ইংরেজ ডাকাত/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
লালবাজার পুলিসে বড় সাহেবের আফিসের সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময়ে তাঁহার ‘টম্ টম্’ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি ও সাহেব উভয়েই সেই ‘টম্ টম্’ আরোহণ করিয়া প্রেসিডেন্সী জেলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গমন করিয়া যাহা দেখিলাম, ও যাহা শুনিলাম, তাহাতে অবগত হইলাম যে, ওয়ার্ণার ও হিলি দুইজনেই এক সময়ে জেল-হাসপাতালে ছিল; সেই সময় হইতেই উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া উহারা যখন জেলের ভিতর থাকে, সেই সময়ে একজন কয়েদী সংবাদ দেয় যে, ওয়ার্ণার ও হিলি জেল হইতে পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। সেই সংবাদ পাইয়া জেলের কর্ত্তৃপক্ষীয়গণকর্ত্তৃক উহাদিগের থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করা। হয়। সেই সময় হিলি যে স্থানে থাকিত, সেইস্থানে একখানি লৌহ-নির্ম্মিত অস্ত্র পাওয়া যায়। সেই সময় হইতে উহাদিগের উপরে বিশেষ পীড়াপীড়ি আরম্ভ হয়, এবং বিশেষ সতর্কতার সহিত উহাদিগকে জেলের ভিতর কয়েদ করিয়া রাখা হয়; উভয়কেই বৃহৎ লৌহ-শৃঙ্খল বা বেড়ির দ্বারা আবদ্ধ করা হয়। ইহা ব্যতীত রাত্রিকালে উভয়কেই স্বতন্ত্র গৃহে বন্ধ করিয়া রাখা হয়, এবং গৃহের দ্বার: ‘চব্স্’ তালা দ্বারা আবদ্ধ থাকে। এই গৃহকে “শেল” কহে।
হিলি ও ওয়ার্ণার কয়েদী। কিন্তু কয়েদী হইলেও উহারা ইংরাজ; সুতরাং দেশীয় কয়েদীর সহিত তাহাদের তুলনা হইতে পারে না। দেশীয় কয়েদীর পোষাক, এক প্রকার কাল ডোরাযুক্ত মোটা কাপড়ের জাঙ্গিয়া ও পিরাণ, এবং গলায় লোহার হাঁসুলি। আর ইংরাজ কয়েদীর পোষাক, কিছু অল্পমূল্যের কাপড়ের কোট, পেন্ট্লান; পায়ে মোজা ও বুট জুতা, মস্তকে সাদা সোলার হাট। এই ত গেল পরিধেয়ের তারতম্য। ইহা ভিন্ন দেশীয় কয়েদী লোহার থালায় অন্ন আহার করে, ও মৃত্তিকা-নির্মিত এক প্রকার শয্যার উপর শয়ন করে। আর, ইংরাজ কয়েদীর থাকিবার গৃহে প্রত্যেকেরই একটা টেবিল, একখানি চেয়ার ও একখানি খাট থাকে; আর তাহাদিগকে প্লেটে করিয়া রুটী, মাখম এবং মাংসাদি ভোজন করিতে দেওয়া হয়।
হিলি ও ওয়ার্ণার যে যে ‘শেলে’ বদ্ধ থাকিত, সেই সেই ‘শেলে’ এক একটী টেবিল, চেয়ার ও খাট ছিল।
যে সময়ে জেলের প্রহরী ‘কয়েদী পলাইল’ বলিয়া চীৎকার করিল, তাহার পর জেলের ভিতর দেখা গেল, উভয় ‘শেলের’ চব্স্ তালা ভাঙ্গা, উভয় কয়েদীর বেড়ি সেইস্থানে গড়া গড়ি যাইতেছে। সেই স্থানে একটী লোহার পুরাতন গাতি পড়িয়া রহিয়াছে, ‘শেলের’ ভিতর টেবিল চেয়ার প্রভৃতি কিছুই নাই। যে স্থান দিয়া কয়েদীকে পলাইতে একজন প্রহরী দেখিয়াছিল, সেইস্থানে জেলের ভিতর সেই সকল টেবিল, চেয়ার, খাট প্রভৃতি উপর্য্যুপরি করিয়া রাখা আছে। এই অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, উহারা এই সকল দ্রব্যের সাহায্যে, সেই উচ্চ প্রাচীরে উঠিয়া সেই স্থান হইতে লম্ফপ্রদান পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে।
