আলোর ফুলকি/৭

উইকিসংকলন থেকে

বনে বসন্তকাল এসেছে। চমৎকার দিনগুলি— আলো-ছায়ায় নিবিড় বনের সবুজে ঢাকা পথে-পথে, আর নিস্তব্ধ রাতগুলি— রাঙা-ফুলে ঢাকা অশোক গাছের দোলনায়, কুঁকড়ো আর সোনালিয়া ফুটিতে আনন্দে কাটাচ্ছেন। এমন সবুজ, এমন ঠাণ্ডা ছায়ায় ছায়াময় সে বন, যেন মনে হয় মায়ের কোলে এসেছি। সেইখানে কুঁকড়ো আস্তে আস্তে সব কষ্ট ভুলতে লাগলেন। সকাল থেকে সন্ধে তিনি বেড়িয়ে বেড়ান, একলাটি। চারি দিকে বড়ো বড়ো দেবদারু আর ঝাউ, এত পুরোনো যে তাদের বয়স কেউ জানে না। ডালে ডালে সব সবুজ শেওলা জটার মতো বুলে পড়েছে; শিকড়গুলো তাদের পাথর আঁকড়ে কোন পাতালে যে নেমে গেছে তার ঠিক নেই। কোথাও বুর-কুর করে পাতা ঝরছে, কোথাও ঝাউ ফলগুলোয় মাটি একেবারে বিছিয়ে গেছে। একটা নালার ধারে ঝরনা ঝরছে, তারি এক পাশে ব্যাঙের ছতরি বেঁধে হাট বসিয়েছে।  কত রকমের পাখি গাছে গাছে। কাঠবেরালি সব বাদাম-গাছের ডালে-ডালে লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে; খরগোস ঘাসের মধ্যে লুকোচুরি আর কপাটি খেলছে। বনে এসেই খরগোসগুলোর সঙ্গে কুঁকড়োর ভাব হয়ে গেল; কিন্তু তারা ফ্যাল-ফ্যাল ক'রে চেয়ে থাকে,সোনালিয়া সেট সইতে পারে না; এক-একদিন কুঁকড়োর আড়ালে ডানার ঝাপটা দিয়ে তাদের ভয় দেখাতে ছাড়ে না।

 একটা কাঠঠোকরার সঙ্গে কুঁকড়োর খুব জমে গেল। অশোক-গাছটার পাশেই একটা কাঠাল গাছে তার কোটর। দিনের মধ্যে দশবার সে কুঁকড়োর সঙ্গে গল্প করতে এসে হাজির হয়। সোনালিয়। কিন্তু এটা ভারি অপছন্দ করে; সময় নেই, অসময় নেই, এলেই হল? শেষে কাঠঠোকরার সঙ্গে বন্দোবস্ত হল, আসবার আগে সে তিনবার ঠকঠক আওয়াজ দিয়ে তবে অগসবে।

 কিন্তু কাঠঠোকরার গল্প শুনতে কুঁকড়ো সত্যি ভালোবাসেন; সে যে কত কালের সব পাখিদের কথা জানে, তার ঠিক নেই।

 একদিন সন্ধেবেলা কাঠঠোকরা কুঁকড়োকে সন্ধ্যা-পাখির গান শোনালে। সে অতি চমৎকার। দুটি টুনটুনি স্বর ধরলে আর বনের সব পাখি তাদের গানে আস্তে আস্তে যোগ দিলে। প্রথম পাখিটি গাইলে, “ও আমাদের বন্ধু।” জুড়ি-টুনটুনিটি অমনি ধরলে, “ও অনাথের নাথ!” হাজার হাজার পাখির মিষ্টি স্বর অমনি গাছে গাছে সাড়া দিলে, “ওগো বন্ধু। ওগো বন্ধু।” তারপরে বন্দন শুরু হল—

 “নমস্কার নমস্কার। আকাশে নমস্কার, আলোতে নমস্কার, আভাতে নমস্কার, বাতাসে নমস্কার, রাতে নমস্কার, দিনে নমস্কার— তোমাকে নমস্কার। তোমার দেওয়া চোখের আলো, তোমার দেওয়া মিষ্টি জল, তোমার এই ঘন বন, তোমার এই মধুফল, তোমার এই কাটার বেড়া, তোমার এই সবুজ ঘাস। মিষ্টি স্বর এও তোমার, তোমার এ নিশ্বাস। তোমার এই পাতার বাসা, তোমার এই ছোটো পাখি। আমার এই ছোটো সুরে তোমারেই আমি ডাকি।—ছোটো বাসার ছোটো পাখি— সন্ধ্যা হল তোমায় ডাকি, দিনের শেষে তোমায় ডাকি, বন্ধু এসো,তোমায় ডাকি।”

