ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/দুর্ভিক্ষের গান

উইকিসংকলন থেকে

দুর্ভিক্ষের গান।

 গ্রামের প্রবেশপথে রাস্তার চৌমাথায় কতকগুলি শিশু-কতকগুলি ক্ষুদ্র নরকঙ্কাল বলিলেও হয়—দুই হাতে আপনাদের উদর ধরিয়া একটা-কি গান গাহিতেছে, অথবা চীৎকার করিয়া কি বলিতেছে। উহাদের উদর ভিতরদিকে ভয়ানক ঢুকিয়া গিয়াছে; চামড়ার খালি বোতলের মত কুঁচকিয়া চুপসিয়া গিয়াছে; বড় বড় চক্ষু;—কেন এত দুঃখ যন্ত্রণা সহিতে হইতেছে ভাবিয়াই যেন বিস্ময়বিস্ফারিত।

 এই গানের পূর্ণ প্রচণ্ডতা হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে যাইতে হয়, রাজস্থানে যাইতে হয় যেখানে, শুধু একমুষ্টি চাউলের অভাবে শতসহস্র লোক মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছে। এই গুহা হইতে সেই সব স্থান প্রায় দেড়শতক্রোশ দূরে।

 এই প্রদেশে,মৃত বন, মৃত জঙ্গল, সমস্তই মৃত। যে বৃষ্টি পূর্ব্ব্বে আরবসাগর হইতে প্রেরিত হইত, কিয়ৎবৎসর হইতে তাহার অভাব হইয়াছে, অথবা উহা ভিন্নপথে চলিয়া গিয়াছে;—বেলুচিস্থানের মরুভূমির উপর নিরর্থক ছড়াইয়া পড়িয়াছে। স্রোতস্বিনীতে জল নাই; নদী শুকাইয়া গিয়াছে; তরুলতা আর হরিৎ পরিচ্ছদ ধারণ করে না।

 আমি এখন রৎলাম ও ইন্দোরের রাস্তা ধরিয়া রেলপথে দুর্ভিক্ষপ্রদেশে যাইতেছি। এক্ষণে সমস্ত ভারতই লৌহপথে ক্ষতবিক্ষত। যে ট্রেণে যাইতেছি, উহার সমস্ত গাড়িই প্রায় খালি;—যাত্রীর মধ্যে দুইটিমাত্র ভারতবাসী।

 আমার চোখের নীচে দিয়া—কয়েকঘণ্টাকাল - কেবলই বন চলিয়াছে; —ইহা তাণীবন নহে; এই সব বনতরু কতকটা আমাদের দেশীয় গাছের মত। বনগুলা যদি এত বড় না হইত, উহার দিগন্তদেশ যদি বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন না হইত, তাহা হইলে আমাদের দেশের বন বলিয়া ভ্রম হইতেও পারিত। সুকুমার শাখা, ধূসর শাখা। উহার সাধারণ রং—আমাদের দেশের ডিসেম্বরের “ওক"-গাছের পাতার মত। আমাদের ফ্রান্সদেশে, শরতের শেষভাগেই এইরূপ দৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এখন এপ্রিলমাসে ভারতর্ষে রহিয়াছি। গ্রীষ্মদেশসুলভ প্রখর উত্তাপ, অথচ বহিদৃশ্য শীতদেশের মত। আজ ভ্রমণের এই প্রথমদিবসে, উৎকট দুঃখকষ্টের চিহ্ন এখন পর্য্যন্ত কোথাও প্রকাশ পায় নাই; তবে মনে হয়,। প্রকৃতির কি-যেন-একটা বিপর্য্যয় ঘটিয়াছে; সমস্ত দেশ নিরুপায় হইয়া, যেন একটা উদাসভাব ধারণ করিয়াছে; নিঃশেষিতশক্তি কোন গ্রহের যেন মরণযন্ত্রণা উপস্থিত হইয়াছে।

