ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/ভীষণ গুহা

উইকিসংকলন থেকে

ভীষণ গুহা

 এই সকল গুহাগহ্বর, পৌরাণিক সমস্ত দেবতাদিগের নামেই উৎসর্গীকৃত; কিন্তু যেগুলি সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ, তাহার প্রায় অধিকাংশই সেই মৃত্যুর দেবতা শিবের নামে প্রতিষ্ঠিত।

 পূর্ব্ব্বকালে, যাহাদের চিত্তে নানাপ্রকার ভীষণ ও বিরাট কল্পনার উদয় হইত, সেই সব মনুষ্য কত কত শতাব্দী ধরিয়া অতীব আগ্রহসহকারে পর্ব্বতের প্রস্তরপাষাণ খুদিয়া এই সমস্ত গুহাগহর প্রস্তুত করিয়াছে। উহাদের মধ্যে কতকগুলি বৌদ্ধযুগের, কতকগুলি ব্রাহ্মণযুগের এবং কতকগুলি আরো প্রাচীন জৈনরাজাদের আমলের। সভ্যতার বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া, বিবিধ ধর্ম্মসম্প্রদায়ের মধ্য দিয়া, এই সকল আশ্চর্য খননকার্ণ অব্যাঘাতে ও ধারাবাহিকরূপে ভারতীয়-তক্ষণশিল্পিগণ-কর্তৃক সম্পন্ন হয়।

 এ বিষয়ের যিনি সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন লেখক, সেই মাদিনামক একজন আরব এইরূপ বলেন প্রায় একসহস্র খৃষ্টাব্দে এই সকল গুহার অসীম মাহাত্ম্য ছিল; ভারতবর্ষের সকল দিক্ হইতেই অসংখ্য যাত্রী এখানে ক্রমাগত আসিয়া উপস্থিত হইত।

 এক্ষণে এই সকল গুহা পরিত্যক্ত হইয়াছে। দীর্ঘকালব্যাপী অনাবৃষ্টির ফলে চতুর্দিস্থ রুক্ষ-শুষ্ক প্রদেশটি জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। এই মৃতকল্প প্রদেশের অভ্যন্তরে এই গুহাগুলি' কতকাল হইতে এইরূপ পরিত্যক্ত অবস্থায় ও নিস্তব্ধতার মধ্যে রহিয়া গিয়াছে, তাহাব নির্দেশ নাই।

 অধুনা এই সকল গুহায় উপনীত হইতে হইলে, একটা ছোটখাটো মরুভূমি অতিক্রম করিতে হয়; এই ভূমির বর্ণ মৃগচর্মের ন্যায়; ইহা সমুদ্রতটস্থ সৈকতভূমির ন্যায় সমতল; কেবল একএকটি নিঃসঙ্গ পর্বত ইতস্তত সমুখিত হইয়াছে। এই পর্ব্বতগুলা যেন একটু বেশিরকম মানানসই; মাথায়-মাথায় সব একসমান;—দেখিতে কারাগারের ন্যায় বৃহৎ দুর্গনগরের ন্যায়।

 আজ আমি ভারতীয় শকটে করিয়া প্রখর রৌদ্রে এই বিজন প্রদেশ অতিক্রম করিলাম। যাত্রাপথের দুই ধারে মরা গাছগুলা খুটির মত সারি-সারি পোতা রহিয়াছে।

 সন্ধ্যার মুখে একটা মৃতনগরের উপচ্ছায়া পার হইয়া গেলাম—যাহা পূৰ্বে দৌলতাবাদ নামে প্রসিদ্ধ ছিল এবং যেখানে নির্বাসিত হইয়া, তিনশত বৎসর হইল, গল্কণ্ডার শেষ- সুন ইহলীলা সংবরণ করেন। পুরাতন চিত্রসমূহে, “ব্যাবেলের টাওয়া” যেরূপ দেখা যায়—তোর সহিত অনেকটা এই মৃতনগরের সাদৃশ্য দূর হইতে উপলব্ধি হয়। ইহা একটি নগরগিরি,—একটি মন্দিরদুর্গ, একটি বৃহৎ শৈলখণ্ড—যাহা হইতে পূৰ্বকালীন মনুষ্যেরা ইহাকে খুদিয়া-কাটিয়া বাহির করিয়াছে;— যাহাতে ইমারতের মালমসল। প্রয়োগ করিয়াছে,—যাহার আপাদমস্তক একটু মানাই করিয়া গড়িয়া তুলিয়াছে এবং যাহা এক্ষণে বালুরাশিসমুখিত মিশরীয় পিরামিড, অপেক্ষাও অধিক বিস্ময়জনক বলিয়া বোধ হয়। ইহার কাছাকাছি শতশত সমাধিমন্দির ভগ্নদশাপন্ন হইয়া মাটীর মধ্যে বসিয়া গিয়াছে। কত সূচ্যগ্রচূড়াবহুল দন্তুর প্রকাৱাবলী পরস্পরকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে, তাহা নির্ণয় করা যায় না। গল্কওার ন্যায় এখানেও লৌহশলাকাবৃত ভাঁজওয়ালা ভীষণ জোড়া-কপাটের মধ্য দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। কিন্তু উহার অভ্যন্তরে জনপ্রাণী নাই। কেবলি নিস্তব্ধতা, ভগ্নাবশেষ, আর ইতস্তত শুস্কতসমূহ বিরাজমান; বটবৃক্ষগুলা কঙ্কালসার,উহার শাখা-প্রশাখা হইতে দীর্ঘ কেশগুচ্ছের ন্যায় শিকড় নামিয়াছে। আবার আমরা সেইরূপ ভাঁজ-কপাটের দরজা দিয়া বাহির হইলাম,—সেইরূপই অকেজো ও সেইরূপই ভীষণ বর্মে আবৃত। পূর্ব্ব্বদিকে উচ্চ শৈলভূমি দিগন্ত পর্য্যন্ত প্রসারিত। আঁকা-বাঁকা পথ দিয়া উপরে উঠিতে হইল। আমাদের মন্থরগামী শকটের পিছনে-পিছনে আমরা পদব্রজে চলিতে লাগিলাম। এখন সূর্যাস্তের সময়। মেঘের অভাবে দেশ মৃতকল্প,তথাপি সূর্যাস্তের সেই একই অপরিবর্তনীয় আরক্তিম ভাস্বর-মহিমা। আমরাও যেমন উপরে উঠিলাম, আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই দৌলতাবাদ—ধ্বজচূড়া-প্রাকার-মন্দির-সমন্বিত সেই ভীষণ দৌলতাবাদ যেন মস্তক উত্তোলন করিয়া খাড়া হইয়া উঠিল; মুক্ত আকাশে, দেবকিরীটের ন্যায় অশুভানুর কিরণচ্ছটার মধ্যে, দৌলতাবাদের অবয়বরেখা ফুটিয়া উঠিল। এদিকে সেই নিস্তব্ধ অসীম লোহিত ক্ষেত্রভূমিতে যেন আগুন জ্বলিতেছে বলিয়া বোধ হইল, সেখানে জীবনের নিদর্শনমাত্র নাই।

 এই উচ্চ শৈলভূমির উপর আরো একটা ধ্বংসাবশেষ আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল;—"রজাস"নামক একটা অত্যন্ত-মুসলমানীধরণের নগর;—"পোড়ো” মসজিদ ও সরু-সরু ভঙ্গুর ধ্বজস্তম্ভে আচ্ছন্ন। উহার প্রাকারাবলীর সন্নিকটে রাশিরাশি সমাধি-গম্বুজ সন্ধ্যার আলোকে আমাদের দৃষ্টিপথে পতিত হইল। রাত্রি যখন আসন্ন, সেই সময়ে এই সব প্রাণশূন্য রাজপথের ধারে ধারে উষ্ণীষধারী কতকগুলি লোক পাথরের উপর উপবিষ্ট রহিয়াছে দেখিলাম। এই দৃঢ়ব্রত বৃদ্ধগণ এই নগরের শেষ-অধিবাসী; শুধু এই সব মজিদের মাহাত্ম্যের খাতিরেই উহারা এখানে “মাটী কামড়াইয়া পড়িয়া আছে।

