ইয়ুরোপে তিন বৎসর/২

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়।

লণ্ডন নগর; ১৮১৮ সালের এপ্রেল হইতে ১৮৬৯ সালের জুলাই পর্য্যন্ত।

 ৯ই জুন দিবাভাগে লণ্ডন নগরের কিয়দ্দূরে সিডেনহেম প্রদেশের বিখ্যাত কাচের প্রাসাদ সন্দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। উহা অতি বৃহৎ প্রকাণ্ড অট্টালিকা, পাতলা লৌহখণ্ডের গরাদিয়া দ্বারা সংযুক্ত চিক্কণ কাচখণ্ডে নির্ম্মিত। মধ্যদেশে একটা একাণ্ড খিলান ও তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটা দালান আছে। সূর্য্যকিরণে যখন উহা ঝক্‌মক্ করিতে থাকে, তখন উহার দর্শন অতি চমৎকার। উক্ত প্রাসাদের বাহিরে সুন্দর উপবন, দুর্ব্বাদল আচ্ছাদিত ক্ষেত্র, প্রস্তরখণ্ড-বিনির্ম্মিত পদবী, ও জ্যামিতির আকারের ন্যায় অতি সুন্দররূপে নির্ম্মিত ফুলের চৌকা আছে। জলস্তম্ভ সমুদয় সূর্যকিরণে খেলা ও ঝক্‌মক্ করিতেছে, নরহস্ত-খাদিত সরসী-জলে পক্ষী সকল সন্তরণ করিতেছে, সুদর্শন বনমধ্যে শীতল ও নিভৃত পদবী সমস্ত বিরাজ করিতেছে, সুগঠন প্রস্তর-মূর্ত্তি সকল ইতস্ততঃ শোভা করিতেছে। ফলতঃ যে যে দ্রব্য কল্পনাশক্তি কি শিল্পবিদ্যা দ্বারা সৃজিত হইতে পারে, তৎসমুদয়ই এই স্থানের শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। সতেজ লতা সমুদয় এই প্রাসাদের কাচময় প্রাচীরে উঠিয়াছে। অভ্যন্তরের যে দর্শন, তাহা আরো চমৎকার। উহার এক পার্শ্ব হইতে অপর পার্শ্ব পর্য্যন্ত একটা সুদীর্ঘ পথ আছে, শ্রেণীবদ্ধ প্রস্তুর-মূর্ত্তি তদুভয় দিকে রহিয়াছে, আর সতেজ লতা সমুদয় ছাদ হইতে নামিয়া নানা আকারে লৌহস্তম্ভ সকলে আশ্লিষ্ট হইয়া আছে, এবং সুন্দর জলস্তম্ভ সমস্ত ইতস্ততঃ বারিবর্ষণ করিতেছে, এবং নির্গত উজ্জ্বল জলরাশি অতিসুশোভন পাত্রে পতিত হইতেছে।

 উহার মধ্যে যেখানে ছবি থাকে, তথায় বিক্রয়ার্থ নানাবিধ চিত্রপট ও প্রসিদ্ধ লোকের মূর্ত্তি সকল আছে। কিয়ৎক্ষণ সেই রমণীয় উপবনে ভ্রমণ করিয়া আমরা একখান নৌকা লইলাম, এবং নিবিড় অন্ধকার হওয়া পর্য্যন্ত আমরা সরোবরে নৌকা বাহিতে লাগিলাম। রাত্রি অধিক হইলে পুনরায় লণ্ডনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

 * * * * * *

 নেপোলিয়ন বোনাপার্টি কহিয়াছিলেন যে, ইংরাজ জাতি কেবল দোকানদার। তিনি একথা বলিতেও পারিতেন যে, উহারা কেবল বিজ্ঞাপনদার। এদেশের লোক যে কি বিজ্ঞাপনপ্রিয়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। যে স্থানে স্থলবিন্দু পায়, সেইখানে বিজ্ঞাপনপত্র সকল প্রদর্শিত হয়। রেলওয়ে ষ্টেশনে আর স্থান থাকে না, তথাপি লোকে সন্তুষ্ট নহে। তাহারা বেতন দিয়া লোক নিযুক্ত করে ও তাহার সম্মুখে ও পশ্চাতে বিজ্ঞাপনপত্র ঝুলাইয়া দিয়া নগর মধ্যে ভ্রমণ করিতে পাঠাইয়া দেয়। আহা! বাহকগণের কি সুখের চাকরী!!

