বিষয়বস্তুতে চলুন

উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/উত্তর-পূর্বের লাজুক বাংলা সাহিত্য

উইকিসংকলন থেকে

উত্তর-পূর্বের লাজুক বাংলা সাহিত্য

উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বড়োই জটিল। বেনিয়া বৃটিশ প্রভুত্বের ফাঁসকলে বারবার জড়িয়েছে, কিছু বাংলাভাষী অঞ্চল কিছুতেই ছাড়াতে পারে নি পর-শাসনের নিগড়। বৃটিশ সরকার ব্যবসা আর প্রশাসনের প্রয়োজনে পূর্ব ভারতের বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূগোল বদলেছে স্বেচ্ছাচারে। যেমন অধুনা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে স্বাধীনতার প্রাক্কালে। গণভোট নামক প্রহসনে সিলেট চলে যায় পাকিস্তানে। তার আগেও হয়েছে দেশভাগের আগেও, কখনও সিলেট চট্টগ্রাম নোয়াখালি গোয়ালপাড়া নিয়ে গড়া হয়েছে রেসিডেন্সি। কখনও আবার শুধু সিলেট গোয়ালপাড়া নিয়ে আসাম। তাই উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগকে। জানতে হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কিংবা সাবেক আসাম রাজ্যকে। মুসলিম লিগের বৃহৎ পাকিস্তান পরিকল্পনাকে যদি না পোকায় কাটত তাহলে তো আসামও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ভারত থেকে। তাই নাকের বদলে নরুণ, তৎকালীন আসাম প্রদেশ কংগ্রেস ঘাটতি অর্থনীতির তত্ত্বে গরিব জেলা সিলেটকে ছেঁটে দিয়ে আসামকে সমৃদ্ধ করতে চাইলেন। নাকি বাঙালির সংখ্যাবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে মেনে নিলেন গণভোট। মুসলিম লিগকে প্রশাসনিক মদতে জিতিয়ে দেওয়ার শর্ত নিলেন। বৃটিশের তখন তাড়া, তারা কথা দিয়েছে ১৯৪৮ এর জুনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তাই তাড়াহুড়োর দেশভাগের সঙ্গে গণভোটে সিলেট জেতায় রাজি ছিলেন না রাজরোগাক্রান্ত কয়েদে আজম। মহাত্মাজির বার্ধক্যও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম ছিল সেই মুহূর্তে। সিলেট গণভোট আবার দ্বিখণ্ডিত করে দিল সিলেটের বাঙালিকে। প্রায় আধাআধির হিন্দু বাঙালি পরবাসে চলে এলেন পাশ্ববর্তী কাছাড় জেলায় এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। সিলেট গণভোট থেকে আসাম নামক রাজনৈতিক ভূভাগের বসতকারদের যন্ত্রণার শুরু। পরবর্তী কালের বঙ্গাল খেদা বিদেশি হঠাও আলফা আন্দোলনের বিষ বীজ রোপিত হয়। সিলেট পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় সংলগ্ন যে অংশটা থেকে গেল আসাম ত্রিপুরার গায়ে সেই অংশটা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল রাষ্ট্রসীমা থেকে। আবার রাতারাতি হাইলাকান্দি পাথারকান্দি এবং করিমগঞ্জ মহকুমার অর্দ্ধেক ফিরিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপুরা রাজ্যের বন্দীদশা মুক্ত করতে। একটি জটিল ভূগোলের অঙ্ক কষতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল উত্তর পূর্ব ভারতের বাঙালি। শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরা ছিটমহল না হলেও তিনদিকে বিদেশ বাংলাদেশ ঘেরা আংশিক বন্দীত্ব আর ঘুচল না। দেশ ভাগের আগে ত্রিপুরা ও বরাক উপত্যকার যাতায়াত ছিল সহজ। পূর্ব বাংলার ভিতর দিয়ে স্থলপথ ও জলপথের অবাধ যাতায়াত। জোড়াতালি দেওয়া সীমানা পেরিয়ে প্রথমে হিন্দু শরণার্থীর ঢল নামল ত্রিপুরায় বরাক উপত্যকায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। যাঁরা থাকলেন ওপারের স্বপ্নের দেশে, মূলত মুসলমান কৃষক জনগোষ্ঠী, তাঁরাও বুঝলেন মুসলিম লিগের আশ্বাসের অসারতা, তাঁরাও সীমান্ত পেরিয়ে চলে এলেন ব্রহ্মপুত্র পারের উর্বর অববাহিকায়। হয়তো একটা সংগঠিত চাতুর্য কাজ করেছিল তাঁদের মনে তাই তাঁরা জীবন জীবিকার সুরক্ষায় নাম নিলেন অসমিয়া, বাঙালি পরিচয় ঘুচিয়ে হলেন ন-অসমিয়া বা নতুন অসমিয়া। ইতিমধ্যে আসাম ভেঙে অনেক রাজ্য গঠিত হল, হল স্বশাসিত জেলাও। রাজনৈতিক ভূগোল পোকায় কাটতে কাটতে যখন ছোটো হয়ে এল তখন শুরু হল ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি অসমিয়া, অসমিয়া মাড়োয়ারি বড়ো অবড়ো নেলি গহপুর এবং কে জানে ভবিষ্যতের গর্ভে আরও কী রয়েছে ভয়াবহ। তবে সুখের বিষয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নবীন প্রজন্ম শিখে নিয়েছে প্রতিরোধের পাঠ, তারা ভাবাবেগের সঙ্গে যুক্তিবুদ্ধিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, শান্তিতে বসবাস করার মন্ত্র শিখে নিয়েছে।

