উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/শল্যপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

শল্যপর্ব

র্ণের মৃত্যুতেও দুর্যোধন পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধি করিতে চাহিলেন না। তাঁহার পক্ষের বীরগণেরও বিলক্ষণ রণোৎসাহ দেখা গেল। সুতরাং প্রস্তুত হইলেন।

 সে রাত্রে আর তাঁহারা শিবিরে থাকেন নাই। তীরে, হিমালয়প্রস্থ নামক স্থানে, তাঁহারা রাত্রি কাটাইয়াছিলেন।

 পরদিন নতুন সেনাপতি শল্য অসাধারণ বিক্রমের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। আজ এই নিয়ম হইল যে ‘তাহাদের কেহই একাকী পাণ্ডবদিগকে আক্রমণ করিতে যাইবেন না;সকলে মিলিয়া সাবধানে পরস্পরকে সাহায্য করা হইবে৷’ মোটামুটি এইভাবেই যুদ্ধ চলিল। কিছুকাল যুদ্ধের পরই, কর্ণের পুত্র চিত্রসেন, সত্যসেন এবং সুষেণ নকুলের হাতে এবং শল্যের পুত্র সহদেবের হাতে মারা গেলেন।

 তারপর ভীমের সহিত শল্যের ঘোর গদাযুদ্ধ হয়। যুদ্ধ করিতে করিতে, শেষে দুইজনেই দুজনের গদাঘাতে অজ্ঞান হওয়ায়, কৃপাচার্য শল্যকে লইয়া প্রস্থান করিলেন, আর ভীম উঠিয়া গদা হাতে তাঁহাকে ডাকিতে লাগিলেন।

 যুধিষ্ঠিরের সহিত শল্যের বারবার যুদ্ধ হয়! তখন পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধারা সকলে মিলিয়াও শল্যের কিছুই করিতে পারেন নাই! অর্জুন এ সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না; তিনি অন্যস্থানে অশ্বথামা প্রভৃতির সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন। কিন্তু ইহার কিছুকাল পরে, অর্জুনের সম্মুখেই সৈন্যেরা ভীমের নিষেধ অমান্য করিয়া, পলায়ন করিতে লাগিল।

 এই সময়ে শল্যের বাণে নিজে নিতান্ত অস্থির হইয়া এবং সৈন্যদিগকে রক্তাক্ত শরীরে পলায়ন করিতে দেখিয়া, যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞা করিলেন “হয় শল্যকে বধ করিব না হয় নিজে প্রাণ দিব৷” তারপর ভীমকে সম্মুখে অর্জুনকে পশ্চাতে এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন আর সাত্যকিকে দুপাশে লইয়া, তিনি শল্যের সহিত এমন ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে তাহতে কৌরবদের আর আতঙ্কের সীমা রহিল না।

 ইহার মধ্যে একবার শল্যের বাণে কঠিন বেদনা পাইয়াও যুধিষ্ঠির তাঁহাকে অজ্ঞান করিয়া দিলেন। কিন্তু শল্যের জ্ঞান হইতে অধিক সময় লাগিল না। তখন যুধিষ্ঠির তাঁহার কবচ ভেদ করিলে, তিনি উল্টিয়া যুধিষ্ঠির এবং ভীম দুইজনেরই কবচ ছিঁড়িয়া দিলেন।

 এমন সময় শল্যের বাণে যুধিষ্ঠিরের ধনুক এবং কৃপের বাণে তাঁহার সারথির মাথা কাটা গেল। ঘোড়া চারটি শল্যের বাণে মরিতেও আর বেশি বিলম্ব হইল না।