 এ পাখি থেকে ও পাখি, এ গাছ থেকে ও গাছ, এমনি ক’রে বনের শেষ পর্যন্ত “বন্ধু এসে।”

 ১০ ব’লে সবাই ডাক দিয়ে গেয়ে উঠল। কুঁকড়োও ডাক দিলেন, “বন্ধু বন্ধু!” তার পর একটি একটি করে সব ছোটে পাখির পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে চাদের আলো বনের ফাঁক দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ঝরনার মতো নেমে এল— লতাপাতার কিনারায়, পাথরের উপর, শেওলার গায়ে। কুঁকড়ো দেখলেন, একটুখানি মাকড়সার জালে হীরের মতে কী ঝলক দিচ্ছে। মনে হল, বুঝি একটা জোনাক-পোকা জালে পড়েছে। কাছে গিয়ে দেখেন, বিষ্টির একটি ফোটায় চাদের আলো এসে লেগেছে। এমনি সব নূতন-নূতন কত কী দেখতে দেখতে সেই মহাবনে কুঁকড়োর দিন আর রাতগুলি আনন্দে কাটছে।

 বনে ফিরে এসে কুঁকড়ো আবার তার গান ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু কেবল সকালের গানটি ছাড়া সোনালি তাকে আর-একটি গানও গাইতে দেবে না— তাও আবার সকালটা যদি সোনালির গায়ের পালকের চেয়েও রঙিন আর জমকালো হয়ে দেখা দেয় তবেই। কুঁকড়ো সোনালিকে বলেন, “এই আলোতেই আমাদের সেদিনের মিলন, সেটা ভুললে চলবে না সোনালি। আলোর জয় আমাকে দিতেই হবে সারাদিন।” সোনালি বলে, “তুমি আমার চেয়ে আলো-কে কেন ভালোবাসবে।”

 ইতিমধ্যে একদিন চকচকে সবুজ এক সোনাল-পাখির সঙ্গে সোনালির দেখাশুনো হয়েছে,আর গহন-বনের একটা নির্জন পথে ফুটিতে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে এটা কুঁকড়োর চোখ এড়াল না। কিন্তু মনের দুঃখ মনেই রেখে কুঁকড়ো ভাবলেন, “আমি কি বলতে পারি, কেন তুমি সোনালকে বেশি পছন্দ করবে আমার চেয়ে সোনালি? আকাশ কি কোনোদিন তাতে-পোড়া পৃথিবীকে বলতে পারে— তুমি বিষ্টির ফোটাগুলিকে রোদের চেয়ে কেন ভালোবাসবে? না, মাটিই বলতে পারে আকাশকে— তুমি বিষ্টিকেই বরণ করে, আলো-কে চেয়ে না! সোনালিয়া, সে বনের তুলালী, অরণ্য তো তাকে আমার সঙ্গে বাইরে— দূরে পাঠাতে পারবে না; সে দূত পাঠিয়েছে ঘন বনের সবুজ সোনাল-পাখিটি; ওরি সঙ্গে কোনদিন চলে যাবে ঝরা ফুল ঝরা পাতার স্বপ্ন-বিছানো গহন-বনের অন্দরের পথে সোনার আঁচলে ঝিলিক দিয়ে সোনার পাখি। আর আমি” —বলে কুঁকড়ো নিশ্বাস ফেললেন।—“কাঠঠোকরা ঠিকই বলে, যেখানে যার বাসা, সেইখানেই তার ভালোবাসা। আমার সবই সেই পাহাড়তলির আকাশের নীচে —আর সোনালির সবই এই বনের তলায় যেদিন দেখা দেবে, সেদিন তো কেউ-কাউকে ‘যেয়ে না বলে রাখতে পারব না; কেবল এইটুকুই সেদিন বলবার থাকবে— ভুলো না বন্ধু, মনে রেখো।”