 এরকম একটা সিনোপসিস করা যায় উত্তর-পূর্বের। যদিও ভাষা সাহিত্যের কথায় যাওয়ার আগে আরও দু-একটা কথাও প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়। দেশভাগের ইতিহাসে সিলেট রেফারেণ্ডামের উল্লেখ হয়তো থাকে এক লাইনের এবং অবাক করার মতো বিষয় হল তার পরিপ্রেক্ষিত এবং পরবর্তীকালের প্রভাব নিয়েও কোনো সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা ইতিহাসকারও দায়িত্ব নেননি। একমাত্র একজনই বরাক উপত্যকার এক ভুক্তভোগী সমাজতাত্ত্বিক সুজিৎ চৌধুরি বলেছেন, সিলেট গণভোট না হলে আসাম আন্দোলন হওয়ার কোনো কারণ ঘটত না।

 সিলেট তো চলে গেল বাংলাদেশে। শরণার্থী হিন্দুরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে থেকে বরাক উপত্যকায় গড়ে তুললেন এক নতুন সমাজ, নতুন ভাষাও গড়ে উঠল সিলেটি উপভাষা আর তৎকালীন কাছাড় জেলার বাংলা উপভাষার মিশ্রণে। ঠিক একই রকম ত্রিপুরায়ও উপজাতিদের সঙ্গে মিশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা আর সিলেটির মিশ্রণে গড়ে উঠল নতুন উপভাষা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আবার পূর্বোক্ত উপভাষাগুলির সঙ্গে রেলশহরের চট্টগ্রাম নোয়াখালি আর গোয়ালপাড়ার সঙ্গে অসমিয়ার মিশ্রণে তৈরি হল নবীন আর এক ভাষা। দেশভাগের পর শরণার্থীদের মধ্যেও দেখা দিল বর্ণসংকট, জেলাসংকট, উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ জমিদার রায়ত এবং গ্রাম পরিচয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের লড়াই চলতে থাকল। তার উপর অর্থনৈতিক সংকট হয়ে উঠল প্রধান। সব অতীত জমিদারদের শূন্য থেকে শুরু করতে হল জীবন। জীবন ও জীবিকার লড়াই করতে করতে ক্লান্ত নতুন ইহুদির এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেল প্রস্তুতি পর্বে। দেশভাগের চোদ্দবছর পর রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সরকারি উৎসব পর্যন্ত গৌহাটিতেই সীমাবদ্ধ থাকল। এর মধ্যেই আসামের কংগ্রেসি সরকার কুখ্যাত ভাষা আইনের খসড়া পাশ করিয়ে নেয় দলীয় সভায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শিলং বিধানসভায়ও। বরাক উপত্যকা যেহেতু মূলত বাঙালি প্রধান জেলা, আন্দোলন শুরু হয়ে যায় রবীন্দ্র শতবর্ষের মাসেই উনিশে মে ১৯৬১তে। সেদিনই শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে এগারোজন শহিদ হয়ে যান। শহিদের রক্তে বাংলাভাষার সীমিত স্বীকৃতি পাওয়া গেলেও, ভাষিক আগ্রাসন না থামায় দফায় দফায় ভাষা সৈনিক শহিদ হয়েছেন।

