উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/বিরাটপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

বিরাট পর্ব

জ্ঞাতবাসেব সময় উপস্থিত৷ এই একটি বৎসর বড়ই বিপদের সময৷ কোন দেশে কি ভাবে থাকিলে এ বিপদে রক্ষা পাওয়া যায়?

 পাঞ্চাল, চেদী, মৎস্য, সুরাষ্ট্র অবস্তী প্রভৃতি অনেক ভালো ভালো দেশ আছে৷ ইহাদের মধ্যে মৎস্য দেশের রাজা বিরাট অতি ধামিক লোক৷ ধামিকেরা ধামিকের আশ্রয় ছাড়িয়া আর কোথায় থাকিবে? সুতরাং পান্ডবেরা বিরাটের নিকটেই কোনোরূপ কাজ লইয়া থাকা স্থির করিলেন৷

 যুধিষ্ঠির সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কে কি কাজ করিতে পারিবে বল তো?” এ কথার উত্তরে অর্জুন বলিলেন, “আপনি কি কাজ করিবেন?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমি ব্রাহ্মণ সাজিয়া বিরাটের সভাসদ (অর্থাৎ সভার লোক) হইব। বলিব, আমার নাম কঙ্ক, খুব পাশা খেলিতে পারি। আরো জিজ্ঞাসা করিলে বলিব, আমি যুধিষ্ঠিরের বন্ধু ছিলাম। এখন ভীম বল তো, তুমি কি বলিবে?’ ভীম বলিলেন, ‘আমি রাঁধুনি ব্রাহ্মণ সাজিয়া যাইব। পরিচয় চাহিলে বলিব, আমার নাম বল্লভ, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পাচক ছিলাম, একটু-আধটু পালোয়ানীও জানি। সে দেশের রাঁধুনিদের চেয়ে ঢের ভালো ব্যঞ্জন রাঁধিয়া, আর এই বড় কাঠের বোঝা বহিয়া আনিয়া, হুকুম পাইলে দু-একটা পালোয়ান বা খ্যাপা হাতিকেও ঠ্যাঙ্গাইয়া আমি রাজাকে খুশি রাখিব৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আচ্ছা অর্জুন কি করিবে?” অর্জুন বলিলেন “আমি রাজবাড়ির মেয়েদের সঙ্গীতের শিক্ষক হইয়া থাকিব। এ-সব লোকে স্ত্রীলোকের পোশাক পরে, আমিও তাহাই পরিব। ধনুকের গুণের ঘষায় হাতে যে দাগ হইয়াছে, বালা পরিয়া তাহা ঢাকিব। স্ত্রীলোকের মতন কাপড় পরিব মাথায় বেণী রাখিব, কানে কুণ্ডল দুলাইব, কথাবার্তাও স্ত্রীলোকের মতন করিয়া কহিব। তাহা হইলেই আর কেহ আমাকে চিনিতে পারিবে না। পরিচয় চাহিলে বলিব, আমার নাম বৃহন্নলা, আমি দ্রৌপদীর নিকট ছিলাম৷

 তারপর যুধিষ্ঠির নকুলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, নকুল! তুমি কি করিবে?

 নকুল বলিলেন, ‘আমি বলিব, আমার নাম গ্রন্থিক, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের ঘোড়াশালের কর্তা ছিলাম। ঘোড়ার কথা আমার মতন কেহই জানে না৷’

 তারপর যুধিষ্ঠির সহদেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সহদেব কি করিবে?’

 সহদেব বলিলেন, আমি গোরু দেখা-শোনার কাজ লইব। বলিব আমাৰ নাম তন্ত্রিপাল। আমি গোরু সম্বন্ধে সকলরকম কাজ বিশেষরূপে জানি৷

 সকলের শেষে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করিলেন, দ্রৌপদী তো কখনো কোনো ক্লেশের কাজ করেন নাই, তিনি এই এক বৎসর কি করিয়া কাটাইবেন?

 দ্রৌপদী বলিলেন, “আমি বিরাট রাজার রানী সুদেষ্ণার নিকট কাজ লইব। জিজ্ঞাসা করিলে বলিব, আমি সৈরিন্ধী (অর্থাৎ যে চুল বাঁধা, মালা গাঁথা ইত্যাদি কাজ কবে,) মহারাজ যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে দ্রৌপদীর নিকট ছিলাম৷”

 এইরূপে সকল পরামর্শ স্থির করিয়া পাণ্ডবেরা সঙ্গের লোকদিগকে বিদায় দিলেন। চাকদিগকে বলিলেন, ‘তোমরা দ্বারকায় চলিয়া যাও৷’ ধৌম্যকে বলিলেন, সারথী, পাচকগণ, আর দ্রৌপদীর দাসীকে লইয়া আপনি রাজা দ্রুপদের বাড়িতে গিযা থাকুন৷

 তারপর তাঁহারা উপস্থিত ব্রাহ্মণ ও মুনিদিগের আশীর্বাদ লইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। কোথায় গেলেন, তাহা কেহই জানিতে পারিল না৷

 অবশ্য আমরা জানি, তাঁহারা মৎস্যদেশে গিয়াছিলেন। সঙ্গে তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র ও বর্ম ছিল৷

 পাহাড়ের আড়াল দিয়া, বনের ভিতর দিয়া, বহু কষ্টে, অতি সাবধানে পথ চলিয়া পাণ্ডবেরা ক্রমে দশার্ণ, পাঞ্চাল, শূরসেন প্রভৃতি দেশ অতিক্রম পূর্বক শেষে বিরাট নগরের কাজে উপস্থিত হইলেন। তখন তাদের মনে এই চিন্তা হইল যে, এইসকল অস্ত্র লইয়া নগরের ভিতরে গেলে, লোকে আমাদিগকে চিনিয়া ফেলিবে। সুতরাং এইগুলিকে একটা ভালো জায়গায় লুকাইয়া রাখা আবশ্যক৷

 সেইখানে একটা শ্মশানের পাশে পাহাড়ে উপরে প্রকাণ্ড শমী গাছ ছিল। অৰ্জুন বললেন, ‘এই গাছে অস্ত্র-শস্ত্র রাখিলে কেহই জানিতে পারিবে না৷’

 সেই শমী গাছে উঠিয়া, নকুল তাঁহাদের সকলের ধনুক, তৃণ, শঙ্খ, বর্ম, খড়গ প্রভৃতি বেশ করিয়া বাধিয়া রাখিলেন। তারপর শ্মশান হইতে একটা মড়া আনিয়া তাহাও ঐ গাছে বধিলেন। মড়া বাঁধিবার কারণ এই যে, তাহা হইলে গন্ধে, আর ভূতের ভয়ে, কেহ আর সে গাছের নিকটে আসিবে না৷

 তারপর তাঁহারা তাঁহাদের প্রত্যেকের আর-একটি করিয়া নাম রাখিলেন। যুধিষ্ঠির ‘জয়’, ভীম ‘জয়ন্ত’, অৰ্জুন ‘বিজয়’, নকুল ‘জয়ৎসেন’, সহদেব ‘জয়দ্বল’ এগুলি হইল তাঁহাদের গোপনীয় নাম, অর্থাৎ এ-সকল নামের কথা আর কেহ জানিতে পারিল না। কাজেই ইহার কোনো-একটা নাম লইলে কেহ বুঝিয়া ফেলিবারও ভয় রহিল না৷

 মহারাজ বিরাট পাত্রমিত্র সমেত সভায় বসিয়া আছেন, এমন সময় যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণের বেশে, পাশা হাতে ধীরে ধীরে তথায় উপস্থিত হইলেন। দূর হইতে তাঁহাকে দেখিয়া, বিরাট সভার লোকদিগকে বলিলেন, ‘উনি কে আসিতেছেন? গরিবের মতো পোশাক বটে, কিন্তু চেহারা দেখিলে মনে হয় যেন কোনো রাজা হইবেন৷’

 যুধিষ্ঠির আস্তে আস্তে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, ‘মহারাজের জয় হউক। দুঃখে পড়িয়া আপনার কাছে আসিয়াছি। দয়া করিয়া আশ্রয় দিলে বড় উপকার হয়।’

