উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের রামায়ণ/লঙ্কাকাণ্ড

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

লঙ্কাকাণ্ড

 রপর সকলে উৎসাহে আকাশ পাতাল কাঁপাইয়া লঙ্কায় চলিল। সকলের আগে চলিল নল। সে পথ পরীক্ষায় বড়ই পণ্ডিত। কোন্ পথ ভাল, কোথায় পরিষ্কার জল, কোথায় মিষ্ট ফল, নলের সব মুখস্থ আছে। নল যে পথে যাইতেছে, সেই পথ ধরিয়া অন্যেরা তাহার পিছু পিছু চলিয়াছে। হনুমান রামকে আর অঙ্গদ লক্ষ্মণকে পিঠে করিয়া লইয়াছে। অন্য বানরেরা গাছের ফল খাইয়া, ফুলের শোভা দেখিয়া, মনের সুখে দল বাঁধিয়া চলিয়াছে। এইরূপে তাহারা সেই মহেন্দ্র পর্বতের কাছে সমুদ্রের ধারে আসিয়া উপস্থিত হইল।

এদিকে রাবণ রাক্ষসদের সহিত বসিয়া পরামর্শ করিতেছে। সে বলিল, ‘বল দেখি এখন উপায় কি! বড়ই যে মুস্কিল দেখিতেছি! লঙ্কায় আসিয়া প্রবেশ কবা ত যেমন-তেমন কঠিন কাজ নহে! সেই কাজ সামান্য একটা বানরে করিয়া দিয়া গেল, আমার ঘর বাড়িও ভাঙিল, এতগুলি বাক্ষসও মারিল! বল দেখি এখন কি করা যায়।’

রাক্ষসেরা বলিল, ‘সে কি মহারাজ। আমাদের এত সৈন্য, এত অস্ত্র, আর আপনি এমন বীর! পৃথিবী, আকাশ, পাতাল সকলই আপনি জয় করিয়াছেন। বানর আর মানুষকে আপনার কিসের ভয়? আপনার নিজেরও যুদ্ধ করিতে হইবে না; একা ইন্দ্রজিৎই মানুষ আর বানর মারিয়া শেষ করিবেন।’

প্রহস্ত বলিল, ‘আমি তাহাদিগকে মারিব।’

বজ্রদংষ্ট্র বলিল, ‘আমি একটা বুদ্ধি করিয়াছি। জোয়ান জোয়ান রাক্ষসেরা ভরতের সৈন্য সাজিয়া উহাদের কাছে যাইবে। উহারা কিছুতে বুঝিতে পরিবে না। আর ইহার মধ্যে আমাদের লোকেরা এক সময় তাহাদিগকে বাগে পাইয়া মারিয়া শেষ করিবে।’

রাক্ষসেরা সকলেই এইরূপ বলিতেছে, তাহা দেখিয়া বিভীষণ বলিল, ‘মহারাজ, যাহার জোর নাই, সে কি সাহস করিয়া লঙ্কায় যুদ্ধ করিতে আসে? রামের সীতা রামকে ফিরাইয়া দিন, নহিলে বড়ই বিপদ হইবে। আপনি রামের এত অনিষ্ট করিয়াছেন, তাহতেই ত রাম যুদ্ধ করিতে আসিলেন। এ কাজ আপনার উচিত হয় নাই।’

S88 উপেন্দ্রকিশোব রচনাসমগ্র তখনই বানবেকা গাছ পাথব আনিয়া সমুদ্রেব ধাবে ফেলিতে লাগিল বিভীষণের কথা শুনিয়া বাবণ রাগের ভরে সভা হইতে চলিযা গেল। পরদিন আবার মস্ত সভা। সেদিনও খোসামুদে রাক্ষসেবা বলিল, মহাবাজ, কোন ভয নাই, যুদ্ধ করুন। আর কেবল বিভীষণ বলিল, শীঘ্র সীতাকে ফিরাইয়া দিন। সেজন্য রাবণ রাগের ভরে তাহাকে যত ইচ্ছা গালি দিয়া শেষে বলিল, ‘হতভাগা, আর কেহ যদি এই কথা বলিত, তাহা হইলে এখনই তাহাকে কাটিয়া ফেলিতাম!’ তখন বিভীষণ বলিল, মহারাজ, আপনি আমার গুরুজন। আপনাকে বুঝাইতে পারি, আমার এমন সাধ্য কি? আমার অন্যায় হইয়া থাকিলে ক্ষমা করিবেন। ভাল কথা বলিতে গেলাম, তাহাতে আপনার এত রাগ হইল। এখন আপনার যাহা ইচ্ছ, তাহাই করুন;আমি চলিলাম। এই বলিয়া বিভীষণ আর চারিজন রাক্ষস সঙ্গে লইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।

 রাবণের সভা ছাড়িয়া বিভীষণ আর সেই চারিজন রাক্ষস সমুদ্র পার হইয়া রামের নিকটে চলিয়া আসিল। সেখানে সুগ্রীব আর অন্য অন্য বানরদিগকে দেখিয়া বিভীষণ বলিল, “আমি রাবণের ভাই, আমার নাম বিভীষণ। আমি সীতাকে ফিরাইয়া দিবার কথা বলাতে, রাবণ আমাকে গালি দিয়াছেন। তাই আমি রামের কাছে থাকিবার জন্য এখানে আসিয়াছি।’

 এই কথা শুনিয়া সুগ্রীব তাড়াতাড়ি রামের কাছে গিয়া সংবাদ দিল। বিভীষণকে সে বিশ্বাস করিতে পারে নাই। হনুমান ছাড়া বানরদিগের অন্য কেহ তাহাকে বিশ্বাস করে নাই। তাই তাহারা সকলে বিভীষণকে জায়গা দিতে রামকে বারবার নিষেধ করিল। খালি হনুমান বলিল, “উহার মুখ দেখিয়া ত উহাকে দুষ্ট লোক বলিয়া আমার বোধহয় না। ও যথার্থই আমাদের সহিত বন্ধুতা করিতে আসিয়াছে। উহাকে জায়গা দেওয়া উচিত।’

 সকলের কথা শুনিয়া রাম বলিলেন, “যে আশ্রয় চায় তাহাকে আশ্রয় দেওয়া উচিত। সে যদি দুষ্টও হয়, তথাপি তাহাব এমন ক্ষমতা নাই যে আমার অনিষ্ট করে। তোমরা শীঘ্র তাহাকে ডাকিয়া আন।’

 তখন বিভীষণ আসিয়া রামকে প্রণাম করিয়া বলিল, রাবণ আমায় অপমান করিয়াছেন, তাই আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। এখন আপনাব ইচ্ছা হয় আমাকে রাখুন, না হয় মারিয়া ফেলুন।’

 রাম মিষ্ট কথায় তাহাব ভয় দূর করিয়া বলিলেন, ‘বিভীষণ, আমি রাবণকে মারিয়া, তোমাকে রাজা করিব।’ বিভীষণও বলিল, “আমি প্রাণ দিয়া আপনার সাহায্য করিব।’

 তখন রাম লক্ষ্মণকে বলিলেন, ‘চল, আমরা এখানেই বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করি।” রাজা হইবার সময় মান করিতে হয়, সেই স্নানকে অভিষেক বলে। রামের কথায় লক্ষ্মণ তখনই সমুদ্রের জলে বিভীষণকে অভিষেক করিয়া তাহাকে লঙ্কার রাজা করিলেন।

 তারপর সুগ্রীব আর হনুমান বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করিল, মহাশয়, সমুদ্র পার হইব কি করিয়া? বিভীষণ বলিল, বাম যদি সমুদ্রেব পূজা করেন, তবে অবশ্য সমুদ্র পার হওয়া যাইবে।’

 এ কথা শুনিয়া বানরেরা তখনই পূজার জোগাড় করিয়া, সমুদ্রের ধারে কুশাসন বিছাইয়া দিল। রাম তাহাতে বসিয়া সমুদ্রের পূজা আরম্ভ করিলেন। পূজা শেষ হইলে সমুদ্রকে প্রণাম করিয়া, তিনি সেই কুশাসনের উপর শুইয়া রহিলেন। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন, চারি দিন রাম সেইখানে পড়িয়া আছেন, তবুও সমুদ্র তাহাব সংবাদ লয় না। তাহ দেখিয়া রাম বলিলেন, এত করিয়া পূজা করিলাম, আর তুমি গ্রাহাই করিলে না! তোমার এতই অহঙ্কার! আচ্ছ দাড়াও, তোমাকে শুষিয়া ফেলিতে কতক্ষণ লাগে!'

 এই বলিয়া রাম ধনুক লইয়া তাহাতে ব্রহ্মাস্ত্র জুলেন। সে অস্ত্রের তেজে চন্দ্র সূর্য অবধি কাঁপিতে লাগিল আর সাগরও প্রাণের ভয়ে আমনি হাত যোড় করিয়া উপস্থিত হইল। তারপর সে রামের নিকট অনেক মিনতি করিয়া বলিল, “এই নল বিশ্বকর্মর পুত্র। নল আমার উপর সেতু বাধিয়া দিলেই সকলে পার হইতে পারবে। সেতু যাহাতে না ভাঙে, সেজন্য আমি এখন হইতে খুব স্থির হইয়া থাকিব।’

 তখনই বানরেরা গাছ আর পাথর আনিয়া সমুদ্রের ধারে ফেলিতে লাগিল। নল কি আশ্চর্য 

কারিকর। সেই গাছ পাথর দিয়া একশত যোজন লম্বা সুন্দর সেতু প্রস্তুত করিতে ছয় দিনের বেশি লাগিল না। সেই সেতুর উপর দিয়া সকলে পার হইয়া লঙ্কায় আসিল।

 রাম লঙ্কায় আসিয়াছেন শুনিয়া রাবণ শুক আর সারণ নামক তাহার দুইজন মন্ত্রীকে চুপি চুপি তাহার সৈন্য দেখিবার জন্য পাঠাইয়া দিল। শুক সারণ বানর সাজিয়া গিয়াছিল, কিন্তু তাহাদের সে ফাকিতে বিভীষণ ভুলিল না। সে তখনই তাহাদিগকে ধরিয়া রামের কাছে লইয়া গেল।

 শুক, সারণ ত ঠিক করিয়া রাখিয়াছে যে এ-যাত্রা আর তাহদের রক্ষা নাই; কেন না, শত্রুর লোক ঐরুপ চুরি করিয়া খবর লইতে আসিলে, তাহাকে মারিয়া ফেলাই দস্তুর। তাহারা রামের পায়ে পড়িয়া বলিল, “আমরা রাবণের হুকুমে আপনার সৈন্য গণিতে আসিয়াছিলাম।’

 তাহা শুনিয়া রাম হাসিয়া বলিলেন, “তোমাদের কিছু ভয় নাই। যদি সৈন্য দেখা হইয়া থাকে, তবে নিশ্চিন্তে ঘরে চলিয়া যাও। আর যদি দেখা না হইয়া থাকে, তবে ভাল করিয়া দেখিয়া যাও।’

 এ কথা শুনিয়া শুক, সারণ রামকে কত আশীর্বাদই করিল! তারপর তাহারা গিয়া রাবণকে বলিল, মহারাজ, যুদ্ধ করিয়া কাজ নাই। ইহারা বড় ভয়ানক বীর! সীতাকে ফিরাইয়া দিন।’ রাবণ বলিল, “তোমরা যে ভারি ভয় পাইয়াছ বল দেখি, এই পৃথিবীতে এমন কে আছে যে আমাকে যুদ্ধ করিয়া হারাইতে পারে? এই বলিয়া সে ছাদে উঠিয়া দেখিতে গেল, রামের সৈন্য কিরূপ।

 সাদা সাদা মেঘ আসিয়া যেমন করিয়া আকাশ ঢাকে, তেমনি করিয়া বানরেতে লঙ্কার চারিদিক ছাইয়া গিয়াছে। এই-সকল সৈন্য দেখিয়া সারণ রাবণকে কহিল, মহারাজ, ঐ দেখুন নীল, বীর দশ হাজার যোদ্ধা সঙ্গে লইয়া ফিরিতেছে। ঐ দেখুন বালীর পুত্র অঙ্গদ, উহার সঙ্গে অনেক কোটি সৈন্য। ঐ নল, যে সেতু বধিয়াছে। ঐ শ্বেত, ঐ কুমুদ, ঐ চণ্ড, ঐ সংরম্ভ, ঐ শরভ, ঐ পনস, ঐ বিনত, ঐ ক্রর্থন, ঐ গবয়, ঐ হয়। ঐ জাম্ববান, দেখুন তাহার সহিত কত ভালুক আসিয়াছে, ঐ রম্ভ, ঐ সন্নাদন, ঐ প্রমার্থী, ঐ গবাক্ষ, ঐ কেশরী, ঐ শতাবলী!

 মহারাজ, ঐ যে শাল গাছের মতন বড় বড় বানর দাড়াইয়া আছে, উহারা সুগ্রীবের লোক। উহাদের বাড়ি কিষ্কিন্ধ্যায়; উহারা সকলেই বড় বড় বীর। উহাদের মধ্যে ঐ দুইজনার নাম মৈন্দ আর দ্বিবিদ। আর হনুমানকে বোধহয় চিনিতে পারিয়াছেন;ঐ যে বসিয়া আছে। হনুমানের কাছে যিনি বসিয়া আছেন, তিনি রাম। তাঁহার কথা আর কি বলিব। যেমন দেখিতে সুন্দর, তেমনি দয়ালু, তেমনি বিদ্বান, তেমনি ধার্মিক, আর তেমনি বীর। উহার পাশে ঐ লক্ষ্মণ বসিয়া, সোনার মত রঙ, কোকড়ান কালো চুল, চওড়া বুক। দেখিতে যেমন, গুণেও তেমনি। উহার মতন বীর কোথাও নাই। লক্ষ্মণের পাশে ঐ দেখুন বিভীষণ বসিয়া আছেন। শুনিয়াছি রাম নাকি তাহাকে লঙ্কার রাজা করিয়াছেন। ঐ সুগ্রীব, যাহার গলায় সোনার হার আর শরীর পাহাড়ের মতন বড়।

 ‘মহারাজ, এক শত লক্ষে এক কোটি হয়। লক্ষ কোটিতে এক শঙ্কু, লক্ষ শঙ্কুতে এক মহাশঙ্কু, লক্ষ মহাশঙ্কুতে এক বৃন্দ, লক্ষ বৃন্দে এক মহাবৃন্দ, লক্ষ মহাবৃন্দে এক পদ্ম, লক্ষ পদ্মে এক মহাপদ্ম, লক্ষ মহাপদ্মে এক খর্ব, লক্ষ খর্বে এক সমুদ্র, লক্ষ সমুদ্রে এক মইোঘ। রামের সঙ্গে এইরূপ হিসাবে (১০০০০০, ১০০০০, ১০০০, ১০০০০০, ১০০০, ১০০০০০,

১০০০, ১০০০০০, ১০০০, ১০০০০০০০০০০) একহাজার কোটি, একশত শঙ্কু, একহাজার মহাশন্ধু, একশত বৃন্দ, একহাজার মহাবৃন্দ, একশত পদ্ম, একহাজার মহাপদ্ম, একশত খর্ব একশত সমুদ্র আর একহাজার মহীেঘ সৈন্য আসিয়াছে।’

 এ-সকল দেখিয়া শুনিয়া রাবণের মনে খুবই ভয় হইল;কিন্তু সে তাহা শুক, সারণকে জানিতে দিল না। বাহিরে সে যার-পর নাই রাগ দেখাইয়া, শুক, সারণকে বকিয়া সেখান হইতে তাড়াইয়া দিল।

 এরপর একদিন কি হইল শুন। লঙ্কায় বিদ্যুজ্জিতু নামে এক জাদুকর রাক্ষস ছিল। রাবণ তাহাকে দিয়া ঠিক রামের মাথার মতন একটা মাথা আর তাহার ধনুর্বাণের মতন ধনুর্বাণ প্রস্তুত করাইল। তারপর অশোক বনে গিয়া সেই মাথা আর ধনুক সীতাকে দেখাইয়া বলিল, “এই দেখ, তোমার রামকে আমরা মারিয়া ফেলিয়াছি। রাত্রিতে যখন তাহারা ঘুমাইতেছিল তখন আমার সৈন্যেরা গিয়া তাহার মাথা কাটিয়াছে, আর বিভীষণকে ধরিয়া আনিয়াছে। লক্ষ্মণ পলাইয়াছে সুগ্রীবের ঘাড় ভাঙিয়াছে, হনুমান জাম্ববান প্রভৃতি আর সকলে মরিয়া গিয়াছে। এখন আর রামের কথা ভাবিয়া কি করিবে?’

