আশাকানন/সপ্তম কল্পনা

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম কল্পনা

স্নেহ-উপবন—মাতৃস্নেহ—সান্ত্বনা-মন্দির—দ্বারদেশে ভ্রান্তির সহিত সাক্ষাৎ।

আশার আশ্বাসে চলিনু পশ্চাতে
প্রণয়-অঞ্চল মাঝে;
আসি কিছু দূর দিব্য বাণী এক
সম্মুখে হেরি বিরাজে।
মনোহর বাণী গভীর সুন্দর
থই থই করে জল;
স্থির শান্ত নীর সুগন্ধি রুচির
অতি স্বচ্ছ নিরমল।
দাঁড়াইলে তীরে অপূর্ব্ব সৌরভ
পরাণ করে শীতল;
হেন ভ্রান্তি হয় মনে নাহি মানে
আছি যেন ধরাতল;
সলিল তেমন কভু ক্ষিতিতলে
চক্ষে না দেখিতে আসে,
সুধা দেখি নাই জানিয়াছি শুধু
ঋষির বাক্য-আভাসে;
না জানি সে বারি সুধা কিনা সেই
আশা-বনে পরকাশ,
এমন নির্ম্মল এমন সুরভি
এমনি সুচারু ভাস!
বাপী-চারিধারে প্রাণী লক্ষ লক্ষ
দাঁড়ায়ে গাঢ় ভকতি;
করে নিরীক্ষণ নির্ম্মল সলিল
সতত প্রসন্ন-মতি।
দাঁড়ায়ে তটেতে হাতে হেম-পাত্র
অপরূপ এক নারী;

আইসে যত প্রাণী সতত সকলে
বিতরণ করে বারি;
কিবা মূর্ত্তি তার কি মাধুরী মুখে
কিবা সে অধরে হাস।
বিধাতা যেমন জগতের সুখ
একত্রে কৈলা প্রকাশ।
কুসুম-পরাগে করিয়া গঠন
অমৃত লেপন করি
বিধি যেন সেই নিরুপম দেহ
গঠিলা হৃদয়ে ধরি;
সদা হাস্যময়ী সদা বারি দান
করেন সুবর্ণ-পাত্রে;
কোটি কোটি জীব আ(ই)সে অনুক্ষণ
সতৃপ্ত পরশ মাত্রে।
পিপাসা-আতুর চাহি আশা-মুখ
কতই আনন্দ মনে,
আশা কহে “বৎস, মাতৃস্নেহভূমি
ইহাই আমার বনে।
হেন পুণ্য-ভূমি পাবে না দেখিতে
খুঁজিলে অবনীতল;
হ্রদ পরিপূর্ণ নেহার সম্মুখে
কিবা সুমধুর জল।
ব্রহ্মাণ্ডের জীব নিত্য করে পান
কণামাত্র নহে ক্ষয়;
চারি যুগ ইহা আছে সমভাবে
এইরূপে পুর্ণপয়।
এই দিব্য বাণী এ কানন-সার
মাতার স্নেহের হ্রদ;
সুধা হৈতে মিষ্ট সলিল ইহার
বিনাশে সর্ব্ব বিপদ;

কেহ কোন কালে এ সুধা-সলিলে
বঞ্চিত নহে অদ্যাপি;
চিরকাল ইহা আছে এইরূপ
অগাধ অক্ষয় বাণী।
অই যে দেখিছ মাধুরীর রাশি
নারী-রূপ-নিরুপমা,
দেবীমূর্ত্তি ধরি জননীর স্নেহ
প্রকাশে হের সুষমা;
প্রকাশি এখানে বিতরে সলিল
রাখিতে প্রাণীর কুল;
জগত-ভিতরে এই সুধা-নীর,
এ মূর্ত্তি নিত্য, অতুল।”
হেরি কত ক্ষণ হেরি প্রাণ ভরি
কত বার ফিরি চাই!
কত যে আনন্দ উথলে হৃদয়ে
অবধি তাহার নাই।
ধ্যান ধরি হেরি, হেরি চক্ষু মেলি
ভুলি যেন ভূমণ্ডল,
হাতে যেন পাই হেরি যত বার
পবিত্র ত্রিদশ-স্থল।
চাহিয়া আবার হেরি বাণীতটে
চারু ইন্দ্রধনু উঠে;
বাঁকিয়া পড়েছে ধরণী-শরীরে
শিশুগণ ধায় ছুটে;
ধরি ধরি করি ধায় শিশুগণ
ইন্দ্রধনু ধায় আগে;
সরিয়া সরিয়া নানা বর্ণ আভা
প্রকাশিয়া পুরোভাগে;
ধরেছে ভাবিয়া, কেহ বা খুলিয়া
নিজ করতলে চায়,