 ইহাতে ভীম বিষম রোষে শল্যের ধনুক, সারথি, ঘোড়া সকল চূর্ণ করিয়া দিলেন। শল্যের বর্ম ও মুহূর্তেক পরেই কাটা যাওয়ায় তিনি অসি চর্ম হাতে, রথ হইতে নামিয়া, ক্রোধভরে যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিতে গেলেন। এমন সময় ভীমের নয়টি বাণ, বিদ্যুদ্বেগে আসিয়া শল্যর খড়্গের মুষ্ঠি কাটিয়া ফেলিল। তথাপি তিনি যুধিষ্ঠিরের দিকে সিংহের ন্যায় ছুটিয়া চলিলে যুধিষ্ঠির মণিমণ্ডিত অতি ভীষণ করালবদন স্বর্ণময় জ্বলন্ত শক্তি গ্রহণ করিলেন।

 তারপর তিনি তাঁহার বিশাল দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া, রোষভরে সেই শক্তি ছুঁড়িয়া মারিলে, শল্য তাহা লুফিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই সাংঘাতিক অস্ত্র, দেখিতে দেখিতে তাহার বক্ষ ভেদপূর্বক, প্রবল বেগে ভূতলে প্রবেশ করিল।

 শল্যের মৃত্যুতে তাহার সহোদর সক্রোধে যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিয়া মস্তক হারাইতে অধিক বিলম্ব হইল না। শল্যের সঙ্গে মদ্রদেশীয় লোকেরাও অনেক যুদ্ধের পর পাণ্ডবদের হাতে মারা গেল। ইহার পরে কৌরব সৈন্যেরা আর কিসের ভরসায় যুদ্ধ করিবে? তখন তাহারা সকলেই বুঝিল যে, আর পলায়ন ভিন্ন গতি নাই।

 এ সময়ে দুর্যোধন, অনেক কষ্টে তাহার সৈন্যদিগকে ফিরাইয়া পাণ্ডবদিগের সহিত ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করেন। তখন ম্লেচ্ছরাজ শাল্ব, এক ভয়ংকর হাতিতে চড়িয়া, অতি অদ্ভুত কাণ্ড করিয়াছিলেন। সৈন্যরা তো সে হাতির ভয়ে চ্যাঁচাইয়া পলাইলই; ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্নের মতো বীরেরাও তাহার তাড়ায় কম ব্যস্ত হলেন না। সে হতভাগা হাতি ধৃষ্টদ্যুম্নকে এমনি তাড়া করিল যে, তিনি রথ ছাড়িয়াই দে চম্পট! বেচারা সারথি আর পলাইতে পারিল না। হাতি তাহাকে সুদ্ধ রথখানিকে আছড়াইয়া গুঁড়া করিল।

 যাহা হউক,শেষে ধৃষ্টদ্যুম্নের গদায়ই হাতি মারা পড়ে। তারপরেই তীক্ষ্ম ভল্লে সাত্যকি শাল্বের মাথা কাটেন।

 তারপর দুই দলে ভয়ানক যুদ্ধ চলিল। দুর্যোধন এ সময়ে খুবই বীরত্ব দেখাইলেন। শকুনিও কম যুদ্ধ করিলেন না। দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া তিনি দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং সহদেবের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করেন। কিন্তু সেই দশ হাজারের মধ্যে চারি হাজার অশ্বারোহী দেখিতে দেখিতেই মারা যাওয়াতে, তাহার মনে হইল যে, এখন সবেগে প্রস্থান করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

 যাহা হউক শকুনি অবিলম্বেই আবার ফিরিয়া আসিলেন। তারপর পলকের মধ্যে তাহার অশ্বারোহীর সংখ্যা সাতশতে নামিয়া আসায় তিনি অমনি দুর্যোধনকে গিয়া বলিলেন, “আমি অশ্বারোহীগণকে পরাজয় করিয়াছি। এখন তুমি গিয়া রথীদিগকে পরাজয় কর।”

