ইন্দুমতী/কর্ম্মক্ষেত্রে

উইকিসংকলন থেকে
চতুর্থ সর্গ।
কর্ম্মক্ষেত্রে।

আরোগ্য হ’লেন শেষে শ্রীধর ঠাকুর
পুত্র কন্যাগণ আর গৃহিণী সহিত।
তাঁহাদের যত্নে,স্নেহে,আর ইব্রাহিম
তাঁহার আগ্রহে,শেষে করিলেন স্থির
দেবব্রত সেইখানে থাকিতে এখন,
উৎসর্গ করিতে প্রাণ পল্লীর কল্যাণে।
 পল্লীবাসী কিসে শিখে সাম্য,উদারতা,
পরস্পরে সমব্যথা,ভালবাসাবাসি,
কেমনে সকলে এক হইবে তাহারা,
হইবে উন্নত আর অবস্থা তা’দের,
গো জাতির কিসে হয় অশেষ মঙ্গল,
কৃষিকাজে কিসে হয় বহু অর্থ লাভ,
গ্রামখানি কিসে হয় সুখ স্বাস্থ্যময়,
সবিস্তারে কহি তাহা মধুর ভাষায়,
শিক্ষা দিতে লাগিলেন সারা গ্রামময়।
 সাধু উপদেশ কভু বিফলে না যায়,
পরিশ্রমে হয় সিদ্ধি সর্ব্বত্র নিশ্চয়।

দেবব্রত যত্নে হ’ল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত
বিদ্যালয়,আর,যৌথ বিপনি সকল।
পথ,ঘাট,জলাশয় হ’ল পরিস্কৃত।
গৃহস্থ রোপিল যত্নে গৃহের প্রাঙ্গণে
শেফালিকা,সূর্য্যমুখী,তুলসীর গাছ,
নিম,নিসিন্দাদি,বিল,নানা বৃক্ষ চয়,
পুতি-বাষ্পজ্বর যা’তে হয় নিবারিত,
বাতাস বিশুদ্ধ হয় সকল সময়।
গ্রামে এক ধর্ম্ম-গোলা হইল স্থাপিত,
গ্রামবাসী দিত সবে অংশ মত ধন
সাহায্য পাইবে ব’লে ‘অজন্মার’ দিনে।
শিখিল কৃষক সবে,বীজ-নির্ব্বাচন
কেমনে করিতে হয় করিয়া চয়ন
পুষ্ট পক্ক, শস্যগুলি ক্ষেত্র হ’তে তা’র।
শিখিল তাহারা আব গবাদি পশুর
কেমনে উন্নতি হয়,দুগ্ধ হয় বেশী;
কেমনে করতে হয় সার-সংরক্ষণ;
সেচনের সুব্যবস্থা জলাভাব দিনে;
গভীর কর্ষণে কিবা হয় উপকার,
উৎপাদিকা শক্তি বাড়ে মাঠের আবার
জন্মিলে তাহাতে শস্য বিভিন্ন জাতীয়।
শিখিল তাহারা আর করিতে সকলে

নানাজাতী আলু চাষ, শাক, শব্জী, মূল—
করিত না কেহ যাহা সেখানে কখন,
জ্ঞানের অভাবে আর অন্ধ বিশ্বাসেতে।
শিখিল মৎস্যের চাষ ফল চাষ আর।
এই রূপে নানাবিধ উপদেশ গুণে
শ্রীবৃদ্ধি হইল গ্রামে,উন্নত সকলে।
 বীরেন্দ্র তাহার সব অনুচর সহ
হইল দেবব্রতের উপাসক এবে।
উপদেশ মত তাঁ’র তাহারা সকলে
আগ্রহে হইল ব্রতী দেশের মঙ্গলে।
দেবব্রত রূপে আর চরিত্রের বলে,
বিনয়,সৌজন্য,শিক্ষা,উপদেশে আর,
গ্রামবাসী নর-নারী হইল আকৃষ্ট,
দেবতার মত তাঁ’রে দেখিতে লাগিল।
 সুশিক্ষার ফল শীঘ্র দেখিতে দেখিতে,
হইল বিস্তৃত গ্রাম হ’তে গ্রামান্তর।
বাড়িতে লাগিল যত কার্য্যের পরিধি
উৎসাহে ভৱিল তত তাদের অন্তর।
 শঙ্কর বিশ্বাস বাবু দেখিল সকল,
শুনিল সকল, এবে হ’ল চমৎকৃত,
নূতন জীবন দেখি সন্তানে তাহার,
যাহার কারণ তিনি ছিলেন শঙ্কিত।

