বিষয়বস্তুতে চলুন

ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/রাজপুত রাজার গৃহে

উইকিসংকলন থেকে

রাজপুতরাজার গৃহে।

 আমাকে পান্থশালায় লইয়া যাইবার জন্য উদয়পুর-মহারাজার আদেশক্রমে একটা “ল্যাণ্ডৌ” গাড়ি আসিয়া হাজির হইল। অশ্বযুগল নিখুঁৎ সাজসজ্জায় সজ্জিত। বালুকাময় ঢালুভূমির উপর দিয়া ঘোড়ারা ছুটিয়া চলিল। ঢালুভূমির ধারে-ধারে ক্ষুদ্র স্তম্ভশ্রেণী ও গোলাপীরঙের একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকা। একটি সরোবরের তীরে-শৈলভূমির উপর প্রাসাদ-সৌধাবলী অর্ধচন্দ্রাকারে সজ্জিত। পুষ্পপল্লবের মধ্য হইতে কতকগুলা পাথরের হাতী ইতস্তত দেখা যাইতেছে। এই ঢালু-ভূমির উপর দিয়া বলিষ্ঠ অশ্বযুগল বেগভরে অবলীলাক্রমে উঠিতেছে, আমি বেশ অনুভব করিতেছি। শাই, আমাদের দৃষ্টিক্ষেত্র প্রসারিত হইল। শীঘ্নই, সেই সুরম্য বনভূমি, সেই নীল সরোবর, সেই-সব ছোট-ছোট দ্বীপ, সেই-সব দ্বীপস্থ প্রাসাদ আমার নেত্রসমক্ষে প্রসারিত হইল। আমরা যেমন উপরে উঠিতেছি—চতুর্দিকের পর্বতপ্রাচীরটিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই যেন উঠিতেছে, এইরূপ মনে হইতে লাগিল। উদয়পুরের সব জিনিষেরই পশ্চাতে, এই পর্ব্বত-অরণ্যের রহস্যময় চিত্রপটটি চিরবিদ্যমান।

 এই মহারাজা মেওয়ারদেশের অধিপতি। ইহারই সহিত আজ আমি সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছি। রাজস্থানে যত রাজবংশ আছে, তন্মধ্যে ইহারই বংশ সর্ব্বাপেক্ষ। প্রাচীন এবং মানসম্ভ্রমেও ইনি সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চ। ইনি সূর্য্যবংশীয়। বহু-বহু শতাব্দী পূর্ব্বে—যখন য়ুরোপের প্রাচীনতম রাজবংশাবলীর অস্তিত্বমাত্র ছিল না—তখন ইহার পূর্ব্বপুরুষগণ দিগ্‌ বিজয়ার্থ, অথবা বন্দীকৃত রাণীদের উদ্ধারার্থ বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করিতেছিলেন।[]

 বিষ্ণুর অবতার মহাবীর রাম সূর্য্যবংশীয় রাজাদের আদিপুরুষ—এইরূপ রামায়ণে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ লাহোরনগর প্রতিষ্ঠা করেন; কনিষ্ঠের কোন উত্তর-পুরুষ একাদশ শতাব্দীতে রাজপুতদিগের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। যাহাই হউক, ৫২৪ খৃষ্টাব্দে, যখন উত্তরদেশীয় বর্ব্বরগণ দেশ আক্রমণ করিয়া লুঠপাট করে, তখন এই বংশের সমস্ত রাজাই নিহত হন; কেবল একজন রাণী—যিনি তীর্থযাত্রায় বহির্গত হইয়াছিলে—তিনিই রক্ষা পান। তিনি গর্ভবতী হইয়া একটা গুহার মধ্যে লুকাইয়া ছিলেন। তিনি সেই গুহার মধ্যেই একটি পুত্র প্রসব করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। পুরোহিতের এই শিশুটিকে কুড়াইয়া আনে। কিন্তু ইহাকে আগলাইয়া রাখা কঠিন হইল; উষ্ণ রাজশোণিতের প্রভাবে, শিশুটি পর্ব্বতবাসী ভীদিগের বর্ব্বর ব্যায়ামক্রিয়ামোদে লিপ্ত হইল। ভীলেরা উহাকেই সর্দাররূপে বরণ করিল। পরে এই সকল ভীলবীরদিগের মধ্যে একজন,রাজচিহ্নস্বরূপ, নিজের আঙুল কাটিয়া সেই রক্তে তাঁহার ললাট চিহ্নিত করিল। অবশেষে, ৭২৩ খৃষ্টাব্দে, এই গুহাকুমারের বংশধরেরাই এখানকার অধিপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। সেই অবধি এই বাজবংশ অবিচ্ছেদে চলিয়া আসিতেছে। ১৩শত বৎসর পরে এখনো সেই অভিষেক প্রথাটি অক্ষুন্ন রহিয়াছে; প্রত্যেক নূতন রাজার অভিষেক সময়ে,—সেই আদিমঘটনার স্মরণার্থে,–এখনো নবভূপতির ললাটদেশ ভীলহস্তে রক্তের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ল্যাণ্ডৌ-গাড়ি একটা অন্তঃপ্রাঙ্গণে আসিয়া থামিল। এই প্রাঙ্গণটি তাল ও ঝাউগাছে সুশশাভিত। শুভ্রপরিচ্ছদধারী, রাজবাটীর একজন কর্ম্মচারী এইখানে আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন।