 বিরাট বলিলেন, তুমি কে বাপুঃ কোথা হইতে আসিতেছ? কি কাজ করিতে পার? যুধিষ্ঠির বলিলেন, মহারাজ, আমি ব্রাহ্মণ, আমার নাম কঙ্ক। রাজা যুধিষ্ঠিরের বন্ধু ছিলাম। আমি পাশা খেলায় বিশেষ দক্ষ৷”

 বিরাট যুধিষ্ঠিরকে দেখিয়াই ভালবাসিয়াছিলেন, তাহাতে আবার তাঁহার নিজের পাশা খেলার খুব সখ। কাজেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে আদর করিয়া কাছে রাখলেন। সকলকে বলিয়া দিলেন ‘ইনি আমার বন্ধু, তোমরা আমাকে যেমন মান্য কর, ইহাকে তেমনি মান্য করবে৷’

 তারপর রসুয়ে বামুনের সাজে ভীম আসিয়া উপস্থিত, হাতা-বেড়ি হাতে, সিংহের মতন চেহারা। দূর হইতে তাঁহাকে দেখিয়াই বিরাট ভারি আশ্চর্য হইয়া গেলেন। রাজার হুকুমে কয়েকজন লোক ছুটিয়া ভীমের পরিচয় লইতে গেল। ভীম তাহাদিগকে গ্রাহ্য না করিয়া, একেবারে রাজ্যের সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, আমার নাম বল্লভ, আমি পাচক, অতি উত্তম ব্যঞ্জন রাঁধতে পারি, আমাকে রাখিতে আজ্ঞা হউক।’

 বিরাট কহিলেন, ‘তোমার চেহারা দেখিয়া তো তোমাকে রাধুনি বলিয়া মনে হয় না!’

 ভীম বলিলেন, মহারাজ! আমি রাঁধুনিই বটে, আপনার চাকর। পূর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রধান পাচক ছিলাম। অল্প-অল্প পালোয়ানীও জানি। মহারাজ আমার কাজ দেখিলে সন্তুষ্ট হইবেন৷

 এইরূপে ভীম বিরাট রাজ্যের রসুই মহলের কর্তা হইয়া, পরম সুখে সেখানে বাস করিতে লাগিলেন৷

 এদিকে দ্রৌপদী একখানি ময়লা কাপড় পরিয়া সৈরিন্ধীর বেশে রাজপথ দিয়া চলিয়াছেন৷ পথের লোক এমন সুন্দর মানুষ আর কখনো দেখে নাই। তাহারা আশ্চর্য হইয়া তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে, তিনি বলেন, ‘আমি সৈরিন্ধ্রী, কাজ খুঁজিতেছি৷’ কিন্তু তাঁহার এ কথা কেহ বিশ্বাস করে না৷

 রানী সুদেষ্ণাও ছাদ হইতে দ্রৌপদীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি তাহাকে ডাকাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন৷

 দ্রৌপদী বলিলেন, আমার স্বামী পাঁচজন গন্ধর্ব। কোনো কারণে তাঁহারা এখন বড়ই দুঃখে পড়িয়াছে, আর আমি সৈরিন্ধ্রীর কাজ করিয়া দিন কাটাইতেছি। আগে আমি সত্যভামা আর দ্রৌপদীর নিকট কাজ করিয়াছিলাম। এখন আপনার নিকট আসিয়াছি, দয়া করিয়া আশ্রয় দিলে এখানে থাকিব৷

 সুদেষ্ণা আহ্লাদের সহিত দ্রৌপদীকে সৈরিন্ধ্রীর কাজে নিযুক্ত করিলেন। দ্রৌপদী বলিলেন, মা, আমি কখনো উচ্ছিষ্ট ছুঁই না, বা কোনো নীচ কাজ করি না। আমার গন্ধর্ব স্বামীরা যদিও দুঃখে পড়িয়াছে, তবুও তাঁহারা আমাকে সর্বদা রক্ষা করেন। কেহ আমার অপমান করিলে, তাঁহারা তাহাকে মারিয়া ফেলেন৷

 এইরূপে ক্রমে অর্জুন, সহদেব আর নকুল এক-একজন করিয়া বিরাট রাজার নিকট কাজ লইলেন। অর্জুন হইলেন রাজকুমারী উত্তরার গানের শিক্ষক। সহদেব আর নকুল হইলেন গোশাল আর ঘোড়াশালের কর্তা। অর্জুন এখন স্ত্রীলোকের মতন পোশাক পরেন, আর বাড়ির ভিতরেই থাকেন। ভীমও তাঁহার কাজ সাবিয়া রান্নার মহলের বাহিরে আসিবার অবসর পান না। কাজেই তাঁহাদের কথা কেহ জানিতেও পারিল না৷

 এইরূপে দিন যায়। পাণ্ডবদের কাজ দেখিয়া বিরাট তাঁহাদের সকলের উপরেই বিশেষ সন্তুষ্ট। ভীম ইহার মধ্যেই জীমূত নামক একটা পালোয়ানকে হারাইয়া রাজার নিকট অনেক পুরস্কার পাইয়াছে। সুতরাং মোটের উপরে তাহাবা সুখেই আছে বলিতে হইবে৷

 কিন্তু হায়! দ্রৌপদীর সময় নিতান্তই কষ্টে কাটিতে লাগিল। সুদেষ্ণা তাঁহাকে খুবই স্নেহ করিতেন, কিন্তু সুদেষ্ণার ভাই কীচক তাঁহাকে দেখিতে পাইলেই অপমান করিত। দ্রৌপদী তাহা সহিতে না পারিয়া তাহাকে কত গালি দিতেন, কত মিনতি করিতেন, কত ভয় দেখাইতেন। দুরাত্মা তথাপি আরো বেশি করিয়া তাঁহাকে অপমান করিত৷

 একদিন সুদেষ্ণা কিছু খাবার আনিবার জন্য দ্রৌপদীকে কীচকের বাড়িতে পাঠান। সেদিন তাঁহার প্রতি সে এত অভদ্রতা করে যে, তিনি রাগ থামাইতে না পারিয়া তাহাকে ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দেন। তারপর ভয়ে তিনি ছুটিয়া একেবারে রাজসভায় গিয়া উপস্থিত হন৷

 পাপিষ্ঠ সেইখানে তাঁহার পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া, তাঁহার চুলের মুঠি ধরিয়া তাঁহাকে মাটিতে ফেলিয়া, তাঁহার গায়ে লাথি মারিল। সেখানে যুধিষ্ঠির আর ভীম উপস্থিত ছিলেন, তাহাদের মনে ইহাতে কি ভয়ানক ক্লেশ হইল বুঝিতে পার। ভীম রাগে কাঁপতে কাঁপতে ক্রমাগত একটা গাছের দিকে তাকাইতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠির দেখিলেন সর্বনাশ উপস্থিত। ভীম হয়তো তখন ঐ গাছ লইয়া সভার সকলকে গুঁড়া করিবেন। তাই তিনি ভীমকে শান্ত হইতে ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, “কি পাচক ঠাকুর, কাঠের জন্য গাছের দিকে তাকাইতেছ? কাঠের গাছ বাহিরে গিয়া খোঁজ৷”

 সভার লোকেরা কীচকের অনেক নিন্দা কবিতে লাগিল, কিন্তু রাজা তাহাকে কিছু বলিলেন না৷ কীচককে তিনি বড়ই ভয় করিতেন৷ সে ৩াঁহার সেনাপতি ছিল, তার জোরেই তিনি রাজা করিতেন৷ বাস্তবিক বিরাট কেবল নামেই সে দেশের রাজা ছিলেন, দেশ শাসন করিত কীচক৷

 দ্রৌপদীর কষ্ট দেখিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! ঘরে যাও তোমার গন্ধৰ্ব স্বামীরা সময় বুঝিয়া হয়তো ইহার বিচার করিবেন৷”

 এ কথায় দ্রৌপদী চোখের জল মুছিয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেলেন৷ সেখানে সুদেষ্ণা তাঁহার নিকট সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “তুমি যদি বল তবে দুষ্টকে এখনই কাটিয়া ফেলি৷”

 দ্রৌপদী বলিলেন, “আমার যাঁহারা আছেন, তাঁহারাই তাহাকে বধ করিবেন৷”