 আমাদের য়ুরোপের পিতামহ্‌ ভারত-বলা বাহুল্য, এখন ধ্বংসাবশেষের দেশ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রায় চারিদিকেই সেই সব মৃতনগরের উপচ্ছায়া দেখিতে পাওয়া যায়—যাহা শত-শত বৎসর, সহস্র সহস্র বৎসর পূর্ব্বে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে; সেই সব নগর, যাহার নাম পর্য্যন্ত এখন বিলুপ্ত হইয়াছে, কিন্তু যাহা এককালে খুব বড় ছিল;—পর্ব্বতাদির উপর রাজমহিমায় অধিষ্ঠিত হইয়া, পাদশায়ী অতলস্পর্শ অবলোকন করিত। তিনক্রোশ দীর্ঘ প্রাকারাবলী, প্রাসাদ ও মন্দিরাদি এক্ষণে পরিত্যক্ত হইয়া কপিবৃন্দ ও ভীষণ সর্পের আবাস হইয়া পড়িয়াছে।•••এই সব ভগ্নাবশেষের নিকটে -আমাদের সেকেলে দুর্গ প্রাসাদের চূড়ামন্দির, নগরপালের আবাসগৃহ, 'আমাদের সেই সামন্ত-যুগের আর সমস্ত কি ক্ষুদ্র বলিয়াই মনে হয়!

 আমাদের যাত্রাপথের বরাবর বারেবারে একটার পর একটা নগর ও অরণ্যের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাইতেছে;—সন্ধ্যা পর্য্যন্ত সেই একই জ্বালাময় বায়ুরাশির মধ্যে নিমজ্জিত। এই উদ্ভিজ্জাবশেষের উপর,সেই গল্পকাহিনীর প্রাচীন মৃতনগরাদির অস্থিরাশির উপর—প্রখর সূর্য অস্ত যাইতেছে—ধূলায় মলিন, শীতঋতুসুলভ পাণ্ডুবর্ণ।

 পরদিন, অসীম জঙ্গলের মধ্যে জাগ্রত হইলাম। সে প্রথম-গ্রামটিঙ্গে আসিয়া গাড়ি দাঁড়াইল, গাড়ির চাকার ঘর্ঘশব্দ ও লোহালক্কড়ের ঝন্‌ঝনানি থামিমাত্র, একটা কোলাহল—একটা বিশেষধরণের কোলাহল উঠিল; কি জন্য, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না—কিন্তু শুনিলে শরীরের রক্ত, যেন জমাট হইয়া যায়। আবার সেই ভীষণ গান—ইহা আমাকে ছাড়িবে না দেখিতেছি। এইবার দুর্ভিক্ষের দেশে প্রবেশ করা গিয়াছে। কতক গুলা শিশুর কণ্ঠস্বর,—ছুটির সময়ে, ইস্কুলের ছেলেরা যেরূপ কোলাহল করে, কতকটা সেইরূপ—কিন্তু এই কণ্ঠস্বর কেমন-যেন চেরা-চেরা, খ্যাখেন, অবসন্নপ্রায় স্পষ্ট শুনা যায় না।•••

 আহা! বেচারা শিশুগুলা, ঐখানে ঐ রেলিং-বেড়ার ধারে ভিড় করিয়া ঠেলাঠেলি করিতেছে এবং উহাদের শুষ্কবাহু আমাদের দিকে প্রসারিত করিতেছে;—যে অস্থিখণ্ডের শেষপ্রান্ত হইতে হাতটি বাহির হইয়াছে, ঐ অস্থিখণ্ডই উহাদের বাহু। উহাদের শ্যামল গায়ের চামড়া পর্দায়-পর্দায় কুঁচকিয়া গিয়াছে, উহাদের শীর্ণ কঙ্কাল বাহির হইয়া পড়িয়াছে —দেখিলে ভয় হয়। উহাদের উদর দেখিলে মনে হয়, যেন একেবারেই অন্ত্রশূন্য —এম্‌নি সমতল। চোখের পাতার উপব, ওষ্ঠের উপর মাছি লাগিয়া রহিয়াছে —শেষাবশিষ্ট আর্দ্রতাটুকু পান করিবে, এই আশায়। উহাদের শ্বাস যেন ফুরাইয়া আসিয়াছে, দেহে যেন আর প্রাণ নাই, তবু দাঁড়াইয়া চীৎকার করিতেছে। উহারা খাইতে চাহে —শুধু একমুঠা খাইতে চাহে। উহারা মনে করিতেছে, যাহারা এমন বড়-বড় গাড়ি চড়িয়া যাইতেছে, অবশ্যই উহারা ধনিলোক হইবে;—অবশ্যই উহারা সদয় হইয়া কিছু আমাদের নিকট ছুঁড়িয়া দিবে।