 রাবণের কথা শুনিয়া আর সেই মাথা দেখিয়া সীতা ভয়ানক কাদিতে লাগিলেন। এমন সময় একটা দাবোযান আসিয়া রাবণকে ডাকিয়া লইয়া গেল। রাবণ যাইতে না যাইতেই সেই জাদুর তৈয়ারি মুণ্ড আর ধনুক কোথায় যে মিলাইল, কিছু বুঝা গেল না।

 বিভীষণের স্ত্রী সরমাকে রাবণ সর্বদা সীতার কাছে থাকিতে বলিয়াছিল। সরমা সীতাকে অত্যন্ত ভালবাসিত, আর সর্বদা তাঁহার কাছে কাছে থাকিত। রাবণ চলিয়া গেলে পরেও সীতা মাটিতে লুটাইয়া কাদিতেছেন দেখিয়া সরমা বলিল, সীতা, তুমি কাদিতেছ কেন? রাবণের কথা সকলই মিথ্যা। যুদ্ধও হয় নাই, রামেরও কিছু হয় নাই। আমি নিজে তাহাকে দেখিয়া আসিমাছি। রাক্ষসেরা বড়ই ভয় পাইয়াছে। রাম নিশ্চয় তাহাদিগকে মারিয়া তোমাকে লইয়া যাইবেন।’ সরমা আর সীতা এইরূপ কথাবার্তা বলিতেছেন, এমন সময় বানরদিগের গর্জন শুনা যাইতে লাগিল। সেই গর্জন শুনিয়া রাক্ষসেরা মনে করিল, বুঝি সর্বনাশ উপস্থিত।

 রামের সৈন্য যেখানে ছিল, তাহার কাছেই সুবেল পর্বত। সেই পর্বতের উপর উঠিয়া বানরেরা যুদ্ধের আগের রাত্রি কাটাইল। সুবেল পর্বতের উপর হইতে লঙ্কার সকলই দেখিতে পাওয়া যায়। তাই পরদিন সকালে উঠিয়া সকলে সেখান হইতে লঙ্কার শোভা দেখিতে লাগিল। সেই লঙ্কার উত্তর দরজার কাছে রাবণ নিজে দাড়াইয়া। তাহার দুই পাশে চামর দুলিতেছে মাথার উপরে সাদা ছাতা, গলায় গজমতির মালা।

 রাবণকে দেখিয়া সুগ্রীবেব আর সহ্য হইল না। সে তখনই এক লাফে সেই পর্বতের উপর হইতে একেবারে লঙ্কার দরজার উপরে গিয়া পড়িল। আর-এক লাফে একেবারে রাবণের ঘাড়ে। ঘাড়ে পড়িয়াই হাসিতে হাসিতে তাহার মুকুটটি কড়িয়া লইয়া মাটিতে এক আছাড়! তারপর দুইজনে মল্লযুদ্ধ। রাবণ সুগ্রীবকে ধরিয়া মাটিতে আছড়াইল, সুগ্রীবও রাবণকে আছড়াইল। কিল, চড়, লাথি দুইজনে দুইজনকে যে কত মারিল তাহার লেখাজোখা নাই। এইরূপে রাবণকে অপমান আর নাকাল করিয়া, সুগ্রীব এক লাফে আবার সুবেল পর্বতে চলিয়া আসিল। লজ্জয় তখন রাবণের মুখে আর কথাটি নাই!

 তারপর রামের সৈন্য পর্বত হইতে নামিয়া লঙ্কার দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইল। লঙ্কার কোন দরজা দিয়াই তাহারা রাক্ষসদিগের বাহির হইবার পথ রাখিল না। উত্তর দরজায় রাবণ ছিল, রাম লক্ষ্মণ নিজে গিয়া সেই দরজা আটকাইলেন। মৈন্দ, দ্বিবিদ আর নীল পূর্ব দরজা আটকাইল। ঋষভ, গবাক্ষ, গয় আর গবয়কে লইয়া দক্ষিণ দরজায় রহিল। পশ্চিম দরজায় গাছপাথর লইয়া নিজে হনুমান। উত্তর দরজা আর পশ্চিম দরজার মাঝখানে সুগ্রীব। এইরূপে সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। এখন রাবণ বাইরে আসিলেই হয়।

 তখন রাম অঙ্গদকে রাবণের সভায় পাঠাইয়া দিলেন। রাবণ পাত্রমিত্র লইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় অঙ্গদ সেখানে গিয়া উপস্থিত। সেখানে গিয়া সে রাবণকে বলিল, “আমি শ্রীরামের দূত, আমার নাম অঙ্গদ। আমার পিতার নাম বালী;তাহার কথা বোধহয় তোমার এখনও মনে আছে। রাম বলিলেন তুমি শীঘ্র বাহিরে আসিয়া যুদ্ধ কর। তিনি তোমাকে বধ করিয়া বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করিবেন।

 এখানে একটা হাসির কথা বলি। অঙ্গদ যে রাবণকে তাহার পিতার নাম বলিয়া তাহার কথা বোধহয় তোমার এখনও মনে আছে বলিল, তাহার কারণ কি জান? রাবণ একবার বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গিয়া বড়ই নাকাল হইয়াছিল। রাবণ সকলকে যুদ্ধে হারাইয়া ত্রিভুবন ঘুরিয়া বেড়াইত আর কেহ তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সাহস করিত না। যুদ্ধ করিবার আর লোক না পাইয়া শেষে সে একদিন বালীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গেল। বালী তখন সমুদ্রের ধারে চোখ বুজিয়া সন্ধ্যা করিতেছিল। রাবণ মনে করিল, এই বেলা উহাকে জড়াইয়া ধরিয়া জব্দ করি:চোখ বুজিয়া আছে, দেখিতে পাইবে না। এই বলিয়া ত সে পিছন দিক হইতে গিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল;কিন্তু প্রাণপণে টানাটানি করিয়াও তাহাকে নাড়িতে পারিল না। ততক্ষণে বালী সন্ধ্যা সারিয়া, রাবণ মহাশয়কে পাখিটির মত খপ করিয়া বগলে পুরিয়া বসিয়াছে। বালী পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এই চারি সমুদ্রের ধারে বসিয়া চারিবার সন্ধ্যা করিত। সবে তখন তাহার একবার সন্ধ্যা শেষ হইয়াছিল;সুতরাং সে রাবণকে বগলে করিয়াই আরও তিনবার সন্ধ্যা করিল। এদিকে সেই বগলের চাপে, গরমে ঘামে আর গন্ধে বেচারা চ্যাপ্টা হইয়া, সিদ্ধ হইয়া, দম আটকাইয়া, পেট ঢাক হইয়া নাকালের একশেষ। মরে নাই কেবল ব্রহ্মার বরে। তাই অঙ্গদ এখন বলিল, “বোধহয় মনে আছে।’

 তাহা শুনিয়া রাবণ বলিল, ‘এই মুর্খ এখনই টুকরা টুকরা করিয়া কাট্ ত রে!” এই কথা বলিতে বলিতেই চারিটা রাক্ষস আসিয়া অঙ্গদকে ধরিয়া ফেলিল। অঙ্গদও সেই চারিটা রাক্ষসকে বগলে লইয়া এক লাফে একেবারে ছাদের উপরে। সেখান হইতে রাক্ষসগুলিকে আছড়াইয়া ফেলিয়া আর ছাদখানকে গুড়া করিয়া,আর-এক লাফে সে রামের কাছে আসিয়া হাজির। ইহার পর দুই দলে ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কত রাক্ষস আর কত বানর যে মরিতে লাগিল, তাহার সীমা-সংখ্যা নাই। চারিদিকে মার মার, কাট কাট, ধুপ ধাপ, বড় ঘড়, ঝন ঝন, ঠকাঠক, চটপট ভিন্ন আর কিছুই শোনা যায় না। সমস্ত দিন যুদ্ধ চলিল, রাত্রিতেও তাহার শেষ নাই। যুদ্ধের স্থানে মরা রাক্ষস আর বানরের পাহাড় হইয়া গেল, রক্তের নদী বহিয়া চলিল, তবুও যুদ্ধের বিরাম নাই।

 এক স্থানে পাঁচটা সেনাপতি অসংখ্য রাক্ষস লইয়া বড়ই গর্জন করিতে করিতে রামের

সহিত যুদ্ধ জুড়িয়াছে। আবার দেখিতে দেখিতে রামের বাণ খাইয়া পাঁচজনেই পালাইবার পথ পাইতেছে না।

 আর এক স্থানে অঙ্গদ আর ইন্দ্রজিতে যুদ্ধ। অঙ্গদ লাথি মারিয়া, ইন্দ্রজিতের সারথি আর ঘোড়া চ্যাপ্টা করিয়া দিয়াছে। ইন্দ্রজিৎ দেখিল, সামনে থাকিয়া যুদ্ধ করিলে বড়ই বিপদ। কাজেই তখন সে মেঘের আড়ালে লুকাইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিল। এইরূপ যুদ্ধ করিবার বর সে শিবের নিকট পায়। যখন সে মেঘের আড়ালে লুকাইয়া যুদ্ধ করিত, তখন কেহই তাহাকে দেখিতে পাইত না। কাজেই তখন তাহাকে কেহই মারিতে পারিত না; কিন্তু সে নিজে অন্য সকলকে বাণ মারিয়া অস্থির করিত।

 মেঘের আড়ালে থাকিয়া দুষ্ট ইন্দ্রজিৎ রাম লক্ষ্মণের গায়ে নাগপাশ বান মারিল। সে বাণ ছুড়িবামাত্রই বড় বড় সাপ আসিয়া তাহাদিগকে জড়াইয়া ফেলল। ইন্দ্রজিৎকে দেখিতে না পাওয়ায় তাহারা তাহা আটকাইতে পারিলেন না।

 এইরূপে সে রাম লক্ষ্মণকে সাপের বাঁধনে বাধিয়া তাহাদের উপর এমনি নিষ্ঠুর বাণ মারিতে লাগিল যে তাহাদের শরীরে একটুও স্থান রহিল না যেখানে বাণ বিধে নাই। সেই ভয়ানক বাণের যন্ত্রণায় তাহারা অজ্ঞান হইয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া ইন্দ্রজিৎ হাসিতে হাসিতে গিয়া রাবণকে বলিল, “বাবা, রাম লক্ষ্মণকে মারিয়া আসিয়াছি।’

 এদিকে সুগ্রীব, বিভীষণ, অঙ্গদ, হনুমান জাম্ববান প্রভৃতি সকলে রাম লক্ষ্মণকে ঘিরিয়া কাদিতে লাগিল। বানরদিগের মধ্যে সুষেণ ভাল ঔষধ জানিত। সে বলিল, ক্ষীরোদ সাগরের তীরে বিশল্যকরণী আর সঞ্জীবনী নামক ঔষধ আছে চন্দ্র আর দ্রোণ নামক পর্বতের উপরে সেই ঔষধ পাওয়া যায়। শীঘ্র তাহা হইয়া আইস।’

 এমন সময় ভয়ানক ঝড় উঠিয়া গাছপালা ভাঙিতে লাগিল, অজগরেরা তাড়াতাড়ি গর্তের ভিতরে লুকাইতে চলিল, সমুদ্রের জন্তু আর আকাশের পক্ষীসকল ভয়ে অস্থির হইয়া উঠিল। গোলমাল শুনিয়া সকলে চাহিয়া দেখিল, গরুড় আসিতেছে;তাহারই পাখার বাতাসে এরূপ কাণ্ড উপস্থিত। গরুড়কে দেখিয়াই ইন্দ্রজিতের সাপের ভবিল, সর্বনাশ! আমাদের যম আসিয়াছে!’ তখন তাহারা রাম লক্ষ্মণকে ছাড়িযা প্রাণ লইয়া পলাইতে পারিলে বাঁচে। গরুড়কে সাপেরা বড়ই ভয় করে, কারণ সে সাপ দেখিলেই ধরিয়া খায়।

 গরুড় রাম লক্ষ্মণের গায়ে হাত বুলাইয়া দিবামাত্রই, তাহাদের শরীরের সকল জ্বালা চলিয়া গেল, এমন-কি, বাণের দাগ পর্যন্ত রহিল না। তখন দুই ভাই আবার সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিলেন। তাঁহাদের বোধ হইতে লাগিল, যেন তাহাদের জোর আর সাহস দ্বিগুণ বাড়িয়া গিয়াছে।

 গরুড়কে দেখিয়া রাম বলিলেন, ‘পাখি, তুমি কে? বড়ই ভয়ানক বিপদ হইতে তুমি আমাদিগকে বাঁচাইলে!’ গরুড় বলিল, “আমার নাম গরুড়, ইন্দ্রজিৎ তোমাদিগকে বাধিয়াছে শুনিয়া তাড়াতাড়ি এখানে আসিয়াছি। তোমাদিগকে আমি বড়ই ভালবাসি। এখন যাই, এই যুদ্ধে তোমরা নিশ্চয় জিতিবে। এই কথা বলিয়া গরুড় চলিয়া গেল। রাম লক্ষ্মণকে সুস্থ দেখিয়া, বানরদিগের আনন্দের আর সীমা রহিল না। সে আনন্দে তাহারা কোলাহল করিয়া লঙ্কা কাঁপাইয়া তুলিল।