 তাহার পর প্রায় একঘণ্টাকাল আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল নাকেবল সেই একঘেয়ে শ্যামল শৈলরাশি—সায়াহ্নের মহানিস্তব্ধতার মধ্যে সম্মুখে প্রসারিত।••

 পরে হঠাৎ এমন-একটা আশ্চর্য্য পদার্থ—অসম্ভব পদার্থ আমাদের দৃষ্টিপথে পতিত হইল—যাহা দেখিয়া এবং আর কিছুই বুঝিতে না পাইয়া, প্রথম মুহূর্তে মনোমধ্যে যেন একটু ভয়ের উদয় হয়। সমুদ্র! সমুদ্র আমার সম্মুখে উপস্থিত, অথচ আমি মধ্যভারতে নিজামের রাজ্যে রহিয়াছি। অধিত্যকাভূমির উপর একটা কুঠারখনিত বৃহৎ গহর—সেইখানেই যেন সমস্ত সেই “তরঙ্গিত অসীম” পূর্ণমহিমায় প্রসারিত। বিস্তীর্ণ শৈলভূমির উপর হইতে নিম্নস্থ অধিত্যকাভূমি আমাদের নয়নগোচর হইতেছে। এই উচ্চ শৈলভূমির ধার দিয়া আমাদের যাত্রাপথ। এই সময়ে নিম্নদেশ হইতে একটা প্রবল বাতাস উঠিয়া আমাদের নিকটে আসিয়া পৌছিল; এ বাতাসটা তেমন গরম নহে—যেন কতকটা খোলা-সমুদ্রের হাওয়া...

 এই শৈলভূমির পরপারে হাজাপোড়া গুড়া-মাটীর যে শুক্ষেত্র প্রসারিত—সেইখানেই এই বাতাস ধূলা-বালির ঢেউ উঠাইয়া সমুদ্রের মত সফেন তরঙ্গভঙ্গের সৃষ্টি করিয়াছে।

 তা ছাড়া, আমরা আমাদের যাত্রাপথের শেষসীমায় সবেমাত্র আসিয়া পেীছিয়াছি, এখনো গুহার[১] লেশমাত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় নাই। এই গুহাগুলা আমাদের নিম্নে—ঐ বিষাদময় কল্পিত-সমুদ্রতটের ধারে-ধারে —বিস্তীর্ণ শৈলভূমি কাটিয়া প্রস্তুত হইয়াছে; এবং ঐ জলহীন সমুদ্রের সম্মুখেই এই ভীষণ গুহাগুলা মুখব্যাদান করিয়া আছে।

 এখন রাত্রি, আকাশে তারা জ্বলিতেছে; আমার শকট একটা ক্ষুদ্র পান্থশালার সম্মুখে আসিয়া থামিল। আমার আতিথ্যকারী–পলিকেশ দুইজন বৃদ্ধ ভারতবাসী আমার অভ্যর্থনার জন্য তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাদের ভৃত্যগণ—যাহারা অলসভাবে নিকটস্থ মাঠে বেড়াইতেছিল—তাহাদিগকে উচ্চৈস্বরে ডাক দিলেন।

 আজ রাত্রে আমাকে শিবের গুহায় লইয়া যাইতে কেহই সম্মত হইল। তাহারা বলিল, আজ রাত্রিটা অপেক্ষা করিয়া কাল দিনে গেলেই ভাল হয়। অবশেষে একজন ছাগপালক রাখাল কিছু অর্থের লোভে আমাকে লইয়া যাইতে স্বীকৃত হইল। আমরা সঙ্গে একটা হাত-ল্যাষ্ঠান লইয়া যাত্রা করিলাম। নীচে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশপথে যাইবার সময় ল্যাঠাল্টা জ্বালাইতে হইবে।

 আজিকার রাত্রি চন্দ্রহীন, কিন্তু বেশ স্বচ্ছ পরিষ্কার; চক্ষু অন্ধকারে একটু অভ্যস্ত হইলেই, এই রাত্রিকালেও বেশ দেখা যাইবে। এখন সেই সাগরচ্ছদ্মবেশী নিঃক্ষেত্রে অবতরণ করিতে হইবে। প্রায় ৬৭ শত-গজপরিমাণ একটা সিড়ি দিয়া নীচে নামিলাম। চারিদিক নিস্তব্ধ, আকাশে তারা ঝিকমিক করিতেছে। কুঠারাহত খোদিত শৈলগণ যেন মর্মান্তিক যাতনায় অভিভূত। এখানকার সকল পদার্থেরই ন্যায় –"ক্যাটা"গাছগুলাও শুষ্কীর্ণ, কিন্তু তবু এখনো খাড়া হইয়া আছে। ইহার শুষ্ককঠিন শাখাগুলা ডালওয়ালা ঝাড়ের বড়-বড় মোমবাতির মত দেখিতে হইয়াছে।

 যাহা উপর হইতে সমুদ্রতট বলিয়া মনে হইয়াছিল, সেই তটরেখা অনুসরণ করিয়া যখন চলিতে আরম্ভ করিলাম, তখন সেই নীচে, অন্ধকার যেন আরো ঘনাইয়া আসিল। উচ্চ শৈলভূমির আড়ালে যেখানে ছায়া পড়িয়াছে, সেই শৈলভূমির পাদদেশে এই কল্পিত সমুদ্রটি অবস্থিত। রাত্রির প্রারম্ভে যে-একটা জোর-বাতাস উঠিয়াছিল, তাহা এখন শান্ত হইয়াছে। এখন কোথাও আর সাড়াশব্দ নাই। এই স্থানটির কি অপূৰ্ব গাম্ভীর্য!

 পর্বতের পার্শ্বদেশে গুহার প্রবেশপথগুলা মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে। এই গুহার মুখ চারিদিক্কার অন্ধকার হইতে আরো ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। গুহাগুলা এত প্রকাণ্ড যে, উহা মানুষের রচনা বলিয়া মনে হয় নাআবার এতটা মানাই যে, নৈসর্গিক পদার্থ বলিয়াও বোধ হর না।•••

 আমরা একটুও না থামিয়া বরাবর চলিতে লাগিলাম। কিন্তু আমার 'সেই পথপ্রদর্শক একটু ইতস্তত করিতেছিল; কিন্তু একটু পরেই কি জানি কি ভাবিয়া, একটা মুখ-ঝকানি দিয়া, আমাদের সহিত আবার চলিতে লাগিল। বোধ করি, যেখানে আমাদিগকে লইয়া যাইবে মনে করিয়াছিল, সেইখানে যাইতে তাহার মনে দেবতাদির ভয় কিংবা এমনি-একটা কোন সাদাসিধা ভয়ের উদয় হইয়াছিল। এখানকার এক-একটা স্থান যে অপেক্ষাকৃত একটু বেশি ভয়ানক, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহার মুখের ভাবে মনে হইতেছিল, সে যেন আমাকে এইরূপ বলিতেছে-“না, আর বেশিদূর গিয়া কাজ নাই—এই পর্য্যন্তই যথেষ্ট।” কিন্তু পরে সে আমার সহিত শৈলস্থলিত প্রস্তররাশির মধ্য দিয়া,—ক্যাক্‌টাস্‌-গাছ মধ্য দিয়া চলিতে চলিতে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, গুহামুখে প্রবেশ করিল। এখনি এই স্থানটি আমার নিকট ভীষণ-সুন্দর বলিয়া মনে হইল। কিন্তু আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, পথপ্রদর্শক আমাকে যে-স্থানটি দেখাইতে সাহস করিতেছে না, তাহার কাছে ইহা কিছুই নয়।

