ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/জালিকাটা বেলে-পাথরের নগর

উইকিসংকলন থেকে

জালিকাটা বেলে-পাথরের নগর।

 এই দুর্ভিক্ষপ্রদেশ ছাড়িয়া বঙ্গোপসাগরতটে ফিরিয়া যাইবার সময় গোয়ালিয়ার আমার পথে পড়িল। দুর্ভিক্ষপ্রদেশে ইহাই আমার শেষ থামিবার আড্ডা। সমস্ত নগরটি খোদিত-কারুকার্য্যে, শুভ্র ‘জালির’ কারুকার্য্যে সমাচ্ছন্ন। সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে গোয়ালিয়ার প্রস্তরের উপর সুন্দর ও বিচিত্র তক্ষণকার্য্যের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে যাহা কিছু দেখা যায়, প্রায় সবই সুন্দর; সবই খোদাইকাজে—জাফ্‌রির কাজে বিভূষিত।

 এই শোভাগৃহগুলি দেখিলে মনে হয়, যেন পাৎলা তাস-কাগজের উপর ফোঁড় কাটা; কিন্তু আসলে কঠিন বেলে-পাথরে নির্ম্মিত এবং উহার সূক্ষ্ম সুকুমার কাজগুলি আদৌ ক্ষণভঙ্গুর নহে। দ্বারপ্রকোষ্ঠের উপর পুষ্পমালার নক্‌সা; গবাক্ষের উপর ঝালরের নক্‌সা। দ্বারপ্রকোষ্ঠলগুলা ছোট-ছোট অসংখ্য থাম দিয়া ঘেরা; থামের মাথালগুলা বৃক্ষপত্রের অনুকরণে এবং থামের তলদেশ পুষ্পকোষের অনুকরণে গঠিত। উপর্য্যুপরিন্যস্ত রাশিরাশি অলিন্দ ও বারণ্ডা,—স্বসীমা অতিক্রম করিয়া রাস্তার উপর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। সমস্তই বেলে-পাথরের। এই গোয়ালিয়ার-নগরে, যদি কেহ গবাক্ষের গরাদে, কিংবা সুন্দরীদিগকে প্রচ্ছন্ন রাখিবার জন্য ঝাঁজরী-জান্‌লা নির্ম্মাণ করিতে চাহে, তাহা হইলে সে বেলে-পাথরের একটা বৃহৎ চাক্‌লা লইয়া তক্তার মত চাঁচিয়া পাৎলা করে এবং তাহাতে ছিদ্র করিয়া লতাপাতার আকারে অনেকগুলা সূক্ষ্মচারু ফুকর বাহির করে। দেখিলে মনে হয়, যেন উহা হাল্‌কা কাঠের কাজ কিংবা কাগজের কাজ। সমস্তই চুনকামের মত তুষারশুভ্র শ্বেতবর্ণে ধবলিত; মধ্যে-মধ্যে, দেয়ালের উপর পুষ্প, হস্তী ও দেবদেবীর চিত্র উজ্জ্বলবর্ণে অঙ্কিত। এদিকে গ্রামপল্লী ক্রমেই উজাড় হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই ইন্দ্রপুরীতুল্য নগরটিতে প্রবেশ করিলে দুর্ভিক্ষের দুঃস্বপ্নটা যেন প্রায় ভুলিয়া যাইতে হয়। এখানকার লোকের এতটা অর্থসম্বল আছে যে, তাহারা শস্যাদি অনায়াসে ক্রয় করিতে পারে; এবং তাহাদের এখনো এতটা জলসঞ্চয় আছে সে, তাহাতে উদ্যানাদি সংরক্ষিত হইতে পারে।

 আতর প্রস্তুত করিবার জন্য ও সাজসজ্জার জন্য নগরচত্বরে ঝুড়িঝুড়ি গোলাপফুল বিক্রী হইতেছে।

