আশাকানন/চতুর্থ কল্পনা

উইকিসংকলন থেকে

যশঃশৈল—নিম্নভাগে প্রাণিসমাগম—আরোহণ-প্রথা—ভিন্ন ভিন্ন শিখর দর্শন—ভিন্ন ভিন্ন যশস্বী প্রাণিমণ্ডলীর কীর্ত্তিকলাপ দর্শন—বাল্মীকির সহিত সাক্ষাং।

নিকটে আসিয়া নিরখি সুন্দর
অপূর্ব্ব শিখর-শ্রেণী;
শিখরে শিখরে কনক প্রদীপ
যেন কিরণের বেণী।
শৈল চারি দিকে তৃষিত নয়ন
প্রাণী লক্ষ লক্ষ জন,
কুসুমে গ্রথিত মাল্য মনোহর
শূন্যে করে উৎক্ষেপণ;
ঘন ঘন ঘন হয় জয়ধ্বনি
ক্ষণেক নাহি বিশ্রাম,
যেন উর্ম্মিরাশি জলরাশি-অঙ্গে
গতি করে অবিরাম।
প্রাণিবৃন্দ আসি একে একে সবে
ক্রমে শৈলভলে যায়;
চূড়াতে জ্বলিছে মাণিকের দীপ
সঘনে দেখিছে তায়।

সে আচলে হেরি ঘেরি চারি দিক্‌
প্রাণী আরোহণ করে;
আমূল শিখর শৈল-অঙ্গে প্রাণী
অপরূপ শোভা ধরে।
চলে ধীরে ধীরে শিরে শিরে শিরে
অঙ্গে অঙ্গে পরশন,
অবিরত স্রোত প্রাণীর প্রবাহ
কৌতুকে করি দর্শন;
শিলাতে শিলাতে পদ রাখি ধীরে
উঠিছে পরাণীগণ,
উঠিতে উঠিতে পড়ে কত জন
স্খলিত হৈয়ে চরণ;
বটফল যথা বৃক্ষ হ'তে সদা
খসিয়া পড়ে ভূতলে;
এথা সেইরূপ প্রাণী নিত্য নিত্য
খসিয়া পড়ে অচলে।
পড়িয়া উঠিতে কেহ নাহি পারে
কেহ বা আরোহে পুনঃ;
সে প্রাণী-প্রবাহ অবিচ্ছেদ গতি
কখন না হয় উন।
লৈয়ে নিজ নিজ যে আছে সম্বল
উঠিছে যতনে কত;
শিখরে শিখরে কনক-প্রদীপ
নেহারে সুখে সতত।
উঠে প্রাণিগণ দীপ লক্ষ্য করি
শীত গ্রীষ্ম নাহি জ্ঞান।
মন্ত্র করি সার দেহ ভাবি ছার
পণ করি নিজ প্রাণ।
কাহার মস্তকে মণি-মুক্তারাশি
উপাধি কাহার শিরে,



কাহার সম্বল নিজ বুদ্ধি বল
আচলে উঠিছে ধীরে;
গ্রন্থ রাশি রাশি লৈয়ে কোন জন
কার করতলে তুলি,
কেহ বা ধরিছে যতনে কক্ষেতে
কাব্যগ্রন্থ কতগুলি,
কেহ বা রূপের ডাল লৈয়ে শিরে
চলেছে সুরূপা নারী;
চলেছে গায়ক নাটক, বাদক,
বীণা বেণু আদি ধারী।
উঠিতে বাসনা করে না অনেকে
আসিয়া ফিরিয়া যায়,
নীচে হৈতে শূন্যে ফেলি ফুল-মালা
সেই অচলের গায়!
বহু জন পুনঃ করিয়া প্রয়াস
উঠিছে অচল-দেশে,
পাই বহু ক্লেশ ফিরিয়া আবার
নামিয়া আসিছে শেষে।
জিজ্ঞাসি আশারে প্রাণিরঙ্গভূমে
কিবা হেরি এ অচল;
আশা কহে “বৎস, যশঃশৈল ইহা
অতি মনোরম্য স্থল।”
বাড়িল কৌতুক উঠিতে শিখরে
আনন্দে আগ্রহে যাই;
আগে আগে আশা চলিল সম্মুখে
অচলে পথ দেখাই।
উঠিতে উঠিতে শুনি শূন্য'পরে
সুমধুর ধ্বনি ঘন,
মস্তক উপরে ঘুরিয়া যেমন
সতত করে ভ্রমণ,

