ইন্দুমতী/সন্ন্যাসী সাক্ষাতে

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় খণ্ড।

দেবব্রত

প্রথম সর্গ।
সন্ন্যাসী—সাক্ষাতে।

এ দিকে পাইয়া রক্ষা ধীবর যতনে,
ধীবরের গৃহে তিনি থাকি কিছু দিন,
দেবব্রত করিলেন কতই সন্ধান
ইন্দুর উদ্দেশে সেথা,প্রতি গ্রামে গ্রামে,
নদীর উভয় কূলে। নিরাশ হইয়া,
ধীবর নিকটে তিনি লইয়া বিদায়,
চলিয়া গেলেন শেষে ভাগ্য পরীক্ষায়।
বিষাদ কাতর চিতে চলিলেন তিনি,
কোথায়,নাহিক লক্ষ্য সে দিকে তাঁহার,
যে দিকে নয়ন যায় যান সেই দিকে।
অতীত মধ্যাহ্নকাল। শারদীয় রবি
বর্ষিছে সুতীব্রকর। পিপাসা ক্ষুধায়
কাতর হইয়া তিনি,বটবৃক্ষতলে
গন্তব্য পথের ধারে বসিলেন একা।
শীতল ছায়ায় বসি ডালে কত পাখী,
কাকলি করিছে কিবা মনের আনন্দে।
যোজন ব্যাপিয়া তাঁ’র দুই পার্শ্বে মাঠ,

শ্যামল ধান্যেতে পূর্ন,অতি মনোহর।
পবন হিল্লোলে কভু দুলিছে সুন্দর,
সুনীল বারিধি কোলে বীচিমালা মত।
মনে হয় যেন কেহ মখমল দিয়া
মুড়িয়া দিয়াছে সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তর।
প্রান্তরের মাঝে মাঝে,দূরে,বহু দূরে,
রহিয়াছে কত গ্রাম নেত্র তৃপ্তিকর।
চারিদিকে কত শত বৃক্ষেতে বেষ্টিত,
সমুজ্জ্বল পত্ররাজি রবির কিরণে।
 বৃক্ষের তলায় বসি জীবন কাহিনী
করিতে করিতে চিন্তা,এল তন্দ্রা ধীরে
নয়ন যুগলে তাঁ’র। পড়িলেন শুয়ে।
শান্তিময়ী নিদ্রাদেবী হরিল চেতনা।
 কতক্ষণ এই রূপে ঘুমায়ে সেখানে,
উঠিলেন জাগি, কা’র কোমল পরশে?
চাহিয়া দেখেন তিনি আছেন শায়িত
অপূর্ব মূরতি এক সন্ন্যাসীর ক্রোড়ে।
ভাবিলেন এও বুঝি স্বপ্ন-প্রতারণা।
উঠিয়া বসিয়া তাই মুছিয়া নয়ন,
চাহিলেন সন্ন্যাসীর মুখ পানে পুনঃ।
কি সুন্দর মুখ তাঁ’র! কি বাৎসল্য ভাব!
চিন্তাপূর্ণ নেত্রযুগ,উন্নত ললাট,

দীর্ঘ জটাজালে তাঁ’র বেষ্টিত মস্তক,
বিভূতি চর্চ্চিত কিবা সুবিশাল দেহ,
বাঘাম্বর,কণ্ঠে দোলে রুদ্রাক্ষের মালা।
 দেবব্রত তাড়াতাড়ি উঠিয়া তখনি
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি লয়ে পদধূলি
ভক্তিভরে কহিলেন “কে দেব আপনি,
কৃপাকরি দরশন দিলেন আমারে?”
 ঈষৎ হাসিয়া তবে কহিল সন্ন্যাসী——
“তিষ্ঠ বৎস! শুন আমি সামান্য মানব।
আসিয়া বৃক্ষের তলে দেখিলাম তুমি
নিদ্রায় বিভোর;এক মহাকালসর্প
রয়েছে মস্তক পাশে বিস্তারিয়া ফণা।
কমণ্ডলু হ’তে জল করিলে প্রক্ষেপ
পলা’ল বিবরে সর্প। ধূলায় লুণ্ঠিত
দেখিয়া মস্তক তব,লইনু তুলিয়া
নিদ্রার সুবিধা হেতু,অঙ্কে আপনার।
এখন আমার কার্য্য হইয়াছে শেষ
চলিলাম আমি এবে।”
   দেবব্রত তবে
গলদশ্রু নেত্রে তাঁ’র ধরিল চরণ,
জিজ্ঞাসা উদ্দেশে কিছু। সন্ন্যাসী কহিল—
“বুঝিয়াছি বৎস এবে তব অভিপ্রায়,