 পরিতাপের কথা, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় হয়তো পশ্চিমবঙ্গের এবং সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সাময়িকভাবে সক্রিয় হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদরাও পলিটিক্যালি শুদ্ধ থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিমির ঘোচেনি। এমনকি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সংখ্যালঘু বাঙালিরাও সংখ্যাগুরুর ভয়ে সহমর্মী হতে পারেন নি। সারা ভারতে কোথাও চোখে পড়ার মতো কোনো সাহিত্য কর্মও হয়নি এত বড়ো আত্মত্যাগের উপর। উল্টে, বরেণ্য এক সাহিত্যিক বললেন, এসব আন্তঃরাজ্য সমস্যা। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

 ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি উনিশে মে নিয়ে সোচ্চার না হলেও অস্বীকার করেন না একুশে ফেব্রুয়ারির সহোদর দিনটিকে। দেশভাগের পর উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালির আত্মপরিচয়ের এতবড়ো অভিজ্ঞানকে অমান্য করেন কীভাবে। উনিশে মে-র আগে উত্তর-পূর্বের বাঙালি ছিল বিভিন্ন পরিচয়ে বিচ্ছিন্ন, ব্রাহ্মাণ কায়স্থ মুসলমান, এমনকি পূর্বনিবাস জেলার পরিচয়ে খণ্ডিত। উনিশে মে-র পর হয় নবজাগরণ, নতুন দেশের নবীন নাগরিক সাবালক হয়, হয় বাঙালি। ফলত সূচনা হয় সাহিত্য আন্দোলনের। বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা শুরু হয় বরাক উপত্যকাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কবিতার ছোটো পরিসরে হয় আত্মপ্রকাশ। ব্যক্তিগত উচ্চারণ বলে আন্দোলনের রূপ নিতে পারে নি ‘এই আলো হাওয়া রৌদ্র’ এক ও দুই। গদ্যসাহিত্য কথাসাহিত্য তখন নাবালক ও নয়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল না। কারণ অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, কবিতা যেখানে ছাপানো যায় সস্তার কাগজের এক ফর্মায়, গদ্যের জন্য কম করেও চাই চার ফর্মা। তাই গদ্য উপন্যাস ছোটোগল্পের কথা ভেবেছেন খুব কমজনই। ভাবলেও লিখলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরাসরি বই ছেপেছেন।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বরাক উপত্যকা ছাড়া প্রধান দুটি কেন্দ্র রয়েছে ত্রিপুরায় ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। ত্রিপুরার আগরতলায় বিশাল কেন্দ্র ছাড়া কুমারঘাট থেকেও ইদানীং সমৃদ্ধ পত্রপত্রিকা ও কথাসাহিত্যের উপর বই ছাপা হচ্ছে। যদিও সরকারি আনুকূল্য পাওয়া যায় যথেষ্ট। স্বনামধন্য অনেক কবি সাহিত্যিক গর্বিত করেছেন ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্যকে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গৌহাটি সবসময়ই অসমিয়া-বাংলা সাহিত্যের মিলনক্ষেত্র হয়ে আছে। কয়েকটি উচ্চমানের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে নিয়মিত অনিয়মিত। অধুনালুপ্ত পূর্বদেশ গল্পপত্র শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নয়, বাংলা কথা সাহিত্যের শিকড়ে জল সিঞ্চন করেছে গভীর মমতায়। ‘মহাবাহু’ প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনও হয় ‘একা এবং কয়েকজন’ যাপনকথা ও ‘নাইনথ কলাম’। ভিকি পাবলিশার্স তো গুয়াহাটিতে বাংলা প্রকাশনার জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে মৌলিক কথাসাহিত্যের প্রকাশে এবং অনুবাদ সাহিত্যে।

