৪র্থ খণ্ড)। শুধু তাই-ই নয়, আত্মার পক্ষে পূঁজ-রক্ত বা মদিরা—দুই পান-ই অসম্ভব। অসম্ভব হুরীদের সঙ্গে সহবাস।
পরলোকের ভাগ ও শাস্তির কথা সত্যি হলে আত্মার 'শরীর' বা 'জীবদেহ' থাকতে বাধ্য। ভোগ ও শাস্তি অধ্যাত্মিকভাবে সম্ভব নয়। “আত্মা আগুনে পোড়ে না, অস্ত্রের আঘাতে খণ্ডিত হয় না, আত্মা হত বা আহত হয় না"—এ'জাতীয় ধর্মীয় বক্তব্যকে মেনে নিলে, পরলোকে ভোগ ও শাস্তির কথা মিথ্যে হয়ে যায়। আত্মা একই সঙ্গে জীবদেহ হীন, আবার ভোগ বা শাস্তি গ্রহণে সক্ষম—এ কথা মানলে সোনার পাথরবাটির অস্তিত্বও মানতে হয়। এই স্ববিরোধিতা প্রসঙ্গে একজন ধর্মগুরু হিসেবে আপনি কিছু বলবেন কি?
পরলোকের ভোগ ও শাস্তির কথা সত্যি হলে আত্মার 'শরীর' বা 'জীবদেহ' থাকতে বাধ্য। ভোগ ও শান্তি অধ্যাত্মিকভাবে সম্ভব নয়। “আত্মা আগুনে পোড়ে না, অস্ত্রের আঘাতে খণ্ডিত হয় না, আত্মা হত বা আহত হয় না”—এজাতীয় ধর্মীয় বক্তব্যকে মেনে নিলে, পরলোকে ভোগ ও শাস্তির কথা মিথ্যে হয়ে যায়। অন্য একই সঙ্গে জীবদেহ হীন, আবার ভোগ বা শাস্তি গ্রহণে সক্ষম—এ কথা মানলে সোনার পাথরবাটির অস্তিত্বও মানতে হয়।
‘আত্মা' ও 'পরলোক' ধারণাগুলো যদি এ'ভাবে স্ববিরোধিতায় মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে তারপর ‘আত্মা' ও পরলোকের বিচারক ‘পরমাত্মা'—'ঈশ্বর’—'আল্লাহ' যে নামেই ডাকুন—সে সবের অস্তিত্বও যে মিথ্যে হয়ে যায়!
কারণ: সাঁইত্রিশ
জীবহত্যায় পাপ হয়, না পুণ্য? এতে করে ঈশ্বর রাগেন, না খুশি হন?
জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে 'জীবহত্যা মহাপাপ'। এই দুই ধর্মের অনুসারীরা নিরামিষ খাবার খান। তাঁদের দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্যেই নিরামিষ খাবার খান। সুতরাং তাঁদের ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য ঈশ্বরের কাছে পশু বলি—আরে ছিঃ ছিঃ! ঈশ্বর কখনও কি তাঁরই সৃষ্টিকে, তাঁরই সন্তানকে বলি চরিয়ে আনন্দ পেতে পারেন? ঈশ্বর কি শয়তান?
হিন্দু ধর্মের দিকে তাকান। সেখানে শাক্তরা অর্থাৎ শক্তির উপাসকরা বিশ্বাস করেন, বলিতে দেবতা সন্তুষ্ট হন। হিন্দুদের মধ্যে একসময় নরবলিরও প্রচলন ছিল। এবং বলির মধ্যে নরবলিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। নরবলি বে-আইনি ঘোষিত হওয়ার পর, হত্যার অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলার ভয়ে এই প্রথা প্রায় বন্ধ। তবে আজও লুকিয়ে-চুরিয়ে নরবলি হয়।
শক্তির দেবী কালী, তারা, বগলা, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, দুর্গা, চামুণ্ডা, সাপের দেবী মনসা, কলেরা-বসন্ত ইত্যাদি রোগের দেবী শীতলার কাছে পশুবলির প্রচলন রয়েছে। বলি দেওয়া হয় সাধারণভাবে পাঁঠা, ভেড়া, মোষ, হরিণ, শুয়োর, কাছিম ইত্যাদি।
ইসলাম ধর্মে ‘কোরবানী' একটি বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। 'কোরবানী'তে বলি দেওয়া হয় গরু, ভেড়া, ছাগল, উট ইত্যাদি। যারা কোরবানী দেয়, তারা ঈশ্বরের প্রিয় হয় বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে।
এরপর যে প্রশ্নটা উঠে আসে, তা হল—কোন্ ধর্মের কথা ঠিক, হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে জীববলিতে বা কোরবানীতে পুণ্য, নাকি বৌদ্ধ ও জৈন্য ধর্মের বিধান মত জীবহত্যা পাপ?
কারণ: আটত্রিশ
ঈশ্বর-চিন্তা, পাপ-পূণ্য বোধ কি মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত করে?
আনন্দবাজার পত্রিকায় ৫ ডিসেম্বর '৯৪ ‘ঈশ্বর' শিরোনামে একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক শুভ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসের পক্ষে একটি যুক্তি হাজির করেছিলেন, যে যুক্তি বহুজন বহু সহস্রবার হাজির করেই চলেছেন। যুক্তিটা এই—ঈশ্বর বিশ্বাস করার ফলে মানুষ অনেক সময় কুকাজ থেকে বিরত থাকে। “ঈশ্বর পাপ দেবেন” এমন চিন্তাই অনেক সময় কুকাজ থেকে মানুষকে বিরত করে।
‘ঈশ্বর পাপ দেবেন' চিন্তা মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিরত যদি করতেই পারত, তবে ভারতের মত ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দেশ কখনই দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে স্থান করে নিতে পারত না।
না, করে না শুভবাবু। আদৌ করে না। 'ঈশ্বর পাপ দেবেন' চিন্তা মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিরত যদি করতেই পারত, তবে ভারতের মত ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দেশ কখনই দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে স্থান করে নিতে পারত না। ভারতে নিরীশ্বরবাদীদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে তাদের দেখতে মাইক্রোস্কোপের দরকার হয়। তাহলে একেবারে নিচুতলা থেকে সর্বোচ্চ তলা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে কেন এত বিশাল দুর্নীতি? এ'দেশে সব ধর্মের ব্যবসাই দারুণ জমজমাট। কালীপুজো, দুর্গাপুজো, রামপুজো, শনিপুজো, পরিরের দরগায় সিরনি, ইফতার পার্টি, মহরমের তাজিয়া, গির্জায় মোম, পাদ্রি সাহেবদের মাইক ফোঁকা, জৈনদের মিছিল, বিশ্বধর্ম সম্মেলন, মায়াপুরের কৃষ্ণ ভজনা ইত্যাদি রমরমার পিছনে রয়েছে ধনকুবের হুজুরের দল ও তাদের টাকায় নির্বাচনে জেতা শাসকগোষ্ঠি সহ রাজনৈতিক দলগুলোর স্পনসরশিপ। তবু কেন এত দুর্নীতি শুভবাবু? বরং ধর্মেই রয়েছে সমস্ত অকাজ-কুকাজ করেও পার পাওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা। মক্কা, জেরুজালেম, পুরী, বারাণসী কি তিরুপতি, এ'সব পবিত্র স্থান দর্শনে রয়েছে জীবনের সব পাপ ধুয়ে গিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের নিশ্চিত গ্যারান্টি। আর এমন গ্যারান্টি দিয়ে পাপ মুক্ত করার পবিত্র স্থানের ফাঁদ পাতা রয়েছে ভুবন জুড়ে। অতএব মা'ভৈ! নীতিবোধ, মূল্যবোধ, আদর্শবোধ সব কিছুকে শিকেয় তুলে রেখে শুধু ভোগ করে যাও। চিত্তে যা চায়, ভোগ করে যাও। খাও-পিও-মৌজ বানাও। ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া'র মত কুঁচো চিন্তা ছেড়ে বড় করে ভাবতে শেখ। ঋণ করে মদ খাও, গণ্ডা-গুচ্ছের শয্যাসঙ্গী ও সঙ্গিনী পোষ। ঋণ শোধের কথা না ভাবলেও চলবে। চাই কি বেশি তাগাদা দিয়ে বিরক্ত করলে ঋণদাতাকে পৃথিবী থেকেই নিকেশ করে দাও। ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে শোধ না করার ও সে টাকাকে 'নয়-ছয়' করার যে ট্র্যাডিশন ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের দেশ ভারতে আছে, তারই একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হর্ষদ মেহেতার ব্যাঙ্ক থেকে ছ'হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়া। এতো স্রেফ ধরা পড়ে যাওয়া একটি ঘটনা মাত্র, যা হিমশৈলের ভেসে থাকা মাথার মতই সমগ্রের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ। এইসব প্রতারকরা প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, এবং “এলো-মেলো করে দে মা, লুটে-পুটে খাই'-তেও বিশ্বাসী। এরা জানে পাপ স্খলনের জন্য কুম্ভমেলায় কিংবা সাগরমেলায় একটা ডুব দিলেই যথেষ্টর কিছু বেশি। দিন-ক্ষণ দেখে মেলা হয়। সে সময় ডুব দিয়ে পাপ ধুয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের মত সময় বের করতে না পারলেও কুছ পরোয়া নেই। ব্যস্ত ধনীদের আলাদা ব্যবস্থাও আছে। তিরুপতিতে হিরের প্যাকেট, জগন্নাথের পায়ের তলায় কোটি টাকার বান্ডিল, এমন ঘুষ অনেক দেবস্থানেই ধারাবাহিকভাবে পড়েই চলেছে। ভগবানদের ভুমিকা অনেকটা মস্তানদের ‘দাদা'র মত। বিপদে পড়লে উদ্ধার করবে। বিনিময়ে কিঞ্চিৎ প্রণামী।
ধর্মেই রয়েছে সময় অকাজ-কুকাজ করেও পার পাওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা। মক্কা, জেরুজালেম, পুরী, বারাণসী কি তিরুপতি, এ'সব পবিত্র স্থান দর্শন রয়েছে জীবনের সব পাপ ধুয়ে গিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের নিশ্চিত গ্যারান্টি।
সত্যিই ভাবুন তো, ভোগবাদী, প্রতারক, হত্যাকারী থেকে ধর্ষক, প্রত্যেকের জন্যেই পরম করুণাময় সব ধর্মের ঈশ্বরের কি অপার করুণা! পাপীদের উদ্দেশে ভগবান হেঁকে বলছেন—“লুটে-পুটে খেতে ভয় কি রে পাগল, আমি তো আছি"।
