বিষয়বস্তুতে চলুন

উপবাস

উইকিসংকলন থেকে
উপবাস


উপবাস।




শ্রীযুক্ত রায় যদুনাথ মজুমদার বাহাদুর
এম্‌, এ, বি, এল্‌, কর্ত্তৃক
প্রণীত।




যশোহর
হিন্দু-পত্রিকা-প্রেসে
শ্রীকালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় দ্বারা
মুদ্রিত ও প্রকাশিত।




শকাব্দাঃ ১৮৩৩।


উপবাস


 পূর্ব্বে জ্বর হইলে কবিরাজ মহাশয়েরা “লঙ্ঘন”ই ব্যবস্থা করিতেন। “জ্বরাদৌ লঙ্ঘনং পথ্যং জ্বরান্তে লঘুভোজনং।” সে দিন এখন গিয়াছে; এখন কবিরাজের রাজত্ব গিয়া ডাক্তারের রাজত্ব হইয়াছে। তাঁহারা vitality বা জীবনীশক্তির জন্য চিন্তিত। অনাহারে জীবনী শক্তির হ্রাস হইবে, এই তাঁহাদের ভয়। কবিরাজ মহাশয়েরাও শাস্ত্রের আদেশ উপেক্ষা করিয়া, দেশ-কাল-পাত্রানুসারে ডাক্তার বাবুদেরই অনুকরণ করিতেছেন। সুর কিন্তু ফিরিতেছে! পাশ্চাত্য চিকিৎসাব্যবসায়িগণ ইদানীং উপবাসের ভূয়সী প্রশংসা করিতেছেন; সুতরাং অবস্থাবিশেষে উপবাসই যে স্বাস্থ্যরক্ষার প্রধান উপায়, তাহা পুনর্ব্বার এদেশের লোক বুঝিবেন বলিয়া আশা করা যায়।

 বর্ত্তমানে দেশ যেরূপ দরিদ্র, তাহাতে উপবাস অভ্যাস করিলে, অর্থচিন্তারও অনেক লাঘব হইবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। একথা উপহাসচ্ছলে বলিতেছি না, ঠিক্‌ মনের কথা বলিতেছি। অন্ততঃ দুইটা একাদশী আর অমাবস্যা-পূর্ণিমায় যদি উপবাস করা যায়, তাহা হইলে বৎসরে প্রত্যেক ব্যক্তির দেড় মাসের অধিক কালের আহারের ব্যয় বাঁচিয়া গেল। ইহাতে সকলের বাৎসরিক ব্যয়ের অষ্টমাংশ বাঁচিল, অর্থাৎ শতকরা প্রায় ১২ টাকা বাঁচিয়া গেল।

 উপবাসে দরিদ্রের যেরূপ উপকার, ধনীরও তদ্রূপ; তাঁহার ধন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইবে। কৃপণের পক্ষে উপবাস উপযোগী, দাতার পক্ষেও তাহাই। ইহা দ্বারা দাতা দান করার অধিক সুবিধা পাইবেন।

 টাকা বাঁচাইবার জন্য, উপবাস করিয়া শরীরকে অনর্থক কষ্ট দিব কেন? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে—উপবাসের দ্বারা শরীরের কোন অপকার হয় না, কিন্তু বিশেষ উপকারই হয়। একেবারে উপবাস না করিলেই বরং শরীরের অপকার হয়।

 আমাদের যে কোন ব্যাধি, তাহা প্রায়শঃ আমাদের অজীর্ণ-রস-সমুদ্ভূত; আমাদের প্রাচীন ঋষিরা ইহা উচ্চ কণ্ঠে আয়ুর্ব্বেদশাস্ত্রে ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন। “অপক্বামরসং দোষবৈষম্যং রোগকারণম্।” দেহীর দেহে রোগাক্রমণের নিদানতত্ত্বালোচনায় বলা হইয়াছে যে, অপক্ব আমরস দ্বারাই দেহে দোষবৈষম্য অর্থাৎ বায়ু-পিত্ত-কফ, এই ত্রিদোষের বৈষম্য (অসামঞ্জস্য) রোগের কারণ হয়। পাশ্চাত্য চিকিৎসকেরাও ক্রমশঃ এই সত্যের উপলব্ধি করিতেছেন।