 ঘোড়সওয়ারদিগের ক্রীড়াস্থানের ন্যায় মুক্তাকাশ বৃহৎ প্রাঙ্গণসমূহ সেই সব প্রকাণ্ড পাষাণস্তুপ হইতে -সেই আদিমকালেব পর্ব্বত হইতে কাটিয়া বাহির করা হইয়াছে। উহার দেয়াল এত উচ্চ যে, মনে হয় যেন এখনি মাথায় ভাঙিয়া পড়িবে। দেয়ালের গায়ে,—মোটা-মোটা খাটো থামের চার থাক্ বারণ্ডা-দালন উপযুপরি স্থাপিত। এই দালানের বরাবর ধারে-ধারে অমানুসিক-দেহপ্রমাণ সারি-সারি দেবমূর্তি,—যেন নাট্যালয়ে মৃত্যুর অভিনয়ে কতকগুলা লোক অসাড় ও স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া আছে। রাত্রির অন্ধকারে সমস্তই কালো দেখাইতেছে। এই সব দালানের মাথার উপর তারকাখচিত আকাশ ভিন্ন আর-কিছুই নাই। তারার এই অস্পষ্ট তরল আলোকে আমরা সেই বিরাট মূর্তিগুলা দেখিলাম। উহার যেন দর্শকের ন্যায় আমাদের আগমন নিরীক্ষণ করিতেছিল। | এইরূপ এক-এক-সার গুহা যে কত রহিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই

 এইরূপ প্রত্যেক গুহার সার, - কোন বিশেষ সময়কার লোকদিগের সমবেত উদ্যম ও প্রভূত শ্রমের ফল।  আমার পথপ্রদর্শক ছাগপালক প্রথমে ভয় পাইয়াছিল, কিন্তু আমাদের সঙ্গে এই সব ভয়ানক স্থানে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ক্রমশ তাহার সাহস জন্মিল। এক্ষণে ঘোর - অন্ধকার একটা গুহার মধ্যে প্রবেশ করিবার সময় সে তাহার হাতল্যাণ্ঠান্‌টা জ্বালিল। আর এখন আমাদের মাথার উপর আকাশের তারা নাই—তাহার স্থানে পৰ্বতের স্থূল প্রস্তররাশি প্রসারিত। ইহা একটা ঢাকাপথ—দুই ধারের প্রাচীরের মধ্য দিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই গুহা “গথিক্ ক্যাথিড্রালের” মধ্য-দালান-মণ্ডপের মত উচ্চ ও গভীর। মসৃণ দেয়ালের গায়ে পশুপক্ষীর মূর্তির অনুকরণে উৎকীর্ণ একপ্রকার ছোট-ছোট খিলান রহিয়াছে। গুহার ভিতরে গিয়া মনে হয়, যেন একটা বিরাটকায় জন্তুর দেহের শূন্যগর্ভ থোলের মধ্যে রহিয়াছি। এই ঘন অন্ধকারের মধ্যে আমাদের ল্যাথাটা এমন মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছিল যে, কিছুই প্রায় দেখা যাইতেছিল না। এই দীর্ঘ দালানের মধ্যে মনে হইল, যেন জনপ্রাণী নাই। কিন্তু গুহার পশ্চাদ্ভাগে একটা আকৃতি স্পষ্টরূপে লক্ষিত হইল;— ২০ কি ৩০ ফীট উচ্চ একটি নিঃসঙ্গ | বিগ্রহ সিংহাসনে আসীন; পশ্চাৎ হইতে তাহার ছায়া মণ্ডপের খিলান-ছাদ পর্যন্ত উঠিয়াছে এবং সেই ছায়া আমাদের ল্যাষ্ঠানের চলন্ত আলোকের সঙ্গে সঙ্গে যেন নাচিয়া বেড়াইতেছে। সমস্ত স্থানটির ন্যায় এই বিগ্রহও সেই-একই শ্যামল প্রস্তরে নির্মিত; কিন্তু তাহার বিরাট দেহ লাল-রঙে রঞ্জিত। বড়-বড় শাদা চোখ;—কালে-কালো চোখের তারা যেন আমাদের দিকে অবনত; মনে হয়, যেন তাহার নৈশ শান্তির ব্যাঘাত হওয়ায় একেবারে বিহবল হইয়া পড়িয়াছে। এখানকার নিস্তব্ধতা এরূপ মুখর যে, আমাদের কথা শেষ হইয়া গেলেও, আমাদের কণ্ঠস্বরের অনুরণন অনেকক্ষণ পর্যন্ত থাকিয়া যায়। বিগ্রহের একদৃষ্টি-চাহুনিতে আমরা যেন স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম। যাই হোক, আমার পথপ্রদর্শক ছাগপালকটির এখন আর কোন ভয় নাই; সে এখন প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে, এই সকল প্রস্তরবিগ্রহ, যেমন দিবসে, তেম্‌নি রাত্রিকালেও অচল, স্থির। গুহা হইতে বাহির হইয়া তাহার ল্যাণ্ঠান্‌ নিবিয়া গেলে, সে ইচ্ছা করিয়া আবার ফিরিয়া চলিল; আমি বুঝিলাম, আগে যে-জিনিষের কাছে যাইতে সাহস করিতেছিল না, এখন আমাকে তাহার কাছে লইয়া যাইতে চাহে। যে বালুকারাশি সমুদ্রের সৈকতবেলাভূমিকে স্মরণ করাইয়া দেয়, সেই বালুকারাশির উপর দিয়া আমরা দ্রুতপদে চলিতে লাগিলাম;— শৈলভূমির রেখা অনুসরণ না করিয়া এবার তাহার উল্টাদিকে চলিলাম। সেই সব প্রবেশপথের সম্মুখে আর থামিলাম না। কেন না, আমরা পূৰ্বেই তাহার রহস্যভেদ করিয়াছি॥

 যখন আমরা শেষসীমায় আসিয়া পৌছিলাম, তখন রাত্রি অনেক হইয়াছে। আমার পথপ্রদর্শক আবার তাহার ল্যাণ্ঠান্‌ জ্বলিল এবং আলিয়া একটু পিছু হটিয়া দাঁড়াইল। বোধ হয়, যেখানে আমরা যাইতেছি, সে স্থানটা খুব অন্ধকার।

সর্ব্বাপেক্ষা এই প্রবেশপথটি অধিকতর ভীষণ। কারণ, এইমাত্র যে বিগ্রহগুলি দেখিয়া আসিলাম, তাহাদের ন্যায় এই দ্বারদেশের মূর্তিগুলা শান্তচিত্ত নহে—পরন্তু যেন রোষের আবেশে ও কষ্টযাতনায় আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে—অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাঁকিয়া পড়িয়াছে; এই ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে এত কম দেখা যায় যে, কোন্ মূর্তিগুলি পাথর কাটিয়া গঠিত এবং কোন্গুলিই বা পাথরের গায়ে উৎকীর্ণ, তাহা নির্বাচন করা কঠিন। এই গণ্ডশৈলগুলাও, এই অতিভারাক্রান্ত পাষাণসুপগুলাও যেন অবসন্নভাবে শুইয়া পড়িয়াছে; যেন তীব্র যাতনায় উহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাঁকিয়া-চুরিয়া গিয়াছে। আমরা এখন শিবালয়ের সম্মুখে উপস্থিত;— সেই শিব,—যিনি মৃত্যুর দেবতা, সংহারের জন্যই যিনি সংহার করিয়া থাকেন, সংহারেই যাঁহার আনন্দ।