 বানরের কোলাহল শুনিয়া রাবণ বলিল, রাম লক্ষ্মণ ত মরিয়া গিয়াছে, তবে আবার

বানরদিগের কিসের কোলাহল? দেখ ত বিষয়টা কি রাক্ষসেরা দেখিয়া আসিয়া বলিল, মহারাজ ইন্দ্রজিৎ যাহা করিয়াছিলেন সব মাটি রাম লক্ষ্মণ নাগপাশের বাধন ছাড়াইয়া আবার উঠিয়া বসিয়াছে!” রাবণ তাহা শুনিয়া বলিল, বল কি? তবে ত সর্বনাশ!” এই বলিয়া সে রাম লক্ষ্মণকে মারিবার জন্য তাড়াতাড়ি ধূম্রাক্ষকে পাঠাইয়া দিল।

 গাধার মুখ সিংহের আর বাঘের মতন হইলে সে জানোয়ার দেখিতে কেমনটি বিকট হয়? সেইরূপ গাধায় ধূম্রাক্ষের রথ টানিত। সেই রথে চড়িয়া ধূম্রাক্ষ যুদ্ধ করিতে চলিল। সঙ্গে বর্ম-আঁটা সিপাহী সৈন্য, হাতি ঘোড়া মুষল, মুদগর, পরিঘ, পট্টিশ, ভিন্দিপালের আর শেষ নাই। রাক্ষসদের যেমন গর্জন তেমনি রাগ! যেন এক-একটা ভীত আর কি! পশ্চিম দরজায় হনুমানের পাহারা,রাক্ষসেরা দাঁত কড়মড় করিতে করিতে মার মার শব্দে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

 প্রথমে হনুমানের দলের ছোট ছোট বানরদিগের সহিত রাক্ষসদিগের যুদ্ধ আরম্ভ হইল। রাক্ষসদিগের অস্ত্র ধনুক ভাণ, শেল, শূল, মুষল, মুদগর প্রভৃতি:বানরদিগের অস্ত্র গাছ আর পাথর। যুদ্ধের সময় বানর আগে নিজের নামটি বলে, তারপর ‘জয়রাম’ শব্দে গাছ পাথর উঠাইয়া ধাই করিয়া রাক্ষসের মাথা ফাটায়। কেহ বা কিল চড় মারিয়া তাহাদের ছাতি ভাঙিয়া দেয়, নখে আঁচড়াইয়া নাক, কান ছিড়িয়া আনে! এইরূপে মার খাইয়া রাক্ষসেরা কিছুতেই বানরদিগের সামনে টিকিতে পারিল না।

 তাহা দেখিয়া ধূম্রাক্ষ এমনি তেজের সহিত বানরদিগকে তাড়া করিল যে তাহারা পলাইবার পথ পায় না। যাহা হউক, হনুমানের সামনে এত বাহাদুর আর কতক্ষণ থাকে? হনুমান তাহাকে এমনি এক পর্বতের চুড়া ছুড়িয়া মারিল যে তাহাতে তাহার রথখানি একেবারে চুরমার হইয়া গেল। ইহার আগেই সে গদা হাতে করিয়া রথ হইতে লাফাইয়া পড়িয়াছিল, তাই রক্ষানহিলে তাহাকেও রথের সঙ্গে যাইতে হইত। ততক্ষণে হনুমান গাছ দিয়া অন্যান্য রাক্ষসগুলিকে শেষ করিয়া দিয়াছে কেবল গদা হাতে ধূম্রাক্ষই বাকি। সেটা বড়ই ভয়ঙ্কর গদা; তাহার গায়ে বড় বড় কাটা। কিন্তু ভয়ঙ্কর হইলেও, তাহা দিয়া সে হনুমানের কিছু করিতে পারিল না। বরং হনুমানই পর্বতের চুড়া দিয়া তাহার মাথা গুঁড়া করিয়া দিল।

 ধূম্রাক্ষের পরে যে যুদ্ধ করিতে আসিল, তাহার নাম বজ্রদংষ্ট্র। বজ্রদংষ্ট্র অনেক যুদ্ধ করিয়া, শেষে অঙ্গদের হাতে মারা গেল।

 বড় বড় রাক্ষসেরা যুদ্ধ করিতে আসে আর বানরেরা তাহাদিগকে মারিয়া শেষ করে। এইরূপে অকম্পন যুদ্ধে আসিয়া হনুমানের হাতে, নরান্তক দ্বিবিদের হাতে, কুম্ভহনু জাম্ববানের হাতে আর প্রহস্ত নীলের হাতে প্রাণ দিল। রাক্ষস মারিয়া বানরদিগের আনন্দের সীমা নাই; আর যুদ্ধে যাহারা জয়লাভ করিল, তাহদের প্রশংসার শেষ নাই।

 এদিকে লঙ্কায় আবার যুদ্ধের বাজনা বাজিয়া উঠিল আর দেখিতে দেখিতে আবার অসংখ্য রাক্ষস যুদ্ধ করিবার জন্য বাহির হইয়া আসিল। এত রাক্ষস দেখিয়া রাম বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘রাজা বিভীষণ, এত সৈন্য অত অস্ত্র লইয়া কে আসিল?’

 বিভীষণ বলিল, “ঐ যাহার রথের নিশানে সিংহের চেহারা দেখিতেছেন, সে ইন্দ্রজিৎ। আর ঐ যাহার খুব লম্বা চওড়া শরীর, তাহার নাম অতিকায়; সেও রাবণের পুত্র। ঐ যে হাতির গলায় ঘণ্টার শব্দ হইতেছে, তাহার উপরে মহোদর। ঐ যে লাল রঙের যোদ্ধা

ঘোড়ায় চড়িয়া আছে, তাহার নাম পিশাচ। শুল হাতে যাঁড়ের উপর চড়িয়া যে আসিতেছে, উহার নাম ত্রিশিরা। যাহার নিশানে সাপের ছবি, সে কুম্ভ। আর যাহার হাতে পরিঘ রহিয়াছে, সে নিকুম্ভ। ঐ যাহার মাথায় মুকুট আর উপরে সাদা ছাতা, তিনি নিজে রাবণ।”

 রাম বলিলেন, রাবণ আসিয়াছে? ভালই হইয়াছে আজ সীতাকে চুরি করিয়া আনিবার শাস্তিটা উহাকে দিতে হইবে।”

 রাবণকে দেখিয়া সুগ্রীব একটা পর্বতের চুড়া ছুড়িয়া মারিল। রাবণ সেই পর্বত কাটিয়া সুগ্রীবকে এমনই এক বাণ মারিল যে তাহাতে সে চিৎকার করিয়া একেবারে অজ্ঞান হইয়া গেল। তাহা দেখিয়া জ্যোতিমুখ, গবাক্ষ, গবয়, সুষেণ, ঋষভ আর নল ছুটয়া যুদ্ধ করিতে আসিল। কিন্তু তাহাদের সাধ্য কি যে রাবণের বাণের সম্মুখে টিকিয়া থাকে। বাণের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া বানরেরা একেবারে রামের কাছে গিয়া উপস্থিত। তখন রাম নিজেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন, এমন সময়ে লক্ষ্মণ বলিলেন, দাদা, আমি রাবণের সহিত যুদ্ধ করিব।”

 এদিকে হনুমান ছুটিয়া গিয়া রাবণকে বলিল, আজ এই এক কিলে তোর প্রাণ বাহির করিয়া দিব!’

 রাবণ বলিল, ‘মার দেখি তোর কত জোর! এই বলিয়া সে আগেই হনুমানের বুকে এক চড় মারিল। হনুমানের খুব লাগিল বটে, কিন্তু সে সামলাইয়া উঠিয়া রাবণের বুকে এক চড় মারিয়া তাহাকে একেবারে অস্থির করিয়া দিল। আবার রাবণ একটু সুস্থ হইয়া হনুমানের বুকে এমন এক কিল মারিল যে হনুমান সহজে তাহার চোট সামলাইয়া উঠিতে পারিল না।

 ততক্ষণে রাবণ হনুমানকে ছাড়িয়া নীলের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে। রাবণ বাণ মারে আর নীল গাছ পাথর মারে। ইহার মধ্যে নীল হঠাৎ খুব ছোট্টটি হইয়া কখন গিয়া রাবণের রথের নিশানে উঠিয়াছে। সেখান হইতে রাবণের মুকুটে, সেখান হইতে তাহার ধনুকের আগায়। এমনি করিয়া সে তাহাকে কি যে ব্যস্ত করিয়া তুলিল, তাহ বলিবার নহে। তাহা দেখিয়া বানরেরা যত হাসে, রাবণের রাগ ততই বাড়িয়া যায়। শেষে সে অগ্নিবাণে নীলকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিয়া, লক্ষ্মণের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল।

 লক্ষ্মণ আর রাবণের অনেকক্ষণ খুব যুদ্ধ হইল। রাবণ বাণ মারে, লক্ষ্মণ তাহা কাটেন। আবার লক্ষ্মণ বান মারেন, রাবণ তাহা কাটে। একবার ব্রহ্মার দেওয়া একটা বাণ মারিয়া রাবণ লক্ষ্মণকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিল। কিন্তু লক্ষ্মণ তখনই আবার সুস্থ হইয়া রাবণের ধনুক কাটিয়া, তারপর তিন বাণে তাহাকে অজ্ঞান করিয়া তবে ছড়িলেন।

 তারপর রাবণের আবার জ্ঞান হইলে সে একটা শক্তি হাতে লইল। এই শক্তিও ব্রহ্মা তাহাকে দিয়াছিলেন। ইহা অতি ভয়ানক অস্ত্র! লক্ষ্মণ বাণ মারিয়া তাহা কাটিলেন, তবুও সেটা আসিয়া তাহার বুকে বিধিয়া তাঁহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলিল। তখন রাবণ তাড়াতাড়ি লক্ষ্মণকে লইয়া যাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু তাহার সাধ্য কি যে তাহাকে নাড়ে। ততক্ষণে হনুমান আসিয়া তাহার বুকে এমনি এক কিল মারিল যে তেমন কিল আর সে কখনও খায় নাই; কিলের চোটে রাবণ রক্ত বমি করিতে করিতে অজ্ঞান হইয়া গেল।

 এদিকে হনুমান লক্ষ্মণকে কোলে করিয়া রামের নিকট লইয়া আসিয়াছে। সেখানে তাঁহার বুক হইতে শক্তি খসিয়া পড়িবামাত্র তিনি সুস্থ শরীরে উঠিয়া বসিলেন। ততক্ষণে রাবণও



আবার উঠিয়া ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ করাতে, রাম নিজেই তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে চলিলেন। তাহা দেখিয়া হনুমান বলিল, 'আমার পিঠে চড়িয়া যুদ্ধ করুন।’

 হনুমানের উপর রাবণের আগে হইতেই বিষম রাগ। কাজেই এবার তাহাকে বাগে পাইয়া সে খুব করিয়া বাণ মারিতে ছড়িল না। কিন্তু খালি হনুমানকে বাণ মারিলে কি হইবে? রামকে আটকাইতে পারিলে তবে ত হয়! তাহার রথ ঘোড়া সারথি সকলই রাম কাটিয়া শেষ করিয়াছেন, এখন তাহার নিজের প্রাণটি লইয়া টানাটানি। ইহারই মধ্যে তাহার মুকুট গিয়াছে আর সে নিজে এতই কাতর হইয়া পড়িয়াছে যে তাহার আর ধনুক ধরিবারও ক্ষমতা নাই। তাহা দেখিয়া রাম বলিলেন, “তোমার বড়ই পরিশ্রম হইয়াছে দেখিতেছি। আচ্ছা, আজ তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম। ঘরে গিয়া বিশ্রাম কর, তারপর অন্য সময়ে দেখা যাইবে।” তখন রাবণ লজ্জায় মাথা হেট করিয়া লঙ্কার ভিতর চলিয়া গেল।

 এখন রাবণ করে কি? সিংহাসনে বসিয়া সে চিন্তা করিতেছে, চারিদিকে রাক্ষসেরা দাঁড়াইয়া। তাহদের দিকে চাহিয়া রাবণ বলিল, এত করিয়া শেষটা কিনা আমাকে মানুষের কাছে হারিতে হইল! পূর্বে যখন তপস্যা করিতে গেলাম, তখন ব্রহ্মা বর দিতে আসিলেন। আমি বলিলাম, “দেবতা অসুর যক্ষ রাক্ষস ইহাদের কেহই আমাকে মারিতে পরিবে না, এই বর আমাকে দিন।” ব্রহ্মা আমাকে সেই বরই দিলেন। মানুষের কথা তখন আমি ভাবি নাই, কাজেই বর লইবার সময় তাহার কথা বলি নাই। সেইজন্যই ত এই বিপদ! আমি কি জানি যে মানুষ এমন ভয়ানক হইতে পারে! তোমরা শীঘ্র গিয়া কুম্ভকর্ণকে জাগাও, সে যদি রাম লক্ষ্মণকে মারিতে পারে।'

 কুম্ভকর্ণ রাবণের ভাই। রাবণের তিন ভাই ছিল; রাবণ বড়, তারপর কুম্ভকর্ণ, তারপব বিভীষণ। ইহারা বিশ্রবা মুনির পুত্র;ইহাদের মাতার নাম কৈকসী। বিশ্রবার আর এক পুত্রের নাম কুবের। রাবণ আর কুম্ভকর্ণ জন্মিবার পূর্বেই বিশ্রবা কৈকসীকে বলিয়াছিলেন, ‘এদুটা ভয়ঙ্কর রাক্ষস হইবে।” কিন্তু বিভীষণের কথায় তিনি বলিয়াছিলেন, ‘এটি ধাৰ্মিক হইবে। আসলেও তাহারা তেমনি হইল। রাবণের আর কুম্ভকর্ণের জ্বালায় লোকে স্থির থাকিতে পারিত না। রাবণের চেয়ে কুম্ভকর্ণটা বেশি দুষ্ট ছিল। মুনিদিগকে পাইলেই সে দুষ্ট ধরিয়া খাইত।

 একদিন কৈকসী কুবেরকে দেখাইয়া রাবণকে বলিলেন, “দেখ দিখি ও কেমন ভাল;তুই বাছা এমনি হইলি কেন?” রাবণ বলিল, “দেখ না মা, আমি ওর চেয়ে বেশি হইব।’ এই বলিয়া সে কুম্ভকর্ণ আর বিভীষণকে লইয়া তপস্যা আরম্ভ করিল।

 সে কি যেমন তেমন তপস্যা। দশ হাজার বৎসর চলিয়া গেল, তবুও তাহদের তপস্যা ফুরইল না। দশ হাজার বৎসর তপস্যার পর ব্রহ্মা আসিয়া রাবণকে বলিলেন, রাবণ আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি বর লহ।'

 রাবণ বলিল, “এই বর দিন যে আমার মৃত্যু হইবে না।'

 ব্রহ্মা বলিলেন, “এই বর দিতে পারিব না, অন্য বর চাহ। '

 রাবণ বলিল, তবে এই বর দিন যে সৰ্প যক্ষ দৈত্য রাক্ষস আর দেবতা—ইহাদের কেহই আমাকে মারিতে পারবে না। ইহা ছাড়া মানুষ আর অন্য-অন্য যে-সকল জন্তু আছে তাহদের ভয় আমার নাই। ব্রক্ষা কহিলেন, “আচ্ছ, তাহাই হউক। আর ইহা ছাড়া এই বরও দিতেছি

যে, তোমার যখন যেরূপ ইচ্ছা হইবে, তুমি সেইরূপ চেহারা করিতে পরিবে।’

 তারপর ব্রহ্মা বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি বর চাহ? বিভীষণ বলিল, 'আমাকে দয়া করিয়া এই বর দিন যে আমার যেন সকল সময়েই ঈশ্বরেতে আর ধর্মেতে মতি থাকে।'

 তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা বলিলেন, আচ্ছ তাহাই হইবে। আর তাহাছাড়া তুমি অমর হইবে।” এই বলিয়া তিনি কুম্ভকর্ণকে বর দিতে চাহিলেন।

 এমন সময় দেবতারা তাহাকে নিষেধ করিয়া কহিলেন, ‘দোহাই ঠাকুর, এই হতভাগাকে বর দিবেন না! ইহার জ্বালায় আমরা অস্থির হইয়াছি! এই দুষ্ট ইহারই মধ্যে সাতটা অঙ্গরা, ইন্দ্রের দশ জন চাকর আর তাহা ছাড়া বিস্তর মুনি ঋষি খাইয়া ফেলিয়াছে। বর না পাইতেই এমন, বর পাইলে কি আর কাহাকেও রাখিবে?'