 রাত্রিতে দ্রৌপদী চুপিচুপি ভীমের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন৷ ভীম আগে হইতেই প্রস্তুত হইয়া আছো! এতক্ষণ যে কীচককে মারেন নাই, সে কেবল লোকে জানিতে পারার ভযে৷ নির্জন স্থানে তাহাকে পাইলে আর তিনি এক মুহুৰ্তও দেরি করিতেন না৷

 রাজবাড়িব মেয়েদেব সঙ্গীতের ঘরটি ঠিক এইরূপ নিরিবিলি স্থান ছিল৷ সে স্থানে দিনের বেলায মোগে,ব’ নাচ-গান করিত, রাত্রিতে কেহ সেখানে থাকিত না৷ কোনো কারণে সেদিন ভোব রাত্রে কীচকেব একেলা সেই খবে যাওয়ার দরকাব ছিল৷ ভীম তাহা জানিতে পারিয়া তাহার আগেই চুপিচুপি সেখানে গিয়া, চাদর মুড়ি দিযা শুইয়া রহিলেন৷

 অনেক বাত্রে কীচক সেখানে আসিয়াছে৷ অন্ধকারে ভীমকে দেখিয়া সে মনে করিল, বুঝি দ্রৌপদী সেখানে শুইয়া আছেন৷ তাই দুষ্ট তাঁহার সঙ্গে তামাশা আরম্ভ করিল৷ সে বলিল, “বাড়িব লোক বলে, আমার মতন সুন্দর মানুষ আর নাই৷”

 তাহাতে ভীম বলিলেন, “আর আমার এই হাতখানির মতো মোলায়েম হাতও আর কো—থা-ও নাই!”

 এই বলিয়াই তিনি সেই দুষ্টের চুলের মুঠি ধরিলেন। তারপর কি হইল বুঝিয়া লও৷ কীচকও যেমন-তেমন বীর ছিল না, সে খানিক্ষণ খুবই যুদ্ধ করিল৷ কিন্তু ভীমের কাছে তাহার বড়াই আব কতক্ষণ খাটিবে? সেই ‘মোলায়েম’ হাতের চড় ভালো মতে খাইয়া আর তাহার বেশি কথা কহিতে হইল না৷ তখন ভীম সেই দুষ্টকে ধরিয়া তাহার এমনি সাজা করিলেন যে, তাহার হাড়গোড় ভাঙ্গিয়া, হাত-পা আর মাথা পেটের ভিতর ঢুকিয়া, একতাল মাংস মাত্র অবশিষ্ট রহিল৷ আজও কেহ কাহাকেও নিতান্ত ভয়ানক সাজা দিলে, লোকে বলে, ‘কীচক বধ করিয়াছে৷’

 তারপর দ্রৌপদীকে ডাকিয়া কীচকের দশা দেখাইয়া ভীম চুপিচুপি নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। লোকে দ্রৌপদীর নিকট শুনিল যে, তাঁহার গন্ধৰ্ব স্বামিগণের হাতেই কীচকের সাজা হইয়াছে।


 এই ঘটনার সংবাদে কীচকের ভাইয়েরা সেখানে আসিয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে তাহাকে শ্মশানে লইয়া চলিল৷ তাহারা তাহাকে লইয়া ঘরের বাহিরে আসিবার সময় দৌপদী সেখানে দাঁড়াইয়াছিলেন৷ তাঁহাকে দেখিবামাত্র দুষ্টেরা বলিল, “এই হতভাগীর জনাই তো আমাদের দাদার প্রাণ গেল৷ চল তাঁহার সঙ্গে ইহাকেও নিয়া পোড়াই৷”

 বিরাট এই-সকল দুষ্ট লোককে বড়ই ভয় করিতেন, সুতরাং তিনি উহাদের কথায় রাজি হইলেন৷

 হায় হায়! যাঁহার পায়ের ধূলা পাইলে লোকে আপনাকে ধন্য মনে করিতে, দেবতারা পর্যন্ত যাঁহাকে সম্মান দিয়া চলিতেন, সেই দ্রৌপদী দেবীর কপালে কিনা এতই দুঃখ আর অপমান ছিল! দুরাত্মারা তাঁহাকে কীচকের সঙ্গে শ্মশানে লইয়া চলিল, একটি লোকও তাহাদিগকে বারণ করিল না। দ্রৌপদী কেবল এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, “হে জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন, জয়দ্বল তোমরা কোথায়? আমাকে রক্ষা কর!”

 ভীম তাঁহার ভয়ানক কার্য শেষ করিয়া সবে গিয়া একটু নিদ্রার আয়োজন করিতেছে, এমন সময় দ্রৌপদীর সেই কান্না তাঁহার কানে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাড়াতাড়ি পোশাক বদলাইয়া একটা গোপনীয় পথে শ্মশানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে দশ ব্যাম (পয়ত্রিশ হাত, সাড়ে তিন হাতে এক ব্যাম) লম্বা প্রকাণ্ড একটা গাছ ছিল, সেই গাছ তুলিয়া লইয়া তিনি যখন ঘোরতর গর্জনে সেই দুরাত্মাদিগকে তাড়া করিলেন, তখন তাঁহাকে নিতান্তই ভয়ংকর দেখা গিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহারা তাঁহাকে দেখিবামাত্রই “বাবা গো, ঐ গন্ধর্ব আসিতেছে!” বলিয়া দ্রৌপদীকে ফেলিয়া ঊৰ্দ্ধশ্বসে পলাইতে লাগিল। কিন্তু পলাইয়া আর কদূর যাইবে? ভীম সেই গাছ দিয়া দেখিতে দেখিতে তাহাদের মাথা গুঁড়া করিয়া দিলেন। উহারা একশত পাঁচজন ছিল, তাহারা একটিও প্রাণ লইয়া ঘরে ফিবিতে পারিল না৷

 তারপর দ্রৌপদীকে শান্ত করিয়া ভীম পুনরায় ঘরে চলিয়া আসিলেন৷

 এদিকে দেশের সকল লোক গন্ধর্বের ভয়ে নিতান্তই ব্যস্ত হইয়া উঠিল। নিজে রাজা আসিয়া রানীকে বলিলেন, “এই মেয়েটি আমাদের এখানে থাকিলে তো বড়ই ভয়ের কথা দেখিতেছি। ইহাকে বল, সে অন্যত্র চলিয়া যাউক৷”

 দ্রৌপদী ঘরে ফিরিবামাত্রই সুদেষ্ণা তাঁহাকে এ কথা জানাইলেন। তাহা শুনিয়া দ্রৌপদী বলিলেন, “মা, আর তেরোটি দিন দয়া করিয়া অপেক্ষা করুন, তারপর আমি এখান হইতে চলিয়া যাইব। এই সময়ের মধ্যেই আমার স্বামিগণের দুঃখ দূর হইবে৷”

 দুঃখ দূর হওয়ার অর্থ বোধহয় বুঝিয়াছ। অর্থাৎ আর তেরো দিন গেলেই অজ্ঞাতবাসের এক বৎসর শেষ হইবে৷

 অজ্ঞাতবাসের সময় ফুরাইয়া আসিল। এতদিন দুর্যোধনের দলের লোকেরা কি করিতেছিলেন? তাঁহারা দেশ-বিদেশে লোক পাঠাইয়া প্রাণপণে পাণ্ডবদিগকে খুঁজিয়াছে, কিন্তু কোনোমতেই তাহাদের সন্ধান করিতে পারেন নাই! দূতেরা ফিরিয়া আসিয়া খালি এক থাই বলে, “মহারাজ, কত খুঁজিলাম, কোথাও পাণ্ডবদিগকে দেখিতে পাইলাম না৷”

 দূতগণের কথা শুনিয়া কৌরবেরা যারপরনাই চিন্তিত হইলেন। যাহা হউক, দূতেরা এই একটা ভালো সংবাদ আনিল যে বিরাটের সেনাপতি কীচক মারা গিয়াছে। এই কীচকের জন্য সকল রাজাই বিরাটকে ভয় করিয়া চলিতেন। দুর্যোধনের সভায় তখন ত্রিগর্ত দেশের রাজা সুশর্মা উপস্থিত ছিলেন। বিরাট কীচকের সাহায্যে এই সুশর্মাকে বার বার পরাজয় করাতে, ইহার মনে বিরাটের উপরে চিরকালই ভারি রাগ ছিল। এখন কীচক মারা যাওয়াতে সুশর্মা ভাবিলেন যে, সেইসকল পরাজয়ের শোধ সওয়ার উত্তম সুযোগ উপস্থিত। তাই তিনি, এই বেলা বিরাটের রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহার ধনরত্ন ও গোরুবাছুর কাড়িয়া লইবার জন্য কৌরবদিগকে খ্যাপাইয়া তুলিলেন৷