 * * * * * *

 লণ্ডন নগরের পথে কতই চাতুরী ও প্রবঞ্চনার ব্যাপার দেখিতে পাওয়া যায়। একদা সন্ধ্যার সময়ে এক জন চীৎকার করিয়া কহিতেছে যে, পারিস নগর হইতে তারে এক ভয়ানক সংবাদ আসিয়াছে, সম্রাট নেপোলিয়ান দস্যুর হস্তে নিহত হইয়াছেন। আমরা ঐ সংবাদপত্র ক্রয় করিলাম; কিন্তু তাহাতে উক্ত সম্রাটের মৃত্যুর বিষয় কিছুই দেখিতে পাইলাম না। এইরূপে ইহারা অকর্মণ্য সংবাদপত্র ও মিথ্যা বাক্য বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেছে। এই সমস্ত প্রবঞ্চনার কার্য্য দিবা দ্বিপ্রহরে হয় না, কুহাবৃত সায়ংকালে কখন কখন হইয়া থাকে।

 * * * * * *

 ৮ই নবেম্বর প্রাতে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া দেখি, কি পথ, কি অট্টালিকা, কি উপবন, কি পাদপশ্রেণী, সকলই তুষারে আবৃত। বোধ হইল যেন, সকল পদার্থ রৌপ্যমণ্ডিত হইয়া রহিয়াছে। আমার পক্ষে ইহা এক অপূর্ব্বদর্শন সন্দেহ নাই।