 সে আর-একদিন; দুজনে অশোক-তলাটিতে দাঁড়িয়ে; সূর্য অস্ত গেছে; সন্ধ্যার পাখিদের গান বন্ধ হয়েছে; দু-একটা কাঠবেরাল তখনো পাতার মধ্যে উস্থুস করছে; খরগোসগুলো তাদের গড়ের বাইরে বসে একটু সন্ধের বাতাসে জিরিয়ে নিচ্ছে; বন আস্তে-আস্তে নিঝুম হয়ে আসছে। রাত্রির অন্ধকারে গাছ সব ক্রমে যেন মিলিয়ে গেল; সেই সময় ক্রমে-ক্রমে চাদের আলো ঘুমন্ত বনে এসে পড়ল। সে রাতের মতো বিদায় নেবার জন্তে সোনালি কুঁকড়োকে “আসি” বলতে গিয়েই দেখলে খরগোসগুলো চোখ প্যাট-প্যাট করে তাদের দিকে দেখছে। অমনি এক ডানার ঝাপটায় সোনালি তাদের তাড়িয়ে দিয়ে বললে, “আসি তবে।” কুঁকড়ে বললেন, “দেখো, মনে রেখে।” সোনালি বিদায় নিয়ে অশোক ফুলের গাছে তার মনোমত ডালটির উপরে উড়ে-বসতে ফিরে দাড়িয়েছে, এমন সময় পায়ে তার কী-একটা ঠেকল। “ইস্ ব'লে সোনালি সরে দাড়িয়ে দেখলে কী, সে তো কিছু বুঝতে পারলে না। কুঁকড়ো কাছে এসে দেখে বললেন, “সর্বনাশ, এ যে ফাঁদ পাতা রয়েছে। কে এখানে ফাদ পাতলে?” টুক্‌টুক্‌টুক্‌তিনবার আওয়াজ দিয়ে সবুজ ফতুয়ালাল-টুপিটি মাথায় কাঠঠোকরা কোটর থেকে বেরিয়ে বললেন,“ফাঁদটা বঁচিয়ে চোলো, ওই গোলাবাড়ির মানুষটিই ফাঁদ পেতেছে,সোনালিয়াকে ধরবে ব'লে।” “আমাকে ধরা তার কর্ম নয়।”—ব’লে সোনালি মাথা ঝাড়া দিলে। কাঠঠোকরা বলল, “শুনলুম সে তোমাকে ধরে পোষ মানাবে।” কড়ো বললেন, “তিনি খুব ভালো লোক, যদি তুমি ধরা পড়তে,তবে তোমাকে তিনি কষ্ট দিতেন না, এটা আমি ঠিক বলতে পারি।” সোনালি বললে, “কষ্ট না দিন, কিন্তু প্রাণ থাকতে সোনালি তার পোষ মানত না, সেটাও ঠিক।”

 ফাঁদ পাতা হলে বনের সবাই সরাইকে সাবধান না ক’রে নিশ্চিন্ত হতে পারে না, তাই খরগোস এসে বললে, “দেখো, খবরদার ওই কলটাতে যেন পা দিয়ে না; ছুয়েছ কি —”

 “বোকো না তুমি। ফাঁদে যে আটকায় কেমন-ক’রে তা আমি খুব জানি। এক কুকুর ছাড়া আর কাউকে আমি ডরাই নে। ঘরে যাও, ঠাণ্ডা লাগবে।”—ব’লে সোনালি আস্তে ডানার ঝাপট দিয়ে খরগোসকে বিদায় ক’রে কুঁকড়োকে বললে, “আমি একবার গোলাবাড়ির দিকে যাচ্ছি।”

 কুঁকড়ো ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “কেন। কেন। সেখানে কেন।” “ও-দিককার কুকুরগুলোকে একটু দৌড় করিয়ে আসি। এই এক-পা এখানে, এক-পা ওখানে, যাব আর আসব, দেরি হবে না।”

 সোনালি চলে গেল, কুঁকড়ো অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে, গাছের উপর কাঠঠোকরাকে শুধালেন, “সোনালিকে দেখতে পাচ্ছ কি।” কাঠঠোকরা উচু ডাল থেকে গলা বাড়িয়ে দেখে বললেন, “ন, তিনি গেছেন।” কুঁকড়ো বললেন, “তুমি ভাই, একটু নজর রেখে তো, সে আসছে কি না। আমি একবার গোলাবাড়ির চড়াইটার সঙ্গে কথা কয়ে নিই।”

 কাঠঠোকরা আশ্চর্য হয়ে ব’লে উঠল, “চড়াই না তোমার শত্রু?”