 আমরা যে যাহাই খাই, আমিষভোজীই হই বা নিরামিষভোজীই হই, তাহা ভাল ভাবে জীর্ণ না হইলে, অজীণরস সর্ব্ব-শরীরে সঞ্চারিত হয়; উহাই আমাদের সর্ব্ববিধ ব্যাধির কারণ। আজ কাল Dyspepsia এবং Diabetes বা অম্ল ও বহুমূত্র রোগের বড়ই বাড়বাড়ি দেখা যায়। অতিরিক্ত ভোজনই উহার কারণ। অজীর্ণ রস আমাদের শরীরের যে যন্ত্রে অধিক পরিমাপে সঞ্চারিত হয়, সেই যন্ত্রই রোগাক্রান্ত হয়। অনেক রোগ-বীজ অন্য শরীর হইতে আমাদের শরীরে সংক্রামিত হয় বটে, কিন্তু নিজের শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ থাকিলে, বাহ্যবিষ শরীরে প্রবেশ করিলেও কোন ক্ষতি করিতে পারে না; যদিও করে, সে অতি সামান্য ভাবে, সাংঘাতিক ভাবে নয়। উপবাসে কোন ভয় নাই। সপ্তাহে একবার করিয়া প্রতি রবিবারে উপবাস করিয়া দেখ। একদিন না খাইলে ত আর মরিবে না ভাই! দেখ, শরীর সেদিন পূর্ব্বাপেক্ষা ভাল থাকে কিনা। উপবাসের দিন অন্ততঃ দুইবার স্নান করিবে; উষায় ও মধ্যাহ্নে অথবা মধ্যাহ্নে ও অপরাহ্নে। আর একেবারে নিরম্বু উপবাস না করিয়া, যতবার ইচ্ছা—বিশুদ্ধ জল যত পার, খাইবে। উপবাসের দিন—অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জল ব্যতীত অ।র কিছুই খাইবে না। সুফল হাতে হাতে পাইবে; দেখিবে—পেট পরিষ্কার হইয়াছে, জিহ্বা পরিষ্কার হইয়াছে, গাত্রে ‘ঘিন ঘিন ভাব’ নাই, অলসতা নাই, কার্য্য করিতে অনিচ্ছা নাই; শরীর লঘু হইবে, মনে স্ফূর্ত্তি ও শান্তি আসিবে। আয়ুর্ব্বেদশাস্ত্র উপবাসের উপকারিতা-বর্ণনে বলিয়াছেন,—

‘অনবস্থিতদোষাগ্নের্লঙ্ঘনং দোষপাচনং।
জ্বরঘ্নং দীপনং কাঙ্ক্ষারুচিলাঘনপ্রাণদম্॥’

 অর্থাৎ অগ্নির অনবস্থিততায় যে অজীর্ণ-রসরূপ দোষ এবং তজ্জনিত বায়ু-পিত্ত-কফের বৈষম্য রূপ দোষ জন্মে, উপবাসে সেই রসের বিকৃতিরূপ দোষের পরিপাক বা প্রকৃতিস্থতা হয়। উপবাস জরনাশক, জঠরাগ্নির উদ্দীপক, কার্য্যে আগ্রহ ও উৎসাহ-জনক। উপবাসে আহারে রুচি বৰ্দ্ধিত হয়, আহার্য্যের আস্বাদ মধুরতার বোধ হয়, শরীর লঘু—অর্থাৎ ‘খট্‌খটে—ঝর্‌ঝরে’ হয় এবং উহা ‘প্রাণদ’ অর্থাৎ জীবনীশক্তির বর্দ্ধক। নিশ্চয় জানিবেন, সিদ্ধর্ষি আয়ুর্ব্বেদাচার্য্যগণের এই উপবাস-গুণ-বর্ণনে একটুও অত্যুক্তি নাই। যদি ভগবানে বিশ্বাস থাকে, তবে উপবাসের দিন নিজের প্রীতি অনুসারে, যে ভাবে হউক্‌ তাহার উপাসন করিবে। ইহাতে ‘সোণায় সোহাগা’ দেওয়া হইবে। তুমি যদি সুস্থ থাক, তাহা হইলে আরও সুস্থ হইবে; যদি রোগযুক্ত থাক, তবে রোগমুক্ত হইবে। তুমি যে কোন কঠিন রোগেই আক্রান্ত থাক না, দেখিবে, উহার অনেক উপশম হইয়াছে। ক্রমে সপ্তাহে এইরূপ দুইবার উপবাস করিবে এবং পরিবারস্থ সকলকে উপবাস করাইবে। ইহাতে ডাক্তারের খরচ প্রায় বাঁচিয়া যাইবে; সেটাও কম লাভ নয়। এতদ্ব্যতীত প্রতি মাসে একতৃতীয়াংশ ‘খাইখরচ’ বাঁচিয়া গেল। এর সঙ্গে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী যোগ দিলে, আরও ৪ দিনের খরচ বাঁচিয়া গেল। তবে অনেক সময় রবিবারে ঐ সকল পর্ব্বদিন পড়িতে পারে। যাহা হউক্‌, শরীরের কিছুমাত্র অনিষ্ট নাই, অনেক ইষ্ট আছে, এমত স্থলে এই দারিদ্র্য-পীড়িত দেশে মহোপক রী উপবাসের ফলে অর্থের উদ্বৃত্তি কখনই অবাঞ্ছনীয় নহে।