 গোয়ালিয়ার আসলে হিন্দুনগর; কিন্তু এখানকার লোকের পাগ্‌ড়ীগুলা মুসলমানীধরণের। তবে একরকম বিশেষধরণের পাগ্‌ড়ী আছে—যাহা খুব আঁটসাঁট করিয়া জড়াইয়া বাঁধা; বর্ণভেদ অনুসারে এই সকল পাগ্‌ড়ী অসংখ্যরকমের। কোনটার শাঁখের মত গড়ন, কোনটার বা একাদশ-লুইরাজার আমলের টুপির মত গড়ন। আবার একরকম পাগ্‌ড়ী আছে—যাহার লম্বা দুই পাশ উর্দ্ধে উত্তোলিত ও দুইদিকে সিং-বাহিরকরা। এই পাগ্‌ড়ীগুলা,—লালরঙের কিংবা পীচফল-রঙের, কিংবা ফিঁকা-সবুজ-রঙের রেশমী কাপড়ের। হাইদ্রাবাদে যেরূপ দেখা গিয়াছিল—সেইরূপ এখানেও, জনতার শুভ্র পরিচ্ছদের উপর—রাস্তার শাদা রঙের উপর, পাগড়ীর এই টাট্‌কা রংগুলা যেন আরো বেশী ফুটিয়া উঠিয়াছে। এখানকার লোকেরা ললাটে যে শৈবচিহ্ন ধারণ করে, তাহা দেখিতে কতকটা শাদা প্রজাপতির মত, ও খুব সযত্নে চিত্রিত। ললাটের মধ্যস্থলে একটা বড় লাল ফোঁটা;—তাহার দুইপাশ হইতে যেন দুইটা ডানা বাহির হইয়াছে। পক্ষান্তরে এখানকার বৈষ্ণবচিহ্ন দাক্ষিণাত্যের বৈষ্ণবচিহ্নেরই মত।

 গোয়ালিয়ারকে ঘোড়সওয়ারের নগর বলিলেও হয়;—সর্ব্বত্রই দেখা যায়, ঘোড়সওয়ারেরা জরির জিন-লাগানো তেজী ঘোড়ার উপর চড়িয়া ছুটিয়া চলিয়াছে কিংবা চক্রাকারে ঘুরিতেছে; অনেকে হাতীর উপরেও চড়িয়াছে, দলে-দলে উষ্ট্রগণ সারিবন্দি হইয়া চলিয়াছে; অশ্বতরী ও ছোট ছোট ধূসরচর্ম্ম গর্দ্দভেরও অভাব নাই।  গাড়ি যে কত রকমের, তার সংখ্যা নাই। ঝক্‌ঝকে তামার ছোটছোট ভাড়াটে গাড়ি—তাহার ছাদ সূচ্যগ্র মন্দিরচূড়ার মত;—গাড়িটা ঘোটকের পশ্চাদ্দেশে যেন আটা দিয়া জোড়া; আর ঘোড়াগুলা ক্রমাগত পিছনদিকে লাথি ছুঁড়িতেছে। কোন কোন শকট স্থূলকায় দুইটী অলস বলদে টানিতেছে; শকট “গদাইনস্করি” চালে চলিয়াছে; একটা লম্বা পিতলের ডাণ্ডা দুইটা বলদকে পরস্পর হইতে একগজপরিমাণ পৃথক্‌ করিয়া রাখিয়াছে,—তাহাতে অনেকটা রাস্তা জুড়িয়া যায়; এই শকটের গঠন কতকটা সেকেলে তিন-সারি-দাঁড়ওয়ালা নৌকার মত;—খুব অলঙ্কারভূষিত নৌকার অগ্রভাগের মত; কিন্তু এই অগ্রভাগটি একেবারে সূচ্যগ্র; ইহার উপর আরোহীরা, অশ্বপৃষ্ঠে বসিবার ধরণে সারি-সারি বসিয়াছে। এই ধরণের বড় শকটগুলা প্রচ্ছন্নকায় রহস্যময়ী সুন্দরীদিগের ব্যবহারের জন্য; ইহাদের গঠন কোন বৃহদাকার পক্ষীর অণ্ডের মত; একেবারে গোলাকৃতি; লাল কাপড় দিয়া অতি সাবধানে চারিদিক্‌ ঢাকা; এই শকটগুলাও ধীরেধীরে চলিয়াছে। কখন-কখন এই ঢাকা কাপড়ের আধ-খোলা ফাঁক হইতে স্বর্ণবলয়ভুষিত, তৃণমণিবর্ণের একটা বাহু, কিংবা স্বর্ণনূপুরভুষিত একটা নগ্ন পদ, কিংবা অঙ্গুরীভারাক্রান্ত কতকগুলা আঙুল বাহির হইয়া আছে, দেখিতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া, কতরকমের পাল্কি-তাঞ্জাম; এই সকল যানে চড়িয়া তরুণবয়স্ক সর্দ্দারেরা হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন। তাঁহাদের পরিচ্ছদ নারাঙ্গিরঙের কিংবা Mallow-তরু-রঙের রেশমী কাপড়ের; চোখে কাজলের দীর্ঘ রেখা এবং কাণে হীরকের অলঙ্কার। অথবা কোন নবাব বাহির হইয়াছেন; তাঁহার পাটল কিংবা বেগনি রঙের আচ্‌কান; সেই আচকানের উপর তুষারশুভ্র কিংবা সিন্দূরবর্ণে রঞ্জিত শ্মশ্রুরাজি বিলম্বিত।