 দুর্যোধনের নিরানব্বই ভাইয়ের মধ্যে কেবল দুর্মর্ষণ, শ্রূতান্ত, জৈত্র, ভুরিবল, রবি, জয়ৎসেন, সুজাত, দুর্বিসহ, অরিহা, দুর্বিমোচন, দুষ্পরধর্ষ আর শ্র‍ূতর্বা এই বারোজন বাঁচিয়া ছিলেন। এই দিনের যুদ্ধে ভীমের হাতে তাহাদের মৃত্যু হইল। ইহার কিছুকাল পরেই সুশর্মা অর্জুনের বাণে, আর শকুনির পুত্র উলুক সহদেবের হাতে প্রাণত্যাগ করিলেন।

 পুত্রের মৃত্যু সহ্য করিতে না পারিয়া শকুনি তখনি সহদেবকে আক্রমণ করেন, কিন্তু ভালো মতে যুদ্ধ আরম্ভ না করিতেই সহদেবের বাণে তাহার ধনুক কাটা যায়। তখন অসি গদা শক্তি প্রভৃতি যে অস্ত্রই তিনি হাতে করেন, সহদেব তাহাই কাটিয়া ফেলেন। কাজেই শকুনি আর এক মুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করিলেন না।

 কিন্তু পলাইয়া তিনি যাইবেন কোথায়? সহদেব তাহার পিছু পিছু তাড়া করিয়া, বাণে বাণে তাহাকে ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিলেন। তখন শকুনি একটা প্রাস লইয়া সহদেবকে আক্রমণ করিতে গেলে, সহদেব তাহার দুখানি হাতসুদ্ধ সেই প্রাস কাটিয়া, সিংহনাদ করিতে করিতে তাহার মাথায় এক ভয়ানক ভল্ল ছুঁড়িয়া মারিলেন। সে ভল্ল তাহার মাথা কাটিয়া, প্রাণ বাহির করিয়া দিল।

 ইহার পর আর যুদ্ধের বড় বেশি বাকি রহিল না। দেখিতে দেখিতে কৌরবদিগের মধ্যে কেবলমাত্র দুর্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা অবশিষ্ট রহিলেন। তাহাদের এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্যের সমস্তই মরিয়া শেষ হইল।

 তখন রাজা দুর্যোধন, চারিদিক শূন্য দেখিয়া, প্রাণের ভয়ে পলায়নপূর্বক রণভূমির নিকটেই দ্বৈপায়ন নামক একটা হ্রদের জলে লুকাইতে চলিলেন। তখন তাহার মনে হইল যে, বিদুর পূর্বেই বলিয়াছিলেন, এইরূপ হইবে।

 ইতিমধ্যে বেচারা সঞ্জয়, সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে পড়িয়া প্রায় মারাই গিয়াছিলেন। তাহারা তাহাকে কাটিতে যাইবেন, ইত্যবসরে ব্যাসদেব সেখানে আসিয়া বলিলেন, “ইহাকে ছাড়িয়া দাও।”

 এইরূপে মুক্তি পাইয়া, সঞ্জয় তথা হইতে নগরের দিকে চলিয়াছে, এমন সময়, রণস্থলের এক ক্রোশ দূরে, দুর্যোধনের সহিত তাহার দেখা হইল। দুই চক্ষু জলে পূর্ণ থাকায়, দুর্যোধন প্রথমে সঞ্জয়কে দেখিতে পান নাই। তারপর তাহার কণ্ঠস্বরে তাহাকে চিনিয়া বলিলেন, “সঞ্জয়, বাবাকে বলিও, আমি হ্রদের নিকট লুকাইয়া, প্রাণ বাঁচাইয়াছি।” এই বলিয়া তিনি গদা হাতে দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকাইয়া রহিলেন।

 সঞ্জয় সেখান হইতে চলিয়া যাইবার কিঞ্চিৎ পরেই কৃপ, অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা তাহার নিকট দুর্যোধনের সংবাদ পাইয়া, সেই হ্রদের তীরে আসিয়া উপস্থিত হলেন। হ্রদের তীরে দাঁড়াইয়া তাহারা বলিলেন, “মহারাজ! জল হইতে উঠিয়া আইস, আমরা তিনজনে তোমাকে লইয়া পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধ করিব। আজ উহারা নিশ্চয় পরাজিত হইবে।”

