উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/আদিপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

আদি পর্ব

খন আমরা যাহাকে দিল্লী বলি, সেই দিল্লীর কাঁছে, অনেকদিন আগে, হস্তিনা বলিয়া একটা নগর ছিল৷

 এই হস্তিনার রাজা বিচিত্রবীর্যের ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু নামে দুই পুত্র ছিলেন৷ ধৃতরাষ্ট্র বয়সে বড় ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি অন্ধ ছিলেন৷ অন্ধ যে, সে রাজ্য পায় না৷ কাজেই, বয়সে বড় হইয়াও ধৃতরাষ্ট্র রাজা হইতে পারিলেন না, রাজা হইলেন ছেটো ভাই পাণ্ডু৷

 রাজ্য না পাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র দুঃখিত হইয়াছিলেন বৈকি! তবুও যদি পাণ্ডুর ছেলে হওয়ার আগে তাঁহার ছেলে হইত, তবে সে দুঃখ তিনি সহিয়া থাকিতে পারিতেন, কারণ তাঁহাদের ছেলেদের মধ্যে যে বড়, তাহারই রাজ্য পাইবার কথা ছিল৷ কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের কপালে তাহাও হইল না, পান্ডুরই আগে ছেলে হইল৷ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা যখন বুঝিল, তাহারা রাজ্য পাইবে না, তখন হইতেই তাহাবা প্রাণ ভরিয়া পান্ডব (অর্থাৎ পান্ডুর ছেলে)-দিগকে হিংসা করিতে লাগিল৷

 ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের মধ্যে দুর্যোধন সকলের বড়, তারপর দুঃশাসন, তারপর আরো আটানববুই জন৷ সবসুদ্ধ তাহারা একশত ভাই৷ ইহা ছাড়া দুঃশলা নামে তাহাদের একটি বোনও ছিল৷

 পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র৷ সকলের বড় যুধিষ্ঠির, তারপর ভীম, তারপর অর্জুন, তারপর নকুল ও সহদেব নামে দুটি যমজ ভাই৷ ইঁহারা এক মায়ের ছেলে নহেন৷ পাণ্ডুর দুই রানী ছিলেন৷ বড়র নাম কুন্তী, ছোটর নাম মাদ্রী৷ যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুন, ইহারা কুন্তীর ছেলে৷ নকুল সহদেব মাদ্রীর ছেলে৷ দুই মা হইলে কি হয়? ইঁহাদের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল তেমন ভালোবাসা এক মায়ের ছেলেদের ভিতরেও কম দেখা যায়৷

 এক-একজন দেবতা পাণ্ডু কে এই-সকল পুত্রের এক-একটি দিয়াছিলেন৷ ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে দিয়াছিলেন, পবন ভীমকে দিয়াছিলেন, ইন্দ্ৰ অর্জুনকে আর অশ্বিনীকুমার নামক দুই দেবতা নকুল ও সহদেবকে৷ এইজন্য লোকে বলে যে যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম পবনের পুত্র, অর্জুন ইন্দ্রের পুত্র, নকুল সহদেব অশ্বিনীকুমারদিগের পুত্র৷ এই-সকল দেবতা ইঁহাদিগকে অতিশয় স্নেহ করিতেন৷

 কিন্তু হায়! এই পৃথিবীতে অল্পদিনই ইঁহারা সুখে কাটাইতে পারিয়াছিলেন৷ পাণ্ডু ইহাদিগকে খুব ছোট রাখিয়াই হঠাৎ মারা গেলেন, মৃত্যুর সময় মাতা মাদ্রী তাঁহার কাছে ছিলেন, তিনি মনের দুঃখ সহিতে না পারিয়া পাণ্ডুর চিতার আগুনে ঝাঁপ দিয়া সেই দুঃখ দূর করিলেন৷ ইহার পর আর এমন কেহই রহিল না, যে আপনার বলিয়া মা কুন্তী আর পাঁচটি ভাইয়ের দিকে চায়।

 যাহা হউক, পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গেই রহিলেন। একশো পাঁচটি ছেলের একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে পড়া, একসঙ্গে খেলা, সবই একসঙ্গে হইতে লাগিল।

 খেলার সময় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা ভীমের হাতে বড়ই নাকাল হয়। ভীমের জ্বালায় উহারা ভালো করিয়া খেলিতেই পায় না। খেলা আরম্ভ করিলেই ভীম কোথা হইতে আসিয়া তাহদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করিয়া দেন। ইহারা একশো ভাই, ভীম একেলা। তবুও উহারা কিছুতেই তাঁহাকে আঁটিতে পারে না। তিনি তাহাদিগকে আছড়াইয়া ফেলিয়া চুল ধরিয়া এমনি টান দেন যে, বেচারারা তাহাতে চ্যাঁচাইয়া অস্থির হয়। জলে নামিয়া খেলা করিতে গেলে, তিনি তাহাদের দশজনকে একসঙ্গে জড়াইয়া ধরিয়া ডুব দেন, আর তাহারা আধমরা না হইলে ছাড়েন না। বেচারারা হয়তো ফল পাড়িবার জন্য গাছে উঠিয়াছে, এমন সময় ভীম আসিয়া সেই গাছে লাথি মারিতে থাকেন। লাথির চোটে গাছ এমনি নড়িয়া উঠে যে, ফলের সঙ্গে সঙ্গে উহারাও মাটিতে পড়িয়া যায়। কাজেই উহারা ভীমকে বড়ই হিংসা করে, আর তাঁহার কাছে বড়-একটা ঘেঁষে না।

 ভীমকে যতই দেখে, দুর্যোধনের মনে ততই ভয় হয়, আর ততই তাহার দুষ্টবুদ্ধি বাড়িয়া উঠে। সে কেবলই ভাবে, ‘এই ভীমটাকে বড় হইতে দিলেই তো আমাদের সর্বনাশ! সুতরাং, এইবেলা এটাকে মারিয়া ফেলিতে না পারিলে চলিতেছে না। ভীম মরিলে আর চারিটা ভাইকে বাঁধিয়া রাখিলেই চলিবে।’

 দুষ্ট বসিয়া বসিয়া খালি এইরূপ ভাবে। তারপর একদিন সে সকলকে বলিল, ‘চল আজ গঙ্গাস্নানে যাই!’ এই সহজ কথাটার ভিতর কি ফন্দি রহিয়াছে, তাহা তো পাণ্ডবেরা জানেন না, তাঁহারা কেবল জানেন গঙ্গায় ঝুটোপাটি করিয়া স্নান করিতে যারপরনাই আরাম। সুতরাং, স্নানের কথা শুনিয়াই সকলে ‘যাইব!’ ‘যাইব!’ বলিয়া প্রস্তুত হইলেন।

 প্রমাণকোটিতে গঙ্গাস্নানের আয়োজন হইল। প্রমাণকোটি অতি চমৎকার স্থান। গঙ্গার ধারে বাগান আর সুন্দর বাড়ি। জলযোগের আয়োজন সেখানে ভালো মতই হইয়াছে। কাজেই ছেলেদের আনন্দের আর সীমা নাই। বেশি খুশি অবশ্য মিঠাই দেখিয়া। মিঠাই যে তাঁহারা কি আনন্দ করিয়া খাইলেন, সে কি বলিব। আবার শুধু নিজে খাইয়া তৃপ্তি হয় না, যেটা ভালো লাগে, সেটা ভাইয়ের মুখে তুলিয়া দেওয়া চাই।

 তাহা দেখিয়া দুর্যোধন ভাবিল, ‘এইবার আবার সুবিধা।’ তারপর মিষ্ট মিষ্ট কথা বলিয়া, আর যারপরনাই আদর দেখাইয়া, হাসিতে হাসিতে দুরাত্মা বিষ মাখানো সন্দেশ ভীমের মুখে তুলিয়া দিল। ভীম কি জানেন? তিনি সন্দেশের সঙ্গে বিষ খাইয়া ফেলিলেন, কোনো সন্দেহ করিলেন না।

 তারপর অনেকক্ষণ ধরিয়া স্নান চলিল। শেষে ঝুটোপাটিতে ক্লান্ত হইয়া আর সকলেই কাপড় ছাড়িবার জন্য ঘরে গেলেন, গেলেন না শুধু ভীম। বিষের তেজে, আর তাহার উপর পরিশ্রমে, তিনি এতই দুর্বল হইয়া পড়িলেন যে, গঙ্গার ধারে একটু না শুইয়া থাকিতে পারিলেন না।

 সেইখানে ভীম কখন অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে, দুর্যোধন ছাড়া তাহা আর কেহই জানিতে পারে নাই, ভীম অজ্ঞান হইতেই সেই দুষ্ট, লতা দিয়া তাঁহার হাত-পা বাঁধিয়া তাঁহাকে জলে ফেলিয়া দিল৷

 ভীম জলে ডুবিয়া গেলেন। কিন্তু ভগবান যাঁহাকে রাখেন, হাজার দুষ্টলোক মিলিয়াও তাঁহাকে মারিতে পারে না। ভীম ডুবিলেন বটে, আর অন্য স্থানে পড়িলে তিনি মরিয়াও যাইতেন, তাহাতে ভুল নাই, কিন্তু তাঁহাকে যেখানে ফেলিয়াছিল, ঠিক সেইখান দিয়া ছিল পাতালে যাইবার পথ—যেখানে সাপেরা আর তাহাদের রাজা বাসুকি থাকেন। ভীম সেই পাতালের পথ দিয়া ডুবিতে ডুবিতে একেবারে সেই সাপের দেশে গিয়া পড়িয়াছিলেন। আর পড়িবি তো পড়—একেবারে কতকগুলি সাপের ঘাড়ে! সে বেচারারা তাঁহার চাপে তখনই চেপ্টা হইয়া গেল৷

 তখন যে ভারি একটা গোলমাল হইল, তাহা বুঝিতেই পার। সাপের দল মহারাগে আসিয়া ভীমকে যে কি ভয়ানক কামড়াইতে লাগিল, তাহা আর বলিবার নয়৷

 ইহাতে কিন্তু ভীমের ভালোই হইল, কেননা, ভীমকে যে বিষ খাওয়ানো হইয়াছিল, সাপের বিষই হইতেছে তাহার ঔষধ। কাজেই সাপের কামড়ে ভীমের গায়ের বিষ কাটিয়া গেল। ভীম চক্ষু মেলিয়া উঠিয়া দেখেন, একি আশ্চর্য ব্যাপার! ‘তখন তিনি দুই মিনিটের মধ্যে বাঁধন ছিঁড়িয়া কিল চড়ের ঘায় সাপের বাছাদের কি দুর্দশাই করিলেন! সে কিল যাহারা খাইল, তাহারা তো মরিয়াই গেল। যাহারা পলাইতে পারিল তাহারা ঊর্ধ্বশ্বাসে তাহাদের রাজা বাসুকিকে গিয়া বলিল, “রাজা মহাশয়! সর্বনাশ! একটা মানুষের ছেলে আসিয়া সব মাটি করিল! আপনি শীঘ্র আসুন!”

 এ কথা শুনিয়াই বাসুকি ছুটিয়া দেখিতে আসিলেন, ব্যাপারখানা কি। আসিয়া দেখেন—কি আশ্চর্য! এ যে ভীম! “আরে তাইতো। ও ভীম! তুমি যে আমার নাতির নাতি! এসো ভাই কোলাকুলি করি!” বলিয়া বাসুকি ভীমকে জড়াইয়া ধরিয়া কতই আদর করিলেন! আর ধনরত্নই-বা তাঁহাকে কত দিলেন৷

 শুধু তাহাই নহে, ইহার উপর আবার অমৃত। বাসুকির বাড়িতে অমৃতের ভাণ্ডার ছিল। চৌবাচ্চার পর চৌবাচ্চা সারি সারি সাজানো, তাহা ভরিয়া খালি অমৃত রাখিয়াছে। সাপেরা ভীমকে সেই অমৃতের কাছে নিয়া বলিল, “যত ইচ্ছা খাও!”

 ভীম এক নিশ্বাসে এক চৌবাচ্চা খালি করিয়া দিলেন। তারপর আর-এক নিশ্বাসে আরএক চৌবাচ্চা! আর-এক নিশ্বাসে আর-এক চৌবাচ্চা! এমনি করিয়া আট চৌবাচ্চা অমৃত খাইয়া দেখিলেন, আর পেটে ধরে না৷

 যেমন খাওয়া তেমনি বিশ্রামটি তো চাই! ভীম আট চৌবাচ্চা অমৃত খাইয়া, আটদিন যাবৎ কেবলই ঘুমাইলেন৷

 যুধিষ্ঠির স্নান করিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় ভীমকে দেখিতে পাইলেন না বটে, সেজন্য তখন তাঁহার মনে বেশি চিন্তা হইল না। তিনি ভাবিলেন, হয়তো ভীম আগেই চলিয়া আসিয়াছেন। বাড়ি ফিরিয়া মাকে প্রণাম করিয়াই যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, ভীম যে আমাদের আগে চলিয়া আসিয়াছে, তাহাকে তো দেখিতেছি না। তুমি কি তাহাকে কোথাও পাঠাইয়াছ?”

 এ কথা শুনিয়াই কুন্তী নিতান্ত ব্যস্তভাবে বলিলেন, “সেকি কথা বাবা, আমি তো ভীমকে দেখিতে পাই নাই। হায় হায়, কি হইবে? শীঘ্র তার খোঁজ কর৷”

 তখনই বিদুরকে ডাকানো হইল। বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাকা হন। এমন সরল সাধুলোক পৃথিবীতে খুব কমই জন্মিয়াছে। বিদুর আসিলে কুন্তী সকল কথা তাঁহাকে জানাইয়া, শেষে বলিলেন, “বুঝি-বা দুর্যোধনই আমার ভীমকে মারিয়া ফেলিল। ও দুষ্ট ভীমকে বড়ই হিংসা করে!”

 বিদুর বলিলেন, “বৌদিদি, চুপ, চুপ! আপনার এ কথা দুর্যোধন শুনিতে পাইলে বড়ই বিপদ ঘটাইবে। ভীমের জন্য আপনি কোনো চিন্তা করিবেন না। আমি ব্যাসদেবের মুখে শুনিয়াছি যে, আপনার ছেলেরা অনেকদিন বাঁচিয়া থাকিবেন। ব্যাসের কথা কি মিথ্যা হইতে পারে? আপনার কোনো ভয় নাই, নিশ্চয় ভীম ফিরিয়া আসিবেন!” এই বলিয়া বিদুর চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাঁহার কথায় কুন্তী আর তাঁহার পুত্রগণের মনের দুঃখ ঘুচিল না৷

 এদিকে ভীমও আটদিনের লম্বা ঘুমের শেষে জাগিয়া উঠিয়াছেন। অমৃত খাইয়া তাঁহার শরীরে দশহাজার হাতির বল হইয়াছে। সাপেরা তাঁহাকে স্নান করাইয়া সাদা কাপড় আর সাদা মালা পরাইয়া, পায়স রাঁধিয়া খাওয়াইয়া, পরম আদরের সহিত সেই প্রমাণকোটির স্নানের জায়গায় রাখিয়া গেল। সেখানে আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলিয়া আসিলেন৷

 মরা ছেলে বাঁচিয়া উঠিলে মা-বাপ যেমন খুশি হয়, ভীমকে পাইয়া সকলে তেমনি সুখী হইলেন। তারপর তাঁহার মুখে সকল কথা শুনিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “ভাই সাবধান! এ সব কথা যেন আর কেহ না জানে৷”

 তখন হইতে পাঁচ ভাই যারপরনাই সাবধান হইয়া চলিতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন আর দুর্যোধনের মামা শকুনি কতরকমে তাঁহাদিগকে হিংসা করেন, তাঁহারা সে-সব জানিতে পারিয়াও চুপ করিয়া থাকেন। এইরূপ করিয়া দিন যাইতে লাগিল৷

 শিশুকাল হইতেই লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের ছেলেরা ধনুর্বিদ্যা (অর্থাৎ ধনুক দিয়া তীর ছোঁড়া) শিখিতে আরম্ভ করে। যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতি সকলেই একসঙ্গে কৃপাচার্য নামক একজন খুব ভালো শিক্ষকের নিকট ধনুর্বিদ্যা শিখিতে লাগিলেন৷

 এই সময়ে একদিন ছেলেরা শহরের বাহিরে একটা লোহার গোলা লইয়া খেলা করিতেছিল। খেলিতে খেলিতে গোলাটা একটা শুকনো কুয়ার ভিতরে পড়িয়া গেল, ছেলেরা অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই তাহা তুলিতে পারিল না। গোলা তুলিতে না পারায় অপ্রস্তুত হইয়া তাহারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতেছে, এমন সময়, সেইখান দিয়া একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যাইতেছিলেন। ছিপ্‌ছিপে কালো-হেন লোকটি, পাকাচুল, হাতে তীর-ধনুক। ছেলেদের দুর্দশা দেখিয়া তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দুয়ো! দুয়ো! তোমরা ক্ষত্রিয় হইয়া এই গোলাটা তুলিতে পারিলে না! দুয়ো! দুয়ো! আমাকে কি খাইতে দিবে বল, আমি গোলা তুলিয়া দিতেছি! গোলাও তুলিব, আর আমার এই আংটি কুয়ায় ফেলিতেছি তাহাও তুলিব।” এই কথা বলিয়া তিনি তাঁহার আংটিও কুয়ায় ফেলিয়া দিলেন৷

 তখন যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মহাশয়, আপনি যদি গোলাটা তুলিতে পারেন তবে চিরকাল খাইতে পাইবেন৷”

 ব্রাহ্মণ হাসিতে হাসিতে একমুঠো শর লইলেন। তারপর তাহার একটি শর গোলায় বিঁধাইয়া, সেই শরের পিছনে আর-একটি শর বিঁধাইয়া তাহার পিছনে আবার আর-একটি— এমনি করিয়া কুয়ার মুখ অবধি লম্বা একটা কাঠি প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন। সেই কাঠি ধরিয়া গোলা টানিয়া তুলিতে আর কতক্ষণ লাগে?

 ছেলেরা আশ্চর্য হইয়া বলিল, “আচ্ছা, আংটিটি তুলুন তো!” ব্রাহ্মণ তীর ধনুক লইয়া দেখিতে দেখিতে আংটিও তুলিয়া আনিলেন। ছেলেরা তো অবাক। তখন তাহারা হাত জোড় করিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল, তারপর বলিল, “আপনি নিশ্চয় কোনো মহাপুরুষ হইবেন। বলুন আপনি কে? আর আমরা আপনার কোন কাজ করিব?”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, “তোমাদের আর কিছুই করিতে হইবে না। তোমরা তোমাদের ঠাকুরদাদা মহাশয়ের নিকট গিয়া বল যে, এইরকম এক বুড়া আসিয়াছে।”

 অমনি সকলে ছুটিয়া গিয়া তাহাদের ঠাকুরদাদা ভীষ্মের নিকট সংবাদ দিল। ভীষ্ম সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “বুঝিয়াছি। দ্রোণাচার্য আসিয়াছেন। এ আর কাহারো কর্ম নহে।” ভীষ্মের অনেকদিন হইতেই ইচ্ছা, ছেলেদিগকে দ্রোণাচার্যের হাতে দেন, সেই দ্রোণাচার্য আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত। ইহাতে বড়ই আনন্দিত হইয়া, ভীষ্ম তাঁহাকে পরম আদরের সহিত বাড়িতে লইয়া আসিলেন।

 ভীষ্ম, দ্রোণ, ইঁহারা অতি মহৎ লোক ছিলেন। ইঁহাদের খালি নাম আর পরিচয় শুনিলেই হইবে না, ইঁহাদের কথা আরো বেশি করিয়া জানা চাই।

 দেবতাদের মধ্যে আটজনকে আট বসু বলে। এই বসুরা একবার তাঁহাদের স্ত্রীদিগকে লইয়া সুমেরু পর্বতের কাছে একটি সুন্দর বনে বেড়াইতে গিয়েছিলেন। সেই বনে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম ছিল। বশিষ্ঠের একটি গাই ছিল, তাহার নাম নন্দিনী। এমন সুন্দর গরু আর কখনো হয় নাই, হইবেও না। যত দুধ চাই নন্দিনী তত দুধই দিত আর সে আশ্চর্য দুধ একবাব খাইলে দশ হাজার বৎসর সুস্থ শরীরে বাঁচিয়া থাকা যাইতো।

 বসুদের মধ্যে একজনের নাম দ্যু। তাঁহার স্ত্রীর বড়ই ইচ্ছা হইল, গাইটি লইয়া যাইবেন। উশীনর রাজার কন্যা জিতবতী তাঁহার সখী। সখীকে একবাব এরই গরুর দুধ খাওয়াইতে পারিলে তিনি দশহাজার বৎসর বাঁচিয়া থাকিবেন। আহা, তাহা হইলে কি সুখের কথাই হইবে।

 দ্যুর স্ত্রী যতই এ কথা ভাবেন, ততই তাঁহার গাইটির জন্য মন পাগল হয়, আর ততই তিনি তাঁহার স্বামীকে পীড়াপীড়ি করেন, ওগো লইয়া চল’ লইয়া চল, গাইটি আর বাছুরটি।”

 ইঁহার কথায় শেষে বসুরা আট ভাই মিলিয়া বাছুরসুদ্ধু গাইটিকে চুরি করিলেন।

 বশিষ্ঠ ফলমূল আনিবার জন্য বাহির হইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি নন্দিনীকে লইয়া যাইবার সময় দেখিতে পাইলেন না। কিন্তু মুনিরা ধ্যানে সকল কথাই জানিতে পারেন। কাজেই, তাঁহার চোর ধরিতে বেশি বিলম্ব হইল না। তিনি বসুদিগকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তোরা দেবতা হইয়া এমন কর্ম করিলি, এজন্য তোরা মানুষ হইয়া পৃথিবীতে জন্মাইবি।”

 বসুদের আটজনের মধ্যে দ্যুরই অধিক দোষ ছিল, অন্যদের দোষ তত নহে। তাই শেষে বশিষ্ঠ দয়া করিয়া বলিলেন যে, অপর সাতজন একবৎসর মানুষ থাকিয়াই আবার দেবতা হইতে পারিবে, কিন্তু দ্যুর, যত বৎসর মানুষ বাঁচে, তত বৎসরই পৃথিবীতে থাকিতে হইবে।

 এখন বসুরা তো নিতান্তই সংকটে পড়িলেন। মুনির কথা মিথ্যা হইবার নহে, কাজেই মানুষ হইয়া জন্মিতেই হইবে। সুতরাং আর উপায় না দেখিয়া তাঁহারা গঙ্গাদেবীকে বলিলেন, “মা। পৃথিবীতে যদি জন্মিতেই হয় তবে যে-সে বাপ-মায়ের ছেলে হইয়া যেন আমরা না জন্মাই, এমনি করিয়া দাও। হস্তিনার রাজা প্রতীপের শান্তনু নামক অতিশয় ধার্মিক পুত্র হইবেন আমরা তাঁহারই পুত্র হইব। আর আমাদের মা হইবে তুমি নিজে। আমাদের জন্যে মা তোমাকে মানুষ হইয়া পৃথিবীতে যাইতেই হইতেছে। তোমার সঙ্গে আমাদের এই কথা রহিল যে, আমাদের জন্মের পরেই তুমি আমাদিগকে জলে ফেলিয়া দিবে৷”

 বসুগণের মিনতি দেখিয়া গঙ্গা তাঁহাদের কথায় রাজি হইলেন৷

 পরম ধার্মিক রাজা প্রতীপ গঙ্গার ধারে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া ভগবানের চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় গঙ্গাদেবী একটি সুন্দরী কন্যা হইয়া তাঁহার কোলে গিয়ে বসিলেন। প্রতীপ চক্ষু মেলিয়া দেখিয়া দেখিয়া নিতান্ত আশ্চর্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে মা, বৌমার মতন আসিয়া আমার কোলে বসিলে? আমার পুত্র হইলে তোমাকে তাহার সঙ্গে বিবাহ দিব৷”

 গঙ্গা বলিলেন, “আচ্ছা দিবেন। কিন্তু আমার একটি কথা রাখিতে হইবে আমি যখন যাহা করিব, হাজার মন্দ বোধ হইলেও আপনার পুত্র তাহাতে বাধা দিতে পারিবেন না, তাহার জন্য আমাকে তিরস্কার করিতে পারিবেন না৷” রাজা এ কথায় সম্মত হইবামাত্র, গঙ্গা আকাশে মিলাইয়া গেলেন৷

 প্রতীপের পুত্র হইলে, তাঁহার নাম শান্তনু রাখা হইল। শান্তনু দেখিতে যেমন সুন্দর ছিলেন, ধর্মে, বিদ্যায়, স্বভাবে এবং অন্য সকল গুণেও তেমনি। তাহা দেখিয়া প্রতীপ মনে সুখে তাঁহার হাতে রাজ্যের ভার দিয়া, তপস্যা করিবার জন্য বনে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় তাঁহাকে বলিলেন, “বাবা, একটি দেবতার মেয়ে আমার বৌমা হইতে রাজি হইয়াছিলেন। তাঁহার দেখা পাইলে তুমি তাঁহাকে বিবাহ করিবে, আর তাঁহার মন বুঝিয়া সর্বদা চলিতে চেষ্টা করিবে। তাঁহার কোনো কাজে কখনো বাধা দিও না, বা অসন্তুষ্ট হইও না!”