 * * * * * *

 ইংলণ্ডের রাজকার্য্য সমাধার নিমিত্ত পার্লেমেণ্ট নামে এক সভা আছে। সেই সভার সভ্যেরা ৫।৭ বৎসর অন্তর বদল হয়। দেশের ভদ্রাভদ্র সকল লোক একত্রিত হইয়া, কাহাকে কাহাকে সভ্য করিলে দেশের হিত সাধন হইবে, এই বিবেচনা করিয়া ৫। ৭ বৎসর অন্তর এক একবার সভ্য নিরূপণ করে। এই সভ্য নির্ব্বাচনের নাম ইলেক্‌সন। বিগত পক্ষে অর্থাৎ নবেম্বর মাসের ৫ হইতে ২০ দিবস পর্য্যন্ত লণ্ডন নগরীতে ও সমগ্র বৃটিশ দ্বীপে পার্লেমেণ্টের সভ্য মনোনীত করণোপলক্ষে অতিশয় ঔৎসুক্য লক্ষিত হইয়াছিল, এবং সভ্য নির্ব্বাচনের দিনে লণ্ডন নগরে যে ব্যস্তসমস্ততা দেখিলাম তাহা অনির্ব্বচনীয় ও অবিশ্বাস্য। স্থানে স্থানে পথে পথে কতই ঘর নির্ম্মিত হইয়াছে; তথায় বহুলোক একত্রিত হইয়া আপন আপন মত প্রকাশ করিতেছে। পথে লোকারণ্য; সকলেই একত্রিত হইয়াছে—সকলেরই মুখে কেবল সেই সম্বন্ধীয় কথা। পার্লেমেণ্টের সভ্যপদপ্রার্থিগণ এখান হইতে ওখানে, এ ঘর হইতে ও ঘরে, অতিশয় চঞ্চলতা ও ব্যগ্রতা সহকারে যাতায়াত করিতেছে। ইলেক্‌সনের দিবস যত অবসান হইতে লাগিল, ততই সাধারণ লোকে, সন্ধ্যাকালে যাহা ঘটনা হইবে, তাহা অনুভব করিতে সমর্থ হইল; কেন না কোন্ প্রার্থীর জন্য কত লোকে সম্মত হইতেছে, তাহা প্রতি ঘণ্টায় শত শত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়া সাধারণের দুর্নিবার চিন্তা দূর করিতে লাগিল। পার্লেমেণ্টের সভ্যেরা ও দেশের সমস্ত লোক দুই দলে বিভক্ত। যাহারা দেশের পুরাতন রীতিনীতিতে আসক্ত, তাহাদিগকে কন্‌সরবেটিব্ বলে, ও যাহারা পরিবর্ত্তনে তৎপর তাহাদিগকে লিবরেল কহে। যদি কোন লিবরেল-প্রার্থীর অনুকূলে অধিকসংখ্যক মত দেওয়া সম্ভব বোধ হয়, তবে লিবরেল-প্রজাদিগের আহ্লাদ আমোদ এবং জাঁকের আর পরিসীমা থাকে না। যদি কোন কন্‌সরবেটিবের তদপেক্ষা অধিক মত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ পায়, তবে কন্‌সরবেটিবেরা তাদৃশ আমোদিত ও উৎসাহিত হয়। ইংরাজমাত্রেই রাজ্যতন্ত্রে ও দেশের রাজকার্য্যে অত্যন্ত মনোযোগ দেন এবং যে,যে পরিমাণে কন্‌সরবেটিব বা লিবরেল, সে সেই পরিমাণে কন্‌সরবেটিব বা লিবারেলকে পার্লেমেণ্টে অধিষ্ঠিত করাইতে চাহে। বিলক্ষণ চিন্তা করিয়া দেখিলে এরূপ মনোযোগের এক অতি নিগূঢ় অর্থ আছে। এদেশের প্রত্যেক লোকেই আপনাকে জনসমাজের এক জন বলিয়া জ্ঞান করে, স্বজাতির অভিমানে অভিমান ও স্বদেশের সৌভাগ্যে স্বীয় সৌভাগ্য বোধ করে, এবং তন্নিবন্ধন কিসে স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি হয়, তৎপ্রতি একদৃষ্টে লক্ষ্য করিয়া থাকে। যদি এরূপ কোন আইন প্রচলিত হয়, যদ্দারা কোন সম্প্রদায়র মতে দেশের অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা, তবে সেই সম্প্রদায়ের ইংরাজেরা তাহা নিজের অমঙ্গলের ন্যায় জ্ঞান করে। দেশের অভ্যুদয়সাধন কিসে হইবে, তৎসম্বন্ধে সকল ইংরাজেই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র মতাবলম্বন করে। এবং যদি কাহারও মতে কন্‌সরবেটিব কি লিবরলের দ্বারা সেই মনোভীষ্ট সাধিত হইবে বোধ হয়, তবে তিনি সেই পক্ষ অবলম্বন করেন। সুতরাং সকল ইংরাজই রাজনীতিজ্ঞ, এবং পার্লেমেণ্টে কিরূপ কার্য্য হয়, তৎপ্রতি একাগ্রচিত্তে মনোভিনিবেশ করিয়া থাকে। অতি সামান্য লোককেও জিজ্ঞাসা করিলে সেঠিক বলিয়া দিবে যে দেশীয় ঋণ কত; কাহার কর্ত্তক পার্লেমেটে কোন আইনের প্রস্তাব হইয়াছিল, এবং সংপ্রতি কোন্ আইনের কি কি দোষ গুণ আছে। ইংরাজেরা যখন স্বদেশের কোন প্রকার উৎকর্ষ সাধন করিতে ইচ্ছুক হয়, তখন তাহারা কতকগুলি লোক একত্র হইয়া সভা করে, বক্তৃতা করে, পুস্তক ছাপায়, সংবাদপত্র লেখে, এবং আপনাদিগের মতের পোষক পুস্তক সকল প্রকাশ করে। এবম্প্রকারে তাহারা সকল সম্প্রদায়ের লোককে স্বীয় মতাবলম্বী করিতে চেষ্টা করে। এই দলস্থ লোকেরা যদি বিলক্ষণ সবল হয়, তবে তাহারা পার্লেমেণ্টে আবেদন করে এবং যদি উক্ত সভার কোন সভ্য তাহাদিগের একমতাবলম্বী হয়েন, তবে তাঁহার দ্বারা তথায় নূতন ব্যবস্থার প্রস্তাব করায়। এরূপও ঘটিয়া থাকে যে, সেই প্রস্তাব প্রথম, দ্বিতীয় কি তৃতীয় বারেও অগ্রাহ্য হইয়া যায়; কিন্তু তাহাতে ভগ্নচিত্ত হওয়া দুরে থাকুক, তাহারা এরূপ সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায় সহকারে মনোথসিদ্ধি করিতে তৎপর থাকে যে, তাহা অনুভব করা অতীব দুঃসাধ্য। তাহাদিগের মনে এই বিশ্বাস যে, সাধারণের মতই স্বদেশের আইন, এবং যদি সাধারণ লোকে তাহাদিগের মতাবলম্বী হয় ও যত্ন প্রকাশ করে, তবে নিশ্চয়ই তাহাদিগের চেষ্টা ফলবতী হইবে। কিন্তু যদি তাহার বিপরীত ভাব লক্ষিত হয়, তবে তাহারা অগত্যা বিরত ও নিরস্ত হইয়া থাকে। এই প্রকারের সভা ইংলণ্ডদেশে যে কতই আছে, তহা গণনা করা দুঃসাধ্য, এবং তত্তাবতেই কীদৃশ সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায়ের সহিত কার্য্য করে, তাহা চিন্তা করিলে চমৎকৃত হইতে হয়। কখন এরূপও ঘটে যে, পূর্ব্ব পুরুষেরা যে কোন বিষয়ে লিপ্ত হইয়াছিল, কিন্তু চরিতার্থতা লাভ করিতে পারে নাই, পরপুরুষেরা সেই বিষয়ে মনোযোগ করে, ও লোকের মনোহরণ করিতে শিথিলপ্রযত্ন হয় না। ইংলণ্ডে প্রজার অভিমতই তাইন, এবং প্রজার মতদ্বারাই দেশ শাসিত হয়। মহারাণীর সাধ্য নাই, মহৎ লোকদিগের সাধ্য নাই যে, প্রজার মতের বিপরীত কার্য্য করেন। যদি পার্লেমেণ্টের সভ্যেরা বিরুদ্ধাচার করিতে চাহে, তবে আগামী ইলেক্‌শনের সময় প্রজাগণের মতাবলম্বী সভ্যদিগকে মনোনীত করিয়া বিপরীতাচারী সভ্য মুদয়কে দূরীভূত করিয়া দেয়। ইংলণ্ডীয় রাজতন্ত্রের এইরূপ অবস্থা, এবং এখানে প্রজাগণই দেশ শাসন করিয়া থাকে। অতএব বিচিত্র কি যে ধরাতলে তাহারা আমেরিকা ব্যতীত সর্ব্বদেশাপেক্ষা সমধিক পরিমাণে স্বাধীনতা-সুখ সম্ভোগ করে।