 তাহা শুনিয়া দুর্যোধন বলিলেন, “বড় ভাগ্য যে, আপনাদিগকে জীবিত দেখিলাম। কিন্তু আমি অতিশয় ক্ষত-বিক্ষত হইয়াছি আর পাণ্ডবদিগের অনেক সৈন্য এখনো বাঁচিয়া আছে। সুতরাং আজ আমি যুদ্ধ করিতে পারি না। আজিকার রাত্রিটি বিশ্রাম করি, কাল আপনাদিগকে লইয়া যুদ্ধ করিব।”

 তখন অশ্বত্থামা বলিলেন, “মহারাজ! তুমি উঠিয়া আইস! আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, রাত্রি প্রভাত না হইতে তোমার শত্রুদিগকে বিনাশ করিব।”

 এই সময়ে কয়েকজন ব্যাধ সেই হ্রদের ধারে বিশ্রাম করিতেছিল। কৃপ, অশ্বথামা আর কৃতবর্মা তাহাদিগকে দেখিতে পান নাই, কিন্তু তাহারা তাহাদের কথাবার্তা সকলই শুনিতে পাইল। সুতরাং দুর্যোধন যে সেই হ্রদের জলে লুকাইয়া রহিয়াছে, এ কথা আর তাহাদের বুঝিতে বাকি রহিল না। একটু আগেই তাহারা পাণ্ডবদিগকে তাহার অন্বেষণ করিতে দেখিয়াছিল, আর তাহারা তাহাদিগকে দুর্যোধনের কথা জিজ্ঞাসাও করিয়াছিল। এমন সংবাদ তাহাদিগকে দিতে পারিলে, নিশ্চয়ই বিশেষ পুরস্কার মিলিবে, এই মনে করিয়া তাহারা অবিলম্বে ভীমের কাছে গিয়া, সকল কথা বলিয়া দিল।

 পাণ্ডবদিগের তখনো দুহাজার রথী, সাতশত গজারোহী, পাঁচহাজার অশ্বারোহী আর দশহাজার পদাতি অবশিষ্ট ছিল। দুর্যোধন পলায়ন করা অবধি তাহারা তাহাকে খুঁজিয়া ক্লান্ত হইয়াছে, কিন্তু কোথাও তাহার সন্ধান পান নাই। এমন সময় সেই ব্যাধেরা আসিয়া তাহাদিগকে সেই সংবাদ দিল।

 ব্যাধদিগকে রাশি রাশি ধন দিয়া তখনি সকলে দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে আসিলেন। কৃপ, অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা দূর হইতেই তাহাদের কোলাহল শুনিতে পাইয়াই, হ্রদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। তারপর পাণ্ডবেরা সেখানে আসিয়া, চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, এখন কি উপায়ে দুর্যোধনকে জলের ভিতর হইতে বাহির করা যায়।

 দুর্যোধন বড়ই অহংকারী লোক ছিলেন, কটু কথা তিনি কিছুতেই সহিতে পারিতেন না। গালি দিলে তিনি বাহির হইয়া আসিবেন, এই ভাবিয়া যুধিষ্ঠির তাহাকে অতি কর্কশভাবে বলিলেন, “দুর্যোধন! তুমি যে সকলকে যমের হাতে দিয়া, নিজে প্রাণভয়ে পলায়ন করিলে, এ কাজটা ভালো হয় নাই: আইস যুদ্ধ করি।”

 এ কথার উত্তরে দুর্যোধন জলের ভিতর হইতে বলিলেন, “আমি পলায়ন কবি নাই, বিশ্রাম করিতেছি। তোমরাও এখন গিয়া বিশ্রাম কর, তারপর যুদ্ধ হইবে।”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমাদের বিশ্রাম হইয়াছে, সুতরাং এখন আসিয়া হয় আমাদিগকে হারাইয়া রাজ্য ভোগ কর, না হয় আমাদের হাতে মরিয়া স্বর্গে যাও!”