যে প্রহরীর পাহারার সময় কয়েদীদ্বয় পলায়ন করে, সেই প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, সে উহাদিগকে প্রথমে প্রাচীরের উপর দেখিতে পাইয়া “কয়েদী পলাইল, কয়েদী পলাইল” বলিয়া যেমন চীৎকার করে, অমনি তাহারা এক এক লম্ফে জেলের বাহিরে গিয়া উপস্থিত হয়। সেই সময় সে তাহার হস্তের রুল ফেলিয়া প্রহার করায়, উহাদের একজনের টুপি সেইস্থানে পড়িয়া যায়। উহারা সেই টুপি লইতে সময় না পাইয়া, টুপি ফেলিয়াই প্রস্থান করে। প্রহরী বন্দুক লইয়া পাহারায় নিযুক্ত ছিল, কিন্তু সে সময়ে সেই বন্দুক কোন কাজেই লাগে নাই; কারণ, উহাতে গুলি, বারুদ প্রভৃতি কিছুই ছিল না; কেবল ফাকা বন্দুকই ছিলমাত্র।
আরও জানিতে পারিলাম যে, সেই প্রহরীর নিকট সংবাদ পাইয়া জেলের প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীমাত্রই সেই স্থানে আগমন করেন। যেরূপভাবে কয়েদীদ্বয় পলায়ন করিয়াছে, তাহা শ্রবণ করিয়া, এবং জেলের ভিতরস্থিত অবস্থা সকল দেখিয়া তাঁহারা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়েন; তথাপি সময়োচিত অনুসন্ধান করিতে তাঁহারা কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই। তাঁহাদিগের সাধ্যমত সেই জেলের চতুঃপার্শ্ববর্ত্তী প্রকাণ্ড ময়দানের ভিতর সেই রাত্রিতেই কয়েদীদিগের অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; এবং অপরাপর বিশ্বাসী কর্ম্মচারীবর্গের দ্বারাও নিকটবর্ত্তী স্থান সকল অনুসন্ধান করিতে কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই; কিন্তু তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ না হইয়া পরদিবস প্রাতঃকালে পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন।
এই সকল দেখিয়া শুনিয়া সাহেব ও আমি সেই জেল হইতে বহির্গত হইয়া, পলাতক কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। কিন্তু কোন্স্থানে গমন করিব, কোন্ পথ অবলম্বন করিলে তাহাদিগের সন্ধান পাইতে পারি, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কারণ, এমন কোনস্থান বাকি ছিল না, যে দিকে অপরাপর কর্ম্মচারীগণকে প্রেরণ করা না হইয়াছে। পরিশেষে উভয়ে যুক্তি করিয়া প্রথমে হাবড়া রেলে দেখাই স্থির করিলাম। কারণ, সেই পথ দিয়া ওয়ার্ণার আর একবার পলায়ন করিয়াছিল। হাবড়ায় গিয়া দেখিলাম, সম্মুখে গাড়ি সুসজ্জিত। তখন তাহাতে উঠিয়াই চলিলাম—বর্দ্ধমান। প্রথমে বর্দ্ধমানে অনুসন্ধান করিলাম, কোন সন্ধান পাইলাম না। সেইস্থান হইতে চন্দননগরে ও পরিশেষে সেওড়াফুলিতে আসিলাম; সেস্থানেও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। এইরূপে দুই একটী ষ্টেশন অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু সে দিবস কোন সন্ধান না পাইয়া রাত্রি বারটার সময় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। রাত্রি দুইটা পর্য্যন্ত উভয়ে পরামর্শ পূর্ব্বক স্থির করিলাম যে, এরূপভাবে অনুসন্ধান করিলে চলিবে না। হাবড়া হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেক ষ্টেশনে গমন করিব, ও সেই সেইস্থানে থাকিয়া রীতিমত অনুসন্ধান করিতে করিতে, ক্রমে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত গমন করিতে থাকিব, এবং আবশ্যক বিবেচনা করিলে ক্রমে আরও অধিক দূর গমন করিব।