ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/শিবের নৌকা

উইকিসংকলন থেকে

শিবের নৌকা।

 বলা বাহুল্য, এই নৌকাখানা একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার হইলেও নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী কতকগুলা হালকা বাঁশে নির্মিত। তিন-‘ডে’ ওয়ালা জাহাজ অপেক্ষাও ইহা বড়;—এক প্রকার পরী-প্রাসাদ বলিলেও হয়। ইহার পৃষ্ঠভাগ সোনালি পাতমোড়া মোটা কাগজের, অথবা রেশমের। ইহাতে মন্দিরের ন্যায় কতকগুলা চূড়া, কাগজের ঘোড়া, কাগজের হাতী রহিয়াছে; আর কতকগুলা ছোট ঘোট নিশান উড়িতেছে। আমরা য়ুরোপীয়, আমাদের চোখে, ইহার সব দোষ খণ্ডিয়া যায় ইহার অতিমাত্র বৈদেশিকতায়, ইহার অদ্ভুত বিচিত্র কল্পনা-লীলায়, ইহার সেকেলে ধরণের সাজসজ্জায়।

 এখন অপরাহ্ন দুই ঘটিকা। সরোবরের উপর,—উহার বিজন তটভূমির উপর,প্রখর রৌদ্র। মান্ধাতার আমলের সাজ-সজ্জায় সজ্জিত হইয়া, এই নৌকাখানা এইখানেই, প্রকাও ঘাটের সিড়িতে বাঁধা রহিয়াছে। এই সময়ে শিবের নৌকাররাহণ করিবার কথা। কিন্তু কেহই আসে নাই,—এখনও কাহারও সাড়াশব্দ নাই।

 এই সরোবরটি মানুষের হাতে খনিত চতুষ্কোণ; তটের ঘের ৯০০ কিংবা ১২০০ গজ হইবে। ভক্তগণ যাহাতে সোবরে নামিতে পারে, এই জন্য উহার চারিধারেই পাথরের সিড়ি। সরোবরের মধ্যস্থলে একটি দ্বীপ—সবোবরেরই ন্যায় চতুষ্কোণ। এই দ্বীপের উপর একটি ধপধপে সাদা মন্দির; উহার প্রত্যেক কোণ হইতে এক একটি ক্ষুদ্র চূড়া সমুথিত। সরোবরের তটসংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভূমি-জনতার পক্ষে খুব অনুকূল—এই সময়ে সূর্যের প্রখর কিরণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে; উহার চারিধারে উদ্ভিজ্জের হরিৎশ্যামল যবনিকা-তালীবনরাজি, আর কতকগুলি মন্দির; এ সমস্ত, দেবীর বৃহৎ মন্দির হইতে বহুদূরে—প্রায় গ্রামপল্লীর অভ্যন্তরে।

 ঢাকঢোলের শব্দ ক্রমেই নিকটবর্তী হইতেছে। + + সমারোহের ঠাটু আসিতেছে;— একটা ছায়াপথ হইতে বাহিব হইয়া উহার মুক্তাললাকে, এই তাপদগ্ধ ক্ষুদ্র মরুভূমির মধ্যে আসিয়া পড়িল—যেখানে সরোবর ও সরোবরের নৌকাখানা এখনও নিদ্রামগ্ন। প্রথমে মানুষের কাঁধে,—১০১৫ ফীট উচ্চ, কতকগুলা কাগজের বিরাটমূর্ত্তি, মানুষের পিঠে কতকগুলা কৃত্রিম হাতী ঝাকাইতে বাকাইতে আসিল, তার পর, ৬টা সত্যকার হাতী-চুমকি বসানো, লম্বা, লাল পোষাকে সজ্জিত; ২০ টা প্রাচ্যদেশীয় পুরাতন প্রকাণ্ড লাল ছত্র —যাহা এককালে ব্যাবিলন্ ও নিনিভায় খুব প্রচলিত ছিল; তাহার পর ঢাক ঢোল, তীক্ষ্ণস্বর শানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র; সৰ্বশেষে শিবের জন্য ও তাঁহার পরিবারস্থ অন্যান্য দেবতার জন্য সোনার গিণ্টিকরা পাল্কী। সমারোহের এই সমস্ত ঠাট। ইহার সঙ্গে কোনও জনতা নাই। এই ঠাট মাদুরার মধ্য দিয়া আসিবার সময়, মাদুরার লোকদিগের কিছুমাত্র ঔৎসুক্য হয় নাই। সরোবর প্রদক্ষিণ করিয়া ঠাটুটি নৌকার সম্মুখে আসিয়া থামিল। কিন্তু কেহই কুতূহলী হইয়া এখানে দেখিতে আসিল না!