 দুর্যোধন বলিলেন, “আমি এখনো তোমাদিগকে পরাজয় করিতে পারি। কিন্তু আমার সব মরিয়া গেল, আর কাহার জন্য রাজ্য লইতে চাহিব? সুতরাং তোমরাই এখন বাজ্য ভোগ কর, আমি মৃগচর্ম পরিয়া বনে যাইতেছি।”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “তোমার ও কান্নায় আর আমার মন ভুলিবার নয়। এখন তুমি আমাকে রাজ্য দিবার কে? তোমাকে বধ করিয়া আমার রাজ্য কাড়িয়া লইব। আইস, যুদ্ধ করি।”

 এরূপ কঠিন কথা দুর্যোধন আর তাহার জীবনে কখনো শোনেন নাই। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই জলের ভিতর হইতে বাহির হইয়া বলিলেন, “আমার বর্ম নাই, অস্ত্র নাই, রথ নাই; তোমাদের সকলই আছে। তোমরা সকলে আমায় ঘিরিয়া মারিলে, আমি কি করিয়া যুদ্ধ করিব? এক একজন করিয়া আইস, দেখা যাইবে।”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “তোমার যেমন খুশি, অস্ত্র দেখিয়া লও। বর্ম পর, চুল বাঁধ আর যাহা খুশি কর। তারপর আমাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যাহার সহিত ইচ্ছ যুদ্ধ কর। সেই একজনকে পরাজয় করিতে পারিলেই সমুদয় রাজ্য তোমার হইবে।”

 তখন দুর্যোধন বর্ম আর পাগড়ি পরিয়া, গদা হাতে লইয়া বলিলেন, “আমি এই গদা ইয়া যুদ্ধ করিব। তুমি বা ভীম বা অর্জুন বা নকুল বা সহদেব, যাহার খুশি, আসিয়া আমার সহিত গদাযুদ্ধ কর। ন্যায় মতে গদাযুদ্ধ করিয়া, তোমাদের কেহ আমার সঙ্গে পারিবে না। সত্য কি মিথ্যা, এমনি দেখিতে পাইবে।”

 এই সময়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “আপনি কোন সাহসে দুর্যোধনকে আপনাদের যাহার সহিত ইচ্ছা যুদ্ধ করিতে বলিলেন? দুরাত্মা যদি আপনাকে, অর্জুনকে,নকুলকে বা সহদেবকে আক্রমণ করিয়া বসিত, তাহা হইলে আপনাদের কিরূপ দশা হইত? ভীমও গদাযুদ্ধে দুর্যোধনকে আঁটিতে পারে কিনা সন্দেহ। ভীমের বল আর তেজ বেশি, কিন্তু দুর্যোধনের শিক্ষা অধিক, আর শিক্ষাতেই হারজিৎ। এখন বুঝিলাম যে, পাণ্ডবদের কপালে রাজ্য লাভ নাই, বিধাতা উহাদিগকে বনে থাকিবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন।”

 এমন সময় ভীম গদা হাতে লইয়া দুর্যোধনকে বলিলেন, “ওরে নরাধম! সকল দুরাত্মা মরিয়া এখন কেবল তুমিই অবশিষ্ট রহিয়াছ; আজ এই গদার প্রহারে তোমাকেও বধ করিয়া, আমাদের সকল দুঃখের শোধ লইব!”

 দুর্যোধন বলিলেন, “আর বড়াই করিও না! এখনি তোমার যুদ্ধের সাধ মিটাইয়া দিব।ন্যায় মতে গদাযুদ্ধে ইন্দ্রও আমাকে পরাজয় করিতে পারেন না। আইস দেখি, তোমার কত বিদ্যা!”