 * * * * * *

 অদ্য (২৫ শে ডিসেম্বর) সুখের বড়দিন ইংলণ্ডকে প্রমোদিত করিতে সমাগত হইয়াছে, এবং প্রাতে গিরিজাঘর হইতে নিঃসারিত উচ্চ ঘণ্টা-রব সর্ব্বত্রই প্রতিধ্বনিত হইতেছে। আমাদিগের দেশে পর্ব্বাহে যেরূপ হইয়া থাকে,এখানে তদ্রূপ হয় না। পথে লােক কি শব্দ মাত্র নাই, আপণ ও কার্য্যালয় সমুদয়ই বন্ধ, এবং চারিদিকে সকলই নিস্তব্ধ; কিন্তু যদি বড়দিনের প্রকৃত মূর্ত্তি সন্দর্শন করিতে ইচ্ছা করেন, তবে যদৃচ্ছা এক গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করুন, এবং তথায় কি হইতেছে তাহা দেখুন। তথায় পরিবারের সমস্ত লােকে একত্র হইয়া কত রঙ্গে আমােদ প্রমােদ করে।

 * * * * * *

 সে দিন বরফ পড়িয়াছিল। দেখিলাম কার্পাস তূলার ন্যায় সুন্দর তুষারবিন্দু ধীরে ধীরে ধরাতল-অভিমুখে পতিত হইতেছে। অল্পক্ষণ পরে তুষারবৃষ্টি ক্ষান্ত হইলে আমরা তুষারাবৃত পথে ভ্রমণ করিতে নির্গত হইলাম। আমাদিগের দেশে শীত ঋতু যে প্রকার, এখানে সে প্রকার নহে। সেখানে শীত কালে পরিষ্কারাকাশে সুর্য্যোদয় হয়, এখানে দুই কি তিন দিনের মধ্যে নভোমণ্ডলে নিস্তেজ পাণ্ডুবর্ণ ও ঘনাচ্ছাদিত একটি গােলাকার পদার্থ দেখিতে পাইলে সৌভাগ্য জ্ঞান করিতে হয়। সমস্ত দিনই কুজ্‌ঝটিকাময় ও অত্যন্ত শীতল, এবং আমাদিগের দেশের প্রচুর ধারাপাত পরিবর্ত্তে সকল দিন কেবল ছিপ্‌ছিপে গুঁড়ানি বৃষ্টিপাত হইয়া থাকে। যখন অসাধারণ শীতলতার প্রাদুর্ভাব হয়, তখন বারিবর্ষণ না হইয়া তুষারপাত হয়।