ভাবিলেন মনে মনে, এ নূতন দিনে,
যদি কোন মতে হয় চাতুরী প্রকাশ,
যাহার কৌশলে আজ শ্রীধর ঠাকুর
হইয়াছে সর্ব্বস্বান্ত দেশত্যাগী এবে,
বিপদ ঘটিবে তাঁ’র নাহিক সন্দেহ,
লাঞ্ছিত হ’বেন তিনি দেশবাসী কাছে।
বিশেষতঃ হইয়াছে বয়স তাঁহার।
আজীবন করেছেন ধন উপার্জন,
নানাবিধ অত্যাচারে, অবিচারে আর।
আর ক’টি দিন? কিবা যাবে সঙ্গে তাঁ’র?
ফিরিল তাঁহার মতি। তাই ঠাকুরের
সম্পত্তি ফিরায়ে দিতে করিলেন স্থির।
অনেক ভাবিয়া, শেষে এক দান-পত্র
শ্রীধরের নামে তিনি রাখিলেন লিখে,
শ্রীধরে ফিরা’য়ে দিয়া সমস্ত সম্পত্তি।
 পূর্ণ কীর্ত্তি ইব্রাহিম অন্য দিকে আর,
মাথট করিয়া অর্থ তুলিল অনেক,
শ্রীধরের ভিটাখানি করিতে উদ্ধার।
একদা তাহারা সবে হ’ল উপস্থিত
বিশ্বাস বাবুর গৃহে। বলিল তাঁহারে,
লইয়া তাঁহার প্রাপ্য, দয়া করি দিতে
শ্রীধরের ভিটাখানি ফিরা’য়ে তাঁহারে।

 শঙ্কর প্রস্তুত ছিল এত উদারতা,
এত সমব্যথা,তুল্য উদারতা দিয়া
পরিশোধ দিতে আজ। গাল ভরা হাসি
হাসিয়া তখন তিনি, শ্রীধরের গৃহ
সমস্ত সম্পত্তি সহ, সেই দান পত্র,
বিনা পণে, স্বত্ব ছাড়ি দিলেন তাঁ’দের।
উঠিল তখন মহা জয় জয় কার,
ছুটিল আনন্দ রোল গ্রামের ভিতর।
 যথাকালে সবে মিলে মহা সমারোহে
শ্রীধর ঠাকুরে পুনঃ ফিরায়ে আনিল,
সমস্ত মাথট লব্ধ অর্থ দিয়া তাঁ’রে,
তাঁহাকে তাঁহারি গৃহে স্থাপিত করিল।
 লোকনাথপুর গ্রামে একদা হইল
এক মহাসভা, বিক্রয় লইয়া ‘পাট’।
‘দালাল’,‘ব্যাপারি' আর ‘আড়তের’,
প্রবঞ্চনা হ’তে কিসে বাঁচিবে কৃষক,
এ বিষয় ল’য়ে তর্ক হইল অনেক।
বহু গ্রাম হ’তে এল প্রতিনিধি কত।
যদিও হইল সেথা দীর্ঘ আলোচনা,
নিরীহ কৃষক কুল, কোন প্রতিকার
দেখিলনা তা’র। শেষে সবে এক বাক্যে
করিল সিদ্ধান্ত এই, পাঠাইবে তা’রা,

দেবব্রতে কলিকাতা, করিয়া তা’দের
একমাত্র প্রতিনিধি, বিক্রয় করিতে
তাদের সমস্ত ‘পাট’। উচ্চ হারে দিবে
তাঁহাকে সকলে বৃত্তি। লোকনাথপুর,
যেহেতু অদূরে এক খাল প্রবাহিত,
হইবে প্রধান স্থান। সেখানে সকলে
আনি দিবে নিজ পাট, মিটিবে ঝঞ্ঝাট।
 লইয়া দায়িত্ব গুরু দেবব্রত এবে
গেল কলিকাতা। ঈশ্বরের দয়া,আর
সাহসে নিজের,শুধু করিয়া নির্ভর,
এ কঠিন পরীক্ষায় হ’ল অগ্রসর।