 দুজনে প্রাণ ভরিয়া গালাগালি চলিতেছে, এমন সময় বলরাম সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভীম ও দুর্যোধন দুইজনেই বলরামের ছত্র, তিনিই ইহাদের গদা শিক্ষার গুরু। সুতরাং যুদ্ধের সময় তাহাকে উপস্থিত দেখিয়া দুজনেরই খুব উৎসাহ হইল।

 কুরুক্ষেত্র অতি পবিত্র স্থান, সেখানে মৃত্যু হইলে স্বর্গলাভ হয়। এইজন্য বলরাম বলিলেন যে, যুদ্ধ দ্বৈপায়ণ হ্রদের ধারে না হইয়া কুরুক্ষেত্রে হওয়াই ভালো। তখন সকলে সেখান হইতে কুরুক্ষেত্রে আসিয়া, যুদ্ধের জন্য একটি স্থান দেখিয়া লইলেন।

 তারপর দুজনে, দুই মত্ত হস্তীর ন্যায় গর্জন করিতে করিতে, কি ঘোর যুদ্ধই আরম্ভ করিলেন। সকলে স্তব্ধভাবে চারিদিকে বসিয়া সেই অদ্ভুত যুদ্ধ দেখিতে লাগিল।

 সেকালের লোকেরা আগে খুব এক চোট বাক্য যুদ্ধ, অর্থাৎ গালাগালি, না করিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিত না। সুতরাং প্রথমে তাহাই কিছুকাল চলিল। তারপর ভীষণ ঠকঠক শব্দে রণস্থল কাঁপাইয়া উভয়ে উভয়কে আঘাত করিতে লাগিলেন। সে সময়ে তাহাদের গদা হইতে ক্রমাগত আগুন বাহির হইতেছিল।

 সে যুদ্ধের কি অদ্ভুত কৌশল! মণ্ডল, গতি, প্রত্যাগতি, অস্ত্র, যন্ত্র, পরিমোক্ষ, প্রহার, বঞ্জন, পরিবারণ, অভিস্রাবণ, আক্ষেপ, বিগ্রহ, পরাবর্তন, সংবর্ধন, অবপ্লুত, উপপুত, উপন্যস্ত প্রভৃতি অশেষ প্রকার কৌশল দেখাইয়া তাহারা যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এ সকল কৌশলে দুর্যোধনেরই অধিক ক্ষমতা দেখা গেল। তিনি একবার ভীমের বুকে এমনি গদা প্রহার করিলেন যে, কিছুকাল পর্যন্ত তাহার নড়িবার শক্তি রহিল না। যাহা হউক, ইহার পরেই ভীমও, এক গদাঘাতে দুর্যোধনকে অজ্ঞান করিলেন।

 খানিক পরে দুর্যোধন উঠিয়াই, ভীমের কপালে এমন গদার আঘাত করিলেন যে, সে স্থান হইতে দর দর ধারে রক্ত পড়িতে লাগিল। কিন্তু ভীমের দেহে এমনি অসাধারণ শক্তি ছিল যে, সেই সাংঘাতিক আঘাতেও তাহার কিছুই হইল না। তাহার পরেই দেখা গেল যে, দুর্যোধন ভীমের গদার চোটে ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িয়া যাইতেছে। তখনি আবার দুর্যোধনের আঘাতে ভীমেরও সেই দশা হইল! তখন দুর্যোধন ঘোরনাদে পুনরায় গদাঘাত করত ভীমের কবচ ছিড়িয়া দিলেন। সে আঘাতের বেগ ভীম সহজে সামলাইতে পারিলেন না।

 এতক্ষণে কৃষ্ণ স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, ন্যায় যুদ্ধে ভীমের দুর্যোধনকে পরাজয় করা অসম্ভব। সুতরাং তিনি অন্যায় যুদ্ধেই তাহাকে বধ করিতে পরামর্শ দিলেন। তখন অর্জুন ইঙ্গিত করামাত্র ভীম বুঝিতে পারিলেন যে, দুর্যোধনের উরু ভাঙ্গিয়া তাহাকে সংহার করিতে হইবে। গদাযুদ্ধে নাভির নীচে আঘাত নিষিদ্ধ বটে, কিন্তু ইহা ভিন্ন দুর্যোধনকে বধ করা যাইতেছেনা। সুতরাং ভীম এইটুকু অন্যায় করিয়াই নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে প্রস্তুত হইলেন।