 ছোট ছোট বালক-বালিকাদিগকে ও অল্প অল্প উপবাস করাইবে। তবে “খাব খাব” করিয়া বিরক্ত করিলে, একটু একটু দুগ্ধ দিবে। ক্রমে তাহারা ইচ্ছাপূর্ব্বক (অন্ততঃ বিনা কষ্টে) উপবাস করিবে।

 উপবাসে কোন ভয় নাই। আমাদের যত রোগ, তাহার অধিকাংশই অতিরিক্ত ও কুখাদ্যযুক্ত-ভোজন-জনিত; কিন্তু উপবাস-জনিত নহে। বিধবারা অনেক উপবাস করেন, তাঁহাদের সুস্থ ও তেজঃপূর্ণ শরীর দেখিয়াও কি কিছু শিক্ষা লাভ করা যায় না? পুরোহিত ঠাকুরেরাও অনেক উপবাস করেন। আমরা দেখিয়ছি, অনেক বৃদ্ধ পুরোহিতঠাকুর দুর্গোৎসবের সময় দক্ষিণান্ত শেষ না করিয়া জলস্পর্শ ও করেন না। তাঁহারা কেমন কর্ম্মঠ ও সুস্থ! কে কোথায় শুনিয়াছ যে, ঐ ব্যক্তি উপবাসে রোগগ্রস্ত হইয়াছেন? দীর্ঘকাল না খেগে, প্রাণীমাত্রেই মরিবে, সে বিষয়ে অবশ্য কোন সন্দেহ নাই; কিন্তু সর্প, ভেক—বহুদিন এবং সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি জন্তু অনেক দিন অনাহারে থাকে; কিন্তু উহারা কেমন সুস্থ ও সবল!

 উপবাসে কোন ভয় নাই; তবে একরূপ ভয়ও আছে; সে ভয় উপবাসের জন্য নয়, সে উপবাসের ভয়ের ভয়! উপবাস করিলে আমি মরিয়া যাইব বা কাতর—দুর্ব্বল—পীড়িত হইব, এই যে একটি সংস্কার, উহা সেই সংস্কার-জনিত ভয়। বস্তুতঃ উপবাসে সাধারণতঃ কোনই ভয় নাই।