হে ভোগবাদীগণ, আপনারা কেউই চার্বাকের এই তথাকথিত ভোগবাদী দর্শনের খপ্পরে পড়ে নাস্তিক হতে যাবেন না। ওরা কতটুকু দিতে পারে? ওরা নাকি ঋণ করে ঘি খাওয়ার কথা বলেছে। শেষপর্যন্ত ঋণ শোধ না করলেও চলবে, কারণ এ জীবনেই তো সব শেষ। হে ভোগবাদীগণ, ওদের কথায় প্রলুব্ধ হবেন না। পরলোক আছে। নিশ্চয়ই আছে। আছে পুনর্জন্ম। এজন্মের কর্মফল অনুসারেই আগামী জন্মে ফল পাবেন। হে মহান ও বিশিষ্ট ভোগবাদীগণ, আমরা নিশ্চিত করছি, ধর্মের নামে নিশ্চিত করছি, ঈশ্বরের নামে নিশ্চিত করছি-আপনারা আপনাদের মস্তিষ্ক খাটিয়ে যে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাকে পর্বত করতে সচেষ্ট হউন। এতে দুষ্টেরা ও পরশ্রীকাতরেরা যদি আপনাদের শোষক-টোষক বলে গাল পাড়ে তো পাড়তে দিন। আপনারা নিশ্চিন্ত মনে যত খুশি শোষণ চালিয়ে ভোগ-সাগরে চার বেলা অবগাহন করুন। আপনার সমস্ত পাপকে ধুয়ে সাফ-সুতরো করে পুণ্যের ‘আই এস আই' ছাপ মেরে দেব কপালে। তারই ফলে পরলোকে...., বিশ্বাস করুন মদ-মেয়েছেলের যা দারুণ আয়োজন, কোথায় লাগে এই জাগতিক সেরা বার কাউন্টার, সেরা দেহোপজীবিনী, উ—ফ্! তারপর আবার যখন পৃথিবীতে জন্মাবেন, পুণ্যিবলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে, তারপর ভাবুন তো—আবার ভোগ, আবার পুণ্যি, আবার পরলোকে ভোগ, আবার সোনার চামচ মুখে...ব্যাপারটা বৃত্তাকারে ঘুরেই চলবে। ভোগে, রসে-বশে থাকতে পেলে কে এ'জন্মেই সব চুকিয়ে ফেলতে চায়—ভদ্রোমহোদয়গণ! তাই আবারও বলি, চার্বাক দর্শনের খপ্পরে না পড়ে, আপনারা ভক্তিবাদ, বিশ্বাসবাদ, অধ্যাত্মবাদ ইত্যাদি ঈশ্বর-নির্ভর দর্শনে মন-প্রাণ সঁপে দিন। হে মহান ভোগবাদে বিশ্বাসী ক্যারিয়ারিস্টগণ, আপনারা নিজেরটা গুছিয়ে নিতে শিখুন। আর শিখুন শ্রদ্ধার সঙ্গে কিছু তুলে দিতে তাঁরই চরণে—যাঁর কৃপাতে হলেন সুখী, পেলেন ধন-জন। আপনি ঈশ্বরকে দেখুন, ঈশ্বর আপনাকে দেখবে।
হে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভোগবাদীগণ, এতক্ষণের বক্তব্য থেকে এখন নিশ্চয়ই এই বিশ্বাস আপনাদের মধ্যে রোপণ করতে পেরেছি, ঈশ্বর-নির্ভর ভাববাদী দর্শন ভোগবাদ তোষণেরই দর্শন। আমাদের দর্শনের কাছে চার্বাকের তথাকথিত ভোগবাদী দর্শন যেন শ্বেতহাঙরের কাছে নেহাতই পুঁচকে একটা মৌরলা মাছ।
শুভবাবু, আপনাকে একটি খবর শোনাই। ১৯৮৮ সালের ২ মার্চ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত একটি অনুসন্ধান বা সার্ভে চালিয়ে ছিল 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'। বেছে নেওয়া হয়েছিল ১০০ জন বিভিন্ন ধরনের অপরাধীকে। এই অপরাধীদের মধ্যে ৬৬ জন হিন্দু দেব-দেবীর বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করে, ৩২ জন আল্লাহের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, ২ জন যিশুর অলৌকিক ক্ষমতায় ও করুণাময়তায় বিশ্বাসী। ১০০ জনই পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। স্বর্গ-নরক জাতীয় স্থান বাস্তবিকই আছে বলে বিশ্বাস করে। পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস করে। ঈশ্বর কৃপায়, তীর্থদর্শনে, পুণ্য স্থানে, মক্কা দর্শনে এবং 'কনফেস'-এর মধ্য দিয়ে পাপ স্খলন ও পুণ্য সঞ্চয় হয় বলে বিশ্বাস করে।
১০০ জনের মধ্যে ৮৯ জনই বিশ্বাস করে অপরাধ করতে করতে যে কোনও সময় জীবন যেতে পারে। পাপ স্খলনের সুযোগ নেবার আগেই যেতে পারে, আবার নাও যেতে পারে।
শুভবাবু, ঈশ্বর-বিশ্বাস, পরলোক-বিশ্বাস, পাপের ফল নরক যন্ত্রণা-এইসব বিশ্বাস কিন্তু অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
কেন পারেনি? এর কারণ খুঁজে পেতে গেলে শুভবাবু, আপনাকে ফিরে তাকাতেই হবে এ'দেশের আর্থসামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের দিকে। এ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ টিকিয়ে রেখেছে অসাম্যের সমাজ-ব্যবস্থা। এ সমাজে খাটতে চাইলেও পাওয়া যায় না কাজের গ্যারান্টি। চিকিৎসার সুযোগ, লেখা-পড়ার সুযোগ সংবিধানের পাতাতে শুধু ছাপাই থাকে। ভাত-কাপড়-পানীয় জল ও মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রতিটি নাগরিককে দেবার যে সংকল্প সংবিধানে রয়েছে, তার খবরই জানে না দেশের নিরন্ন মানুষগুলো। ওরা আগাছার মতই বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে সমাজের সমস্ত বঞ্চনা ও অবহেলার মধ্যে। যে বয়সে আপনার আমার বাড়ির শিশু লজেন্স চোষে, সেই বয়সে ওদের বাড়ির শিশু চলন্ত ট্রেনে লজেন্স ফেরি করে। যে বয়সে গাড়ি চেপে আপনার আমার বাড়ির শিশু ফিটফাট পোশাকে স্কুলে যায়, সে বয়সে ওদের বাড়ির শিশু কালি-ঝুলি মেখে মটোর- গ্যারেজে গাড়ি সারাবার ‘ফালতু'। লোডশেডিং নিয়ে যখন আপনি আমি এবং আমাদের পত্রিকাগুলো গলা ফোলাচ্ছে, তখন ওরা অদ্ভুত নির্বিকার। মুক্ত আকাশের নীচে ফুটপাতে বা পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট বস্তির ঘরে দশটা মানুষের স্তুপ। আলো বলতে ফুটপাতে স্ট্রিটলাইট, পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট ঘরে কুপি। কুপি জ্বলে, তবে অনেক হিসেব কষে। আলোই যে দেখেনি, তার আবার আলো হারাবার ভয় কী? হাওয়াই যে পায়নি, তার হাওয়া হারাবার ভয় কী? ওরা অন্ধকার জগতের অনেক কেষ্ট-বিষ্টুদের দাবার ঘুঁটি। ওরা ফালতু-পালতু। কেষ্ট-বিষ্টুদের ইশারায় প্রাণ দেওয়া নেওয়ার খেলায় মাতে। ওরা একদিনে তৈরি হয়নি। আর্থ-সামাজিক অবস্থা ওদের একটু একটু করে তৈরি করেছে।
যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে বইতে শুরু করে দুর্নীতির স্রোত, যে দেশে হত্যাকারী, ধর্ষক, গুণ্ডা, ছেনতাইবাজ, ডাকাত, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার দরুন শুধু পারই পায় না, বরং বুক চিতিয়ে ঘুরে বেরাবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়, সে দেশের মানুষ দু-বেলা ঠাকুর প্রমাণ সেরে, নামাজ পড়েও দুর্নীতি চালিয়ে যাবেই; এবং যাচ্ছেও তা। এই তো ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বর-বিশ্বাসী ভারতের সামাজিক অবস্থা।
যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে বইতে শুরু করে দুর্নীতির স্রোত, যে দেশে হত্যাকারী, ধর্ষক, গুণ্ডা, ছেনতাইবাজ, ডাকাত, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার দরুন শুধু পারই পায় না, বরং বুক চিতিয়ে ঘুরে বেরাবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়, সে দেশের মানুষ দু-বেলা ঠাকুর প্রমাণ সেরে, নামাজ পড়েও দুর্নীতি চালিয়ে যাবেই; এবং যাচ্ছেও তা।
এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের এমন কিছু শেখাবার চেষ্টা করে চলেছে, যা অন্ধবিশ্বাস নির্ভর, যা অর্ধসত্য, যা একপেশে, যা অধ্যাত্মবাদী ও ভোগবাদী মতবাদের পরিপোষক, যা ক্যারিয়ারিজিমের আঁতুড়ঘর, যা অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যে-প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে তৈরি হয়ে চলেছে, তারা প্রকৃত শিক্ষিত না হয়ে অসাম্যের এই সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তি হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তাদের শিক্ষা, তাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভুল শিখিয়ে এসেছে ‘দেশপ্রেম' সম্পর্কে, 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয়তাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয় সংহতি' সম্পর্কে, 'মৌলবাদ' সম্পর্কে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সম্পর্কে, 'গণতন্ত্র' সম্পর্কে, 'মানুষের উপর পরিবেশের প্রভাব' সম্পর্কে (এই বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়ুন ‘সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ)।
টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা, থিয়েটার,গান, নাচ, বৃহৎ পত্র-পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা বিশাল ভাবে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা টেলিভিশনে কতটা মারদাঙ্গা দেখব, কতটা যৌনতা, কতটা ভক্তিরসে আপ্লুত হবো, ধর্মগুরুদের বাণীর দ্বারা কতটা আচ্ছন্ন হবো, কতটা ভাগ্য-নির্ভর হবো, কতটা ঈশ্বর বিশ্বাসী হব, কতটা ভূতে, “আদর্শ-নারীর গুণ–পতিসেবা, পতির পরিবারের সেবা, লজ্জা”—এই ধরনের নীতিবোধ কতটা আমাদের মাথায় ঠাসবো—এ সবই ঠিক করে দিচ্ছে বিভিন্ন ধনকুবের গোষ্ঠি ও রাষ্ট্রশক্তি। আমরা কী ধরনের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস কবিতা পড়ব—তা ব্যাপকভাবে নির্ধারিত করে দিচ্ছে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা। প্রচারমাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবরাহের ‘নিরপেক্ষ' মোড়কের আড়ালে থাকে একটি একপেশে মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা। এই একপেশে মূল্যবোধ কাদের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অর্থাৎ, কোন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অবশ্যই প্রচারমাধ্যমের মালিক যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই শ্রেণীর। কারণ প্রচারমাধ্যমগুলোর নীতি মালিকের শ্রেণী চরিত্রের উপর নির্ভর করে।