 আবার যুদ্ধ চলিল। তারপর উভয়েই ক্লান্ত হইয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিলেন। তারপর আবার যুদ্ধ চলিল। এই সময়ে ভীম ইচ্ছা করিয়াই দুর্যোধনকে একটু আঘাতের সুযোগ দিলেন। তাহাতে দুর্যোধন প্রবল বেগে ভীমকে আক্রমণ করিতে আসিবামাত্র ভীম তাহাকে গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন;দুর্যোধন বিদ্যুতের মতো সেই গদা এড়াইয়া ভীমকে সাংঘাতিকভাবে আঘাত করিলেন। যাহা হউক, ভীম সেই ভয়ানক আঘাতও আশ্চর্যরূপে সহিয়া রহিলেন। তাঁহার শান্তভাব দেখিয়া দুর্যোধনের মনে হইল বুঝি তাহার কি অভিসন্ধি আছে। সুতরাং তিনি তাহাকে আর আঘাত না করিয়াই ত্বরায় ফিরিয়া আসিলেন।

 তারপর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিয়া, ভীম অসীম রোষে দুর্যোধনকে আক্রমণ করিতে ছুটিলেন। দুর্যোধন তাহাঁকে এড়াইবার জন্য লাফ দিয়া শূন্যে উঠিবামাত্র ভীম দারুণ গদাঘাতে তাহাব দুই উরু ভাঙ্গিয়া দিলেন। তখন ভগ্নপদে নিতান্ত অসহায়ভাবে দুর্যোধনকে ধরাশায়ী হইতে হইল। অমনি ভীম তাহার মাথায় পদাঘাতপূর্বক বলিলেন, “রে দুরাত্মা! সভার মধ্যে গরু গরু’ বলিয়া বিদ্রুপ করিয়াছিলি, আর দ্রৌপদীকে অপমান করিয়াছিল, তাহার এই সাজা।” এইরূপে গালি দিতে দিতে ভীম দুর্যোধনের মাথায় আবার পদাঘাত করিলেন।

 ভীমের এই ব্যবহারে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া, যুধিষ্ঠির তাঁহাকে বলিলেন, “ভীম’ সৎ উপায়েই হউক, আর অসৎ উপায়েই হউক, তোমার প্রতিজ্ঞা তুমি রাখিয়াছ,এখন ক্ষান্ত হও। ইহার মাথায় পদাঘাত করিযা আব পাপ কেন বাড়াও ইহার অবস্থা দেখিলে এখন বড়ই দুঃখ হয়। এ আমাদের ভাই তুমি ধার্মিক হইযা কেন উহাকে পদাঘাত করিতেছ?”

 তারপর তিনি দুর্যোধনকে বলিলেন, “ভাই, তুমি দুঃখ করিও না। তোমার দোষেই যুদ্ধ হইয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু তুমি দেত্যাগপূর্বক এখনি স্বর্গে যাইবে, আব আমরা এখানে সুহৃগণের শোকে চিরকাল দারুণ দুঃখ ভোগ করিব।”

 এই বলিয়া যুধিষ্ঠির চোখের জল ফেলিতে লাগিলেন।

 ভীমের কাজটি অতি অন্যায় হইয়াছিল;উপস্থিত যোদ্ধারাও ইহাতে সন্তুষ্ট হন নাই। বলরাম তো লাঙ্গল উঠাইয়া, তখনি ভীমকে বধ করিতে চাহিয়াছিলেন। কৃষ্ণের অনেক চেষ্টায় তিনি তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার রাগ দূর হইল না। তিনি কৃষ্ণকে বলিলেন, “তুমি যত চেষ্টাই কর না কেন, ভীম যে নিতান্ত অন্যায় কবিয়াছেন, এ বিশ্বাস আমার মন হইতে দূর করিতে পারিবে না।”