ল্যাণ্ঠান্‌এই দ্বারদেশের নিস্তব্ধতায় কি-যেন-একটা বিশেষত্ব আছে - একটা বিশেষ প্রকারের ভীষণতা আছে। এই গণ্ডশৈলসমুহ, এই সব মানবাকার বিরাটমূর্তি, এই সব প্রস্তরীভূত মূর্ত্তিমান্ কষ্টগুলা, এই সব স্তম্ভিতশ্বাস সাক্ষাৎ। যন্ত্রণাগুলা—দশ শতাব্দী হইতে এই মহানিস্তব্ধতার মধ্যে নিমজ্জিত রহিয়াছে;—এ সেই নিস্তব্ধতা, যাহা একটু নিশ্বাসপাতেই মুখরিত হইয়া উঠে,—যে নিস্তব্ধতার মধ্যে আপনার পদশব্দ শুনিয়া বিচলিত হইতে হয় এবং আপনার প্রত্যেক শ্বাসপ্রশ্বাস যেন স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়।

 এখানে আর সমস্তই প্রত্যাশা করিতেছিলাম, কিন্তু কোন শব্দ শুনিব বলিয়া প্রত্যাশা করি নাই। কিন্তু গুহার প্রথম মণ্ডপটিতে যেই আমরা পদার্পণ করিয়াছি, অমনি হঠাৎ একটা ভীষণ শব্দ হইয়া সমস্ত স্থান কঁপিয়া উঠিল। ঘড়ির ঘুম-ভাঙানে ঘণ্টাটির কল-কাটি স্পর্শ করিলে হঠাৎ যেরূপ বাজিয়া উঠে, সেইরূপ একটা শব্দ এক সেকেণ্ডের মধ্যে গুহার গভীরতম দেশ পর্যন্ত প্রচারিত হইল। যাহারা উপরের প্রস্তররাশির মধ্যে ঘুমাইতেছিল,—চীল, পেচক, শকুনি প্রভৃতি সেই সব শিকারী পাখী জাগিয়া-উঠিয়া পাখার ঝাপটা দিতেছিল—পাশ্বপরিবর্তন করিতেছিল। ইহা তাহারই শব্দ। এই সমস্ত সমবেত-ধ্বনি গুহার স্বাভাবিক-মুখরতা-প্রভাবে প্রতিধ্বনিত হইয়া অতিরিক্তপরিমাণে বর্ধিত হইল। পরে ক্রমশ প্রশমিত হইয়া শব্দটা দূরে চলিয়া গেল,—থামিয়া গেল। আবার সেই ঘোর নিস্তব্ধতা।•••

 এই স্তম্ভপরিবেষ্টিত গম্বুজ-আচ্ছাদিত মণ্ডপটি হইতে বাহির হইয়াই মাথার উপর আবার তারা দেখিতে পাইলাম। কিন্তু এই তারাগুলা আকাশের ফাকে মাঝে-মাঝে দেখা যাইতেছে—যেন একটা গহ্বরের গভীরদেশ হইতে দৃষ্ট হইতেছে। এখন আমরা কতকগুলা মুক্তাকাশ প্রাঙ্গণের মধ্য দিয়া চলিতেছিলাম। একটা সমগ্র পর্ব্বতের আধখানা তুলিয়া-ফেলিয়া এই প্রাঙ্গণগুলা প্রস্তুত হইয়াছে। ইহা হইতে যে প্রস্তর বাহির হইয়াছিল, তাহাতে নিশ্চয়ই একটা নগর নির্মিত হইতে পারে। এই প্রাঙ্গণগুলার বিশেষত্ব এই যে, উহার দেয়াল ২০০ ফীট্‌ উচ্চ এবং উহার গায়ে থাকে-থাকে কতকগুলি বারণ্ড-দালান উপর্যু্যপরি স্থাপিত এবং অসংখ্য বিগ্রহ যুদ্ধোদ্যত সৈন্যের ন্যায় সারি-সারি সজ্জিত। এই সব প্রাঙ্গণপ্রাচীর ভারকেন্দ্রচ্যুত হইয়া ভীষণভাবে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে। এই প্রাচীর এক-একটা অখণ্ড কঠিন প্রস্তরখণ্ডে নির্মিত; উহার আপাদমস্তক কোথাও একটি ফাট্‌ নাই, চীর নাই। প্রাঙ্গণের এই দেয়ালগুলা খুব ঝুকিয়া থাকায় গুহার আকার ধারণ করিয়াছে, এবং এরূপ ভীষণ, যেন আমাদিগকে গ্রাস করিতে উদ্যত।

 ওদিক্‌কার কতকগুলা প্রাঙ্গণ একেবারে খালি। কিন্তু এই প্রাঙ্গণগুলা বিরাট্ পদার্থসমূহে আচ্ছন্ন;— ক্রমসঙ্কীর্ণ চতুষ্কোণ স্তম্ভমন্দির (Obelisk), পীঠের উপর স্থাপিত হস্তী, মন্দিরের দ্বার প্রকোষ্ঠ, দেবালয় প্রভৃতি। এখন প্রায় দ্বিপ্রহর রাত্রি। এই অন্ধকারের মধ্যে আমাদের ক্ষুদ্র দীপটি বিলীন হইয়া গিয়াছে। সুতরাং এখানকার সমগ্র না-কল্পনাটি যে কি, তাহা এখন নির্ধারণ করা অসম্ভব। এখন চতুর্দিকে কেবল প্রাচুর্য্য ও ভীষণতাই লক্ষিত হইতেছে। যাইতে যাইতে কোথাও বা প্রস্তরে-অঙ্কিত একটা বৃহৎ শবমূর্তি, কোথাও বা কোন নরকঙ্কালের অথবা দৈত্যের মুখে অঙ্কিত বিকট হাস্যরেখা মুহুর্তকাল বিদ্যুতের ন্যায় স্ফুরিত হইয়া আবার তখনি সেই বিশৃঙ্খল পদার্থরাশির মধ্যে মিশিয়া যাইতেছে।

 প্রথমে আমরা শুধু কতকগুলি নিঃসঙ্গ হস্তী দেখিয়াছিলাম। এখন দেখিতেছি, কতকগুলা হস্তী দল বাঁধিয়া সারি-সারি দণ্ডায়মান, তাহাদের শুড়গুলা নীচের দিকে ঝুলিয়া আছে। আরো কত প্রকার জীবজন্তু হাতপা খিচাইয়া মরণকে যেন ভ্যাংচাইতেছে। ইহাদের মধ্যে এই হাতীরাই শান্তমূর্তি। মধ্যস্থলে অখণ্ড-প্রস্তরের যে তিনটি বৃহৎ মন্দির—এই হস্তীরা সেই মন্দির পৃষ্ঠে ধারণ করিয়া রহিয়াছে।