 শিলচর হাইলাকান্দি করিমগঞ্জ নিয়ে যে উপত্যকা সেখানেও ধারাবাহিকতার নিরিখে এগিয়ে ছোটোশহর হাইলাকান্দি। বিজিতকুমার ভট্টাচার্যের ‘সাহিত্য পত্রিকা এক নাগাড়ে এতদিন চলার আর দ্বিতীয় নেই, প্রায় চল্লিশ বছর। শিলচরে তপোধীর ভট্টাচার্যর দ্বিমাসিক দ্বিরালাপ দশ বছরের উপর নিয়মিত দু-মাস অন্তর বেরিয়ে যাচ্ছে বিরতিহীন। বিরতি দিয়ে মিথিলেশ ভট্টাচার্য ও তপোধীর ভট্টাচার্যর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত শতক্রতুও এখন চল্লিশোর্ধ। বরাক উপত্যকার সাহিত্য পত্রের ইতিহাসকে যদি নগেন্দ্র চন্দ্র শ্যাম-এর ‘ভবিষ্যৎ’ দিয়ে শুধু করা যায় উল্লেখযোগ্য, তবে এরপর একটা শূন্য সময় পার করে ভাষা আন্দোলনের বছর দুয়েক পর শুরু হয় শক্তিপদ ব্রহ্মচারী এবং তার কবিবন্ধুদের পত্রিকা ‘অতন্দ্র’। যেহেতু তখন কবির শহর হয়ে উঠেছে শিলচর, কবিতাপত্র ও বেরোচ্ছে অনেক। ‘বরাক কিংবা ব্রুকলীন ব্রিজ’-এর কবি শান্তনু ঘোষ-এর কৃত্তিবাস পুরস্কার পাওয়া এবং শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর ‘সময় শরীর হৃদয়'-এর হৃদয় ও শরীর বিষয়ক কবিতা সময়কে আলোড়িত করেছে। সেই ভীষণ আলোড়নের সময় শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী প্রকাশ করলেন ‘অনিশ’, প্রথম গদ্যের মুখ শহর শিলচরে, অনিশের উত্তরসূরী হয়ে বেরোল শতক্রতু। তবে বরাক উপত্যকায় পদ্যসাহিত্য আর কথাসাহিত্যে যুগলবন্দীর এক আশ্চর্য বন্দিশ রচিত হয়েছে শুরুর সময় থেকেই। অনিশ শতক্রতু কথাসাহিত্যকে প্রাধান্য দিলেও কবিতা অপ্রধান হয়নি কখনও। দেখাদেখি অনেক প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য পত্রিকা বেরোতে শুরু করে কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পরিসর সহ। একদার কবিতাপত্র ‘সাহিত্য’ ততদিনে নবসাজে কথাসাহিত্যের ধাত্রীবাড়ি হয়ে উঠেছে। লালা থেকে আশিসরঞ্জন নাথের সম্পাদনায় 'প্রবাহ', চার মহিলা সম্পাদকের সম্পাদনায় 'মাধবী' সমৃদ্ধ লিটল ম্যাগাজিন নাম। শুধু ত্রিপুরা ব্রহ্মপুত্র বরাক উপত্যকা নয়, বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্য ভুবন বিস্তৃত হয় শিলং-এ নাগাল্যাণ্ড-এর ডিমাপুর থেকে দেবাশিস দত্ত বের করছেন ‘পূর্বাদ্রি’, সেও তো হয়ে গেল অনেককাল। আর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গুয়াহাটিকে কেন্দ্রে রেখে এপারে-ওপারে প্রকাশিত হয়েছে শহরে শহরে কথাসাহিত্যের বিস্তৃত ভাণ্ডার। তেজপুর, মরাণ, ডিব্রুগড় তিনসুকিয়া ডিগবয় এবং সর্বশেষ সংযোজন নওগাঁর যাপন কথা, সম্পাদনায় কাত্তার ভূষণ নন্দী ও নিপন দাস।