 পরীক্ষা করিয়া দেখা হইয়াছে যে, ৪০।৫০ দিন উপবাসেও মানুষ মরে না। ঘোর দুর্ভিক্ষ-কালে মানুষ উপবাসে মরে বটে, কিন্তু সে ‘মরিব’ এই ভয় প্রথম হইতে হৃদয়ে পোষণ করে বলিয়াই শীঘ্র মরিয়া যায়। সাধারণের পক্ষে এ পরীক্ষার প্রয়োজন নাই। তাঁহারা সপ্তাহে এক দিন, দুই দিন এবং তৎপরে ক্রমে তিন দিন উপবাস করিয়া দেখিবেন। ক্রমশ: নিজেরাই বুঝিতে পরিবেন যে আবশ্যককমত সাময়িক উপবাসই স্বাস্থ্যের মূল। সাধারণতঃ মিতাহারী অর্থাৎ একটু অল্পাহারীই হইবে। শাস্ত্র বলেন—“লঘুশী নাবসীদতি”—লঘু-আহারকারী কখনও অবসাদপ্রাপ্ত হন না। আমিষ-নিরামিষের কথা এখানে কিছু বলিব না। যাঁহারা মৎস্য মাংসাদি পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই, তাঁহারা যেন উহা ক্রমে কমাইয়া দেন। তবে নিরামিষই খাও বা অমিষই খাও, যত কম করিয়া পার, খাইবে। সাময়িক উপবাস যেমন স্বাস্থ্যের মূল, দৈনিক অল্প আহারও তদ্রূপ। উপবাসের পর দিন, নিত্য যেরূপ আহার কর, তাহা অপেক্ষাও কম করিবে। আহারান্তেই জল পান করিবে না; অtহারের এক প্রহর বা তিন ঘণ্টার পর জলপান করিবে। অন্ততঃ পক্ষে অৰ্দ্ধপ্রহর বা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করা অতি আবশ্যক। ঠাণ্ডা ও সর্‌দি আদি লাগিলে, গরম জল খাইবে এবং উহা যত পার, খাইবে; তাহাতে উপকার ভিন্ন অপকার নাই। মানুষের সর্ব্বপ্রকার আহারের মধ্যে দুগ্ধ ও ফলই ভাল। বালক, বৃদ্ধ, যুব, সকলের পক্ষেই ভাল। তন্মধ্যে দুগ্ধ শিশু ও বৃদ্ধের পক্ষে অধিকতর উপযোগী।

 আমাদের দেশে অনেকে উপবাসাদির দিন বরং কিছু অতিরিক্তই আহার করেন। একাদশীর উপবাস-আ’জ ভাঁত খাই ব না, কিন্তু খাব কি—না ময়দা বা আটা। তাতে আবার নানা উপকরণের ঘটা। আটাটা ভাত হইতে লঘু পথ্য কি না (!) বিচারটা মন্দ নয়। অভোজনের দিনেই ভুরি-ভোজন! ফলিতার্থে উহা উপবাসের উপহাস মাত্র। ধর্ম্মের হিসাবেই কর বা স্বাস্থ্যের হিসাবেই কর, এরূপ উপবাসে ধর্ম্ম ও স্বাস্থ্য, উভয়েরই হানি। শেষে হয়ত বা প্রাণ নিয়া টানাটানি! উপপাস করিতে হইলে, রীতিমত কর। যদি নিতান্ত অশক্ত হও, কিছু দুগ্ধ পান কর। দুগ্ধেই দেহ-রক্ষণোপযোগী সমস্ত পদার্থ বর্ত্তমান।

 প্রাচীন কালে হিন্দুগৃহে একাদশীর দিন গো-অশ্বদিগেরও উপবাস করিতে হইত। গো-অশ্ব প্রভৃতিরও শরীর-রক্ষার জন্য উপবাস যে প্রয়োজনীয়, আমাদের তাহা বুঝা উচিত। কুকুর-বিড়াল প্রভৃতিকে মধ্যে মধ্যে স্বতঃসিদ্ধ প্রাকৃতিক শিক্ষায় উপবাস করিতে দেখা যায়। ফলে পশ্বাদিরও উপবাস আবশ্যক।