 যুদ্ধের কাজটা রাজাদের খুব ভালো করিয়াই শিখিতে হয়, আর সর্বদা তাহার অভ্যাস রাখিতে হয়। এইজন্য শিকার তাঁহাদের একটা খুব দরকারি কাজের মধ্যে। শান্তনু শিকার করিতে বড়ই ভালোবাসিতেন। একদিন শিকার করিতে করিতে তিনি গঙ্গার ধারে আসিয়া একটি পরমাসুন্দরী কন্যাকে দেখিতে পাইলেন। এমন সুন্দর মানুষ তিনি আর কখনো দেখেন নাই। তাঁহাকে তাঁহার এতই ভালো লাগিল যে, তিনি তাঁহার সঙ্গে কথা না বলিয়া থাকিতে পারিলেন না৷

 শান্তনু বলিলেন, “আপনি কি দেবতা, না দানব, না অপ্সরা, না যক্ষ, না মানুষ? আপনাকে আমার রানী করিতে পারিলে বড়ই সুখী হইব৷”

 সেই মেয়েটি আর কেহ নহে, গঙ্গা। গঙ্গা বলিলেন, “মহারাজ, আমি আপনার রানী হইব, কিন্তু আমার একটা নিয়ম আছে। আমার কোনো কাজে আপনি বাধা দিতে পারিবেন না, বা অসন্তোষ দেখাইতে পারিবেন না। যদি কখনো বাধা দেন, বা অসন্তুষ্ট হন, তবে তখনই আমি চলিয়া যাইব৷”

 শান্তনু এই নিয়মে রাজি হইয়া পরমাসুন্দরী রানী লইয়া ঘরে ফিরিলেন। তারপর তাঁহাদের দিন খুবই সুখে যায়৷

 কিন্তু ইহার মধ্যে একটা ভারি দুঃখের বিষয় হইয়া উঠিল। রাজার দেবকুমারের মতো সুন্দর এক-একটি ছেলে হয়, আর অমনি রানী তাহাকে গঙ্গায় ফেলিয়া দেন। দুঃখে রাজার বুক ফাটিয়া যায়, তবুও কিছু বলিতে সাহস পান না, পাছে রানী বলেন, “আমি চলিলাম!”

 একটি নয়, দুটি নয়, রানী ক্রমে সাতটি ছেলে এইভাবে জন্মের পরই গঙ্গায় ফেলিয়া দিলেন, সাতবার রাজা চুপ করিয়া দুঃখ সহ্য করিলেন। তারপর যখন আর-একটি ছেলে হইল, তখন রানী হাসিতে লাগিলেন। কিন্তু রাজার প্রাণে আর কত সহ্য হইবে? এই একটি ছেলেকে রাখিতে পারিলেও বুঝি তাঁহার প্রাণ একটু শীতল হয়! এই ভাবিয়া তিনি সকল কথা ভুলিয়া গিয়া এবারে রানীকে বাধা দিলেন। বলিলেন, “হায় হায়, এটিকে মারিও না, কেন তুমি এমন নিষ্ঠুর হইলে? এমন পাপ কি করিতে আছে?”

 রানী বলিলেন, “মহারাজ, এই লও তোমার ছেলে। কিন্তু নিয়মের কথা মনে আছে তো? আমি চলিলাম, তোমার মঙ্গল হউক!”

 তখন গঙ্গা তাঁহার নিজের কথা আর আটজন বসুর কথা রাজাকে বুঝাইয়া বলিয়া, আর ছেলেটি তাহাকে দিয়া, আকাশে মিলাইয়া গেলেন।

 সেই ছেলেটির নাম দেবব্রত আর গাঙ্গেয়, এই দুই নাম রাখা হইল। দেবব্রত খুব ছোট থাকিতেই শান্তনু তপস্যা করিতে বনে চলিয়া গেলেন।

 গঙ্গার ধারেই সেই বন। সেখানে অনেক বৎসর ধরিয়া শান্তনু তপস্যা করিলেন, ততদিনে দেবব্রতও বেশ বড় হইয়া উঠিলেন। রূপে, গুণে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে এই পৃথিবীতে দেবব্রতের সমান কেই রহিল না।

 এমন সময়, একদিন দেবব্রত হরিণ শিকারে বাহির হইয়াছে। আর একটা হরিণ তাঁর তীর খাইয়া পলায়ন করাতে, তাহাকে ধরিবার জন্য তিনি ভয়ংকর তীর ছুঁড়িয়া গঙ্গার জল প্রায় শুষিয়া ফেলিয়াছেন।

 সেইখানে শান্তনু থাকেন। হঠাৎ গঙ্গার জল কেন শুকাইয়া গেল, তাহা জানিতে গিয়া, দেবব্রতের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। কিন্তু দেবব্রত তাঁহাকে দেখিতে পাইয়াই অন্য দিকে চলিয়া গেলেন। যাহাই হউক, শান্তনুর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, এটি তাঁহারই পুত্র। তাই তিনি গঙ্গাকে স্মরণ করিয়া বলিলেন, “আমার পুত্রকে আবার দেখাও।”

 তখন গঙ্গা দেবব্রতকে শান্তনুর নিকট উপস্থিত করিয়া বলিলেন, “মহারাজ, এই তোমার সেই পুত্র। আমি ইহাকে বড় করিয়াছি। এই কুমার দেবতার অতিশয় প্রিয়পাত্র। বশিষ্ঠের নিকট সকল বেদ আর বৃহস্পতি ও শুক্রের নিকট সকল শাস্ত্র পড়িয়াছে। পরশুরাম ধনুর্বিদ্যা যত জানেন, সব ইহাকে শিখাইয়াছেন। ইহাকে লইয়া তুমি ঘরে ফিরিয়া যাও।”

 এমন সুন্দর পুত্র পাইয়া রাজা মনের সুখে আবার রাজ্যে ফিরিয়া আসিলেন, আর কিছুদিন পরেই তাঁহাকে যুবরাজ করিয়া দিলেন।

 ইহার মধ্যে একদিন শান্তনু বনের ভিতরে বেড়াইতে গিয়া, দেবতার মতো সুন্দরী একটি কন্যা দেখিতে পাইলেন। সেই কন্যার দেহের এমনি অপরূপ সৌরভ যে, সমস্ত বন তাহাতে ভরিয়া গিয়াছে। রাজা আশ্চর্য হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

 কন্যা বলিল, “আমি জেলের মেয়ে।”

 মেয়েটির নাম সত্যবতী। আসলে সে জেলের মেয়ে নহে, জেলে তাহাকে একটা মাছের পেটের ভিতরে পাইয়া মানুষ করিয়াছিল। লোকে জানে যে, সে সেই জেলেরই মেয়ে।

 যাহা হউক, রাজা অবিলম্বে সেই জেলের কাছে গিয়া বলিলেন, “আমি তোমার মেয়েকে বিবাহ করিতে চাহি।”

 জেলে বলিল, “ইহার যে ছেলে হইবে, তাহাকে যদি আপনার সমস্ত রাজ্য দেন, তবে বিবাহ দিব, নহিলে দিব না।”

 যদিও সেই মেয়েটিকে বিবাহ করিতে রাজার বড় ইচ্ছা হইয়াছিল, তথাপি দেবব্রতকে ছাড়িয়া অন্য কাহাকেও রাজ্য দিতে তিনি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলেন না। সুতরাং সত্যবতীকে না লইয়া নিতান্ত দুঃখের সহিত তাঁহাকে ঘরে ফিরিতে হইল। সে দুঃখ এতই যে, তিনি তাহাতে দিন-দিন রোগা হইয়া যাইতে লাগিলেন।

 দেবব্রত ভাবিলেন, তাইতো, বাবাকে কেন এমন দেখিতেছি?’ একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা কি হইয়াছে?”

 রাজা বলিলেন, “আর কি হইবে বাবা! তোমার জন্যই ভাবি, তোমার পাছে কোনো অসুখ হয়, তাই আমার চিন্তা।”

 দেবব্রত বুড়া মন্ত্রীকে বলিলেন, “মন্ত্রীমহাশয়, বাবার তো বড়ই অসুখ।” মন্ত্রী সকল কথাই জানেন, তিনি সেই জেলের মেয়ের কথা দেবব্রতকে বলিলেন।

 এ কথা শুনিবামাত্র, অমনি দেবব্রত সবান্ধবে জেলের নিকট গিয়া বলিলেন, “আমার পিতার সহিত আপনার মেয়ের বিবাহ দিন।”

 জেলে দেবব্রতকে অতিশয় আদর করিয়া বলিল, “রাজপুত্র আপনি যাহা বলিলেন, আমার পক্ষে তাহার চেয়ে সৌভাগ্যের কথা আর কি হইতে পারে? কিন্তু আমার মনে হইতেছে যে, এই বিবাহ হইলে শেষে একটা বিষম ঝগড়া ঝাঁটির কারণ হইবে। আপনার মতো বীরের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া কি আর কেহ বাঁচিয়া থাকিতে পারে?”

 দেবব্রত বুঝিলেন যে, পাছে রাজা লইয়া সত্যবতীর ছেলেদের সঙ্গে তাঁহার ঝগড়া হয়, জেলে সেই ভয় করিতেছে। তিনি তখনই বলিলেন “আমার সঙ্গে আপনার নাতিদের ঝগড়া হইবার কোনো ভয় থাকিবে না। কারণ, আমি এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি রাজ্য লইব না, আপনার নাতিই আমাদের রাজা হইবে।”

 জেলে বলিল, “রাজপুত্র, আপনি অতি মহাশয় লোক—আপনি যে আপনার কথামত কাজ করিবেন, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু আপনার ছেলেরা তো এ কথায় রাজি না হইতে পারেন!”

 দেবব্রত বলিলেন, “আমার যদি ছেলে না হয়, তবে তো আর সে রাজ্য চাহিতে আসিবে না! আমি আবার এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি বিবাহ করিব না।”

 এ কথায় জেলে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়া বলিল, “তবে আপনার পিতাকেই মেয়ে দিব।”

 এদিকে আকাশ হইতে দেবতারা দেবব্রতের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আর তিনি যে ভয়ানক প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার জন্য তাঁহার নাম দিলেন ‘ভীষ্ম’ অথাৎ ভয়ানক লোক। তখন হইতে সকলে তাঁহার ‘দেবব্রত’ নাম ছড়িয়া দিয়া তাঁহাকে 'ভীষ্ম’ বলিয়াই ডাকিত।

 জেলের অনুমতি লইয়া ভীষ্ম সত্যবতীকে বলিলেন “মা, রথে উঠুন ঘরে যাই!”

 এইরূপে ভীষ্ম সত্যবতীকে আনিয়া পিতার সহিত বিবাহ দিলেন। শান্তনু তাঁহার এইকাজে কত সুখী হইলেন, বুঝিতেই পার। তিনি তাঁহাকে এই বলিয়া বর দিলেন, “তোমার মরিতে ইচ্ছা না হইলে কিছুতেই তোমার মৃত্যু হইবে না৷”

 সত্যবতীর চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য নামে দুইটি পুত্র জন্মিবার পরে শান্তনুর মৃত্যু হয়। তখন চিত্রাঙ্গদ বড় হইয়াছে, বিচিত্রবীর্য শিশু। ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজা করিলেন। কিন্তু ইহার কিছুকাল পরেই এক গন্ধর্বের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হইল। বিচিত্রবীর্যের তখনো রাজা হওয়ার বয়স হয় নাই, ভীষ্ম তাঁহার হইয়া রাজ্যের কাজ দেখিতে লাগিলেন৷

 ক্রমে বিচিত্রবীর্যের বিবাহের বয়স হইল। এই সময়ে ভীষ্ম শুনিতে পাইলেন যে, কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকার স্বয়ম্বর হইবে। স্বয়ম্বর, কিনা নিজে দেখিয়া বিবাহ করা। দেশ-বিদেশের রাজা ডাকিয়া মস্ত সভা হয়, কন্যা মালা হাতে সেই সভাতে আসিয়া যাঁহার গলায় সেই মালা পরাইয়া দেন, তাঁহার সঙ্গেই তাঁহার বিবাহ হয়। ইহারই নাম ‘স্বয়ম্বর'। স্বয়ম্ববের কথা শুনিয়াই ভীষ্ম ভাবিলেন যে, তিনটি মেয়েকে আনিয়া তাঁহার ভাইয়ের সহিত বিবাহ দিবেন৷

 কাশীরাজের বাড়িতে স্বয়ম্বরের সভা আরম্ভ হইয়াছে, আর তাঁহার কন্যাদের রূপগুণের কথা শুনিয়া ভারতবর্ষের প্রায় সকল রাজাই তাঁহাদিগকে বিবাহ করিবার আশায় সেখানে আসিয়াছেন। এমন সময় ভীষ্ম তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আমি আমার ভাইয়ের জন্য এই মেয়ে তিনটিকে চাহিতেছি। ক্ষত্রিয়ের মেয়েদের যে কেবল স্বয়ম্বর করিয়াই বিবাহ হয়, তাহা তো নহে, বিবাহ অনেকরকমেই হইতে পারে। তাহার মধ্যে জোর করিয়া মেয়ে লইয়া গিয়া বিবাহ দিতে পারিলেই লোকে খুব ভালো বলিয়া থাকে। সুতরাং এই দেখ, আমি জোর করিয়া মেয়ে লইয়া যাইতেছি। তোমরা পার তো আমাকে আটকাও৷”

 এই বলিয়া তিনি মেয়ে তিনটিকে রথে তুলিয়া লইয়া চলিলেন। রাজারা সকলে ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াও তাঁহাদিগকে রাখিতে পারিলেন না। সকলের শেষে রাজা শাল্ব প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কিন্তু ভীষ্মের হাতে তাঁহারাও খুবই দুর্দশা হইল৷

 তারপর ভীষ্ম সেই তিনটি মেয়েকে যারপরনাই আদরের সহিত বাড়িতে আনিয়া বিচিত্রবীর্যের সহিত তাঁহাদের বিবাহ দিবার আয়োজন করিতেছিলেন, এমন সময় অম্বা বলিলেন, “আমি শাল্বকে ভালোবাসি, আর মনে মনে তাঁহাকেই বিবাহ করিয়াছি৷”

 এ কথায় অম্বাকে ছাড়িয়া দিয়া, অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হইল। সেই অম্বিকার ছেলে ধৃতরাষ্ট্র, আর অম্বালিকার ছেলে পাণ্ডু৷

 ভীষ্ম এমনি মহাপুরুষ ছিলেন৷

 আর দ্রোণও নিতান্ত কম লোক ছিলেন না। দ্রোণ, অর্থাৎ কলসীর ভিতর জন্মিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার নাম দ্রোণ, তিনি ভরদ্বাজ মুনির পুত্র; দ্রোণ অনেক তপস্যা করিয়াছিলেন, সকলরকম বিদ্যা, বিশেষত, ধনুর্বিদ্যা, খুব ভালোরূপেই শিখিয়াছিলেন। তারপর পরশুরামের নিকট তাঁহার সমস্ত অস্ত্র পাইয়া তিনি এমন হইয়াছিলেন যে, তাঁহার সামনে কেহ দাঁড়াইতেই পারিত না৷

 পাঞ্চাল দেশের রাজা পৃষতের পুত্র দ্রুপদের সহিত দ্রোণের ছেলেবেলায় বন্ধুতা হইয়াছিল। তখন দ্রুপদ দ্রোণকে বলিয়াছিলেন, “বন্ধু! আমি রাজা হইলে, সত্য করিয়া বলিতেছি, আমার যাহা কিছু সব তোমারই হইবে৷” সেই ছেলেবেলার কথা দ্রোণের মনে ছিল৷

 বড় হইয়া দ্রোণ কৃপাচার্যের ভগিনীকে বিবাহ করেন, এবং অশ্বত্থামা নামে তাঁহার একটি পুত্র হয়। দ্রোণ অতিশয় দরিদ্র ছিলেন, ছেলেকে দুধ কিনিয়া খাওয়াইবার শক্তি তাঁহার ছিল না। অন্য ছেলেদিগকে দুধ খাইতে দেখিয়া একদিন অশ্বত্থামা কাঁদিতে লাগিলেন। সেই ছেলেরা ‘পিঠালি’ গোলা জল আনিয়া তাঁহাকে বলিল, “এই দুধ খাও৷” অশ্বত্থামা সেই পিঠালির জল খাইয়াই “দুধ খাইয়াছি” বলিয়া নাচিয়া অস্থির। তখন ছেলেরা হাততালি দিয়া বলিল, “ছি ছি! তোর বাপের পয়সা নাই, তোকে দুধ কিনিয়া দিতে পারে না!”

 ইহাতে দ্রোণের মনে খুব কষ্ট হওয়ায়, তিনি দ্রুপদের সেই ছেলেবেলার কথাগুলি মনে করিয়া ভাবিলেন, ‘একবার বন্ধুর কাছে যাই, এ দুঃখ দূর হইবে৷’

 দ্রোণ অনেক আশা করিয়া দ্রুপদের কাছে গেলেন। কিন্তু দ্রুপদ আর সে দ্রুপদ নাই, বড় হইয়া আর রাজ্য পাইয়া, তিনি আর-এক রকম হইয়া গিয়াছেন৷

 দ্রোণ বলিলেন, “বন্ধু! সেই যে তুমি বলিয়াছিলে, রাজা হইলে আমাকে কত সুখে রাখিবে, তাই আমি আসিয়াছি৷”

 দ্রুপদ বলিলেন, “বল কি, ঠাকুর? আমি রাজা, আর তুমি ভিখারি, তুমি নাকি আবার আমার বন্ধু। ছেলেবেলায় তোমাকে কি বলিয়াছি তাহা কে মনে রাখিয়াছে? চাহ তো না হয় তোমাকে একবেলা চারিটি খাইতে দিতে পারি৷”

 এইরূপ অপমান পাইয়া দ্রোণ সেখান হইতে হস্তিনায় চলিয়া আসিয়াছেন, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন যে, ‘ইহার শোধ লইতে হইবে৷’

 হস্তিনায় আসিয়া দ্রোণ যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতির গুরু হইলেন। তাঁহাদিগকে তিনি বলিলেন, ‘বাছাসকল! আমি খুব ভালো করিয়া তোমাদিগকে ধনুর্বিদ্যা শিখাইব, কিন্তু শেষে তোমাদিগকে আমার একটা কাজ করিয়া দিতে হইবে৷’

 এ কথায় সকলেই চুপ করিয়া রহিল, কেবল অর্জুন বলিলেন, ‘হ্যাঁ, গুরুদেব! আপনার কাজ অবশ্যই করিয়া দিব৷’

 আহা, এই কথাগুলি না জানি বুড়ার কাছে কতই মিষ্ট লাগিয়াছিল! তিনি অর্জুনকে জড়াইয়া ধরিয়া চোখের জলে তাঁহাকে ভিজাইয়া দিলেন৷

 রাজপুত্রদের শিক্ষা আরম্ভ হইল। দ্রোণের কাছে শিক্ষা পাইবার লোভে বাহিরেরও দু-একটি রাজপুত্র আসিলেন। আর-একটি ছেলে আসিলেন, তাহার নাম কর্ণ। লোকে বলে, কর্ণ অধিরথ নামক এক সারথির ছেলে৷

 কর্ণের সঙ্গে প্রথম হইতেই অর্জুনের শত্রুতা হইয়া গেল। কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে বড়ই রেষারেষি করেন, আর দুর্যোধনের সঙ্গে জুটিয়া যুধিষ্ঠির আর তাঁহার ভাইদিগকে অপমান করেন৷

 যাহা হউক, অর্জুনের সমান কেহই শিখিতে পারিল না। শিখিবার জন্য তাঁহার যত্ন দেখিয়া দ্রোণ বলিলেন, ‘তোমাকে এমনি ভালো করিয়া শিখাইব যে, তোমার সমান আর পৃথিবীতে কেহ থাকিবে না৷’

 ছেলেদের শিক্ষা বেশ ভালো করিয়াই হইল। দুর্যোধন আর ভীম গদা খেলায় খুব মজবুত হইলেন, নকুল সহদেব খড়্গে, রথ চালাইতে যুধিষ্ঠির, আর ধনুকে যে অর্জুন, তাহা বুঝিতেই পার। ভীম আর অর্জুনের ক্ষমতা দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আর হিংসায় বাঁচে না৷

 ইঁহাদের পরীক্ষা লইবার জন্য দ্রোণ চুপিচুপি এক কারিগরকে দিয়া একটা নীল পক্ষী প্রস্তুত করাইলেন। তারপর সেটাকে এক গাছের আগায় রাখিয়া, রাজপুত্রদিগকে ডাকাইয়া বলিলেন, ‘তোমরা তীর-ধনুক লইয়া প্রস্তুত হও। এক-একবার এক-একজনকে আমি তীর ছুঁড়িতে বলিব। আমার কথা শেষ হইতে না হইতে তাহাকে ঐ পাখিটার মাথা কাটিয়া ফেলিতে হইবে৷’

 সকলের আগে যুধিষ্ঠিরের ডাক পড়িল। যুধিষ্ঠির ধনুক উঠাইয়া পাখির দিকে তাকাইয়া প্রস্তুত। দ্রোণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি দেখিতেছ?’

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘গাছ দেখিতেছি, আপনাদের সকলকে দেখিতেছি, আর পাখিটাকে দেখিতেছি৷’

 ইহাতে এই বুঝা গেল যে, যুধিষ্ঠিরের নজর ঠিক হয় নাই, তিনি এদিক-ওদিক তাকাইতেছেন। কাজেই এই কথা শুনিয়া দ্রোণ মুখ সিঁটকাইয়া বলিলেন, ‘তবে তুমি পারিবে না। তুমি সরিয়া দাঁড়াও৷’

 এইরূপে এক-একজন করিয়া সকলেই আসিলেন, সকলেই লজ্জা পাইয়া ফিরিয়া গেলেন৷

 শেষে আসিলেন অর্জুন। তাঁহাকেও দ্রোণ ধনুক উঠাইয়া পাখির দিকে তাকাইতে বলিয়া, তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি দেখিতেছ?’