 কৌরবদিগের মধ্যে দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ প্রভৃতির মতো লোক থাকিতে কি আর অন্যায় কাজের জন্য তাঁহাদিগকে খ্যাপাইয়া তুলিতে বেশি সময় লাগে? সুশর্মা কথাটা পাড়িতে না পাড়িতেই স্থির হইল যে, তিনি তখনই বিরাটের গোয়ালাদিগকে তাড়াইয়া দিয়া তাঁহার গোরু চুরি করিতে যাইবেন, কৌরবেরা তাহার পরের দিনই দলবল সমেত গিয়া সেই সকার্যের সহায়তা করিবেন। এমন সুযোগ পাইয়া সুশমা আর একটুও সময় নষ্ট করিলেন না৷

 বিরাট সভায় বসিয়া আছে, এমন সময় এক গোয়ালা উদ্ধশ্বসে সেখানে আসিয়া সংবাদ দিল, “মহারাজ! ত্রিগর্ত দেশের লোকেরা আমাদিগকে পরাজয় করিয়া হাজার হাজার গোরু লইয়া গিয়াছে৷”

 যেই এ সংবাদ দেওয়া, অমনি রাজ্যময় হুলস্থূল পড়িয়া গেল। চারিদিকে কেবলই ‘সাজ, সাজ! ধর, ধর! মার, মার!’ শব্দ। সিপাহী, সৈন্য, রথ, হাতি, ঘোড়া, সব সাজিয়া প্রস্তুত হইল, নিশান উড়িতে লাগিল। মেঘের গর্জনের ন্যায় রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল। তাহার সহিত অস্ত্রের ঝন্ ঝন্ মিশিয়া গেল৷

 যোদ্ধারা বর্ম আঁটিয়া অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া প্রস্তুত। নিজে বিরাট সাজিয়াছেন, তাঁহার ভাই শতানিক সাজিয়াছেন, জ্যেষ্ঠ পুত্র শঙখও সাজিয়াছে। আর আর যোদ্ধারা তো কথাই নাই। যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল আর সহদেবকেও রাজা যুদ্ধের পোশাক পরাইয়া উত্তম-উত্তম অস্ত্র দিয়া চমৎকার রথে চড়াইয়া সঙ্গে লইয়াছেন৷

 বেলা প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় দুই দলের যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অন্ধকারের সহিত সেই যুদ্ধ আরো ঘনাইয়া আসিল৷

 দুঃখের বিষয়, আয়োজনের ঘটা যেমন হইয়াছিল, আসল যুদ্ধটা তেমন করিয়া হইতে পারে নাই। প্রথমে কয়েক ঘণ্টা খুবই যুদ্ধ হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার পরেই দেখা গেল যে, সুশর্মা বিরাটের সারথিকে মারিয়া তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছেন। তখন বিরাটের সৈন্যগণ রণস্থল ছাড়িয়া, যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল৷

 এদিকে যুধিষ্ঠির ভীমকে বলিতেছে, “ভীম, দেখিতেছ কি? বিরাটকে তো লইয়া গেল! শীঘ্র তাঁহাকে ছাড়াইয়া আন! এতদিন যাঁহার আশ্রয়ে সুখে বাস করিলাম, এসময়ে তাঁহার উপকার করা উচিত৷”

 ভীম বলিলেন, “হাঁ নিশ্চয়। এই দেখুন না, আমি এই গাছ দিয়া—”

 গাছের নাম শুনিয়া যুধিষ্ঠির ব্যস্তভাবে বলিলেন, “না না! গাছ লইয়া নয়। তাহা হইলেই তোমাকে চিনিয়া ফেলিবে। তুমি সাধারণ লোকের মতো অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া যাও। নকুল তোমার সঙ্গে যাউক৷”

 ভীম তাহতেই রাজি হইয়া চলিয়া গেলেন। হাতে গাছ না থাকিলেই কি ভীম তো! বিরাটকে তিনি ডাকিয়া বলিলেন, “ভয় নাই!” তাহা শুনিয়া সুশর্মা পিছনের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, একটা কি অদ্ভুত মানুষ ঝড়ের মতন ছুটিয়া আসিতেছে। দেখিতে দেখিতে সেই অদ্ভুত মানুষের গদার ঘায় তাহার হাতি, ঘোড়া, সিপাহী প্রায় শেষ করিয়া ফেলিল৷

 সুশর্মা আর উপায় না দেখিয়া ভীমের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। কিন্তু যুদ্ধ আর করিবেন কি, তাহার পূর্বেই ভীমের গদার ঘায় তাঁহার রথের ঘোড়া আর সারথি চুরমার হইয়া গিয়াছে। ততক্ষণে সহদেব প্রভৃতিও ভীমের সাহায্য করিতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, নিজে বিরাটও ভরসা পাইয়া ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন৷

 সুশর্মা ভাবিলেন, ‘বড় বিপদ! এই বেলা পালাই!’

 কিন্তু হায়! যুদ্ধের সময় ভীমেব সম্মুখ হইতে পালাইবার যেমন দরকার হয়, কাজটি তেমনি কঠিন হইয়া উঠে! সুশর্মা কয়েক পা যাইতে না যাইতেই ভীম তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া বসিলেন। তারপর আছাড়, কীল চড় প্রভৃতি কোনো সাজাই বাকি রহিল না—বাকি রহিল খালি প্রাণ বাহির কবিযা দেওয়া৷

 তখন বিরাটেব গোরু ও সুশর্মাকে লইয়া সকলে এক জায়গায় আসিযা মিলিলেন। সেখানে যুধিষ্ঠিবের ইচ্ছামত সুশর্মাকে কিছু মিষ্ট উপদেশ দিযা ছাড়িযা দেওযা হইল। এই ঘটনায় বিরাট যে পাণ্ডবদের উপর নিতান্তই সন্তুষ্ট হইলেন, এ কথা বলাই বাহুল্য। তিনি বলিলেন, “আপনাদের কৃপায় আজ আমার প্রাণ, মান সবই বজায় রহিল। এখন বলুন আপনাদিগকে কি দিয়া সন্তুষ্ট কবিব?”

 এ কথাব উত্তবে যুধিষ্ঠিৰ বলিলেন, “মহারাজ। শত্রুর হাত হইতে বক্ষা পাইয়াছেন ইহাই আমাদের যথেষ্ট পুবস্কাব। আপনি সুখে থাকুন৷”

 তারপর যুদ্ধ জয়ের সংবাদ লইযা দূতেরা বিবাট নগবের দিকে ছুটিয়া চলিল। অন্য সকলে সে রাত্রি যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাইযা পরদিন বাড়ি ফিবিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন৷

 এদিকে বিরাট নগরে অনেক বড়-বড় ঘটনা ঘটিতেছিল। বিরাট দলবল লইয ত্রিগর্ত দেশে যুদ্ধ করিতে গিযাছেন, বাডিতে রাজপুত্র উত্তর আর কয়েকজন কর্মচাবি ছাড়া আর কেহ নাই। ইহাব মধ্যে দুর্যোধন অসংখ্য সৈন্য আর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, শকুনি, দুঃশাসন প্রভৃতি বড়-বড় বীব সমেত আসিয়া মৎস্য দেশে উপস্থিত। তাহাবা আসিয়া বিরাটের গোযালাদিগকে ঠেঙ্গাইয়া একেবাবে ষাট হাজাব গোরু লইয়া প্রস্থান কবিলেন। গোয়ালারা মার খাইয়া চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে আসিযা বাজবাড়িতে খবর দিল৷