 শাদা পাথরের এই সকল সুন্দর রাস্তায় চলিতে চলিতে লোকেরা পরস্পরকে ক্রমাগত সেলাম করিতেছে দেখিতে পাওয়া যায়। গোয়ালিয়ারের লোকেরা বড়ই ভদ্র।

 এ কথা নিশ্চিত, এ দেশের উচ্চবর্ণের মধ্যে আর্য্যজাতীয় দৈহিক শ্রীসৌন্দর্য্য চরম উৎকর্ষে উপনীত হইয়াছে,—উহাদের মুখের রং প্রায় ইরাণীদিগেরই ন্যায় ফর্শা।

 স্বচ্ছ মল্‌মল্‌বস্ত্রে রোমীয় ধরণে আবৃত হইয়া এবং উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা বিচ্ছুরিত করিয়া যে সকল রমণী দলে-দলে রাস্তায় চলিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদের কি সুন্দর চোখ!—কি অনিন্দ্যসুন্দর দেহের গঠন!

 তালীবনসঙ্কুল ভারত হইতে—তাম্রবর্ণ নগ্নতার ভারত হইতে—আলুলিত দীর্ঘকুন্তলের ভারত হইতে, এই প্রদেশটি কত দূরে!

 রাজপুতানার এই সকল মল্‌মলের ওড়্‌না—যাহার দ্বারা রমণীদের আপাদমস্তক আবৃত—এই সকল ওড়্‌নার কাপড়ে যে নক্সা কাটা আছে, তাহাতে ইচ্ছা করিয়াই যেন একটু বর্বররুচির পরিচয় দেওয়া হইয়াছে; উহাতে যেন কেবল কতকগুলা রঙের ধ্যাবড়া ছোপ্‌—কতকগুলা বেঢপ চক্রাকার রেখা।

 একজন রমণী যে ওড়নাটা পছন্দ করিয়া গায়ে পরিয়াছেন, তাহার রং শ্যাওলা-সবুজ;—তাহার উপর গোলাপীরঙের চক্র কাটা; তাঁহার সঙ্গিনীটি যে ওড়না পরিয়াছেন, উহা সোনালী-রঙের,—তাহার উপর নীলের ছোপ্‌ অথবা Lilacপুষ্প-রঙের ছোপ্‌। ওড়নার কাপড় যেরূপ সূক্ষ্ম ও লঘু, তাহাতে সূর্য্যরশ্মি ও ছায়া ভিতরে প্রবেশ করায়, বেলোয়ারী কাচের সমস্ত আভাই যেন বস্ত্রের উপর খেলাইয়া বেড়াইতেছে। এই সব বিচিত্র কুসুমবর্ণের মধ্যে—প্রাভাতিক বর্ণচ্ছটার মধ্যে—কোন সুন্দরী সাক্ষাৎ নিশাদেবীর ন্যায় দীর্ঘ-রজত-রেখাঙ্কিত কৃষ্ণবর্ণ ওড়না পরিধান করিয়া সকলকে চমকিত করিতেছেন।