 অর্জুন বলিলেন, ‘আমি কেবল পাখিই দেখিতে পাইতেছি, আর তো কিছু দেখিতেছিনা৷’

 দ্রোণ বলিলেন, ‘সমস্তটা পাখিই দেখিতে পাইতেছ?’

 অর্জুন বলিলেন, ‘না, পাখির কেবল মাথাটুকু দেখিতেছি, আর কিছু না৷’

 এইবার দ্রোণ সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, ‘তবে তীর ছোড়৷’

 কথাটা ভালো করিয়া শেষ হইতে না হইতেই অর্জুন তীর ছাড়িয়া দিলেন কাটা মাথুসুদ্ধ পাখিও মাটিতে পড়িয়া গেল৷

 এমন আশ্চর্য শিক্ষা কি সকলের হয়? দ্রোণের আনন্দ আর ধরে না। তিনি অর্জুনকে বুকে চাপিয়া মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, আমার পরিশ্রম সার্থক হইল। অর্জুন আমার কাজ করিয়া দিতে পারিবে৷

 আর-একদিন স্নানের সময় দ্রোণকে কুমিরে ধরিল। সে ভয়ংকর কুমির দেখিয়া রাজপুত্রদের বুদ্ধিসুদ্ধি কোথায় যে চলিয়া গেল, তাঁহারা খালি ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া আছে, নড়িবার-চড়িবার ক্ষমতা নাই। অর্জুন ইহার মধ্যে ঝকঝকে পাঁচটি বাণ মারিয়া কুমিরকে খণ্ড-খণ্ড করিয়াছেন৷

 দ্রোণ ইচ্ছা করিলেই কুমির মারিয়া চলিয়া আসিতে পারিতেন। কিন্তু রাজপুত্রদিগকে পরীক্ষা করিবার জন্য তিনি তাহা না করিয়া, কেবল ডাকিতেছিলেন, ‘রাজপুত্রগণ! আমাকে বাঁচাও!’ অর্জুনের বুদ্ধি আর সাহস দেখিয়া তিনি তাঁহাকে ‘ব্রহ্মশিরা’ নামক একটি আশ্চর্য অস্ত্র পুরস্কার দিলেন৷

 এটি বড় ভয়ংকর অস্ত্র। তাই দ্রোণ, অর্জুনকে সেই অস্ত্র ছড়িবার আর থামাইবার সংকেত শিখাইয়া, তারপর সাবধান করিয়া দিলেন, ‘দেখিও, যেন মানুষের উপরে এ অস্ত্র কদাচ ছাড়িও না, তাহা হইলে সব ভস্ম হইয়া যাইবে। কোন দেবতার সঙ্গে যুদ্ধ হইলেই এ অস্ত্র ছড়িতে পার৷’

 অর্জুন গুরুকে প্রণাম করিয়া, জোড়হাতে অস্ত্রখানি লইলেন৷

 এমনি করিয়া রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা শেষ হইল। সকলেই বড়-বড় বীর হইয়াছে এখন সকলকে ডাকিয়া ইঁহাদের বিদ্যার পরীক্ষা দেখাইবার সময় উপস্থিত। পরীক্ষার আয়োজন খুব ধুমধামের সহিত হইতে লাগিল। এক দিকে প্রকাণ্ড মাঠে শত-শত রাজমিস্ত্রী খাটিতেছে, আর-এক দিকে পরীক্ষার সংবাদ লইয়া দূতেরা দেশ-বিদেশে ঢোল পিটাইয়া ফিরিতেছে। লোকের উৎসাহের আর সীমা নাই। বুড়া ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত বলিলেন, ‘এতদিনে অন্ধ বলিয়া আমার মনে দুঃখ হইতেছে, এমন খেলা আমি দেখিতে পাইলাম না।’

 পরীক্ষার দিন উপস্থিত। লোকজন যে কত আসিয়াছে তাহার সীমা-সংখ্যা নাই। নিশানে, ঝালরে, মণি-মুক্তায় সভাটি ঝলমল্ করিতেছে। খেলার জায়গা, অস্ত্র রাখিবার জায়গা, বাজনদারদের জায়গা, স্ত্রীলোকদের বসিবার জায়গা, রাজারাজড়াদের বসিবার জায়গা, সাধারণ লোকদের বসিবার জায়গা, সব এমন সুন্দর করিয়া সাজানো আর গুছানো যে দেখিলে আশ্চর্য বোধ হয়। লোকের কোলাহল আর বাজনার শব্দ মিশিয়া সমুদ্রের গর্জনকে হারাইয়া দিতেছে। সভার মধ্যে ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, কৃপাচার্য এবং আর-আর সকলে বসিয়াছে। মেয়েদের জায়গায়, কুন্তী, গান্ধারী (দুর্যোধনের মা) প্রভৃতি সকলে দাসী চাকরাণী লইয়া উপস্থিত। এমন সময়ে দ্রোণাচার্য তাঁহার পুত্র অশ্বত্থামাকে সঙ্গে লইয়া রঙ্গভূমি অর্থাৎ খেলার জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার চুল সাদা, দাড়ি সাদা, ধুতি সাদা, চাদর সাদা। বুকের উপরে সাদা পৈতা, গলায় সাদা ফুলের মালা, গায় শ্বেত চন্দন৷

 তারপর সকলের আগে দেবতার পূজা হইলে, চাকরেরা অস্ত্র-শস্ত্র আনিয়া রঙ্গভূমিতে উপস্থিত করিল৷

 এদিকে রাজপুত্রেরা সাজগোছ করিয়া প্রস্তুত! প্রত্যেকের পরনে সুন্দর দামী পোশাক, কোমরে কোমরবন্ধ, আঙ্গুলে আঙ্গুলপোষ (অর্থাৎ আঙ্গুল বাঁচাইবার জন্য চামড়ার ঢাকনা), হাতে ধনুক, পিঠে তৃণ। যুধিষ্ঠির সকলের বড় বলিয়া সকলের আগে, তারপর যিনি যত ছোট, তিনি তত পিছনে, এমনি করিয়া তাঁহারা রঙ্গভূমির দিকে আসিতে লাগিলেন। রাজপুত্রদের সুন্দর পোশাক আর উজ্জ্বল চেহারা দেখিয়া সকলেই আশ্চর্য হইল। তারপর তাঁহারা নানারকম অস্ত্র ছুঁড়িতে আরম্ভ করিলে, অনেকে খুব ভয়ও পাইল৷

 সেদিন দুর্যোধন আর ভীমের গদার খেলা বড়ই অদ্ভুত হইয়াছিল। এমন খেলা আর কেহ দেখে নাই। তাঁহারা বাহবাও পাইয়াছিলেন যতদুর হইতে হয়। এদিকে তাঁহাদের হাতির মতো গর্জন শুনিয়া দ্রোণ একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। ইহার পরই হয়তো ইহারা চটিয়া গিয়া মুস্কিল বাধাইবেন। কাজেই তাড়াতাড়ি ইহাদিগকে থামাইয়া দিতে হইল৷

 তারপর অর্জুনকে আসিতে দেখিয়া লোকের আনন্দ আর ধরে না। কেহ বলে, ‘আরে ঐ অর্জুন! কেহ বলে, ইনি ভারি যোদ্ধা!’ কেহ বলে, ‘ইনি বড়ই ধার্মিক!’

 অর্জুন কি আশ্চর্য খেলাই দেখাইলেন। একবার অগ্নিবাণে ভীষণ আগুন জ্বালিয়া তিনি সকলের ত্রাস লাগাইয়া দিলেন। তারপরেই আবার বরুণবাণে জলের বন্যা বহাইয়া আগুন নিভাইয়া ফেলিলেন, এখন সকলে তল না হইলে বাঁচে! তখনই আবার বায়ুবাণ ছুটিল, অমনি জল উড়িয়া গিয়া সব পরিষ্কার ঝর্‌ঝরে! পর্জন্যাস্ত্রে তারপরের মুহূর্তেই মেঘ আসিয়া আকাশ অন্ধকার করিয়া ফেলিল!

 ভৌমাস্ত্র মারিয়া তিনি মাটির ভিতর ঢুকিয়া গেলেন। পর্বতাস্ত্র মারিয়া কোথা হইতে বিশাল এক পর্বত আনিয়া ফেলিলেন। তারপর যখন অন্তর্ধান অস্ত্র মারিলেন, তখন আর কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না৷

 আর কত বলিব? অর্জুন সকলকে অবাক করিয়া তবে ছড়িলেন৷

 এইরূপে খেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, বাজনা থামিয়াছে, সকলে বাড়ি যাইবে, এমন সময় ফটকের কাছে ও কিসের গর্জন? সকলে বলে, ‘একি, বাজ পড়িল? না পর্বত ফাটিল?’

 বাজও পড়ে নাই, পর্বতও ফাটে নাই। উহা কর্ণের হুঙ্কার, আর কিছুই নহে। কর্ণকে যেমন-তেমন লোক মনে করিও না। কেহ বলে তিনি সূর্যের পুত্র, কেহ বলে তিনি অধিরথ নামক সারথির পুত্র। কিন্তু আসলে তিনিও কুন্তীরই পুত্র, অধিরথের কেহ নহেন। কুন্তী কর্ণের মা হইয়াও তাঁহার প্রতি মায়ের কাজ করেন নাই, জন্মিবার পরেই তিনি তাঁহাকে ফেলিয়া দেন৷

 সেই শিশুটিকে অধিরথ কুড়াইয়া পাইয়া তাহার স্ত্রী রাধার নিকট আনিয়া দিল, আর দুজনে মিলিয়া পরম যত্নে তাঁহাকে মানুষ করিতে লাগিল। নিজেদের ছেলেপিলে নাই, তাই এমন সুন্দর শিশুটিকে পাইয়া তাহারা ভাবিল যেন দেবতা দয়া করিয়া তাহাদিগকে একটি পুত্র দিলেন, তখন হইতেই লোকে ভাবে যে কর্ণ অধিরথ আর রাধার ছেলে। কর্ণও ইহাদিগকে পিতা-মাতার মতন মান্য করেন আর ভালোবাসেন। তিনি জানেন না যে তিনি যুধিষ্ঠিরদের ভাই৷

 জন্মাবধিই কর্ণের কানে কুণ্ডল আর পরনে কবচ (অর্থাৎ বর্ম বা যুদ্ধের পোশাক) ছিল। দেখিতে তিনি খুব উঁচু, খুব সুন্দর আর ফরসা, গায় সিংহের মতন জোর। তাঁহাকে দেখিয়াই সকলে ‘ইনিকে? ইনি কে?’ বলিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিল৷

 কর্ণ বড়ই অহংকারী। আর জানই তো, অর্জুনের সঙ্গে তাঁহার কেমন শক্রতা। তাই তিনি অর্জুনের প্রশংসা সহিতে না পারিয়া রাগের ভরে নিজের ক্ষমতা দেখাইতে আসিয়াছে। আর যথার্থই তাঁহার ক্ষমতা কম ছিল না, কারণ, অর্জুন যাহা কিছু করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই তিনিও করিয়া দেখাইলেন। তারপর তিনি বলিলেন, ‘আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করিব৷’ ইহাতে সভার মধ্যে ভারি একটা হুলস্থুল কাণ্ড উপস্থিত হইল। একদিকে দুর্যোধন কর্ণকে প্রশংসা করিতেছেন, আর পাণ্ডবদিগকে অপমানের কথা বলিতেছে, অপর দিকে অর্জুন তাহা সহিতে না পারিয়া রাগে কাঁপিতেছে, একটা খুনাখুনি বুঝি না হইয়া যায় না। নিজের দুই পুত্রের এমন ভাব দেখিয়া ভয়ে আর দুঃখে কুন্তী ইহার মধ্যেই অজ্ঞান হইয়া গিয়াছে৷

 এমন সময় কৃপাচার্য কর্ণকে বলিলেন, ‘বাপু, যুদ্ধ যে করিবে, তাহা তো বুঝিলাম, কিন্তু রাজার ছেলে তো আর যাহার তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারে না, আগে বল দেখি, তুমি কোন্ রাজার বংশে জমিয়াছ, আর তোমার বাপ-মায়েরই-বা কি নাম?’

 কৃপের কথা শুনিয়া লজ্জায় কর্ণের মাথা হেঁট হইল। তাহা দেখিয়া দুর্যোধন বলিল, ‘রাজা হইলেই তো যুদ্ধ হইতে পারে, আচ্ছা আমি এখনই কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজা করিয়া দিতেছি!’ তখনই জল আসিল, ব্রাহ্মণ আসিল, আর তখনই কর্ণকে স্নান করাইয়া, ছাতা ধরিয়া, খই ছড়াইয়া, চামর দোলাইয়া, সোনা আর ফুল দিয়া, জয়-জয় শব্দে রাজা করিয়া দেওয়া হইল। কর্ণ ইহাতে চিরদিনের তরে দুর্যোধনের বন্ধু হইয়া গেলেন৷

 এদিকে সেই সারথি অধিরথ সংবাদ পাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে পাগলের মতন সেখানে ছুটিয়া আসিয়াছে। তাহাকে দেখিয়াই কর্ণ তাঁহার সেই রাজার সাজসুদ্ধ উঠিয়া তাড়াতাড়ি প্রণাম করিতে গেলেন, কিন্তু অধিরথ ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া নিজের চাদর দিয়া পা ঢাকিয়া রাখিলেন। তারপর ‘বাপ! বাপ’ বলিয়া কর্ণকে আদর করিতে করিতে বুড়া চক্ষের জলে তাহার গা ভিজাইয়া দিলেন৷

 তাহা দেখিয়া ভীম বলিলেন, ‘সারথির ছেলে, তুই অর্জুনের হাতে প্রাণটা কেন দিতেছিস? ততক্ষণ রাশ ধরগে যা!’

 তখন রাগে কর্ণের ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল। দুর্যোধন পাগলা হাতির মতো ক্ষেপিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘কর্ণ রাজা হওয়াতে যদি কাহারো আপত্তি থাকে, আসিয়া যুদ্ধ কর!’

 ভাগ্যিস তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল, নহিলে কি হইত, কে জানে? সন্ধ্যা হওয়ায় কাজেই সকলকে ঘরে ফিরিতে হইল, বিপদও কাটিয়া গেল৷

 শিক্ষা শেষ হইলে গুরুকে দক্ষিণা দিতে হয়। রাজপুত্রদেরও শিক্ষা শেষ হইয়াছে, এখন দক্ষিণা দিবার সময়। দ্রোণ রাজপুত্রদিগকে বলিলেন, ‘তোমরা পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদকে ধরিয়া আনিয়া দাও। ইহাই আমার দক্ষিণা৷’

 সে কথায় রাজপুত্রেরা তখনই দ্রোণকে লইয়া দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে চলিলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন, ইঁহাদিগকে পাণ্ডবদের আগে যুদ্ধ করিবার জন্য বড়ই ব্যস্ত দেখা গেল। ইচ্ছা যে বাহাদুরিটা তাঁহাদেরই হয়। পাণ্ডবদের তাহাতে কোনো আপত্তি ছিল না, কাজেই তাঁহারা দ্রোণের সঙ্গে একটু পিছনে থাকিলেন। কিন্তু দুর্যোধনেরা অনেক যুঝিয়াও বেশি কিছুই করিতে পারিলেন না, এবং পাঞ্চালেরাই যেন ‘মার্-মার্’ করিয়া আরো তেজের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাহাদের গর্জন এমনই ভয়ংকর হইয়া উঠিল যে, তাহা শুনিয়া অর্জুন আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না৷

 দ্রোণকে লইয়া পাণ্ডবেরা যুদ্ধে নামিলেন, কিন্তু দ্রুপদের লোকেরা তবুও ভয় পাইল না। ভীমের গদায় কত হাতি ঘোড়ার মাথা ফাটিল, রথ চুরমার হইল, সৈন্য পিষিয়া গেল। অর্জুনের বাণেও কত হাতি ঘোড়া সিপাহী সৈন্য কাটিল, তাহার লেখাজোখা নাই। কিন্তু দ্রুপদ কাবু হওয়া দূরে থাকুক, বরং ভীম অর্জুনকে প্রশংসা করিয়া আরো ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। তাঁহার সেনাপতিরাও কম যুদ্ধ করিলেন না৷

 যাহা হউক, অর্জুনের হাতে ক্রমে সকলেরই জব্দ হইতে হইল। শেষে রহিলেন কেবল দ্রুপদ, তাহারও ধনুক নিশান সারথি, সব গিয়াছে। তখন অর্জুন ধনুক-বাণ ফেলিয়া, তলোয়ার হাতে সিংহনাদ পূর্বক, এক লাফে তাঁহার রথে উঠিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলেন। দ্রুপদ মন্ত্রীসহ ধরা পড়িলেন তাঁহার লোকজন পলাইয়া গেল, কাজেই যুদ্ধও মিটিল। ভীমের কিন্তু এমন একটুখানি যুদ্ধ একেবারেই ভালো লাগিল না। তাঁহার ইচ্ছে ছিল আরো অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেন৷

 দ্রুপদকে দ্রোণের নিকট উপস্থিত করা হইলে, দ্রোণ তাঁহাকে বলিলেন, ‘দ্রুপদ! তোমার রাজ্যও গিয়াছে, নগরও গিয়াছে তোমার প্রাণ অবধি আমাদের হাতে। এখন আমাদের বন্ধুতার খাতিরে তুমি কি চাহ বল?’

 তারপর তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘ভয় নাই, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষমা করাই আমাদের স্বভাব। তাহা ছাড়া শিশুকাল হইতে তোমাকে ভালোবাসি, এখনো তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুতাই করিতে চাহি। তোমার রাজ্য এখন আমার হাতে, আমি তাহার অর্ধেক তোমাকে দিয়া অর্ধেক রাখিব। কেননা, আমার একটু রাজ্য না থাকিলে আবার তুমি বলিবে যে, তুই গরিব, তোর সঙ্গে বন্ধুতা করিব না। এখন হইতে গঙ্গার দক্ষিণধারে তোমার, উত্তরধারে আমার জায়গা হইল। কি বল?’

 দ্রুপদ আর কি বলিবেন? এইটুকু যে পাইয়াছে, ইহাই তো ঢের বলিতে হইবে। কাজেই তিনি সবিনয়ে দ্রোণকে ধন্যবাদ দিয়া দুঃখের সহিত ঘরে ফিরিলেন। সেই অবধি তাঁহার এই চিন্তা হইল যে, কি করিয়া দ্রোণকে মারিতে পারা যায়৷

 ইহার পর এক বৎসর চলিয়া গেলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ করিলেন। যুধিষ্ঠির এমনি ধার্মিক, সরল, দয়ালু আর শান্ত ছিলেন যে, তাঁহার গুণে রাজ্যের সকল লোক মোহিত হইয়া গেল। এদিকে ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেব মিলিয়া বাহিরের শত্রুদিগকে এমনি শাসনে রাখিলেন যে, তাহারা আর মাথা তুলিতে সাহস পায় না। আর তাহা দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্রের মনে এমনি হিংসা হইল যে, রাত্রিতে তাঁহার আর ঘুম হয় না৷

 শেষে আর না থাকিতে পারিয়া তিনি তাঁহার মন্ত্রী কণিককে ডাকাইয়া বলিলেন, ‘মন্ত্রি! এই পাণ্ডবদের বাড়াবাড়ি তো আর আমি সহিতে পারিতেছি না। বল দেখি ইহার কি উপায়?’

 কণিক বলিলেন, ‘মহারাজ, ইহারা আর বেশি বড় না হইতেই এইবেলা ইহাদিগকে মারিয়া ফেলুন৷’

 একদিকে কণিকের এইরূপ পরামর্শ, আর-একদিকে দুর্যোধনের পীড়াপীড়ি৷

 রাজ্যের লোকেরা খালি যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরই বলে। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, ভীষ্ম রাজ্য ছাড়িয়া দিয়াছে, কাজেই সকলে এমন গুণবান যুধিষ্ঠিরকে পাইয়া তাঁহাকেই রাজা করিতে চাহিতেছে। এসকল কথা যেন কাঁটার মতো দুর্যোধনের বুকে গিয়া বিঁধিতে লাগিল। তিনি কর্ণ, শকুনি (দুর্যোধনের মামা) দুঃশাসন প্রভৃতিকে লইয়া পরামর্শ করিলেন যে, পাণ্ডবদিগকে পোড়াইয়া মারিতে হইবে৷

 এইরূপ যুক্তি আঁটিয়া দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্র কে বলিলেন, ‘বাবা! আর তো সহ্য হয় না। আপনি আর ভীষ্ম থাকিতে ইহারা নাকি যুধিষ্ঠিরকে রাজা করিতে চাহে। পাণ্ডবদের কাছে হাত জোড় করিয়াই কি শেষটা আমাদের থাকিতে হইবে? তাহা হইলে আর নরকে যাওয়ার বাকি কি রহিল? বাবা! এ অপমান হইতে কি রক্ষা পাওয়া যায় না?’

 দুর্যোধনের কথায় ধৃতরাষ্ট্রের মন আরো খারাপ হইয়া গেল। তখন দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন, ইহারা বলিলেন, মহারাজ! একটিবার যদি বুদ্ধি করিয়া ইহাদিগকে বারণাবত নগরে পাঠাইতে পারেন, তবেই আমাদের আপদ দূর হয়!

 ধৃতরাষ্ট্রের ইহাতে খুবই মত, ভয় শুধু এই যে, পাছে ইহাতে রাজ্যের লোক চটিয়া গিয়া তাঁহাদিগকে মারিতে আসে। তাহাতে দুর্যোধন বলিলেন, ‘ভয় কি? টাকাকড়ি তো সব আমাদেরই হাতে! আমরা টাকা দিয়া সকলকে বশ করিব। একটিবার কুন্তী আর তাহার পাঁচটা ছেলেকে বারণাবতে পাঠাইয়া দিন। তারপর আমরা সব হাত করিয়া লইতে পারিলে যেন উহারা ফিরিয়া আসে৷’

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘আমারও তো তাহাই মনে হয়। কিন্তু কাজটা কিনা ভালো নয়, তাই ভয় করি, পাছে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ ইহারা চটিয়া মুস্কিল বাধান৷’

 দুর্যোধন বলিলেন, ‘ভীষ্মের কাছে তো আমরা যেমন, পাণ্ডবেরাও তেমনি। অশ্বথামা আমারই পক্ষের লোক, কাজেই তাঁহার বাবা দ্রোণ আর মামা কৃপাচার্যও আমাদের পক্ষেই থাকিবেন। তারপর একা বিদুর আর আমাদের কি করিবেন?’