প্রচারমাধ্যমগুলোর সাহায্যে ধনকুবেরগোষ্ঠী আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে নতুন নতুন উৎপাদিত ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা। আমরা কোন্ ধরনের সিনেমা দেখব, ‘অপরাধ' কতটা বীরত্বের সূচক হিসেবে আমাদের চেতনায় ধরা পড়বে, ধর্ষণে কতটা খুঁজে পাব উত্তেজনার মজা, অশ্লীল নাচে কতটা খুঁজে পাবে আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া, দেশপ্রেম সম্পর্কে কতটা ভুল ধারণা গেলানো হবে—সে সবই ঠিক করে কোটিপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সেন্সর ক্ষমতার অধিকারী সরকার। এমনই সমাজ সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলশ্রুতি হিসেবেই দলে দলে উঠে আসছে কিশোর অপরাধী, ঠাণ্ডামাথার কিশোর খুনি, ঠাণ্ডামাথার কিশোর ধর্ষক।
শুভবাবু, এতক্ষণের দেওয়া যুক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই আপনার পূর্ব-মতকে পাল্টাতে সমর্থ হয়েছিল। আপনি যদি সুপরিকল্পিতভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ব্যক্তি না হন, যুক্তির প্রতি যদি ভালোবাসা থাকে, সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠার প্রতি যদি আন্তরিক সহানুভূতি থাকে, তবে নিশ্চয়ই আপনি পাল্টাবেন।
অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত করতে ‘ঈশ্বর' নামের জুজুর ভয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। যে মানুষ নিজেকে সঠিক আদর্শবোধ ও সঠিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত করে, সে কখনই খারাপ কাজ করে না। তাকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করানো যায় না। 'সঠিক আদর্শবোধ', 'সঠিক মূল্যবোধ’ শব্দ দুটি ব্যবহারের কারণ, এই অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে 'বেঠিক আদর্শবোধ' ও 'বেঠিক মূল্যবোধ' প্রবল ভাবেই প্রতিষ্ঠিত।
অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত করতে ‘ঈশ্বর নামের জুজুর ভয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। যে মানুষ নিজেকে সঠিক আদর্শবোধ ও সঠিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত করে, সে কখনই খারাপ কাজ করে না।
আমাদের এই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্তা ধনকুবেরগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণকে কায়েম রাখতে হাতে রাখে সরকার, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনী, প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের। ধনকুবেরগোষ্ঠীর শোষণের সহায়ক এই শক্তিগুলো শোষকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে বহু নীতিবোধ বা মূল্যবোধ সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়। এই নীতিবোধ ও মূল্যবোধ ব্যাপক প্রচারের ফলে, ব্যাপক মগজ ধোলাইয়ের ফলে বহুর কাছেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করলেও আসলে এগুলো 'বেঠিক নীতিবোধ' বা 'বেঠিক আদর্শবোধ' এবং 'বেঠিক মূল্যবোধ'।
কারণ: উনচল্লিশ
পাপ-পুণ্যের হিসেবে তো বেজায় গোলমাল।
পরলোকে বিশ্বাসী হিন্দুরা মনে করেন, মানুষের পাপ-পুণ্যের সমস্ত হিসেব রাখেন চিত্রগুপ্ত। মুসলিম ধর্মে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের কাঁধের উপর বসে রয়েছে দু’জন করে ফেরেস্তা। এদের নাম 'কেরামান’ ও ‘কাতেবীন'। একজন লেখেন সৎ কাজের বিবরণ, অপরজন অসৎ কাজের।
মানুষ জন্মেই কখনও 'সৎ' বা 'অসৎ' কাজ করতে পারে না। 'সৎ' বা 'অসৎ' কাজ করার মত ন্যায়-অন্যায় বোধ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চয়ই চিত্রগুপ্তের খাতায় পাপ-পুণ্যের হিসেব চালু হয় না, চালু হয় না কেরামান ও কাতেবীন-এর লেখার কাজ। মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কারও উপর নামাজ ও রোজা ফরজ হয় না। নাবালকের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ, পাপ-পুণ্য বোধ তৈরি হয় না বলেই নামাজ ও রোজার ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দেওয়া হয়।
এতদূর পর্যন্ত না হয় শোনা গেল, মানা গেল। কিন্তু তারপরও যে অনেক চিন্তা উঠে আসে। মানুষের তো সাবালক হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। তবে ঠিক কোন্ সময় থেকে চিত্রগুপ্ত, কেরামান, কাতেবীন ও অনা ধর্মে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে তাঁদের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেব রাখা শুরু করেন?
যারা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, যাদের ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য বোধ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মনে দাগ কাটে না, তাদের ক্ষেত্রে চিত্রগুপ্ত, দুই ফেরেস্তা অন্য ধর্মের ঈশ্বর বা ঈশ্বর-প্রতিনিধি কীভাবে হিসেব রাখেন! তাদের মৃত্যুর পর কোনও দিনই কি বিচার হয় না? তারা তো না স্বর্গের অধিকারী, নরকের! তবে সে সব আত্মাদের কী হয়? তারা থাকে কোথায়?
যারা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, যাদের ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য বোধ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে দাগ কাটে না, তাদের ক্ষেত্রে চিত্রগুপ্ত, দুই ফেরেস্তা বা অন্য ধর্মের ঈশ্বর বা ঈশ্বর-প্রতিনিধি কীভাবে হিসেব রাখেন! তাদের মৃত্যুর পর কোনও দিনই কি বিচার হয় না? তারা তো না স্বর্গের অধিকারী, না নরকের! তবে সে সব আত্মাদের কী হয়? তারা থাকে কোথায়?
ফেরেস্তা দু’জন যে মানুষের কাঁধে বসে তাদের পাপ-পুণ্যের হিসেব লেখেন, কী দিয়ে লেখেন, অদৃশ্য ফেরেস্তা কি অদৃশ্য কাগজে অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখেন? এত কিছুর পর পাপ-পুণ্যের হিসাবটা আল্লাহের কাছে দৃশ্যমান হয় তো? নাকি তাও অদৃশ্যই থেকে যায়?
পাপ-পুণ্যের হিসেবে এতবড় গোলমাল ধরা পড়ার পর পাপ-পুণ্যের বিচারক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখি কী করে?
কারণ: চল্লিশ
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী? পরলোকের বিচার কি সব প্রাণীদের বেলায়-ই প্রয়োগ করা হয়?
গরুর রচনার সেই গল্পটা অনেকেরই জানা। সেই যে, সেই ছেলেটা পরীক্ষার জন্য একটি-ই রচনা মুখস্ত করে গেছে। গরুর রচনা। প্রশ্ন পেয়ে দেখে, রচনা এসেছে শ্মশানের। ছেলেটি লিখল—আমাদের গ্রামে একটি শ্মশান আছে। গ্রামবাসী কেহ মারা গেলে সেখানে তাহাকে দাহ করা হয়।
এই দুটি বাক্য লিখেই ছেলেটি শ্মশানে গরুকে এনে ফেলতে একটি লাইন লিখল, শ্মশানে কচি কচি ঘাস হয়। তারপর আর কি, “এই ঘাস গরুতে খায়” লিখেই সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ল গরুর রচনায়।
আজ পর্যন্ত বহু ধর্মের ধর্মগুরুদের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি। অনেকের সঙ্গেই অধ্যাত্মবাদ, আত্মা, পরমাত্মা, নিয়তি, অলৌকিকত্ব, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আলোচনা যে বিষয়েই হোক, এক সময় তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই গরুর রচনার মত এনে ফেলেছি একটি প্রশ্ন—ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন কোন্ উদ্দেশ্যে?
প্রত্যেকেরই উত্তর ছিল এক ও অভিন্ন। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ঈশ্বরের নাম ভজনা ও গুণ কীর্তন করা। সে ঈশ্বরকে কৃষ্ণ, যিশু, যেহোভা, আল্লাহ বা অন্য যে নামেই ডাকি।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ঈশ্বর, আল্লাহ বা ওই ধরনের কোনও পরমাত্মার নাম ভজনা ও গুণকীর্তনই হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য জীব সৃষ্টির কারণ কী? হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক, আরশোলা কি পিঁপড়ে, সব্বাই কি তবে ঈশ্বর ভজনা করে? ওইসব প্রাণীরা কোন্ ঈশ্বরের ভজনা করে? কৃষ্ণের না আল্লাহের? যিশুর না বুদ্ধের? তাদের ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? সাকার হলে দেখতে কেমন? পিঁপড়ের ঈশ্বর কি পিঁপড়ের মত দেখতে, বাঘের ঈশ্বর দেখতে বাঘের মত?
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য যদি ঈশ্বর, আল্লাহ বা ওই ধরনের কোনও পরমাত্মার নাম ভজনা ও গুণকীর্তনই হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য জীব সৃষ্টির কারণ কী? হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভালুক, আরশোলা কি পিঁপড়ে, সব্বাই কি তবে ঈশ্বর ভজনা করে?
আচ্ছা, মৃত্যুর পর সব প্রাণীদেরই আত্মার নিশ্চয়ই বিচার হয়? সব প্রাণীরই কি ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য বোধ আছে? একটা শুঁয়োপোকা থেকে জেলিফিস, সব্বারই এই ধরনের বোধ আছে? মানুষ ছাড়া অন্য জীবদের মধ্যে অথবা বহু জীবদের মধ্যে যদি এই ধরনের ন্যায়-অন্যায়বোধ কাজ না করে, সেক্ষেত্রে সে-সব প্রাণীর পাপ-পুণ্যের বিচার হয় কীভাবে? ওদের পাপ-পুণ্যের হিসেব রাখার জন্যেও কি চিত্রগুপ্ত, কেরামান—কাতেবীনরা হিসেবের খাতা খুলে তৎপর? অথবা তৎপর রয়েছেন না কোনও ধর্মের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি? ভাইরাস থেকে শ্যাওলা—সব প্রাণীরই কি পাপ-পুণ্যের হিসেব হয়? সবারই শেষ বিচার করেন ঈশ্বর?