 কুঁকড়ো বললেন, “কিন্তু খবর দিতে আর তার মতো ছটি নেই। খবর যা চাও, তার কাছে পাবে।”

 “চড়াই আসছেন নাকি।” কাঠঠোকরা শুধলে।

 কুঁকড়ো বললেন, “না। এই দেখে-না তাকে ফোঁ করি। এই যে নীল ধুঁতরো ফুলটা দেখছ, এর সঙ্গে মাটির মধ্যে দিয়ে তারের মতো সরু শিকড় দিয়ে গোলাবাড়ির পুকুরধারে শ্বেত ধুঁতরো ফুলের যোগ আছে। ফুলের ভাষা ব’লে কবিতার বইয়ে পড়েছ তো। একেই বলে ফুলে-ফুলে কানাকানি।”

 বনের মধ্যে যে এমন কল আছে কাঠঠোকরা তা জানত না। ফোঁ কেমন, দেখতে সে ব্যস্ত হল। কুঁকড়ো ফুলের মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকলেন, “হ্যালো।” খানিক ঘর-ঘর শব্দ হল – “হ্যালোচড়াই। গোলাবাড়ি।” কাঠঠোকরা বলে উঠল,“কুঁকড়ো ভাই,তোমার তো সাহস কম নয়। বাসার একেবারে দরজায় দাড়িয়ে কথা-চালাচালি। সোনালি টের পেলে—।”

 কুঁকড়ো বললেন, “সেখান থেকে যখন কথা আসবে তখন এই ফুলের মধ্যে যে মৌমাছিটা আছে, সে জেগে উঠবে আর—।”

 বোঁ-ওঁ-ও শব্দ হল। অমনি কুঁকড়ো ফুলে কান দিয়ে “চড়াই নাকি” বলে খানিক আবার শুনে বললেন, “ও তাই নাকি। আজ সকালে—।”  কাঠঠোকরা শুধলে, “কী বলছে? কী?”

 কুঁকড়ো বললেন, “দুকুড়ি দশটা মুরগির বাচ্ছা ফুটেছে?” তার পর আবার একটু শুনে বললেন, “বলো কী। তন্মার ভারি ব্যায়রাম”

 কী একটা গোল বাধল। কুঁকড়ো বললেন, “রোসে, রোসে। কী। ভালো শোনা যাচ্ছে নাহে। আঃ, মশাগুলো জালালে। চড়াই, আঃ, হা হা তারপর, জিম্মাকে নিয়ে তারা শিকারে বেরবে। বল কী হে। “জিন্ম গোলাবাড়ির একজন।”—কাঠঠোকরাকে এই বলে কুঁকড়ো আবার ফেঁধরলেন, “কী বললে? আমি চলে আসবার পর থেকে সব কাজে গোলমাল চলেছে? এ তে জানা কথা— এই সেদিন এসেছি এরি মধ্যে. যেতে হবে. তাই তে কী করা যায় হে... যাব নাকি। কী বল।” কাঠঠোকরা চুপিচুপি বললে, “সোনালি আসছেন।” কিন্তু কুঁকড়ো তখন মন দিয়ে কানে ফুলটা চেপে ধরেছেন, কাঠঠোকরার কথা তার কানেইগেল না। কথা চলল, “কী বললে? হাসগুলো সারারাত লাঙলটার তলায় ঘুমিয়েছে? বল কী!” কাঠঠোকরা কুঁকড়োকে বলছে, “থাক, দেখো, চুপ।” কিন্তু কিছু ফল হচ্ছে না। ওদিকে সোনালি এসে উপস্থিত। কাঠঠোকরাকে ইশারায় চুপ করতে ব’লে সোনালি কুঁকড়োর পিছনে লুকিয়ে দাড়াল।