 শুনিলাম, এইবার উহারা নৌকায় উঠিবে; কে আগে, কে পরে উঠিবে, তাহাও পূর্ব্ব হইতে নির্দিষ্ট আছে। প্রথমে শিবের দুই পুত্র, পরে শিব, এবং সর্ব্বশেষে পার্বতী,শিবের পত্নী। যাহারা বহুদিন হইতে এই কর্মে নিযুক্ত,সেই চৰ্মাবরণে আচ্ছাদিত পুরাতন মাঝিমাল্লারা টস্ট করিয়া গা-বাহিয়া জল ঝরিতেছে, এই অবস্থায়,—জল হইতে উঠিয়া পাল্কীর নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। বিষ্ণুদেবের রথারোহণের সহিত ইহার কত প্রভেদ; সেই রাগমে, রহস্যময় বিষ্ণুদেব-গভীর। রাত্রে, কত অবগুণ্ঠন-বস্ত্রে আবৃত হইয়া, তবে রথে উঠিয়াছিলেন। এইখানে আমি খুব কাছে আসিয়া দাড়াইলাম। উহারা তাহাতে কিছুমাত্র উদবেজিত হইল না—আমাকে দূরে যাইতেও অনুরোধ করিল না। পাল্কীর ঘেরাটোপ্ খোল ছিল; তাই, আজ এই প্রথমবার সেই সব বিগ্রহ দেখিতে পাইলাম—যাহাদিগকে কত শতাব্দী ধরিয়া এখানকার লোকে ভয় ও ভক্তি করিয়া আসিতেছে। * * *

 জমকাল গদীর উপর উপবিষ্ট এই বিগ্রহগুলিকে, যখন কতকগুলি নগ্নকায় বৃদ্ধ স্বীয় বলিরেখাঙ্কিত বাহুর উপর বসাইয়া লইয়া গেল, তখন আমার যেকি বিস্ময়—এমন কি, আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছিল—তাহা আর কি বলিব! কতকগুলি বিকটাকার পুত্তলিকা;—দেখিভে নরম-ততলে; গ্রীবাদেশ কাঁধের মধ্যে যেন ঢুকিয়া গিয়াছে; গোলাপী রঙ্গের ছোট ছোট মূর্ত্তি-কমলানের মত ট্যাবাটোবা। (কি জন্য গোলাপী রঙ্গ?—ভারতবাসীর রঙ্গ তাম্রাভ বলিয়াই কি?) ওষ্ঠাধর পাতলা; চক্ষু নিমীলিত ও পক্ষশূন্য;—দেখিলে মনে হয়, মনুষ্যের জ্বণ, * * * মৃতশিশু; এই চিরনিদ্রার অবস্থাতেও মুখের ভাব ভীষণ; কিন্তু এই ভীষণতার সঙ্গে একপ্রকার ভোগতৃপ্ত হৃষ্টপুষ্ট ভাব, প্রমত্ততার ভাবও প্রকটিত রহিয়াছে। মাশি রাশি রত্নমালা, হীরা চুণির অলঙ্কার, সূক্ষ্ম মুক্তার ঝালর-এই সমন্তের মধ্যে বিগ্রহগুলি নিমজ্জিত। বহুমূল্য কাণবালার ভারে ভারাক্রান্ত বড় বড় সোনার কাণ উহাদের মাথার দুই পাশে ঝুলিতেছে। উহাদের হাতের উপর খুব বড় বড় সোনার হাত বসানো,—তাহাতে লম্বা লম্বা নখ। আবার উহাদের জঘার শেষপ্রান্তে বড় বড় সোনার পা। এইরূপ একটা বিপরীত-প্রমাণ কৃত্রিম হাতের মধ্য হইতে উহাদের একটা আসল হাত বাহির হইয়া পড়িয়াছে;—ইহা বানরের হাতের ন্যায়, কিংবা শিশুর হাতের ন্যায় ক্ষুদ্র। হস্তপুট শম্ব কাকৃতি। হাতের রঙ্গ দেহের রঙ্গেরই মত গোলাপী। * *