 এইরকম তাঁহাদের পরামর্শ হয়, আর এদিকে টাকা দিয়া লোকজনকে বশ করিবার চেষ্টাও চলে। তারপর একদিন ধৃতরাষ্ট্রের পরামর্শে তাঁহাদের লোকেরা সভায় বসিয়া বলিতে লাগিল, ‘বারণাবত যে কি চমৎকার জায়গা, কি বলিব। আর সেখানকার শিবের মন্দিরে এই সময়ে বড়ই ধুমধাম, দেশ-বিদেশের লোক পূজা করিতে আসিয়াছে৷’

 এ-সকল কথা শুনিয়া পাণ্ডবদের বারণাবত যাইতে খুব ইচ্ছা হইল। তাহা দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘বাছাসকল! শুনিতেছি এটা নাকি বড়ই সুন্দর স্থান, পৃথিবীতে এমন স্থান আর নাই। তা তোমাদের ইচ্ছা থাকিলে, তোমরা সপরিবারে একবার সেখানে গিয়া পরম সুখে কিছুদিন বাস কর। তারপর আবার ফিরিয়া আসিও।’

 ধৃতরাষ্ট্রের দুষ্টবুদ্ধি যুধিষ্ঠিরের বুঝিতে বাকি রহিল না। কিন্তু কি করেন, চারি দিকেই ধৃতরাষ্ট্রের লোক, পাণ্ডবদের হইয়া দু কথা বলিবার কেহ নাই। কাজেই তিনি রাজি হইলেন। তারপর তিনি ভীষ্ম, বিদুর দ্রোণ, কৃপ, অশ্বথামা, গান্ধারী আর ব্রাহ্মণ পুরোহিত প্রভৃতি সকলের নিকট গিয়া বিনয়ের সহিত বলিলেন ‘জ্যেঠামহাশয়ের কথায় আমরা বারণাবত চলিলাম, আপনারা আমাদিগকে আশীর্বাদ করুন।’

 তাঁহারা সকলেই বলিলেন, ‘ভালোয় ভালোয় ফিরিয়া আসিও। তোমাদের যেন কোনো অনিষ্ট না হয়।’

 পাণ্ডবদের বারণাবত যাওয়া স্থির হইয়াছে দেখিয়া দুর্যোধনের আর আনন্দের সীমা রহিল না। তিনি গোপনে পুরোচন নামক তাঁহাদের একজন মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পুরোচন, তোমার মতো আর আমাদের বন্ধু কে আছে? এই যে রাজ্য দেখিতেছ, ইহা যে কেবল আমরাই, তাহা নহে—তোমারও। বাবা আজ পাণ্ডবদিগকে বারণাবত পাঠাইতেছেন। তুমি খুব গাড়ি হাঁকাইয়া উহাদের ঢের আগেই সেখানে চলিয়া যাও। সেখানে গিয়া শহরের একপাশে, নির্জন স্থানে, গাছপালার আড়ালে একটি সুন্দর বাড়ি করিবে। গালা, ধূনা, চর্বি, তেল, শণ্, কাঠ এমনি সব জিনিস দিয়া বাড়িটি প্রস্তুত হওয়া চাই, যাহাতে আগুন ছোঁয়াইবামাত্রই তাহা দপ-দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠে। সাবধান! যেন বাড়ি দেখিয়া কেহ টের না পায় যে তাহাতে এমন কোনো জিনিস আছে। তারপর কুন্তীকে তাহার পাঁচ ছেলে সুদ্ধ নিয়া সেই বাড়িতে রাখিবে। দিন কতক খুব আদর দেখাইয়া উহাদের বিশ্বাস জন্মাইয়া নিবে, শেষে একদিন রাত্রিকালে পাণ্ডবেরা নিশ্চিন্তে ঘুমাইবার সময় দরজায় আগুন দিয়া তাহাদিগকে পোড়াইয়া মারিবে। তাহা হইলে লোকে ভাবিবে, হঠাৎ আগুন লাগিয়াছে আমাদের কেহ সন্দেহ করিবে না৷’

 দুষ্ট পুরোচন এ কথায় ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া চলিয়া গেল৷

 এদিকে পাণ্ডবদের যাত্রার সময় উপস্থিত, রথ প্রস্তুত। পাণ্ডবেরা গুরুজনকে প্রণাম, সমান বয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি, ছোটদিগকে আশীর্বাদ আর প্রজাদিগকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া রথ ছড়িয়া দিলেন। বিদুর প্রভৃতি কয়েকজন লোক অতিশয় দুঃখের সহিত কিছুদূর তাঁহাদের পিছু পিছু চলিলেন। এদিকে ব্রাহ্মণেরা ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করিয়া বলিতে লাগিলেন, ধৃতরাষ্ট্র দুষ্টলোক তাই এমন কাজ করিল। পাণ্ডবেরা তো কোনোদিন তাহাদের কোনো ক্ষতি করে নাই। আর ভীষ্মকেই বা কি বলি? তাঁহার চোখের সামনে এমন অধর্ম হইল, আর তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। আইস আমরাও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে চলিয়া যাই৷

 যুধিষ্ঠির তাঁহাদিগকে বলিলেন, ‘দেখুন, জ্যেঠামহাশয় আমাদের গুরুলোক, তাঁহার কথা শুনিয়া চলাই আমাদের উচিত। আপনারা আমাদের পরম বন্ধু, আমাদিগকে আশীর্বাদ করিয়া এখন ঘরে ফিরুন। ইহাতে শেষে আমাদের উপকার হইবে৷’

 এ কথায় তাঁহারা পাণ্ডবদিগকে আশীর্বাদ করিয়া ঘরে ফিরিলেন। বিদুর এতক্ষণ চুপিচুপি আসিতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ফিরিতে দেখিয়া, সময় বুঝিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, ‘বাবা যুধিষ্ঠির! বিপদ আসিলে বুদ্ধিমান লোকে তাহা এড়াইবার চেষ্টা করেন। গর্তের ভিতরে থাকিলে আগুনে পোড়াইতে পারে না। লোহার অস্ত্র নয়, কিন্তু তাহাতে শরীর কাটে, তাহার কথা যে জানে, শত্রুরা তাহাকে মারিতে পারে না। অন্ধ হইলে পথ দেখিতে পায় না, ব্যস্ত হইলে বুদ্ধি ঠিক থাকেনা। এইটুকু বলিলাম, বুঝিয়া লও। চলাফেরা করিলেই পথ জানা যায়, নক্ষত্র দিয়া দিক ঠিক করা যায়, আর নিজের মন বশে থাকিলে ভয়ে কাবু হইতে হয় না৷’

 এই কথাগুলি বিদুর যে কিরকম একটা ভাষায় বলিলেন, কেহ তাহার অর্থ বুঝিতে পারিল না! কেবল যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘বুঝিয়াছি।’ সকলে চলিয়া গেলে কুন্তী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাবা! বিদুর যে কি বলিলেন, আর তুমিও বলিলে বুঝিয়াছি’ আমি তো তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না৷

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘মা! দুর্যোধন নাকি আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিতে চাহে। তাই কাকা আমাকে সাবধান করিয়া দিলেন, আর সর্বদা পথ-ঘাটের খবর লইতে, আর ভালো হইয়া চলিতে বলিলেন!’

 তারপর কিচ্ছুদিন পথ চলিয়া তাঁহারা বারণাবতে পৌঁছিলেন। তাহাদিগকে পাইয়া সেখানকার লোকদিগের খুবই আনন্দ হইল। পাণ্ডবেরা নিতান্ত গরিবদেরও বাড়ি বাড়ি গিয়া দেখা করিলেন। পুরোচন তো প্রথমেই আসিয়া তাঁহাদের সঙ্গে জুটিয়াছে। তাহাদিগকে পাইয়া যেন কত খুশি! দুষ্টের মুখে হাসি আর ধরে না, কুমিরের মতন তাহার দাঁত খালি বাহির হইয়াই আছে। পাণ্ডবদিগকে সে আগে অন্য একটা সুন্দর বাড়িতে খুব আদরের সহিত দশদিন রাখিয়া তারপর তাঁহাদিগকে সেই গালার বাড়িতে নিয়া উপস্থিত করিল। সে বাড়িতে গিয়াই যুধিষ্ঠির চুপিচুপি ভীমকে বলিলেন, ‘ভাই! আমি চর্বি আর গালার গন্ধ পাইতেছি। এ বাড়িটা নিশ্চয়ই গালা, চর্বি, শুকনো বাঁশ প্রভৃতি জিনিসের তৈরি। দুষ্ট আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার জন্য এইখানে আনিয়াছে। বিদুর কাকা ইহার কথা জানিতে পারিয়াই আমাকে ওরূপ বলিয়াছিলেন৷’

 এ কথা শুনিয়া ভীম বলিলেন, ‘তবে আসুন আমরা এখান হইতে চলিয়া যাই৷’

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘না আমাদের এখানে থাকাই ভালো। এখন চলিয়া গেলে উহারা আর কোনো ফন্দি করিয়া আমাদিগকে মারিবে। তাহার চেয়ে এই ঘর পোড়াইবার সময় উহাদিগকে ফাঁকি দিয়া আমরা পলাইয়া গেলে লোকে ভাবিবে, আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিয়াছে। আর এ কথা শুনিলে ভীষ্ম, দ্রোণ ইঁহারাও ইঁহাদের উপর খুব বিরক্ত হইবেন। এখন হইতে খুব শিকার করিয়া বেড়াইলে আমরা পথ-ঘাট সবই জানিতে পারিব, আর পলাইবার সময় কোনো মুস্কিলও হইবে না। আজই এই ঘরের ভিতরে একটা গর্ত খুঁড়িয়া, আমরা তাহার মধ্যে থাকিব, তাহা হইলে আর আগুনের ভয় থাকিবে না৷’

 ইহার মধ্যে একদিন একটি লোক চুপিচুপি যুধিষ্ঠিরের নিকট আসিয়া বলিল, ‘বিদুর মহাশয় আমাকে আপনার নিকট পাঠাইয়াছেন। আমি প্রাণ দিয়া আপনাদের কাজ করিব। আপনারা আসিবার সময় তিনি ম্লেচ্ছ ভাষায় আপনাকে কিছু বলেন, তাহার উত্তরে আপনি বলেন যে, ‘বুঝিলাম’ এই কথা বলিলেই বুঝিতে পারিবেন যে আমি যথার্থই বিদুরের লোক। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পুরোচন এই ঘরসুদ্ধ আপনাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার যুক্তি করিয়াছে। এখন কি করিতে হইবে বলুন, আমি খুব গর্ত খুঁড়িতে পারি৷

 লোকটিকে দেখিয়াই যুধিষ্ঠির বুঝিতে পারিলেন যে, এ ব্যক্তি খুব সরল ও ধার্মিক। তিনি তাহাকে বলিলেন, ‘আমি বেশ বুঝিয়াছি তুমি ভালো লোক, আর কাকা তোমাকে পাঠাইয়াছেন। এখন যাহাতে আমরা এ বিপদে রক্ষা পাই তাহাই কর৷’

 সেই লোকটি ঘরের মধ্যে নর্দমা কাটিবার ছল করিয়া এক প্রকাণ্ড গর্ত খুঁড়িয়া ফেলিল। পাণ্ডবেরা দিনের বেলায় শিকার করিয়া বেড়াইতেন, রাত্রিতে সেই গর্তের ভিতরে সাবধানে লুকাইয়া থাকিতেন। গর্তের মুখ এমনভাবে লুকানো ছিল যে, না জানিলে তাহা টের পাওয়া অসম্ভব। উহার কথা খালি পাণ্ডবেরা জানিলেন, আর যে গর্ত খুঁড়িয়াছিল সে জানিত, আর কেহই জানিত না। ক্রমে সেই কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী আসিল, যেদিন পুরোচনের সেই গালার ঘরে আগুন দেওয়ার কথা। সেদিন কুন্তী অনেক ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন। একটি নিষাদী, অর্থাৎ ব্যাধজাতীয় স্ত্রীলোক ও তাহার পাঁচটি পুত্র লইয়া সেখানে খাইতে আসিল। গরিব লোক, ভালো খাবার পাইয়া এতই খাইল যে তাহাদের চলিয়া যাইবার শক্তি নাই। কাজেই তাহারা ছয়জন সেইখানে রহিল৷

 এদিকে ক্রমে ঢের রাত হইয়াছে, আর খুব বাতাসও বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে পুরোচনও নিদ্রায় অচেতন। সেই সুন্দর সুযোগ পাইয়া ভীম তখনই তাড়াতাড়ি তাহার ঘরের দরজায় আগুন লাগাইয়া দিলেন। তারপর বাড়ির চারিদিকে বেশ ভালোরূপে আগুন ধরাইয়া, পাঁচ ভাই মায়ের সঙ্গে সেই গর্তের ভিতর দিয়া বাহিরে চলিয়া আসিলেন। পুরোচন আর পাঁচপুত্র সমেত সেই নিষাদী পুড়িয়া মারা গেল৷

 আগুনের শব্দে শহরের লোকের জাগিতে অনেকক্ষণ লাগিল না। তাহারা আসিয়া ‘হায় হায়’ করিতে করিতে পুরোচন আর দুর্যোধনকে গালি দিতে লাগিল। পাণ্ডবদিগকে পোড়াইয়া মারিবার জন্যই যে পুরোচন দুর্যোধনের কথায় এই ঘর প্রস্তুত করিয়াছিল, একথা আর তাহাদের বুঝিতে বাকি রহিল না। তাহারা বলিল, ‘দুষ্ট নিজেও পুড়িয়া মরিয়াছে বেশ হইয়াছে। যেমন কর্ম তেমন ফল৷’

 এতক্ষণ পাণ্ডবেরা কি করিতেছেন? তাঁহারা প্রাণপণে বনের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছেন৷ কিন্তু চলা কি যায়? একে ভয়ে অস্থির, তাহাতে রাত জাগিয়া দুর্বল। অন্ধকার রাত্রি, ঝড় বহিতেছে। তাঁহারা পদে পদে উঁচট খাইতেছেন, পা আর চলে না। তখন ভীম আর উপায় দেখিয়া মাকে লইলেন কাঁধে, আর নকুল সহদেবকে কোলে। তারপর যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের হাত ধরিয়া লইয়া ঝড়ের মতন ছুটিয়া চলিলেন৷

 এদিকে বিদুর পাণ্ডবদিগের সাহায্য করিবার জন্য আর-একজন খুব পাকা লোক পাঠাইয়া দিলেন। সে খুঁজিতে খুঁজিতে গঙ্গার ধারে আসিয়া দেখিল যে, তাঁহারা নদী পার হইবার চেষ্টায় জল মাপিতেছে। তখন সে সেই ম্লেচ্ছ ভাষার ঘটনার কথা বলিতেই তাহার প্রতি পাণ্ডবদের বিশ্বাস জন্মিল। তারপর একটি সুন্দর নৌকা আনিয়া তাঁহাদিগকে বলিল, ‘চলুন আপনাদিগকে পার করিয়া দিই৷’

 নৌকা বাহিতে বাহিতে সেই লোকটি তাঁহাদিগকে বলিল, ‘বিদুর মহাশয় আপনাদিগকে অনেক আশীর্বাদ জানাইয়াছে, আর বলিয়াছে, আপনাদের কোনো ভয় নাই, শেষে আপনাদেরই জয় হইবে৷’

 পাণ্ডবেরা বলিলেন, ‘কাকাকে আমাদের প্রণাম জানাইবে।’

 এইরূপ কথাবার্তায় নৌকা অপর পারে উপস্থিত হইলে, লোকটিকে বিদায় দিয়া পাণ্ডবেরা আবার পথ চলিতে লাগিলেন৷

 এদিকে সকালবেলায় বারণাবতের লোকেরা পাণ্ডবদিগকে খুঁজিতে আসিয়া গালার ঘরের ছাইয়ের ভিতরে পুরোচন আর সেই নিষাদী আর তাহার পাঁচ ছেলের পোড়া হাড় পাইল। তাহারা নিষাদীর কথা জানিত না, কাজেই এই হাড় কুন্তী আর পাঁচ পাণ্ডবের মনে করিয়া তাহার কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘চল আমরা দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রকে গিয়া বলি, ‘তোমার সাধ পূর্ণ হইয়াছে, পাণ্ডবদিগকে পোড়াইয়া মারিয়াছ।’

 ইহার মধ্যে সেই যে লোকটি গর্ত খুঁড়িয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি ছাই উল্টাইবার ছল করিয়া সেই গর্ত কখন বুজাইয়া দিয়াছিল, কাজেই তাহার কথা কেহ জানিতে পারিল না৷

 ধৃতরাষ্ট্র শুনিলেন যে, পুরোচন আর পাণ্ডবেরা জতুগৃহের (গালার ঘরের) সঙ্গে পুড়িয়া মারা গিয়াছে, তখন তিনি মনে মনে খুবই খুশি হইলেন, কিন্তু বাহিরে দেখাইলেন যেন পাণ্ডবদের দুঃখে তাঁহার বুক একেবারে ফাটিয়া গেল। তিনি কাঁদেন আর বলেন, “হায় হায়! শীঘ্র উহাদের শ্রাদ্ধ কর! হায় হায়! ঢের টাকা খরচ কর! হায় হায় একটি নদী খোঁড়াও! হায় হায়! পাণ্ডবেরা ভালো করিয়া স্বর্গে যাউক৷”

 আর-একজন লোক এমনি কপট কান্না কাঁদিয়াছিলেন, কিন্তু সে অন্য কারণে। বিদুর তো জানেনই যে পাণ্ডবেরা বাঁচিয়া আছে, কাজেই তাঁহার কেন দুঃখ হইবে? কিন্তু দেশসুদ্ধ লোক পাণ্ডবদের জন্য ‘হায় হায়’ করিয়া কাঁদিতেছে, ইহার মধ্যে তিনি চুপ করিয়া থাকিলে তো ভারি সন্দেহের কথা হয়। কাজেই তিনি আসল কথা জানিয়াও লোকের সন্দেহ দূর করিবার জন্য একটু কাঁদিলেন৷

 এদিকে পাণ্ডবেরা গঙ্গা পার হইয়া আবার ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে চলিয়াছেন। তখন রাত্রি প্রভাত হয় নাই, চারিদিকে ঘোর অন্ধকার আর ভয়ংকর বন। পিপাসায়, পরিশ্রমে আর ঘুমে ভীম ছাড়া আর সকলেই নিতান্ত কাতর। যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘ভীম! ভাই, আর যে পারি না। এখন উপায়?’

 ভীম বলিলেন, ‘ভয় কি দাদা? এই যে আমি আপনাদিগকে লইয়া যাইতেছি৷’ এই বলিয়া তিনি পূর্বের ন্যায় সকলকে বহিয়া লইয়া ছুট দিলেন৷

 ভীম সেদিন কি ভয়ানক বেগেই চলিয়াছিলেন। তাঁহার দাপটে গাছ ভাঙ্গে, মাটি উড়ে, আর যুধিষ্ঠিরেরা তো প্রায় অজ্ঞান! বনের পর বন পার হইয়া যাইতেছে, তবুও তাঁহার বিশ্রাম নাই। রাত চলিয়া গেল, তারপর সমস্তটা দিন চলিয়া গেল। সন্ধ্যার সময় একটা বনের ভিতরে আসিয়া ভীম থামিলেন। ক্রমে ঘোর অন্ধকার আসিল, ঝড় উঠিল, চারিদিকে বাঘ ভাল্লুক ডাকিতে লাগিল, কিন্তু পাণ্ডবেরা আর কিছুতেই চলিতে পারেন না, কাজেই সেখানে বিশ্রাম করা ভিন্ন আর উপায় নাই৷

 এমন সময় কুন্তী বলিলেন, ‘আর তো পারি না! পিপাসায় যে প্রাণ গেল!’ মায়ের দুঃখ ভীমের সহ্য হয় না, অথচ সে পোড়া বনে জল বা ফলমূল কিছুই নাই। কাজেই তিনি আবার সকলকে লইয়া আর-একটা সুন্দর বনে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় তাঁহাদিগকে রাখিয়া তিনি বলিলেন, ‘এইখানে তোমরা বিশ্রাম কর। ঐ সারসের ডাক শুনা যাইতেছে, জল কাছেই পাইব৷’

 ভীম সারসের ডাক শুনিয়া খুঁজিতে খুঁজিতে দুই ক্রোশ দূরে একটা জলাশয়ে উপস্থিত হইলেন। সেখানে স্নান আর জলপানের পর আর সকলের জন্য জল লইয়া আসিয়া দেখেন, তাঁহারা ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন৷

 হায়! রাজরানী, রাজার ছেলে, তাঁহারা কিনা আজ মাটিতে গড়াগড়ি যাইতেছেন! দুঃখে ভীমের চোখে জল আসিল। তখন শত্রুদিগের হিংসার কথা ভাবিয়া তিনি বাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘দুষ্ট দুর্যোধন! তোর বড় ভাগ্য যে দাদা আমাকে বলেন না। নহিলে আজই তোদের সকলকে যমের বাড়ি পাঠাইতাম।’ বলিতে বলিতে ভীমের ঝড়ের মত নিশ্বাস বহিতে লাগিল৷

 এত কষ্টের পর সকলে ঘুমাইয়াছেন, কাজেই তাঁহাদিগকে জল খাওয়াইবার জন্য জাগাইতে ভীমের ইচ্ছা হইল না। তিনি জল হাতে করিয়া সেখানে পাহারা দিতে লাগিলেন৷

 সেই বনের কাছে, এক প্রকাণ্ড শাল গাছের উপরে, হিড়িম্ব নামে একটা বিকট রাক্ষস থাকিত। তাহার তালগাছের মতো বিশাল দেহে ভয়ানক জোর, আগুনের মতো চোখ, জালার মতো মুখ, মূলার মতো দাঁত, গাধার মতো কান, ঝাঁকড়া তামাটে চুল-দাড়ি, বেলুনের মতো প্রকাণ্ড ভুঁড়ি। অনেকদিন মানুষের মাংস খায় নাই, তাই পাণ্ডবদিগকে দেখিয়া তাহার মুখে জল আর ধরে না। সে খালি মাথা চুলকায়, আর হাঁই তোলে, আর বারবার তাঁহাদিগকে চাহিয়া দেখে। শেষে আর থাকিতে না পারিয়া সে তাহার বোন হিড়িম্বাকে বলিল, ‘বাঃ! কি এ মিঠঠারে গন্ধো! ও বোহিন্, ঝট্ কোরে ধোরে লিয়ে আয়! মোরা খাবো! আর পেটমে ঢাক পিট্টায়কে নাচ্চ্‌বো!’

 হিড়িম্বা তাহার কথায় পাণ্ডবদের কাছে আসিল। কিন্তু রাক্ষসের মেয়ের প্রাণেও দয়ামায়া খুব থাকিতে পারে। পাণ্ডবদিগকে মারিবার কোনো চেষ্টা করা দূরে থাকুক, বরং সে আসিয়াই ভীমকে সকল কথা জানাইয়া বলিল, ‘শীঘ্র সকলকে জাগাও। আমি তোমাদিগকে রাক্ষসের হাত হইতে বাঁচাইয়া দিতেছি৷’

 ভীম বলিলেন, ‘আমি রাক্ষস-টাক্ষসকে ভয় করি না। ইহারা অনেক পরিশ্রমের পর ঘুমাইয়াছে, ইঁহাদগকে কি এখন জাগানো যায়? নাহয় তোমার ভাইকে পাঠাইয়া দাও, আমার তাহাতে আপত্তি নাই৷

 এদিকে রাক্ষসের আর বিলম্ব সহ্য না হওয়ায়, সে নিজেই আসিয়া উপস্থিত। তাহাতে হিড়িম্বা নিতান্ত ভয় পাইয়া বলিল, শীঘ্র তোমরা আমার পিঠে উঠ, আমি এখনো তোমাদিগকে লইয়া আকাশে উড়িয়া যাইতে পারি৷

 ভীম বলিলেন, ‘তোমার কোনো ভয় নাই, আমার গায় ঢের জোর আছে মানুষ বলিয়া আমায় অবহেলা করিও না!’