 ভারতের অন্যান্য রাজাদিগের ন্যায় এই মহারাজারও অনেকগুলি প্রাসাদ। সর্ব্বপ্রথমে যে প্রাসাদটি আমি দেখিলাম, উহা আধুনিক ধরণের; য়ুরোপীয়-ধরণের বৈঠকখানা-ঘর; বড়-বড় আয়না; রৌপ্যসামগ্রীতে ভারাক্রান্ত সজ্জা-টেবিল; বিলিয়ার্ড-টেবিল;—ভারতের একটি নগরে, এই সমস্ত অপ্রত্যাশিত দ্রব্যসামগ্রী দেখিয়া বিস্মরবিহবল হইতে হয়।

 কিন্তু মহারাজা নিজে, তাঁহার পূর্ব্বপুরুষদিগের পুরাতন অবাসগৃহটিই বেশী পছন্দ করেন। সেইখানেই তিনি আমাকে দর্শন দিবেন; সেইখানেই এখন আমার যাইতে হইবে।

 প্রথমেই, কতকগুলি ছোট ছোট বাগান-বাগিচা ও কতকগুলি নিস্তব্ধ সুঁড়িপথ পার হইলাম। পরে, কোণালু খিলান ও তাম্রকপাটবিশিষ্ট একটা দ্বার পার হইয়াই হঠাৎ দেখি—সম্মুখে জনতা। জনকোলাহল ও কর্ণরোধী উৎকট বাদ্য। আমরা একটা বিশাল প্রাঙ্গণে আসিয়া পড়িয়াছি। এইখানে হস্তিগণের যুদ্ধক্রীড়া প্রদর্শিত হয়। ইহারই এক পার্শ্বে, শুভ্রমুখচ্ছবি পুরাতন প্রাসাদ পূর্ণমহিমায় বিরাজমান। প্রাচীনধরণের খোদাইকাজে, নীলবর্ণ মৃন্ময় ঘটে, সোনালি সূর্য্যের নক্‌সায়, প্রাসাদের সম্মুখভাগ বিভূষিত। প্রাঙ্গণের অপর পার্শ্বে-প্রাচীরের গায়ে সারি-সারি ঘর। সেইখানে শৃঙ্খলবদ্ধ হস্তিগণ, গা দোলাইতে দোলাইতে তৃণচর্বণ করিতেছে। মধ্যস্থলে,ভীষণ সাজে সজ্জিত তিনচারিশত লোক-দেবদাৎসব উপলক্ষে সমাগত পর্ব্বতবাসী ভীল; ইহারা যষ্টির দ্বারা পরস্পরকে আঘাত, করিতে করিতে একপ্রকার যুদ্ধনৃত্য করিতেছে এবং সেই সঙ্গে সানাই, শিঙা, প্রকাণ্ড ঢাকঢোল ও কাংস্যকর্ত্তালের বাদ্য চলিতেছে। একটা ছাদের উপর, শতশত রমণী উহাদের নৃত্য দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া রহিয়াছে। আহা! যেন রূপের হাট বসিয়া গিয়াছে;—মল্‌মল্‌বস্ত্রে ঢাকা কি অনিন্দ্যসুন্দর বক্ষোদেশ!