 সূর্যের প্রখর তাপ; ঢাক ঢোল শানাইয়ের ঘোর বাদ্যঘটা। এ দিকে চৰ্মাবরণে আচ্ছাদিত সেই মাঝিমাল্লারা মৃতজাত-শিশু প্রায় পুতুলগুলাকে রত্নালঙ্কার ও কিংখাব-বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া নৌকায় লইয়া গেল; এবং নৌকার অন্তরতম প্রদেশে সিংহাসনের উপর বসাইয়া, মোটা কাপড়ের পর্দার আড়ালে উহাদিগকে অদৃশ্য করিয়া রাখিল।

 এইখানেই সমস্ত শেষ। সমারোহের ঠাট—হস্তী, ছত্র, সমস্তই চলিয়া গিয়াছে। সবোবরের তটদেশ আবার মরুভূমিতে পরিণত হইল। কেবল আজ রাত্রে একবার বিগ্রহগুলিকে সরোবরের চারিধারে ঘুরাইয়া আনা হইবে।

 দিবসের প্রখর অত্যাচার এবং রশ্মি ও বর্ণচ্ছটার উন্মত্ত উৎসব-লীলা থামাইয়া দিয়া,বৃদ্ধ ভারতকে একটু বিশ্রাম দিবার জন্য, আবার রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হইল। নীলিম কৃষ্ণবর্ণে ধরাপৃষ্ঠ আচ্ছন্ন ছিল,এক্ষণে সধুর চন্দ্রমা সমুদিত হইয়া, ধীরে ধীরে সমস্ত পদার্থ রজতকিরণে রঞ্জিত করিল। এই সময়ে ভক্তগণ দলে দলে সরোবরের ধারে আসিয়া, তিনটি প্রস্তরনির্মিত ঘাটের প্রত্যেক ঘাটের সিড়িতে নামিয়া, তিন-সারি তৈলসিক্ত দীপ-শলিত জালাইবার জন্য আগ্রহসহকারে প্রবৃত্ত হইল। এই প্রকাণ্ড চৌকোণা সরোবরের চারিধারেই তিন-সারি ছোট ছোট প্রদীপ সজ্জিত রহিয়াছে। সরোবরমধ্যস্থিত দ্বীপে যে মন্দিরাদি রহিয়াছে, তাহাতেও দীপাবলী জ্বালান হইল। শুভ্র চন্দ্রালোকে সমস্তই ধপ ধপ, করিতেছেতথাপি, অনলশিখাচ্ছটা চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইল।  সূর্য্যাস্ত-সময় হইতে জনতার আরম্ভ হইয়াছে। যে সব ছায়াতরুর পথ,—আলুলায়িত-কেশ-বটবৃক্ষ-শশাভিত পথ এইখানে আসিয়া মিলিত হইয়াছে, সেই পথগুলি,—নগর গ্রামাদি হইতে মানব-জনতার প্রবাহধারা, এই সরোবরের ধারে অজস্র ঢালিয়া দিতেছে।