 এই কথা শুনিয়া ব্রহ্মা তাড়াতাড়ি সরস্বতীকে ডাকিয়া বলিলেন, মা তুমি শীঘ্র গিয়া উহার বুদ্ধি নাশ করিয়া দাও।” ব্রহ্মার কথায সরস্বতী তখনই কুম্ভকর্ণের মনের ভিতর গিয়া ঢুকিলেন আর তাহতেই তাহার মাথায় এমনি গোল লাগিয়া গেল যে সে আর বুঝিয়া সুঝিয়া ব্রহ্মার সহিত কথা কহিতে পালিল না।

 ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কুম্ভকর্ণ, কি বর চাহ? ‘

 কুম্ভকর্ণ বলিল, আমি দিনরাত খালি ঘুমাইতে চাহি।’

 ব্রহ্মা বলিলেন, “বেশ কথা, তাহাই হউক।’

 কুম্ভকর্ণের কথা অগস্তা মুনি এইরূপ বলিয়াছেন। কিন্তু তাহার কথা বিভীষণ যাহা বলিয়াছে, তাহা অন্যরূপ। বিভীষণ বলে যে কুম্ভকর্ণ অত্যন্ত দুষ্ট ছিল বলিয়া ব্রহ্মা নিজেই তাহাকে শাপ দিয়াছিলেন, ‘তুই ছয় মাস ঘুমাইবি আর একদিন জাগিয়া থাকিবি।’

 যাহা হউক, সে-অবধি কুম্ভকর্ণ কেবলই ঘুমায়। সেই কুম্ভকর্ণকে এখন রাক্ষসেরা জাগাইতে চলিল।

 একটা পর্বতের গুহার ভিতরে কুম্ভকর্ণের শুইবার ঘর। ঘরখানি অতি সুন্দর। তাহার মেঝে সোনার আর দেয়ালের কারিকুরি অতি আশ্চর্য। গুহাটি এক যোজন চওড়া আর তাহার দরজাও তেমনি বড়। বড় দরজা না হইলে কুম্ভকর্ণ ঘরে ঢুকিবে কি করিয়া? তাহার শরীর এতই বড় যে বিছানায় শুইয়া থাকিলেও তাহাকে একটা পর্বতের মতন দেখা যায়। তাহার নাকের নিশ্বাসে ঝড় বহে;সেই ঝড়ের চোটে রাক্ষসেরা ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িয়া যায়।

 প্রথমে অনেক শুয়োর, হরিণ, মহিষ প্রভৃতি জন্তু আর কলসী কলসী রক্ত আনিয়া কুম্ভকর্ণের কাছে পাহাড়ের মতন করিয়া রাখা হইল। ঘুম হইতে উঠিয়া তাহার বিষম ক্ষুধা হইবে। তখন আর কিছু না পাইলে যাহারা জাগাইতে আসিয়াছে, তাহাদিগকে ধরিয়াই হয়ত মুখে দিবে। কাজেই আহারের যোগাড়টি সকলের আগে আর বেশ ভালরকম হওয়া চাই।

 তারপর তাহার গায় চন্দন লেপিয়া আর ঘরে ধূপ জ্বালাইয়া রাক্ষসেরা নানারকম শব্দ করিতে লাগিল। বড়বড় শখ, যাহার একটার আওয়াজ শুনিলে প্রাণ চমকিয়া যায়, তাহার কয়েক শত আনিয়া তাহারা একসঙ্গে বাজাইল। আবার কয়েক শত রাক্ষস মিলিয়া প্রাণপণে চিৎকার করিল। না জানি তখন ব্যাপারখানা কিরকম হইয়াছিল। রাক্ষসের চিৎকার ত সহজ

চিৎকার নহে, তাহার কাছে শঙ্খ কোথায় লাগে! সেই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে আবার বাহু চাপড়াইবার ঘোরতর চটাপট শব্দ!

 এই সকল বিকট শব্দ তাহারা সকলে মিলিয়া একসঙ্গে করিয়াছিল। সে কি যেমন-তেমন কোলাহল! আকাশের পাখি তাহা শুনিলে মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যায়। এমনিতর শব্দ করিয়া তাহারা প্রাণপণে কুম্ভকর্ণের গায়ে নাড়া দিল। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম তাহাতে ভাঙিল না।

 তারপর দশ হাজার রাক্ষস মিলিয়া তাহাকে প্রাণপনে কিল, গদার বাড়ি আর পাথরের গুতা মারিয়াও তাহাকে জাগাইতে পারিল না। বরং তাহাতে তাহার আরাম বোধ হওয়ায় সে এমনই নাক ডাকাইতে লাগিল যে তাহার নিশ্বাসের সামনে টিকিয়া থাকাই ভার!

 তখন সকলে একসঙ্গে গর্জন করিয়া, শঙ্খ, ভেরী ও ঢাকের বাদ্য আর মুগুরের গুতা হইতে আরম্ভ করিয়া, তাহার উপর আবার অনেক হাতি ঘোড়া আর উট আনিয়া তাহাকে মাড়াল। তাহাতেও যখন তাহার ঘুম ভাঙিল না, তখন তাহার চুল ছিঁড়িয়া কান কামড়াইয়া আর কানের ভিতর জল ঢালিয়া তাহাকে জাগাইবার চেষ্টা করিল। শতঘ্নী আনিয়া তাহাকে মারিল। কিন্তু কুম্ভকর্ণ কিছুতেই জাগিল না।

 শেষে তাহারা একেবারে এক হাজার হাতি দিয়া তাহাকে মাড়াইতে আরম্ভ করিল। এইবার কুম্ভকর্ণের বোধ হইল যেন কেহ অতিশয় আদরে তাহার গা টিপিয়া দিতেছে। তখন সে চক্ষুমেলিয়া বসিয়া হাই তুলিল। সেই হাই তোলা দেখিয়া কি আর কাহারও সেখানে দাঁড়াই থাকিতে ভরসা হয়? রাক্ষসেরা তখন তাড়াতাড়ি তাহাকে সেই শুয়োর ও মহিষের ঢিপি দেখাইয়া দিযাই, আমনি উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া দূরে চলিয়া গেল। কুম্ভকর্ণও মাংসের পর্বত আর রক্তের কলসীসকল সামনে পাইয়া তাহা শেষ করিয়া দিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না।

 রাক্ষসেরা এতক্ষণ ভয়ে-ভয়ে দূরে দাড়াইয়া ছিল। যখন তাহারা দেখিল যে কুম্ভকর্ণের ক্ষুধা কমিয়াছে, তখন তাহার কাছে আসিয়া নমস্কার করিল। তখনও কুম্ভকর্ণের চোখে ঘুম রহিয়াছে। সে খানিক রাক্ষসদিগের দিকে ঢুলু-ঢুলু চোখে বোকার মতন তাকাইয়া রহিল। তারপর জিজ্ঞাসা করিল, “আমাকে জাগাইলে কেন! কোন বিপদ হইয়াছে নাকি?’

 সেখানে মন্ত্রী যুপাক্ষ ছিল। সে হাত যোড় করিয়া বলিল, মানুষ আর বানর আসিয়া লঙ্কা ছারখার করিয়াছে।’ তাহা শুনিয়া কুম্ভকর্ণ বলিল, তবে আমি আগে সেই মানুষ আর বানরগুলিকে খাইয়া, তারপর দাদার সঙ্গে দেখা করিব।” রাক্ষসেরা কহিল, আগে রাজার সঙ্গে দেখা করিয়া তারপর যুদ্ধ করিতে গেলেই ভাল হয়। তখন কুম্ভকর্ণ রাবণের সঙ্গে দেখা করিতে চলিল।

 যাইবার সময় তাহার সেই বিশাল শরীর আর বিকট চেহারা দেখিয়া বানরেরা যে কি ভয় পাইয়াছিল, তাহা কি বলিব! তাহদের কেহ রামের কাছে গিয়া আশ্রয় লইল, কেহ ভয়ে মাটিতে শুইয়া পড়িল। অন্যেরা দুই লাফে কে কোথায় পলাইল, তাহার ঠিক নাই। তখন রাম বিভীষণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ওটা আবার কি হে? এরূপ জন্তু ত আর কখনও দেখি নাই! এটা রাক্ষস, না দৈত্য?’

 বিভীষণ বলিল, ইনি বিশ্রবা মুনির পুত্র, নাম কুম্ভকর্ণ। ইনি জন্মিয়াই এত জন্তু ধরিয়া খাইতে আরম্ভ করেন যে ইহার ভয়ে সকলে ইন্দ্রের নিকটে গিয়া উপস্থিত হয়। ইন্দ্র তখন

কুম্ভকর্ণকে বজ্র দিয়া মারিলেন। কুম্ভকর্ণও ঐরাবতের দাঁত ছিঁড়িয়া লইয়া, তাহার ঘায়ে ইন্দ্রকে অজ্ঞান করিয়া দিলেন।

 কুম্ভকর্ণের অত্যাচার দেখিয়া ব্রহ্মা বলিলেন, “তুমি কেবল ঘুমাইবে।” ইহাতে পৃথিবীর লোক খুবই আনন্দিত হইল বটে, কিন্তু রাবণ নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ব্রহ্মাকে বলিলেন, “প্রভু, কুম্ভকর্ণ আপনার নাতির পুত্র। তাহাকে কি এমন করিয়া শাস্তি দিতে হয়? ইহার জাগিবার উপায় করিয়া দিন।” তখন ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছ ও ছয় মাস ঘুমাইবে, তারপর একদিন জাগিয়া থাকিবে।” রাবণ আজ বড়ই ভয় পাইয়া সেই কুম্ভকর্ণকে জাগাইয়াছেন।

 এই কথা শুনিয়া রাম বানরদিগকে বলিলেন, “তোমরা সাবধান হইয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক।” বানরেরা বড় বড় পর্বতের চূড়া হাতে করিয়া লঙ্কার দরজা আটকাইয়া রহিল।

 এদিকে কুম্ভকর্ণ রাবণের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহারাজ, আমাকে কেন জাগাইয়াছেন? কি করিতে হইবে?”

 রাবণ বলিল, ভাই, তুমি খালি ঘুমাও, কোন খবর ত রাখ না! ইহার মধ্যে দশরথের পুত্র রাম বানর লইয়া আসিয়া লঙ্কা ছারখার করিয়া দিল। বড় বড় বীরেরা তাহাদের হাতে মারা গিয়াছে। লঙ্কায় কি আর যোদ্ধা আছে! তাই তোমাকে জাগাইয়াছি। তুমি যদি ইহাদিগকে মারিতে পার, তবেই রক্ষা!

 তারপর সকল কথা শুনিয়া কুম্ভকর্ণ বলিল, না বুঝিয়া শুনিয়া কাজ করিয়াছেন, তাহাতেই ত এত বিপদ! লোকে এত করিয়া আপনাকে বুঝাইল, আপনি তাহা শুনিলেন না। বিভীষণ যাহা বলিয়াছিল, সেরূপ করিলে কি এমন হইত? তাহাতে রাবণ রাগিয়া বলিল, “তোমার এত কথায় কাজ কি? যাহা বলিতেছি তাহাই কর। জান না, আমি তোমার দাদা? বড় যে উপদেশ দিতে আসিয়াছ।”

 তাহা শুনিয়া কুম্ভকর্ণ কহিল, “আমি যাহা ভাল মনে করিয়াছি, তাহাই বলিয়াছি। দাদা হইলে কি আর তাহাকে ভাল কথা বলিতে নাই? যাহা হউক, আমি থাকিতে আপনার কিসের ভয়? এখনই আমি এগুলিকে মারিয়া দিতেছি।”

 তখন রাবণ যার-পর-নাই খুশি হইয়া বলিল, “ভাই তোমার মত বীর আর কে আছে? তাই ত ইহাদিগকে মারিবার জন্য তোমাকে জাগাইয়াছি। শীঘ্র যাও, শীঘ্র গিয়া রাম লক্ষ্মণ আর তাহাদের সৈন্যদিগকে খাইয়া আইস!”