 উপবাসাদিতে ধ্যান-ধারণার সাহায্য হয়; এ কথা সকলে স্বীকার করিতে প্রস্তুত হইবেন না, কারণ, উপবাসের অভিজ্ঞতা তাহাদের নাই। তবে মোটামুটি বুঝুন, ভূঁড়ি বা পেট অপরিস্কার থাকিলেই, মুড়ি (মাথা) অপরিস্কার থাকে। Tympanitis এর সঙ্গে সঙ্গে দেখিবে, brain এর Congestion হয়। রোগীর পেট ফাঁপিলেই মুস্কিল! ডাক্তার তখনই enema দিয়া কুপ্ত মল বাহর করিয়া দেন। না দিলে, তাহার মস্তিষ্কের বিকার হয়। অতিরিক্ত আহার করিলে, পেট ভরা থাকিলে, মাথা খেলে না। বড় লোকের ছেলের ভুড়ি লইয়া বিব্রত, সুতরাং অনেকেরই মুড়ী (মাথা) আদৌ খেলে না। আহার কম করিলে, অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেরূপ সবল হয়, মস্তিষ্কও তদ্রূপ সবল হয়। ভাই! বিশ্বাস না কর, নিজেই পরীক্ষা করিয়া দেখ। একেবারেই ত কম খাইতে বলা হইতেছে না, তাহাতেও ত শীরর কৃশ ও দুর্ব্বল হইবে, ফলে সাধারণতঃ একটু কম কম খাওয়াই ভাল। শাস্ত্র তাহাকেই মিতাহার বলিয়াছেন। গীতায় উক্ত হইয়াছে—“নাত্যশ্নতস্তু যোগেহস্তি নচৈকান্তমনশ্নতঃ।” অর্থাৎ অত্যাহার ও অত্যল্পাহার, উভয়ই স্বাস্থ্যের বিরোধী; সুতরাং যোগের হানিজনক। দেহের প্রধান যন্ত্রই মাথা। অত্যাহারে সেই মাথারই মাথা-খাওয়া, হয়! স্বাস্থ্যই ধর্ম্মসাধনের মূল; “শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম্মসাধনম্।” রুগ্ন ব্যক্তি দ্বারা জগতের কোন কার্য্যই হয় না। ধর্ম্মই বল, আর কর্ম্মই বল, আরোগ্য ভিন্ন সব অসম্ভব। শাস্ত্র বলেন—“ধর্ম্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যং মূলমুত্তমম্‌” উপবাসই সেই আরোগ্য বা স্বাস্থ্যের মূল; স্বাস্থ্যই চতুর্ব্বৰ্গসাধনের উত্তম মূল। অতএব যথাসম্ভব উপবাস অভ্যাস অবশ্য কর্ত্তব্য।

 আবার বলি, উপবাসে ভয় নাই। আমার তিন ক্রোশ পথ হাঁটিতে হইবে, উপবাস করিয়া কি করিয়া পারিব? কিন্তু কোন ভয় নাই; দেখিবে, ভরা পেটের চেয়ে খালি পেটে হাঁটা যায় বেশী;—ব্যায়াম হয়, ক্ষুধা বাড়ে। পরে ভ্রমণান্তে মিতাহার করিলে, তুষ্টি, পুষ্টি, ক্ষুন্নিবৃত্তি ও বলবৃদ্ধি সহজে ও সুখে সম্পাদিত হয়। অতএব সাধারণতঃ কমকম খাবে, আর মাঝে মাঝে উপবাস করিবে। ইহাতে যদি শরীর সুস্থ না হয়, উপবাসী, care of Editor, Hindu Patrika, ঠিকানায় পত্র লিখিবে, আমি বিনাপয়সায় তোমার স্বাস্থ্যের বিধান করিয়া দিব। বার বার বলি, উপবাসে কোন ভয় নাই। উপবাস কর, Malaria, Cholera, Small pox, Plague, Headache, Rheumatism, Gout, প্রভৃতি কোন রগের ভয় থাকিবে না। উপবাস ভয়ের কারণ নয়, বরং অভয়েরই কারণ। উপবাস রোগীর আশ্রয়, ভোগীর রক্ষা-কবচ, যোগীর সাধন-সহায়। আমাদের শরীরের জন্য যতটুকু দরকার, তাহার অতিরিক্ত খাইলেই সেগুলি পেটে গিয়া পচে এবং সমস্ত শরীর সেই অজীর্ণ-রসোদ্ভূত বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত হয়। মল-মূত্র দ্বারা যদি ঐ বিষাক্ত পদার্থগুলি বাহির না হইতে পারে, তাহ হইলেই আমরা কোন না কোন কঠিন ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হই। সাধারণতঃ যাহার যে যন্ত্র গুলি দুর্ব্বল থাকে, ঐ বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা সেই যন্ত্রগুলিই অধিক অভিভূত হয় এবং আমরা সেই যন্ত্রের ব্যাধি-গ্রস্ত হই। ঐ বিষাক্ত পদার্থ যন্ত্রগুলিকে নিস্তেজ করিয়া ফেলে, শোণিত-প্রবাহিনী শিরাগুলিকে দুষ্টরসে রুদ্ধ করিয়া ফেলে। শুদ্ধ রক্তের সঞ্চালন হয় না। যাহা সঞ্চালিত হয়, সে দূষিত রক্ত। সুতরাং সমস্ত শরীর বিষে জর্জরিত হয়। মানুষ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। সে এক দিন দুই দিনের অনিয়মে নয়। বিধাতা আমাদিগকে এমনি করিয়া গঠিত করিয়াছেন যে, সামান্য সামান্য অনিয়ম করিলে, যন্ত্র গুলি নিজে নিজেই স্ববলে তাহার প্রতিকার করিয়। লয়; কিন্তু বেচারারা যখন আর পারে না, ল’ড়ে পিটে হয়রাণ হয়, তখন হা’র মানিয়া বসে, আর আমরা ব্যাধিগ্রস্ত হই।