 এই সকল মন্দির ও গুহার চতুর্দিকে সেই যে ভীষণ দেয়ালগুলা—এই উভয়ের মধ্য দিয়া একপ্রকার চক্রাকার পথে আমরা চলিতে লাগিলাম। মধ্যে-মধ্যে তারা দেখা যাইতেছে। তারাগুলা এত দূরবর্তী বলিয়া পূর্বে আমার কখন মনে হয় নাই। সর্বত্রই প্রচণ্ড মূর্তিসমূহের মধ্যে জড়াজড়ি-ঝপ্‌টাঝাপ্‌টি, দৈত্যদানবের যুদ্ধ ভীষণ মৈথুন, মনুষ্যদেহের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়াছড়ি। উহাদের মধ্যে কাহারো অন্ত্র বাহির হইয়া পড়িয়াছে, তবু পরস্পরকে জাপটাইয়া ধরিরা আছে। এখানে শিব, শিব, ক্রমাগতই শিব! শিব—যাহার ভূষণ মণ্ডমালা; শিব—যিনি জগৎ সৃষ্টি করিয়া আবার সংহার করিতেছেন; শিব—যিনি দশ দিকেই সমানভাবে সংহার করিতে পারিবেন বলিয়া বহুবাহু হইয়াছেন; শিব—যাহার মুখে মর্মান্তিক প্রচ্ছন্ন উপহাসের কুটিল রেখা; শিব—যিনি পরে বিনাশ করিবেন বলিয়াই এখন নির্দয়রূপে প্রজা উৎপাদন করিতেছেন। শিব-যিনি ধ্বংসাবশেষের উপর, ছিন্নমূল বাহুসমূহের উপর, ছিন্নভিন্ন অস্ত্ররাশির উপর হুঙ্কার ছাড়িয়া তাণ্ডবনৃত্য করিতেছেন; শিব - যিনি কতকগুলি ক্ষুদ্র মৃতবালিকাকে পদদলিত করিয়া উন্মত্ত আনন্দে হাস্য করিতেছেন এবং তাঁহার পদাঘাতে ঐ সব শবমুণ্ড হইতে মস্তিষ্ক উছলিয়া পড়িতেছে। আমাদের ল্যাষ্ঠানের আলো নীচের দিকে বিকীর্ণ হওয়ায়, শুধু নিম্নস্থ ভীষণ দৃশ্যগুলার মধ্যে কোন-কোনটা একএকবার প্রকাশ পাইয়া আবার তখনি অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া যাইতেছে। স্থানে-স্থানে এইসব মুর্ত্তি ক্ষয় হইয়া গিয়াছে—বহুশতাব্দীর ঘর্ষণ-স্পর্শনে অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। একটা-কিছু দৃষ্টিগোচর হইবামাত্রই অন্ধকার যেন তাহার উপর একটা তুলি বুলাইয়া দেয় এবং তখনি উহা সেই চঞ্চল তমোরাশির মধ্যে কোথায় যেন ছুটিয়া পলায়—শৈলরাশির সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া যায়, আর দৃষ্টিগোচর হয় না, কোথায় গিয়া থামিল বুঝা যায় না। তখন এইরূপ মনে হয়, যেন সমস্ত পৰ্বতটা —তার হৃদয়দেশ পর্য্যন্ত—কেবল কতকগুলা অস্পষ্ট ভীষণ আকৃতিতে সমাচ্ছন্ন; সমস্তই যেন বিলাস ও বিনাশের দৃশ্যে পরিপূর্ণ।  মধ্যস্থলের মন্দিরগুলি পৃষ্ঠে ধারণ করিয়া হস্তিগণ সারি-সারি দণ্ডায়মান; ইহাদের যেরূপ শান্তভাব, তাহাতে এ স্থানের পক্ষে ইহাদিগকে “বেসুরো”, ও “বেখাপ্পা” বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এই মন্দিরগুলির অপর পার্শ্বে গিয়া দেখিলাম, উহাদেরই সমান-উচ্চ আর কতকগুলা হস্তী অন্যান্য জীবজন্তুর ন্যায় যুঝাবুঝি ও যন্ত্রণার ভাবভঙ্গী প্রকটিত করিতেছে; কতকগুলা বাঘ ও কতকগুলা কল্পিত জীবজন্তু এই হস্তীদিগকে চাপিয়া ধরিয়াছে অথবা উহাদের উদরে দংষ্ট্রাঘাত করিতেছে। একে ত উহাদের দেহের পশ্চাদ্ভাগে দেয়ালের ভার চাপিয়া থাকায় উহারা যেন অর্ধনিষ্পেষিত অবস্থায় রহিয়াছে, তাহাতে আবার পরস্পরের মধ্যে প্রাণপণে যুদ্ধ চলিতেছে। এই পাশটাতেই গুহার প্রাচীর—সেই আদিম ভূস্তরের পাষাণরাশি—সর্বাপেক্ষা বেশি বুকিয়া রহিয়াছে। এই প্রাচীরের দশ কিংবা বিশ ফিট উচ্চে অত্রত্য অসংখ্য মূর্তিগুলার প্রথম রেখাপাত আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীরের সমস্ত তলদেশটা স্ফীত উদরের ন্যায় মসৃণ: স্থানে-শুনে যেন ফুলিয়া উঠিয়াছে—এই ফুলে গুলা দেখিলে মনে হয় যেন খুব ততলে নরম; এই স্ফীত প্রস্তরবাশি মনে হয় যেন কালো দৃর্ণিজলের পার্শ্বদেশ—মনে হয় যেন অত্রত্য ইমারৎ-আদি হইতে “বানডাকা”র মত স্ফীত জলরাশির একটা প্রবাহ নামিয়া আসিয়াছে, আর যেন সমস্ত ইমারৎ এখনি ভাঙিয়া পড়িবে এবং আমরা সকলেই তাহাতে চাপা পড়িয়া যাইব।•••

 অখণ্ডপ্রস্তরের যে মন্দিরগুলা হস্তিপৃষ্ঠের উপর সংস্থাপিত এবং যাহা খোদিত পৰ্বতে পরিবেষ্টিত-তৎসমস্তই আমরা প্রদক্ষিণ করিলাম। এখন কেবল বাকি উহাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা; কিন্তু আমার পথপ্রদর্শক একটু ইতস্তত করিতেছে - কল্যকার সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে বলিতেছে।

 যে সিড়ি দিয়া ঐ সকল মন্দিরে প্রবেশ করা যায়, ঐ সিঁড়ির ধাপগুলা ভাঙিয়া-চুরিয়া বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িয়াছে;—লগ্নপদের অবিরত গতায়াতে মসৃণ হইয়া এরূপ পিছল হইয়াছে যে, বিপদের বিলক্ষণ সম্ভাবনা।

 না ভাবিয়া-চিন্তিয়া, কেবলমাত্র স্বাভাবিক সংস্কারের বশে, আমরা নিস্তব্ধভাবে অতি সাবধানে উপরে উঠিতে লাগিলাম। কিন্তু ছোটখাটো কোন-একটা পাথর যেই নড়িয়া উঠে, -কোন-একটা মুড়ি যেই গড়াইয়া যায়, অম্‌নি উহার শব্দে প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠে, আর আমরাও অনি থম্‌কিয়া দাড়াই। এখন আমাদের চতুর্দিকে বিবিধ ভীষণদৃশ্যের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হইতেছে। কোথাও কোন শিব বিবিধপ্রকার মুখভঙ্গি করিতেছেন; কোথাও কোন শিব কুঞ্চিত-কায় হইয়া আছেন; কোথাও কোন শি। স্বীয় শীর্ণশরীরকে ধনুকের মত বাঁকাইয়াছেন; কোথাও কোন শিব স্বীয় মাংসল-বক্ষ ফুলাইয়া আছেন;—কোথাও জননক্রিয়ায় বিল, কোথাও হননক্রিয়ায় উন্মত্ত।