 স্বীকার করে নেওয়া ভাল, ব্যক্তিগত উচ্চারণের কথা যদি কবিতার বেলায় খাটে, কথাসাহিত্যের সলতে পাকানোর কালটাও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। অনুকরণের কলকাতা বারবার ফিরে এসেছে, কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলেওছেন কলকাতায় বৃষ্টি হলে উত্তর-পূর্বের কথাসাহিত্যিকরা ছাতা টাঙিয়ে নেন। সময় বড়ো শিক্ষক, শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে সময় নিয়েছে এক ঝাঁক নবীন কথাকারের উদয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে নতুন দিগন্ত। কয়েকটা নাম না বললে কালের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। প্রথমেই নাম করা যায় মিথিলেশ ভট্টাচার্য ও শেখর দাশের। তারপর দুলাল ঘোষ অরিজিৎ চৌধুরি মলয় কান্তি দে দেবব্রত দেব কিশোররঞ্জন দে বদরুজ্জামান চৌধুরি। প্রথম কিস্তির এই কয়জন উল্লেখযোগ্য এইজন্য যে এরা একটা মাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন উত্তর-পূর্বের কথাসাহিত্যে এদের রাজত্বকাল চলতে চলতেই এলেন নতুন নৃপতিরা দেবীপ্রসাদ সিংহ, সুব্রত কুমার রায় অমিতাভ দেব চৌধুরি কান্তারভূষণ নন্দী পল্লব ভট্টাচার্য দেবব্রত চৌধুরি স্বপ্না ভট্টাচার্য, ঝুমুর পাণ্ডে অনুগল্পের প্রতিভা শর্মিলা দত্ত। আর সর্বশেষ সংযোজন মেঘলমালা দে। এককালের গল্পকার পরেশ দত্ত, কুমার অজিত দত্ত ও অধুনার হিমাসিশ ভট্টাচার্য বাণিজ্যিক পত্রিকায়ও লিখেছেন সুনামের সঙ্গে। এখন তো অনেক শক্তিশালী কথাকার লিখছেন, সবার নাম জানানো উদ্দেশ্যে নয় বলে আপাতত যতি।