 * * * * * *

 অতঃপর আমরা বহুজনাকীর্ণ লণ্ডননগর পরিত্যাগ করিয়া এক পক্ষকাল সসেক্‌স প্রদেশে ইষ্টবোর্‌ণ ও হেষ্টিংস্ নামক সমুদ্রকুলস্থ নগরের দূর্ব্বাদলশোভিত ক্ষেত্রচয় দর্শন এবং পল্লীগ্রামের স্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করিতে মনস্থ করিলাম। ইংলণ্ড দেশীয় সমস্ত সমুদ্রকূলস্থ নগরে যাইবার নির্দ্দিষ্ট সময় আছে, সেই সেই সময়ে লণ্ডন এবং অন্যান্য নগর হইতে ভূরি ভূরি লোক তথায় সমাগত হয়। আর সেই সময় অতীত হইয়া গেলে, সেই সেই স্থান নিস্তব্ধ ও জনশূন্যপ্রায় হইয়া থাকে। ইষ্টবোর্‌ণ সর্ব্বকালেই নিস্তব্ধ, কিন্তু এক্ষণে অধিকতর নিস্তব্ধ, যেহেতু অদ্যাপি তথায় লোকের আসিবার সময় উপস্থিত হয় নাই। আপনাকে এই পত্র লিখিতে লিখিতে সুগভীর নীলোজ্জ্বল সাগরের শোভা-সন্দর্শন, সমুদ্রবারি-সম্পৃক্ত শীতল ও সুখকর বায়ু-সেবন, এবং অনিবার বীচিবাদন-শ্রবণসুখে মগ্ন রহিয়াছি। ফেনময় সাগরের জল উপলকীর্ণ বেলায় প্রতিঘাত হইয়া কখন পরাঙমুখ, কখন উচ্ছ্বসিত, কখন মগ্ন হইতেছে; সমুদ্রের সর্ব্বদাই পরিবর্ত্তন এবং সর্ব্বদাই একরূপ অবস্থা। বহুক্ষণ সমুদ্রের শুভ্র ফেনরাশি সন্দর্শন, কি উহার অবিরল সঙ্গীত-ধ্বনি শ্রবণ করিয়াও কেহ পরিতৃপ্তিলাভ করিতে পারে না; আমিও পারি নাই। গত কল্য ইষ্টবোর্‌ণের দুই ক্রোশ অন্তর বীচিহেড নামক স্থানে অমিরা সমুদ্রপথে গমন করিয়াছিলাম। সমস্ত পথই আমি দাঁড় বাহিয়াছিলাম; বীচিহেড-পর্ব্বত প্রায় ৫৭৫ ফিট্ উচ্চ। প্রখর রবিকরে সন্তাপিত হইয়া দুই ক্রোশ দাঁড় বাহিয়া যাওয়ার পর, তাহাতে আরোহণ করিতে বিলক্ষণ শ্রমানুভব করিয়াছিলাম। কিন্তু যখন তাহার শিখরে উঠিলাম, তখন চতুর্দ্দিকের শোভা সন্দর্শন করিয়া শ্রম সফল জ্ঞান করিলাম। বসন্তকালের নবদূর্ব্দাদল ও পাদপপুঞ্জ-মণ্ডিত ক্ষেত্রে ভ্রমণ, ইংলণ্ডের দক্ষিণপ্রদেশীয় শুভ্র পর্ব্বতে উত্থান, সন্ধ্যাকালে শৈলোপরিস্থ সমীরচালিত কল সকল সন্দর্শন, সরসীজলে ক্রীড়াসক্ত মরালবৃন্দের দর্শন, চাতক পক্ষীর সুমধুর সঙ্গীত শ্রবণ, উপলময় সাগরবেলায় সন্ধ্যাকালে ভ্রমণ এবং সমুদ-তরঙ্গমালার অবিরল ও মনোহর বাদ্য শ্রবণ—এই প্রকার মনোহর কার্য্যে আমরা এক্ষণে কাল হরণ করিতেছি।