 মহারাজ পর্য্যন্ত পৌঁছিতে, আরো কত খুঁড়িপথ আরো কত প্রাঙ্গণ। পার হইতে হইল—যেখানে, শাদা মার্ব্বেলের খিলানবীথির মধ্যে, বড়-বড় নারাঙ্গিগাছে ফুল ফুটিয়া আছে এবং তাঁহার গন্ধে চতুর্দিক আমোদিত। কত প্রবেশ-দালান নাগরাজুর ভারে ভারাক্রান্ত! প্রত্যেক কোণে, দীর্ঘ-অসিধারী কত লোক। ইদুরকলের মত কত সুঁডিপথ; কত পুরাতন অন্ধকেরে সিঁড়ি—যাহার ধাপগুলা দুরারোহ ও পিছল; -এরূপ খাড়া যে, উঠিতে ভয় হয়;—উহা পুরু দেয়ালগাঁথুনির মধ্য হইতে কাটিয়া বাহির করা অথবা আদৎ পাথরে গঠিত। ছায়ান্ধকারের মধ্যে যেখানে-সেখানে রক্ষিপুরুষ; যেখানে-সেখানে নাগরাজুতার ছড়াছড়ি। কুলুঙ্গির গভীর দেশ হইতে কত দেবতা আমাদিগকে নিরীক্ষণ করিতেছেন। কত শৈলমঞ্চের উপর দিয়া, উপযুপরি-বিন্যস্ত কত ঘরের উপর দিয়া, খুব উচ্চে উঠিয়া, অবশেষে একটা দ্বারদেশে আসিয়া উপনীত হইলাম। যে কর্ম্মচারী আমাকে পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতেছিল, সে এইখানে আসিয়া সসম্ভ্রমে থামিল এবং মৃদুস্বরে আমাকে বলিল—"এইখানে মহারাজ আছেন। আমি একাকীই প্রবেশ করিলাম।

 মার্ব্বেল-খিলান-সমূহের উপর একটা শুভ্র অলিন্দ প্রসারিত;—তলদেশে শুভ্র বিশাল ছাদ; সেই জমির উপর, তুষারশুভ্র একটা চাদব পাতা। রক্ষিপুরুষ কেহ নাই, আবা আদিও নাই। অন্তরীক্ষবৎ এই বিমল নিস্তব্ধতার মধ্যে—দুইটিমাত্র সোনালি গিটি:করা একইরকমের কেদারা পাশাপাশি স্থাপিত। যিনি একাকী দণ্ডায়মান হইয়া হস্ত প্রসারিত করিয়া আছেন, তাঁহাকে দেখিয়াই চিনিলাম তিনি সেই অশ্বারোহী পুরুষ, যাহার উদ্দেশে সেদিন সায়াহ্নে, বনের সন্ন্যাসিত্রয় স্বকীয় মুখরাগ সম্পাদন কখিতেছিল। ইহার পরিচ্ছদ শুভ্র ও সাদাসিধা; কণ্ঠে নীলমণির হার।  এক্ষণে সেই গিটির হাল্কা চৌকির উপর আমরা উপবেশন করিলাম। দস্তুরমত আদবকায়দার সহিত একজন দোভাষী নিঃশব্দে আমাদের পশ্চাতে আসিয়া দাড়াইল। পাছে তাহার নিশ্বাসবায়ু মহারাজের দিকে যায়, এইজন্য যখনই সে কথা কহিতেছে, অমুনি একটা শাদা রেশমের রুমাল নিজের মুখের সম্মুখে ধারণ করিতেছে। এই। সতর্কতার কোন প্রয়োজন দেখি না; কেন না; তাহার দন্তপংক্তি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও তাহার নিশ্বাস বেশ বিশুদ্ধ।

 মহারাজা স্বল্পভাষী; সহজে কেহ ইহার দর্শন পায় না; তথাপি, ইহাতে কেমন-একটা “মোহিনী” আছে—কেমন-একটি লালিত্য আছে; অতীব মার্জিত শিষ্টতার সহিত কেমন-একটা সঙ্কোচের ভাব মিশ্রিত —যাহা বড়-বড় লাটদিগের মধ্যেই প্রায় দেখা যায়। প্রথমেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহার দেশে আসিয়া আমি যথোচিত আদর-যত্ন পাইয়াছি কিনা;—যে গাড়িঘোড়। তিনি আমার জন্য পাঠাইয়াছেন, তাহা আমার মনোমত হইয়াছে কি না। এইরূপ নিতান্ত সাধারণধরণের সাদামাটা কথা দিয়া আমাদের কথোপকথন আরম্ভ হইল; মাঝে-মাঝে থামিয়া যাইতে লাগিল—বাধিয়া যাইতে লাগিল। কেন না, আমাদের উভয়ের স্বাভাবিক ও কৌলিক সংস্কারের মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ। কিন্তু তাহার পর যখন য়ুরোপের কথা উপস্থিত হইল, যে দেশ হইতে আমি আসিয়াছি তাহার কথা উপস্থিত হই, যে দেশে আমি শীঘই যাইব সেই পারস্যদেশের কথা উপস্থিত হইল, তখন আমি দেখিতে পাইলাম—যদি আমাদের মধ্যে এই সমস্ত বাধা না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের পরস্পরের মধ্যে কত কৌতূহলজনক নূতন-নূতন কথার বিনিময় হইতে পারিত।••