 এই বলিয়া বলবাম সেখান হইতে চলিয়া গেলে, যোদ্ধারা সকলে মিলিয়া দুর্যোধনের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাহারা বলিলেন, “হে ভীম! আজ তুমি দুষ্ট দুর্যোধনকে মারিয়া বড়ই ভালো কাজ করিলে। আমাদের ইহাতে যারপরনাই আনন্দ হইয়াছে।”

 তখন কৃষ্ণ সেই যোদ্ধাদিগকে বলিলেন, “যে শক্র মরিতে বসিয়াছে তাহাকে বকিলে কি হইবে? এ দুষ্ট এখন শত্রুতা বা বন্ধুতা কিছুরই উপযুক্ত নহে। আমাদের ভাগ্যের জোরে এতদিনে পাপী মারা গেল, এখন চল আমরা এ স্থান হইতে প্রস্থান করি।”

 এ কথায় দুর্যোধন, দুহাতে মাটিতে ভর দিয়া, মাথা তুলিয়া, কৃষ্ণকে বলিলেন, “হে কংসের দাসের পুত্র! তোমার দুষ্ট বুদ্ধিতেই আমাদের বীরেরা মারা গেলেন। তোমার মতো পাপী, নির্দয় আর নির্লজ্জ কে আছে?”

 তাহার উত্তরে কৃষ্ণ বলিলেন, “তুমি অনেক পাপ করিয়াছ এখন তাহারই ফল ভোগ কর৷”

 তাহাতে দুর্যোধন বলিলেন, “রাজার যে সুখ, তাহা আমি ভালো মতোই ভোগ করিয়াছি৷ এখন আমি সবান্ধবে স্বর্গে চলিলাম, তোমরা শোকে দুঃখে আধমরা হইয়া এই পৃথিবীতে পড়িয়া থাক৷”

 এ কথা বলিবামাত্র স্বৰ্গ হইতে দুর্যোধনের উপর পুষ্পবৃষ্টি আরম্ভ হইলে পাণ্ডবেরা লজ্জিতভাবে শিবিরে ফিরিয়া চলিলেন৷ কিন্তু সে রাত্রিতে তাহদের সকলের শিবিরের ভিতরে থাকা হইল না৷ কৃষ্ণের পরামর্শে, যুধিষ্ঠির, ভীম, অৰ্জুন, নকুল, সহদেব আর সাত্যকি তাহার সহিত শিবির ছাড়িয়া নদীর ধারে আসিয়া নিদ্রার আয়োজন করিলেন৷

 ইহার কিছুকাল পরেই কৃপ, অশ্বত্থামা আর কৃতবৰ্মা, দুর্যোধনের উরুভঙ্গের সংবাদ পাইয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন৷ দুৰ্যোধনের তখনকার অবস্থা দেখিয়া, সেই তিন বীরের বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল! তাঁহারা তাঁহার কাছে বসিয়া অনেক কাঁদিলে, দুর্যোধন তাঁহাদিগকে বলিলেন, “আপনারা আমার জন্য দুঃখ করিবেন না; আমি নিশ্চয়ই স্বৰ্গলাভ করিব৷ আপনারা প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াছেন; কিন্তু আমার ভাগ্যে জয়লাভ ছিল না, কি করিব?

 এই কথা বলিয়া দুর্যোধন চুপ করিলে, অশ্বত্থামা দুঃখে ও রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “আমাকে অনুমতি দাও, আমি প্রতিজ্ঞা কবিতেছি, আজ যেমন করিয়া হউক, শত্রুদিগকে মারিয়া শেষ করিব৷ ”

 এ কথায় দুর্যোধন তখনই অশ্বত্থামাকে সেনাপতি কবিয়া দিলে তাঁহাকে সেই অবস্থায় রাখিয়াই তিন বীর সিংহনাদ করিতে করিতে সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন৷