 ইষ্টবোর্‌ণের দুই ক্রোশ অন্তরে পেভিন্সি দুর্গের ভগ্নাবশেষ সংলক্ষিত হইল। উহার ছাদশূন্য ও লতামণ্ডিত কলেবর পুরাতন ঐতিহাসিক শোভায় পরিবেষ্টিত আছে, এবং যতকাল উহার শেষ প্রস্তরখণ্ড ধূলিসাৎ না হইবে, ততকাল সেই শোভা স্থায়ী হইবে। এয়ারি নামক সুবিখ্যাত অধ্যাপক বলেন যে, সীজার তাঁহার রোমীয় সৈন্য লইয়া এবং বিজেতা উইলিয়াম তাঁহার নর্ম্মাণ সেনা সমভিব্যাহারে প্রথমতঃ এই স্থানে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। আমরা উহার লতামণ্ডিত প্রাচীরে উঠিলাম, দূর্ব্বাচ্ছাদিত মেঝের উপর বেড়াইলাম, ভগ্ন বাতায়নতলে গেলাম, এবং অন্ধকারময় কারাগার সন্দর্শন করিলাম। যেখানে সেই অসভ্য সময়ে কতই বড় বড় লোক রুদ্ধ হইয়া ক্রমে কালকবলে কবলিত হইয়াছেন, এবং বোধ হয় কত বরাঙ্গনাও কারারুদ্ধ ছিলেন। যথায় কিরীটধারী কত মহোদয় আমোদ প্রমোণ করিয়াছিলেন, যথায় কুলীনপুত্রেরা এবং সম্মানিত সীমন্তিনীগণ লোকের আনন্দবর্দ্ধন করিয়াছিলেন, তথায় এক্ষণে তার কিছুই নাই; কেবল কতকগুলা কাকপক্ষী বাসা করিয়াছে, এবং উৎসধ্বনির পরিবর্ত্তে কেবল ‘কা’ ‘কা’ শব্দ প্রতিধ্বনিত হইতেছে, বোধ হয় যেন তাহার বিগত গৌরবকে চিতাশায়ী করিতে হরি সংকীর্ত্তন করিতেছে।

 পেভেন্সি গ্রামে কতিপয় যৎসামান্য কুটীর, একটা গির্জা এবং একটা পান্থশালা আছে। আমরা যেমন সমুদ্রপথে পেভেন্সি গ্রামে গিয়াছিলাম, তেমনি আবার সমুদ্রপথে তথা হইতে প্রত্যাগত হইলাম; পথিমধ্যে মার্টিলো টাউয়ার্স সন্দর্শন করলাম। ১৮০৪ সালে যখন বোনাপার্টি ইংলণ্ড আক্রমণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন, তৎকালে ইংরাজেরা কেণ্ট ও সসেক্স প্রদেশের দক্ষিণকূলে এই সমস্ত দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিল।

 আপনাকে শেষে যে পত্র লিখিয়াছি, তাহার পর হইতে আমরা রমণীয় ক্ষেত্রে বেড়াইতেছি, উত্তুঙ্গ শৈলে আরোহণ করিতেছি, এবং ভগ্ন দুর্গ সকল দেখিতেছি, কখন যদৃচ্ছা বেড়াইতেছি, কখন নৌকায় দাঁড় বাহিয়া যাইতেছি, কখন পল্লীগ্রামে দিনাতিপাত করিতেছি। সে দিন হর্ষ্টমন্‌সো দুর্গ দেখিতে গিয়াছিলাম। ইংলণ্ডের মধ্যে যত ভগ্ন দুর্গ আছে, তন্মধ্যে ইহা অতীব সুন্দর। মধ্যযুগের ইতিহাসে দুর্গ সমূহের যেরূপ অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, এখানে সেই প্রকারই দৃষ্টিগোচর হইল। সেই সেতু, সেই গড়, সেই মন্দির, সেই প্রহরীর স্থান, সেই ভয়ঙ্কর ভূগর্ভস্থ কারাগার, সেই সেই সমুদায়ই বিদ্যমান রহিয়াছে। আর লতাগুল্‌মাদি তদুপরি উঠিয়া উহাকে একান্ত মনোহর করিয়াছে।