আচ্ছা, ভাইরাসের পাপ-পুণ্যের বোধোদয় হয় কোন্ বয়সে? আর, সজনে গাছটার বোধোদয় হয় কোন্ বয়স থেকে? বীজ থেকে গাছের বোধের উদয় আগে হয়? না, কলমের গাছের ন্যায়-অন্যায় বোধটা আগে টন্টনে হয়? গাছেরা কোন্ ঈশ্বরের ভজন-কীর্তন করে পুণ্যি করতে—কে জানে? আহারে, সদ্য অঙ্কুরিত ছোলাগুলো যখন খেয়ে ফেলি, তখন ছোলার অঙ্কুরগুলো বোধহয় একটুও পুণ্যি অর্জনের সুযোগ পায় না।
আমাদের মানুষদের পাপ ধুয়ে ফেলার হরেক রকম বাবস্থা রয়েছে। অন্য জীবদের তীর্থ দর্শনের ও ঈশ্বর দর্শনের সুযোগ নেই। আহা-হা-রে—
মনুষ্যেতর প্রতিটি জীবের মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত শেষ বিচারের ব্যবস্থা না থাকলে, মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু তা আছে—মানি কোন যুক্তিতে? আর, বিচার ব্যবস্থার অস্তিত্বই না থাকলে বিচারক (ঈশ্বর) কী করবেন?
কারণ: একচল্লিশ
ধর্ম কি ঈশ্বর বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত? ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ মেনে চলাই কি সৎপথে চলা, মানবিক হয়ে ওঠার দিশা?
আসলে 'ধর্ম' শব্দটাই বেশ গোল পাকায়। 'ধর্ম' শব্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষিতরাই সংস্কৃত ধৃ-ধাতুর উৎপত্তিগত অর্থকে টেনে আনেন। বলেন—যা আমাদের জীবনকে ধারণ করে তাই 'ধর্ম'। কিন্তু যা আমাদের জীবনকে ধারণ করে, তা দিয়ে কোনও ভাবেই ধর্ম কি—সে ধারণায় পৌঁছন যায় না। কারণ, অনেক কিছুই আমাদের জীবনকে ধারণ করে। আমাদের জীবন প্রথম যা ধারণ করে তা হল মাতৃগর্ভ বা টেস্টটিউব। আমরা কি মাতৃগর্ভ বা টেস্টটিউবকে ‘ধর্ম' বলব? প্রতি দিনকার খাদ্য-পানীয়ের দেওয়া পুষ্টি জীবনকে ধারণ করে। বাতাসের অক্সিজেন জীবনকে ধারণ করে। শিশুকালে পিতা মাতার সাহায্য-সহযোগিতা জীবনকে ধারণ করে। এভাবে পরিবার, বন্ধু, শিক্ষা, শিক্ষক, প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সবই তো জীবনকে ধারণ করে রাখে এ'সবই কি ‘ধর্ম'? কিন্তু তা তো নয়।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট ইহুদি ইত্যাদি প্রচলিত ধর্মগুলোকে বিশ্লেষণ করে ধর্মের ধারণা বা সংজ্ঞায় পৌঁছতে চাইলে আমরা কী পাব? বেদ, ভগবদ্গীতা, পুরাণে যে বহু সংখ্যক দেব-দেবীর কথা আছে, তাঁদের অস্তিত্বে বিশ্বাস এবং সেই সব দেব-দেবীদের খুশি করতে পুজো-ব্রত-যাগযজ্ঞ ইত্যাদির উপযোগিতায় বিশ্বাস ও আত্মার অমরত্ব, কর্মফল, ভাগ্য, ঈশ্বরদৃষ্ট বর্ণ বৈষম্য ইত্যাদিতে যিনি বিশ্বাস করেন ও মান্য করেন তিনিই হিন্দু। যাঁরা কোরানকে অপৌরুষেয় মনে করেন, হজরত মোহম্মদকে শেষ নবী বলে বিশ্বাস করেন, কোরান ও হাদিস নির্দিষ্ট পথে চলাকে মানব জীবনের চরম সার্থকতা বলে মনে করেন, কেয়ামতে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন বেহস্ত ও দোজখে, আত্মার অমরত্বে ফেরস্তা ও নিপাকে, রোবাক ও মেয়ারাজের অস্তিত্বে, তিনিই মুসলমান। যাঁরা বাইবেলের ‘নিউ টেস্টামেন্ট'-এর কাহিনী অনুযায়ী যিশুকে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র ও প্রতিনিধি বলে বিশ্বাস করেন এবং মান্য করেন, যিশুর পুনরুত্থানের কাহিনী সত্যি বলে বিশ্বাস করেন, নিউ টেস্টামেণ্টের নির্দেশ মত আচার-আচরণকে সদাচার মনে করেন, আত্মা তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তিনিই খ্রিস্টান।
কিন্তু শুধুমাত্র এতেই হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্ট ধর্মগুলো চূড়ান্ত রূপ পায় না। প্রত্যেক ধর্মেরই রয়েছে কাশী, পুরী, মক্কা, মদিনা, জেরুজালেমের মত পবিত্র তীর্থস্থান; মন্দির, মসজিদ, গীর্জার মত উপাসনাকক্ষ; ঈশ্বরকে তুষ্ট করার নানা উপচার-পদ্ধতি-প্রকরণ, বেদ-কোরান-বাইবেলের মত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মগুরু বা পুরোহিত শ্রেণী। এই সবকিছু মিলিয়ে, সবকিছুকে সম্পর্কীত করে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট এবং আরও বিভিন্ন ধর্মই তাদের সাংগঠনিক কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। তাই এইসব ধর্মকে সমাজ-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে 'প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম' বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
‘ধর্ম বলতে 'Religion' বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কথা না বলে আমরা যদি কোনও কিছুর গুণ বা বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ 'Property'কে বোঝাতে চাই, বোঝাতেই পারি; কোনও অসুবিধে নেই। বরং বলা যায় ‘ধর্ম' বলতে আত্মা-পরমাত্মা-পরলোক ইত্যাদি অলীক-বিশ্বাস নির্ভর সাংগঠনিক কাঠামোর চেয়ে, ধর্ম বলতে কোনও কিছুর গুণ বা বৈশিষ্ট্য'-কে চিহ্নিত করাই যুক্তির নিরিখে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক। কারণ, প্রথমটি অলীক-বিশ্বাস নির্ভর; দ্বিতীয়টি বাস্তব নির্ভর, যুক্তি নির্ভর। এরপর আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারি—'ধর্ম' মানে শনি, শীতলার পুজো, দরগার সিরনি বা গীর্জার মোম জ্বালানো নয়। 'ধর্ম' মানে আত্মা-পরমাত্মা-পরলোকের অলীক চিন্তায় নতজানু হওয়া নয়। 'ধর্ম' মানে বেদ-কোরান-বাইবেল-কে অপৌরুষেয় মনে করে ধর্মগ্রন্থের নির্দেশমত অমানবিক জীবন যাপন নয়। 'ধর্ম' মানে জীবে প্রেম বিলোবার নামে দুর্নীতিগ্রস্ত শোষকের প্রতি প্রেম বিলানো নয়। আগুনের 'ধর্ম' যেমন 'দহন', তলোয়ারের ‘ধর্ম' 'তীক্ষ্ণতা', মানুষের ‘ধর্ম' তেমনই 'মনুষ্যত্ব’ বা ‘মানবতা', যে মানবতা সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়তে শেখায়, মানুষকে এগিয়ে যেতে শেখায়। এই ‘এগিয়ে যাওয়া', এই 'প্রগতি' আজকের অসাম্যের সমাজ কাঠামোর 'প্রগতি' নয়, যেখানে 'মানুষের প্রগতি' বলতে মুষ্টিমেয় মানুষের প্রগতি ও তামাম মানুষের দুর্গতিকে বোঝায়।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যেমন ঈশ্বর বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, ঈশ্বর বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল, তেমনই এও সত্যি - ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলে শুধুমাত্র ঈশ্বর বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো কখনই গড়ে উঠত না। অর্থাৎ 'প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম' ও 'ঈশ্বর বিশ্বাস' উভয় উভয়ের পরিপূরক। এ যেন দুই টলোমলো মাতালের দু'জনের গায়ে ঠেকনা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। বাস্তবিকই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম না থাকলে ঈশ্বর-বিশ্বাস টেকে না। ঈশ্বর বিশ্বাস না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম দাঁড়াতে পারে না।
মানুষের ধর্ম কখনই অলীক বিশ্বাসের ভিতের উপর গড়ে ওঠা হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্ট ইত্যাদি হতে পারে না। এমন ভ্রান্ত 'ধর্ম'-চিন্তা আরোপিত। অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আরোপিত। মানুষ ধর্মের নামে কৃত্রিম ভাবে এমন ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে পারে না। মানুষের একটাই ধর্ম 'মনুষ্যত্ব’ বা ‘মানবতা'। 'মনুষ্যত্ব’ বা ‘মানবতা'র সঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসের মত অলীক বিশ্বাস একান্তভাবেই সুসম্পর্কহীন। সম্পর্ক যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা সংঘর্ষের। অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামের। অলীকের বিরুদ্ধে বাস্তবের সংগ্রামের।
মানুষ ধর্মের নামে কৃত্রিম ভাবে এমন ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে পারে না। মানুষের একটাই ধর্ম—'মনুষ্যত্ব’ বা ‘মানবতা।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্ট বা অন্য যে কোনও ধর্মবিশ্বাসীরাই বিশ্বাস করেন, তাঁদের ধর্মগ্রন্থের নির্দেশিত আচরণবিধি মেনে চলাটাই সৎ জীবন যাপন ও আদর্শ জীবন যাপনের দিশারি। তাঁদের ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মশাস্ত্রগুলোর নির্দেশের বিরোধী কোনও আচরণ কখনই ‘সৎ' বা ‘আদর্শ' আচরণ বলে ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে গণ্য হয় না। যদিও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের নির্দেশের বা বাণীর নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে, তবুও এখনও পর্যন্ত ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মশাস্ত্রগুলোর মূল বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়নি।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিরিখে একজন ধার্মিক লোক কখনই শাস্ত্রের বিধান অমান্য করে ইচ্ছে মত আচরণ করতে পারেন না। ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্রত্যাগকারী অর্জুনকে শাস্ত্রের বিধান মেনে ক্ষত্রিয়ের 'যুদ্ধই ধর্ম' বিবেচনায় অস্ত্র ধারণ করাটাই ইহলোকের কর্তব্য বলে উপদেশ দিতে গিয়ে বলছেন- যে শাস্ত্র-বিধান না মেনে ইচ্ছে মত কাজ করে, সে সিদ্ধি, সুখ বা পরমগতি লাভ করে না। কোনটা কাজ, কোনটা অকাজ, তা নির্ণয়ের একমাত্র প্রমাণ শাস্ত্র। শাস্ত্রের বিধান জেনে শুধু তা পালনের মধ্যেই তুমি ইহলোকের কাজ করতে পার। [ভগবদ্গীতা, ১৬/২৩-২৪]