 হিড়িম্বা বলিল, ‘ঐ দুষ্ট মানুষকে ধরিয়াই মারিয়া ফেলে, তাই আমি ভয় পাই। তোমাকে অবহেলা করিতেছি না৷’

 এ-সকল কথা শুনিয়া রাক্ষসের কিরূপ রাগ হইল, বুঝিতেই পার। সে ভীমকে আগে মারিবে, না হিড়িম্বাকেই আগে মারিবে ঠিক করিতে পারিতেছে না। হাউ-মাউ করিয়া সে বন মাথায় করিয়া তুলিল৷

 ভীম বলিলেন, ‘মাটি করিল! আরে চুপ চুপ! হতভাগা, ইঁহাদের ঘুম ভাঙ্গিয়া দিবি?’

 রাক্ষস ষাঁড়ের মতন শব্দ করিয়া বলিল, ‘মুহি তো তোদ্ধের্‌র্‌কে খাবো, ওহার্‌র্ লোকের ঘুম ভেঙ্গিবেক কেনে?’ এই বলিয়া সে দুই হাত ছড়াইয়া ভীমকে ধরিতে গেল৷

 ভীম তাহার হাত দুটা ধরিয়া হাসিতে হাসিতে তাহাকে খানিক দূরে লইয়া গেলেন৷

 তখন বন তোলপাড় গাছপালা চুরমার করিয়া দুজনে কি বিষম যুদ্ধ ই আরম্ভ হইল। পাণ্ডবদের আর নিদ্রা যাওয়া হইল না। হিড়িম্বা সেইখানে বসিয়াছিল। কুন্তী চক্ষু মেলিয়া তাহাকে দেখিয়া যারপরনাই আশ্চর্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মা! তুমি কি এই বনের দেবতা, না কোনো অপ্সরা? এমন সুন্দর তো আমি কখনো দেখি নাই! তুমি কে, কিজন্য আসিয়াছ?’

 হিড়িম্বা বলিল, ‘মা! আমি রাক্ষসের মেয়ে, আমার নাম হিড়িম্বা, আমার দাদা হিড়িম্ব আর আমি এই বনে থাকি। আপনাদিগকে দেখিয়া দাদা বলিল, উহাদিগকে ধরিয়া আন্, খাইব৷’ আপনারা ঘুমাইতেছিলেন, আর আপনাদিগকে পিঠে করিয়া এখান হইতে কোনো ভালো জায়গায় লইয়া যাইতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হইলেন না। শেষে আমার দেরি দেখিয়া দাদা নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইল। ঐ দেখুন, আপনার সেই ছেলেটির সঙ্গে কেমন যুদ্ধ চলিতেছে!’

 এ কথা শুনিবামাত্র যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল আর সহদেব ভীমের নিকট ছুটিয়া চলিলেন। অর্জুন ভীমকে ডাকিয়া বলিলেন, দাদা! পরিশ্রম হইয়াছে কি? ভয় নাই, আমি তোমায় সাহায্য করিতেছি৷

 ভীম বলিলেন, ‘ভয় নাই ভাই! হতভাগাকে কাবু করিয়া আনিয়াছি!

 অর্জুন বলিলেন, ‘শীঘ্র উহাকে মারিয়া ফেল। নহিলে দুষ্ট আবার কোনো ফাঁকি-টাকি দিয়া বসিবে, ইহারা বড়ই ধূর্ত। তুমি নাহয় একটু বিশ্রাম কর, আমি উহাকে মারিতেছি৷’

 ইহাতে ভীম তখনই ক্রোধভরে রাক্ষসকে তুলিয়া সাংঘাতিক এক আছাড় দিলেন। তারপর উহার দেহটাকে মট্‌ করিয়া ভাঙ্গিতেই উহার প্রাণ বাহির হইয়া গেল। মরিবার সময় রাক্ষসটা এমনি ভয়ানক চ্যাঁচাইতেছিল যে কি বলিব!

 অমন ভীষণ স্থানে না থাকাই ভালো, আর বোধ হইল যেন কাছেই নগর আছে। সুতরাং রাক্ষস মারিবার পরেই পাণ্ডবেরা তাড়াতাড়ি সে স্থান ছাড়িয়া চলিলেন। হিড়িম্বাও তাঁহাদের সঙ্গে চলিল।

 হিড়িম্বাকে সঙ্গে আসিতে দেখিয়া ভীম বলিলেন, রাক্ষসেরা বড়ই দুষ্ট উহাদিগকে বিশ্বাস করিতে নাই। তোর ভাইকে মারিয়াছি, আয়, তোকে মারি!'

 এ কথায় যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘ছি ভীম! এমন কাজ করিতে নাই। স্ত্রীলোককে মারা বড় পাপ।’

 ভীমের রাগ দেখিয়া হিড়িম্বা নিতান্ত দুঃখের সহিত জোড়হাতে কুন্তীকে বলিল, ‘মা, আমার কোনো দোষ নাই। আপনার ভীমকে আমি প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি, আর আশা করিয়াছিলাম, তিনি আমাকে বিবাহ করিবেন। আমাকে রক্ষা করুন৷’

 তখন যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘ঠিক কথা। ভীম! তোমার ইহাকে বিবাহ করা উচিত।’

 ততক্ষণে ভীমের রাগ চলিয়া গিয়াছে, আর দাদার কথা তিনি কখনো অমান্য করেন না। কাজেই তিনি হিড়িম্বাকে বিবাহ করিলেন৷

 ভীম আর হিড়িম্বার ঘটোৎকচ নামক এক পুত্র হইয়াছিল, তাহার কথা আরো শুনিতে পাইবে। ঘটোৎকচ ধার্মিক, বিদ্বান আর অসাধারণ বীর ছিল। জন্মমাত্রেই ঘটোৎকচ বড় মানুষের মতন করিয়া ভীমকে বলিল, ‘বাবা, এখন যাই। দরকার হইলে, যখন ডাকিবেন তখনই আসিব।’ এই বলিয়া সে সকলকে প্রণাম করিয়া তাহার মায়ের সহিত উত্তর দিকে চলিয়া গেল৷

 তারপর পাণ্ডবেরা গাছের ছাল পরিয়া আর মাথায় জটা পাকাইয়া তপস্বীর বেশে বনে বনে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। হরিণ শিকার করিয়া খাওয়া, বেদ উপনিষৎ প্রভৃতি পড়া, আর মায়ের সেবা করা, ইহাই তখন তাঁহাদের প্রধান কাজ ছিল। এইরূপে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল, কীচক প্রভৃতি নানা দেশে ঘুরিয়া শেষে একদিন তাঁহারা ব্যাসদেবকে দেখিতে পাইলেন। ভীষ্ম যেমন ইহাদের ঠাকুরদাদা, ব্যাসও তেমনি। কাজেই পাণ্ডবদিগকে ব্যাস অনেক আদর করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘আমি সব জানি। যদিও আমার কাছে তোমরা আর দুর্যোধনেরা দুইই সমান, তথাপি ইহাদের ব্যবহার দেখিয়া এখন আমি তোমাদিগকে অধিক ভালোবাসি, আর তোমাদের উপকারের জন্যই এখানে আসিয়াছি। আমি আবার না আসা পর্যন্ত তোমরা ঐ নিকটের নগরটিতে গিয়া বাস কর৷’

 এই বলিয়া ব্যাস পাণ্ডবদিগকে একচক্রা নামক একটি নগরে পৌঁছাইয়া দিয়া, কুন্তীকে বলিলেন, ‘মা, আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতেছি, তোমার পুত্রেরা সমস্ত পৃথিবী জয় করিয়া পরম সুখে দিন কাটাইবে।’

 ব্যাস তাহাদিগকে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে রাখিয়া চলিয়া গেলেন। এক মাস পরে তাঁহার ফিরিয়া আসিবার কথা রহিল৷

 সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে পাণ্ডবেরা বাস করিতে লাগিলেন। দিনেরবেলা পাঁচ ভাই ভিক্ষা করিয়া আর নানা স্থান দেখিয়া বেড়ান। সন্ধ্যা হইলে মায়ের কাছে ফিরিয়া আসেন। ভিক্ষার জিনিসগুলির সমান দুই ভাগ হয়। ইহার এক ভাগের সমস্তই ভীম খান, অপর ভাগ আর পাঁচজনে বাঁটিয়া খান। এইরূপে দিন যায়৷

 ইহার মধ্যে একদিন কি হইল শুন। সেদিন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল আর সহদেব ভিক্ষায় বাহির হইয়াছেন। ভীমের সেদিন যাওয়া হয় নাই, তিনি মায়ের কাছেই রহিয়াছে। ইহার মধ্যে হঠাৎ সেই ব্রাহ্মণের বাড়ির ভিতরে ভয়ানক কান্না উঠিল৷

 কান্না শুনিয়া কুন্তী ভীমকে বলিলেন, ‘না জানি ব্রাহ্মণের কি ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইয়াছে! ইনি আমাদিগকে এত স্নেহ করেন, আমরা কি ইঁহার কোনো উপকার করিতে পারি না, বাবা?’

 ভীম বলিলেন, ‘মা, তুমি জানিয়া আইস, বিষয়টা কি? সাধ্য হইলে অবশ্য ব্রাহ্মণের উপকার করিব৷’ কথা শেষ হইতে না হইতেই আবার সেই কান্না। তখন কুন্তী ব্যস্তভাবে ছুটিয়া বাড়ির ভিতর গিয়া দেখিলেন, ব্রাহ্মণ স্ত্রী কন্যা আর পুত্র লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিতেছেন, ‘হায়, কেন বাঁচিয়া আছি? বাঁচিয়া থাকায় কি সুখ? আমি আগেই এখান হইতে চলিয়া যাইতে চাহিয়াছিলাম, গিন্নি! তুমিই তো দিলেন না! তোমার বাপের বাড়ি বলিয়া এ স্থান ছাড়িতে তোমার কষ্ট হইয়াছিল, তাহার ফলে দেখ এখন কি কষ্ট উপস্থিত! হায় হায়! আমি কাহাকে ছাড়িব? আর তোমাদিগকে বিপদে ফেলিয়া নিজেই বা কি করিয়া যাইব? তাহার চেয়ে চল আমরা সকলেই একসঙ্গে মরি৷’

 তাহা শুনিয়া বাহ্মণী বলিলেন, ‘ওগো তুমি এমন কথা বলিও না। তোমরা থাক, আমি যাই! তুমি গেলে আমরা কেহই বাঁচিব না। কিন্তু আমি গেলে তুমি মেয়েটিকে আর ছেলেটিকে মানুষ করিতে পারিবে।’

 বাপমায়ের কথা শুনিয়া মেয়েটি বলিল, ‘মা, বাবা, তোমরা কেন কাঁদিতেছ? আমি যাহা বলিতেছি, তাহা কর। দেখ বাবা, আমাকে আর তোমরা কয়দিন রাখিতে পারিবে? বিবাহ হইলে তো আমি তোমাদিগকে ছাড়িয়া যাইব। তাহাই যদি হইল, তবে এখনই কেন আমি যাই না? তোমরা কেহ গেলে কি ভাইটি বাঁচিবে? ভাবিয়া দেখ, আমি গেলে সকল দিকই রক্ষা হয়৷

 তখন ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী মেয়েটিকে জড়াইয়া ধরিয়া আরো ভয়ানক কাঁদিতে লাগিলেন৷

 ছোট ছেলেটি ইহার মধ্যে কোথায় একগাছি খড় কুড়াইয়া পাইয়াছে, সেই খড় দেখাইয়া সে সকলকে বলিল, “থি! তাঁদে না! এই দান্দা দে আমি নাত্থচ মালবো!” শিশুর কথায় সেই দুঃখের ভিতরেও সকলের হাসি পাইল৷

 কুন্তী এতক্ষণ দাঁড়াইয়াছিলেন। উহাদিগকে একটু হাসিতে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কিজন্য কাঁদিতেছেন? আপনাদের কিসের দুঃখ বলুন, আমাদের সাধ্য থাকিলে তাহা দূর করিব।”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, “মা, আমাদের দুঃখ কি মানুষে দূর করিতে পারে? এই নগরের কাছেই বক বলিয়া একটা রাক্ষস থাকে। সে আমাদিগকে বাঘ ভাল্লুক আর শত্রুর হাত হইতে রক্ষা করে, কিন্তু তাহার বদলে আমাদিগকে তাহার খাবার জোগাইতে হয়। রোজ একটি মানুষ, বিশ খারি ভাত আর দুটা মহিষ তাহার নিকট যাওয়া চাই। সে সেই ভাত মহিষ আর মানুষ সব খাইয়া শেষ করে। আমাদিগকে পালা করিয়া এক-একদিন এক-এক বাড়ি হইতে এসকল জিনিস পাঠাইতে হয়। যে না পাঠায়, দুষ্ট তাহার ছেলেপিলেসুদ্ধ সব মারিয়া খায়। এদেশের রাজা আমাদের কোন খবর নেন না, তাই রাক্ষসের হাতে আমাদের এই দুর্দশা৷ আজ আমার পালা। আমার টাকা নাই যে একজন মানুষ কিনিয়া পাঠাইব। আপনার লোক কাহাকেই বা কেমন করিয়া পাঠাই! তাই মনে করিয়াছি, আমরা সকলে মিলিয়া তাহার কাছে গিয়া একেবারে সকল দুঃখ দূর করিব৷”

 কুন্তী বলিলেন, “ঠাকুর! আপনার কোনো চিন্তা নাই। আমার পাঁচ ছেলের একটি আজ রাক্ষসের নিকট যাইবে।”

 ব্রাহ্মণ কহিলেন, “তাহা কি হয় মা? আপনারা একে ব্রাহ্মণ[১], তাহাতে অতিথি। আপনাদিগকে কিছুতেই আমি রাক্ষসের কাছে যাইতে দিব না৷”

 কুন্তী বলিলেন, “আপনার ভয় কি? রাক্ষস আমার ছেলের কিছুই করিতে পারিবে না। সে আরো বড় বড় রাক্ষস মারিয়াছে। কিন্তু ঠাকুর এ কথা কাহাকেও বলিবেন না। তাহা হইলে লোকে খামখা আসিয়া আমার ছেলেদিগকে কুস্তি শিখাইবার জন্য বিরক্ত করিবে৷”

 ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী যেন হাতে স্বর্গ পাইলেন। কুন্তীর প্রতি তাহাদের কিরকম ভক্তি হইল বুঝিতেই পার। এদিকে কুন্তী আসিয়া ভীমকে সকল কথা বলাতে ভীম উৎসাহের সহিত রাক্ষসের নিকট যাইতে প্রস্তুত হইলেন৷

 যুধিষ্ঠির ভিক্ষা হইতে ফিরিয়া আসিয়া প্রথমে এই সংবাদে বড় ভয় পাইলেন। তিনি বলিলেন, “মা! তুমি কি পাগল হইয়াছ যে, ভীমকে এমন কাজে পাঠাইতে রাজি হইলে? ভীমের যদি কিছু হয়, তবে আমাদের কি দশা হইবে?”

কুন্তী বলিলেন, “ভীমের গায় দশ হাজার হাতির জোর। সে যে-সকল কাজ করিয়াছে তাহা দেখ নাই? এসব কথা জানিয়া শুনিয়াও ব্রাহ্মণের উপকার না করা ভালো বোধ হয় না৷”

 তখন যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মা তুমি ঠিক বলিয়াছ, ভীমের যাওয়াই উচিত৷”

 পরদিন ভোরে ভীম রাক্ষসের খাবার লইয়া বনে গিয়াছেন। সেখানে গিয়া তিনি ডাকিতে লাগিলেন, “কোথায় হে! বক কাহার নাম?”“ও বক! খাবে নাকি এসো গো!” ডাকিতেছে, আর এদিকে নিজেই ভাত খাইয়া শেষ করিতেছেন। ডাক শুনিয়া রাক্ষস দাঁত কড়মড় করিতে করিতে হাজির! কি বিকট চেহারা! এক কান হইতে আর এক কান পর্যন্ত তাহার খালি দাঁত!

 একেই তো রাগিয়া আসিয়াছে, তাহার উপর আবার আসিয়া দেখে ভীম তাহার ভাত প্রায় শেষ করিয়াছে। কাজেই বুঝিতেই পার। সে গর্জন করিয়া বলিল, “মোর ভাতটি খাইছিস্? তোকে যোম ঘর পেঠ্‌ঠাইব নি?”

 কিন্তু তাহার কথা কে শোনে? ভীম খালি হাসেন আর খান। রাক্ষস হাত তুলিয়া ভয়ানক শব্দে ভীমকে মারিতে চলিল। ভীম তখনো হাসেন আর খান। রাক্ষস দুই হাতে ধাই ধাই করিয়া প্রাণপণে তাঁহার পিঠে চাপড় মারিতে লাগিল। তিনি তবুও খালি হাসেন আর খান! তখন রাক্ষস এক প্রকাণ্ড গাছ তুলিয়া লইয়া ভীমকে মারিতে আসল। ততক্ষণে ভীমেরও ভাত কয়টি শেষ হইয়াছে। তখন তিনি ধীরে-সুস্থে হাত মুখ ধুইয়া, হাসিতে হাসিতে রাক্ষসের হাত হইতে গাছ কাড়িয়া লইলেন। তারপর দুজনের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। যুদ্ধ করিতে করিতে যখন আর গাছ রহিল না, তখন আরম্ভ হইল কুস্তি। দিন গেল, রাত্রিও যায়-যায়, তবু যুদ্ধ চলিয়াছে৷

 এইরূপে ক্রমে রাক্ষসকে কাবু করিয়া, শেষে ভীম তাহাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিলেন। তারপর তাহার পিঠে হাঁটু দিয়া, গলা আর কোমরের কাপড় ধরিয়া এমনি বিষম টান দিলেন যে, সেই টানেই তাহার মেরুদণ্ড একেবারে দুইখান! তখনই চিৎকার আর রক্তবমি করিতে করিতে রাক্ষস মরিয়া গেল৷

 বকের চিৎকারে তাহার লোকজন সব ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটিয়া আসিয়াছিল। ভীম তাহাদিগকে বলিলেন, “খবরদার! আর মানুষ খাইতে পাইবি না। তাহা হইলে তোদের এমনি দশা করিব!”

 তাহারা বলিল, “ওরে বাবাগো! মোরা আর কখ্‌খনু মান্ন‍ুস খাবো নি”৷

 তখন হইতে উহারা ভদ্রলোক হইয়া গেল, আর মানুষ খায় না৷

 এদিকে ভীম রাক্ষস মারিয়া চুপিচুপি চলিয়া আসিয়াছে। সকালবেলা সকলে উঠিয়া দেখিল, রাক্ষস মরিয়া পাহাড়ের মতো পড়িয়া আছে। সংবাদ পাইয়া একচক্রার ছেলে বুড়ো পুরুষ মেয়ে সকলে ছুটিয়া তাহা দেখিতে আসিল। কিন্তু এমন ভয়ানক কাজ কাহার? সকলে বলিল, “দেখ কাল কাহার পালা গিয়াছে।”

 পালা সেই ব্রাহ্মণের, আর কাহার হইবে? সকলে মিলিয়া ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল, “বলুন তো ঠাকুর, কিরকম হইয়াছিল।”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, “ঠিক কিরকমটি হইয়াছিল, তাহা তো জানি না। আমরা কান্নাকাটি করিতেছিলাম, এমন সময় এক মহাপুরুষ আসিয়া দয়া করিয়া আমাদিগকে বলিলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমিই রাক্ষসের কাছে যাইব।’ বোধহয় সেই মহাপুরুষ রাক্ষস মারিয়া থাকিবেন৷”

 এ কথায় সকলে অতিশয় আহ্লাদের সহিত নিজ নিজ ঘরে গিয়া দেবতার পূজা দিতে লাগিল৷

 ইহার কয়েকদিন পরে এক ব্রাহ্মণ পাণ্ডবদিগের ঘরে আসিয়া রাত্রিতে থাকিবার জন্য একটু জায়গা চাহিলেন। ব্রাহ্মণটি অনেক দেশ দেখিয়া আসিয়াছে। পাণ্ডবদিগের যত্নে তুষ্ট হইয়া তিনি সেই সকল দেশের অনেক আশ্চর্য কথা তাঁহাদিগতে শুনাইতে লাগিলেন। সেই ব্রাহ্মণের নিকট তাঁহারা জানিতে পারিলেন যে, শীঘ্রই পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদের মেয়ে কৃষ্ণার স্বয়ম্বর হইবে৷

 কৃষ্ণার কথা অতি সুন্দর। দ্রুপদ রাজার কথা তো আগেই শুনিয়াছ দ্রোণের নিকট তিনি কেমন সাজা পাইয়াছিলেন তাহাও জান। সে সময়ে মুখে তিনি দ্রোণের সহিত বন্ধুতা করেন, কিন্তু মনে মনে সেই অবধি দ্রোণকে মারিবার উপায় খুঁজিতে থাকেন৷

 দ্রোণকে মারা যে সহজ কথা নহে, আর যুদ্ধ করিয়াও তাঁহাকে মারা যে একেবারেই অসম্ভব, এ কথা দ্রুপদের বুঝিতে বিলম্ব হইল না। তাই তিনি স্থির করিলেন যে, কোনো মুনিকে ধরিয়া ইহার উপায় করিতে হইবে৷

 কল্মাষী নদীর ধারে অনেক মুনি তপস্যা করেন। সেইখানে খুঁজিতে খুঁজিতে দ্রুপদ যাজ আর উপযাজ নামক দুই ভাইকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহারা বড়ই ধার্মিক আর উঁহাদের
রাক্ষস রক্তবমি করিতে করিতে মরিয়া গেল

ক্ষমতাও অসাধারণ। দেখিয়া দ্রুপদ মনে করিলেন যে, ‘ইহাঁদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারিলে আমার কাজ হইবে৷’

 দ্রুপদ অনেক কষ্টে যাজ্ঞ ও উপযাজকে পাঞ্চাল দেশে আনিয়া পুত্রেষ্টি যজ্ঞ আরম্ভ করেন। মুনি বলিলেন, “এই যজ্ঞে তোমার পুত্রও হইবে এবং কন্যাও হইবে৷”

 এই বলিয়া অগ্নিতে ঘৃত ঢালিবামাত্রই তাহার ভিতর হইতে, আশ্চর্য মুকুট আর বর্ম পরা পরম সুন্দর এক কুমার ঝক্‌ঝকে রথে চড়িয়া গর্জন করিতে করিতে বাহির হইয়া আসিল, তাহার হাতে ধনুর্বাণ আর ঢাল তলোয়ার। তখন আকাশ হইতে দেবতারা বলিলেন, “এই রাজপুত্র দ্রোণকে মারিবে৷”

 এদিকে আবার যজ্ঞের বেদী হইতে এক কন্যা উঠিয়া আসিয়াছেন। তাঁহার শরীরের রঙ কালো, কিন্তু এমন অপরূপ সুন্দর কন্যা কেহ কখনো দেখে নাই। কালো কোঁকড়ানো চুল, পদ্মফুলের পাপড়ির মতো সুন্দর উজ্জ্বল দুটি চক্ষু, ভ্রূ দুটি যেন তুলি দিয়া আঁকা। শরীরের সদ্যফোটা পদ্মের গন্ধে, এক ক্রোশ পর্যন্ত ছাইয়া গিয়াছে। দেবতা ছাড়া মানুষ কখনো এমন সুন্দর হয় না। কন্যা জন্মিবামাত্র আকাশ হইতে দেবতারা বলিলেন, “এই কন্যা কৌরবদিগের ভয়ের কারণ হইবে৷”

 ছেলেটির নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন আর মেয়েটির নাম কৃষ্ণা, রাখা হইল। কৃষ্ণাকে লোকে দ্রৌপদী অর্থাৎ দ্রুপদের কন্যা বলিয়াই বেশি ডাকিত। এই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের কথা শুনিয়া, পাণ্ডবদিগের তাহা দেখিতে যাইবার ইচ্ছা হইল। তাহা দেখিয়া কুন্তী বলিলেন, “চল বাবা আমরা সেইখানে যাই। এখানে আমরা অনেকদিন রহিয়াছি। বেশিদিন এক জায়গায় থাকা ভালো নহে৷” সুতরাং স্থির হইল, তাঁহারা সেই ব্রাহ্মণের নিকট বিদায় লইয়া মায়ের সঙ্গে পাঞ্চাল যাত্রা করিলেন৷

 গঙ্গার ধারে সোমাশ্রয়ায়ণ নামে এক তীর্থ আছে, সেখানে আসিয়া পাণ্ডবদিগের রাত্রি হইল। তখন পথ দেখাইবার জন্য অর্জুন মশাল হাতে আগে আগে চলিলেন৷

 সেখানে এক গন্ধর্ব সপরিবারে স্নান করিতেছিল। সে পাণ্ডবদিগকে ধমকাইয়া বলিল, “এইয়ো! এদিকে আইস! জান আমি কে? আমি কুবেরের বন্ধু অঙ্গারপর্ণ। আমার ক্ষমতা এখনি দেখিতে পাইবে। মানুষ হইয়া এখানে আসিয়াছ, তোমাদের সাহস কেমন?”