সেই ইন্দ্রধনু আছে সেইখানে
দূরেতে দেখিতে পায়।
হাসি নাহি ধরে মধুর অধরে
লুটাইয়া পড়ে ভূমে;
হাত বাড়াইয়া উঠিয়া আবার
ধরিতে ধাইছে ধূমে।
কোন শিশু ধেয়ে ধরে ধনু-অঙ্গ
অমনি মিলায়ে যায়;
আবার ফুটিয়া নূতন নূতন
নয়ন-পথে বেড়ায়।
খেলে শিশুগণ মনের হরষে
সে বাপী-তীরেতে সুখে;
তরুণ তপন সুন্দর কিরণ
ভাতিয়া পড়েছে মুখে;
হাসিছে নয়ন হাসিছে অধর
বদনে ফুটিছে আলো,
না জানি তেমন অমরাবতীতে
আছে কি কিরণ ভালো।
হেরে সে আনন্দ রোমাঞ্চ শরীর
কত চিন্তা করি মনে,
ভাবি বুঝি হেন নিরমল সুখ
নাহি ভুঞ্জে কোন জনে;
ভাবি বুঝি ব্যাস, বাল্মীকি তাপস,
করেছিলা দরশন,
মর্ত্তে স্বর্গপুরী ভুবনে অতুল
আশার স্নেহ-কানন;
তাই সে গোকুলে, তপস্বী-আশ্রমে,
ছড়ায়ে আনন্দরস
গায়িলা মধুর সুললিত হেন
জননী-স্নেহের যশ।

ভাবি মর্ত্তধামে থাকিতে এ পুরী
আবার কি হেতু লোক
যাইতে কামনা করে স্বর্গপুরী
ছাড়িয়া মরত-লোক?
ভুলিয়া সে ভ্রমে ভাবিতে ভাবিতে
মৃত্যুরূপ পুনঃ স্মরি;
কাতর অন্তরে উৎসুক হইয়া
আশারে জিজ্ঞাসা করি,
এই ভাবে নিত্য এ শোভা প্রকাশ
থাকে কি তোমার বনে?
এ আনন্দ-ধারা নাহি কি শুকায়
মৃত্যুশিখা-পরশনে?
ধরাতে সে জানি বিধির ছলনে
বৃথা সে শৈশব-নিধি!
কৈশোরে রাখিয়া মৃত্যু-ফণী শিরে
মানবে বঞ্চিলা বিধি!
এ কাননে পুনঃ আছে কি সে কীট
দারুণ করাল কাল?
আশারও কাননে এ স্বর্গ-পুত্তলি-
পথে কি আছে জঞ্জাল?
শুনি কহে আশা "কখন এখানে
পড়ে সে কালের ছায়া,
কিন্তু সে ক্ষণিক, নিবারি তাহাতে
নিমেষে প্রকাশি মায়া।
অশেষ কৌশলে করেছি নির্ম্মাণ
দিব্য অট্টালিকা ফুলে;
শোকতপ্ত প্রাণী প্রবেশে যে তায়
তখনি সকল ভুলে।
প্রবেশি তাহাতে পায় নিরখিতে
যে যাহা হয়েছে হার—