 তারপর রাবণ নিজ হস্তে কুম্ভকর্ণকে যুদ্ধের পোশাক পরাইয়া দিল। তাহার সঙ্গে কত সৈন্য দিল তাহার সংখ্যা নাই। যখন কুম্ভকর্ণ গর্জন করিয়া শূল হাতে লঙ্কা হইতে বাহির হইল, তখন বানরেরা ত তাহাকে দেখিয়া ‘বাবাগো’ বলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দে ছুট। একবার দেখিয়া আর তাহারা দুইবার দেখিবার জন্য দাঁড়াইল না।

 অঙ্গদ কি সহজে তাহাদিগকে বকিয়া ফিরাইতে পারে! একবার অনেক কষ্টে তাহারা ফিরিয়াছিল; কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর জন্তুর সামনে টিকিয়া থাকা ত সহজ কাজ নহে! যম পাহাড় সাজিয়া যুদ্ধ করিতে আসিলে তাহাকেও দুচারটা পাথর ছুঁড়িয়া মারিতে পারে, এমন সাহস হয়ত তাহাদের ছিল। কিন্তু এ আপদ যে যমের চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ, এ হতভাগা বানর দেখিলেই মিঠাই মণ্ডার মতন তুলিয়া মুখে দেয়! যম ত তাহা করে না। যাহা হউক, এরূপ ভয় খালি ছোট মর্কটগুলাই পাইল, বড় বানরেরা নহে।  বড়দের মধ্যে দ্বিবিদ পাহাড় ছুঁড়িয়া অনেক রাক্ষস মারিল। হনুমানও পর্বতের চূড়া আর গাছ লইয়া কুম্ভকর্ণের সহিত কম যুদ্ধ করে নাই। কিন্তু কুম্ভকর্ণের শূলের কাছে তাহার গাছ পাথর কিছুই করিতে পারিল না। তাহা দেখিয়া হনুমান রাগের ভরে একটা প্রকাণ্ড পর্বতের চূড়া দিয়া ঠুকিয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া দিল। কুম্ভকর্ণও আবার একটু সুস্থ হইয়া, হনুমানের বুকে এমন এক শক্তির ঘা মারিল যে হনুমান বেদনায় চেঁচাইয়া অস্থির।

 ইহার পর ঋষভ, শরভ, নীল, গবাক্ষ আর গন্ধমাদন এই পাঁচজন মিলিয়া কুম্ভকর্ণকে মারিতে গেল। কিন্তু তাহারা কুম্ভকর্ণের কি করিবে! তাহারা প্রাণপণ করিয়া আঁচড়, কামড়, লাথি, কিল, গাছ, পাথর যত মারে কুম্ভকর্ণের তাহাতে বেশ আরামই বোধ হয়—যেন কেহ তাহার ঘামাচি মারিয়া দিতেছে। তারপর কুম্ভকর্ণ যখন তাহাদিগকে বগলে ফেলিয়া চাপিতে আর ঠুকিতে আরম্ভ করিল, তখন বেচারাদের দুর্দশার শেষ রহিল না।

 হাজার হাজার বানর কুম্ভকর্ণকে একসঙ্গে আক্রমণ করিয়াও তাহার কিছুই করিতে পারিল না। কুম্ভকর্ণ তাহাদিগকে ধরিয়া অমনি মুখে দেয়। অনেক বানর আবার তাহার মুখের ভিতর ঢুকিয়া নাকের ছিদ্র দিয়া বাহির হইয়াও আসে।

 তারপর অঙ্গদ অনেক যুদ্ধ করিল, কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না। একবার সে বুকে চড় মারিয়া কুম্ভকর্ণকে অজ্ঞান করিয়াছিল বটে, কিন্তু কুম্ভকর্ণও তখনই আবার লাফাইয়া উঠিয়া, এক কিলে অঙ্গদকে অজ্ঞান করিয়া দিল।

 অঙ্গদকে অজ্ঞান দেখিয়া সুগ্রীব পাহাড় হাতে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে পাহাড় যে কুম্ভকর্ণের গায়ে লাগিয়া গুঁড়া হইয়া গেল, তাহা বোধহয় বলিবার আগেই বুঝিয়াছ। তারপর শূল দিয়া সে সুগ্রীবকে এমনি এক ঘা মারিবার যোগাড় করিয়াছিল যে হনুমান তাড়াতাড়ি শূলটা ভাঙিয়া না ফেলিলে, হয়ত তখনই সুগ্রীবের বুক ফুটা হইয়া যাইত। শূল ভাঙার পরেও কুম্ভকর্ণ সুগ্রীবকে সহজে ছড়িল না। সে তাহাকে পর্বতের চূড়ার ঘায় অজ্ঞান করিয়া, রাক্ষসদিগকে দেখাইবার জন্য লঙ্কার ভিতর লইয়া গেল।

 লঙ্কার ভিতরে গিয়াই সুগ্রীবের জ্ঞান হইয়াছে। তখন সে মনে করিল যে এইবেলা কুম্ভকর্ণকে জব্দ করিবার একটা উপায় করা চাই। যেই এই কথা মনে করা, আর অমনি দুই হাতে রাক্ষসের দুটি কান, দাঁতে তাহার নাকটি, আর দুই পায়ে তাহার দুই পাশের চামড়া একেবারে শিকড়সুদ্ধ ছিঁড়িয়া তোলা। সে সময়ে কুম্ভকর্ণ কিরূপ চমকিয়া গিয়াছিল আর কেমন মুখ সিটকাইয়াছিল আর কি ভয়ানক চ্যাঁচাইয়াছিল আর সুগ্রীবকেই বা কতখানি ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি আছড়াইয়া ফেলিয়াছিল, তাহা আর বলিবার দরকার নাই। আর সেই গোলমালে যে সুগ্রীবও দুই লাফে সেখান হইতে চলিয়া আসিল, তাহাও সহজেই বুঝিতে পার।

 কুম্ভকর্ণের চেহারা একেই ত অতিশয় ভয়ানক, তাহার উপরে আবার এখন নাক কান নাই; সুতরাং তাহা আরও ভয়ানক হইবারই কথা। আবার বেদনায় সে এতই রাগিয়া গিয়াছে যে এখন আর রাক্ষস বানর বুঝিতে পারে না। রাক্ষসকেও ধরিয়া মুখে দেয়, বানরকেও ধরিয়া মুখে দেয়। কাজেই এবারে যে বানরেরা তাহাকে দেখিয়া আরও ভয় পাইল, ইহা আশ্চর্য নহে। তাহা দেখিয়া লক্ষ্মণ তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

 তখন কুম্ভকর্ণ লক্ষ্মণকে বলিল, “লক্ষ্মণ, তুমি ছেলেমানুষ, তুমি যে সাহস করিয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিয়াছ, তাহাতেই আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি। কিন্তু আমি এখন রামকে মারিতে আসিয়াছি, তোমার সহিত যুদ্ধ করিব না। এই বলিয়া সে রামের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল।

 রামের বাণে তাহার হাতের গদা মাটিতে পড়িয়া যাইতে অধিক সময় লাগিল না। তখন আর তাহার অন্য অস্ত্র নাই; কাজেই সে পর্বতের চূড়া লইয়া যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। এদিকে বড় বড় বানরেরা দল বাঁধিয়া তাহার ঘাড়ে গিয়া উঠিয়াছে। সে যুদ্ধ করিবে, না বানরগুলিকেই ঝাড়িয়া ফেলিবে, বুঝিতে পারিতেছে না।

 কিন্তু রামের বাণ খাইয়াও কুম্ভকর্ণ সহজে কাহিল হইল না। যে বাণে বালী মরিয়াছিল তাহাও সে সহিয়া রহিল। ইহার মধ্যে কখন সে একটা লোহার মুদগর তুলিয়া লইয়াছে। সেই মুদগর ঘুরাইয়া সে রামের বাণও ফিরাইয়া দিতেছে, আবার বানরদিগকেও মারিতেছে। তাহা দেখিয়া রাম বায়ুবাণে সেই মুদগরসুদ্ধ তাহার হাতটি কাটিয়া ফেলিলেন। তখন কুম্ভকর্ণ বেদনায় চিৎকার করিতে করিতে, আর-এক হাতে একটা তালগাছ লইয়া রামকে মারিতে চলিল। রাম ইন্দ্র-অস্ত্রে সে হাতটাও কাটিয়া ফেলিলেন। কিন্তু তবুও সে ছুটিয়া আসিতে ছাড়িল না।

 তারপর রাম অর্ধচন্দ্র বাণ মারিয়া তাহার পা দুইটা কাটিলেন। তবুও সে গড়াইতে গড়াইতে হাঁ করিয়া রামকে গিলিতে চলিয়াছে। তখন রাম অনেকগুলি বাণ মারিয়া তাহার মুখের হাঁ বন্ধ করিয়া দিলেন, তারপর ইন্দ্র-অস্ত্রে মাথা কাটিয়া ফেলিলেন। কুম্ভকর্ণের মৃত্যু দেখিয়া রাক্ষসেরা ভয়ে চিৎকাব করিতে লাগিল, আর দেবতা, গন্ধর্ব, মুনি, ঋষিরা যার-পরনাই সন্তুষ্ট হইয়া কোলাহলে আকাশ কাঁপাইয়া তুলিলেন।

 রাবণ যখন শুনিল যে কুম্ভকর্ণের মৃত্যু হইয়াছে তখন তাহার আর দুঃখের শেষ রহিল না। প্রথমে সে অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল। জ্ঞান হইলে পর অনেক কাঁদিয়া শেষে বলিল, “হায়, আমি না বুঝিয়া ভাই বিভীষণকে অপমান করিয়াছিলাম, তাহার শাস্তি এখন পাইতেছি। আমার সব গেল।” এই বলিয়া সে আবার অজ্ঞান হইয়া গেল।

 রাবণের দুঃখ দেখিয়া তাহার পুত্র ত্রিশিরা বলিল, “মহারাজ, আপনি এত দুঃখ করিতেছেন কেন? আমি রাম লক্ষ্মণকে মারিয়া দিতেছি।” তাহ শুনিয়া দেবান্তক, নরান্তক ও অতিকায় নামক রাবণের আর তিন পুত্র এবং মহোদর ও মহাপার্শ্ব নামে ইহাদের দুই খুড়া বলিল যে তাহারাও যুদ্ধ করিতে যাইবে।

 ইহারা আসিয়া প্রথমে ছোট ছোট বানরদিগকে বড়ই অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু তাহার পরেই অঙ্গদ, হনুমান, নীল আর ঋষভ আসিয়া অতিকায় ছাড়া ইহাদের আর সকলকেই মারিয়া ফেলিল।

 অতিকায় তপস্যা করিয়া ব্রহ্মার নিকট একটা রথ, অনেকগুলি অস্ত্র আর এমন একটা বর্ম পাইয়াছিল যে তাহাতে কিছুই বিঁধিতে পারিত না। সেই বর্মের নাম অক্ষয় কবচ। এইসকলের জোরে অতিকায় লক্ষ্মণের সহিত অনেকক্ষণ যুদ্ধ করিয়াছিল। লক্ষ্মণ তাহাকে অনেক বাণ মারিলেন, কিন্তু তাঁহার কোন বাণই সেই বর্ম ভেদ করিতে পারিল না। এমন সময় পবন আসিয়া লক্ষ্মণের কানে কানে বলিলেন, ব্রহ্মাস্ত্র মার, অন্য অস্ত্রে এ রাক্ষস মরিবে না, ইহার গায়ে অক্ষয় কবচ আছে। এ কথা শুনিয়া লক্ষ্মণ ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়িলেন। সে অস্ত্র আটকাইবার জন্য অতিকায় কত চেষ্টাই করিল, কত শক্তি, কত গদা, কত শূল ছুঁড়িয়া মারিল, কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র কি তাহাতে থামে। দেখিতে দেখিতে অতিকায়ের মাথা তাহাতে কাটিয়া দুইখণ্ড হইয়া গেল।

 ইহার পর আবার ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধ করিতে আসিল। ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে থাকিয়া যুদ্ধ করে। চোরের মত আড়াল হইতে সে সকলকে বাণ মারিল, অন্যেরা তাহার কিছুই করিতে পারিল না। তাহার বাণ খাইয়া সকল বানর অজ্ঞান হইয়া গেলেন। ইহাতে রাক্ষসেরা যে খুবই খুশি হইল, তাহাতে আর সন্দেহ কি? তাহারা নাচিতে নাচিতে লঙ্কায় গিয়া কহিল, “এবারে উহাদিগকে মারিয়া আসিয়াছি।”

 এদিকে রাম, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্ববান, সকলেই অজ্ঞান, কেবল বিভীষণ আর হনুমান অজ্ঞান হয় নাই। তাহারা দুইজন মশাল লইয়া সকলকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল। সেই অন্ধকার রাত্রিতে কোটি কোটি বানর যুদ্ধের জায়গায় পড়িয়া আছে ইহাদের ভিতর হইতে কাহাকেও খুঁজিয়া বাহির করা কি সহজ কাজ!

 অনেক খুঁজিতে খুঁজিতে তাহারা এক জায়গায় জাম্ববানকে দেখিতে পাইল। বিভীষণ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, জাম্ববান, “তুমি কি বাঁচিয়া আছ?” তাহা শুনিয়া জাম্ববান অনেক কষ্টে উত্তর করিল, “চক্ষে তীর লাগিয়াছে চাহিতে পারি না। আপনার গলার শব্দে বোধ হইতেছে আপনি বিভীষণ। হনুমান বাঁচিয়া আছে ত?”

 বিভীষণ বলিল, “তুমি রাম লক্ষ্মণের কথা জিজ্ঞাসা করিলে না, অন্য কাহারও কথা জিজ্ঞাসা করিলে না, আগেই হনুমানের কথা কেন?”

 জাম্ববান বলিল, “হনুমান যদি বাঁচিয়া থাকে, তবে কোন ভয় নাই; আর যদি সে মরিয়া গিয়া থাকে, তবে আর উপায় নাই।”

 তখন হনুমান জাম্ববানকে প্রণাম করিল। হনুমানকে চিনিতে পারিয়া জাম্ববান বলিল, বাছা, তুমি ছাড়া এ সময়ে আমাদের আর কেহ নাই। তুমি চেষ্টা করিলে সকলকে বাঁচাইতে পার। হিমালয়ের পরে ঋষভ আর কৈলাস পর্বত। সেই দুই পর্বতের মাঝখানে ঔষধের পর্বত। সেখানে বিশল্যকরণী, মৃত্যুসঞ্জীবনী, সুবর্ণকরণী আর সন্থানী, এই চারিরকমের ঔষধ আছে শীঘ্র গিয়া তাহা লইয়া আইস।

হনুমান তখনই ঔষধ আনিতে চলিয়া গেল। হিমালয় পর্বত পার হইলে কৈলাস পর্বত, তাহার কাছে ঔষধের পর্বত। এতদূর যাইতে হনুমানের কিছুই বিলম্ব হইল না। কিন্তু সেখানে গিয়া দেখিল যে ঔষধ খুঁজিয়া বাহির করা বড়ই কঠিন। ঔষধের গাছ ঝক্‌-ঝক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে, তাহা সে দূর হইতে দেখিতে পাইয়াছিল। কিন্তু কাছে আসিতেই তাহারা যে কোথায় লুকাইয়াছে কিছুই বুঝিবার জো নাই।

 তখন হনুমান রাগিয়া বলিল, আচ্ছা দাঁড়াও! আমি পাহাড়সুদ্ধই লইয়া যাইতেছি। এই বলিয়া গাছ পাথর, হাতি গণ্ডার, সবসুদ্ধ সেই প্রকাণ্ড পাহাড় ধরিয়া সে এমনই বিষম টান দিল যে সেই টানে একেবারে পাহাড়ের গোড়া অবধি চড়্‌-চড়্‌ শব্দে উঠিয়া আসিল। তারপর সেটাকে মাথায় করিয়া ফিরিয়া আসা ত এক মুহূর্তের কাজ!