 শুরুতেই উত্তর-পূর্বের ইতিহাস ভূগোল নিয়ে লেখা হয়ে গেল বিস্তর। কিন্তু সেই জটিল খণ্ডভূমি আর টুকরো সময়ের কথকতা তো লেখা হল না ষাট বছর হয়ে গেল। দেশভাগের কথা কি ভুলে গেল তবে উত্তর-পূর্বের নবীন বাঙালি। আসলে এই নতুন অর্জিত ভূমিতে নবীন প্রজন্মের গৃহবাসী হওয়ার জন্য সময়ের দরকার ছিল। শরণার্থী জীবনের যন্ত্রণা আর ভাত কাপড় ভিটের ব্যবস্থা করতে গিয়ে শিল্প সাহিত্যের নন্দনে চোখ দেওয়ার সময় পায়নি উৎখাত মানুষ। জীবনের নিয়ত টানাপোড়েন আর সংঘাতের টাটকা প্রতিবেদন তাই উঠে আসে নি কোথাও। কিন্তু সময় কখনও প্রবঞ্চনা করে না। সব জমিয়ে রাখে সঠিক প্রকাশের জন্য। কারণ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আবেগের প্রশ্রয় থাকে বিস্তর। আবেগ কাটিয়ে থিতু হতে সময় লেগে গেল বলেই মলয় কান্তি দে লিখতে পারলেন ‘আশরাফ আলির স্বদেশ' নামের কালজয়ী ছোটোগল্প, যা দেশভাগের এক মর্মান্তিক দলিল হয়ে থাকবে মহাকালের মহাফেজখানায়। এই একটি মাত্র গল্প দিয়েই কি দেশ ভাগের কথকতা শেষ হয়ে গেল উত্তর পূর্বের। আসলে মলয়কান্তি বর্তিকা বহনের কাজ করেছেন এগিয়ে থেকে। দেশভাগজনিত প্রব্রজনের জন্য উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাংলা সাহিত্যের গতি শ্লথ থাকাও হয়তো একটা কারণ হতে পারে। তিনদিকে সীমান্তের নিষেধ থাকায় মূল স্রোত মূল দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাও কারণ হতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে স্থলপথে রেলপথে ভারত দেশের সঙ্গে যোগাযোগের সাধন শুধু সীমিতই ছিল না, ছিল দুর্গমও। ফারাক্কা সেতু হওয়ার আগে রেলভ্রমণের কথা এখন ভাবাই যায় না, আর পাহাড় লাইনের বরাক উপত্যকা তো এখনও যেমনকে তেমন। ফলত বই পত্রপত্রিকা পাওয়া সহজ ছিল না। এখনও তেমন সহজ নয় বরং দেশভাগের আগে এবং অব্যবহিত পরেও গ্রাহক করার ডাকে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল কলকাতা থেকে লক্ষ্মৌ থেকে। এখনও তেমন ব্যবস্থা আছে তবে তার অভিমুখ পাল্টে গেছে, কলকাতা থেকে খুব কমই আসে ডাকে, কিন্তু উত্তর-পূর্ব থেকে সাহিত্য শতক্রতু দ্বিরালাপ মানবী ব্যতিক্রম উজ্জ্বল পাণ্ডুলিপি ঈশান প্রতিস্রোত পূর্বাদ্রি মুখাবয়ব যাপনকথা প্রবাহ কিন্তু ডাকে যায় ভারতের গ্রাহকদের কাছে এমনকি বিনামূল্যে আগ্রহী পাঠকের কাছেও। কলকাতার পত্রপত্রিকার প্রচারের অভিমুখ সিউড়ি কাটোয়া শিলিগুড়িতেই সীমাবদ্ধ। ইণ্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় যোগাযোগ বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ায় আর অভিযোগ থাকল না।

 এ তো গেল বহিরঙ্গ কথা। তাহলে আর বাধা থাকল কোথায়, উত্তর ভারত আর পূর্ব ভারতের দেশ ভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক বিভাজন কথার দলিল লেখার শুরু হয়েছে এখন। এতদিন তো আক্ষেপ ছিল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আর প্রফুল্ল রায় ছাড়া এপারের কেউ লিখলেন না দেশভাগ তেমন করে। তাই হয়তো এখন বন্যার মতো দেশভাগ-কথার দলিল লেখা হচ্ছে নতুন উদ্যমে, হয়তো বহুব্যবহারে তার গুরুত্বও অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে, একই গল্পকথা বিভিন্ন কলমে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে, লিখিত হচ্ছে দয়াময়ীর কথা এবং আগুনপাখি। তবে বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভুবনকে এখনও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দেশভাগ, গণভোট নতুন দিগন্তের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। যেমন নিয়ে গেছে মলয় কান্তি দের আসরাফ আলির স্বদেশ, স্বপ্না ভট্টাচার্যর উজান, শেখর দাসের উপন্যাস বিন্দু বিন্দু জল, মিথিলেশ ভট্টাচার্যর ফটিক চাঁদের ভিটেমাটি। ইদানীং কবি সাংবাদিক অতীন দাস, মোজাম্মিল আলি লস্কর এবং ইমাদ উদ্দিন বুলবুল লিখছেন প্রেক্ষিত বদল করে।