 শিবপূজার জন্য এই লোকসমাগম। সরোবরের চারিধার মাথায় মাথায় আচ্ছন্ন। মাথাগুলা এত ঘেঁষাঘেসি যে, নদীতীরের উপল-রাশি বলিয়া মনে হয়। ভারতবাসীদের এই সরু সরু তমসাচ্ছন্ন মাথাগুলা, আমাদের য়ুরোপীয় মাথা অপেক্ষা অনেক ছোট। মনে হয়, এই সব মস্তকে গুহধর্ম্ম (Mysticism) ও জ্বলন্ত ইন্দ্রিয়পরতা ভিন্ন বুঝি আর কিছুরই জন্য স্থান নাই। (কথাটা বিরক্তিকর হইলেও বলিতে হইবে, এই দুই জিনিস প্রায় যুগলমূর্ত্তিতেই দেখা দেয়)। এই শিবের সোবরে আসিবার সময়, প্রত্যেকেই একএকটা সপল্লব খাগড়ার ডাল কাধে করিয়া লইয়া আইসে;—দেখিলে মনে হয়, যেন একটা তৃণের ক্ষেত আসিতেছে।

 রাত্রির প্রারম্ভেই, বৃহৎ মন্দির হইতে যে সকল হস্তী এখানে আসিয়াছে, তাহারা এই সব চিন্তাশীল-মস্তকরূপী কন্দুকরাশির মধ্যে—গণ্ডশৈলের ন্যায়, ক্ষুদ্র দ্বীপের ন্যায়, ইতস্ততঃ সমুখিত।

 এই পরী-নৌকার পার্শ্বে,–এই স্বর্ণমণ্ডিত ধ্বজচূড়া-সমন্বিত ভাসন্ত প্রাসাদের পার্শ্বে যেখানে অবিরাম মশাল জ্বলিতেছে-একটা তুমুল মানবজনতা, বাধোদ্যম-সহকারে, আসিয়া উপস্থিত হইল। উহারা, নৌকার গুণটানা রশি মাটির উপর লম্বাভাবে ছড়াইয়া রাখিল; এবং ভক্তদিগের মধ্য হইতে শত শত লোক আসিয়া, আনন্দধ্বনি করিতে করিতে, ঐ রশিটা ধরিল। এই দীর্ঘ প্রসারিত রঞ্জুর পার্শ্বে যাহারা দাড়াইবার স্থান পাইল না, তাহারা সকলের উপর জল ছিটাইয়া, সরোবরের উপর ঝাপাইয়া পড়িল। আ-কটি জলে নিমজ্জিত হইয়া উহারা পিছন হইতে পার্শ্ব হইতে নৌকাকে ঠেলিবে—অন্ততঃ নৌকার সঙ্গে সঙ্গে যাইবে।   আবার ঘোর কোলাহল;—ঢাক ঢোল শানাইয়ের উন্মত্ত বাদ্যঘটা। এইবার নৌকা ছাড়িয়াছে। সরোবরের প্রস্তরময় কিনারা দিয়া নৌকা বেশ সহজে চলিতেছে। দেব ও দেবীর নৌকাযাত্রা এইবার আরম্ভ হইয়াছে। যে স্বর্গীয় শুকিরণ ঢালিয়া আজ রাত্রে চন্দ্রমা সকলকে বিমুগ্ধ করিতেছেন, তাহা অপেক্ষা শিবের এই উৎসব-আড়ম্বর শতগুণে পার্থিব, সন্দেহ নাই। সরোবরের তীরে, ঘণ্টিকাজাল সমাচ্ছন্ন শান্তশিষ্ট হস্তিগণ ঘণ্টাধ্বনি করিতে করিতে এই তুমুল জনতার সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে, এবং তাহাদের গুরুপদভারে পাছে কোনও শিশু বিদলিত হয়, এই জন্য। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে পদক্ষেপ করিতেছে।