 এই ঘন-অন্ধকার মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার সময়, সঙ্গে কোন অস্ত্র লই নাই, একগাছি ছড়িও লই নাই, লওয়া আবশ্যকও মনে করি নাই। কোন মনুষ্য কিংবা হিংস্রপশুকর্তৃক আক্রমণের সম্ভাবনা আছে বলিয়া একবার মনে হয় নাই। তথাপি, কে জানে কেন, আমিও পথপ্রদর্শক ছাগপালকের ন্যায় ভয়ে ক্রমশ অভিভূত হইয়া পড়িলাম;—একপ্রকার “অন্ধকেরে” “কিম্ভুতকিমাকার” ভয়—যে ভয়ের কোন নাম নাই——যাহা বাক্যে ব্যক্ত করা যায় না।

 যে সকল ভীষণ দৃশ্য চারিদিকে প্রসারিত—তাহারই কোন চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত সাঙ্কেতিক নিষ্ঠুর ব্যাপারসমূহের একটা চরম আতিশয্য,এইবার মন্দিরের অভ্যন্তরে গিয়া দেখিব, মনে করিতেছিলাম। কিন্তু না, এখানকার সমস্ত পদার্থেরই সহজ শান্তভাব। ঠিক যেন মরণত্রাসের পর মহাশান্তি আসিয়া মৃত্যুর পরপারে আমাকে অভিবাদন করিল এখানে মনুষ কিংবা পশুর কোন প্রতিকৃতি নাই; একটি মুক্তি নাই; ঝাঝির দৃশ্য নাই; মুখভঙ্গীর রেখামাত্র নাই; কিছুই নাই। কেবল একটা শূন্য দেবালয়; তাহাতে প্রশান্ত গাম্ভীয্য বিরাজমান। কেবল এখানকার করাল শব্দমুখরতা বাহিরের অপেক্ষাও বেশী। একটু কথা কহিলে কিংবা পায়ের শব্দ হইলে চতুর্দিক ভয়ানক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠে। তা ছাড়া, বাস্তবপক্ষে এখানে এমন কিছুই নাই, যাহাতে ভয় হইতে পারে। এমন কি এখানে সেই পাখীগুলার কালো পাখার নাড়াচাড়াও নাই। এই সব চৌকোণা থাম - যাহা খিলানছাদের সহিত একই অখণ্ডপ্রস্তরে গঠিত - এই সব থামের অলঙ্কারগুলি নিতান্ত সাদাসিধা ও কঠোরধরণের। কতকগুলি রেখাই উহাদের প্রধান অলঙ্কার।

 দারুণ ভগ্নাবস্থা ও সহস্রবর্ষব্যাপী জরাজীর্ণতা সত্ত্বেও এ স্থানটি এখনো পুণ্যতীর্থরূপে বিরাজমান। প্রবেশমাত্রই এই ভাবটি যেন সহসা অন্তরে জাগিয়া উঠে। এখানে আসিয়া যে ভয়ের উদয় হয়, সে ভয়ও ধর্ম্ম ভাবসংশ্লিষ্ট। মন্দিরের দেয়ালগুলা মশাল ও প্রদীপের ধোয়ায় কালো হইয়া গিয়াছে। কুটিমের সান্ চকচক করিতেছে ও “তেলচুকচুকে” হইয়া উঠিয়াছে। ইহাতেই বুঝা যায়, সময়ে-সময়ে এখানে বহুল জনতা হইয়া থাকে। অন্য যুগের লোকেরা, যে পর্ব্বতে মহাদেবের জন্য গুহা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিল, মহাদেব এখনো সে পর্ব্বতটিকে পরিত্যাগ করিয়া যান নাই। এই পুরাতন দেবালয়ের মধ্যে এখনো যেন একটা প্রাণ রহিয়াছে।

 যে তিনটি দালান, যে তিনটি দেবালয় একটার পর একটা ক্রমান্বয়ে অবস্থিত-ইহারা একই অখণ্ড প্রস্তরে গঠিত। শেষেরটির পুণ্যমাহাত্ম্য সর্বাপেক্ষা অধিক; তাই, ইহার মধ্যে প্রায় কেহই প্রবেশ করিতে পায় না। অন্য ব্রাহ্মণিক দেবালয়ের এইরূপ স্থানে আমি পূর্বে কখনই প্রবেশ করিতে পাই নাই।

 এখানেও আমি মনে করিয়াছিলাম, কি-না-জানি ভয়ানক দৃশ্য দেখিব।. কিন্তু এখানেও সেরূপ দৃশ্য প্রায় কিছুই নাই।  কিন্তু এখানে একটি ক্ষুদ্র জিনিষ দেখিলাম, যাহা বাহিরের সমস্ত ভীষণ পদার্থ অপেক্ষাও বিস্ময় উৎপাদন করে, চিত্তকে আকুল করে, সমস্ত স্থানটিকে তমসাচ্ছন্ন করিয়া তুলে। বেদির ক্ষয়িত প্রস্তরের উপর চকচকে মর্মর পাথরের একটা ছোট কালো নুড়ি,—দীর্ঘডিম্বাকৃতি- খাড়া হইয়া রহিয়াছে; তাহার প্রত্যেক পার্শ্বে, বেদির উপর, সেই সব শৈবচিহ্ন উৎকীর্ণ রহিয়াছে, যাহা শৈবগণ প্রতিদিন প্রভাতে স্বকীর ললাটে ভস্ম দিয়া অঙ্কিত কবে। চারিধারের সমস্ত পদার্থ দোয়ায় কালো হইয়া গিয়াছে। দেবালয়েব যে সব কুলুঙ্গিতে পুণ্যদীপ রক্ষিত হয়, সেই সব কুলুঙ্গিতে এক প্রকার কালো ঘন ঝুল জমিয়া গিয়াছে। দীপের পোড় সলিতাগুলা—যাহা সরাইয়া ফেলিতে কেহই সাহস করে না—দীপ হইতে ঝরিয়া-ঝরিয়া কুলুঙ্গির ভূমিকে তৈলাক্ত করিয়া তুলিয়াছে। এখান কার সমস্তই দীন-হীন-মলিন;—সমস্তই সেই ভীষণ ধর্ম্মানুষ্ঠানের নিদর্শন।

 এই কালো নুড়িটিই সকলের কেন্দ্রস্থল; অলৌকিকশ্রমসাধ্য এই সব খনন ও খোদন কার্যের ইহাই একমাত্র হেতু ও মূলকারণ। কোন-এক দেবতা কেবল সংহাব কবিবার জন্যই ক্রমাগত জীব উৎপাদন করিতেছেন -এই ভাবটি পূর্ধ্বতন ভারতবাসিগণ সংহতভাবে ও বিশদরূপে প্রকাশ করিবার জন্য যে সাঙ্কেতিক চিহ্নের কল্পনা করিয়াছিলেন, তাহা অতীব অপূর্ধ্ব। ইহাই শিবলিঙ্গ; ইহা জননক্রিয়ার সাঙ্কেতিক প্রতিরূপ। কিন্তু এই প্রকার জননে মরণেরই উদরপূর্ত্তি হইয়া থাকে।

 এই ভীষণ গুহাগর হইতে ফিরিয়া গিয়া যেখানে আমি নিদ্রা গিয়াছিলাম, সেই পান্থশালা হইতে বাহির হইয়াই দেখিলাম,—যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড সমুদ্রের মূর্তি ধাৰণ করিয়া আছে, তাহা ক্ষীণরেখায় আমার সমক্ষে প্রসারিত। এক প্রকার কুজ্জটিকার ন্যায়, ধূলার অবগুণ্ঠনে আচ্ছাদিত হওয়ায়, সূর্যোদয়ের পূর্বে এই স্থানটি একটু নীলাভ ও বাষ্পবৎ অস্পষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে।  কিন্তু সূর্যোদয় হইবামাত্র একটা বিস্তীর্ণ লোহিতক্ষেত্র আমার সমক্ষে প্রসারিত হইল;—শুষ্কবায়ুর প্রভাবে একেবারে শুকাইয়া গিয়াছে; আর, ইতস্তত কতকগুলা মরাগাছ দেখা যাইতেছে।