 পূর্বেই বলিয়াছি, তখন রাজবাড়িতে আর যোদ্ধা ছিল না, ছিলেন কেবল রাজপুত্র উত্তর। তিনি বাড়ি ভিতর হইতে এই সংবাদ শুনিয়া স্ত্রীলোকদিগের নিকট বাহাদুবি লইবাব জন্য বলিতে লাগিলেন, “কি করি, একজন সারথি নাই। ভালো একজন সারথি পাইলে, আমি ভীষ্ম-টিষ্মকে মারিয়া, এখনই গোরু ছাড়াইয়া আনিতাম। কৌরবেরা দেশ খালি পাইয়া গোরু চুরি করিয়া নিতেছে আমি সেখানে থাকিলে দেখিতাম, কেমন করিয়া নেয়।”

 এ কথা শুনিয়া অর্জুন চুপিচুপি দ্রৌপদীকে কি যেন শিখাইয়া দিলেন, তাবপর দ্রৌপদী আসিয়া উত্তরকে বলিলেন, “রাজপুত্র, আপনাদের বৃহন্নলা নামক ঐ হাতি হেন সুশ্রী ওস্তাদটি আগে অর্জুনের সারথি ছিলেন, উনি তাঁহারই শিষ্য, আর যুদ্ধেও তাঁহার চেয়ে বড় কম নহে। পাণ্ডবদের ওখানে থাকার সময় তাহার কথা আমি বেশ করিয়া জানিয়াছি। এমন সারথি আর কোথাও নাই৷”

 উত্তর বলিলেন, “তাহা তো বুঝিলাম, কিন্তু আমি নিজে উহাকে কেমন করিয়া আমার সারথি হইতে বলি?”

 দ্রৌপদী বলিলেন, “আপনার ভগ্নী উত্তরা বলিলে, উনি নিশ্চয় রাজি হইবেন। আব উঁহাকে সঙ্গে নিলে আপনারও যুদ্ধে জিতিয়া আসা নিশ্চিত৷”

 উত্তরাকে অর্জুন নিজের কন্যার মতো স্নেহ করিতেন, তাঁহার আব্দার তিনি কিছুতেই না রাখিয়া পারিতেন না। উত্তরের কথায় রাজকুমারী যখন অর্জুনের নিকট আসিয়া, মধুর স্নেহ আর আদরের সহিত, তাঁহাকে সারথি হইবার জন্য অনুরোধ করিলেন তখন আর তাঁহার “না” বলিবার উপায় রহিল না। আর তাঁহার না বলিবার ইচ্ছাও ছিল না। সুতরাং তিনি উত্তরার সঙ্গে সঙ্গেই রাজপুত্রের নিকট চলিলেন। উত্তর তাঁহাকে বলিলেন, “বৃহন্নলা! আমি কৌরবদের হাত হইতে গোরু ছাড়াইয়া আনিতে যাইব। তুমি আমার সারথি হইবে?”

 অর্জুন বলিলেন, “আমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, সারথি-ফারথি হওয়া কি আমার কাজ? নাচিতে বলিলে বরং চেষ্টা করিতে পারি৷”

 উত্তরা বলিলেন, “আগে তো সারথির কাজটা চালাইয়া দাও, শেষে নাচিবে এখন৷”

 এইরূপে হাসি তামাশার ভিতরে অর্জুন সারথির সাজ পরিতে লাগিলেন৷

 ভঙ্গির আর সীমা নাই। যেন কতই আনাড়ি, জম্মেও যেন বর্ম চোখে দেখেন নাই, সেটাকে উল্টা করিয়া পরিয়াই বসিলেন। মেয়েরা তো তাহা দেখিয়া হাসিয়া কুটিপাটি৷

 যাহা হউক, শেষে সাজগোজ করিয়া দুজনই রওয়ানা হইলেন। যাইবার সময় উত্তরা বলিলেন “ভীষ্ম দ্রোণ, এদের পোশাকগুলি কিন্তু আনা চাই আমরা পুতুল সাজাইব৷”

 তাহাতে অর্জুন হাসিয়া বলিলেন, “তোমার দাদা যদি উঁহাদিগকে পরাজয় করিতে পারেন, তবে আনিব৷”

 এইরূপে তাঁহারা যাত্রা করিলেন। উত্তরের উৎসাহ আর ধরে না, তিনি ক্রমাগতই বলিতেছে, “কোথায় গেল কৌরবেরা? বৃহন্নলা, শীঘ্র চল! এখনই গোরু ছড়াইয়া আনিব!”

 অর্জুন রথ চালাইতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিলেন না। খানিক পরেই তাঁহারা সেই শ্মশানে আর শমী গাছের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখান হইতে কৌরবদের সৈন্য দেখা যাইতেছিল, যেন সাগরের জল, পৃথিবী ছাইয়া ফেলিয়াছে!

 সেই সৈন্যের দল দেখিযাই ভয়ে উত্তরের মুখ শুকাইয়া গেল। তিনি বলিলেন, “ও বৃহন্নলা! আমাকে এ কোথায় আনিলে? আমি ছেলেমানুষ, এত এত সৈন্য আর ভয়ানক বীরের সহিত কেমন করিয়া যুদ্ধ করিব? ওমা! আমার কি হইবে? আমাকে ঘরে নিয়া চল!”

 অর্জুন বলিলেন, “সে কি রাজপুত্র! এত বড়াই করিয়াছিলেন, সেসব এখন কোথায়? এখন খালি হাতে ফিরিলে লোকে বলিবে কি? আমি তো গোৰু না লইয়া ঘরে ফিরিতে পারিব না৷”

 উত্তর বলিলেন, “গোরু যায়, সেও ভালো! গালি খাই, সেও ভালো! আমি যুদ্ধ করিতে পারিব না৷”

 এই বলিয়া রজপুত্র রথ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া দে ছুট!

 কি বিপদ! বুঝি বেচারা সবই মাটি করে। কাজেই অর্জুনকেও তাঁহার পিছু পিছু ছুটিতে হইল। ছুটতে ছুটতে তাঁহার মাথার লম্বা বেণী এলাইয়া গেল, গায়ের চাদর হওয়ায় উড়িতে লাগিল৷

 এদিকে কৌরবের লোকেরা এসকল ঘটনার অর্থ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেনা। উত্তরকে পালাইতে আর অজুৰ্নকে ছুটিতে দেখিয়া, প্রথমে কেহ কেহ হাসিয়াছিল। কিন্তু তাহার পরেই তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, “এ ব্যক্তি কে? স্ত্রীলোকের মতো কতকটা চেহারা বটে, কিন্তু আবার পুরুষের মতোও দেখিতেছি। মাথা, ঘাড়, আর হাত ঠিক অর্জুনের মতে। এ ব্যক্তি নিশ্চয় অর্জুন, নহিলে এমন তেজীয়ান চেহারা কাহার? আর এমন সাহসই বা কাহার যে একেলা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে?”

 এদিকে অর্জুন একশত পা গিয়াই উত্তরের চুল ধরিয়াছেন। তখন যে উত্তরের কান্না! “ও বৃহন্নলা। শীঘ্র ঘরে চল। তোমাকে মোহর দিব, হীরা দিব, ঘোড়া দিব, রথ দিব, হাতি দিব, আমাকে ছাড়িয়া দাও!”

 অর্জুন তাহাকে সাহস দিয়া বলিলেন, “রাজপুত্র, তোমার কোনো ভয় নাই। তুমি যুদ্ধ করিতে না চাহ আমার সারথি হও। আমি যুদ্ধ করিয়া গোরু ছাড়াইব৷”

 এইরূপে উত্তরকে শান্ত করিয়া অর্জুন তাঁহাকে রথে তুলিয়া লইয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন৷

 এদিকে দ্রোণ ভীষ্মকে বলিতেছেন, “ভীষ্ম। আজ কিন্তু অর্জুনের হাতে আমাদের রক্ষা নাই। যুদ্ধে শিবকে খুশি করিয়াছে তারপর এতদিন ক্লেশ পাইয়া রাগিয়া আছে, ও কি আমাদিগকে সহজে ছাড়িবে?”