 ঔষধ আনিয়া তাহা আর কাহাকেও খাওয়াইবার দরকার হইল না। সে এমনি আশ্চর্য ঔষধ যে তাহার গন্ধ পাইয়াই সকলে উঠিয়া বসিল—যেন তাহারা সবে ঘুম হইতে জাগিয়াছে। রাম লক্ষ্মণ উঠিলেন, বানরেরা সকলেই উঠিল। উঠিল না খালি রাক্ষসগুলি। পাছে অনেক রাক্ষস মরিয়াছে দেখিলে বানরদের সাহস বাড়িয়া যায়, এজন্য রাক্ষস মরিলেই অন্য রাক্ষসেরা তাহাকে সমুদ্রের জলে ফেলিয়া দিত। কাজেই ঔষধের গন্ধ তাহাদের নাকে পৌঁছাইতে পারিল না আর তাহারাও বঁচিল না।

 সকলে বাঁচিয়া উঠিল, কাজেই ঔষধের কাজ ফুরাইয়া গেল। তখন হনুমান আবার যেখানকার পাহাড়টি, সেইখানে তাহাকে রাখিয়া আসিল।

 পরদিন সন্ধ্যার সময় দলে দলে বানর মশাল হাতে লইয়া লঙ্কায় গিয়া ঢুকিল। হনুমান সেবার লঙ্কার সকল স্থান পোড়াইতে পারে নাই, কিন্তু এবার আর কিছু বাকি রহিল না। রাক্ষসেরা বানরদিগকে বাধা দিবে কি, তাহারা নিজেরাই তখন পলাইতে ব্যস্ত। তাহদের সে সময়কার চিৎকার একশত যোজন দূর হইতে শোনা গিয়াছিল।

 একদিকে লঙ্কা ধক্‌-ধক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে আর একদিকে সেই রাত্রিতেই আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। এবারে রাক্ষসদিগের সেনাপতি কুম্ভ নিকুম্ভ যুগাক্ষ শোণিতাক্ষ আর প্রজঙ্ঘ।

 সে রাত্রিতে রাক্ষস আর বানরেরা ভয়ানক যুদ্ধ করিয়াছিল, কিন্তু বানরদিগের সঙ্গে রাক্ষসেরা আঁটিতে পারিল না। অঙ্গদ, দ্বিবিদ আর মৈন্দ যুগাক্ষ, প্রজঙ্ঘ আর শোণিতাক্ষের সহিত অনেক যুদ্ধ করিয়া, তাহাদিগকে মারিয়া ফেলিল।

 কুম্ভ দেখিল যে বানরেরা রাক্ষসদিগকে মারিয়া শেষ করিতেছে। তখন সে ধনুর্বাণ লইয়া ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিল। সে সময়ে আর তাহার সামনে কেহ টিকিয়া থাকিতে পারিল না। মৈন্দ, দ্বিবিদ, অঙ্গদ, সকলেই তাহার বাণে অজ্ঞান হইয়া গেল। তাহার বাণে চারিদিক এমনি করিয়া ছাইয়া গিয়াছিল যে জাম্ববান আর সুষেণ আসিয়া, বাণের জন্য কিছুই দেখিতে পাইল না। তারপর সুগ্রীব আসিয়া অনেক গাছপাথর ছুঁড়িয়া মারিল, কিন্তু তাহাতেও প্রথমে কুম্ভের কিছুই হইল না। তখন সুগ্রীব তাহার ধনুক কড়িয়া লইল।

 ধনুক গেলে কাজেই তখন কুস্তি। কুম্ভ আসিয়া সুগ্রীবকে জড়াইয়া ধরিল। সুগ্রীবও তাহার সহিত খুব একচোট কুস্তি করিয়া শেষে তাহাকে একেবারে সমুদ্রের জলে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। কিন্তু কুম্ভ তাহাতে হটিবার লোক নহে। সে সেইখান হইতে ভিজা কাপড়ে উঠিয়া আসিয়া সুগ্রীবের বুকে এক কিল মারিয়াছে। সুগ্রীবেরও কাজেই তখন সেই কিলের শোধ দেওয়া দরকার হইল। আর সেই শোধ দিতে গিয়া, সুগ্রীবের কিলে কুম্ভের প্রাণও বাহির হইয়া গেল। কাজেই তাহার আর যুদ্ধ করিতে হইল না।

 এদিকে ভাইয়ের মৃত্যুতে নিকুম্ভ রাগে জ্বলিয়া একেবারে আগুন। তাহার হাতে একটা ভয়ানক পরিঘ। সেই পরিঘের ভয়ে কেহই তাহার নিকটে ঘেঁষিতে পারিতেছে না। সেই পরিঘ লইয়া সে হনুমানকে মারিতে আসিল। কিন্তু হনুমান কি পরিঘকে ভয় করিবার লোক? পরিঘকে হনুমান ভয় করা দূরে থাকুক, বরং সেটাই তাহার বুকে ঠেকিয়া গুঁড়া হইয়া গেল; আর তাহার এক কিলের চোটে নিকুম্ভের বর্ম ছিঁড়িয়া একেবারে খান-খান হইল।

 এই সময়ে নিকুম্ভ কোন ফাঁকে তাড়াতাড়ি হনুমানকে ধরিয়া লইয়া এক ছুট দিয়াছিল। কিন্তু হনুমান তাহাতে ঠকিবে কেন? সে প্রচণ্ড এক কিল মরিয়া তাহার হাত হইতে ছাড়াইয়া গেল। তাহার পরেই দেখা গেল যে সে ঘোরতর গর্জনে নিকুম্ভকে মাটিতে ফেলিয়া, তাহার বুকে চড়িয়া বসিয়াছে। তখন নিকুম্ভের চিৎকার দেখে কে! যাহা হউক, তাহাকে অধিক চ্যাঁচাইতে হইল না; কারণ, তাহার পরক্ষণেই হনুমান তাহার মাথাটা টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল।

 ইহার পর যে যুদ্ধ করিতে আসিল, সে সেই খরের পুত্র। তাহার নাম মকরাক্ষ। তাহার যুদ্ধের কথা আর কি শুনিবে? রাম তাহাকে হাসিতে হাসিতে যে-সকল বাণ মারিলেন, তাহতেই সে বেচারার প্রাণ বাহির হইয়া গেল।

 তখন রাবণ আর কাহাকে পাঠাইবে? ইন্দ্রজিৎ ভিন্ন আর লোক নাই। কাজেই ইন্দ্রজিৎ আবার যুদ্ধ করিতে আসিল। তাহার যুদ্ধ কিরূপ, তাহা তা জানাই আছে। সে চোরা-যুদ্ধ করিয়া রাম লক্ষ্মণকে সে খুবই কষ্ট দিল।

 তখন লক্ষ্মণ বলিলেন, “দাদা ব্রহ্মাস্ত্র মারিয়া কেন একেবারে সকল রাক্ষস শেষ করিয়া দাও না?” রাম বলিলেন, “যে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে তাহাকেই মারা যায়; যাহারা যুদ্ধ করিতেছে না, তাহাদিগকে কি মারা উচিত? আচ্ছা, আজ ইন্দ্রজিতের রক্ষা নাই! আজ যদি সে মাটির নীচে গিয়াও লুকায়, তথাপি তাহাকে মারিবই।” এ কথা শুনিয়া ইন্দ্রজিৎ তখনই সেখান হইতে চলিয়া গেল।

 খানিক পরে দেখা গেল যে একটি স্ত্রীলোককে রথে লইয়া ইন্দ্রজিৎ আবার আসিয়াছে। স্ত্রীলোকটি দেখিতে ঠিক সীতার মতন, কিন্তু আসলে তাহা রাক্ষসদের গড়া, মায়া, অর্থাৎ জাদুর পুতুল ভিন্ন আর কিছুই নহে। সেই মায়া সীতার চুলে ধরিয়া ইন্দ্রজিৎ তাহাকে খড়্গ দিয়া কাটিতে যাইতেছে, আর মায়া সীতা ‘হা রাম!’ বলিয়া চিৎকার করিতেছে। তাহা দেখিয়া হনুমান আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিল, “দুষ্ট, সীতাকে যদি মারিস, তবে তোকে এখনই যমের বাড়ি পাঠাইব!” কিন্তু হনুমান এ কথা বলিয়া তাহার কাছে ছুটিয়া যাইবার পূর্বেই, ইন্দ্রজিৎ সে পুতুলটার মাথা কাটিয়া তাহাকে বলিল, “এই দেখ্ তোদের সীতাকে কাটিয়া ফেলিয়াছি।”

 তখন হনুমান রাগে দুঃখে অস্থির হইয়া রাক্ষসদের সহিত ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিল। কিন্তু খানিক যুদ্ধ করিয়াই সে ভাবিল “সীতা যখন মরিয়া গিয়াছে তখন কিসের জন্য যুদ্ধ করিব? আগে রামকে গিয়া এই সংবাদ দিই, তারপর তিনি যাহা বলেন তাহাই করা যাইবে।”

 ইন্দ্রজিৎ সীতাকে কাটিয়া ফেলিয়াছে, এ কথা শুনিয়া রাম দুঃখে নিতান্তই কাতর হইয়া পড়িলেন। এমনকি, সে সময়ে তাঁহাকে শান্ত করাই সম্ভব হইত না, যদি বিভীষণ সেখানে না আসিত।

 বিভীষণ সকল কথা শুনিয়া রামকে বলিল, “সীতাকে কাটিয়াছে, ইহা কখনই হইতে পারে না। যাহা কাটিয়াছে তাহা নিশ্চয়ই মায়া সীতা। তোমরা সেটাকে যথার্থ সীতা মনে করিয়া কাঁদিতে বসিয়াছ আর ততক্ষণে সেই দুষ্ট নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করিতে গিয়াছে। যজ্ঞ শেষ করিতে পারিলে আর কেহই তাহাকে যুদ্ধের সময় দেখিতে পাইবেনা; কাজেই সকলে তাহার নিকটে হারিয়া যাইবে। যজ্ঞ শেষ না হইলে তাহার নিজেকেই মরিতে হইবে। পাছে বানরেরা যজ্ঞে বাধা দেয়, তাই সে এরূপ করিয়া তোমাদিগকে ভুলাইয়া রাখিয়া গিয়াছে। এই যজ্ঞ শেষ না হইতেই উহাকে মারিতে হইবে। লক্ষ্মণ, আমার সঙ্গে চল; তুমি ভিন্ন আর কেহ এ কাজ করিতে পারিবে না।” এই বলিয়া লক্ষ্মণকে লইয়া বিভীষণ যজ্ঞ আটকাইতে চলিল।

 কিন্তু যজ্ঞ আটকাইতে গেলেই ত আর অমনি তাহা আটকাইয়া ফেলা যায় না। রাক্ষসেরা তাহা সহজে করিতে দিবে কেন? কাজেই সেখানে রাক্ষসদের সহিত লক্ষ্মণের ভয়ানক যুদ্ধ বাধিয়া গেল। যাহা হউক, ইন্দ্রজিতের আর যজ্ঞ করা হইল না। রাক্ষস আর বানরের গর্জনে লঙ্কা কাঁপিতেছে, এই গোলমালের ভিতরে কি আর যজ্ঞ হয়! আর, এখনই গিয়া লক্ষ্মণকে না আটকাইলে তাই তিনি মুহূর্তের মধ্যেই সকলকে মারিয়া শেষ করিবেন। কাজেই তখন ইন্দ্রজিৎ ছুটিয়া না আসিয়া আর যায় কোথায়। আর সেইজন্যই যজ্ঞ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিতে হইল। প্রাণ বাঁচিলে তবে ত যজ্ঞ হইবে!

 এদিকে হনুমান প্রকাণ্ড গাছ লইয়া রাক্ষসদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে। রাক্ষসেরাও তাহাকে নানাবিধ অস্ত্র উঁড়িয়া মারিতে ছাড়িতেছে না। এমন সময় ইন্দ্রজিৎ আসিয়া হনুমানকে তাড়া করিল। তাহা দেখিয়া বিভীষণ লক্ষ্মণকে বলিল, ‘ঐ ইন্দ্রজিৎ আসিতেছে, এই বেলা দুষ্টকে বধ কর!’

 তখন লক্ষ্মণ আর ইন্দ্রজিতে কি যুদ্ধই না হইল! ইন্দ্রজিৎ রথের উপরে, আর লক্ষ্মণ হনুমানের পিঠের উপরে। দুইজনেই প্রায় সমান বীর, সুতরাং অনেকক্ষণ পর্যন্ত সমানভাবেই যুদ্ধ চলিল, কাহারও হার জিত নাই। অস্ত্রের ঘায় দুইজনের শরীর দিয়াই দর দর করিয়া রক্ত পড়িতেছে। অদ্ভুত-অদ্ভুত অস্ত্র সকল দুইজনেই ছুঁড়িতেছেন, আবার দুইজনেই কাটিতেছেন।

 ইহার মধ্যে একবার ইন্দ্রজিতের রথের ঘোড়া আর সারথি কাটা যায়। আবার বাণের অন্ধকারের ভিতরে কখন ছুটিয়া গিয়া, সে আবার নূতন রথে চড়িয়া আসে। তারপর ক্রমাগত দুইবার তাহাকে ধনুক বদলাইতে হইয়াছে। খানিক পরে আবার লক্ষ্মণের ভল্লঅস্ত্রে ইন্দ্রজিতের নূতন রথের সারথি মারা গেল;আর বিভীষণ গদার ঘায়ে তাহার চারিটা ঘোড়া চুরমার করিয়া দিল। তখন ইন্দ্রজিৎ রথ হইতে নামিযা যে-ই বিভীষণকে একটা শক্তি ছুঁড়িয়া মারিয়াছে, অমনি লক্ষ্মণ তাহা খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিলেন।

 ইরূপে আরও অনেক যুদ্ধের পর শেষে লক্ষ্মণ তাঁহার ধনুকে অস্ত্র জুড়িলেন। ইন্দ্র যাহা দিয়া দৈত্যকে মারিয়াছিলেন, এ সেই অস্ত্র। তাহার চেহারা দেখিয়াই রাক্ষসদিগের প্রাণ উড়িয়া গেল। আর লক্ষ্মণ তাহা ছুঁড়িবামাত্রই ইন্দ্রজিতের মাথা কাটিয়া একেবারে দুইখান হইল।

 ইন্দ্রজিতের মৃত্যুতে কেবল যে বানরেরাই আনন্দে ‘জয় লক্ষ্মণ!’ বলিয়া লেজ নাডিল, তাহা নহে। স্বর্গ হইতে যেমন করিয়া ফুল পড়িল আর দুন্দুভিব শব্দ শুনা গেল, তাহাতে নিশ্চই বুঝা গেল যে দেবতারাও ইহাতে কম খুশি হন নাই। দুঃখ হইল খালি রাক্ষসদেরই। তাহা ছাড়া আর কে না সুখী হইল?

 ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর কথা শুনিয়া রাবণ প্রথমে অনেক কাঁদিল। তারপর রাগে অস্থির হইয়া বলিল, ‘ইন্দ্রজিৎ মায়া-সীতা কাটিয়াছিল, আমি সত্যসত্যই সীতাকে কাটিব!’ মন্ত্রীরা বারণ না করিলে, সেদিন সে সীতাকে কাটিয়াই ফেলিত। মন্ত্রীদের কথায় অনেক কষ্টে রাগ থামাইয়া, সে বলিল, ‘রাক্ষসগণ, আজ তোমরা গিয়া কেবল রামকে ঘিরিয়া মার। তোমাদের হাতে আজ যদি বাঁচিতেও পারে, তবুও ইহাতে সে খুব দুর্বল হইয়া যাইবে। তাহা হইলে কাল আমি তাহাকে গিয়া মারিব।’

 সেই রাক্ষসেরা যখন রামকে মারিতে গেল, তখন রাম এমনই যুদ্ধ করিলেন যে তেমন যুদ্ধ কেহ কখনও দেখে নাই। তিনি কোথায় আছেন তাহাই কেহ বুঝিতে পারিল না, এত তাড়াতাড়ি তিনি ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তিন ঘণ্টার ভিতরে আঠার হাজার হাতি, দুই লক্ষ সৈন্য, দশ হাজার রথ, আর সওয়ারসুদ্ধ চৌদ্দ হাজার ঘোড়া তাঁহার বাণে খণ্ড খণ্ড হইল। তখন আর-আর সকল রাক্ষস ভয়েই পলাইয়া গেল।

 এখন আর কে যুদ্ধ করিতে যাইবে? রাবণ ছাড়া লঙ্কায় আর বড় বীর কেহ নাই। কাজেই সে অবশিষ্ট রাক্ষসদিগকে লইয়া, নিজেই যুদ্ধ করিতে আসিল। রাক্ষসেরা যত যুদ্ধ জানে, এবারে তাহার কিছুমাত্র ত্রুটি করিল না। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। রাবণের সঙ্গে ছোটখাট বীর যাহারা আসিয়াছিল তাহারা অল্প সময়ের ভিতরেই মরিয়া গেল।

 কিন্তু রাবণ নিজে এমনি ঘোরতর যুদ্ধ করিল যে বানরেরা তাহার সামনে দাঁড়াইতে পারিল না। যুদ্ধ যাহা হইল তাহার বেশির ভাগ রাম আর লক্ষ্মণের সঙ্গে। লক্ষ্মণ রাবণের ধনুক কাটিলেন আর সারথিকেও মারিলেন। ঘোড়াগুলির জন্য তাঁহার কিছু করিতে হইল না, কারণ বিভীষণ আগেই তাহাদের কর্ম শেষ করিয়া রাখিয়াছিল। তাহার জন্য রাবণ বিভীষণকে শক্তি ছুঁড়িয়া মারে, কিন্তু লক্ষ্মণ তাহা কাটিয়া ফেলাতে বিভীষণের তাহাতে কিছু হয় নাই।

 তখন রাবণ আর একটা শক্তি লইল। সেটা এমনি ভয়ানক যে তাহার ভিতর হইতে ঝক্-ঝক্ করিয়া আলো বাহির হইতেছে। লক্ষ্মণ দেখিলেন, বিভীষণের এবার বড়ই বিপদ। কাজেই তিনি তাহাকে বাঁচাইবার জন্য রাবণকে খুব বেশী করিয়া বাণ মারিতে লাগিলেন।

 তখন রাবণ কহিল, ‘বটে! বিভীষণকে বাঁচাইতে চাহিস? আচ্ছ, তবে তোকেই ইহা দিয়া মারিব!’ এই বলিয়া সে সেই শক্তি লক্ষ্মণের দিকেই ছুঁড়িয়া মারিল। সে অস্ত্র গর্জন করিতে করিতে আসিয়া বুকে বিঁধিবামাত্র লক্ষ্মণ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন; তাঁহার বুক হইতে তাহা বাহির করিবার জন্য বানরেরা তখনই ছুটিয়া আসিয়াছিল, কিন্তু রাবণ বাণ মারিয়া তাহাদিগকে তাঁহার কাছে আসিতে দিল না। তাহা দেখিয়া রাম নিজেই আসিয়া দুই হাতে সেই শক্তি টানিয়া তুলিলেন। রাবণ তাহার যতদূর সাধ্য তাঁহাকে বাণ মারিল, তিনি তাহা গ্রাহ্যও করিলেন না।

 লক্ষ্মণের দুঃখে রামের বুক ফাটিয়া যাইতেছিল; কিন্তু সে দুঃখের দিকে তখন মন না দিয়া তিনি বলিলেন, ‘লক্ষ্মণ এখন এইভাবেই থাকুক। আগে আমি এই দুষ্টকে শাস্তি দিতেছি।’ এই বলিয়া তিনি রাবণকে বাণে বাণে এমনই জব্দ করিয়া তুলিলেন যে তাহার তখন লঙ্কায় পলাইয়া যাওয়া ভিন্ন আর বাঁচিবার উপায়ই রহিল না।

 রাবণ পলাইয়া গেলে পর রাম লক্ষ্মণকে লইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তখন সুষেণ তাঁহাকে বলিল, ‘আপনি শান্ত হইন; লক্ষ্মণ মরেন নাই। এখনও তাঁহার বুকের কাছে ধুক্-ধুক্ করিতেছে আর চক্ষু উজ্জল রহিয়াছে।’

 এইরূপে রামকে শান্ত করিয়া সুষেণ তখনই হনুমানকে দিয়া ঔষধ আনাইল। সে ঔষধের গন্ধে লক্ষ্মণ আবার ভাল হইয়া উঠিলেন।

 এদিকে রাবণ আবার আসিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিল। রামের সহিত তাহার ভয়ানক যুদ্ধ চলিয়াছে এমন সময় দেখা গেল যে মণি মুক্তার কাজ করা একখানি উজ্জ্বল রথ স্বর্গ হইতে নামিয়া আসিতেছে। সেই রথের ঘোড়া ছয়টি সবুজ রঙের; তাহাদের শরীরে সোনার অলঙ্কার আর গলায় মুক্তার মালা। সেই রথের সারথি মাতলি হাত যোড় করিয়া রামকে বলিল, ইন্দ্র আপনার জন্য এই রথ, ধনুক, কবচ আর অস্ত্র পাঠাইয়াছে। এই রথে চড়িয়া আপনি রাবণকে বধ করুন। তাহা শুনিয়া রাম সেই রথে চড়িয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

 সে যুদ্ধ যে কি ভয়ানক হইয়াছিল তাহা কি বলিব। রাবণ একবার ইন্দ্রের রথের নিশান আর ঘোড়া কাটিয়া বাণে বাণে রামকে অস্থির করিয়া তুলিল। আবার তারপরেই রামের তেজ দেখিয়া তাহার মনে হইল, বুঝি এইবারেই তাহার প্রাণ যায়। সে সময়ে দেবতা, অসুর প্রভৃতি সকলে রাম রাবণের যুদ্ধ দেখিবার জন্য আকাশে উপস্থিত। অসুরেরা বলে, ‘রাবণের জয় হউক!’ দেবতারা বলেন, ‘রামের জয় হউক!’

 এদিকে রাবণ আগুনের মত তেজাল তিনমুখো একটা শূল ছুঁড়িয়া রামকে বলিল, ‘এইবার তুই মরিবি!’ কিন্তু রাম আর এক শূলে সেই শূল কাটিয়া, তারপর হাজার হাজার বাণে তাহাকে এমনি নাকাল করিয়া ফেলিলেন যে সে আর ধনুকখানিও ধরিয়া থাকিতে পারে না। তখন রাম দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন, আর তাহার সারথি রথ ফিরাইয়া লঙ্কায় পলাইয়া গেল।

 লঙ্কায় আসিয়া একটু সুস্থ হওয়ামাত্রই রাবণ সারথিকে গালি দিতে আরম্ভ করিল, ‘ওরে নির্বোধ, তুই কি ভাবিয়াছিস আমার গায়ে জোর নাই? না কি আমার সাহস কম? দেখ ত হতভাগা, কি করিলি? রথ লইয়া পলাইয়া আসিলি, এখন লোকে আমাকে বলিবে কি?’

 সারথি বলিল, ‘মহারাজ আপনার পরিশ্রম হইয়াছে আর ঘোড়াগুলিও বড় কাহিল। তাই একটু বিশ্রামের জন্য এখানে আসিয়াছি। এখন যেমন অনুমতি করেন তাহাই করি।’ এ কথায় রাবণ খুশি হইয়া সারথিকে হাতের বালা পুরস্কার দিয়া বলিল, ‘শীঘ্র যুদ্ধেব জায়গায় চল্। শত্রুকে না মারিয়া আমি ঘরে ফিরিব না!’ কাজেই সারথি আবার যুদ্ধের জায়গায় রথ ফিরাইয়া আনিল।

 এবারে যে যুদ্ধ হইল তাহাই শেষ যুদ্ধ। কিন্তু রাবণ সহজে মরে নাই। মাথা কাটিলেও যে মরিতে চাহেনা, তাহাকে মারা সহজ কি করিয়া হইবে? এক-একবার রাবণের মাথা কাটা যায়, আবার তখনই তাহার জায়গায় আর-একটা মাথা উঠে। এইরূপ করিয়া রাম একশত বার তাহার মাথা কাটিলেন, কিন্তু তাহাতেও তাহার মৃত্যু হইল না।

 তখন মাতলি রামকে বলিল, আপনি ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়ুন, নিশ্চয় রাবণ মরিবে। এই অস্ত্র রাম অগস্ত্য মুনির কাছে পাইয়াছিলেন; ইহার সমান অস্ত্র আর জগতে নাই।

 সে অস্ত্র ধনুকে জুড়িবার সময় পৃথিবী অবধি কাঁপিত লাগিল, জীবজন্তুরা ত ভয় পাইতেই পারে। সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্র ছুঁড়িবামাত্রই তাহা রাবণের বুক ভেদ করিয়া একেবারে মাটির ভিতরে ঢুকিয়া গেল। এবার রাবণের মৃত্যু আটকায় কার সাধ্য! মাথা কাটা গেলেও তাহার মাথা যোড়া লাগিয়াছিল, কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের ঘা খাইয়া আর তাহাকে বাঁচিয়া থাকিতে হইল না। যে রাবণের তেজে দেবতারা পর্যন্ত অস্থির, সেই রাবণকে মুহূর্তের মধ্যে বধ করিয়া, রামের অস্ত্র তাঁহার তূণে ফিরিয়া আসিল।

 রাবণের মৃত্যুতে সকলে কিরূপ সুখী হইল, বানরেরা কিরূপ লাফালাফি করিল আর লেজ নাড়িল, দেবতারাই বা কেমন করিয়া দুন্দভি বাজাইলেন আর পুষ্পবৃষ্টি করিলেন, সেসকল আর বেশি করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। তখন যে একটা আনন্দের ঘটা হইয়াছিল, তাহা সহজেই মনে করিয়া লইতে পারি।

 অবশ্য রাক্ষসেরা রাবণের জন্য অনেক দুঃখ করিয়াছিল। যে বিভীষণ তাহার নিকট অপমান পাইয়া এত রাগের ভরে চলিয়া আসিয়াছিল, সে বিভীষণও কি কাঁদে নাই? বিভীষণই সকলের আগে কাঁদিয়াছিল। হাজার হউক, ভাই ত! রাগ যতই থাকুক, রাবণের মৃত্যুতে তাহা ভুলিয়া গিয়া সে কাঁদিয়া অস্থির হইল। রাম তাহাকে অনেক বুঝাইয়া শান্ত করিলেন।

 আহা! লঙ্কার রাণীরা তখন কি কাতর হইয়াই কাঁদিয়াছিল, সে কান্না শুনিলে বুঝি পাথরও গলিয়া যায়। তাহাদের ত আর কোন দোষ ছিল না; কাজেই তাহাদের দুঃখে কাহার না দুঃখ হইবে? তাহাদিগকে শান্ত করিবার ক্ষমতা কাহারও হইল না। শেষে তাহারা নিজেরাই একে অন্যকে বুঝাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া রাম বিভীষণকে বলিলেন, ‘ইহাদের দুঃখ আমি আর সহিতে পারিতেছি না; শীঘ্র রাবণকে পোড়াইবার আয়োজন কর।’

 তখন সকলে মিলিয়া রাবণকে রেশমী পোশাকে সাজাইয়া, সোনার পাল্কিতে করিয়া, শ্মশানে লইয়া গেল। সেখানে চন্দনকাঠের চিতায় অনেক জাঁকজমকের সহিত তাহাকে পোড়ানো হইল। তারপর রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করিলেন।

 তখন সকলে সীতার কথা বলিবার সময় হইয়াছে। দুঃখিনী সীতা এখনও সেই ময়লা কাপড়খানি পরিয়া, বিনা স্নানে, এলো চুলে, চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে অশোক বনে দিন কাটাইতেছেন। তাঁহার দুঃখের সময় কখন ফুরাইযাছে, তাহা তিনি জানিতেও পারেন নাই। এমন সময় হনুমান আসিয়া প্রণাম করিয়া, তাঁহাকে রাবণের মৃত্যুসংবাদ দিল।

 সুখ বা দুঃখ বেশি হইলে লোকে ব্যস্ত হইয়া উঠে। কিন্তু সেই সুখ বা দুঃখ যদি নিতান্তই বেশি রকমের হয়, তবে প্রায়ই ব্যস্ত হইবাব অবসর থাকে না। তখন লোকে কেমন হতবুদ্ধির মত হইয়া যায়। হনুমানের কথা শুনিয়া, সীতাও অনেকক্ষণ সেইরূপ হইয়া রহিলেন। তারপর একটু সুস্থ হইয়া হনুমানকে বলিলেন, ‘বাছা, যে সংবাদ তুমি দিলে, আমি দীন দুঃখিনী তাহার উপযুক্ত পুরস্কার কি দিব?’

 কিন্তু হনুমান পুরস্কাবের ধার ধারে না। সীতা যে সুখী হইয়াছেন ইহাই তাহার পক্ষে ঢের, সে আর কিছু চাহে না। তবে, একটা কাজ করিতে পারিলে তাহার মনটা আরও খুশি হইত। দুষ্ট রাক্ষসীরা সীতাকে কিরূপ কষ্ট দিত তাহা সে নিজের চক্ষে দেখিয়াছে। সেই রাক্ষসীগুলির ঘাড় ভাঙিতে হনুমানের বড়ই ইচ্ছা ছিল। সীতার অনুমতি পাইলে, সে ইহাদের কি দশা করিত তাহা সে-ই জানে!