প্রণয়ী, প্রেমিকা, দারা, সুত, ভ্রাতা,
হেন সে প্রাসাদ-ধারা।
চল দেখাইব" বলি চলে আশা,
যাই পাছে কুতূহলে;
আসি কিছু পথ হেরি অট্টালিকা
শোভিছে গগন-তলে।
কি দিব তুলনা? তুলনা তাহার
নাহি এ ধরার মাঝ!
ভূলোকে অতুল তাজ-অট্টালিকা
সেহ হারি মানে লাজ!
পরীর আলয় স্বপনে দেখিয়া
বুঝি কোন শিল্পকর
রচিলা সে তাজ করিয়া সুন্দর
মানবের মনোহর।
শুভ্র চন্দ্র-করে শিলা ধৌত করি
রাখিয়াছে যেন গাঁথি;
চুনী পান্না মণি হীরক প্রবাল
তাহাতে সুন্দর পাঁতি;
লতায় লতায় শোভে ভিত্তিকায়
কতই হীরার ফুল;
মণি পদ্মরাগ মণি মরকত
সৌন্দর্য্য শোভা অতুল;
নীল কৃষ্ণ পীত লোহিত বরণ
মাণিকের কিবা ছটা;
মাণিকের লতা মাণিকের পাতা
মাণিকের তরুজটা;
চামেলি, পঙ্কজ, কামিনী, বকুল,
কত যে কুসুম তায়
রতনে খচিত রতনে জড়িত
ভিত্তি-অঙ্গে শোভা পায়;

কিবা মনোহর গোলাপের ঝাড়
সুন্দর পদ্মের শ্রেণী
খুদিয়া পাষাণে করেছে কোমল
যেন নবনীতে ফেণি;
দেখিলে আলয় পাষাণ বলিয়া
নাহি হয় অনুমান;
ভ্রমে ভুলে আঁখি উপজে প্রমাদ
পুষ্পতনু হয় জ্ঞান!
ভিতরে প্রবেশি শিলা-অঙ্গে আভা
আহা কিবা মনোহর,
যেন সে পূর্ণিমা চাঁদের জ্যোৎস্না
ঝরে তাহে নিরন্তর।
এ হেন সুন্দর অট্টালিকা-তাজ,
তুলনাতে সেহ ছার।
নিরখি আসিয়া অট্টালিকা সেথা,
হেরে হই চমৎকার।
কত কাচখণ্ড স্থানে স্থানে মরি
জ্বলিছে প্রাসাদ-গায়;
যেন মনোহর সহস্র মুকুর
প্রদীপ্ত আছে প্রভায়।
হেরি কত প্রাণী প্রবেশিছে তায়
ম্লান-মুখ মৃদুগতি,
চিন্তা-সমাকুল বদন নয়ন
শরীরে নাহি শকতি;
কতই যতনে ধরেছে হৃদয়ে
সুগন্ধি কাষ্ঠের পুট,
মুখে মৃদু রব করিছে নিয়ত
সুমধুর অর্দ্ধ ফুট;
খুলিয়া খুলিয়া পুট হৈতে তুলি
দ্রব্য করি বিনির্গত।

রাখি বক্ষ'পরে ধীরে লয় ঘ্রাণ
আদরে যতনে কত,
কখন বা দুঃখে করিছে চুম্বন
সে পুট হৃদয়ে রাখি,
কখন মস্তকে করিছে ধারণ
মনস্তাপে মুদি আঁখি।
এরূপে আলয়ে করিয়া প্রবেশ
ভ্রমে তাহে কত ক্ষণ;
শেষে ধীরে ধীরে আসি ভিত্তি-পাশে
ঈষৎ তুলে বদন,
যেমনি নয়ন পড়ে কাচ-অঙ্গে
অমনি মধুর হাস,
বদন নয়ন অধর ওষ্ঠেতে
ক্ষণে হয় পরকাশ।
তখনি বিরূপ হয় পুর্ব্বভাব
ভুলে যত পূর্ব্বকথা;
হাসিতে হাসিতে প্রফুল্ল অন্তরে
গৃহে ফিরে নব প্রথা।
অট্টালিকা-দ্বারে আশা-সহচরী
ভ্রান্তি হাতে দেয় তুলে
কোটা নব নব হেরিতে হেরিতে
পূর্ব্বভাব সবে ভুলে।
কত প্রাণী হেন হেরি কাচখণ্ড
ফিরে সে আলয় ছাড়ি
সহাস্য বদনে কেশ, বেশ, অঙ্গ
চলে নানারূপে ঝাড়ি।
আশার কুহকে চমকিত মন
বসি সে সোপান'পর;
আদেশে তাহার উঠি পুনর্ব্বার,
ধীরে হই অগ্রসর।