 এই সময়ে একজন আসিয়া মহারাজকে জানাইল,—যেখানে তিন সন্ন্যাসীর বাস, সেই রমণীয় বনে সান্ধ্যভ্রমণার্থ অশ্বারোহণে বাহির হইবার সময় হইয়াছে। আজ সরোবর প্রদক্ষিণ করিয়া, যেখানে হরিণেরা আসিয়া জড় হয়, সেই বাড়ী পর্যন্ত যাইবার কথা। এই ছাদের উপর যে-সকল ভৃত্য বড়-বড় প্রাচ্যধরণের বৃহৎ ছত্র মহারাজার মাথার উপর ধরিয়াছিল, তাহারা নীচে গিয়াও সেই সব ছত্র ধরিয়া মহারাজকে ছায়ায়-ছায়ায় রাখিতে লাগিল। নীচে অশ্বারোহী অনুচরবর্গ মহারাজার সহিত যাইবার জন্য প্রস্তুত।

 আমাকে বিদায় দিবার পূর্বেই, তিনি যে নূতন প্রাসাদটি নির্মাণ করাইতেছেন এবং যাহা এখনো শেষ হয় নাই, তাহা আমাকে দেখাইবার জন্য তাঁহার লোকজনকে আদেশ করিলেন; এবং সেই দ্বীপস্থ পুরাতন প্রাসাদগুলিও দেখাইবার জন্য নৌকা প্রস্তুত রাখিতে বলিবেন।

 আমাদের এই যুগে, পুরাতন জিনিষ সমস্তই লোপ পাইতেছে। সৌভাগ্যের বিষয়, এই ভারতে এখনো এমন কতকগুলি রাজা আছেন, যাহারা খাটি ভারতীয় ধরণের গৃহাদি-নির্ম্মাণে প্রবৃত্ত;—সেইরূপ ধরণের গৃহ, যাহা তাহার পূর্বপুরুষেরা সেই গৌরবান্বিত পুরাকালে উদ্ভাবিত করিয়াছিলেন।

 একটি চক্রাকৃতি ভূমিখণ্ড অন্তরীপের মত সরোবরের অভিমুখে চলিয়া গিয়াছে। এই ভূমিখণ্ডের উপর, খুব উচ্চদেশে, নূতন প্রাসাদটি প্রতিষ্ঠিত;—কতকগুলা শাদাশাদা দালানঘর, কতকগুলা শাদাদা চতুগৃহ;— সমস্তই মালাকৃতি কারুকার্যে ভূষিত;—শাদাটে পাথর কিংবা মার্বেলের সান বসানো। প্রাসাদটি এরূপভাবে নির্ম্মিত ও সংস্থাপিত যে, সেখান হইতে সরোবরের বিভিন্নভাগ বেশ দৃষ্টিগোচর হয়; একটা প্রকাণ্ড সোপান সরোবর পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে; তাহার দুই ধারে পাথরের হাতী। সরোবরটি অরণ্যসমাচ্ছন্ন পৰ্বতমালায় পরিবেষ্টিত। প্রাসাদের অভ্যন্তরে,—দেয়ালের গায়ে, কাচ ও চীনেমাটির (mosaic) বিচিত্র নকসা। অমুক ঘরে দেখিযে—শুধু গোলাপেরই শাখাপল্লব; প্রত্যেক গোলাপটি ২০ রকমের বিভিন্ন চীনেমাটির দ্বারা রচিত। আর-এক ঘরে গিয়া দেখিবে—জলের গাছপালা; পদ্মের গাছ; সেই সঙ্গে বক। ও মাছরাঙা পাখী। এইরূপ বিচিত্র না-কাজের ধৈর্যশালী কারিকরেরা এখনো সেইখানে রহিয়াছে। উহার মাটির উপর উবু হইয়া বসিয়া হাজার-হাজার রঙিন টুকরা-কাচ হইতে, পল্লব ও পাপড়ি খুদিয়া বাহির করিতেছে। সম্প্রতি একটা ঘর শেষ হইয়াছে;—শেয়াল-সবুজ দেয়ালের গায়ে, বড়-বড় লাল গোলাপের নক্সা ছাড়া সেখানে আর কিছুই নাই। এই ঘরটিতে, প্রাচীনধরণের সাজসজ্জা যেরূপভাবে বিন্যস্ত, তাহাতে আমাদের দেশে বাহাকে “নুতন শিল্পকলা” বলে, তাহাই মনে করাইয়া দেয়;—মধ্যস্থলে একটি স্ফটিকের খাট; দেয়ালে যেপ্রকার সবুজ রং-সেই রঙের মশারি; এবং পদানাগুলির সেরূপ লাল রং, সেই রঙেরই মমলের গদী।

