ইন্দুমতী/তীর্থে

উইকিসংকলন থেকে
নবম সর্গ।
তীর্থে।

যথাযথ আয়োজন করিয়া তাঁহারা,
শুভদিনে হইলেন বাহির সকলে
তীর্থ পর্য্যটনে এবে। ছাড়ি অন্তঃপুর,
ছাড়িয়া জনতা পূর্ণ মানব সংসার,
সকলি কৃত্রিম যথা পূর্ণ ছলনায়,
আসিলেন তাঁ’রা আজ প্রকৃতির কোলে।
দেখিলেন মুগ্ধনেত্রে বিমুক্ত প্রান্তর,
যোজন ব্যাপিয়া আছে যোজনের পর,
হরিৎ বরণে ঢাকা দিগন্তে বিস্তৃত,
ঊর্দ্ধে তা’র রহিয়াছে চির বিরাজিত
অনন্ত,উদার ওই নীল নভঃস্থল!
অসংখ্য তালের বৃক্ষ র’য়েছে কোথায়,
কোথায় রয়েছে কত সুন্দর উদ্যান,
কত শত পল্লীগ্রাম,নগর নগরী,
কত নদ নদী,কত গভীর তড়াগ,
কত শত খাল বিল, কত প্রস্রবণ,
অধিত্যকা, উপত্যকা বন্ধুর প্রদেশ!

কত নর নারী কত বালক বালিকা,
মানব জীবন তা’র কত বিচিত্রতা,
সংসার সংগ্রামে কত নিদারুণ ক্লেশ!
দেখিলেন দূরে ওই গগনের গায়,
মেঘ রেখা মত যেন গিয়াছে চলিয়া
কুয়াসা আবৃত সদা পর্ব্বতের শ্রেণী।
ধূম রেখা মত কিম্বা দীর্ঘ বনভূমি।
দেখিলেন তাঁ’রা,কত পথের পার্শ্বেতে
ফল-ফুলে সুশোভিত নিবিড় কানন,
বিশাল বিটপীচয়,কত যুগ হ’তে,
অতীত ঘটনা কত নীরব ভাষায়,
চিন্তাপূর্ণ পান্থজনে কহি সবিস্তারে
রয়েছে দাঁড়ায়ে। কুসুম রতন পূর্ণ
কোমল ব্রততী কত, রূপে আলো করি,
দুলিছে জড়ায়ে গাছে। দেখিলেন আর
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অনন্ত ভাণ্ডার,
মানবের বল,বুদ্ধি,শিল্প পরিচয়,
বিজ্ঞানের অধিকার প্রকৃতি উপরে,
শিল্পের আদর্শ আর বাষ্পীয় শকটে।
 অনন্তের অংশ এই মানবের মন,
অনন্ত সংসর্গে সদা চাহে থাকিবারে।
কক্ষ কিম্বা সমাজের কোন সঙ্কীর্ণতা

লাগেনা তাহার ভাল। সম্পূর্ণ বিকাশ
হয় না ইহাতে তা’র, যতনে রোপিতা
গৃহের ছায়ায় যথা সুকোমলা লতা।
প্রকৃতির মুক্তপথে রাখিলে তাহারে,
সিঞ্চিত হইলে তাঁ’র করুণার ধারা,
কঠোর,কোমল আর শাসনে তাঁহার,
মানবের মন হয় অশেষ উন্নত।
ক্ষুদ্রতা থাকে না আর নীচতা তাহার।
প্রকৃতির বিশালতা দেখিলে সতত—
দাঁড়া’য়ে নির্জ্জন ওই সমুদ্র সৈকতে,
চাহিয়া দেখিলে তা’র নীল বারি রাশি,
যতদূর দেখা যায় রয়েছে বিস্তৃত,
সদাই উচ্ছ্বাস পূর্ণ ভাব পূর্ণ আর,
দেখিলে তাহার সেই গম্ভীর প্রকৃতি,
ভৈরব কল্লোল সদা শুনিলে তাহার
মানব বুঝিতে পারে ক্ষুদ্রতা আপন।
দাঁড়াইয়া কিম্বা ওই প্রান্তর উপর,
দেখিলে দিগন্ত কোলে তাহার বিস্তৃতি,
কিম্বা ওই শৈল-শিরে উঠিয়া দেখিলে
প্রকৃতির মহা দেহ,সৌন্দর্য্য অপার;
বিমুক্ত নির্ম্মল বায়ু করিলে সেবন,
অনন্ত প্রকৃতি সাথে মিশি ক্ষুদ্র মন—

হয় অনন্ত উদার,শিখে সরলতা,
মানবের সঙ্কীর্ণতা থাকেনা কখন।
প্রকৃতির বিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা স্থান।
 একে একে কত দেশ,কত তীর্থ স্থান,
করিল ভ্রমণ তা’রা। জল বায়ু আর,
প্রকৃতি প্রভেদে কত হয়েছে প্রভেদ
সে সব স্থানের, আর সে দেশ বাসীর,
রীতি নীতি,বেশ ভূষা,তাহাদের ভাষা,
সমাজ,স্বভাব,আর আহার বিহার,
গৃহ আর গৃহস্থলী,দেখিল তাহারা।
স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত অতীতের স্মৃতি,
অতীতের কথা,কত পুরাণ রহস্য,
ধর্ম্মের রহস্য কত,কত উপকথা
জড়িত রয়েছে কত বনে উপবনে,
শৈলের শিখর দেশে,ভূধরের গায়,
প্রান্তর মাঝারে,আর নদীর সৈকতে,
নির্জ্জন প্রদেশে,আর জনপূর্ণ স্থানে,
প্রাসাদে,কুটিরে,কিম্বা বৃক্ষের তলায়,
দেখিল শুনিল তা’রা এই সমুদয়!
কত নর নারী এই সংসারের হাটে,
সাধু সদাশয়,কত পথিক,সন্ন্যাসী,
দেখিলেন ইন্দুমতী চাহিয়া চাহিয়া,

দেবব্রত কিন্তু হায়! মিলিল না তাঁ’র।
 সমতল ক্ষেত্র ছাড়ি পার্ব্বত্য প্রদেশে,
চাহিলেন ইন্দুমতী যাইতে এক্ষণে।
লোক কোলাহল পূর্ণ জনপদ আর
লাগেনা তাঁহার ভাল। সকলে তখন,
হিমাদ্রি শিখর দেশে পবিত্র কঙ্খলে,
সত্যযুগে যেথা দক্ষ করিলেন যজ্ঞ,
শিব বিনা ত্রিজগৎ করি নিমন্ত্রণ,
পতি নিন্দা শুনি যেথা দক্ষ-রাজ সুতা
করিলেন দেহ ত্যাগ,সেই সতী তীর্থ
পবিত্র কঙ্খলে সবে করিল গমন,
হরিদ্ধারে রহিলেন কিছু দিন তরে।