 —"মহারাজ! মহারাজ!” (মহাশয়, মহাশয়)” -ঐ সব ক্ষুদ্র কণ্ঠ গানের কম্পিত স্বরে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল। উহাদের মধ্যে এমন শিশুও আছে, যাহাদের বয়স পূরা চি বৎসর হইয়াছে কি না, সন্দেহ; তাহারাও “মহারাজ! মহারাজ!” বলিয়া চীৎকার করিতেছে; উহারাও বেড়ারেলিংএর মধ্যদিয়া শীর্ণ অঞ্জলিবদ্ধ হস্ত বাহির করিয়া রহিয়াছে।

 এই ট্রেণে যাহারা আমার সহযাত্রী, উহারা তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীর সামান্য-অবস্থার ভারতবাসী। উহাদের যাহা-কিছু সঙ্গে ছিল,—ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া উহারা ঐ শিশুদিগের নিকট ফেলিতেছে;— চাউলপিঠার উচ্ছিষ্টাংশ ও পয়সা। ঐ ক্ষুধিত শিশুরা, পশুদের ন্যায়, পরস্পরকে মাড়াইয়া, হুম্‌ড়ি খাইয়া সেই সমস্তের উপর আসিয়া পড়িতেছে। ঐ পয়সাগুলা কি উহাদের কাজে আসিবে? তবে কি গ্রামের হাটবাজারে এখনো কিছু খাদ্যসামগ্রী আছে?—উহা শুধু তাহাদেরি জন্য, যাহাদের কিনিবার সম্বল আছে। আমাদের ট্রেণের পিছনেই ত চাউল-বোঝাই চারিটা মালগাড়ি যোড়া রহিয়াছে এবং প্রতিদিনই এই সব মালগাড়ি যাতায়াত করিতেছে। কিন্তু এই চাউল উহাদিগকে দেওয়া হইবে না; উহাদিগকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য উহা হইতে একমুষ্টি কিংবা দুইচারিটি দানাও দেওয়া হইবে না; উহা তাহাদেরি জন্য, যাহাদের এখনো কিছু অর্থ আছে—যাহারা উহার মূল্য দিতে সমর্থ।

 এখনো কিজন্য গাড়ি ছাড়িতেছে না? কিজন্য এই বিষাদতমসাচ্ছন্ন গ্রামের সম্মুখে এতক্ষণ অপেক্ষা করা—যেখানে মিনিটে-মিনিটে ক্ষুধিতের দল আসিয়া জমা হইতেছে এবং সেই দুর্ভিক্ষের লোমহর্ষণ গান অবিরত গাহিতেছে।