কোরআন-এর দিকে তাকান, সেখানে বলা হচ্ছে—কোরআন সৎপথের দিশারি। যারা এর নির্দেশাবলী প্রত্যাখ্যান করে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি। [কোরআন ৪৫(১১)]
একইভাবে বৌদ্ধরা 'ত্রিপিটক'-এর বিধানকে সৎপথের দিশারি মনে করেন। খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা 'নিউ টেস্টামেন্ট'-এর নির্দেশিত পথই আদর্শ জীবন যাপনের একমাত্র পথ বলে বিশ্বাস করেন। ইহুদিরা 'ওল্ড টেস্টামেন্ট', 'তালমুদ' ও 'তোরাহ'-এর বিধানগুলোকে সৎপথে চলার নির্দেশ বলে মনে করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি, মূল্যবোধ, সমাজ সচেতনতা—এসবের কোনও দাম নেই। ধর্মগ্রন্থগুলো যে ছক তৈরি করে দিয়েছে, সেই ছককেই ‘চিরন্তন', 'অপরিবর্তনীয়' আদর্শ বলে ধরে নিতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর নির্দেশিত পথ ‘মানবিক' গুণে ভরপুর, এমন একটা বিশ্বাস বহু মানুষের চেতনাকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই আচ্ছন্নতার কারণ - ব্যাপক প্রচার। পত্র-পত্রিকার ছাপার অক্ষরকে, টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দাকে বুদ্ধিজীবীদের কথা ও কলমকে বিশ্বাস করে মানুষ ভেবেছে—সব ধর্মই মানুষের সাম্যে বিশ্বাসী। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির বিরোধী।
এই ধরনের প্রচার ও বিশ্বাস কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, আসুন খোলা মনে একটু বিচার করে দেখি। দেখি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বাস্তবিকই সাম্যের সমাজ গড়তে কতটা আন্তরিক। যাঁরা আধুনিক যুগের তালে তাল মেলাতে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বলেন, “'ধর্ম' মানে শনি-শীতলার পুজো, দর্গার সিরনি বা গির্জার মোমবাতি নয়, 'ধর্ম' মানে ‘way of life' বা একটি বিশেষ জীবন যাপন পদ্ধতি"—আসুন দেখা যাক, ধর্মীয় বিধান-মাফিক জীবন যাপন পদ্ধতি বা 'way of life' কতটা মানবিক। মানবিক কি না—বিচার-বিশ্লেষণের আগে এটা অবশ্যই আরও একবার পরিষ্কার করে বলে দেওয়া প্রয়োজন, প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেই পরমাত্মা বা ঈশ্বর আছেন, আছে ঈশ্বরে পূজার নানা রীতি-নীতি-আচার ইত্যাদি।
এই একই সুরে কথা বলছেন রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় বেত্তারা থেকে মুসলিম ধর্মগুরুরা, বাহাই ধর্মীয় নেতারা, খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারকরা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধর্ম-গুরুরা পর্যন্ত।
এইসব ধর্মগুলো কতটা মানবিক, কতটা মানবতার মূর্ত প্রতীক, তা জানতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ধর্মের বিধানগুলোর দিকে।
হিন্দু ধর্মীয় বিধানে নারী জন্ম-পরাধীন, চির-পরাধীন। মনুর বিধানে [৯:৩] আছে:
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা না স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥
অর্থাৎ নারীকে—
পিতা রক্ষা করবে কুমারীকালে, স্বামী রক্ষা করবে যৌবনে।
বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা, স্ত্রী স্বাধীনতার যোগ্য নয়॥
হঠাৎ মনুর বিধান টানলাম কেন? মনুর বিধান কি হিন্দু ধর্মীয় বিধান, যেমন মুসলিম ধর্মীয় বিধান কোরান বা হাদিস? এমন প্রশ্নের উত্তরে-হ্যাঁ, তাই। মনু কে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন, মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন, ব্রহ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত। এই হেতু তিনি ব্রহ্মাপুত্র বলে বিবেচিত হওয়ার পাশাপাশি 'স্বয়ম্ভূ' মনু বলেও পরিচিত। মনুর স্ত্রী শতরূপা, ছেলে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ। কন্যা–আকুতি, দেবহুতি ও প্রসূতি। এঁদের ছেলে-মেয়েদের থেকেই নাকি মানুষ বা মানবজাতির বিস্তার। মনুর বংশধর বলেই নাকি এই প্রাণীদের নাম হয়েছিল 'মানুষ' বা ‘মানব'।
মনু স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন ব্রহ্মার কাছে। এই স্মৃতিশাস্ত্রই ধর্মশাস্ত্র বা প্রাচীন আইনের বিধান। অর্থাৎ হিন্দু আইনের বিধান ছিল সৃষ্টির দেবতা ব্রক্ষারই চিন্তার ফসল।
মনুর বিধানে মানুষ বিভক্ত হয়েছিল সরাসরি দুটি ভাগে—'পুরুষ' ও নারী'। পুরুষকে প্রভুর ভূমিকায় এবং নারীকে ক্রীতদাসীর চেয়েও অধম, ধর্ষিতার চেয়েও অত্যাচারিতা এবং গৃহপালিত পশুর চেয়েও হীন ভূমিকায় নামিয়ে এনেছিল মনুর আইন অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় আইন।
মনুর বিধানে মানুষ বিভক্ত হয়েছিল সরাসরি দুটি ভাগে—'পুরুষ' ও নারী'। পুরুষকে প্রভুর ভূমিকায় এবং নারীকে ক্রীতদাসীর চেয়েও অধম, ধর্ষিতার চেয়েও অত্যাচারিতা এবং গৃহপালিত পশুর চেয়েও হীন ভূমিকায় নামিয়ে এনেছিল মনুর আইন অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় আইন।
মনুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো একইভাবে নারীকে চূড়ান্তভাবে শোষণ করতে নানা উপদেশ প্রয়োগ করেছে, নানা নীতিকথার নামে দুর্নীতি ছড়াতে চেয়েছে।
শিক্ষা আনে চেতনার মুক্তি, যা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিবেচনায় মনুষ্যত্বের ও মানুষের চরম শত্রু মনু বিধান দিলেন তাঁর বিখ্যাত মনুসংহিতায় [২:৬৭]:
বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহাগ্নি পরিক্রিয়া॥
অর্থাৎ:
বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন।
পতিসেবাই গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা॥
বিধানের এখানেই শেষ নয়। মনু আরও বলেছেন [৫:১৫৪], পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতই পুজো করবে।
তাহলে হিন্দু নারীর বিনোদন কি শুধুই নানা ব্রতপালন ও উপবাস ঘিরেই আবর্তিত হবে?
না, ব্রতপালন, উপবাসের স্বাধীনতা নারীকে দেননি মনু! তাঁর বিধানে আছে [৫:১৫৫]: স্ত্রী'র স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই। নারী স্বর্গে যেতে পারে কেবলমাত্র স্বামী-সেবার সাহায্যেই।
হিন্দু সমাজে পুরুষরা এভাবে নিজেদের লাম্পট্য, অসদাচরণ ও অত্যাচারকে নারীদের কাছে শুধুমাত্র প্রতিবাদহীনভাবে গ্রহণীয় করেনি, নিজেদের দেবতার আসনে বসিয়েছে ধর্মের বিধান খাড়া করে।
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বিধানে পদে পদে পুরুষের লাম্পট্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। পুরুষের লাম্পট্যকে নীতিগতভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় [৬/৬/৮৫] বলা হয়েছে, “যজমান, দীক্ষার দিনে গণিকাসাহচর্য বর্জন করবেন, তার পরদিন পরস্ত্রীর সাহচর্য এবং তৃতীয় দিন নিজ স্ত্রীর সাহচর্য বর্জন করবেন।” অর্থাৎ দীক্ষার দিনেও পরস্ত্রীর সাহচর্য বৈধ ছিল। দীক্ষার দিন ছাড়া অন্যান্য দিন গণিকা গমনও বৈধতার ছাড়পত্র পেয়েছিল এবং গণিকাগমন পুরুষের কাছে কখনই দোষনীয় বা লজ্জার বলে চিহ্নিত হয়নি। বরং চিহ্নিত হয়েছিল পৌরুষের প্রতীক হিসেবেই।
মনুসংহিতায়, অর্থাৎ মনুর বিধানে [৯:৪] বলা হয়েছে, নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় বারো বছর পরে, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে তাগ করা যায় পনের বছর পরে।
সন্তানের জন্ম দেওয়ার অক্ষমতার কারণে স্বামীকে কিন্তু ত্যাগ করার কোনও বিধান নেই হিন্দু শাস্ত্রে।
মনু [৯:৪] ঝগড়ুটে স্ত্রীকে তক্ষুনি ত্যাগ করার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু ঝগড়ুটে শুধু নয়, অত্যাচারী স্বামীকেও দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে বলেছেন এই মনু নামক অমানুষ এক পুরুষ। মানুষের শত্রু, মনুষ্যত্বের শত্রু এই মনুকে দেবত্ব আরোপ করেছে হিন্দু পুরুষ সমাজ। মনুকে ব্রহ্মার অংশ হিসেবে চিত্রিত করে মনুর বিধানকেই আইনের বিধান বলে মেনে নেবার কথা বলেছেন হিন্দু শাস্ত্রকার, যাঁরাও মানুষ ছিলেন না অবশ্যই, যাঁরা ছিলেন পুরুষ শ্রেণীর প্রতিনিধি, যাদের হাতে ধর্মের আর এক নাম কখনই মনুষ্যত্ব হয়ে ওঠেনি, বরং যাঁদের হাতে মনুষ্যত্ব হয়েছে খণ্ডিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত। শত-সহস্র বছর পরে যখন ধর্মের নামে অধর্মের দিন শেষ হয়ে, মানুষের ধর্ম শুধু 'মনুষ্যত্ব' হওয়ার কথা, আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদী তীব্র ক্ষুধা জাগিয়ে তোলার চেষ্টার পাশাপাশি ভাববাদী চিন্তাও মনুষ্যত্বের ধর্ষক ধর্মচিন্তাকে জনপ্রিয় করে তোলার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চলছে শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়।