 একটি ক্ষুদ্র পুরাতন দেবমন্দির;—এরূপ জীর্ণ যে, সরোবরের জলে এখনি খসিয়া পড়িবে বলিয়া মনে হয়; এই মন্দিরের পাদদেশে, একখানা নোকা আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। আমি সেই নৌকায় উঠিলাম। মাঝিমাল্লারা আমাকে ক্ষুদ্র দ্বীপটির অভিমুখে লইয়া গেল। একটা জোরবাতাস উঠিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময়, এইরূপ বাতাস উঠিয়া থাকে। ধূলারাশি ও মৃত্যু বিকীর্ণ করিয়া এই বাতাস সমস্ত রাজস্থানে গুরিয়া বেড়াইতেছে; কিন্তু এই সরোবরে আসিয়া এই বাতাস বেশ শীতল ও বিমল ভাব ধারণ কবিয়াছে; এবং আমাদের চারিধারে অতীব ক্ষুদ্র নীল লহরীলীলা উঠিয়াছে।

 দুইটি দ্বীপের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, সেই দ্বীপের প্রাসাদটি একশত বৎসরের হইবে; উহা সুগভীর সরোবরের মধ্যস্থলে অবস্থিত। সুতরাং এম্‌নিই ত লোকালয় হইতে বিচ্ছিন্ন,—তাতে আবার প্রাচীরবদ্ধ, হওয়ায়, আরো নিভৃতভাব ধারণ করিয়াছে। ছোট-ছোট উদ্যানগুলিও প্রাচীরবদ্ধ;—সমাধিভূমিসুলভ একপ্রকার উদ্ভিজ্জের দ্বারা আক্রান্ত; কাটাগাছের ঝোপঝাড়, লম্বা-লম্বা উদ্দাম তৃণরাশি, চরকার পাইজের মত বড়-বড় lollyhock,এই সব তৃণগুলে আচ্ছন্ন। প্রাসাদের অভ্যন্তরে, গোলোকধাধার মত কতকগুলা অতধরণের ঘর;—নীচু, অন্ধকরে, বিচিত্র নক্সার কাজে কিংবা চিত্রে বিভূষিত; কিন্তু এই সব নক্সাদি এখন অনেকটা ক্ষয় হইয়া গিয়াছে। প্রাসাদটি এরূপভাবে নির্ম্মিত যে, দিবসের প্রত্যেক মুহূর্তেই, ছায়া ও শৈতা সকল-দিকেই সমান উপভোগ করা যাইতে পারে; ইচ্ছা করিলে, এই প্রাসাদেই, কখন তুমি বিষগ্ন ফুলের • কেয়ারীর সম্মুখে, কখন দূরহ ব্যাসঙ্কুল অরণ্যের সম্মুখে, কখন বা নিকটবর্তী সরোবরতীরস্থ শুভ্র পরীপ্রাসাদের সম্মুখে, আপন কল্পনায় বিভোর হইতে পার। এই দ্বীপের ছোট-ছোট ঘরগুলিতে—এখানকার এই সব “পোড়ে” ঘৰগুলিতে,—একসময় না জানি কত জীবননাট্য অভিনীত হইয়াছে,—দীর্ঘকাল ধরিয়া কত লোকে কত কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে! এক্ষণে এই ঘরগুলি,—সোবরের আর্দ্রতা, শৈবাল, ও যক্ষারের প্রভাবে ধীবে-ধীরে বিনষ্ট হওয়া-প্রযুক্তই কি পরিত্যক্ত হইয়াছে?... প্রাচীরের কুলুঙ্গিতে,—সমাধিস্থানের আধো অন্ধকারের মধ্যে কতকগুলা ছোট-খাটো খেলনাসামগ্রী শাশি-দরজার মধ্যে রুদ্ধ। প্রায় • একশত বৎসর হইল, এই সব দ্রব্য যুবোপ হইতে আইসে, সুতরাং মহামূল্য হইবারই কথা!—পুরাতন চীনেমাটির পাত্রাদি, যোড়শ লুইর আমলের পোষাকপরা পুতুল, ছোট-ছোট ঘটে বসানো কৃত্রিম পুস্পাদি। জানি কত রাণী, কত রাজকুমারী এই সকল ক্ষণভঙ্গুর উপঢৌকন প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাঁহারা চলিয়া গিয়াছেন—তাঁহাদের জিনিষগুলি এইখানেই রহিয়া গিয়াছে।