 চতুর্দ্দিকে, মাটি এত শুষ্ক গুঁড়গুঁড়া হইয়া গিয়াছে যে, পূর্ব্বে যাহা ধানের ক্ষেত ছিল, এক্ষণে তাহা ভস্মাচ্ছন্ন মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে। ঐ দেখ কতকগুলি রমণী—রমণীর কঙ্কাল বলিলেও হয়—উহাদের স্তন শুষ্কচামড়ার টুকরার মত ঝুলিতেছে। উহারা পূতিগন্ধি ভারী বোঝার গাঁট মাথায় লইয়া, বিক্রয়ের আশায়, তাড়াতাড়ি হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়াছে;—এ সমস্ত সেই সব গরুর চামড়া—যাহারা অনাহারে মরিয়াছে এবং পরে যাহাদের গাত্র হইতে উহার ছাল ছাড়াইয়া লইয়াছে। গরুদের খাওয়াইতে পারে না বলিয়া, আধ-মরা জীবন্ত গরুদের মূল্য চারিআনা পর্য্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। গোমাংস খাইয়া কেহ যে ক্ষুন্নিবৃত্তি করিবে, তাহার জো নাই; কেন না, এই ব্রাহ্মণ্যের দেশে, প্রাণ গেলেও কেহ এ কাজ করিবে না। তবে এই চামড়াগুলা কে ক্রয় করিবে?—এই সব চর্ম্মে, যাহা হইতে পূতিগন্ধ বাহির হইতেছে এবং যাহাতে ঝাঁকে-ঝাকে মাছি আসিয়া বসিতেছে।

 আমার কাছে যাহা-কিছু ছিল, সমস্তই উহাদের নিকট ছুঁড়িয়া দিয়াছি…কি উৎপাত। এখান হইতে গাড়ি কি আর ছাড়িবে না? -আহা! ঐ ৩৪ বৎসরের শিশুটির মুখে কি হতাশভাব! উহা অপেক্ষা একটু বয়সে বড় আর-একটি শিশু উহার মুষ্টিবদ্ধ হাত হইতে উহার ভিক্ষাসমগ্রীটি ছিনাইয়া লইয়াছে!…

 এতক্ষণের পর ট্রেণটা ঝাঁকানি দিয়া নড়িয়া উঠিল, চলিতে লাগিল; সমস্ত কোলাহল ক্রমে দূরে চলিয়া গেল। আবার আমাদিগকে সেই নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে আনিয়া ফেলিল।

 এ, মরা জঙ্গল। পূর্ব্বে এই জঙ্গল বসন্তকালে জীবজন্তুতে আকীর্ণ হইত; তৃণাদি, ঝোপ্‌ঝাড় এখন আর হরিদ্বর্ণ ধারণ করে না; এই ফাল্গুনও রসসঞ্চার করিয়া উদ্ভিজ্জকে বাঁচাইয়া তুলিতে পারিতেছে না। প্রচণ্ড সূর্যের প্রখর উত্তাপসত্ত্বেও, অরণ্যাদির ন্যায় এই জঙ্গলও শীতের ভাব ধারণ করিয়াছে। শীর্ণকায় হরিণেরা তৃণ খুঁজিয়া না পাইয়া, জলের সন্ধান না পাইয়া, আকুলভাবে ইতস্তত বিচরণ করিতেছে। দূর-দূর ব্যবধানে, কোন একটি শুষ্কগাছের গুঁড়িতে কোন একটি তরুণ শাখায়, কোন একটি নিঃসঙ্গ ক্ষুদ্র উপশাখায়—যে-কিছু রস অবশিষ্ট ছিল তাহাই শোষণ করিয়া, তাহা হইতে দুইচারিটি নরম পাতা বাহির হইয়াছে, অথবা একটি বড়-রকমের লাল ফুল, এই মরুদৃশ্যের মাঝখানে, উদাসভাব ফুটিয়া রহিয়াছে।

 যে গ্রামেই ট্রেন্ আসিয়া থামে, সেইখানেই এই সব দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধিতের দল রেলিংএর মধ্য দিয়া আমাদের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। যাহা শুনিতে ভয় হয়, যাহা সর্ব্বত্রই একই ধরণের—সেই চেরা-চেরা আওয়াজের একসুরো গান কোন গ্রামের নিকটে গাড়ি থামিলেই শুনিতে পাওয়া যায়। এবং যখন আমরা সেই তাপদগ্ধ বিজন দেশের মধ্য দিয়া—দূরে চলিয়া যাই, তখন দারুণ নৈরাশ্যে উহাদের কণ্ঠস্বর আরো স্ফীত হইয়া আমাদিগকে অনুধাবন করে।