 ফোনে কুঁকড়ো বললেন, “বল কী, সব কজনেই? ও? ময়ুরটা তা হলে মাটি হয়েছে বলে।” *

 কাঠঠোকরা আবার মুখ বার করতেই সোনালি তার দিকে এমনি চোখ রাঙিয়ে উঠল যে সে তাড়াতাড়ি কোটরে যেমন সেঁধবে, অমনি দরজায় মাথা ঠুকে ফেললে। কুঁকড়ো ফোনে বললেন, “মুরগিরাসব. আঃ,ভালো আছে শুনে খুশি হলেম. গান? ও গান করি বৈকি। হারোজ। কিন্তু এখান থেকে একটু দূরে. ওই যে দিঘিটা আছে, তারি ধারে। হাঁ, নিত্যি নিত্যি, ঠিক আগেরই মতো।”

 রাগে সোনালি লাল হয়ে উঠল; তাকে লুকিয়ে গান গাওয়া হয়। এত বারণ করলুম.।

 কুঁকড়োর কথা চলল, “সোনালি গাইতে মান করে, তাই লুকিয়ে আমি আলো আনছি আজকাল।” সোনালি এক-পা কুঁকড়োর দিকে এগিয়ে শুনলে, কুঁকড়ে বলছেন, “যখন সোনালির কালো চোখদুটি ঘুমে ঢলে পড়ে, যখন তার সোনার দেহটি আলিসে লুটিয়ে চমৎকার দেখতে হয়”, সোনালির মুখে এবার হাসি ফুটল। “...সেইসময় আমি পা-টিপে-টপে শিশিরের উপর দিয়ে দূরে গিয়ে, আলোর জন্যে যে-ক'টি গান সব ক'টি গেয়ে, যেমনি দেখি অন্ধকার ফিকে হচ্ছে, অমনি আস্তে আস্তে বাসায় ফিরি।—কী বলছ? শিশিরে পা ভিজে দেখে সে সন্দেহ করবে? তাই যদি হবে, তবে ডানার পালকগুলো আছে কী করতে। পা-ফ্লুটো মুছে নিতে কতক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে অশোকের ডালে বসে যে-গান সে গাইতে মানা করে নি, সেইটে গেয়ে তার ঘুম ভাঙাই।”

 সোনালি আর রাগ সামলাতে না পেরে ফোঁস করে উঠল। কুঁকড়ো ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখেই চটপট ফোনে বললেন, “নাঃ কিছু না, আর-একদিন হবে এখন।”

 সোনালি বললে, “আমাকে ঠকালে কেন।”

 ফোনটা শব্দ করলে, “ফুর-র।”

 কুঁকড়ো বললেন, “আমি তোমাকে—”

 “ফুর-র”, আবার ফুলের মধ্যে মাছিটা ডাকলে। কুঁকড়ো ফুলটার উপর ডানা চাপা দিলেন, কিন্তু সেটা ক্রমাগত “ফুর-রর-র-র-র-র” ব’লেই চলল।

 সোনালি খুব রেগে বললেন, “কী নির্দয় তুমি ঠগ।... কেন শুধচ্ছ। তুমি মুরগিদের খবর নিতে এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন? কে কোথায় ঘুমোয়, কে কী খায়, কার কটি ছানা হল? গোলাবাড়ির বাইরেও যে ডালকুত্তোটা তার পর্যন্ত খবর নেওয়া হচ্ছে। এও না-হয় সইলুম কিন্তু ভোরবেলায় ডানায় পা মুছে চুপি চুপি. ও বুঝেছি, তুমি একলা এই সোনার পাখিটাকেই ভালোবাস, কেমন?”

 কুঁকড়ো খানিক চুপথেকে বললেন,”সোনালি, ভেবে দেখো, এই হৃদয়ের মধ্যে আলোটি যদি না দেখতে পেতে তবে কি এখানে আসতে তোমার ইচ্ছে হত। হৃদয়ের মধ্যে কিছু না থাকার চেয়ে আলো থাকা কি ভালো নয়। রঙিন-আলো-দিয়ে-গড়া সোনালিয়া। আমি আলো-কে ভালোবাসি তাই তোমাকেও ভালোবাসতে পেরেছি, আলোর দিকে হৃদয় পেতে যদি প্রতিদিন না দাড়াতেম, তবে ভালাবাসার ফোয়ারা যে এতদিনে শুকিয়ে যেত সে কি জান না।”  কুঁকড়োর কথায় সোনালির অভিমান বাড়ল বৈ কমল না। সে ঝগড়া করতে লাগল। কান্নাকাটি ক'রে ক’রে পাড়া জাগিয়ে তোলবার জোগাড় করলে। কুঁকড়োও একটু যে চটেন নি তা নয়। শেষ সোনালি বললে, “আচ্ছা আমার যদি মান রাখতে চাও, তবে কাল সকালে একেবারে গাইবে না বলে।”