 গোয়ালিয়ারের লোকেরা এই রঙের খেলা দেখিতে এতই ভালবাসে যে, একএকটা রাস্তার সমস্তটা জুড়িয়া কেবলি কাপড়-রঙানোই হইতেছে এবং মিলাইয়া-মিলাইয়া তাহার উপর বিচিত্র রঙের ছোপ্‌ দেওয়া হইতেছে। পথ-চল্‌তি লোকদিগের সম্মুখেই এই সব কাজ চলিতেছে;—তাহারা দেখিবার জন্য সেইখানে দাঁড়াইতেছে এবং আপনাদের মতামতও প্রকাশ করিতেছে। একটা কাপড়ের রং-করা শেষ হইবামাত্র অম্‌নি উহা গৃহবারণ্ডার উপর বিছাইয়া রাখা হইতেছে; অথবা দুইজন বালক রৌদ্রে শুকাইবার জন্য ঐ কাপড়টার দুই প্রান্ত ধরিয়া ক্রমাগত নাড়া দিতেছে। এই রঞ্জকদিগের অঞ্চলটিতে যেন একটা উৎসব অবিরাম চলিয়াছে। পাৎলা কাপড়গুলা গৃহাদির উপর ঝুলিতেছে; বালকেরা কোন কোন কাপড়ের দুই প্রান্ত ধরিয়া দুলাইতেছে; ঠিক্‌ যেন চারিদিকে উৎসবের নিশান উড়িতেছে।

 কখন কখন দেখা যায়, বরযাত্রীর দল ধীরে-ধীরে অগ্রসর হইতেছে; আগে-আগে ঢাক-ঢোল-শানাই চলিয়াছে; অশ্বপৃষ্ঠে বর; ভৃত্যগণ একটা বৃহৎ ছত্র তাহার মাথার উপর ধরিয়া আছে। আবার কখন-কখন দেখা যায়, শবযাত্রীর দল ছুটিয়া চলিয়াছে; শবশরীর দৃঢ়বন্ধনে বদ্ধ;—কাপড় দিয়া জড়ানো; শববাহকেরা দ্রুতপদে চলায়, শবশরীর ঝাঁকাইতেছে; সহযাত্রীরা হাঁপাইতে হাঁপাইতে পিছনে চলিয়াছে এবং কুকুরেরা আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া যেরূপ চীৎকার করে, সেইরূপ একএকবার চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। রাস্তার কোণে-কোণে ফকীর-সন্ন্যাসীরা গায়ে ভস্ম মাখিয়া অপস্মার-রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ন্যায় ধূলায় পড়িয়া নানাপ্রকার অঙ্গবিক্ষেপ করিতেছে, এবং যেন মরণযন্ত্রণা উপস্থিত, এইভাবে কাতরস্বরে ভিক্ষা চাহিতেছে। বাজার-চত্বরের চারিধারে সূক্ষ্ম খোদাইকাজ বিভূষিত কত দেবমন্দির ও চতুষ্কমণ্ডপ। যাহাদের ওড়না ইন্দ্রধনুর সমস্ত বর্ণে রঞ্জিত—সেই সব রমণী গালিচার দোকানে, রেশমি-বস্ত্রের দোকানে, ফলের দোকানে, মেঠায়ের দোকানে, শস্যের দোকানে প্রবেশ করিতেছে। আমাদের দেশে বিক্রয়ের জন্য যাহা দোকানে সাজাইয়া রাখা হয়—সেই সব শবদেহের বীভৎস দৃশ্য,—পচা মাছ, অন্ত্র ও টুক্‌রাটুকরা মাংস, এখানে কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না। তাহার কারণ, হিন্দুরা আহারের জন্য কখনই জীবহিংসা করে না। এখানে বেশীর ভাগ বিক্রী হয়—নির্বৃত গোলাপফুল। আতর প্রস্তুত করিবার জন্য, কিংবা শুধু ফুলের মালা বানাইবার জন্য রাশিরাশি গোলাপ বাজারে আনীত হয়।

 চুড়াসমন্বিত অতি শুভ্র সিংহদ্বারসমূহের মধ্য দিয়া সুবিশাল রাজপ্রাসাদাঞ্চলে প্রবেশ করিতে হয়। এই সব প্রাসাদ একেবারে তুষারশুভ্র; প্রাসাদের চারিধারে গোলাপের কেয়ারী; তাহার চতুর্দ্দিকে অবসাদ ম্রিয়মাণ বৃহৎ তরুরাজি,—যাহারা এই এপ্রিলমাসেও শারদীয় বর্ণ ধারাণ করিয়া আছে। এই সকল বিজন উপবন দিন-দিন শুকাইয়া যাইতেছে; রাজা তাহার কোন প্রতিবিধান করিতে পারিতেছেন না। এই সব ক্ষুদ্র হ্রদ—এখন শুষ্ক; উহাদের তটদেশে চমৎকার খোদাই-কাজ-করা চতুষ্কমণ্ডপসমূহ; যে সময়ে একটু বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহারই একটু জল চতুষ্কপ্রাঙ্গণে এখনো জমিয়া আছে; এবং তাহারই প্রভাবে অঙ্গনভূমি এখনো নিবিড় শাখা-পল্লবে বিভূষিত।