 একথায় কর্ণ বলিলেন, “আমার আর দুর্যোধনের যে ক্ষমতা, অর্জুনের তাহার একআনাও নাই৷”

 দুর্যোধন বলিলেন, “এ যদি অর্জুন হয়, তবে তো ভালোই হইল। অজ্ঞাতবাস শেষ না ইতেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, কাজেই আবার বারো বৎসর ইহাদিগকে বনবাস করিতে হইবে৷”

 ইহাদের এইরূপ কথাবার্তা চলিয়াছে। ততক্ষণে অর্জুন উত্তরকে লইয়া সেই শমীগাছের নিকটে উপস্থিত হইয়াছে। শমীগাছের তলায় আসিয়া তিনি বলিলেন, “রাজপুত্র, গাছে উঠিয়া ঐ অস্ত্রগুলো নামাও৷”

 এ কথায় উত্তর ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “ও গাছে মড়া বাঁধা রহিয়াছে, হইলে অশুচি হইবে যে৷

 অজুর্ন বলিলেন, “উহা মড়া নহে, অস্ত্র। মড়া ছুইতে আমি তোমাকে কেন বলিব?”

 অর্জুন বলিলেন, “এসব অস্ত্র পাণ্ডবদিগের৷”

 পাণ্ডবদিগের নাম শুনিয়া উত্তর আরো আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এ-সব যদি পাণ্ডবদিগের অল্প হয়, তবে তাহারা এখন কোথায়?”

 অর্জুন বলিলেন, “তাঁহারা তোমাদের বাড়িতেই আছে। আমি অর্জুন, তোমার পিতার যে কঙ্ক নামে সভাসদ আছে, তিনি যুধিষ্ঠির, বল্লভ নামক ঐ ষণ্ডা পাচকটি ভীম, গ্রন্থিক নামক যে লোকটি ঘোড়াশালে কাজ করে সে নকুল, আর গোশালা্র কর্তা তন্ত্রিপাল সহদেব, তোমাদের বাড়িতে যিনি সৈরিন্ধ্রীর কাজ করেন, তিনি দ্রৌপদী৷”

 উত্তরের নিকট এসকল কথা স্বপ্নের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। পাণ্ডবদিগের ন্যায় মহাপুরুষেরা তাহাদের বাড়িতে সামান্য চাকরের মতো বাস করিতেন, এ কথা কি সহজে বিশ্বাস হয়।কাজেই উক্ত অর্জুনেরকথা পরীক্ষা করিবার জন্য বলিলেন, “শুনিয়াছি অর্জুনের দশটি নাম আছে আপনি যদি সেই অর্জুন, তবে সেই দশটি নাম আর তাদের অর্থ বলুন দেখি।”

 অর্জুন বলিলেন, “অর্জুন মানে সাদা, নির্মল। আমি নির্মল কাজ করি, এইজন্য আমি অর্জুন। দেশ জয় করিয়া ধন আনি, তাই আমি ধনঞ্জয়। যুদ্ধে আমি সর্বদাই জয়লাভ করি, তাই আমি বিজয়। আমার রথের ঘোড়াগুলি সাদা, তাই আমি শ্বেতবাহন। আমার জন্মের দিন উত্তফাল্গুনী নক্ষত্র ছিল, তাই আমি ফাল্গুনী। দৈত্যদিগকে হারাইয়া ইন্দ্রের নিকট কিরীট, অর্থাৎ মুকুট পুরস্কার পাইয়াছিলাম, তাই আমি ‘কিরীট’। যুদ্ধের সময় আমি বীভৎস অর্থাৎ নিষ্ঠুর কাজ করি না, তাই আমি বীভৎসু। আমি সব্য অর্থাৎ বাম হাতেও ডান হাতের ন্যায় তীর ছুঁড়িতে পারি, তাই আমি সব্যসাচী। ভয়ানক শত্রুকেও আমি জয় করিয়া থাকি তাই আমি বিষ্ণু আর রঙ কালো বলিয়া আমি কৃষ্ণ৷”

 তখন উত্তর জোড়হাতে অর্জুনকে নমস্কার করিয়া, বিনয়ের সহিত বলিলেন, “মহাশয়! আমি না জানিয়া আপনার নিকট অনেক অপরাধ করিয়াছি আমাকে ক্ষমা করুন৷”

 অর্জুন বলিলেন, “আমি তোমার উপর কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট হই নাই। ভয় পাইও না, অস্ত্রগুলি রথে তোল, তোমার গরু ছাড়াইয়া দিতেছি”৷

 এতক্ষণে উত্তরের খুবই সাহস হইয়াছে, কারণ অর্জুন সঙ্গে থাকিলে আর কিসের ভয়? এরপর আর সারথির কাজ করিতে তিনি কিছুমাত্র আপত্তি করিলেন না৷

 তারপর অর্জুন হাত হইতে বালার গোছা খুলিয়া, ঝকঝকে সোনালি কবচ আঁটিয়া পরিলেন। সাদা কাপড় দিয়া মাথার বেণী বেশ করিয়া বাঁধিলেন। শেষে সেই সুন্দর রথে চড়িয়া, নানারূপ অস্ত্র মনে মনে ডাকিবামাত্র তাহারা উপস্থিত হইয়া জোড়হতে বলিল, ‘আমরা আসিয়াছি, কি করিতে-হইবে অনুমতি করুন৷’

 অর্জুন বলিলেন, ‘তোমরা যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে থকিয়া আমার কাজ করিবে৷’

 এইরূপে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া, অর্জুন গাণ্ডীবে টঙ্কার ও তাঁহার বিশাল শঙেখ ফুঁ দিবামাত্র, উত্তর ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে রথের ভিতরে বসিয়া পড়িলেন৷

 তাহা দেখিয়া অর্জুন বলিলেন, ‘কি হইয়াছে? ভয় পাইতেছ কেন?’

 উত্তর বলিলেন, ‘উঃ! আমার কান ফাটিয়া গেল! মাথা ঘুরিয়া গেল! শঙ্খের আর ধনুকের শব্দ এমন ভয়ানক হইতে পারে তাহা তো আমি জানিতাম না!’

 যাহা হউক শেষে উত্তরের ভয় গেল।

 এদিকে সেই ধনুকের টঙ্কার আর শঙ্খের শব্দ শুনিয়া, কৌরবদের আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, উহা অর্জুনেরই ধনুক আর শঙ্খ। দুর্যোধনের তখন ভারি আনন্দ। তিনি ভাবিলেন যে, অর্জুন সময় ফুরাইবার পূর্বেই দেখা দিয়াছেন, সুতরাং পাণ্ডবদিগকে আবার বারো বৎসর বনবাস করিতে হইবে৷

 কর্ণের খুবই উৎসাহ। তিনি ভাবিলেন যে, অর্জুনকে মারিয়া একটা নিতান্তই বাহাদুরির কাণ্ড করিবেন৷

 যাঁহারা একটু শান্ত আর ধার্মিক, তাঁহারা বলিলেন, ‘আজ অর্জুনের হাতে বড়ই বিপদ দেখা যাইতেছে সকলে সাবধানে থাকুন!’

 এইরূপে নানারকম কথাবার্তা হইতেছে। কেহ বলিতেছেন, ‘অজ্ঞাত বাসের এখনও বাকী আছে৷’ কেহ বলিতেছেন, ‘না বাকী নাই, তাহা হইলে অর্জুন কখনই এমন করিয়া আসিতেন না।’ শেষে ভীষ্ম ভালমত হিসাব করিয়া বলিলেন, ‘আমি দেখিতেছি, পাণ্ডবদের তের বৎসর পূর্ণ হইয়া পাঁচ ছয় দিন বেশী হইয়াছে। সুতরাং তাঁহাদের যাহা করার কথা ছিল, তাহা ভালরূপেই করিয়াছেন, তাহাতে ভুল নাই।’

 তারপর ভীষ্মের কথায় সৈন্যদিগকে চারিভাগ করিয়া এক ভাগের সহিত দুর্যোধন নিজেকে বাঁচাইবার জন্য হস্তিনায় যাত্রা করিলেন। এক ভাগ গরু লইয়া চলিল আর দুই ভাগ লইয়া ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ প্রভৃতি অর্জুনকে আটকাইতে প্রস্তুত হইলেন৷

 এমন সময় অর্জুনের দুটি বাণ আসিয়া দ্রোণের পায়ের কাছে পড়িল। আর দুটি বাণ তাঁহার কানের কাছ দিয়া চলিয়া গেল। দ্রোণ হইলেন অর্জুনের গুরু। এতদিন পরে দেখা হইল, প্রণাম করিয়া দুটি কুশল মঙ্গল তো জিজ্ঞাসা করা চাই। এত দূরে থাকিয়া সে কাজ আর কীরূপে হইবে? তাই অর্জুন গুরুর পায়ের কাছে বাণ ফেলিয়া তাঁহাকে প্রণাম জানাইলেন আর কানের কাছে বাণ পাঠাইয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। আর এই সব কাজের অর্থ বুঝিতে পারিয়া দ্রোণের বিশেষ আনন্দ হইল৷

 এদিকে অর্জুন যখন দেখিলেন যে, দুর্যোধনের পলায়ন করিবার চেষ্টা, তখন তিনি উত্তর কে বলিলেন, ‘আগে ঐ হতভাগার কাছে চল।’

 অর্জুনের রথকে দুর্যোধনের দিকে ছুটিতে দেখিয়া কৃপ দ্রোণকে বলিলেন, ‘আর গুরুর ভাবনা ভাবিয়া কাজ নাই! ঐ দেখ, দুর্যোধনের এখন বড়ই বেগতিক!’