যেন শত বীণা বাজিছে একত্রে
মিলিত করিয়া তান,
শ্রবণে প্রবেশ করিলে তখনি
পুলকিত করে প্রাণ।
শূন্যে দৃষ্টি করি রোমাঞ্চ শরীর,
বিস্ময় ভাবিয়া চাই,
কিবা কোন যন্ত্র, কিবা বাদ্যকর,
কিছু না দেখিতে পাই।
হাসি কহে আশা "বৃথা আকিঞ্চন,
দৃষ্টি না হইবে নেত্রে;
এ মধুর ধ্বনি নিত্য এইরূপে
নিনাদিত এই ক্ষেত্রে;
বীণা কি বাঁশরি কিম্বা কোন যন্ত্র
নিঃসৃত নহেক স্বর,
স্বতঃ বিনির্গত সুললিত সদা,
ভ্রমে নিত্য গিরি'পর,
সদা মনোহর বায়ুতে বায়ুতে
বেড়ায় ঝঙ্কার করি,
কমলের দল বেষ্টিয়া যেমন
ভ্রমর ভ্রমে গুঞ্জরি।”
শুনিতে শুনিতে আশার বচন
ক্রমশ অচলে উঠি,
যত ঊৰ্দ্ধে যাই তত সুমধুর
ধ্বনি ভ্রমে সেথা ছুটি।
ছাড়ি অধোদেশ উঠিনু যখন
মধ্যভাগে গিরিকায়;
শরীর পরশি ধীরে ধীরে ধীরে
বহিল মৃদুল বায়!
সে বায়ুতে মিশি সুমধুর ভ্রাণ
করিল আমোদময়;

যেন সে অচল সুরভি-মধুর
সৌগন্ধে ডুবিয়া রয়।
অগুরু চন্দন জিনিয়া সে গন্ধ
পুষ্পগন্ধ যেন মৃদু;
মরি কি মধুর মনোহর যেম
দেবের বাঞ্ছিত মধু!
ভ্রমিছে সে গন্ধ ঘেরিয়া আচল
প্রতি শিখরের চূড়ে;
ছুটিছে পবনে সে ঘ্রাণ নিয়ত
কতই যোজন যুড়ে;
নাহি হয় হ্রাস ক্রমে যত যাই
ক্রমে বৃদ্ধি তত হয়,
নাসারন্ধ্র যেন ঘ্রাণ পূর্ণ করি
প্রাণ করে মধুময়।
সেই গন্ধে মজি শুনি সেই ধ্বনি
ভ্রমি সে অচল'পরে;
ভ্রমিতে ভ্রমিতে কত কি অদ্ভুত
দেখি চক্ষে সুখভরে;
নিরখি তাহার কোন বা শিখরে
প্রাণী বসি কোন জন
অসুর-অসাধ্য অসম্ভব ক্রিয়া
নিমেষে করে সাধন;
কোন গিরিচূড়ে বসি কোন প্রাণী
মণিদণ্ড হেলাইছে,
ক্ষণপ্রভা তার বশবর্ত্তী হৈয়ে
চরাচর ঘুরিতেছে;
কোন বা শিখরে বসি কোন জন
তোলে ভোগবতী-জল;
কেহ বা করেতে আকর্ষণ করি
ঘুরায় বিশ্বমণ্ডল;



কেহ বা নক্ষত্র, গ্রহ, ধূমকেতু,
ধরিয়া দেখায় পথ,
লক্ষ্য করি তাহা শূন্য মার্গে উঠে
ভ্রমে সবে চক্রবৎ;
কেহ বা ভেদিয়া সূর্য্যের মণ্ডল
আচ্ছাদন খুলে ফেলি
আনন্দে দেখিছে বাষ্প সরাইয়া
নিবিড় বিদ্যুত-কেলি;
কেহ শূন্য হৈতে পাড়ি চন্দ্র তারা
করতলে রাখে ধরি,
পুনঃ ছাড়ি দেয় সর্ব্ব অঙ্গ তার
সুখে নিরীক্ষণ করি;
দেখি কোন চূড়া উপরে বসিয়া
সুদিব্য-মূরতি প্রাণী
তন্ত্রী বাজাইয়া মনের আনন্দে
ঢালিছে মধুর বাণী;
কোন শৃঙ্গে হেরি প্রাণী কোন জন,
মস্তকে কাঞ্চনময়
জ্বলিছে মুকুট, শিখর উপরে
হয় যেন সূর্য্যোদয়;
হেরি দিব্য মূর্ত্তি দিব্যাসনোপরে
প্রাণী বৈসে কোথা সুখে,
ধক্‌ ধক্‌ করি হীরা-খণ্ড সদা
প্রদীপ্ত হইছে বুকে;
হেরি কত ঋষি স্থির শান্ত ভাব
বসিয়া অচল-অঙ্গে
গ্রন্থ করে পাঠ যেন ধ্যান ধরি
ভাসিছে ভাব-তরঙ্গে।
হেরি অপরূপ অচল-প্রকৃতি
প্রাণিগণ যত উঠে,