 কিন্তু সীতার প্রাণে এতই দয়া যে যাহারা তাঁহাকে এত কষ্ট দিয়াছে, তাহাদিগকেও কোনরূপ কষ্ট দিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না। তাই তিনি হনুমানকে বলিলেন, ‘বাছা এমন কাজ করিও না! উহারা গরিব লোক, যাহা করিয়াছে রাবণের হুকুমেই করিয়াছে আসলে উহাদের কোন দোষ নাই।’

 তারপর সীতা রামের নিকট আসিতে প্রস্তুত হইলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, যেরূপ আছেন ঠিক সেইরূপ মলিন বেশেই তিনি রামের কাছে আসেন। কিন্তু সকলে তাঁহাকে স্নান করাইয়া, সুন্দর কাপড় আর অলঙ্কার পরাইয়া দিল। এতদিন পরে রামকে দেখিয়া তাঁহার মনে না জানি কতই সুখ হইয়াছিল। কিন্তু হায়! সে সুখ তাঁহার অধিকক্ষণ রহিল না।

 সীতা আসিলে রাম তাঁহাকে বলিলেন, ‘সীতা, তুমি রাক্ষসদিগের সঙ্গে এতদিন ছিলে। এখন তুমি আমাদিগকে আগেকার মতন ভালবাস কি না তা কি করিয়া বলিব? আমি রাবণকে মারিয়া তাহার উচিত শাস্তি দিয়াছি। এখন তোমার যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে চলিয়া যাও।’

 সীতা কত দুঃখই সহিয়াছেন, কিন্তু রামের এই কথায় তাঁহার মনে যে দুঃখ হইল, সে দুঃখ আর তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, ‘হায় হায়, আমার আর বাঁচিয়া কি কাজ? লক্ষ্মণ, আগুন জ্বালিয়া দাও, আমি তাহাতে পুড়িয়া মরিব?’

 তখন লক্ষ্মণ রাগে আর দুঃখে চিতা প্রস্তুত করিয়া আগুন জ্বালিয়া দিলেন, আর সেই আগুনে সীতা ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন।

 আহা! সংসারের সকল সুখ দিলেও যে সীতার গুণের পুরস্কার হয় না, যাঁহার দুঃখ দূর করিবার জন্য এত জনের প্রাণ দিতে হইল, সেই সীতার কিনা শেষে এই দশা!

 কিন্তু কি আশ্চর্য! আগুনে সীতার মাথার একগাছি চুলও পুড়িল না। সকলে অবাক হইয়া দেখিল যে নিজে দেবতা অগ্নি সীতাকে কোলে করিয়া, চিতা হইতে উঠিয়া আসিতেছেন। সীতা দেখিতে সকালবেলার সূর্যের ন্যায় উজ্জল;তাঁহার পরনে লাল কাপড়, গায় অলঙ্কার, গলায় মালা। অগ্নি সীতাকে রামের কাছে দিয়া বলিলেন, ‘সীতার কোন দোষ নাই।’ তখন রাম মনের সুখে পরম আদরের সহিত সীতাকে লইলেন।

 এদিকে রাম সীতাকে দেখিবার জন্য দেবতারা সকলে উপস্থিত হইয়াছে। তাঁহাদের সঙ্গে দশরথও আসিয়াছেন। দশরথকে দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ প্রণাম করিলেন। দশরথ রামকে আদর করিয়া বলিলেন, ‘বাছা, স্বর্গে বড় সুখে আছি, কেবল কৈকেয়ীর সেই কথাগুলি মনে হইলে আজও খুব কষ্ট হয়। আজ তোমাদিগকে দেখিয়া আমার সে কষ্ট দূর হইল। আমার জন্য তুমি এতদিন বনে থাকিলে, আর রাবণকে মারিয়া দেবতাদের উপকার করিলে এখন দেশে গিয়া সুখে রাজত্ব কর।’

 রাম হাতযোড় করিয়া দশরথকে বলিলেন, ‘বাবা, মা কৈকেয়ী আর ভাই ভরতের উপর আপনার যদি রাগ থাকে, তবে তাহা দূর করুন।’ রামের এই কথায় দশরথ সম্মত হইয়া রাম সীতা আর লক্ষণকে আশীর্বাদ করিয়া স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 দশরথ চলিয়া গেলে পর ইন্দ্র রামকে বলিলেন, ‘রাম, আমরা তোমার উপর সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি বর লও।’

 রাম বলিলেন, ‘তবে আমাকে এই বর দিন যে আমার উপকার করিতে আসিয়া, যেসকল বানর মরিয়াছে তাহারা আবাব বাঁচিয়া উঠুক। আর তাহাদের দেশের গাছে অনেক ফল আর নদীতে অনেক জল হউক।’

 ইন্দ্র বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে।’ এই কথা শেষ হইতে না হইতেই, যত বানর যুদ্ধে মরিয়াছিল সকলেই আবার উঠিয়া বসিল—যেন এইমাত্র তাহাদের ঘুম ভাঙিয়াছে।

 তারপর দেবতারা রাম লক্ষ্মণকে আদর করিয়া বলিলেন, ‘এখন তোমরা মনের সুখে অযোধ্যায় চলিয়া যাও। সেখানে সকলেই তোমাদের জন্য দুঃখিত রহিয়াছে। আর সীতাও অনেক কষ্ট পাইয়াছে, তাহাকে শান্ত কর।’ এই বলিয়া দেবতারা আবার স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 ততক্ষণে সন্ধ্যা হইয়াছিল; কাজেই রাম সকলকে বিশ্রাম করিতে বলিলেন। সে রাত্রি সকলের কি সুখেই কাটিল! এমন সুখের রাত্রি খুব কমই হইয়া থাকে।

 রাবণ মরিল, বনবাসেরও দিন ফুরাইয়া আসিল। এখন অযোধ্যায় ফিরিবার সময়। তাহা দেখিয়া বিভীষণ রামকে বলিল, ‘আমার ভাই রাবণ কুবেরের পুষ্পক রথখানি কাড়িয়া আনেন। এখন সেই রথ আপনারই। এই রথে এক দিনেই অযোধ্যায় যাইতে পারিবেন। কিন্তু আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আর একটি দিন আমার এখানে থাকিয়া যাউন।’

 রাম বলিলেন, ‘বন্ধু বিভীষণ, তুমি আমার অনেক উপকার করিয়াছ। কিন্তু ভাই ভরত, মা কৌশল্যা, সুমিত্রা আর কৈকেয়ী প্রভৃতিকে দেখিবার জন্য আমার মন বড়ই ব্যস্ত হইয়াছে। তুমি দুঃখ করিও না। আমি আর একদিনও থাকিতে পারিতেছি না, আমাকে এখনই বিদায় দাও।’ তখন সারথি পুষ্পক রথ সাজাইয়া আনিল। রাম সীতা আর লক্ষ্মণের সহিত তাহাতে উঠিয়া, বিভীষণ, সুগ্রীব আর অন্যান্য বানর দিগের নিকট বিদায় চাহিলেন।

 তাহারা সকলে হাতযোড় করিয়া বলিল, ‘দয়া করিয়া আমাদিগকে আপনার সঙ্গে লউন। আমরা অযোধ্যায় গিয়া আপনার অভিষেক দেখিব, আর মা কৌশল্যাকে প্রণাম করিব।’ এই কথায় রাম যার-পর-নাই সুখী হইয়া বলিলেন, ‘তবে তোমরা শীঘ্রই রথে উঠ।’

 তাহারাও রথে উঠিতে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। সুগ্রীব উঠিল, বিভীষণ সপরিবারে উঠিল, অন্যান্য বানরেরা সকলে উঠিল—তাহাদের আনন্দের আর সীমা নাই। তাহাদের সকলকে লইয়া সেই হাঁসে-টানা পুষ্পক রথ শোঁ-শোঁ শব্দে আকাশে উড়িয়া চলিল।

 রথ কিষ্কিন্ধ্যায় আসিলে পর সীতা রামকে বলিলেন, ‘আমার বড় ইচ্ছা হইতেছে যে বানরদিগের বাড়ির মেয়েদিগকে সঙ্গে করিয়া অযোধ্যায় লইয়া যাই। সুতরাং কিষ্কিন্ধ্যার মেয়েরাও অনেকে পুষ্পক রথে উঠিয়া তাঁহাদের সঙ্গে অযোধ্যায় চলিল।

 এইরূপে ক্রমে তাঁহারা ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে রামের বনে থাকার চৌদ্দ বৎসর ফুরাইল।

 রামকে দেখিয়া ভরদ্বাজ বলিলেন, ‘বাছা, যাইবার সময় তোমাকে দেখিয়া আমার মনে যেমন ক্লেশ হইয়াছিল, আজ তোমাকে আবার দেখিয়া আমার মনে তেমনই আনন্দ হইতেছে। তুমি বর লও।’ রাম বলিলেন, ‘এই বর দিন যে অযোধ্যার পথে সকল গাছে যেন মিষ্ট ফল আর মধু পাওয়া যায়।’

 মুনির বরে তখনই অযোধ্যার পথের গাছ সকল মিষ্ট ফলে আর মধুতে ভরিয়া গেল। বানরেরা কত খাইবে!

 তারপর হনুমানকে ডাকিয়া রাম বলিলেন, ‘হনুমান, তুমি শীঘ্র অযোধ্যায় যাও। সেখানে আমাদের সংবাদ দিবে আর সেখানকার সংবাদও লইয়া আসিবে। পথে শৃঙ্গবের নগরে আমার বন্ধু গুহ থাকেন, তাঁহাকে আমার কথা বলিও। তিনি তোমাকে অযোধ্যার পথ বলিয়া দিবেন।’

 হনুমান তখনই মানুষের বেশ ধরিয়া শোঁ-শোঁ শব্দে আকাশে চলিল। পথে গুহের দেশ। সেখানে রামের সংবাদ দিয়া ভরতের নিকট পৌঁছিতে, তাহার অধিক সময় লাগিল না।

 ভরত তখন নন্দীগ্রামে ছিলেন। অযোধ্যা হইতে এক ক্রোশ দূরে হনুমান তাঁহার দেখা পাইল। তাঁহারও তপস্বীর বেশ, মাথায় জটা আর পরিধানে গাছের ছাল। ফল-মূল খাইয়া থাকেন আর রামের খড়ম দুইখানিকে সম্মুখে রাখিয়া রাজ্যের কাজ করেন।

 হনুমান তাঁহার কাছে আসিয়া হাত যোড় করিয়া বলিল, ‘আপনারা যে রামের জন্য এত দুঃখ করিতেছেন, সেই রাম আপনাদের সংবাদ লইবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন। আর দুঃখ করিবেন না, শীঘ্রই তিনি সকলকে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইবেন।’

 এই কথা শুনিয়া ভরত আনন্দে অজ্ঞান হইয়া গেলেন। সুস্থ হইলে পর তিনি হনুমানকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘তুমি দেবতা না মানুষ, দয়া করিয়া আমার এখানে আসিয়াছ? আজ তুমি যে সংবাদ আমাকে শুনাইলে, তাহার উপযুক্ত পুরস্কার আমি তোমাকে কি দিব? তুমি এক লক্ষ গরু আর একশতখানি গ্রাম লও!’

 তারপর হনুমান কুশাসনে বসিয়া রামের সকল সংবাদ ভরতকে শুনাইয়া, শেষে বলিল, ‘তিনি এখন ভরদ্বাজের আশ্রমে আছেন। কাল এইখানে আসিবেন।’

 আজ যদি পৃথিবীতে সুখী কেহ থাকে, তবে সে এই অযোধ্যার লোক। সুখী কেন হইবে না? চৌদ্দ বৎসর ধরিয়া যে রামের দুঃখে তাহারা চক্ষের জল ফেলিয়াছে ভাল করিয়া খায় নাই, ভাল কাপড় পরে নাই, সেই রাম এতদিনে দেশে ফিরিতেছেন। তাই আজ সকলে পথঘাট পরিষ্কার করিয়া, বাড়ি ঘর সাজাইয়া, নিশান উড়াইয়া, বাজনা বাজাইয়া রামকে দেখিতে চলিল। পাল্কি চড়িয়া রাণীরা চলিলেন, ব্রাহ্মণ প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া ভরত চলিলেন—তাঁহার মাথায় রামের সেই খড়মজোড়া।

 যেই রামের রথ দেখা গেল, অমনি সকলে ‘ঐ রাম!’ শব্দে আকাশ ফাটাইয়া দিল।

 তখন যে সকলের মনে খুবই আনন্দ হইয়াছিল, তাহাতে আর সন্দেহ কি? আর, সকলেই তখন যে রামকে প্রাণ ভরিয়া আদর করিবার জন্য ব্যস্ত হইবে, তাহাও আশ্চর্য নহে। যাহারা তাঁহার চেয়ে ছোট, তাহারা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া আশীর্বাদ লইল। রামও মা কৌশল্যা আর অন্যান্য রাণীদিগকে আর বশিষ্ঠ প্রভৃতি গুরুজনকে প্রণাম করিলেন।

 তারপর ভরত রামের সেই খড়মজোড়া তাঁহার পায়ে পরাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘দাদা, তোমার রাজ্য আমাকে রাখিতে দিয়া গিয়াছিলে, এখন তাহা তুমি ফিরাইয়া লও। তোমার রাজ্য এখন আগের চেয়ে দশগুণ বড় হইয়াছে।’

 তারপর ক্ষুর হাতে ভাল ওস্তাদ নাপিতেরা আসিয়া রামের চৌদ্দ বছরের জটা চাঁছিয়া পরিষ্কার করিল। শত্রুঘ্ন রাম লক্ষ্মণকে স্নান করাইয়া নিজ হাতে তাঁহাদিগকে সাজাইয়া দিলেন। সুগ্রীব, বিভীষণ প্রভৃতি আর যত লোক সঙ্গে আসিয়াছিল, কাহারও আদর যত্নের কোন ত্রুটি হইল না। নিজে মা কৌশল্যা যখন বানরের মেয়েদিগকে সাজাইলেন তখন কিরূপ আদর-যত্ন হইল বুঝিতেই পার।

 অবশেষে বশিষ্ঠ প্রভৃতি মুনিরা রাম সীতাকে মাণিকের পিঁড়ির উপর বসাইয়া তাঁহাদের অভিষেক করিলেন। সে অভিষেক কি চমৎকার হইয়াছিল, তাহা কি না দেখিলে বঝিতে পারা যায়? দেবতারা পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন, অন্য কথায় আর কাজ কি?

 যত ভাল ভাল তীর্থ আছে সকল তীর্থের জল দিয়া রামকে স্নান করানো হইল। স্নানের পর রাম রাজবেশে রত্নের পিঁড়িতে সভা আলো করিয়া বসিলেন। তাঁহার মাথায় সেই মনুর সময় অবধি যাহা অযোধ্যার রাজারা মাথায় দিয়া আসিতেছে, সেই আশ্চর্য মুকুট। দুই পাশে সাদা চামর হাতে সুগ্রীব আর বিভীষণ; পিছনে সাদা ছাতাখানি লইয়া শত্রুঘ্ন। তখন ইন্দ্রের হুকুমে পবন আসিয়া তাঁহার গলায় স্বর্গের সোনার পদ্মের মালা আর আশ্চর্য মোতির হার পরাইয়া দিলেন।

 এইরূপ করিয়া দেবতা গন্ধর্বের গান আর আনন্দ-কোলাহলের ভিতরে রাম অযোধ্যার রাজা হইলেন। তেমন রাজা আর কেহ কখনও দেখে নাই। আজও খুব ভাল রাজার কথা বলিতে হইলে লোকে বলে, ‘রামের মতন রাজা!’