 কুঁকড়ো বললেন, “এ কী কথা। সমস্ত পাহাড়তলিটা যে অন্ধকার হয়ে থাকবে।” সোনালি ঠোঁট ফুলিয়ে বললে, “না-হয় থাকলই। তোমারই-বা কী, আমারই-বা কী।” কুঁকড়ো ঘাড় নাড়লেন, “তা হতে পারে না। একদিন আলো বন্ধ! সব যে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাকে গাইতেই হবে।”

 সোনালি বললে, “আচ্ছ, যদি প্রমাণ করে দিই, তুমি না থাকলেও সকাল হতে কিছু বাধল না, তখন?”

 কুঁকড়ো একটু হেসে বললেন, “তখন সোনালি আমি সেখান থেকে তোমার সঙ্গে ঝগড়াও করতে আসব না, আর আলোহল কি না হল সে খবরও জানতে খুব উৎসাহ করব না। কেননা যেদিন আমি-ছাড়া হয়ে আলো উঠবে, সেদিন আমি তো আর কুঁকড়ো নেই, আমি যে আলোর আলোয় গিয়ে মিশেছি।”

 সোনালির চোখে জল ভরে উঠলে সে কেঁদে বললে, “একটি দিন আমার কথা রাখে।”

 কুঁকড়ো ঘাড় নাড়লেন, “না, হতে পারে না।”

 সোনালি বললে, “ভুলেও কি একদিন আমার কথা রাখতে নেই গা।”

 কুঁকড়ো বললেন,“ভুল হবারযোটি নেই। অমনি অন্ধকার বুকে চেপে বলে,ডাক আলো-কে।”

 সোনালি বলে উঠল, “অন্ধকার ওঁর বুকে চেপে ধরে? সব বাজে কথা। বলো-না বাপু গান গাও— সবাই তোমার তারিফ করবে ব’লে। গানের তো ওই ছিরি, এর জন্তে মিছে কথা কেন বাপু! তোমার গান শুনে তো বনের সবাই মোহিত হল। এখানকার বাবুই-পাখি, সেও তোমার চেয়ে গায় ভালো।” *

 কুঁকড়ো বললেন, “হতে পারে বাবুই গায় চমৎকার, কিন্তু সেইজন্তে অভিমানে আমি গাওয়া বন্ধ করব, তেমন কুঁকড়ে আমায় ভাবলে নাকি।” সোনালি রেগেই বলে চলল, “যেখানে নীচের বনে রোদের বেলা বসন্ত বাউরির গানটি মিনতি জানায়, আর উপরের বনে সা-বুলবুল গানের ফোয়ারা খুলে দেয়, সেই বনের মধ্যে কুঁকড়োর ডাক কেউ শুনতে চাইবে, এটা পাগল ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করতে পারে না।”

 কুঁকড়ো কোনো কথা না কয়ে তফাতে সরে দাড়ালেন। সোনালি তবু বললে,“শুনেছ কোনোদিন নিশুত রাতের স্বপনপাখির গান?” “শুনি নি।” ব’লে কুঁকড়ো অশোকের ডালে উঠে বসলেন। সোনালি নিজে নিজেই বলে যেতে লাগল, “স্বপনপাখির গান, সে এমন আশ্চর্য ব্যাপার যে প্রথমবার শুনতে শুনতে”, হঠাৎ সোনালির কী একটা বুদ্ধি মাথায় জোগাল; সে চুপ হয়ে ভাবতে লাগল।

 কুঁকড়ো শুধলেন, “কী বলছিলে?” সোনালি চেঁচিয়ে বললে, “না,কিছু নয়।” আর মনে-মনে হেসে বললে, “এইবার ঠিক হবে। উনি তো জানেন না যে স্বপনপাখির গান শুনতে শুনতে রাত কখন্‌ যে ভোর হয়ে যায়, কেউ বুঝতে পারে না।”

 কুঁকড়ো গাছের উপর থেকে নেমে এসে সোনালিকে বললেন, “কী বলছিলে।”

 “কিছু না।” বলে সোনালি মুখ ফিরিয়ে দাড়াল।