 গোলাপের কেয়ারীতে শরতের ভাব থাকিলেও, যত্নপ্রভাবে গাছগুলা এখনো সতেজ রহিয়াছে; ময়ূর ও বানরেরা বিচরণ করিতেছে; ভূমির এই শুষ্কতায়,—এই দুর্ভিক্ষের সূচনায়, বানরগুলা যেন বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে।

 রাজা এখন জ্বরে ভুগিতেছেন; তাই আরোগ্যলাভের জন্য তিনি এখন পার্শ্ববর্ত্তী কোন শৈলচূড়ায় বিশ্রাম করিতেছেন। তথাপি আমি তাঁহার প্রাসাদে প্রবেশ করিবার অনুমতি পাইয়াছি। আমার জন্য প্রাসাদদ্বার উদ্ঘাটিত হইল।

 ঘরদালানগুলা য়ুয়োপীয় ধরণে সজ্জিত; সর্ব্বত্রই সোনালী-গিল্টির কাজ, জরির কাজ ও ঝাড়-লণ্ঠন। মনে হয়, যেন Palais-Bourbon-প্রসাদে কিংবা Elysce-প্রাসাদে আসিয়া পড়িয়াছি। কিন্তু এই সব দস্তুরমতসাজানো বিলাসদ্রব্যের মধ্যে থাকিয়াও, যখন সেই সব বিগতবসন্ত উপবনগুলির বিষন্নতা মনে করি,—দুর্ভিক্ষের কথা মনে করি, তখন যে ভারত দুকূলবস্ত্রাবৃত দেয়ালের বাহিরে অবস্থিত, সেই ভারত আবার আমার মনে পড়িয়া যায়। সর্দ্দার-শ্রেণীর যে যুবকটি আমাকে এই প্রাসাদে আনিয়াছিলেন এবং যিনি মধুর-সৌজন্য-সহকারে আমাকে সমস্ত দেখাইতেছিলেন, তিনি যেন পরীরাজ্যের লোক। তাঁহার শুভ্র পরিচ্ছদ; মাথায় গোলাপী রেশমের টুপি; কানে মুক্তা; এবং গলায় দুই নহরের পান্নার কণ্ঠি। ভারতীয় ও পারস্যদেশীয় পুরাতন ক্ষুদ্রায়াতন চিত্রপটে যেরূপ চেহারা সচরাচর দেখা যায়, তাঁহার মুখশ্রী সেইরূপ অপূর্ব্বসুন্দর। এম্নিই ত তাঁহার দীর্ঘায়াত চক্ষু, তাহাতে আবার কজ্জলরেখায় আরো দীর্ঘীকৃত হইয়াছে। নাক খুব সরু; রেশমনিন্দী কালো গোঁপ; গালের রক্ত সিন্দুরের মত লাল;—স্বচ্ছ তৃণমণিসদৃশ ত্বকের উপর যেন একটা গোলাপী রঙের ছোপ্‌ দেওয়া।

 নগরের অপর পার্শ্বে গোয়ালিয়ারের প্রচীন রাজাদিগের সমাধিমন্দির; এই অঞ্চলটি একেবারে নিস্তব্ধ। উদ্যানের মধ্যে এই সকল বেলে-পাথরের কিংবা মার্ব্বেলের মন্দিরগুলি অবস্থিত, উহার চূড়াগুলা প্রকাণ্ড ‘সাইপ্রেস’তরুর মত ঊদ্ধদিকে ক্রমসূক্ষ্ম।