 অর্জুন দুর্যোধনের দিকে চলিয়াছে, তাহাকে আটকাইবার জন্য চেষ্টার কিছুমাত্র ত্রুটি হইতেছে না। কিন্তু অজুৰ্নকে আটকায় কাহার সাধ্য! যে তাহার সামনে আসিতেছে, তাহারই তিনি দুর্দশার একশেষ করিতেছে। কেহ পলাইতেছে, কেই মারা যাইতেছে। অনেকে ভ্যাবাচাকা লাগিয়া মার খাইতেছে৷

 অর্জুনকে আটকাইতে গিয়া কর্ণের এক ভাই মারা গেল। কর্ণ তাহাতে ভীষণ রাগের সহিত আসিয়া অর্জুনকে আক্রমণ করিলেন। দু-জনে কিছুকাল এমনি ভয়ানক যুদ্ধ হইল যে, তাহার আর তুলনা নাই। শেষে দেখা গেল যে, হাতে, মাথায়, উরুতে, কপালে আব ঘাড়ে বিষম বাণের খোঁচা খাইয়া কর্ণ উধর্বশ্বাসে পলায়ন করিতেছেন।

 এইরূপে একে-একে সকলেই অর্জুনের হাতে নাকাল হইতে লাগিলেন। কর্ণ পলাইলে আসিলেন কৃপ, কৃপ পলাইলে দ্রোণ। দ্রোণকে অর্জুন অস্ত্র মারিতে চাহেন নাই। কিন্তু দ্রোণ বাণ মারিতে আরম্ভ করিলে অর্জুনকেও যুদ্ধ করিতে হইল। তাহার ফলে দ্রোণও বেশ ফাঁপরে পড়িয়াছিলেন। ইহার মধ্যে অশ্বত্থামা আসিয়া অর্জুনের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করাতে প্রস্থান করিয়া রক্ষা পাইলেন৷

 তারপর কর্ণ আবার আসিয়াছিলেন আর তাঁহার সাজাও তেমনি হইয়াছিল। এবার বুকে সাঙ্ঘাতিক বাণ খাইয়া তিনি রণস্থলেই অজ্ঞান হইয়া যান। তারপর কোনমতে উঠিয়া পলায়ন করেন৷

 এইরূপে কত লোক অর্জুনের কাছে জব্দ হইল, তাহা কত বলিব? সকলে একসঙ্গে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াও তাঁহার কিছুই করিতে পারিলেন না। নিজে ভীষ্ম অজ্ঞান হইয়া গেলেন, তখন সারথি রথ হাঁকাইয়া তাঁহাকে লইয়া প্রস্থান করিল৷

 দুর্যোধন দুবার অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করেন। প্রথম বার পলায়ন করিয়াছিলেন। তাহাতে অর্জুন অনেক ঠাট্টা করায় রাগের ভরে আবার আসেন। এবারে ভীষ্ম প্রভৃতি সকলে তাঁহার সাহায্য করিতে লাগিলেন। তাঁহারা সকলে মিলিয়া অর্জুনের উপরে বাণ মারিতে আরম্ভ করিলে অর্জুন অতি চমৎকার উপায়ে তাঁহাদিগকে জব্দ করেন। এবার কাহাকেও মারিবার চেষ্টা না করিয়া, তিনি ‘সম্মোহন’ নামক অস্ত্র ছুড়িয়া মারিলেন। সেই আশ্চর্য অস্ত্র ছাড়িয়া শঙ্খে ফু দিবামাত্রই, সকলে অজ্ঞান হইয়া ঘুমাইয়া পড়িল। তখন উত্তরার সেই কথা মনে করিয়া, তিনি উত্তরকে বলিলেন, ‘তুমি শীঘ্র গিয়া দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা আর দুর্যোধনের গায়ের কাপড়গুলি লইয়া আইস। সাবধান ভীষ্মের কাছে যাইও না। তিনি এই অস্ত্র থামাইবার সঙ্গেত জানেন, হয়তো তিনি অজ্ঞান হন নাই৷’

 অর্জুনের কথা যে ঠিক, তাহার পরিচয় হাতেই পাওয়া গেল। কর্ণ, দুর্যোধন, প্রভৃতির কাপড় আনিয়া, উত্তর ভালো করিয়া রথে বসিতে না বসিতেই, ভীষ্ম উঠিয়া আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন। কিন্তু অর্জুনের দশ বাণ খাইয়া বুড়ার আর যুদ্ধ করিতে হইল না৷

 এদিকে দুর্যোধন জাগিয়া উঠিয়াই ভারি চোটপাট আরম্ভ করিয়াছেন, “আপনারা কিজন্য অর্জুনকে এত সহজে ছাড়িয়া দিতেছেন? শীঘ্র উহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া দিন৷”

 তখন ভীষ্ম হাসিয়া বলিলেন, “দুর্যোধন, এতক্ষণ তোমার বুদ্ধি কোথায় ছিল? অজ্ঞান হইয়া যখন গড়াগড়ি খাইতেছিলে, তখন অর্জুন ইচ্ছা করলেই তো তোমাদের কর্ম শেষ করিয়া দিতে পারিত! সে ধার্মিক লোক, তাই দয়া করিয়া তোমাদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছে। তাই ঢের, এখন প্রাণ থাকিতে ঘরে ফিরিয়া চলো৷

 আর কি দুর্যোধনের মুখে কথা আছে! তাঁহাব মাথা হেঁট হইয়া গিয়াছে, লম্বা নিশ্বাস বহিতেছে। এদিকে অর্জুন বাণের দ্বারা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতিকে নমস্কার করিয়া, আর-এক বাণে দুর্যোধনের মুকুটটি দুইখান করিয়া গোরু লইয়া শঙ্খ বাজাইতে বাজাইতে ঘরে ফিরিলেন৷

 ফিরিবার সময় পথে অর্জুন উত্তরকে বলিলেন, সাবধান! ঘরে ফিরিয়া কিন্তু আমার নাম করিও না। আমরা যে তোমাদের এখানে আছি, তাহা যেন তোমাদের লোকেরা না জানিতে পারে৷

 তারপর সেই শমী গাছের নিকটে আসিয়া অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশে, রাজপুত্রের সারথি হইয়া বসিলেন। গোয়ালারা তাঁহাদিগকে বিশ্রাম করিতে বসাইয়া, তাড়াতাড়ি নগরে সংবাদ পাঠাইল যে, “যুদ্ধে জিতিয়া গোরু ছাড়ানো হইয়াছে৷”

 এদিকে রাজা বিরাট দেশে ফিরিয়া, মেয়েদের নিকট শুনিলেন যে, উত্তর বৃহন্নলাকে সারথি করিয়া, কৌরবদিগের নিকট হইতে গোরু ছাড়াইয়া আনিতে গিয়াছে। এই সংবাদে তাহার মনে কিরূপ চিন্তা ও ভয় হইল, তাহা বুঝিতেই পার। তিনি তাড়াতাড়ি সৈন্যদিগকে বলিলেন, “তোমরা শীঘ্র তাহাকে খুঁজিতে যাও। হায় হায়! একে ছেলেমানুষ, তাহাতে বৃহন্নলা সারথি, সে কি আর এতক্ষণ বাঁচিয়া আছে?”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মহারাজ, কোনো ভয় নাই। বৃহন্নলা যখন সারথি তখন দেব, দানব যক্ষ প্রভৃতি সকলে মিলিয়াও রাজকুমারের কিছু করিতে পারিবে না৷”

 এই সময় সংবাদ আসিল, “যুদ্ধ জিতিয়া গোৰু ছাড়ানো হইয়াছে৷” তাহা শুনিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “বৃহন্নলা যাহার সারথি তাহার তো জয় হইবেই৷”

 এই সংবাদ শুনিয়া বিরাটের কি আনন্দ হইল! তিনি দূতগণকে পুরস্কার দিয়া, তখনই নগরে একটা ভারি ধুমধামের ব্যবস্থা করিলেন।

 তারপর সৈরিন্ধীকে ডাকিয়া বলিলেন, “পাশা আন, আমি কঙ্কের সহিত পাশা খেলিব।” পাশা আসিল, খেলা আরম্ভ হইল। রাজার মন আজ আনন্দে অধীর হইয়া উঠিয়াছে। তিনি পাশা খেলিতে খেলিতে বলিলেন, “কঙ্ক আজ আমার পুত্র কৌরবদিগকে হারাইয়া দিয়াছে!”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মহারাজ! বৃহন্নলা সারথি, হারাইবেন না তো কি?”