বৃহত্তর ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম এসেছে সবচেয়ে পরে, অর্থাৎ আধুনিকতম। ইসলাম ধর্ম নারীকে দিয়েছিল কিছু অধিকার যা হিন্দু, খ্রিস্ট বা ইহুদি ধর্ম দেয়নি। তারপর শত শত বসন্ত এসেছে, বিদায় নিয়েছে। ইসলামি পুরুষতন্ত্রের ফাঁস আলগা না হয়ে আরও বেশি করে চেপে বসেছে। নারী আরও বেশি শৃঙ্খলিত হয়েছে। ইসলামি সমাজের বিবর্তনে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রগতির পরিবর্তে সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের আবর্তে।
ইসলাম ধর্মগ্রন্থ কোরআন-এ আছে [সূরা নিসা:৩৪], “পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লা তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন...স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা করে তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদের প্রহার কর।”
কেন প্রহার? স্ত্রী কি পুরুষের ক্রীতদাসী? নারী পুরুষকে সমান চোখে দেখে কোরআন নারীকে এক সঙ্গে চারটি পতি গ্রহণের অনুমোদন দিতে পারেনি। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে কোরআন বলছে [সূরা নিসা:৩], “বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার।”
ইসলাম ধর্ম নারীকে দেখেছে পণ্য হিসেবে। ভোগের সামগ্রী হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়। তারই পথ নির্দেশ রয়েছে কোরআন-এ। সেখানে বলা হচ্ছে [সূরা বাকারা:২২৩] “তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র: তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পার।”
ইসলাম ধর্ম নারীকে দেখেছে পণ্য হিসেবে। ভোগের সামগ্রী হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়। তারই পথ নির্দেশ রয়েছে কোরআন-এ। সেখানে বলা হচ্ছে [সূরা বাকারা: ২২৩] “তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র; তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পার
ধর্মের সূত্র ধরে মরক্কোর সংবিধানে স্ত্রীকে স্বামীর আইনি ক্রীতদাসী করা হয়েছে। ও দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে—স্ত্রী বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের সম্মান করবে। স্ত্রী যদি তার মা-বাবাকেও দেখতে চায়, স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। [‘The Sisterhood of Man’ by Newland Kathleen: W.W.Norion & Co., New York: 1979. Page–24]
ইসলামে বিয়ে একটি চুক্তি। বিয়েতে নারীর সম্মতির প্রয়োজন হয়। এই সূত্র ধরে ইসলাম ধর্মে শ্রদ্ধাবান বহু মানুষকে বলতে শুনেছি—ইসলাম ধর্ম নারীকে দিয়েছি কিছু অধিকার যা অন্য ধর্ম দেয়নি।
এ-কিন্তু বাস্তব সত্য নয়। ইসলামে বিয়েতে পাত্র-পাত্রী যে চুক্তিতে আসে, তা পাত্র-পাত্রী ঠিক করে না। চুক্তি সম্পাদন করে পাত্র-পাত্রীর অভিভাবক। এই চুক্তি একজন মালিকের সঙ্গে একজন গোলামের চুক্তি ভিন্ন যে কিছুই নয়, তা মুসলিম ধর্মীয় অনুশাসনে নারীদের অবস্থান নিয়ে সামান্য যে আলোচনা করেছি তাতেই যথেষ্টর বেশিই বোঝা গেছে। বিয়েতে নারীর সম্মতির কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে এই সম্মতি একটি নিয়মরক্ষা বা অভিনয় বই কিছুই নয়। অভিভাবকরা বিয়ে ঠিক করে ফেলার পর আমন্ত্রিতদের সামনে পাত্রীর সম্মতি, একটি আচারের চেয়ে বাড়তি গুরুত্ব পায়নি।
ইসলামে বিয়েতে পাত্র-পাত্রী যে চুক্তিতে আসে, তা পাত্র-পাত্রী ঠিক করে না। চুক্তি সম্পাদন করে পাত্র-পাত্রীর অভিভাবক। এই চুক্তি একজন মালিকের সঙ্গে একজন গোলামের চুক্তি ভিন্ন যে কিছুই নয়।
আরব অঞ্চলে 'ইদ্দা' নামে একটি ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এই বিধান মতো স্বামী তিন মাসের জন্য স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে এবং তিন মাস পরে আবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে। এই মধ্যবর্ত্তী সময়ে স্বামী কোনও নারীকে স্ত্রী করে তার চার স্ত্রী রাখার ধর্মীয় অধিকার বজায় রাখতে পারে। আরবের অনেক পুরুষ ‘ইদ্দা' বিধান মত চার স্ত্রীকেই মাঝে মাঝে তিন মাসের জন্য বিদায় দিয়ে নতুন চার স্ত্রীকে নিয়ে যৌন উত্তেজনা উপভোগ করে।
মুসলমান পুরুষ যে কোনও ধর্মের নারীকেই বিয়ে করার অধিকারী। কিন্তু মুসলমান নারী বিধর্মীকে বিয়ে করার অধিকারী নয়। সত্যিই কি বিচিত্র সাম্য! যে ধর্ম মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সে ধর্ম কখনই মানুষের ধর্ম হতে পারে না। প্রতিটি অলৌকিক ও অলীক বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম নিয়ে সামান্য পড়াশুনো করলেই দেখতে পাবেন এরা কী প্রচণ্ড রকমের মানবিকতার শত্রু। এরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে ঘৃণা।
খৃস্ট ও ইহুদি ধর্ম একইভাবে নারীকে শয়তানের আসনে বসিয়েছে। আর তাই শোষক শ্রেণীর কাছে 'ধর্ম' আজ এক শক্তিশালী অস্ত্র, যার সাহায্যে শোষিতদের ভেঙে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায় পরম নিশ্চিন্তে, অবহেলে, বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে।
মুসলিম দুনিয়ার বহু দেশেই 'নারী-খৎনা' নামের এক বীভৎস, বর্বোরোচিত ধর্মীয় প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এই প্রথা মনুষ্যসমাজের কলঙ্ক বই কিছু নয়। এই প্রথা পুরুষকে মানুষ থেকে শয়তানে পরিণত করেছে। আর নারীকে পরিণত করেছে পশুতর জীবে।
খৎনা প্রথা আজও প্রচলিত আছে ঘানা, গিনি, সোমালিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, নাইজিরিয়া, মিশর, সুদানসহ উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশে। এইসব দেশে নারীদের যৌন কামনাকে অবদমিত করে যৌন-আবেগহীন যৌন-যন্ত্র করে রাখতে পুরুষশাসিত সমাজ বালিকাদের ভগাঙ্কুর কেটে ফেলে। নারীর যৌন আবেগ সষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় যোনির প্রবেশ মুখে পাপড়ির মতো বিকশিত ভগাঙ্কুর। নারীদের খৎনা করা হয় ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ সাধারণভাবে সাত-আট বছর বয়সে। খৎনা যারা করে তাদের বলা হয় 'হাজামী'। দু’জন নারী শক্ত করে টেনে ধরে বালিকার দুই উরু। দুই নারী চেপে ধরে বালিকার দুই হাত। 'হাজামী' ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে ভগাঙ্কুর। এই সময় উপস্থিত নারীরা সুর করে গাইতে থাকেন, “আল্লা মহান, মহম্মদ তার নবী; আল্লা আমাদের দূরে রাখুক সমস্ত পাপ থেকে"।
পুরুষ শাসিত সমাজ এইসব অঞ্চলের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই বিশ্বাসের বীজ রোপণ করেছে, কাম নারীদের পাপ, পুরুষদের পুণ্য। খৎনার পর সেলাই করে দেওয়া হয় ঋতুস্রাবের জন্য সামান্য ফাঁক রেখে যোনিমুখ, খোলা থাকে সূত্রমুখ। খৎনার পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত বালিকার দুই উরুকে একত্রিত করে বেঁধে রাখা হয়, যাতে যোনি মুখ ভালমতো জুড়ে যেতে পারে। বিয়ের পর সেলাই কেটে যোনিমুখ ফাঁক করা হয়, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্য। আবারও বলি, স্বামীর কামকে তৃপ্ত করার জন্যই; কারণ নারীর কাম তো ওরা পাপ বলে চিহ্নিত করে নারীকে করতে চেয়েছে কাম-গন্ধহীন যৌন-যন্ত্র। সন্তান প্রসবের সময় সেলাই আরও কাটা হয়। প্রসব শেষে আবার সেলাই। তালাক পেলে বা বিধবা হলে আবার নতুন করে সেলাই পড়ে ঋতুস্রাবের সামান্য ফাঁক রেখে। আবার বিয়ে, আবার কেটে ফাঁক করা হয় যোনি। জন্তুর চেয়েও অবহেলা ও লাঞ্ছনা মানুষকে যে বিধান দেয়, সে বিধান কখনই মানুষের বিধান হতে পারে না। এ তো শুধু নারীর অপমান নয়, এ মনুষ্যত্বের অবমাননা।
ইসলামের বেহেশত খুঁড়িখানা আর বেশ্যাপল্লী বই কিছুই নয়। এখানে যৌন-সুখ ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার অধিকারী পুরুষ। বেহেশতের হররা সৌন্দর্যে সূর্য, চন্দ্রাকেও মলিন করে। পুরুষদের জন্য বেহেশতের সুখ বিষয়ে কোরআন বলছে, “ওদের সঙ্গিনী দেব আয়তনয়না হুর।” [সূরা দুখান:৫৪] "সাবধানীদের জন্যে রয়েছে সাফল্য: উদ্যান, দ্রাক্ষা, সমবয়স্কা উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী এবং পূর্ণ পানপাত্র।” [সূরা নাবা:৩১:৩৪] এই আয়তনয়না অসামান্য সুন্দরী হুরদের সঙ্গে বেহেশতে আসা পৃথিবীর পুরুষদের মিলন ঘটাবার লোভ দেখানো হয়েছে [সুরা তূর:২০] কোরআনে। এইসব স্বর্গসুন্দরীরা যে হারে অনাঘ্রাত ফুল এবং বেহেশতে আসা পুরুষরাই তাদের জীবনের প্রথম পুরুষ, সে নিশ্চিন্ততার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে কোরআনে [সূরা রহমান:৫৬]!