 এই প্রখর দিবালোকে সেই সব শিবমন্দির দেখিবার জন্য যাত্রা করিলাম। যাহা দেখিয়াছি বলিয়া এখন স্মরণ হইতেছে, তাহা বাস্তবিক সেইরূপ কি না, আমার একবার পরখ করিয়া দেখিতে হইবে। এইবার আমি একাকীই নীচে নামিলাম; আমি এখন পথ চিনি; সেই সব শ্যামল শৈলরাশির মধ্য দিয়া, সেইসর শুষ্ক উচ্চ “ক্যাক্‌টাস্‌"—যাহা হলদেরঙের পুরাতন মোমবাতির মত একেবারে কঠিন হইয়া গিয়াছে—সেই সব ক্যাক্‌টাস্‌গাছের মধ্য দিয়া চলিলাম।

 এখন সবেমাত্র সূর্যোদয়, তবু এই সূর্যের প্রখর উত্তাপে আমার বগ্‌ যেন পুড়িয়া যাইতেছে বোধ হইল। এই দুবৃত্ত সর্ব্ব্বসংহারী প্রচণ্ড সূর্যের প্রভাবেই প্রতিদিন ভারতভূমির উপর মৃত্যুর ছায়া ক্রমশই প্রসারিত হইতেছে।•••ছড়ি-হাতে তিনজন লোক,—গরুর পাল সঙ্গে নাই, অথচ দেখিতে রাখালের মত—ক্ষেত্রভূমি হইতে উপরে উঠিয়া আমাকে নতভাবে সেলাম কবিয়া চলিয়া গেল; এরূপ শীর্ণকায় মনুষ্য আমি কখন চক্ষে দেখি নাই; বড়-বড় চোখ-জরবিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায় ঘোর রক্তবর্ণ। নিশ্চয়ই উহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রদেশ হইতে আসিয়াছে,—যাহার ঠিক দারদেশে আমি এখন উপনীত হইয়াছি। শতসহস্র ছোট-ছোট চারাগাছ,—যাহা পূর্ব্বে স্থানে-স্থানে পর্ব্বতের গায়ে যেন গালিচা বিছাইয়া রাখিত, তাহা এখন প্রাণশূন্য—এখন যেন জমাটপশমের মত দেখিতে হইয়াছে।

 কিন্তু এখানকার জীবজন্তুরা—যেরূপ চিরকাল করিয়া থাকে—সেইরূপ এখনো পরস্পরের সহিত যুঝাবুঝি করিতেছে। মাটীর উপর ছোট-ছোট পাখীদের মৃতদেহ পড়িয়া আছে,—চীলের। উহাদিগকে কাটিয়া খণ্ডখণ্ড করিয়াছে। সর্ব্বত্রই দেখা যায়, মোটামোটা লোভী মাকড়সা শেষাবশিষ্ট প্রজাপতিদিগকে—ফড়িংদিগকে ভক্ষণ করিবার জন্য তন্তুজাল বিস্তার করিয়াছে। নিকটস্থ জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় এই মার্ত্তণ্ডের প্রচণ্ড প্রতাপ মিনিটে-মিনিটে যেন বৃদ্ধি পাইতেছে। এই মার্কণ্ডের মহিমা শিবের মহিমারই স্যায় দারুণ অশিব।•••আজ প্রাতে শিবের ভীষণ মন্দিরে অবতরণ করিয়া শিবকে মনে মনে চিন্তা করিতেছিলাম;—ইনি সেই দেবতা, যিনি জীব সৃষ্টি করিতেছেন এবং সৃষ্টি করিয়া আবার সংহার করিতেছেন! এইবার আমি ব্রাহ্মণদের ধরণে শিবকে বেশ কল্পনা করিতে পারিয়াছি! সেই দেবতা, যিনি এক প্রকার প্রচ্ছন্ন উপহাসের সহিত উন্মত্তভাবে মনুষ্য ও পশুদিগের বংশবৃদ্ধি করিতেছেন; কিন্তু সেই সঙ্গে সেই প্রত্যেকজাতীয় জীবের জন্য সাংঘাতিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এক একটা শত্রুরও সৃষ্টি করিয়াছেন! কি অশেষ উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়া ক্ষুদ্রক্ষুদ্র কতপ্রকার কৌশলসহকারে তিনি দংষ্ট্রা, নখর, শিং, ক্ষুধ, ব্যাধি, সর্প ও মক্ষিকার বিষ প্রস্তুত করিয়াছেন। যেখানে মৎস্যগণ ভাষিয়া বেড়ায়, সেই পুষ্করিণীর উপরিস্থ মাছধরা পাখীদের ঠোট তিনি চুচাল ও তীক্ষ্ণ করিয়া দিয়াছেন, মানুষের জন্য তিনি নানা প্রকার রোগ, অবসাদ, জরাবার্ধক্য পূর্ব্ব হইতেই চুপিচুপি সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন। প্রত্যেকেরই রক্তমাংসের মধ্যে তিনি মর্ম্মন্তুদ চৈতন্যলোপী সুতীক্ষ্ণ প্রেমের কাটা প্রবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছেন; সকলের জন্যই তিনি অসংখ্য ছোটখাট দুঃখ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছেন; স্বচ্ছ নদীর জলেও তিনি শতসহস্র অদৃশ্য ঘাতক রাখিয়া দিয়াছেন;—ভীষণ অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত কীটের বীজ সেই জলে নিহিত করিয়াছেন;—যখনই সেই জল কেহ পান করিতে বাইবে, অমনি তাহারা তাহার অদ্ভুভক্ষণে উদ্যত হইবে।•••"আত্মাকে উন্নত করিবার নিমিত্তই দুঃথযন্ত্রণার সৃষ্টি।” ভাল, তাহাই যেন হইল; কিন্তু আমাদের অবোধ শিশুসন্তানেরা যে একটা বিশেষ রোগে (যে রোগটি বিশেষ করিয়া তাহাদেরই জন্য উদ্ভাবিত) রুদ্ধশ্বাস হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সে বিষয়ে কি বক্তব্য?•••তা ছাড়া, আমি কত হতভাগ্য ক্ষুদ্র পশুদিগের ভয়বিস্ফারিত নয়নে তীব্র যাতনা, নিষ্ফল প্রার্থনা, স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি।•••আর ছোট-ছোট পাখীগুলা যে নির্বোধ-ব্যাধগণকর্তৃক শস্ত্রাঘাতে নিহত হয়, তাহাও কি উহাদের আত্মার উন্নতির জন্য? মাকড়সারা বায়ুস্থিত ক্ষুদ্র প্রাণীদিগকে শোষণ করিয়া যে উদরস্থ করে সে সম্বন্ধেই বা কি বক্তব্য?••এই সমস্ত অনন্ত নিষ্ঠুরতা যুগযুগান্তরব্যাপী জীব-আবর্তের উপর প্রসারিত। বিধাতার প্রতি এরূপ তিরস্কার নিতান্ত অযথা নহে; সর্ব্বকালের সকল লোকেই এই কথা বলিয়া আসিতেছে—ইহার আলোচনা করিতেছে; কিন্তু শিবের গুহার মধ্যে পুনৰ্বার অবতরণ করিয়া এ কথা আজ যেমন আমার মনে দারুণ সত্যরূপে প্রতিভাত হইল, এমন আর পূর্ব্বে কখন হয় নাই। অথচ আমি একজন সুখী পুরুষ; সুখস্বচ্ছন্দে আমার জীবনযাত্রা নিৰ্বাহ হইতেছে; দুর্ভিক্ষ আমার নিকট সহজে পৌছিতে পারে না; বিনাশের অপর কোন হেতুও আমার নিকট আপাতত উপস্থিত নাই; বড়-জোর আমি এখন—মধ্যাহ্বসূর্যের প্রচণ্ড কিরণ হইতে অথবা শুষ্ক তৃণাচ্ছন্ন কৃষ্ণচক্রধারী কেউটেসাপের দংশন হইতে আমার বিনাশের আশঙ্কা করিতে পারি। তা ছাড়া, আমার আশঙ্কার বিষয় এখন আর কিছুই নাই।...