 এ কথায় রাজা তো একেবারে চটিয়া লাল! ‘কি? আমার পুত্র কি উহাদিগকে হারাইতে পারে না, তুমি যে বারবার কেবল বৃহন্নলা বৃহন্নলা করিতেছ? খবরদার! প্রাণের মায়া থাকে ততা আর এমন বেয়াদবি করিও না!'

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, এ-সকল বীরকে কি বৃহন্নলা ছাড়া আর কেহ হারাইতে পারে?”

 ইহার পর রাজা আর রাগ থামাইতে না পারিয়া, যুধিষ্ঠিরের মুখে পাশা ছুঁডিয়া মারিলেন। পাশার ঘায় যুধিষ্ঠিরের নাক দিয়া দর দর ধারে রক্ত পড়িয়া তাঁহার অঞ্জলি ভরিয়া গেল। দ্রৌপদী তাড়াতাড়ি সোনার গামলায় জল আনিয়া, তাঁহার শুশ্রুষা করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে দ্বারী আসিয়া বলিল, “রাজকুমার বৃহন্নলার সহিত দরজায় উপস্থিত হইয়াছে।” তাহা শুনিয়া রাজা বলিলেন, “শীঘ্র তাহাদিগকে এখানে লইয়া আইস।”

 যুধিষ্ঠির দেখিলেন যে সর্বনাশ উপস্থিত, অর্জুন আসিয়া তাঁহার সেই অবস্থা দেখিলে, আর বিরাটকে আস্ত রাখিবেন না। কাজেই তিনি দ্বারীর কানে কানে বলিয়া দিলেন, বৃহন্নলা যেন এখন এখানে না আসে। সুতরাং উত্তর একাই সেখানে আসিলেন।

 উত্তর যুধিষ্ঠিরের মুখে রক্ত দেখিয়াই ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা! এমন অন্যায় কাজ কে করিল? ইহাকে কে আঘাত করিল?”

 রাজা বলিলেন, “আমি করিয়াছি! আমি যতই তোমার প্রশংসা করি, ততই এ বামুন খালি বৃহন্নলার কথা বলে। কাজেই শেষে আমি উহাকে মারিয়াছি'।

 উত্তর বলিলেন, “ব্রাহ্মণ রাগিলে সর্বনাশ হইবে। শীঘ্র ইহাকে সন্তুষ্ট করুন।”

 এ কথায় রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাতে, যুধিষ্ঠির বলিলেন, মহারাজ, আমি ইহার পূর্বেই ক্ষমা করিয়াছি।

 যুধিষ্ঠিরের রক্ত পরিষ্কার হইলে বৃহন্নলা সেখানে আসিয়া রাজাকে নমস্কার করিলেন। রাজা বৃহন্নলার সামনেই উত্ত রকে বলিতে লাগিলেন, বাবা তুমি আমার নাম রাখিয়াছ। তোমার মতন পুত্র কি আর কাহারো হয়! এতগুলি মহা মহা বীরের সহিত না জানি কেমন করিয়া যুদ্ধ করিয়াছিলে!

 উত্তর বলিলেন, “বাবা! আমায় কিছুই করিতে হয় নাই। এক দেবপুত্র আসিয়া আমার হইয়া যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তিনিই কৌরবদিগকে তাড়াইয়া গরু ছাড়াইয়া আনিয়াছেন।”

 এ কথা শুনিয়া বিরাট বলিলেন, “তবে তো সেই দেবপুত্রর পূজা করিতে হয়। তিনি কোথায়?”

 উত্তর বলিলেন, “তিনি কাল পরশু আবার আসিবেন।”

 যুদ্ধের সংবাদে সকলেই খুব খুশি হইল। আর উত্তরা সেই কাপড়গুলি পাইয়া যে কত খুশি হইল। তাহা আর লিখিয়া কি বুঝাইব?

 এইরূপে অজ্ঞাতবাস শেষ হইল। পাঁচ ভাই উত্তরকে লইয়া পরামর্শ করিলেন যে, আর দুদিন পরে তাঁহারা নিজের পরিচয় দিবেন। কিরূপ করিয়া পরিচয় দেওয়া হইবে, তাহাও স্থির হইল।

 যেদিন পরিচয় দিবার কথা, সেদিন পাণ্ডবেরা স্নানের পর সুন্দর সাদা পোশাক আর অলঙ্কার পরিয়া, বিরাটের সিংহাসনে গিয়া বসিলেন। বিরাট সভায় আসিয়া দেখেন, একি আশ্চর্য ব্যাপার। সভাসদ কঙ্ক সাজগোজ করিয়া তাঁহার সিংহাসনে বসিয়া আছেন। তিনি বিরক্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি কঙ্ক! আমার সিংহাসনে কেন বসিতে গেলে?”

 এ কথায় অর্জুন হাসিয়া বলিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠির ইন্দ্রের সিংহাসনে বসিতে পারেন। আপনার সিংহাসনে বসাতে তাঁহার অন্যায় কি হইল?”

 বিরাট বলিলেন, ইনিই যদি রাজা যুধিষ্ঠির হন তবে তাঁহার ভ্রাতাগণ আর দ্রৌপদী দেবী কোথায়?

 এ প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন একে একে সকলেরই পরিচয় দিলেন। তারপর উত্তর অর্জুনের অনেক প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “যে দেবপুত্র কৌরবদিগের সহিত ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করিয়া গরু ছাড়াইয়াছিলেন, তিনি এই অর্জুন।

 সকল কথা শুনিয়া বিরাটের যেমন আশ্চর্য বোধ হইল, তেমনি তিনি আনন্দিতও হইলেন। পাণ্ডবদিগকে যতপ্রকারে আদর দেখানো সম্ভব মনে হইল, তিনি তাহার কিছুই বাকি রাখিলেন না। তিনি কেবলই বলিতে লাগিলেন, আমার কি সৌভাগ্য! বিশেষত, অর্জুনের প্রতি তাঁহার যে কিরূপ স্নেহ হইল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, নিজের কন্যা উত্তরার সহিত তাঁহার বিবাহ দেন।

 কিন্তু এ কথায় অর্জুন রাজি হইলেন না। তিনি বলিলেন, আমি উত্তরার গুরু, তাহাকে সর্বদা আমার কন্যার মতো ভাবিয়া স্নেহ করিয়াছি। ইনিও আমাকে পিতার ন্যায় ভক্তি করিয়াছেন। তাঁহার সহিত কি আমার বিবাহের কথা হইতে পারে? আমার পুত্র অভিমন্যুর সহিত উত্তরার বিবাহ হউক।’

 এই প্রস্তাবে সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন। রূপে, গুণে, বিদ্যায় বুদ্ধিতে, বীরত্বে অভিমন্যুর মতো এমন সুপাত্র আর হয় না। কাজেই, সুন্দর দিন দেখিয়া, মহাসমারোহে অভিমন্যু আর উত্তরার বিবাহ হইয়া গেল। বিবাহে নানা দেশ হইতে বিরাট এবং পাণ্ডবদিগের আত্মীয়-স্বজন আর রাজারা আসিয়াছিলেন। কৃষ্ণ, বলরাম, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি কেহই আসিতে বাকি ছিল না।