ছাড়ি মধ্যদেশ স্থির হয় যেথা
সেইখানে পদ্ম ফুটে;
তখনি শিখরে হয় শৃঙ্গনাদ
দশ দিক্‌ শব্দে পূরে,
অচল-শরীর কাঁপায়ে নিনাদ
প্রবেশে অমরপুরে।
প্রাণী সেই জন এবে দিব্য মূর্ত্তি
বৈসে চারু পুষ্প'পর;
উঠে অন্য যত সে অচল-অঙ্গে
পূজে তারে নিরন্তর।
স্তবকে স্তবকে সে ভূধর-অঙ্গে
কত হেন পদ্মফুল
উপরে উপরে দেখিলাম রঙ্গে
কৌতুকে হৈয়ে আকুল!
বিস্ময়ে তখন জিজ্ঞাসি আশারে,
আশা মৃদু ভাষে কয়
"ত্যজে জীবলীলা প্রাণী যে এখানে
এই ভাবে এথা রয়;
প্রাণিরঙ্গভূমে জানাতে বারতা
হয় শূন্যে শৃঙ্গনাদ;
শিখর-উপরে আ(ই)সে দেবগণ
করিয়া কত আহ্লাদ।
এই যে দেখিছ প্রাণী যত জন
পদ্মাসনে আছে বসি,
ধরার ভূষণ প্রলয়ে অক্ষয়,
মানব-চিত্তের শশী;
দেখ গিয়া কাছে তব পরিচিত
প্রাণী এথা পাবে কত,
বদন হেরিয়া করিয়া আলাপ
পূর্ণ কর মনোরথ।”

একে একে আশা কাণে কহি নাম
চলিল দেখায়ে রঙ্গে;
পুলকিত তনু দেখিতে দেখিতে
চলিনু তাহার সঙ্গে।
ব্যাস, কালিদাস, ভারবি প্রভৃতি
চরণ বন্দনা করি,
শঙ্কর আচার্য্য, খনা, লীলাবতী
মূর্ত্তি হেরি চক্ষু ভরি;
উঠিনু সেখানে যেখানে বসিয়া
বাল্মীকি অমর-প্রায়
আনন্দে বাজায়ে সুমধুর বীণা
শ্রীরাম-চরিত গায়।
দেখিয়া আমারে অমর ব্রাহ্মণ
দয়ার্দ্র-মানস হৈয়ে;
দিল পদধূলি স্বদেশী জানিয়া
আশু শিরঘ্রাণ লৈয়ে;
জিজ্ঞাসিল ত্বরা অযোধ্যা-বারতা
কেবা রাজ্য করে তায়;
ভারতীর পুত্র কেবা আর্য্যভূমে
তাঁহার বীণা বাজায়;
কোন বীরভোগ্যা এবে আর্য্যভূমে
কোন্‌ ক্ষত্রী বলবান্‌
দৈত্য রক্ষঃকুল করিয়া দমন
রক্ষা করে আর্য্যমান;
কোন আর্য্যসুত যশঃ-প্রভাগুণে
স্বদেশ উজ্জ্বলমুখ;
দ্বিতীয় জানকী হৈয়ে কোন্‌ নারী
স্নিগ্ধ করে পতি-বুক;
কেবা রক্ষা করে বেদবিধি ধর্ম্ম
কোন্‌ বুধ মহামতি

ব্রাহ্মণ-কুলের তিলক-স্বরূপ
সাধন করে উন্নতি;
কত এইরূপ জিজ্ঞাসে বারতা
স্বধাইয়া বারম্বার;
কি দিব উত্তর ভাবিয়া না পাই
চক্ষে বহে নীরধার।
হেরে অশ্রুধারা করুণ বাক্যেতে
ঋষি অতি ব্যগ্রমন
আগ্রহে আবার অতি সযতনে
কৈলা মোরে সম্ভাষণ।
কহিনু তখন কি বলিব ঋষি
কি দিব সস্বাদ তার—
তোমার অযোধ্যা তোমার কোশল
সে আর্য্য নাহিক আর;
ডুবেছে এখন কলঙ্ক-সলিলে
নিবিড় তমসা তায়;
সে ধনু-নির্ঘোষ সে বীণা-ঝঙ্কার
আর না কেহ শুনায়,
নিস্তেজ হয়েছে দ্বিজ ক্ষত্রীকুল
বেদ ধর্ম্ম সর্ব্ব গিয়া,
ভাসে পুণ্যভূমি অকুল পাথারে
পরমুখ নিরখিয়া;
সে বচন শুনি আর্য্য-ঋষিমুখ
ধরিল যে কিবা ভাব,
কি যে ভয়ঙ্কর ধ্বনি চতুর্দ্দিকে
আর্য্য-মুখে ঘন স্রাব,
ভাবিতে সে কথা এখন(ও) হৃদয়
ভয়েতে কম্পিত হয়,
অন্তরে অঙ্কিত রবে চিরদিন
বাণীতে প্রকাশ্য নয়।