ইসলামের বেহেশত শুঁড়িখানা আর বেশ্যাপল্লী বই কিছুই নয়। এখানে যৌন-সুখ ও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার অধিকারী পুরুষ।
কল্পিত স্বর্গ বেহেশতে নারীদের কোনও স্থান হয়নি। বরং মুসলিম নীতি নির্দেশক গ্রন্থ হাদিসে বলা হয়েছে, “নারী শয়তানের রূপে আসে আর শয়তানের রূপে যায়।”
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোও একইভাবে নারীকে শয়তান রূপেই চিহ্নিত করেছে। মহাভারত অনুশাসনপর্ব:৩৮-এ বলা হয়েছে—তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান সমান হবে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোও একইভাবে নারীকে শয়তান রূপেই চিহ্নিত করেছে। মহাভারত অনুশাসনপর্ব: ৩৮-এ বলা হয়েছে—তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান সমান হবে।
দেবীভাগবত-এ দেখুন [৯:১], সেখানে বলা হয়েছে, নারীরা জোঁকের মত সতত পুরুষের রক্তপান করে থাকে। মূর্খ পুরুষ তা বুঝতে পারে না, কেননা তারা নারীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে পত্নী মনে করে, সেই পত্নী সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য এবং কুটিল প্রেমালাপে ধন ও মন সবই হরণ করে।
মনুসংহিতায় [৯:১৫] নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে—পুরুষ দেখামাত্রই তারা মেতে ওঠে বলে তারা চঞ্চলচিত্ত ও স্নেহশূন্য; তাই সুরক্ষিত রাখা হলেও তারা স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
নারীকে বশে রাখতে প্রয়োজন স্নেহ-প্রেম ভালবাসা নয়, প্রয়োজন নির্দয় প্রহার—এ কথা হিন্দু শাস্ত্রবাক্যে উচ্চারিত হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে [১:৯:২:১৪] বলা হয়েছে, “লাঠি দিয়ে মেরে নারীকে দুর্বল করা উচিত, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপরে আর কোনও অধিকার না থাকে।”
মনু মনে করতেন, নারী নির্গুণ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “নদী যেমন সমুদ্রের সঙ্গে মিলনে নোনা হয়, নারীও তেমন; যেমন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়, তেমন পুরুষের গুণযুক্ত হয়।” [৯:২২ মনুসংহিতা]
একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় বিধানে নারীর অবিবাহিত থাকা নিষিদ্ধ। বিয়ে ছাড়া নারীর মুক্তি নেই। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মহাভারতে আছে ঋষি কুণির কন্যা সারাজীবন ধর্মপথে থেকে মৃত্যুশয্যায় জানতে পারলেন, চূড়ান্ত ধর্মপালনও একজন নারীর স্বর্গলাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। স্বর্গ প্রাপ্তির জন্য তাকে বিয়ে করতেই হবে। পুরুষদের কিন্তু স্বর্গে যেতে ‘চিরকুমার' থাকা কোনও বাধা নয়।
হিন্দু ধর্মের বিধানে পুরুষতন্ত্র বিধবা নারীকে যেভাবে গ্রাস করতে উদ্যত, তেমনটি পৃথিবীর আর কোনও প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে দেখা যায় না। মনুসংহিতা নির্দেশ দিচ্ছে [৫:১৫৭]: “পতির মৃত্যুর পর পত্নী ফলমূলের স্বল্পাহার দ্বারা দেহ ক্ষয় করবে, তবু পর পুরুষের নাম করবে না।” পত্নীর মৃত্যুর পর পতি কী করবে, তারও নির্দেশ আছে মনুর বিধানে। মনুসংহিতা বলছে [৫:১৬৮]: “পতির মৃত্যু হলে দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে পুরুষ আবার বিয়ে করবে।”
আমাদের দেশের মানুষদের প্রধান ধর্ম ইসলাম ও হিন্দু বলে এই দু'টি ধর্ম নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি। অন্য প্রধান ধর্মগুলোতেও একইভাবে পুরুষ দ্বারা নারীকে অবদমিত রাখার ষড়যন্ত্র ব্যাপকভাবেই উপস্থিত।
ভারতে বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করেছিল মনুর দেওয়া ধর্মীয় অনুশাসন। মনু সংহিতা'য় মনু বললেন:
লোকানান্তু বিবৃদ্ধার্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শুদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ॥ [১:৩১]
অর্থাৎ, পৃথিবীর মানুষদের সমৃদ্ধি কামনায় পরমেশ্বর নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পা থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চার বর্ণ সৃষ্টি করলেন।
ব্রাহ্মণদের কাজ তথা ধর্ম হল—অধ্যাপন, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান, ও প্রতিগ্রহ, এই ছয়টি। [১:৮৮]
ক্ষত্রিয়দের কাজ তথা ধর্ম—প্রজারক্ষণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, ভোগাসক্তি নিয়ন্ত্রণ। [১:৮৯]
বৈশ্যদের ধর্ম—পশুরক্ষণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য, ধনবৃদ্ধির জন্য ধনপ্রয়োগ ও কৃষিকার্য পরিচালন। [১:৯০]
শুদ্রদের কাজ বা ধর্ম—
একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া॥ [১:৯৯]
অর্থাৎ, ক্ষুণ্ণ না হয়ে, প্রসন্নমনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করা শূদ্রগণের প্রধান কর্তব্য, এই নির্দেশ ব্রহ্মা দিলেন।
‘শূদ্র' নামের এই দাসদের পারিশ্রমিক বা বেতন দিতে হত না। দেবার প্রশ্নই নেই। মনু বলেছেন-দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্য বিধাতা শূদ্রকে সৃষ্টি করছেন—“দাস্যায়ৈর হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা” [৮:৪১৩]। কিন্তু দাসদের বাঁচিয়ে তো রাখতে হবে, বেগার খাটাবার জন্যেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শিল্প ও কৃষির দ্বারা নিজেদের ভোগকে চরিতার্থ করার জন্য এইসব শিল্প দাস ও কৃমিদাসদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেইজন্য মনু বিধান দিয়েছেন—শূদ্রভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা বা ঘর দান করিবে [১০:১২৫]।
প্রায় বিনাখরচে শ্রমশক্তি বিনিয়োগের প্রয়োজনেই উচ্চবিত্তেরা সৃষ্টি করেছিল ‘শূদ্র নামের বর্ণটি। আর সেই সৃষ্টির কাজে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ঈশ্বরনির্ভর ধর্ম। ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নির্দেশের নামে সেদিন শূদ্রদের ‘মানুষ’ বলে বিবেচিত হওয়ার সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
শূদ্রদের ধন উপার্জনের অধিকার ছিল, কিন্তু সেই ধন ভোগের কোনও অধিকার ছিল না। সব উপার্জিত ধনই দাস-মালিক গ্রহণ করবে, এই ছিল মনুর বিধান—ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্ত্তৃহার্যধনো হি সঃ। [৮:৪১৬ এবং ৪১৭]
শূদ্রদের আর তিন বর্ণ থেকে আলাদা করে যাতে চেনা যায়, এবং শূদ্ররা যেন প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখে তিন বর্ণের মানুষদের ক্রীতদাস হয়ে সেবা করার জন্যই তাদের জন্ম, তিন বর্ণের মানুষদের থেকে তারা ভিন্নতর জীব, মনুষ্যেতর জীব—সে জন্যে শূদ্রদের প্রতি মাসে কেশ মুণ্ডনের নির্দেশ দিয়েছেন মনু। [৫:১৪০]
ঈশ্বর-নির্দেশে শূদ্রের না ছিল নাগরিক অধিকার, না ছিল ধর্মীয় অধিকার, না অর্থনৈতিক অধিকার।
এই স্বল্প পরিসরের আলোচনার মধ্যে দিয়েও আমাদের বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি, এইসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আদিম মানুষের সাম্যের সমাজকাঠামোর ভিত উপড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা করেছিল অসাম্যের সমাজের, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের। ধর্ম তৈরি করেছিল হুজুর ও মজুর শ্রেণী বিভাজন। তৈরি করেছিল নারী-পুরুষে বিভাজন। প্রতিষ্ঠা করেছিল শোষণের। প্রতিষ্ঠা করেছিল পুরুষতন্ত্রের।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আদিম মানুষের সাম্যের সমাজকাঠামোর ভিত উপড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা করেছিল অসাম্যের সমাজের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের। ধর্ম তৈরি করেছিল হুজুর ও মজুর শ্রেণী বিভাজন। তৈরি করেছিল নারী-পুরুষে বিভাজন। প্রতিষ্ঠা করেছিল শোষণের। প্রতিষ্ঠা করেছিল পুরুষতন্ত্রের।
হ্যাঁ, আবারও বলি, শোষণের জন্যেই সে সময় রাজশক্তি বা ক্ষত্রিয়দের শক্তির সঙ্গে ধর্মগুরু বা ব্রাহ্মণদের বৃদ্ধি যুক্ত হয়েছিল। ব্রাহ্মণরা, ধর্মগুরুরা এই অশুভ আঁতাত, শোষণের আঁতাত টিকিয়ে রাখতেই প্রচার করেছিল—ধর্মগ্রন্থগুলো স্বয়ং ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত। মানুষে মানুষে এই বিভাজন ঈশ্বর নির্দেশিত।
এই অশুভ আঁতাতের কথা আমার কল্পনাপ্রসূত নয়। মনুর শ্লোকেই এর হদিস পাবেন। মনুসংহিতার ৯ম অধ্যায়ের ৩২২ নম্বর শ্লোকে মনু বলেছেন—
না ব্রহ্মক্ষন্দ্রমধ্নোতি নাক্ষদ্রং ব্রহ্ম বর্দ্ধতে।
ব্রহ্ম ক্ষন্দ্রঞ্চ সম্পৃক্তমিহ চামুত্র বর্দ্ধতে॥
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণহীন ক্ষত্রিয় কখনও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন না; ক্ষত্রিয় ব্যতিরেকে ব্রাক্ষণও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন না; ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ মিলিত হলে উভয়েরই শক্তিবৃদ্ধি হয়।
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, এই দুই বর্ণের মিলন নিজ নিজ ধর্মের স্বার্থেই অতি প্রয়োজনীয় বলে যে নির্দেশ প্রাচীনকালে মনু দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশকে আজও মান্য করেই চলেছে চলমান ধর্ম ও রাজনীতির অশুভ আঁতাত।
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, এই দুই বর্ণের মিলন নিজ নিজ ধর্মের স্বার্থেই অতি প্রয়োজনীয় বলে যে নির্দেশ প্রাচীনকালে মনু দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশকে আজও মান্য করেই চলেছে চলমান ধর্ম ও রাজনীতির অশুভ আঁতাত।
ধর্মকে মানবিক বলে লাগাতার প্রচারের যে চেষ্টা বর্তমানে ব্যাপকতা পেয়েছে, তা শোষণের রাজনীতিকে পালন ও পুষ্ট করার স্বার্থে একান্তভাবেই অন্তঃসারশূন্য প্রচার মাত্র, মিথ্য প্রচার মাত্র।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম না থাকলে কি সমাজ উচ্ছন্নে যাবে?