 শরীর রোগগ্রস্ত ও দুর্ব্বল হইলে, তখন বাহিরের শত্রুও আসিয়া সহজে আমাদিগকে অভিভূত করে। দুর্ব্বল শরীরেই, Pnumoniea, Tubercolosis, Typhoid fever প্রভৃতি রোগ-বিষ সহজে অনিষ্ট করিতে পারে। “শক্তের ভক্ত, নরমের গরম” এ প্রবাদ এখানেও প্রমাণিত হয়। রোগ আমাদের আত্মদোষেরই স্বেচ্ছা-গৃহীত দণ্ড। শাস্ত্র বলেন—

“রোগ-শোক-পরিতাপ-বন্ধন-ব্যসনানি চ।
আত্মাপরাধ বৃক্ষস্য ফলান্যেতানি দেহিনাম্‌॥”

 রোগ, গোক, পরিতাপ, বন্ধন ও ব্যসন—আমাদেরই নিজ-দোষ-রূপ বৃক্ষের ফল। উপবাস এই রোগ-রূপ বিষ ফলের বৃক্ষের অত্যাহার-রূপ আত্মদোষ-বীজের ধ্বংস-সাধক; সুতরাং রোগাক্রমণে আত্মরক্ষার এক প্রধান উপায়ই এই উপবাস।

 উপবাস আরম্ভ করিলেই, যখন ক্ষুধার উদ্রেক হয়, তখন না খাইলেই আমাদের পাকস্থলীর secretions বদ্ধ হয়, ইহাকেই মোটামুটি কথায় আমরা ‘পিত্ত পড়া’ বলি। ক্ষুধায় secretions বেশী হয়, তার পর না খাহলে, উহারা যখন দেখে যে, বাহির হইয়া কোন লাভ নাই, উহাদের হজম করার কিছু নই, তখন উহারা চুপ করিয়া যায়। তখন হয় কি, না আমাদের হজম করার যত যন্ত্র আছে, তাহারা বিশ্রাস্তি লাভ করে। তখন গৃহ-পরিষ্কার কার্য্যই আরব্ধ হয়। আ’জ পাক-শাক কিছু হইল না, গৃহিণী রান্নাঘর ধুয়ে ছাপ-ছাপাই করিয়া ফেলিলেন। ভিতরেও তাহাই হয়। আভ্যন্তরিক ধৌতি আরব্ধ হয়। দেহযন্ত্রের তন্ত্রধারিণী প্রকৃতির রীতিই এই। তাই উপবাস শরীরশোধক, বিকৃতযন্ত্র-শাসক, রোগবীজ-নাশক এবং দুষ্ট রসের শোষক ও সংস্কারক।