 এখানে যতগুলি গগনস্পর্শী সমাধিমন্দির আছে, তন্মধ্যে যেটিতে ভূতপূর্ব্ব মহারাজ কিয়ৎ-বৎসর হইতে চিরনিদ্রায় নিমগ্ন, সেই মন্দিরটি সর্ব্বাপেক্ষা জম্‌কালো। তাহাতে বেলে ও মার্ব্বেল পাথরের চমৎকার কাজ। এবং খুব পশ্চাদ্ভাগে যে স্থানটি সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র—সেইখানে একটা কালো মার্ব্বেলের বৃষ বসিয়া আছে। ইহা ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের একটি পরমারাধ্য সাঙ্কেতিক চিহ্ন। এই রাজকীয় সমাধিমন্দিরটির নির্ম্মাণকার্য্য শেষ না হইতে হইতেই, ইহারি মধ্যে পক্ষীরা ইহাকে আক্রমণ করিয়াছে। পেচক, ঘুঘু, টিয়াপাখী ঝাঁকে-ঝাঁকে আসিয়া মন্দিরের চূড়ায় বাসা বাঁধিয়াছে। চূড়ায় উঠিবার সিঁড়ি সবুজ ও ধূসর পক্ষীর পক্ষে সমাকীর্ণ। চূড়াটা খুব উচ্চ; চূড়ার উপর হইতে—“চিকণে”র মত কাজকরা বাড়ী, প্রসাদ, অবসাদ-ম্রিয়মাণ উদ্যান, পাথরের বড়বড়-মন্দিরচুড়াসমেত সমস্ত নগরটাই দৃষ্টিগোচর হয়। মাথার উপর—আকাশে, কাকচিলের ঘোরপাক দিয়া উড়িতেছে। ভারতবর্ষে প্রায়ই যাহা দেখা যায়—নগরের আশপাশ ভগ্নাবশেষে আচ্ছন্ন; পুরাতন গোয়ালিয়ার, পুরাতন বাসস্থান,—দুর্নিবার কালপ্রভাবে, খেয়ালের অবসানে, কিংবা যুদ্ধবিগ্রহের ভাগ্যবিপর্যয়ে পরিত্যক্ত হইয়াছে। যে সময়ে মহাভাগ হিন্দুজাতি বিদেশীয় দাসত্ব স্বীকার করে নাই, স্বাধীনভাবে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিত, বীরগর্ব্বে গর্ব্বিত ছিল, লড়াক্কা ছিল—সেই বীরযুগের বিরাট্‌ দুর্গসমূহ এ দেশের সর্ব্বত্র যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, সেইরূপ একটি দুর্গ দিগন্তের একটা কোণ জুড়িয়া রহিয়াছে। ঐ অদূরে, একশত গজের অধিক উচ্চ খাড়া শৈলের উপর, দেড়ক্রোশব্যাপী বপ্রপ্রকার, ঘোরদর্শন প্রাসাদসৌধাবলী, রাজমুকুটের ন্যায় শোভা পাইতেছে।

 পরিশেষে, ভস্মের আভাবিশিষ্ট—পাংশুবর্ণ পত্রের আভাবিশিষ্ট দূর দিগন্ত, গড়াইতে-গড়াইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে। এখনো এই নগরটি নিরুদ্বেগ ও আমোদ-উল্লাসে পূর্ণ; কিন্তু ঐ সব মরা বন, ঐ সব মরা জঙ্গল, যাহা এখান হইতে অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে—উহা নগরের উপর একটা যেন বিভীষিকার ছায়া নিক্ষেপ করিয়াছে—আসন্ন দুর্ভিক্ষের সূচনা করিতেছে।

 গত সায়াহ্নে, রাজদরবারের একজন সৌম্যদর্শন পুরুষের সহিত, হাতী চড়িয়া সারা সহরটা ঘুরিয়া আসিলাম। বেলে-পাথরের নগরের নিকট আজ আমার এই শেষ বিদায়। এ সময় ততটা গরম নহে; এই সময়ে রমণীরা রঙীণ ওড়না পরিয়া—রূপালি জরির ওড়না পরিয়া, হাওয়া খাইবার জন্য সুন্দর-কাজ-করা নিজ নিজ গৃহের বারাণ্ডায় বসিয়া আছে।  আমার সঙ্গীটিকে চিনিতে পারিয়া এবং গাড়ির আগে-আগে দুই জন ত্রুপ্-সোয়ার দেখিয়া, লোকেরা খুব সেলাম করিতে লাগিল।