 যখন আমি নীচের সেই বালুকা ও ধূলার ক্ষেত্রে আসিয়া পোঁছিলাম সেইখানে ডাহিনে ফিরিয়া কয়েকমিনিটের মধ্যেই আবার সেই “হাঁ-করা” প্রকাণ্ড গুহাদ্বারের সম্মুখে উপনীত হইলাম।

 আজ প্রাতে এই ভীষণ মন্দিরে প্রবেশ করিয়া কোন ভীষণ শব্দ শুনিতে পাইলাম না। চীল, শকুন কিংবা বাজ, যাহারা মন্দিরের ভিতর-ছাদে বাসা করিয়া থাকে, তাহারা ইতঃপূৰ্বেই শিকারে বাহির হইয়াছে। এখন চতুদ্দিক্‌ নিস্তব্ধ। বিগত দ্বিপ্রহর রাত্রির নিস্তব্ধতার ন্যায় এ নিস্তব্ধতা তত ভীষণ নহে।  স্তম্ভমন্দিরসমূহের পরেই,—হস্তিপৃষ্ঠপরিক্বত অখণ্ড প্রস্তরখোদিত সেই সব দেবালয় গুহার গভীরদেশে খাড়া হইয়া আছে; অসংখ্য-মূর্তি-উৎকীর্ণ গুহার দেয়ালগুলা দেবালয়ের চতুর্দিকে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে কিন্তু উদীয়মান আলোকে এ সমস্ত আর তত বিরাট—তত অতিমানুষিক বলিয়া বোধ হইল না; সৃষ্টির যিনি দেবতা, তাহার বাসস্থানের পক্ষে ইহা যথেষ্ট ভীষণ কিংবা যথেষ্ট অলৌকিক বলিয়া মনে হইল না। এই সমস্ত যে জাতির যেসময়কার হস্তরচনা, সে জাতির তথনো শৈশবদশা উত্তীর্ণ হয় নাই;. সুতরাং জীবনের যে কি অপরিমেয় ভীষণতা, সে সময়ে উহারা যথেষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই; অথবা হৃদয়ঙ্গম করিয়া তাহার উপযুক্ত সাঙ্কেতিক প্রতিরূপ নির্ধারণ করিতে সমর্থ হয় নাই। একে ত তমসাচ্ছন্ন দ্বিপ্রহর রাত্রি, তাহাতে আবার ল্যাণ্ঠানে ভাল আলো হইতেছিল না— এই অবস্থায় গতকল্য এখানে আসিয়া আমার মনে যে ধারণা হইয়াছিল, সেই ধারণার অনুরূপ আজ এখানে কিছুই দেখিতেছি না।

 অত্রত্য সমস্ত পদার্থেরই যে চূড়ান্ত ভগ্নদশা, তাহা আজ প্রভাতের আলোকে বিলক্ষণ জানা যাইতেছে। ভাঙা থাম, থামের মাথাল, মুক্তিদের মুণ্ড, মুর্ত্তিদের ভগ্নদেহ—এই সমন্তের উপর দিয়া শুধু যে শতশত শতাব্দী চলিয়া গিয়াছে তাহা নহে; তা ছাড়া, সেই বিজয়ী মুসলমানদিগের আমলে,—যাহারা ঈশ্বরকে ভিন্ন নামে অভিহিত করে, সেই ধর্ম্ম্মোন্মত্ত মনুষ্যেরা অন্য স্থানের শিবমন্দিরের ন্যায় এই শিবমন্দিরগুলিকেও আক্রমণ করিয়াছিল।

 গতকল্য সেই গভীর রাত্রে, যাহা আমি সন্দেহ পর্য্যন্ত করি নাই, এখন তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি;—পূর্ব্বে এই সমস্ত পদার্থে রং মাখানো ছিল। এই এক-ঝোকা শৈলসমূহের আধো-আঁধারে যে সকল অসংখ্য অখণ্ডমূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়—চারিধারে যে সকল বিচিত্র-অঙ্গভঙ্গিবিশিষ্ট মূর্তুিদিগের ভগ্ন অবয়বাদি দেখিতে পাওয়া যায়—সে-সমন্তে এখনো একটু ফিকে সবুজের পোঁচ রহিয়াছে;—কতকটা যেন শবের রং। পক্ষান্তরে, উহাদের বাসস্থানের গভীরদেশে শুষ্ক শোণিতের ন্যায় একটু লাল রহিয়া গিয়াছে।

 মধ্যস্থলের অখণ্ডপ্রস্তরখোদিত মন্দিরগুলিও পূর্ব্বকালে মিশ্রবর্ণ ছিল। প্রাচীন মিশরের থেরিস্ ও মেফিস নগরের গৃহাদিতে যেরূপ সূক্ষ্ম বর্ণভেদ পরিলক্ষিত হয়, সেইরূপ বিচিত্র মিশ্রবণ এখানকার মন্দিরাদিতে এখনো রহিয়া গিয়াছে;—শাদা, লাল, গেরুয়া হলদে।

 আজ প্রাতে আমি একাই, উপরে উঠিব, এইরূপ স্থির করিয়াছিলাম। আমার পথপ্রদর্শক সেই ছাগপালক যতই মূখ বর্বর হউক না কেন, তবু সে চিন্তাধী মনুষ্য। সে আমার সঙ্গে থাকিলে শিবের সহিত মখামুখী করিয়া আলাপ করিবার পক্ষে ব্যাঘাত হইতে পারে।

 পূৰ্বে যেরুপ দেখিয়াছিলাম,—মন্দিরের অভ্যন্তরে এখনো সেইরূপ নিস্তব্ধতা। কিন্তু খিলান-ছাদের নীচে আর একটু বেশি আলো পাইব বলিয়া আমি আশা করিয়াছিলাম, কিন্তু সে আশা পূর্ণ হইল না। এখন সূর্যোদয়; ইহারই মধ্যে বাহিরের লোহিত ক্ষেত্রভূমিতে যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু বাহিরের এই প্রখর উজ্জ্বল আলোক সত্ত্বেও এখানে ঘোর অন্ধকার। উপরিস্থ গুরুভার পাষাণরাশির তলদেশে এখনো যেন একটু নিশার শৈত্য কারাবদ্ধ হইয়া আছে। মন্দিরের যে অংশটি সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র, তাহারই পশ্চাদ্ভাগে—যেখানকার দেয়ালগুলা বহুশতাব্দী হইতে মশালের ধোঁয়ায় কালো হইয়া গিয়াছে—সেখানে অনন্ত অন্ধকারে পরিবেষ্টিত সেই দেবতার তীব্র উপহাসব্যঞ্জক মুখচ্ছবি বিরাজমান—যিনি জন্মমৃত্যুর দেবতা; সেই কৃষ্ণবর্ণ উপলখণ্ড—সেই প্রস্তরখোদিত শিবলিঙ্গ।

  1. এলোরা গুহা।