ইতিহাস/মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

উইকিসংকলন থেকে

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী। শ্রীনিখিলনাথ রায় -প্রণীত


 মুসলমানের রাজত্ব গিয়াছে অথচ কোথাও তাহার জন্য শূন্য স্থান নাই। ইংরাজ রাজত্বের রেলের বাঁশি, স্টিমারের বাঁশি, কারখানার বাঁশি চারি দিকে বাজিয়া উঠিয়াছে— চারি দিকে আপিস-ঘর, আদালত-ঘর, থানাঘর মাথা তুলিতেছে; ইংরাজের নূতন চুনকাম-করা ফিট্‌ফাট ধব্‌ধবে প্রতাপ দেশ জুড়িয়া ভিত্তি গাড়িয়াছে— কোথাও বিচ্ছেদ নাই। তথাপি নিখিলবাবুর ‘মুর্শিদাবাদ-কাহিনী’ পড়িতে পড়িতে মনে হয়, এই নূতন কর্মকোলাহলময় মহিমা মরীচিকাবৎ নিঃশব্দে অন্তর্হিত, তাহার পাটের কলের সমস্ত বাঁশি নীরব, কেবল আমাদের চতুর্দিকে মুসলমানদের পরিত্যক্ত পুরীর প্রকাণ্ড ভগ্নাবশেষ নিস্তব্ধ দাঁড়াইয়া। নিঃশব্দ নহবতখানা, হস্তীহীন হস্তীশালা, প্রভুশূন্য রাজতক্ত, প্রজাশূন্য আমদরবার, নির্বাণদীপ বেগমমহল একটি পরম বিষাদময় বৈরাগ্যময় মহত্বে বিরাজ করিতেছে। মুসলমানরাজলক্ষ্মী যেন শতাধিক বৎসর পরে তাহার সেই অনাথপুরীর মধ্যে গোপনে প্রবেশ করিয়া একে একে তাহার পূর্বপরিচিত কীর্তিমালার ভগ্ন চিহ্নসকল অনুসরণ করিয়া সনিশ্বাসে দূরস্মৃতি-আলোচনায় নিরত হইয়াছে।

 নিখিলবাবু তাঁহার অধিকাংশ প্রবন্ধে সেকাল-একালের তুলনা বা ভালোমন্দ বিচারের অবতারণা করেন নাই। তিনি সেই প্রাচীন কালকে খণ্ড খণ্ড চিত্র-আকারে নিবদ্ধ করিয়া পাঠকদের সম্মুখে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বইখানি যেন নবাবী আমলের ভগ্নশেষের অ্যাল্‌বম। চিত্রগুলি সেদিনকার অসীম ঐশ্বর্য এবং বিচিত্রব্যাপারসংকুল মহৎ প্রতাপের অবসানদশার জন্য একটি স্নিগ্ধ করুণা এবং গভীর বিষাদের উদ্রেক করিতেছে।

 এপ্রকার ঐতিহাসিক চিত্র-গ্রন্থ বঙ্গভাষায় আর নাই। নিখিলবাবুর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া যদি ভিন্ন ভিন্ন জেলা-নিবাসী লেখকগণ তাঁহাদের স্থানীয় প্রাচীন ঐতিহাসিক চিত্রাবলী সংকলন করিতে থাকেন তাহা হইলে বাংলাদেশের সহিত বঙ্গবাসীর যথার্থ সুদূরব্যাপী পরিচয় সাধন হইতে পারে। নিখিলবাবুর এই সদ্‌দৃষ্টান্ত, তাঁহার এই গবেষণা ও অধ্যবসায়ের জন্য, বঙ্গসাহিত্য তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ।

 এই বৃহৎ গ্রন্থে কেবল একটি নিন্দার বিষয় উল্লেখ করিবার আছে। নিখিলবাবু যেখানে সরলভাবে ঐতিহাসিক তথ্য বর্ণনা করিয়াছেন তাহার রচনা অব্যাহতভাবে পরিস্ফুট হইয়াছে। কিন্তু যেখানে তিনি অলংকারপ্রয়োগের প্রয়াস পাইয়াছেন সেখানে তাহার লেখার লাবণ্য বৃদ্ধি হয় নাই, পরন্তু তাহা ভারগ্রস্ত হইয়াছে।