 একটা প্রকাণ্ডকায় হাতীর উপর চড়িয়া আমরা সহরের সরু সরু রাস্তাদিয়া চলিয়াছি। এটি হস্তীনী—উহার বয়স ৬৫ বৎসর; এই হাতীর উপর বসিয়া আমাদের মাথা একতলা পর্য্যন্ত ঠেকিল; এমনকি, যেখানে সুন্দরীরা বসিয়াছিল, সেই খোদাই-কায-করা বারাণ্ডাটা সেখান হইতে ঝুঁকিয়া দুই হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করা যায়।

 চৌমাথা-রাস্তার উপর একটা স্থান—একমানুষ-পরিমাণ উচ্চ দর্ম্মা দিয়া ঘেরা; কিন্তু আমরা এত উচ্চে বসিয়া আছি যে, হাতীর উপর হইতে নীচের সমস্তই দেখা যায়। এখানে একটা বিবাহোৎসব হইতেছে; বরের বাড়ী নিতান্ত ছোট বলিয়া রাস্তার উপরেই এই উৎসবের আয়োজন হইয়াছে। অলঙ্কারে বিভূষিতা কতকগুলি তরুণী চুম্‌কিবসানো ওড়না পরিয়া গানবাদ্য শুনিবার জন্য সেইখানে চক্রাকারে বসিয়া আছে।

 বাজার চত্বর দিয়া যখন আমরা চলিতে লাগিলাম, তখন লোকেরা কতই সেলাম করিতে লাগিল! সামান্য দোকানদারেরা, দরিদ্রলোকেরা, খুব নত হইয়া ভক্তিভরে সেলাম করিতে লাগিল। ইঙ্গিতমাত্রে, সুন্দর অশ্বারোহিগণ রাশ-টানিয়া নিজ নিজ অশ্বকে থামাইয়া রাখিল। কেন না, ঘোটকেরা হাতী দেখিলে ভয় পায়। ভয় পাইয়া ঘোড়াগুলা পিছনের পা ছুঁড়িতে লাগিল, চক্রাকারে ঘুরিতে লাগিল, গোলাপের ঝুড়িগুলাকে ওলট্‌পালট্‌ করিয়া দিল। পাঁচ-ছয় বৎসরের ছোট-ঘোট সুন্দর কাজল-পরা মেয়েগুলি—এমন কি, শিশুগুলি পর্য্যন্ত সেইখানে থামিয়া গম্ভীরভাবে আমাদিগকে সেলাম করিতে লাগিল। খুব নীচে হইতে, এমন কি, হাতীর পায়ের কাছে দাঁড়াইয়া তাহার অতি ভদ্রভাবে ও মজার ধরণে সেলাম করিতে লাগিল এবং পাছে তাহাদের কোন হানি হয়, এইজন্য হাতীও মাতৃসুলভ সতর্কতার সহিত একটার পর আর-একটা পা অতি সন্তর্পণে ফেলিতে লাগিল।

 আমার স্মরণ হয়, যখন এমন-একটা সরু রাস্তা দিয়া চলিয়াছি, যেখানে হাতীর দুই পাশ দুইদিক্‌কার দেয়াল ঘেঁষিয়া যাইতেছে, তখন হঠাৎ একটা ঝাঁকানি হইল, হাতী সহসা থামিয়া পড়িল।

 আমাদের হাতী অপেক্ষাও বড় আর একটা দাঁতালো পুরুষ-হাতী বিপরীত দিক্‌ হইতে ঠিক্‌ আমাদের সম্মুখে আসিয়া পড়িল।…

 আমাদের হাতীটা ক্ষণেকের জন্য যেন কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। কিন্তু তাহার পরেই সৌজন্যসহকারে দুইজনের মধ্যে কি-একটা পরামর্শ হইয়া গেল। এক হস্তিশালাতেই দুইজনে একত্র বাস করে; এক পাত্র হইতেই দুইজনে একসঙ্গে আহার করে,—সুতরাং উভয়েই উভয়ের সুপরিচিত। পরিশেষে অন্য হাতীটা ত্রিশ-পা পিছু হটিয়া একটা প্রাঙ্গণের মধ্যে প্রবেশ করিল,—যাইবার সময় আমাদের গায়ে শুধু একটু শুঁড় বুলাইয়া গেল। তাহার পর আমরা আবার চলিতে লাগিলাম।