 এনিমা প্রভৃতির ব্যবহার ব্যতীতও যথেষ্ট পরিমাণে জল পান দ্বারা এই আভ্যন্তরিক ধৌতি কার্য্যের বিশেষ সহায়তা হয়। যখন পেট খালি হইয়া গেল, তখন দেখিবে, জিহ্বা পরিস্কার হইয়া গিয়াছে, মুখে দুৰ্গন্ধ মাত্রে নাই, মুখের ‘মিষ্টি মিষ্টি’ ভাব নাই; শরীর লঘু ও মন সুস্থ হইয়াছে, কার্য্যে প্রবৃত্তি হইয়াছে, ক্ষুধা বেশ লেগেছে। কিন্তু উপবাসান্তে ক্ষুধা লাগিলেও বেশী খাইবে না। বরং “আধ পেটা” ভাল, তবু “ভর পেটা” ভাল নয়। আমাদের একটা মেয়েলী প্রবাদ আছে “উন ভাতে দুনো বল, ভরা ভাতে রসাতল!” কথাটার প্রতিবর্ণ স্বর্ণময় সত্য। উপবাসের উপকারিতা এদেশে চিরসুপ্রসিদ্ধ বলিয়া, শাস্ত্র হইতে সামান্য গ্রাম্য প্রবাদবাক্য পর্য্যন্ত তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। উপবাসে অবহেলা বা অপারগতা এবং ঔদরিকতা, আর দরিদ্র্যদোষে অপুষ্টিকর কুপথ্যপুঞ্জে সেই ঔদরিকতার পরিতর্পণই আমাদের ব্যাধিসঙ্কুলতা ও অল্পায়ুতার প্রধান নিদান। পাকস্থলীতে যে পরিমান আহার ধরে, তাঁহার অর্দ্ধেক খাওয়াই যোগশাস্ত্রের ব্যবস্থা। চিকিৎসাশাস্ত্রেও তাহাই বলে, যথা,—

“ভোজ্যেন পুরয়েদর্দ্ধং পাদমেকন্তু বারিণা।
মরুতশ্চালনার্থঞ্চ চতুর্থমবশেষয়েৎ॥”

 অর্থাৎ পাকস্থলীর অৰ্দ্ধ-ভাগ ভোজ্যে ও সিকি ভাগ জলে পূর্ণ করিবে, ৪র্থ সিকি ভাগ বায়ু চলাচলার্থ শূন্য রাখিবে। তবেই দেখ, শাস্ত্র মতে ঠিক “আধপেটা” আহারগ্রহণই স্বাস্থ্যকর। মোট কথা, ভাতে-জলে বারো আনার বেশী না হয়, এই হিসাবে খাইবে। আর বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করিবে, বিশুদ্ধ জল পান করিবে, লঘু ও পুষ্টিকর আহার করিবে; সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন এবং অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও দুই একাদশীতে[] উপবাস করিবে; দেখিবে, তোমার কোন রোগ থাকিবে না।

 যদি বলবান হইতে চাও, নিয়মিত উপবাস কর; যদি অর্থ বাঁচাইতে চাও, উপবাস কর; যদি ধর্ম্ম অর্জন করিতে চাও, উপবাস কর; যদি অধিক শারীরিক শ্রম করিতে চাও, উপবাস কর; যদি অধিক মানসিক পরিশ্রম করিতে চাও, উপবাস কর।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, এই চতুর্ব্বৰ্গসাধনের প্রধান উপায় উপবাস। অতএব নিয়মিত উপবাস কর। উপবাসেই জীবন, উপবাসেই আমাদের সর্ব্বার্থ-সাধন। শাস্ত্র ভগবদ্বাক্য বলিয়াই উহা স্বতঃসিদ্ধ ‘আপ্ত’ প্রমাণ। সেই শাস্ত্রে ঋষি-বাক্যের উপলক্ষচ্ছলে—ঐ শুন, ভগবানই বলিতেছেন—“সর্ব্বার্থদং তপশ্চর্য্যং উপবাসং কলৌযুগে।” কলিযুগে উপবাসই সর্ব্বার্থসাধন তপস্যা। কলিযুগে “অন্নগত প্রাণ” বলিয়াই, সাধারণতঃ অত্যাহারে সেই প্রাণদ অন্নের অপব্যবহার হয়; অতএব উপবাস-রূপ সাময়িক অনাহার ও দৈনিক অল্পাহার-রূপ মিতাহারই কলির মানবের অবশ্য কর্ত্তব্য।


  1. শাস্ত্র বলেন—
     “অন্নমাশ্রিত্য পাপানি তিষ্ঠন্তি হরিবাসরে।”
     হরিবাসর অর্থাৎ একাদশী-দিনে সমস্ত পাপ আহার্য্য বস্তুকে আশ্রয় করিয়া থাকে—অর্থাৎ একাদশীতে আহার করিলে সর্ব্বপাপভাগী হইতে হয়। ধর্ম্মোন্মত্ত ভারতের জন্য শাস্ত্রের এই শাসন-বাক্যের সূক্ষ্ম লক্ষ্য-রহস্য সুধীজন বুঝিবেন।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।