 সেণ্টলিনার্ড স্থানে কতকগুলা গিরিগুহা আছে; বোধ হয় তৎসমুদায় বাসের নিমিত্তে মৃত্তিকার ভিতর হইতে খোদিত হইয়াছিল; কিন্তু তথায় অধুনা আর কেহ বাস করে না। যে বৃদ্ধা স্ত্রী দুই হস্তে দুইটা বাতী লইয়া আমাদিগকে এই দর্শনযোগ্য স্থান দেখাইয়াছিল, তাহার পিতা এই সকল গুহা খোদিত করিয়াছিল। উক্ত স্ত্রীলোক বলিল যে, সে তাহার বাল্যাবধি যৌবনাবস্থা পর্য্যন্ত তথায় অবস্থিতি করিয়াছে।

 * * * * * *

 লণ্ডনে প্রত্যাগত হইয়া সে দিন মেডেম তুশোর দর্শনাগারে গিয়া কতকগুলি মোমের প্রতিমূর্ত্তি সন্দর্শন করিলাম, তাহা দেখিয়া অজ্ঞাত লোকমাত্রেই বোধ করিবে যে, তৎসমুদায় জাবিত স্ত্রী-পুরুষ—মোম নির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি নহে। দর্শনকারীদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকে আমার কতবার মোমের প্রতিমূর্ত্তি জ্ঞান হইয়াছিল। তথায় প্রথম উইলিয়াম হইতে ইংলণ্ডের সমুদায় রাজার, বিখ্যাত গ্রন্থকার ও যাজকগণের প্রতিমূর্ত্তি আছে; যথা সেক্‌সপিয়ার, স্কট, নক্স্, ক্যাল্‌ভিন, স্কট্‌লণ্ডের রাজ্ঞী মেরী বলটেয়ার ইত্যাদি। তাহার এক স্থানে নেপোলিয়ন বোনাপার্টির ও তাহার চতুষ্পার্শ্বে তদীয় প্রসিদ্ধ সেনাধ্যক্ষগণের প্রতিমূর্ত্তি আছে।

 * * * * * *

 ইংলণ্ডের গৌরব-স্তম্ভ-স্বরূপ ওয়েষ্ট্‌মিনিষ্টর আবী নামক পুরাতন অট্টালিকা বিরাজ করিতেছে। তাহার অভ্যন্তরে ইংলণ্ডের সম্রাট্, যোদ্ধা, রাজনীতিজ্ঞ ও প্রাতঃস্মরণীয় কবিকুলের গোর-স্থান ও প্রস্তর-নির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি দেখিয়া যে কি পর্য্যন্ত আনন্দিত হইলাম বলিতে পারি না। যিনিই ইংলণ্ডের ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন বা ইংরাজী কাব্যরসে মুগ্ধ হইয়াছেন, তিনিই এই সকল দেখিয়া পরম প্রীতিলাভ করিবেন।

 * * * * * *

 গত রবিবারে নৌকাযোগে টুইকিন হেম নামক স্থানের নীচে দিয়া গেলাম। এই স্থান কবিবর পোপের বাসস্থান ছিল। এই খানে টেম্‌সনদী অতিশয় পরিষ্কার; লণ্ডনের নীচে যেরূপ, এখানে তদ্রূপ নহে। টেম্‌সের উভয় পার্শ্ব বসন্ত ঋতুর সমাগমে তৃণ বৃক্ষাদিদ্বারা পর রমণীয় শোভা ধারণ করিছে। ভারতবর্ষ অপেক্ষা ইংলণ্ডের শীতকাল অতি দীর্ঘ, প্রচণ্ড ও শ্রীহরণকারী। বৎসরের কয়েক মাস কেবলই বৃষ্টি, কুহা, বরফ তুষার, ও মলিন আকাশ দেখিতে পাওয়া যায়। বৃক্ষে পল্লব মাত্র থাকে না, এবং স্বভাবের মূর্ত্তি শ্রীহীন ও মৃতবৎ দেখায়। এইরূপ ভীষণ শীত ঋতু অন্তে বসন্ত যখন উজ্জ্বল আকাশ, উষ্ণকাল, নূতন পল্লব, মনোহর কুসুম, সুন্দর পক্ষী সঙ্গে লইয়া সমাগত হয়, তখন ইংলণ্ডের নিবাসিগণ আহ্লাদিত ও উল্লাসিত হয়। ভারতবর্ষে এই বসন্ত সময়ে উদ্ভিদের প্রাচুর্য্য হয়, সুকণ্ঠ ও সুরূপ নানাবিধ বিহঙ্গমগণ গান করিতে থাকে, আকাশমণ্ডল উজ্জ্বলাভা ধারণ করে; কিন্তু তদ্রূপ ঋতুপরিবর্ত্তনে ভারবর্ষে কিছুরই পরিবর্ত্তন বলিয়া প্রায় বােধ হয় না; যেহেতু তথায় শীতের প্রচণ্ডতা মাত্র নাই, সতত নির্ম্মল আকাশে সূর্য্যোদয় হয়, সকল বৃক্ষের পল্লব পড়িয়া যায় না, এবং নভােমণ্ডল প্রায় মেঘাবৃত হয় না।