 ইহার পরেই, বড় দ্বীপটিতে নামিলাম। এখানকার প্রাসাদগুলি, প্রায় তিনশত বৎসর হইল, একজন-প্রবল-প্রতাপ-নৃপতি-কর্তৃক নির্মিত হয়। এই প্রাসাদগুলি অপেক্ষাকৃত আরো বিশাল, আরো ভগ্নদশাপন্ন। ঘাটের সিঁড়ি প্রকাণ্ড;—ধাপগুলি শাদা ধপ্‌ধপে—জলে অর্দ্ধনিমজ্জিত; সরোবরের সমরেখাপাতে, সোপানের ধারে-ধারে বড়-বড় পাথরের হাতী সারি-সারি সজ্জিত;—মনে হয় যেন তাহারা নৌকার আগমন নিরীক্ষণ করিতেছে। পার্শ্ববর্ত্তী ছোট দ্বীপটির ন্যায়, এখানকার বিষন্ন উদ্যানগুলিও প্রাচীরবদ্ধ; কিন্তু এই সকল প্রাচীরে নক্‌সা-কাজের খুঁটিনাটি আরো বেশী;—কারিকরদিগের ধৈর্য্যের পরিচয় আরো বেশী পাওয়া যায়। দক্ষিণাত্যের বড়-বড় তালগাছ এখানে আছে; এই সব তালগাছ এখানে বন্য-অবস্থায় বর্দ্ধিত হয় না;—রাজপ্রাসাদেরই চতুর্দ্দিকে বিলাসসামগ্রীরূপে সংরক্ষিত। নারাঙ্গিকুঞ্জের উদ্গিরিত সৌরভে চারিদিক্‌ আমোদিত; মরাপাতার উপর নারাঙ্গিফুলের পাপ্‌ড়ি ঝরিয়া-পড়িয়া গাছের তলদেশ ছাইয়া গিয়াছে;—মনে হয় যেন জমাট শিশিরবিন্দুর একটা স্তর পড়িয়াছে। আমরা যখন প্রবেশ করিলাম, তখন একটু বেশী বেলা হইয়া গিয়াছে;—উচ্চ ও খাড়া পর্ব্বতগুলার পশ্চাতে সূর্য্য অনেকটা ঢলিয়া পড়িয়াছে; তাই সরোবরের উপরে যেন একটু আগেভাগেই সন্ধ্যা দেখা দিয়াছে। ইহা টিয়াপাখীদের শয়নকাল। এই সব প্রাচীরবদ্ধ সুরক্ষিত নারাঙ্গিগাছের মধ্যেই উহাদের সাধের বাসা। সুবম্য বনভূমি হইতে, সবুজ মেঘের মত উহারা দলে-দলে উড়িয়া আসিতেছে, দেখিতে পাওয়া যায়। এখানকার ম্রিয়মাণ গাছের পাতাগুলি অপেক্ষা উহারা বেশী সবুজ। চতুর্দ্দিকস্থ বনরাজি শীতঋতুসুলভ ধূসরবর্ণ ধারণ করিয়াছে; এমন কি, জলের ধারেও, সমস্ত উদ্ভিজ্জ “হল্‌দে মারিয়া’’ যাইতেছে। শুষ্ক বায়ু—দুর্ভিক্ষের বায়ু—সোঁসোঁ করিয়া বহিতেছে;—ইহার জোর যেন ক্রমেই বাড়িতেছে। এই দ্বীপে, এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, সন্ধ্যার বিষাদচ্ছায়া আরো যেন ঘনীভূত হইয়া, ভয় ও উদ্বেগ বর্দ্ধিত করিতেছে।

  1. রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা-আক্রমণ।