 অজুর্ন বলিলেন, “এই, তোমরা বুদ্ধি যেমন! এটা গঙ্গার ধার, তোমার কেনা জায়গা তো নয়, এখান দিয়া সকলেই যাইতে পারে। জোর বুঝি খালি তোমারই আছে, আমাদের নাই!”

 ইহাতে তো গন্ধর্ব ভারি চটিয়া একেবারে ধনুক বাগাইয়া তীর ছুঁড়িতে আরম্ভ করিল। অর্জুন তাড়াতাড়ি হাতের ঢাল আর মশাল ঘুরাইয়া তীর ফিরাইয়া দিলেন। তরপর ধনুকে আগ্নেয়াস্ত্র জুড়িয়া মারিতেই গন্ধর্ব মহাশয়ের রথ পুড়িয়া ছাই, আর তিনি নিজে মুখ থুবড়িয়া মাটিতে পড়িয়া একেবারে চক্ষু বুজিয়া অজ্ঞান! তখন অর্জুন তাঁহার চুলের মুঠি ধরিয়া তাঁহাকে যুধিষ্ঠিরের নিকট উপস্থিত করিলেন৷

 এদিকে গন্ধর্বের স্ত্রী কুন্তীনসীও যুধিষ্ঠিরের নিকট আসিযা কাঁদিয়া পড়িয়াছেন। কাজেই যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলিলেন, “ভাই উহাকে ছাড়িয়া দাও৷”

 তখন অর্জুন গন্ধর্বকে বলিলেন, “কুরুরাজ যুধিষ্ঠির তোমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। কাজেই তোমার আর কোনো ভয় নাই, নিশ্চিন্তে ঘরে চলিয়া যাও৷”

 তাহা শুনিয়া গন্ধর্ব বলিল, “আমি হার মানিলাম। ইহাতে আমার কোনো দুঃখ নাই বরং সুখের কথা। শত্রুকে কাবু করিয়া এমনভাবে দয়া কি যে-সে লোকে করিতে পারে?”

 এই বলিয়া গন্ধর্ব অর্জুনকে চাক্ষুষী-বিদ্যা নামক এক আশ্চর্য বিদ্যা শিখাইয়া দিল। ত্রিভুবনের মধ্যে যে বস্তুই দেখিতে ইচ্ছা হইবে, এই বিদ্যা জানা থাকিলে তাহা তৎক্ষণাৎ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহা ছাড়া পাণ্ডবদিগকে সে একশতটি এমন আশ্চর্য ঘোড়া দিল যে, তাহারা কখনো কাহিল বা বুড়া হয় না, তাহাদের কোনো অসুখ বা মৃত্যু নাই, তাহাদের সমান ছুটিতেও কেউ পাবে না৷

 অর্জুন এই-সকলের বদলে গন্ধর্বকে ব্রহ্মাস্ত্র দিলেন, আর স্থির হইল যে ঘোড়াগুলি এখন গন্ধর্বের নিকটেই থাকিবে, পাণ্ডবদিগের দরকার হইলে তাঁহাদের নিকট আসিবে৷

 এইরূপে গন্ধর্ব আর অর্জুনে বন্ধুতা হইয়া গেল। গন্ধর্বের নাম অঙ্গারপর্ণ আর চিত্ররথ দুইই ছিল। চিত্ররথ বলিল, “এখন হইতে আমার চিত্ররথ নাম ঘুচিয়া দগ্ধরথ নাম হউক৷”

 চিত্ররথ অতিশয় পণ্ডিত লোক, পাণ্ডবেরা তাহার নিকট অনেক নূতন কথা শিখিলেন। পাণ্ডবদের একটি পুরোহিতের প্রয়োজন ছিল। তাই তাঁহারা চিত্ররথকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি কাহাকে পুরোহিত করি?”

 চিত্ররথ বলিলেন, “ধৌম্যকে পুরোহিত কর, এমন লোক আর পাইবে না। উৎকোচক নামক তীর্থে গেলে তাঁহার দেখা পাইবে৷”

 সুতরাং পাণ্ডবেরা উৎকোচক তীর্থে ধৌম্যের সন্ধানে চলিলেন। তাঁহাকে পুরোহিত করিয়া তাঁহাদের যে কত উপকার হইয়াছিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায়না। এখন হইতে তাঁহাদের দলে ধৌম্য সমেত সাতজন লোক হইল। সাতজন মিলিয়া তাঁহারা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর দেখিতে চলিলেন৷

 পথে কয়েকটি ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা। তাঁহারাও স্বয়ম্বরেরই যাত্রী। তাঁহারা পাণ্ডবদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কোথা হইতে আসিতেছেন?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আজ্ঞে, আমরা একচক্রা হইতে আসিতেছি৷”

 ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, “আমাদের সঙ্গে চলুন! আজ পাঞ্চাল দেশে বড় ধুমধাম হইবে, আমরা তাহা দেখিতে চলিয়াছি। সেখানকার রাজা যজ্ঞসেনের[২] মেয়ের স্বয়ম্বর। সেই মেয়ের গায়ের গন্ধ পদ্মের মতন। এক ক্রোশ দূর হইতে তাহা টের পাওয়া যায়। কত রাজা, কত পণ্ডিত, কত মুনি সেখানে আসিবেন, তাহার সীমা নাই। গান বাজনা, বাজি, কুস্তির কথা আর কি বলিব। পেট ভরিয়া ফলার পাইব, চোখ ভরিয়া তামাশা দেখিব, তারপর পুঁটলি ভরিয়া দান-দক্ষিণা লইয়া ঘরে ফিরব। চলুন আমরা একসঙ্গেই যাই আপনাদিগকে যেমন সুন্দর দেখিতেছি, চাই কি সেই মেয়ে আপনাদের কাহাকেও মালা দিয়া বসিতে পারে!

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “যে আজ্ঞা! আমরা আপনাদের সঙ্গে চলিলাম।”

 পাঞ্চালদেশে উপস্থিত হইয়া পাণ্ডবেরা এক কুমারের বাড়িতে বাসা লইলেন। সেইখানে তাঁহারা থাকেন, আর ভিক্ষা করিয়া খান।

 দ্রুপদের ইচ্ছা অর্জুনের সহিত দ্রৌপদীর বিবাহ হয়। সুতরাং যাহাতে অর্জুন ছাড়া আর কেহ দ্রৌপদীকে বিবাহ করিতে না পারে তিনি তাহার এক আশ্চর্য উপায় স্থির করিলেন।

 একটা ভয়ংকর ধনুক, তাহাকে কেহই বাঁকাইতে পারে না, সেই ধনুক বাঁকাইয়া তাহাতে গুণ পরাইতে হইবে। তারপর সেই ধনুকে তীর চড়াইয়া খুব উঁচুতে ঝুলানো একটা জিনিসকে বিধিতে হইবে। পথের মাঝখানে আবার একটা কলের মতন আছে, সেটার ভিতর দিয়া তীর গেলে তবে সেই জিনিসটাতে পৌঁছাইতে পারে।

 এতখানি কাজ করিয়া যে লক্ষ্য (অর্থাৎ যে জিনিসটাকে বিধিবার কথা, তাহা) বিঁধিতে পারিবে, সে দ্রৌপদীকে পাইবে। দ্রুপদ বুঝিয়াছিলেন যে, অর্জুন ছাড়া আর কাহারো সে ক্ষমতা নাই, কিন্তু তিনি এ কথা কাহাকেও বলিলেন না।

 স্বয়ম্বরের সংবাদ পাইয়া পৃথিবীতে যত রাজা আর রাজপুত্র আর যোদ্ধা আর বড়লোক সকলেই আসিয়া পাঞ্চাল দেশে উপস্থিত হইয়াছে। কর্ণ, দুর্যোধন, ভীষ্ম, দ্রোণ কেহই আসিতে বাকি নাই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আর মুনি ঋষিতে পাঞ্চাল দেশ ছাইয়া গিয়াছে। দেবতারা পর্যন্ত না আসিয়া থাকিতে পারেন নাই।

 স্বয়ম্বরের স্থানটি যে কি সুন্দর করিয়া সাজাইয়াছে, তাহা না দেখিলে বলা কঠিন। বড়বড় জমকালো ফটক, কাজকবা উঁচু পাচিল, রংবেরঙের ঝালর, নিশান, পর্দা আর চাঁদোয়া, এই সকলের একটা খুব ঘটা মনে করিয়া লও। আর মনে কর, ইহার চারিধারে খাল, তাহাতে জল টলমল করিতেছে, পদ্মফুল ফুটিয়াছে, হাঁস চরিতেছে আর লাল মাছ খেলিতেছে। রাজারাজড়ার জন্য উঁচু উঁচু জায়গা হইয়াছে, তাহাতে বসিয়া তাঁহারা ভালো মতো দেখিতে পাইবেন। সাধারণ লোকেরও ভালোমতোই দেখিবার ইচ্ছ, কিন্তু তাহাদের জন্য আর কে উঁচু জায়গা রাখিবে? কাজেই তাহারা গাছে উঠিয়া রাজাদের চেয়েও ভালো দেখিবার জোগাড় করিল। যাহারা দেখিবার বেশি সুবিধা পাইল না, তাহারা খালি গোলমাল করিয়াই সাধ মিটাইতে লাগিল। উহাদের গলার শব্দই বেশি হইয়াছিল, না বাজনার শব্দই বেশি হইয়াছিল, তাহা ঠিক করিয়া বলা শক্ত।

 পনেরোদিন খালি গানবাজনাই চলিল। বোল দিনের দিন দ্রৌপদী স্নানের পর আশ্চর্য পোশাক এবং অলংকার পরিয়া সোনার মালা হাতে সভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। অমনি গোলমাল থামাইয়া, বাজনা থামাইয়া সারা সভাটি চুপচাপ।

 তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভার মাঝখানে আনিয়া গম্ভীরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “আপনারা সকলে শুনুন। এই ধনুর্বাণ আর ঐ লক্ষ্য আপনারা দেখিতেছেন। ঐ যে একটা কলের মতন, তাহাতে ছিদ্র আছে তাহাও দেখুন। ঐ ছিদ্রের ভিতর দিয়া পাঁচটি তীর মারিয়া লক্ষ্য বিঁধিয়া মাটিতে ফেলিতে হইবে। এ কাজ যিনি করিতে পারিবেন, তিনিই দ্রৌপদীকে পাইবেন।”

 সভার সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এত রাজারাজড়ার মধ্যে না জানি কে আজ দ্রৌপদীকে লইয়া যায়। সেই সভায় কৃষ্ণ আর বলরামও উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন যে, পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই ছদ্মবেশে ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে বসিয়া আছে। ইহাতে যারপরনাই আনন্দিত হইয়া তিনি চুপিচুপি বলরামকে এ কথা জানাইলেন। কিন্তু তাঁহারা দুভাই ভিন্ন আর কেহই পাণ্ডবদিগকে চিনিতে পারিল না। তাহারা তামাশা দেখিতেই ব্যস্ত ছিল।

 এদিকে বাজনা বাজিতেছে, আর রাজাদিগের মধ্য হইতে এক-একজন করিয়া লক্ষ্য বিঁধিয়া বিদ্যার পরীক্ষা দিতে যাইতেছেন। হায় হায়! সে সর্বনেশে ধনুক কাহারো হাতে বাগ মানিতে চাহে না: বরং তাহার ধাক্কায় রাজামহাশয়েরাই ঠিকরাইয়া পড়েন। বড়-বড় রাজা পর্যন্ত কেহ চিৎপাৎ হইয়া, কেহ ডিগবাজি খাইয়া, কাহারো পাগড়ি উড়িয়া গিয়া, নাকালের একশেষ। তাঁহাদের মুখে আর কথাটি নাই।

 এমন সময় কর্ণ আসিয়া দেখিতে দেখিতে সেই ধনুকে গুণ আর তীর চড়াইয়া লক্ষ্য বিধিতে প্রস্তুত হইলেন। তাহা দেখিয়া পাণ্ডবেরা মনে করিলেন, এই বুঝি লক্ষ্য বিঁধিয়া দ্রৌপদীকে লইয়া যায়।

 কিন্তু কর্ণকে দেখিয়া দ্রৌপদী বলিলেন, “সারথির ছেলের গলায় মালা দিতে পারিব না, কাজেই কর্ণকে লক্ষ্য না বিঁধিয়াই ফিরিয়া যাইতে হইল।”

 সেদিন রাজামহাশয়দের যে দুর্দশা! শিশুপালের তো হাঁটুই ভাঙ্গিয়া গেল! জরাসন্ধ গুতা খাইয়া চিৎপাৎ! তারপর তাড়াতাড়ি উঠিয়া ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে সেই যে তিনি সেখান হইতে চলিলেন, আর একেবারে নিজের ঘরে না পৌছিয়া থামিলেন না। শল্যেরও প্রায় সেই দশা!

 অর্জুন এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, রাজামহাশয়দের দুরবস্থা দেখিয়া এইবার তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন। অর্জুনকে লক্ষ্য বিধিতে যাইতে দেখিয়া ব্রাহ্মাদিগের আনন্দের আর সীমা-পরিসীমা রহিল না। তাঁহারা তাঁহাদের বসিবার হরিণের ছাল ঘুরাইয়া চিৎকার আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ যে আবার বিরক্তও না হইলেন এমন নহে। তাঁহারা বলিলেন, “আরে কর কি ঠাকুর? থামো, থামো! এ ব্যক্তি দেখিতেছি আমাদের সকলকে অপদস্থ করাইবে। বড় বড় রাজারা যাহা পারিল না, সেটা ইহার না করিলেই নয়। বেচারার মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে আর কি।”

 তাহা শুনিয়া আর অনেকে বলিলেন “তোমরা ব্যস্ত হইয়াছ কেন? ইহাকে যাইতে দাও ব্রাহ্মণে না করিতে পারে এমন কাজ আছে? ইনি কোনো মহাপুরুষ হইবেন। দেখিতেছ না, ইহার কেমন চেহারা? ও গায় কি তেজ! কাঁধ কি চওড়া! হাত কি লম্বা! এমন সুন্দর আর একটা মানুষ এখানে খুঁজিয়া বাহির কর দেখি। ইনি নিশ্চয় পারিবেন। তোমরা চুপ করিয়া দেখ। ঐ তিনি ধনুকে গুণ চড়াইতেছে"৷

 অর্জুন ধনুকের কাছে একটু থামিয়া ব্রাহ্মাদিগের কথাবার্তা শুনিতেছিলেন, তারপর তিনি দেবতাকে স্মরণ করিয়া ধনুকখানি হাতে লইলেন। সে ধনুকে গুণ চড়ানো কি আর অর্জুনের কাছে একটা কঠিন কাজ? তিনি চক্ষের পলকে গুণ চড়াইয়া, পাঁচটি তীর হাতে লইলেন। তারপর দেখিতে দেখিতে লক্ষ্য বিঁধিয়া মাটিতে পড়িল। সকলে দেখিয়া অবাক!

 তখন আকাশ হইতে দেবতারা জয় জয় শব্দে অর্জুনের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন আর ব্রাহ্মণদিগের কথা কি বলিব! হরিণের ছাল, কুশাসন, চাদর, কোঁচা কিছুই তাঁহারা ঘুরাইতে বাকি রাখিলেন না। তারপর বাজনদারেরা যে তাহাদের সকলগুলি ঢাক, ঢোল, সানাই, কাড়া আর কাঁসি একসঙ্গে মিলাইয়া একটা কাণ্ড করিয়াছিল, তাহা যদি শুনিতে!

 সেই আনন্দ কোলাহলের ভিতরে দ্রৌপদী হাসিতে হাসিতে অর্জুনকে মালা দিয়া তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন৷

 এদিকে কিন্তু রাজামহাশয়দের মুখ ভার আর চোখ লাল। তাঁহারা নিজে যে সকলেই সেদিন কি অদ্ভুত বিদ্যা দেখাইয়াছে, সে কথা আর তাঁহাদের মনে নাই। তাঁহারা থাকিতে ব্রাহ্মণ কেন মেয়ে লইয়া গেল, তাই তাঁদের রাগ! “এমন কথা? আমাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া অপমান করিল? অ্যাঁ বলেন কি মহাশয়?”

 “তাইতো! এমন কথা? অপমান করিল? অ্যাঁ!—মার্! মার্! দ্রুপদকে মার্ আর ঐ হতভাগা মেয়েটাকে পোড়াইয়া ফেল্?”

 এই বলিয়া সকল রাজা একজোটে দ্রুপদকে আক্রমণ করিতে আসিল। দ্রুপদ আর উপায় না দেখিয়া ব্রাক্ষণদিগের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অর্জুন ইহার পূর্বেই ধনুক বাণ লইয়া প্রস্তুত। ততক্ষণে ভীমও একটা বড়গোছের গাছ উপড়াইয়া ডাল-পাতা ঝাড়িয়া বেশ মজবুত একটি লাঠি প্রস্তুত করিয়া লইয়াছেন৷

 এদিকে এ সকল কাণ্ড দেখিয়া কৃষ্ণ বলরামকে বলিতেছেন, “দাদা, এ ধনুক অর্জুন ভিন্ন আর কেহই এমন করিয়া বাগাইতে পারে না আর এমন করিয়া গাছ ভাঙ্গিয়া লাঠি তয়ের করাও ভীম ছাড়া আর কাহারো কর্ম নহে। আর ঐ তিনজন নিশ্চয় যুধিষ্ঠির নকুল আর সহদেব। শুনিয়াছিলাম, পিসীমা (অর্থাৎ কুন্তী, ইনি কৃষ্ণ বলরামের পিসীমা) আর পাণ্ডবেরা জতুগৃহ হইতে রক্ষা পাইয়াছেন। এখন দেখিতেছি তাহা সত্য৷”

 বলরাম বলিলেন, “পিসীমা বাঁচিয়া আছে শুনিয়া বড়ই সুখী হইলাম৷”

 রাজারা যুদ্ধ করিতে আসিতেছে দেখিয়া ব্রাহ্মণদিগের বড়ই রাগ হইল। তাঁহারা হরিণের ছাল আর কমণ্ডলু ঘুরাইয়া ভীম অর্জুনকে বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই। আমরা তোমাদের হইয়া যুদ্ধ করিব৷”

 অর্জুন তাহাতে একটু হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা দাঁড়াইয়া দেখুন, আমরাই ইহাদিগকে তাড়াইয়া দিতেছি৷”

 তারপর যুদ্ধ আরম্ভ হইল, কর্ণ অর্জুনকে আর শল্য ভীমকে মারিবার জন্য দাঁত কড়মড় করিতে করিতে ছুটলেন, আর অন্য সকলে মিলিয়া ব্রাহ্মণদিগকে তাড়া করিলেন। কর্ণও খুব রাগিয়া তীর মারেন, অর্জুনও তেমনি তেজের সহিত তাঁহাকে সাজা দেন। তাঁহা দেখিয়া কর্ণ বলিলেন, “আপনি কে ঠাকুর? আমার মনে হয় আপনি স্বয়ং ধনুর্বেদ বা পরশুরাম বা সূর্য বা বিষ্ণু মানুষ সাজিয়া আসিয়াছেন। আমি রাগিয়া দাঁড়াইলে ইন্দ্র আর অর্জুন ছাড়া কেহ তো আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারে না৷”

 অর্জুন বলিলেন, “আমি ধনুর্বেদও নহি, পরশুরামও নহি। আমি সাদা-সিধা ব্রাহ্মণ, গুরুর কাছে অস্ত্র শিখিয়া তোমাকে সাজা দিতে আসিয়াছি৷”

 এ কথায় কর্ণ বলিলেন, “আপনার ব্রাহ্মণের তেজ, আপনার সঙ্গে আমি পারিব কেন? এই বলিয়া তিনি যুদ্ধ ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।”

 এদিকে শল্য আর ভীমে মল্লযুদ্ধ চলিয়াছে। এক একটা কিল পড়ে যেন পাহাড় ভাঙ্গি য়া পড়ে। ক্রমাগত কেবল ধুপ্‌ধাপ্, টিপটপ, ঠকাঠক্, চটাপট্ ছাড়া আর কথাই নাই। এমন সময়ে ভীম শল্যকে তুলিয়া এক আছাড় দিলেন, আর তাহা দেখিয়া ব্রাহ্মণেরা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, ভীম শল্যকে এমনি কাবু করিয়াও তাহাকে মারিলেন না৷

 এ সকল কাণ্ড দেখিয়া রাজামহাশয়েরা ভয়ে জড়সড়। তাঁহারা আর যুদ্ধ করিবেন কি, এখন কোনো মতে ভীম আর অর্জুনের প্রশংসা করিয়া মানে মানে ফিরিতে পারিলে বাঁচেন। কাজেই তাঁহারা বলিলেন, “বাঃ! ইহার খুব যুদ্ধ করিয়াছেন! যে সে লোক তো কর্ণ আর শল্যকে আঁটিতে পারে না। ইহারা ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ হাজার দোষী হইলেও তাঁহাকে মাপ করিতে হয়। ইহাদের সহিত আমাদের যুদ্ধ করিয়া কাজ নাই, যদিও দরকার হইলে অবশ্য আমরা একটা কাণ্ডকারখানা করিয়া ফেলিতে পারিতাম!”

 তাহা শুনিয়া কৃষ্ণ বলিলেন, “রাজামহাশয়েরা ঠিক বলিয়াছে। ইহারা উচিত মতেই রাজকন্যাকে পাইয়াছে, ইহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আপনাদের কাজ নাই৷”

 কাজেই তখন রাজারা চলিয়া গেলেন৷

 এদিকে কুন্তী সেই কুমারের ঘরে বসিয়া ভাবিতেছেন, “পুত্রেরা কেন এখনো ভিক্ষা লইয়া ঘরে ফিরিল না? দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রের লোকেরা কি তাহাদিগকে মারিয়া ফেলিল, না রাক্ষসেরা তাঁহাদের কোনো অনিষ্ট করিল?”