 এ সময়ে টেম্‌সনদীর উভয় তটই দূর্ব্বাদলে ও বৃক্ষাদিতে অপূর্ব্ব শােভা ধারণ করিয়াছে। আমরা হেম্প্‌টন-কোর্ট নামক প্রসিদ্ধ স্থানে আসিয়া পৌঁছিলাম। তথাকার রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরস্থ শয্যাগৃহ, সভাগৃহ এবং অনেক সু-চিত্রিত ছবি সন্দর্শন করিলাম। লণ্ডনে পৌঁছিতে রাত্রি অনেক হইয়া গেল।

 * * * * * *

 ইংলণ্ডের মধ্যে যাহারা বিলক্ষণ সুশিক্ষিত, তাহাদিগের চিন্তে খৃষ্টীয় ধর্ম্মের বন্ধন ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতেছে। বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই খৃষ্টধর্ম্মাবলম্বী নহে। তাহাদিগের অবিশ্বাস দিন দিন নীচগামী হইতেছে বোধ হয়, এবং বিদ্বান যুবদল দেশের ধর্ম্মের প্রতি কিছু মাত্র আস্থা প্রকাশ করে না।

 যাহাদিগের ঐ ধর্ম্মে বিশ্বাস আছে, তাহাদিগের মধ্যেও তদ্রূপ ভক্তি শ্রদ্ধা থাকিতে দেখা যায় না। তাহারা বাল্যবধি ঐ ধর্ম্মে বিশ্বাস করিতে শিক্ষিত হইয়াছে, ঐ ধর্ম্ম ধরাতলে প্রায় সর্ব্বত্রই প্রচলিত, এই জন্যই তাহারা বিশ্বাস করে। নচেৎ বিলক্ষণ বিবেচনা ও চিন্তাদ্বারা ঐ ধর্ম্মকে সত্য জ্ঞান করে নাই। পরিবারে উপরােধ করে, এই জন্যই অনেকে গর্জ্জায় যান, তথায় বক্তৃতা শুনিতে হয়, এই জন্য শ্রবণ করেন। গাঢ় ভক্তি অতি অল্পই দেখা যায়।

 কিন্তু পল্লীগ্রামে এরূপ নহে। তথায় সে প্রকার বিদ্যার প্রচার নাই এবং অধিক পরিমাণে ধর্ম্মভীরুতা আছে। গ্রাম্য পুরোহিত একজন প্রধান ব্যক্তি এবং নিজাধিকারের মধ্যে তাঁহার মহা ক্ষমতা। তাঁহার পত্নী যদি ধর্ম্মপরায়ণা ও পরোপকারিণী হন, তবে সচরাচরই গ্রামস্থ লোকের বাটীতে যান এবং যাইয়া বহু পরামর্শ ও সদুপদেশ দেন। তিনি সর্ব্বত্রই আদৃতা। গ্রাম্য স্ত্রীলোক ও বালিকাগণ তাঁহাকে স্নেহের সহিত ভাল বাসে। তাহাদিগের অবকাশকালে তিনি প্রিয়সখী স্থানীয় হন, এবং আপদ বিপদের সময় তাঁহার বাক্য অনির্ব্বচনীয়া সান্ত্বনা বর্ষণ করে, কারণ তাঁহাকে সকলেই দেবতার ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করিয়া থাকে। গ্রাম্য লোকদিগের বাটীতে যাইয়া উপদেশ ও সচ্চরিত দ্বারা তাহাদিগকে কুপথ-গমনে বিরত করিয়া এবং দুঃখের সময় সান্ত্বনা-বারি সেচন করিয়া গ্রাম্য পুরোহিত ও তাঁহার প্রেয়সী উভয়ে যথাসাধ্য পরের উপকার করিয়া থাকেন।