শুধাবার নাহি প্রয়োজন। শুন বলি—
জীবিতা তোমার জায়া,মহাপুণ্যবতী
মহিলা আশ্রয়ে এক আছেন কুশলে।
কোন অমঙ্গল তাঁর হবে না নিশ্চয়,
কোন অমঙ্গল বৎস হবে না তোমার।
আজি হ’তে পূর্ণ তিন বৎসরের শেষে
হইবে মিলন পুনঃ। এই তিন বর্ষে,
ভীষণ পরীক্ষা হ’বে জীবনে তোমার।
পাইবে প্রচুর অর্থ দেবতা কৃপায়।
কিন্তু সাবধান, ধর্ম্ম আর নীতি পথ,
যাহাতে রয়েছে এই বিশ্ব চরাচর,
ভুলনা কখন তাহা। রাখিবে চরিত্র
নির্ম্মল পবিত্র সদা। নাহি অন্যবল
চরিত্র বলের শ্রেষ্ঠ। পরহিত ব্রত
করিবে সতত, স্বার্থ করি বিসর্জ্জন।
কায়মনোবাক্যে সদা ডাকিবে ঈশ্বরে,
পাইবে অনন্ত শক্তি ডাকিলে তাঁহারে
 “আমার সাক্ষাৎ? অবশ্য পাইবে পুনঃ
সময় অন্তরে তুমি। ক্ষুধায় তৃষ্ণায়
কাতর হ’য়েছ এবে। অদূরে পল্লীতে
যাও, লও গে আশ্রয়।”
   এই কথা বলি

উঠিয়া তখনি তিনি,অঙ্গুলি নির্দ্দেশে
আসিতে নিষেধ করি,গেলেন চলিয়া।
বিমুগ্ধ যুবক শুধু রহিল চাহিয়া।
 শিহরিল দেবব্রত। ছলনা করিয়া,
দেবতা তাঁহারে একি দিল দরশন,
নির্জ্জন বৃক্ষের তলে মধ্যাহ্ন সময়ে?
মানবে কি পারে কভু বলিতে এমন,
অব্যক্ত মনের কথা,চিন্তার বিষয়?
জীবনের পুরোভাগে পটের আড়ালে,
সত্যই কি এত সুখ আছে লুক্কাইত?
নিশ্চয় দেবতা বাক্যে নাহিক সংশয়।
 আশায় বাঁধিয়া বুক উঠি দেবব্রত,
চলিল অদূরে এক পল্লী অভিমুখে।
পল্লীর পথেতে এক দীর্ঘ সরোবর।
সুনীল শীতল জলে প্রস্ফুটিত তা’র
কুমুদ কহলার কত। উচ্চ পাড়ে তা’র
রহিয়াছে চারিদিকে ফল ফুল গাছ,
শ্রেণীবদ্ধ সুশোভিত। ইষ্টক সোপান
আছে দুই পাড়ে।বেলার আধিক্য হেতু
স্নানার্থী বিরল ঘাটে, স্থান শান্তিময়।
 বৃক্ষের ছায়ায় এক বসি দেবব্রত
কি করিবে এবে তাহা লাগিল ভাবিতে।

স্নান করি গেল লোক পার্শ্ব দিয়া তাঁ’র,
শুধা’লনা কেহ তাঁ’রে পরিচয় কোন।
একটী ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ,অঙ্গুষ্ঠে জড়িত
গলদেশ হ’তে শুভ্র উপবীত তাঁ’র,
অনুচ্চ স্বরেতে মন্ত্র পড়িতে পড়িতে,
স্নানান্তে উঠিয়া তাঁরে দেখি দেবব্রতে,
শুধা’লেন পরিচয়। “বিপন্ন পথিক”
শুনিয়া যতনে ধরি দেবব্রত হাত,
লইয়া গেলেন তাঁ’রে আপনি আলয়ে।