 এমন সময় ভীম আর অর্জুন আসিয়া বাহির হইতে বলিলেন, “মা! আজ ভিক্ষায় গিয়া বড় সুন্দর জিনিস আনিয়াছি৷”

 কুন্তী ভিতরে ছিলেন, দেখিতে পান নাই। তিনি বেশি না ভাবিয়াই বলিলেন, “যাহা পাইয়াছ, তাহা তোমাদের সকলেরই হউক৷”

 বলিতে বলিতেই দেখেন ওমা! কি সর্বনাশ! এতো সাধারণ জিনিস নহে, এযে রাজকন্যা!

 এখন উপায়? কুন্তী যে ‘সকলেরই হউক’ বলিয়া বসিয়াছে, এখন উপায় কি? এ কথা মিথ্যা হইয়া গেলে কুন্তীর পাপ হয়। সত্য হইতে হইলে পাঁচ ভাই মিলিয়া দ্রৌপদীকে বিবাহ করিতে হয়৷

 পাণ্ডবেরা বলিলেন, “তাহাই হউক। দ্রৌপদীকে আমরা সকলে মিলিয়া বিবাহ করিব, তবু মায়ের কথা মিথ্যা হইতে দিব না৷”

 তাঁহাদের এইরূপ কথাবার্তা ঠিক হইয়াছে, এমন সময় কৃষ্ণ আর বলরাম সেইখানে আসিয়া উপস্থিত। কৃষ্ণকে দেখিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “কি আশ্চর্য আমরা এখানে লুকাইয়া রহিয়াছি, তোমরা আমাদের কথা কি করিয়া জানিলে?”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “আগুন কি কাপড়ে চাপা থাকিতে পারে? যে কাণ্ডকারখানা আজ হইয়াছে, আপনারা নহিলে আর কে তাহা করিবে? কি ভাগ্য যে আপনারা সেই দুষ্টদের হাত হইতে বাঁচিয়া আসিয়াছেন৷”

 এইরূপ খানিক কথাবার্তা কহিয়া কৃষ্ণ আর বলরাম সেখান হইতে চলিয়া গেলেন৷

 এখানকার ঘটনা তো এইরূপ। ওদিকে দ্রুপদ আর তাঁহার লোকেরা না জানি কি করিতেছেন! তাঁহাদের মনে খুবই চিন্তা, তাহাতে আর ভুল কি? দ্রৌপদী কাহার হাতে পড়িলেন, যে দুজনে তাঁহাকে লইয়া গেল, তাহারা কে, কিরূপ লোক, কিছুই জানা নাই। এমন অবস্থায় আপনার লোকেরা মন কি স্থির থাকিতে পারে? কাজেই ধৃষ্টদ্যুম্ন কয়েকটি লোক লইয়া চুপিচুপি সেই দুজনের পিছু পিছু চলিলেন। চল আমরাও ইহাদের সঙ্গে সঙ্গে যাই৷

 ঐ সেই দুজন দ্রৌপদীকে লইয়া চলিয়াছে। ব্রাহ্মণেরা অনেকেই উহাদের সঙ্গে যাইতেছে। যে লক্ষ্য বিধিয়াছিল, দ্রৌপদী যেন খুব আহ্লাদের সহিত তাঁহার আসনখানি বহিয়া চলিয়াছেন উহারা কোথায় যায়, দেখিতে হইবে৷

 তাইতো উহারা যে কুমারের বাড়ি ঢুকিল! আচ্ছা দেখা যাউক এরপর কি করে। সেখানে আরো কাহারা আছে। তিনজন পুরুষমানুষ। ঠিক ইহাদেরই মতো তাহাদেরও চেহারা, নিশ্চয় ইহাদের ভাই হইবে। আর ঐ বুড়া স্ত্রীলোকটি কে? তাহার শরীরে কেমন তেজ দেখিয়াছ? খুব বড়ঘরের মেয়ে, তাহতে সন্দেহ নাই, বোধহয় ইহাদের মা, নহিলে ইহারা আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিবে কেন?

 দ্রৌপদীকে সেই স্ত্রীলোকটির কাছে রাখিয়া উহারা কোথায় বাহির হইয়া গেল? বোধহয় ভিক্ষায়৷

 ঐ তাহারা ভিক্ষা লইয়া ফিরিয়াছে, আর দেখ, ছেট চারিজন তাহাদের ভিক্ষার জিনিস তাহাদের বড় ভাইটির সামনে আনিয়া রাখিতেছে উহারা নিশ্চয় খুব ধার্মিক লোক! দেখ না, সকলের আগে ভিক্ষার জিনিস দেবতাকে দিল। আর দেখ কেমন দাতা, উহার ভিতর হইতে আবার ব্রাহ্মণদিগকে ভিক্ষা দিতেছে!

 আচ্ছা উহারা তো সাতজন লোক, কিন্তু ভিক্ষার জিনিস মোটে দুইভাগ করিল কেন? ওহ! দেখিয়াছ? একভাগের তাবতই ঐ ষণ্ডাটি একলা নিল! তা উহার যেমন শরীর, আহরটি তো তেমনই চাই। কম খাইলে কি আর এত বড় গাছ লইয়া রাজামহাশয়দিগকে এমন সাজাটি দিতে পারিত? উহার ওটুকু চাই। বাকি অর্ধেকের ভাগ হইল, আর ছয়জনে খাইবে৷

 বাঃ! ভিখারির খাওয়া-দাওয়া তো বেশ সহজ। ঐ শেষ হইয়া ইহারই মধ্যে সব পরিষ্কার। ছোট দুটি ভাই কুশ বিছাইতেছে। বিছানাও বেশ পরিষ্কার, কুশের উপর হরিণের ছাল, বেশ তো! পাঁচ ভাই দক্ষিণশিয়রী হইয়া শুইল। উহাদের মা উহাদের মাথার কাছে, আর ঐ দেখ দ্রৌপদী পায়ের কাছে শুইলেন। কিন্তু দেখিলে? পায়ের কাছে শুইয়াই কেমন সুখী!

 শোন, শোন! উহারা কি কথাবার্তা বলে। যুদ্ধের কথা, অস্ত্রশস্ত্রের কথা। কি সুন্দর কথাবার্তা। ইহারা নিশ্চয় ক্ষত্রিয় আর বড়লোক। চল যাই, রাজাকে বলি গিয়া৷

 এইরূপ দেখিয়া শুনিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন ও তাহার দলের লোক চলিয়া আসিলেন৷

 এদিকে দ্রুপদ যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া আছে। ধৃষ্টদ্যুম্ন আসিতেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি দেখিলে বাবা? আমাদের কৃষ্ণা কাহার হাতে পড়িল? সে লোকটি কি অর্জুন হইবে? আহা! কৃষ্ণা আমার কোনো ছোটলোকের হাতে পড়ে নাই তো?”

 ধৃষ্টদ্যুম্ন বলিলেন, “বাবা! কোনো চিন্তা করিবেন না। কৃষ্ণা যে সে লোকের হাতে পড়ে নাই। উহারা নিশ্চয় ক্ষত্রিয় আর খুবই বড়লোক হইবেন, তাহাতে ভুল নাই। শুনিয়াছি পাণ্ডবেরা নাকি সেই আগুনে পোড়া হইতে রক্ষা পাইয়াছে। আমার মনে হয় ইঁহারাই পাণ্ডব!”

 আহা! কি আনন্দের কথা! ইঁহারা কি তবে পাণ্ডব? যাহা হউক ইহাদিগকে উচিত আদর দেখাইতে হইবে। তখনই রাজপুরোহিত ছুটিয়া সেই কুমারের বাড়িতে চলিলেন। সেখানে আসিয়া যখন যুধিষ্ঠিরের নিকট সকল কথাই জানিতে পারিলেন, তখন তাঁহার আনন্দ দেখে কে!

 ইহার মধ্যে রাজবাড়ি হইতে সোনার রথ লইয়া লোক উপস্থিত। সেই রথে চড়িয়া সকলে রাজবাড়ি আসিলেন। সেখানে কতরকম জিনিস দিয়া যে তাঁহাদিগকে আদর করা হইল, তাহার সীমা নাই। আর আহারের আয়োজনের কথা কি বলিব? তেমন মিঠাই সন্দেশ আমি কখনো দেখি নাই। পাণ্ডবেরা দামী পোশাক পরিয়া সোনার থালায় সেই-সকল মিষ্টান্ন আহার করিলেন। যে সকল জিনিস তাঁহাদিগকে দেওয়া হইয়াছিল, তাহার মধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ছাড়া আর কিছু তাঁহারা লইলেন না। ইহাতে নিশ্চয় বুঝা গেল যে ইহারা ক্ষত্রিয়, তথাপি দ্রুপদ তাঁহাদিগকে বিনয় করিয়া বলিলেন, “আপনারা কে, আমরা তাহা জানি না। আপনারা নিজের পরিচয় দিয়া আমাদিগকে সুখী করুন৷”

 এ কথায় উত্তরে যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মহারাজ! আপনি কোনো চিন্তা করিবেন না। আমরা ক্ষত্রিয়, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্র। কুন্তীদেবী আমাদের মাতা। আমি সকলের বড়, আমার নাম যুধিষ্ঠির। ইহার নাম ভীম। ইনি অর্জুন, যিনি লক্ষ্য বিঁধিয়াছিলেন। মা আর দ্রৌপদীর সঙ্গে যে দুটি আছে, তাঁহাদের নাম নকুল আর সহদেব৷”

 যুধিষ্ঠিরের কথা শুনিয়া দ্রুপদ আহ্লাদে কিছুকাল কথা কহিতে পারিলেন না। তারপর কথাবার্তায় সকল ঘটনা জানিতে পারিয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করিতে করিতে বলিলেন, “তোমাদেব রাজ্য নিশ্চয় তোমাদিগকে লইয়া দিব!”

 তারপর বিবাহের কথা। পাঁচ ভাই মিলিয়া দ্রৌপদীকে বিবাহ করিবেন শুনিয়া তো সকলে অবাক। এমন কথা তো কখনো শুনে নাই। এও কি হয়?

 সকলে এইরূপ কথাবার্তা কহিতেছে, এমন সময় ব্যাসদেব সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্যাসদেব সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “তোমরা কেন ব্যস্ত হইয়াছ? এ কাজে কোনো মুস্কিলই নাই। দ্রৌপদীর সহিত যে ইহাদের বিবাহ হইবে, ইহা তো শিব অনেকদিন আগেই বলিয়া রাখিয়াছে। আর-এক জন্মে দ্রৌপদী এক মুনির কন্যা ছিলেন। যাহাতে খুব গুণবান লোকের সহিত তাহার বিবাহ হয়, এই জন্য সেই কন্যা শিবের তপস্যা করেন। শেষে যখন শিব বর দিতে আসিলেন, তখন কন্যা ব্যস্ত হইয়া ক্রমাগত পাঁচবার বলিলেন, ‘সকল গুণ যাঁহার আছে, এমন লোকের সহিত আমার বিবাহ হউক৷’ শিব বলিলেন, ‘তুমি পাঁচবার এ কথা বলিলে, কাজেই পাঁচজনের সহিত তোমার বিবাহ হইবে।’ সেই কন্যা এখন দ্রৌপদী হইয়াছে। আর শিবের আজ্ঞা, কাজেই পাঁচজনের সহিত তাঁহার বিবাহ হইতেই হইবে৷”

 তারপর বিবাহের আয়োজন আরম্ভ হইল। কত লোক, কত বাদ্য, কত গান, কত সাজ, কত আলল, কত পূজা, কত আনন্দ! হাতি ঘোড়া, রত্ন অলংকার, দাস দাসী প্রভৃতি যৌতুকই (অর্থাৎ দ্রুপদ পাণ্ডবদিগকে যাহা দিলেন)—বা কত! যাহারা দেখিতে আসিয়াছিল, এত আয়োজন আর এমন সুন্দর বরকন্যা দেখিয়া তাহাদের চক্ষু জুড়াইয়া গেল, আর দামী পোশাক আর অলংকার উপহার পাইয়া তাহাদের মন খুশি হইয়া গেল৷

 দুর্যোধন আর তাঁহার দলের লোকেরা দেখিলেন যে, পাণ্ডবদিগকে তাঁহারা পোড়াইয়া মারিয়াছে বলিয়া মনে মনে এত সুখ বোধ করিয়াছিলেন, সেই পাণ্ডবদিগের সহিতই দ্রৌপদীর বিবাহ হইয়াছে। যিনি লক্ষ্য বিঁধিয়াছিলেন তিনি অর্জুন আর যিনি শল্যকে আছড়াইয়াছিলেন, তিনি ভীম ছাড়া আর কেহ নহেন৷

 তখন তাঁহাদের যে দুঃখ! তাঁহারা এত চেষ্টা করিলেন, তবুও পাণ্ডবেরা মরিলেন না, কি অন্যায়! সেই পুরোচনটা নিতান্তই গাধা ছিল, তাহারই বুদ্ধির দোষে পাণ্ডবেরা বাঁচিয়া গিয়াছে!

 ক্রমে এই সংবাদ বিদুরের নিকট পৌঁছিল। তাহা শুনিবামাত্রই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের নিকট গিয়া বলিলেন, “মহারাজ! স্বয়ম্বব সভায় কৌরবেরাই জিতিয়াছে৷”

 অবশ্য পাণ্ডবেরাও তো কৌরব, কাজেই বিদুর ঠিকই বলিয়াছেন। কিন্তু ধৃতবাষ্ট্র তাহা বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য! বিদুর কি সুখের সংবাদই শুনাইলে! শীঘ্র দুর্যোধন আর দ্রৌপদীকে এখানে নিয়া আসুক৷’

 বিদুর বলিলেন, ‘মহারাজ, পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে পাইয়াছেন। তাঁহারা সকলেই ভালো আছে, আর সেখানে তাঁহাদের অনেক বন্ধু জুটিয়াছে!’

 এই সংবাদে ধৃতরাষ্ট্রের মনে খুবই দুঃখ হইল। কিন্তু তিনি সামলাইয়া গিয়া বলিলেন, ‘তা ভালোই হইয়াছে। আমি আমার নিজের ছেলেদের চেয়েও পাণ্ডবদিগকে ভালোবাসি। আমার ছেলেগুলি বড় দুষ্ট, উহারা পাণ্ডবদের হাতে খুবই সাজা পাইবে৷’

 বিদুর বলিলেন, মহারাজ, সকল সময়ই যেন আপনার এইরূপ বুদ্ধি থাকে৷

 এই কথাবার্তার কথা জানিতে পারিয়া দুর্যোধন আর কর্ণ গোপনে ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, ‘আপনি বিদুরের কাছে শত্রুর প্রশংসা করিলেন কেন? উহাদিগকে এইবেলা জব্দ না করিতে পারিলে যে শেষে আমাদের বিপদ হইবে৷’

 ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘আমারও সেই মত। কেবল বিদুরের কাছে মনের কথা লুকাইবার জন্য পাণ্ডবদের প্রশংসা করি। ও তাহা কিছুই বুঝিতে পারে না। সুযোদন! তুমি কি করিতে চাহ, বল৷

 সুযোধন কে, বুঝিলে?—দুর্যোধন। বাপ কিনা ছেলেকে আদর করিয়া মিষ্ট নামে ডাকিয়া থাকে, তাই ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বলিতেন, ‘সুযোধন’৷

 দুর্যোধন পাণ্ডবদিগকে মারিবার জন্য কতরকম উপায়ের কথাই ভাবিয়া রাখিয়াছেদন—

 ‘পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া বাধাইয়া দিলে উহারা নিজেরাই কাটাকাটি করিয়া মরিবে৷'

 ‘দ্রুপদকে ধন দিয়া বশ করিলেও কাজ চলিতে পারে৷’

 ‘গুণ্ডা লাগাইয়া ভীমকে মারিয়া ফেলিতে পারিলে তো আর কথাই নাই।’

 ‘আর কিছু না হয়, তাঁহাদিগকে ভুলাইয়া এখানে আনিয়া মারিবার ফন্দি করিলেও মন্দ হয় না৷’

 এ-সকল পরামর্শ কর্ণের তত ভালো লাগিল না। তাঁহার ইচ্ছা, এখনই যুদ্ধ করিয়া পাণ্ডবদিগকে বধ করেন৷

 যাহা হউক, ধৃতরাষ্ট্র ইহাদের কথায় নিশ্চিন্ত হইতে না পারিয়া ভীষ্ম, দ্রোণ আর বিদুরকে ডাকাইলেন৷

 ভীষ্ম আর দ্রোণ দুইজনেই বলিলেন, ‘পাণ্ডবদিগকে অর্ধেক রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া তাঁহাদের সহিত বন্ধুতা করা উচিত, নহিলে বিপদ হইবে৷’ কিন্তু একথা কর্ণের একেবারেই পছন্দ হইল না। রাগের চোটে ভদ্রতা ভুলিয়া গিয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘মহারাজ! ইহারা আপনার টাকা খান, অথচ কি পরামর্শ দিলেন দেখুন। ইহারা কেমন লোক, আর আপনার কেমন বন্ধু, ইহাতেই বুঝিয়া লইবেন৷’

 বিদুর বলিলেন, ‘মহারাজ! ভালো কথা কেবল বলিলে কি হয়, তাহার মতো কাজ হইলে তবে তো উপকার হইবে। ভীষ্ম দ্রোণ ইহারা এক-একজন কিরূপ মহাপুরুষ, ভাবিয়া দেখুন। দুর্যোধন, কর্ণ শকুনি ইহারা গোঁয়ার, ইহাদের কথা শুনিয়া চলিলে আপনার সর্বনাশ হইবে, এ কথা আমি বলিয়া রাখিতেছি৷’

 কাজেই তখন ধৃতরাষ্ট্র আর কি করেন? তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ আর বিদুরের মতেই মত দিয়া বলিলেন, ‘বিদুর! তুমি গিয়া ইহাদের সকলকে আদরের সহিত লইয়া আইস।’

 বিদুর এই সংবাদ লইয়া পাঞ্চালদেশে যাইতে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিলেন না। অনেকদিন পরে পাণ্ডবদিগকে দেখিয়া তাঁহার যেমন সুখ হইল পাণ্ডবদেরও তাঁহাকে দেখিয়া তেমনি, বরং তাহার চেয়ে অধিক, সুখ হইল। দ্রুপদ, কৃষ্ণ, বলরাম ইহারা বিদুরকে যারপরনাই সম্মান দেখাইলেন৷

 ধৃতরাষ্ট্রের ভালো বুদ্ধি হইয়াছে ইহা তো বেশ সুখেরই বিষয কাজেই পাণ্ডবেরা দ্রুপদের অনুমতি লইয়া বিদুর, কৃষ্ণ আর বলরামের সঙ্গে হস্তিনায় আসিলেন। আহা নগরের লোকগুলির তাঁহাদিগকে দেখিয়া যে আনন্দ! তাহারা যেন হাতে স্বর্গ পাইল৷

 তারপর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, বাবা যুধিষ্ঠির! তোমরা অর্ধেক রাজ্য লইয়া খাণ্ডবপ্রস্থে গিয়া বাস কর, তাহা হইলে আর দুর্যোধনের সহিত তোমাদের কোনরূপ ঝগড়া হইবে না। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণামপূর্বক পাণ্ডবেরা খাণ্ডবপ্রস্থে আসিয়া অর্ধেক রাজ্য লইয়া সুখে বাস করিতে লাগিলেন৷

 খাণ্ডবপ্রস্থ দেখিতে দেখিতে হস্তিনার চেয়েও বড় আর সুন্দর হইয়া উঠিল। মঠ-মন্দির, লোকজন, হাট-বাজার, দীঘি-পুকুর বাগানে এমন, শোভা আর অতি অল্প স্থানেই দেখা যায়৷

 এইরূপ সুখে তাঁহাদিগকে খাণ্ডবপ্রস্থে রাখিয়া কৃষ্ণ আর বলরাম দ্বারকায় (যেখানে তাঁহাদের বাড়ি) চলিয়া গেলেন৷

 ইহার মধ্যে কি হইল শুন৷

 পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই আর দ্রৌপদী, ইঁহাদের নিজেদের মধ্যে ব্যবহার অতিশয় মিষ্ট ছিল। দ্রৌপদীর সঙ্গে তাঁহারা যারপরনাই ভদ্রতা করিয়া চলিতেন। তিনি তাঁহাদের কোনো একজনের সহিত কথাবার্তা কহিবার সময় কখনো আর-একজন গিয়া তাহাতে বাধা দিতেন না। এমনকি, তাঁহাদের নিয়ম ছিল যে, যদি তাঁহাদের কেহ এরূপ অভদ্রতা করেন, তবে তাঁহাকে বারো বৎসর সন্ন্যাসী হইয়া বনে বাস করিতে হইবে৷

 ইহার মধ্যে একদিন এক ব্রাহ্মণের গোরু চোরে লইয়া গিয়াছে। ব্রাহ্মণ তো খাণ্ডবপ্রস্থে আসিয়া মহাকান্না জুড়িয়াছে, ‘হে পাণ্ডবগণ! আমার গোরু চোরে লইয়া গেল! হায় হায়! আমার গোরু চোরে সইয়া গেল!’

 ব্রাহ্মণের কান্না শুনিয়া অর্জুন বলিলেন, ‘ভয় নাই ঠাকুর! এই আমি চোরকে সাজা দিতেছি৷’

 এই বলিয়া তিনি অস্ত্র আনিতে ছুটিয়া চলিয়াছে, এমন সময় তাঁহার মনে হইল যে, অস্ত্রের ঘরে দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠির কথাবার্তা কহিতেছেন। তখন অর্জুন ভাবিলেন যে, ‘এখন গিয়া ইঁহাদের কথাবার্তায় বাধা দিলে অভদ্রতা হইবে, আর বারো বৎসরের জন্য বনে যাইতে হইবে বটে, কিন্তু চোখের সামনে ব্রাহ্মণের গোরু চোরে লইয়া যাইতেছে, ইহা সহ্য হইবার নহে। বরং বনেই যাইব, তথাপি ব্রাহ্মণের গোরু চোরে নিতে দিব না৷’

 এই মনে করিয়া তিনি অস্ত্র লইয়া চোর ধরিতে বাহির হইলেন। চোরকে মারিয়া ব্রাহ্মণের গোরু আনিয়া দিতে তাঁহার বেশি বিলম্ব হইল না। ব্রাহ্মণ গোরু পাইয়া চিৎকারপূর্বক অর্জুনকে প্রশংসা আর আশীর্বাদ করিতে করিতে ঘরে ফিরিলেন৷

 তারপর অর্জুন যুধিষ্ঠিরের নিকট গিয়া বলিলেন, ‘দাদা, নিয়ম যে ভাঙ্গিল! এখন অনুমতি করুন, বনে যাই৷’

 যুধিষ্ঠির তো শুনিয়াই অবাক! তাঁহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তিনি বলিলেন, ‘সে কি ভাই, তোমার তো কিছুমাত্র অভদ্রতা হয় নাই। আর তুমি ব্রাহ্মণের কাজ করিতে গিয়াছিলে, সুতরাং একটা নিয়ম থাকিলেও তোমার না গেলেই দোষ হইত। আমি তো তোমার দাদা, আমার কথা তো মান্য কর, আমি বলিতেছি তোমার বনে যাওয়ার দরকার নাই। লক্ষ্মী ভাই! তুমি কোনো চিন্তা করিও না৷’

 অর্জুন বলিলেন, ‘দাদা আপনিই তো কহিয়াছে, মিথ্যা বলিয়া ধর্মকর্মও করিবে না। নিয়ম করিয়া তাহা ভাঙ্গিলে অন্যায় কাজ করা হইবে, আমি অস্ত্র ছুঁইয়া বলিতেছি, আমি তাহা পারিব না৷’

 কাজেই যুধিষ্ঠির আর বিদায় না দিয়া থাকিতে পারিলেন না। অর্জুন তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া বারো বৎসরের জন্য বনে চলিয়া গেলেন৷

 অৰ্জুন বনে থাকার সময় অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়াছিল। একদিন তিনি গঙ্গায় নামিয়া স্নান করিতেছেন, এমন সময় নাগরাজ কৌরবের কন্যা উলুপী তাঁহাকে ধরিয়া জলের ভিতর দিয়া একেবারে তাঁহাদের দেশে (অর্থাৎ পাতালে) নিয়া উপস্থিত করেন। তারপর যতক্ষণ অর্জুন উলুপীকে বিবাহ করিতে রাজি হন, ততক্ষণ তিনি তাঁহাকে আসিতে দেন নাই৷

 ইহার কিছুদিন পরে অর্জুন মণিপুর[৩] যান, আর সেখানকার রাজার কন্যা চিত্রাঙ্গদার সহিত তাহার বিবাহ হয়৷

 ইহার পরে অর্জুন গঙ্গার ধারে আসিয়া পাঁচটি তীর্থ দেখিতে পাইলেন। তীর্থগুলি খুব সুন্দর, অথচ তাহাতে লোকজন নাই। ইহাতে তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ইহার কারণ কি?’ তাহা শুনিয়া কয়েকজন মুনি বলিলেন, ‘এই পাঁচ তীর্থে পাঁচটা কুমির আছে, কেহ জলে নামিলেই তাহারা তাহাকে ধরিয়া খায়। তাই এখানে কেহ স্নান করিতে আসে না৷’

 এ কথা শুনিয়া অর্জুন কুমির দেখিতে চলিলেন। মুনিরা অনেক নিষেধ করিলেও শুনিলেন না৷

 এই পাঁচ তীর্থের একটাতে গিয়া অর্জুন স্নান করিবার জন্য যেই জলে নামিয়াছেন, অমনি এক প্রকাণ্ড কুমির আসিয়া তাঁহার পা কামড়াইয়া ধরিয়াছে। আর অর্জুনও সেই মুহূর্তেই কুমিরকে ধরিয়া টানিতে টানিতে একেবারে ডাঙ্গায় আনিয়া তুলিয়াছেন৷

 কিন্তু একি আশ্চর্য! ডাঙ্গায় আসিয়াই কুমির আর কুমির নাই, সে পরমসুন্দরী একটি কন্যা হইয়া গিয়াছে। অর্জুন তো দেখিয়া অবাক। তিনি কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ইহার অর্থ কি? তুমি কে?’