 দেশভাগের কথকতা এক যৌথ বয়ানের কথা। তাই নাম না লিখলেই হত। দেশভাগ এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বন্ধক-শ্রমিক করে তুলেছে। ভিটেমাটি উচ্ছেদ করে অনিশ্চয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আবার নতুন করে যাত্রার বার্তা শুনিয়েছে, যে গমন খুব মসৃণ নয় কখনও। এক্সোডাসের দুঃখে নয় বরং যৌথ চলার আনন্দে, মানুষ গড়েছে নতুন বাসভূমি। সেই চলার কথা ষাট সত্তর বছর পর লিপিবদ্ধ হলে ক্ষতি কী। সহযোদ্ধা অনেক লেখকই মণিমুক্তো আহরণ করতে পারেন নি সঠিক সময়ে, অনেকে আক্ষেপ করে মা এখন কানে শুনেন না। যখন বলত পথের কথা শিবিরের কথা বুঝিনি গুরুত্ব। অনেকে পেরেছেন সাজিয়েছেন, বিদ্বেষের বর্জ্যটুকু ছেঁকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন নতুন ইহুদির জীবন-গাথা।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড, কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরপুর তার জনপদ। কত ভাষা কত সংস্কৃতি আর বাংলা যেহেতু একটি প্রধান ভাষা তাই বাঙালি কথাকারেরা লিখেছেন প্রতিবেশি কথা। অরিজিৎ চৌধুরি শ্যামল ভট্টাচার্য দেবব্রত দেব লিখেছেন বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলনের কথা। প্রাবন্ধিক সম্পাদক দেবাশিস দত্ত নাগা উপকথার সংকলন সাজিয়েছেন। হিন্দু-মুসলমান আর অসমিয়া বাঙালি সম্পর্ক নিয়েও লেখা হচ্ছে ধারাবাহিক স্রোতের মতো।

 উত্তর-পূর্বের ভাষার লড়াই মূলত অসমিয়ার সঙ্গে। আবার প্রীতির সম্পর্কও অসমিয়ার সঙ্গে মধুরতম, বৈবাহিক সম্পর্ক এখন তো স্বাভাবিকতার পর্যায়ে। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে একঝাঁক মুক্তমনা সৃষ্টিশীলের আগমনে এখন সহাবস্থান সহনীয় হচ্ছে দেখে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সরকারি মদতে দাঁত নখ বের করতে উদ্যত হয়েছে। আবার এক বিতর্কিত ভাষা সার্কুলার বের করে বরাক উপত্যকা সহ আসামের সরকারি ভাষা অসমিয়া করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার উত্তপ্ত হবে শান্তির দ্বীপ, উনিশে মে-র বরাক উপত্যকা কিছুতেই মেনে নেবে না আগ্রাসন। যদিও শুভবুদ্ধি জয়ী হবে অচিরেই এ আশায় বুক বেঁধে আছে উত্তর-পূর্ব

 প্রকাশনার ক্ষেত্রেও উত্তর-পূর্ব পিছিয়ে ছিল অনেকদিন, বিশেষ করে বাংলা ভাষায়। সাহিত্য বিষয়ক পুস্তক প্রকাশনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে ছিল উত্তর-পূর্ব। প্রতিনিধিত্বমূলক অনেক বইপত্রই এককালে প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। এই অঞ্চলের স্বনামখ্যাত শিল্পী ময়নুল হক বড়ভূঁইয়ার আঁকা প্রচ্ছদে শিলচরের ঠাকুর প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তপোধীর ভট্টাচার্যর প্রথম গ্রন্থ তথা কাব্যসংকলন ‘তুমি সেই পীড়িত কুসুম’। এর পর সাহিত্য প্রকাশনী থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বই। ত্রিপুরায় সরকারি উৎসাহে প্রকাশনার জগতে জোয়ার আসে এবং দুর্দান্ত ভাবে টিকে থাকে দু-একটি। এর মধ্যে অক্ষর পাবলিকেশন এখন বাংলা সাহিত্যের একটি বড়ো প্রকাশনা ঘর। গুয়াহাটিতে তেমন কিছু ছিল না এই সেদিন পর্যন্ত, হল ভিকি পাবলিকেশনের উদয়, যেন এলাম দেখলাম জয় করলাম। শিলচরের পুণ্যপ্রিয় চৌধুরির শিলচর সানগ্রাফিক্স প্রকাশনার উৎকর্ষ দেখিয়ে বের করছে কিছু অসাধারণ বই, শেষতম সংযোজন মলয়কান্তি দের ‘আত্মপরিচয়’। মিতা দাস পুরকায়স্থর প্রকাশনাও এখন দারুণ সচল। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে ইমাদউদ্দিন বুলবুলের উপন্যাস 'সুরমা নদীর চোখে জল'