যত ছিল সেথা আর্য্যকুলোদ্ভব
মহাপ্রাণী মহোদয়,
ঘোর বজ্রাঘাতে একেবারে যেন
আকুলিত সমুদয়।
সে দুঃখ দেখিয়া, দেখিয়া সে ভাবে
আর্য্যসুতে চিন্তাকুল;
তুলিয়া দর্পণ আশা কহে “ইথে
চাহি দেখ আর্য্যকুল;
দেখ রে দর্পণে ভবিষ্যতে পুনঃ
ভারত কিরূপ বেশ;
দেখে একবার প্রাণের বেদনা
ঘুচা রে মনের ক্লেশ।”
দেখিলাম চাহি যেন পূর্ব্বদিক্‌
জ্বলিছে কিরণময়,
ভারতমণ্ডল সে কিরণে যেন
প্রদীপ্ত হইয়া রয়;
ভারত-জননী যেন পুনর্ব্বার
বসিয়াছে সিংহাসনে;
ফুটিয়াছে যেন তেমনি আবার
পূর্ব্ব তেজ হাস্যাননে;
ঘেরিয়া তাঁহারে নব আর্য্যজাতি
কিরীট কুণ্ডল তুলি
পরাইছে পুনঃ ভূষণ উজ্জ্বল
ঝাড়িয়া কলঙ্ক-ধূলি;
নবীন পতাকা তুলিয়া গগনে
ছুটেছে আবার দূত
ভুবন-ভিতরে করি ঘন নাদ
বদনে প্রভা অদ্ভূত;
দিক্‌দশবাসী মানব-মণ্ডলী
আনি সপ্ত সিন্ধুজল

করে অভিষেক, বলে উচ্চ নাদে
জাগ্রত আর্য্য-মণ্ডল;
পশ্চিমে উত্তরে হয় ঘোর ধ্বনি
আনন্দ-সঙ্গীত গায়;
উঠে সিন্ধুবারি ভারত প্রক্ষালি
আবার গর্জ্জিয়া ধায়;
উঠে হিমালয় পুনঃ শূন্য ভেদি
পূর্ব্বের বিক্রম ধরি;
ছুটে পুনরায় জাহ্নবী যমুনা
গভীর সলিলে ভরি;
আনন্দে আবার ভারত-সন্তান
বীণা ধরে করতলে;
আবার আনন্দে বাজায়ে দুন্দুভি
বসুন্ধরা-মাঝে চলে;
দেখে সে দর্পণে অপূর্ব্ব প্রতিমা
হরষ-বাষ্পেতে আঁখি
পুরিল অমনি ফুটিল বাসনা
হৃদয়ে তুলিয়া রাখি;
দেখিতে দেখিতে সে দর্পণ-ছায়া
আরোও ঊর্দ্ধভাগে যাই;
স্তরে স্তরে যেন হেরি সে ভূধর
উঠে শূন্যে যত চাই।
আশা কহে “বৎস, কত দূর যাবে
নাহি পাবে এর পার,
যত দূর যাবে তত দূর ক্রমে
শৃঙ্গ পাবে অন্য আর।”
আশার বচনে ক্ষান্ত হৈয়ে ফিরি
পুনঃ সে অচল-অঙ্গে;
নামি কিছু দূর নিরখি সেখানে
সুকবিকঙ্কণে রঙ্গে।

পদতলে তার দেখি মনোসুখে
বসিয়া ভারত দ্বিজ।
বাজাইছে বাঁশী মধুর সুরবে
ছড়াইয়া রস নিজ;
ক্রমে ভূমিতলে অবতরি পুনঃ
তবু যেন প্রাণ মন
করে আকিঞ্চন গিরিতলে থাকে
সুখে আরো কিছু ক্ষণ।
যথা নীড় হৈতে করিয়া হরণ
অরণ্যে পক্ষিশাবক
দ্রুত বেগে গতি করে গৃহমুখে
দুরন্ত কোন বালক,
তখন যেমন সেই পক্ষিশিশু
চায় দুঃখে নীড়পানে,
কাকলি করিয়া মৃদু আর্ত্ত স্বরে
আকুলিত হয় প্রাণে;
সেই ভাবে এবে ফিরিয়া ফিরিয়া
অচল-শিখরে চাই;
মুকুট উজলি জ্বলে হেম-দীপ
হেরিতে হেরিতে যাই!