 কন্যা বলিল, ‘মহাশয়, আমি অপ্সরা। আমার নাম বর্গা। আমরা চারিটি সখী আছে, তাহাদের নাম—সৌরভেয়ী, সমীচি, বুদ্বুদা আর লতা। আমরা এক তপস্বীকে অমান্য করিয়াছিলাম, তাহাতে তিনি রাগিয়া আমাদিগকে কুমির করিয়া দেন। তপস্বী বলিয়াছিলেন যে, কোনো মানুষ আমাদিগকে জল হইতে টানিয়া তুলিতে পারিলেই আমাদের শাপ দূর হইবে। তাই আমরা পাঁচজন এই পাঁচ তীর্থে বাস করি, আর মানুষ জলে নামিলেই তাহাকে ধরিয়া লইয়া যাই। কিন্তু এ পর্যন্ত আর কেহ আমাদিগকে টানিয়া ডাঙ্গায় তুলিতে পারে নাই, কাজেই আমরাও এতদিন কুমির থাকিয়া গিয়াছি। আজ আপনি আমাকে রক্ষা করিলেন। এখন আমার সখী চারিটিকে দয়া করিয়া উদ্ধার করুন৷’

 অর্জুন তখনই আর চারি তীর্থে গিয়া সেখানকার চারিটি কুমিরকে টানিয়া তুলিলেন। পাঁচটি অলরা পাপের দায় হইতে রক্ষা পাইয়া স্বর্গে চলিয়া গেল৷

 ইহার পর নানা প্রকার তীর্থ দেখিতে দেখিতে অর্জুন ক্রমে প্রভাসতীর্থে উপস্থিত হইলেন। এই তীর্থ কৃষ্ণের রাজ্যের মধ্যে। কৃষ্ণ অর্জুনের সংবাদ পাইয়া সেখানে আসিয়া তাঁহাকে দ্বারকায় লইয়া গেলেন৷

 বলরাম এবং কৃষ্ণের একটি ভগিনী ছিলেন, তাঁহার নাম সুভদ্রা। সুভদ্রার সহিত যেমন করিয়া অর্জুনের বিবাহ হইয়াছিল, সে এক আশ্চর্য কথা। রূপেগুণে সুভদ্রার মতো মেয়ে অতি কমই দেখা যায়। তাঁহাকে দেখিয়া অর্জুনের বড়ই ভালো লাগিল৷

 কৃষ্ণ অসাধারণ বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, তিনি সহজেই বুঝিতে পারিলেন যে, অর্জুন সুভদ্রাকে বিবাহ করিতে চাচ্ছেন। ইহাতে তাঁর মনে অতিশয় আনন্দ হইল, কারণ, অর্জুনকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, আর জানিতেন যে, সুভদ্রার সহিত বিবাহ দিবার জন্য এমন গুণবান লোক আর পাওয়া যাইবে না৷

 এখন এ বিবাহ কিরূপে হইতে পারে, কৃষ্ণ তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ক্ষত্রিয়দের বিবাহের নানারূপ নিয়ম আছে, কন্যাকে বলপূর্বক লইয়া গিয়া বিবাহ করা তাহার মধ্যে একটি। কৃষ্ণ বলিলেন, ‘এ নিয়মটি আমার বেশ লাগে। কেন, ইহাতে বুঝা যায় যে বর খুব বীরপুরুষ আর কন্যার জন্য সে অনেক বিপদ আর পরিশ্রম সহ্য করিতে প্রস্তুত৷’

 সুতরাং স্থির হইল যে, যুধিষ্ঠিরের অনুমতি পাইলে অর্জুন সুভদ্রাকে জোর করিয়া বিবাহ করিবেন৷

 যুধিষ্ঠিরের অনুমতি সহজেই পাওয়া গেল, এখন বিবাহ হইলেই হয়। এ বিষয়ের সকল কথা কৃষ্ণ আর অর্জুন দুজনে ঠিক করিলেন, দ্বারকার আর কেহ জানিতে পারিল না৷

 ইহার মধ্যে একদিন সুভদ্রা রৈবতক পর্বতে দেবতার পূজা করিতে গিয়াছে। অর্জুন দেখিলেন এই তাঁহার সুযোগ। তিনি তাড়াতাড়ি যুদ্ধের বেশে অস্ত্র-শস্ত্র হাতে সুন্দর রথে চড়িয়া সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন৷

 সুভদ্রার পূজা-অর্চনা শেষ হইয়াছে, এখন দ্বারকায় ফিরিতে হইবে, এমন সময় অর্জুন আসিয়া তাঁহাকে রথে তুলিয়া দে ছুট। সঙ্গের লোকেরা তখন মহাকোলাহল আরম্ভ করিয়া দিল। কেহ দ্বারকায় সংবাদ দিতে যায়, কেহ প্রহরীদিগকে ডাকে, আর সকলে খালি হাউ-মাউ আর ছুটাছুটি করে!

 এদিকে দ্বারকার বড়বড় বীরেরা রাগে অস্থির। ‘এত বড় আস্পর্ধা! আমাদিগের এমন অপমান?’ এই বলিয়া তাঁহারা সকলে বর্ম-চর্ম লইয়া রথ সাজাইয়া প্রস্তুত! বলরাম তো এতই রাগিয়াছে যে, সেইদিনেই-বা সকল কৌরব মারিয়া শেষ করেন৷

 এমন সময় কৃষ্ণ বলিলেন, ‘তোমরা যে চটিয়াছ, বল দেখি অর্জুনের কি দোষ? ক্ষত্রিয়েরা তো এইরূপ বিবাহকেই খুব ভালো বিবাহ মনে করে, অর্জুন তাহাই করিয়াছেন। অর্জুন সুভদ্রাকে বিবাহ করিবেন ইহা আমাদের পক্ষে নিতান্ত সুখেরই কথা। আর তিনি বীরপুরুষ, সুতরাং জোর দেখানো তাঁহার মতো লোকের উপযুক্ত কাজই হইয়াছে। তোমরা যে ইহাতে অপমান মনে করিতেছ অপমান কিসে হইবে, জান? যদি অর্জুন সুভদ্রাকে লইয়া দেশে চলিয়া যায়, তবেই অপমান। আর সে কেমন বীর, তাহাও তো জান। জোর করিয়া তাহাকে কিছুতেই আটকাইতে পারিবে না। আমার কথা যদি শুন, তবে এই বেলা তাঁহাকে মিষ্ট কথায় খুশি করিয়া ফিরাও। তাহাকে ঘরে আনিয়া আদর করিয়া বিবাহ দাও। তাহা হইলে আর অপমানের কথা থাকিবে না, আনন্দের কথা হইবে৷

 কৃষ্ণের কথায় যাদবেরা[৪] তাড়াতাড়ি অর্জুনকে মিষ্ট কথায় ডাকিয়া ফিরাইলেন। তারপর ধুমধামের সহিত তাঁহার আর সুভদ্রার বিবাহ হইল৷

 বিবাহের পর অর্জুন দ্বারকা হইতে পুরুষতীর্থে যান। এইরূপে ক্রমে তাঁহার বারো বৎসর বনবাস শেষ হওয়াতে তিনি সুভদ্রা এবং কৃষ্ণ, বলরাম প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া খাণ্ডবপ্রন্থে চলিয়া আসিলেন। সেখানে কয়েকদিন খুব আনন্দেই কাটিল। তারপর কৃষ্ণ ছাড়া যাদবদিগের আর সকলে চলিয়া গেলেন৷

 ইহার পর একদিন কৃষ্ণ আর অর্জুন, দ্রৌপদী, সুভদ্রা প্রভৃতিকে লইয়া যমুনার ধারে বেড়াইতে যান। সেখানে সকলেই আমোদ-প্রমোদ করিতেছে দেখিয়া কৃষ্ণ আর অর্জুন খানিক দূরে একটি নির্জন স্থানে বসিয়া কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন৷

 এমন সময় জটাধারী (অর্থাৎ মাথায় জটা আর গাছের ছাল পরা) আর পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি-গোঁফওয়ালা এই লম্বা এক ব্রাহ্মণ তাঁহাদের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার রঙ কাঁচা সোনার মতো, আর তেজ প্রভাতের সূর্যের মতো৷

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, আমি ব্রাহ্মণ, আমার একটু বেশি করিয়া খাওয়া অভ্যাস। আপনাদের নিকট আমি কিছু জলযোগের প্রার্থনা করি৷

 কৃষ্ণ আর অর্জুন বলিলেন, আপনি কি খাইতে চাহেন বলুন, আমরা আনিয়া দিতেছি। ব্রাহ্ম বলিলেন, “মিঠাই মণ্ডা, ভাত ব্যঞ্জন আমি কিছুই খাই না! আমি খাণ্ডব নামক বনটিকে খাইব, আপনারা তাহারই উপায় করিয়া দিন৷”

 কি অদ্ভুত জলযোগ! আর ব্রাহ্মণটিও যে কম অদ্ভুত নহে, তাহা তাঁহার পরিচয় শুনিলেই বুঝিতে পারিবে। ব্রাহ্মণ বলিলেন, “আমি অগ্নি। আমার নিতান্ত ইচ্ছা, খাণ্ডব বনটাকে খাই! কিন্তু সেই বনে ইন্দ্রের বন্ধু তক্ষক নাগ আর তাহার পরিবার থাকাতে, আমি সেখানে গেলেই ইন্দ্র বৃষ্টি ফেলিয়া আমাকে নিবাইয়া দেন। তাই আমি আপনাদের নিকট আসিয়াছি। আপনারা যদি বৃষ্টি থামাইয়া আর বনের জন্তুগুলিকে আটকাইয়া রাখিতে পারেন, তবে আমার কিঞ্চিৎ ভোজন হয়৷”

 ব্যাপারখানা কি জান? শ্বেতকী বলিয়া এক রাজা ছিলেন, তাঁহার প্রধান কাজ ছিল কেবল যজ্ঞ করা। সে কি যেমন-তেমন যজ্ঞ? তাঁহার যজ্ঞে খাটিয়া খাটিয়া মুনিরা রোগা হইয়া গেলেন, ধোঁয়ায় তাঁহাদের চোখে ছানি পড়িল, শেষে আর না পারিয়া তাঁহারা রাজার কাজই ছাড়িয়া দিলেন৷

 ইহাতে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া শ্বেতকী শিবের তপস্যা আরম্ভ করাতে, শিব বলিলেন, “তুমি বারো বৎসর ক্রমাগত অগ্নিকে ঘি খাওয়াইয়া খুশি কর, তারপর দেখা যাইবে৷”

 রাজা ক্রমাগত বারো বৎসর অগ্নিকে ঘি খাওয়াইলেন। তাহাতে শিব সন্তুষ্ট হইয়া দুর্বাশা মুনিকে দিয়া তাঁহার যজ্ঞ করাইয়া দিলেন৷

 রাজার যজ্ঞ হইল বটে, কিন্তু এত ঘি অগ্নির সহ্য হইল না। তাঁহার পেট ভার হইল, ক্ষুধা মরিয়া গেল, কাজেই তখন বেচারা ব্যস্তভাবে ব্রহ্মার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্রহ্ম তাঁহার কথা শুনিয়া বলিলেন, “এত ঘি খাইয়াছ, তাই তোমার মন্দাগ্নি হইয়াছে (অর্থাৎ ক্ষুধা চলিয়া গিয়াছে)। এখন খুব খানিকটা মাংস খাও গিয়া, তবেই সারিয়া যাইবে। খাণ্ডব বনে অনেক জন্তু থাকে, সেটাকে পোড়াইতে পার তো তোমার কাজ হয়!”

 অগ্নি তখনই খাণ্ডব বনে চলিয়া আসিলেন। সেখানে আসিয়া তাঁহার কিরূপ দশা হইয়াছিল, তাহা শুনিয়াছ। তিনি কেবল ইন্দ্রের কথাই বলিয়াছেন, কিন্তু সেই বনের জন্তুরাও তাঁহাকে কম নাকাল করে নাই। সেখানকার হাতি-গুলি শুঁড়ে করিয়া জল ঢালিয়া তাঁহাকে নিবাইয়া দিল। অন্য জন্তুরাও তাঁহার কতই দুর্গতি করিল। সাতবার সেই বন পোড়াইতে গিয়া,সাতবারই তিনি এইরূপে জব্দ হইয়া ফিরিয়া আসিলেন৷

 শেষে ব্রহ্মা তাঁহাকে বলিলেন, “তুমি কৃষ্ণ আর অর্জুনের কাছে যাও, তাঁহারা চেষ্টা করিলে ইন্দ্রকেও আটকাইতে পারেন, জন্তুদিগকেও থামাইয়া রাখিতে পারেন৷” তারপর কি হইয়াছে তোমরা জান৷

 অগ্নির কথা শুনিয়া অর্জুন বলিলেন, “আমার তেমন ভালো ধনুক বা রথ নাই, আর কৃষ্ণের হাতেও অস্ত্র নাই। আমাদিগকে এ-সকল জিনিস আনিয়া দিলে আমরা আপনার কাজ করিতে প্রস্তুত আছি৷”

 এ কথায় অগ্নি বরুণের নিকট হইতে গাণ্ডীব নামক ধনুক, অক্ষয় তূণ ও কপিধ্বজ নামক রথ আনিয়া অর্জুনকে দিলেন। সেই রথের উপরে এক ভয়ংকর বানরের মূর্তি থাকাতে উহার ‘কপিধ্বজ’ নাম হয়। অতি আশ্চর্য রথ, বিশ্বকর্মার তৈরি, ঘোড়াগুলি গন্ধর্বের দেশের? আর ধনুকের কথা কি বলিব? নিজে ব্রহ্মা উহা প্রস্তুত করেন। অর্জুন সে ধনুকের গুণ চড়াইবার সময় তাহার ভীষণ শব্দে ত্রিভুবন কাঁপিয়া উঠিল৷

 অগ্নি অর্জুনকে এই সকল জিনিস আর কৃষ্ণকে সুদর্শন নামক একখানি চক্র (অর্থাৎ চাকার ন্যায় অস্ত্র) আর কৌমদকী নামক একটি গদা দিলেন। সে চক্রকে কিছুই আটকাইতে পারে না। যাহাকে মারিবে, তাহার আর রক্ষা নাই। চক্র তাহাকে বধ করিয়া আবার হাতে ফিরিয়া আসিবেই আসিবে। অস্ত্র পাইয়া কৃষ্ণ আর অর্জুন অগ্নিকে বলিলেন, “আচ্ছা, তবে এখন আপনি গিয়া বন পোড়াইতে থাকুন। আমরা আপনার সাহায্য করিতেছি৷”

 অমনি খাণ্ডব বনের চারিদিকে ভয়ানক আগুন জ্বলিয়া উঠিল। খাণ্ডব দহনেব (অর্থাৎ খাণ্ডব পোড়ানোর) ন্যায় ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড খুব কমই হইয়াছে। আগুনের শিখা হড়্-হড়্ ঘড়্-ঘড়্ গর্জনে আকাশ ছইয়া ফেলিল, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে পর্বতাকার কালো ধোঁয়া উঠিয়া দিনকে অমাবস্যার রাত্রির মতো করিয়া দিল। জীব-জন্তু সকলে চিৎকার করিতে করিতে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াও কৃষ্ণ আর অর্জুনের ভয়ে পলাইতে পারিল না। কৃষ্ণের চক্র এমনি যে, কোনো জন্তু বাহিরে দেখা দিতে না দিষ্ট্রে সে তাহাকে কাটিয়া দুইখান করে। অর্জুনের তীর এমনি যে, ফড়িংটিকে পর্যন্ত উড়িয়া পলাইতে দেয় না। তাঁহার রথ সে সমযে এমনি বেগে সেই বনের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল যে, উহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া দেখিতেই পাওয়া যায় না। কত জন্তু, কত পাখি যে পুড়িয়া মরিল, তাহা ভাবিয়াও শেষ করা যায় না! খাল-বিলের জল টগবগ করিয়া ফুটিতে লাগিল, মাছ, কচ্ছপ, কুমির সকলই সিদ্ধ হইয়া গেল। আগুনের শব্দ আর জন্তুদিগের চিৎকার মিলিয়া ঝড় বজ্রপাত আর সমুদ্রের গর্জনকেও হারাইয়া দিল৷

 আগুনের তেজে দেবতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে ইন্দ্রের নিকট গিয়া বলিলেন, “হে ইন্দ্র! আজ অগ্নি কিজন্য পৃথিবীকে ভস্ম করিতে গিয়াছেন? আজ কি সৃষ্টির শেষ দিন উপস্থিত?”

 তাঁহাদের কথায় ইন্দ্র অমনি উনপঞ্চাশ পবন আর ঘোরতর কালো মেঘ সকলকে লইযা আগুন নিবাইতে চলিলেন। কিন্তু সে আগুনের তেজে তাঁহার মেঘ-বৃষ্টি আকাশেই শুষিয়া গেল। মেঘ হরিলে ইন্দ্র মহামেঘদিগকে ডাকিলেন—যাহারা মনে করিলে ব্রহ্মাণ্ড তল করিয়া দিতে পারে। কিন্তু সেই সাংঘাতিক মেঘও অর্জুনের বাণে উড়িয়া গেল৷

 সেই বনে ইন্দ্রের বন্ধু তক্ষক সাপের বাড়ি। তক্ষক তখন বাড়ি ছিলেন না, কিন্তু তাহার স্ত্রী-পুত্র ছিলেন। তক্ষকের পুত্র অশ্বসেনের মা তো পুড়িয়া মারাই গেলেন। ইহর মধ্যে ইন্দ্র একবার ফাঁকি দিয়া অর্জুনকে অজ্ঞান করিতে পারিয়াছিলেন, তাই রক্ষা নহিলে অশ্বসেনকেও তাঁহার মায়ের সঙ্গেই যাইতে হইত৷

 বৃষ্টি করিয়া, বাজ ফেলিয়া, পর্বত ছুঁড়িয়া কিছুতেই ইন্দ্র কৃষ্ণ আর অর্জুনকে জব্দ করিতে পারিলেন না। ইন্দ্রের পর্বত অর্জুনের বাণে ফাটিয়া খণ্ড খণ্ড হইল, তখন বোধ হইল, যেন আকাশের গ্রহগুলি ছুটিয়া পড়িতেছে!

 দেবতাদের বড় খোলা মন। তাই ইন্দ্র যখন দেখিলেন যে তিনি কিছুতেই কৃষ্ণ আর অর্জুনকে আঁটিতে পারিতেছেন না, তখন তিনি যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে প্রশংসা করিতে করিতে চলিয়া গেলেন৷

 তখন খাণ্ডব বন পোড়াইতে কোনো বাধাই রহিল না। সেই ভয়ানক আগুনের হাত হইতে কেবল ছয়টি প্রাণী রক্ষা পাইয়াছিল৷

 এই ছয়টির একটি অবশ্য অশ্বসেন, আর-একটি ময় নামক দানব। এই ব্যক্তি হাত জোড় করিয়া অর্জুনকে এমনি মিনতি করিতে লাগিল যে, অর্জুন দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন৷

 আর চারিটি প্রাণী চারিটি বকের ছানা। ইহাদিগকে অগ্নি দয়া করিয়া পোড়ান নাই৷

 খাণ্ডব বন খাইয়া অগ্নির অসুখ ছাড়িয়াছিল কি না, তাহা মহাভারতে লেখা নাই। সে যাহা হউক, তিনি ভোজন শেষ করিয়া বড়ই আনন্দিত হইলেন। ইন্দ্র যে কৃষ্ণ আর অর্জুনের উপর খুব খুশি হইয়াছিলেন, এ কথা তো আগেই বলিয়াছি। তিনি বলিলেন, “তোমরা যাহা করিলে দেবতারাও তাহা করিতে পারেন না। এক্ষণে তোমরা কি বর চাও?”

 তাহাতে অর্জুন বলিলেন, “আমাকে সকলরকম অস্ত্র দিন, এই আমার প্রার্থনা৷”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তুমি তপস্যা করিয়া শিবকে তুষ্ট কর। তাহা হইলেই আমি অস্ত্র দিব৷”

 কৃষ্ণ বলিলেন, “অর্জুনের সহিত আমার বন্ধুতা যেন চিরদিন থাকে৷”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তথাস্তু৷” (অর্থাৎ “তাহাই হউক”)৷

 তারপর অগ্নি, কৃষ্ণ আর অর্জুনের অনেক প্রশংসা করিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, আর কৃষ্ণ, অর্জুন এবং ময়দানব যমুনার ধারে বসিয়া কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন৷

  1. পাণ্ডবদিগের কিনা তপস্বীর বেশ ছিল, তাই ব্রাহ্মণ ইহাদিগকে ব্রাহ্মণ মনে করিয়াছিলেন। আসলে ইহরা যে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ নহেন, তাহা তো জানই৷
  2. দ্রুপদের আসল নাম যজ্ঞসেন।
  3. এই মণিপুর উড়িষ্যার কাছে ছিল৷
  4. অর্থাৎ কৃষ্ণ যে বংশে জন্মিয়াছেন সেই বংশের লোকেরা; ইহাদের পূর্বপুরুষের নাম ছিল যদু। তাই ইহারা সকলে যাদব৷