ধর্মের মূলগত অনুশাসনগুলোই যেখানে শোষণব্যবস্থা বজায় রাখার সহায়ক, মানুষের দ্বারা মানুষকে অবদমিত করে রাখার সহায়ক, সেখানে এই আচরণবিধিগুলোর অনুসরণ কোনওভাবেই আদর্শ জীবনের সহায়ক হতে পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনির্দেশিত এই ‘way of life’ কোনও ভাবেই মানুষ হয়ে ওঠার দিশারি হতে পারে না।
এরপরও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত বহু মানুষ বলবেন—ধর্ম না থাকলে মানুষ নীতিজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে সমাজকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে। এই ধরনের বক্তব্য বেশ কয়েকটি কারণে একান্তভাবেই অন্তঃসারশূন্য।
দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষিত হয় আইন সৃষ্টি ও তার প্রয়োগ দ্বারা। শাস্ত্রের বিধান দ্বারা নয়।
কারণঃ এক—দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষিত হয় আইন সৃষ্টি ও তার প্রয়োগ দ্বারা। শাস্ত্রের বিধান দ্বারা নয়। ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ বলে পরিচিত দেশগুলো বাস্তবে জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ধনকুবের গোষ্ঠীর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়! দেশের আর্থসামাজিক-সমাজসাংস্কৃতিক আইন-এর নিয়ন্তক শক্তি দেশের ধনিককুল। এই সব তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণভাবে যেটুকু শৃঙ্খলা দেখতে পাই, তা ধর্মীয় নীতির চেয়ে বেশি মানবিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইন ও তার প্রয়োগের কারণে। ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোর দিকে একটু নজর দিলেই দেখতে পারি, এসব দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর যেমন রমরমা, তেমনই খোলামেলা রমরমা দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের। যে সব দেশের শাসক গোষ্ঠী ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছে, সে'সব দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে ফিরে তাকান, দেখতে পাবেন-প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধ্বজা যেমন আকাশচুম্বি, তেমনই সমুদ্রগভীর সেসব দেশের স্বৈরতন্ত্র, শোষণ, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদি কদাচার।
যে সব দেশের শাসক গোষ্ঠী ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা রেছে, সেসব দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে ফিরে তাকান, দেখতে পাবেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধ্বজা যেমন আকাশচুম্বি, তেমনই সমুদ্র-গভীর সে'সব দেশের স্বৈরতন্ত্র, শোষণ, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদি কদাচার।
বিষয়টা সঠিকভাবে বুঝতে একটি উদাহরণ টেনে আনা যাক।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তান। ১৯৯২ সাল থেকে সে দেশে ক্ষমতা দখল করে রয়েছে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত মুজাহেদিনদের বিভিন্ন গোষ্ঠী। আফগানিস্তানে বর্তমানে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। লুঠ, নরহত্যা, নারী-ধর্ষণ নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী মুজাহেদিনদের নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রতিদিনই বহু আফগান পরিবার দেশান্তরী হয়েই চলেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস আফগান মুজাহেদিনদের মধ্যে কোনও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করতে পারেনি।
ঠিক এর কয়েক বছর আগের আফগানিস্তানের ইতিহাস কী বলে? সেই সময়গুলোতে, অর্থাৎ সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকারের আমলে, 'পাপ করলে নরকবাস'—এ বিশ্বাস না করা সরকারের আমলে কি আফগানিস্তানে এর চেয়েও বেশি রকম জঙ্গলের রাজত্ব ছিল?
না, ছিল না। অতি স্পষ্ট করে এবং সোচ্চারেই আমরা বলতে পারি—সেই সময় ওই দেশে প্রথম দেখা দিয়েছিল নারী প্রগতি: নারীদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল। নারীরা চার-দেওয়াল ও বোরখার অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। নারীরাও মানুষ হয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়েছিল। তারই ফলে মুজাহেদিনদের আক্রমণ থেকে সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করার জন্য আফগান নারীরা এক দিকে নিজেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, আর এক দিকে জীবনসঙ্গী, ভ্রাতা ও পুত্রদের প্ররোচিত করেছিল।
আমার এই কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্য আফগানিস্তানের সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকার বা মুজাহেদিনদের সমর্থন বা অসমর্থন নয়। আমি আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সমাজ-চিত্র তুলে ধরে এটুকুই প্রমাণ করতে চাইছি, 'ধর্ম বিশ্বাস'-এর উপর একটি সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধের উন্নতি নির্ভর করে না।
কারণ: দুই—প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কালের ধর্মগুরু, ধর্মযাজক, পীর-মোল্লাদের ইতিহাসের দিকে প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা ফিরে তাকান। স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকান। দেখতে পাবেন, এইসব নীতিজ্ঞানী ধর্মীয়বেত্তাদের জীবনে সদাচারের বদলে বার বার জড়িয়ে গেছে ঐশ্বর্যলিপ্সা, বিলাসিতা, ক্ষমতালিপ্সা, দুর্নীতি, ব্যভিচার, বিকৃত-কামনা, ভ্রান্ত-চিন্তা, মিথ্যাচারিতা ইত্যাদি নানা কদাচার। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যেখানে ধর্মগুরুদের কদাচারেই লাগাম লাগাতে পারেনি, সেখানে সাধারণ মানুষদের সদাচার শেখাবে কীভাবে?
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যেখানে ধর্মগুরুদের কদাচারেই লাগাম লাগাতে পারেনি, সেখানে সাধারণ মানুষদের সদাচার শেখাবে কীভাবে?
কারণ: তিন—১৯৮৮ সালে আমাদের দেশের ১০০ জন অপরাধীর উপর একটি ‘সার্ভে' বা 'তথ্যানুসন্ধান'-এর কাজ চালিয়েছিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'। বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই ১০০ জন অপরাধিদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাসকে যুক্ত করে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিয়েছিল। এরা প্রত্যেকেই আত্মা, পরমাত্মা, স্বর্গ-নরক, পাপ-পূণ্য ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আরোপিত বিশ্বাসে পুরোপুরি আস্থাশীল ছিল। এই প্রসঙ্গ নিয়ে 'কারণ: আটত্রিশ'-এ আরও একটু বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর উপদেশ-ভয়-অলীক বিশ্বাস এইসব অপরাধীদের অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
এই আলোচনার পর একথা বলার আর সুযোগ নেই—'ধর্মগ্রন্থের নির্দেশিত আচরণবিধি কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলাই সদাচার, ধর্মের বিধান থেকে গড়ে ওঠা way of life-ই আদর্শ জীবনদিশা’, ‘পাপ-পুণ্য; স্বর্গ-নরক, ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত করে'।
কারণ: বিয়াল্লিশ
পৃথিবী পাপে-অন্যায়ে-দুর্নীতিতে ভরে গেলে ঈশ্বর কি অবতার হয়ে পৃথিবীতে এসে সমাজ’কে ‘পাপ' মুক্ত করবে? এই কি সমাজ পাল্টাবার অনিবার্য উপায়?
পুরানের আমল ছেড়ে ইতিহাসের আমলে পা রাখা থেকে আজ পর্যন্ত যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তাতে অনেক অত্যাচার, অনেক দুর্নীতি, অনেক সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, অনেক স্বৈরাচারী শাসক, অনেক রক্তপাত, অনেক হত্যা বহমান। তা সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত পৃথিবীকে এইসব 'পাপ' থেকে মুক্ত করতে অবতারের ভূমিকা।
সমাজ সচেতনতার সঙ্গে ইতিহাসে চোখ রাখলে বরং এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অবতার-পয়গম্বররা শাসক ও শোষকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার কাজেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে চলেছে। অসাম্য-অবিচার-দুর্নীতি-শোষণের সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে চলেছে।
একবার ভাবুন তো, শোষিত মানুষ অসাম্য, শোষণ ও দুর্নীতির সমাজ পাল্টাবার দায়-দায়িত্ব ঈশ্বর-অবতারদের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কী হবে? শোষিত মানুষের অলীক চিন্তার সুযোগ নিয়ে অসাম্য, শোষণ ও দুনীতির সমাজ কাঠামো নিরুপদ্রবে তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে।
ইতিহাস এ কথাই বলে, যে সব দেশের মানুষ সাম্যের সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সমাজকে পাল্টে দিয়েছিল (হতে পারে এই পাল্টানো ছিল সাময়িক। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবনে নেতৃত্বের অক্ষমতার দরুন সাম্য-চিন্তা স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া ধাক্কা খেয়েছিল, ভিতরে ভিতরে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল ক্ষমতালোভী ঘুণ পোকাদের অবাধ দংশনে), সে'সব দেশের মানুষ ঈশ্বর ও অবতারদের হাতে সমাজ পাল্টাবার ভার সঁপে না দিয়ে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল বলেই সাফল্য পেয়েছিল।
শোষিত মানুষ অসাম্য, শোষণ ও দুর্নীতির সমাজ পাল্টাবার দায়-দায়িত্ব ঈশ্বর-অবতারদের উপর চাপিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কী হবে? শোষিত মানুষের অলীক চিন্তার সুযোগ নিয়ে অসাম্য, শোষণ ও দুর্নীতির সমাজ কাঠামো নিরুপদ্রবে তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে।
চূড়ান্ত সাফল্য পেতে, শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়তে, নিপীড়িত মানুষকেই নামতে হবে সংঘর্ষে ও নির্মাণে। ঈশ্বর-অবতার-পয়গম্বরদের উপর নির্ভরশীলতাকে বিসর্জন দিয়েই নামতে হবে জয়কে ছিনিয়ে নিতে।
শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়তে, নিপীড়িত মানুষকেই নামতে হবে সংঘর্ষে ও নির্মাণে। ঈশ্বর-অবতার-পয়গম্বরদের উপর নির্ভরশীলতাকে বিসর্জন দিয়েই নামতে হবে জয়কে ছিনিয়ে নিতে।