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কথাসাহিত্যে সমাজ উঠে এসেছে বারবার তার স্ব-স্বরূপে বৈচিত্র্যে। ভিন্ন ভাষার ভিন্ন ধর্মের সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে, অবিশ্বাস ভেঙে সমন্বয়ের প্রেমকাহিনি বিধৃত হয়েছে। অনিয়মিত প্রকাশক গোবিন্দ কংসবনিকের ‘আবাহন’ প্রকাশ করল ‘সরাইঘাট একটি প্রেমকাহিনি'। আসাম আন্দোলনের মূলে ছিল বাঙালি বিরোধিতা, কিংবা বলা যায় উল্টো করে বাঙালির বৌদ্ধিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধতাই ছিল মূলে। দেবাশিস তরফদার এই অলীক বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে মানবতার কথা লিখেছেন তাঁর নিজস্ব গদ্যভঙ্গিতে, এক নবীন গদ্যভাষার স্রষ্টা হয়েছেন তিনি, যাঁকে অনেকে সাধুভাষা বলে ভুল করেছেন। এ ভাষা সাধুর ভিতে এক নব্য কথকতার বাচন যা যোগাযোগের কাজ করে আসামে বিভিন্ন উপভাষার বাঙালির সঙ্গে এবং বাংলার খুব কাছের বন্ধু অসমিয়ার সঙ্গেও।

 অনুবাদের কাজ যথেষ্ট হচ্ছে ত্রিপুরায় বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। দিল্লির বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ‘নিয়োগী বুকস’ প্রকাশ করেছে বরাক উপত্যকার গল্পকারদের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্পের ইংরেজি অনুবাদ। নির্মলকান্তি ভট্টাচার্য ও দীপেন্দু দাসের সম্পাদিত বই এর নাম ‘দ্য বার্বড ওয়্যার ফেল’। গল্পকার কল্লোল চৌধুরিও কলকাতার সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশ করেছেন আর একটি সংকলন তাঁর নিজের অনুবাদে। অসমিয়া মণিপুরি ককবরক এবং অন্য উপভাষা থেকে অনুবাদ হয়েছে বাংলায়। উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন প্রয়াত সুজিৎ চৌধুরি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য এবং কবি রবীন্দ্র সরকার।

 উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাভাষা কিন্তু ফুলে ফলে ভরে উঠেছে। হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র বিশিষ্ট। বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবন সমৃদ্ধ হয়ে আছে নিজের বৈশিষ্ট্যে, যদিও বাংলা ভাষার মহাভোজে পাত পেড়ে খাওয়ার জন্য বিশেষ ডাক পড়ে না প্রধান ভুবনে। বাংলা ভাষার কোনো প্রামাণ্য কবিতা সংকলনে উপস্থিত থাকেন না উত্তর-পূর্বের কবি। গল্প-সংকলনে আলাদা প্যাকেট করা হয় উত্তর-পূর্বের। প্রতিভাধনী হয়েও কেন উপেক্ষা। হয়তো উত্তর-পূর্বের স্বাভিমানই এর জন্য দায়ী, এখানে একটা ঢিলেঢালা ভাব আছে, ব্র্যাণ্ড সাজানো নিজের নামের বিজ্ঞাপন করার কোনো তাগিদ নেই লেখকদের। হয়তো, কিছুটা দর্পিতও, ভাবে কেন বিজ্ঞাপন, লেখা তো লেখাই, আপন মহিমায় পাঠক প্রিয় হয়ে উঠবে। আসলে তাও নয়, পাঠককে পড়ানোর ছল করতে হয়। সেই ছলের বড়ো অভাব এই লাজুক বাংলা সাহিত্যের।