উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/অন্ধদের বই পড়া

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

অন্ধদের বই পড়া

 ডাক্তার মুনের নাম অনেকে শুনিয়াছেন। ১৮৩৫ সালে ইনি অন্ধ হন। সে আজ পঞ্চাশ বছরের কথা। এত কাল ইনি অন্ধদের জন্য খাটিয়াছেন, বিশেষত কিরূপ অক্ষরে পুস্তক ছাপা হইলে তাহাদের পক্ষে বেশি সুবিধা, তাহার সম্বন্ধে অনেক চিন্তা করিয়াছেন।

 অন্ধেরা কিরূপে পড়িতে পারে, এ কথা কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পার। যাহাদের চোখ নাই, তাহারা যে আমাদের মতো চোখের সাহায্যে পড়িতে পায় না, এ কথা সহজেই বুঝা যায়। অন্ধেরা হাতের সাহায্যে পড়ে। প্রায়ই দেখা যায় যাহাদের একটা শক্তি নাই, আরেকটা শক্তি তাহাদের খুব প্রখর হয় আর তা হওয়াও স্বাভাবিক, একটা শক্তি না থাকিলে অপর একটার দ্বারা তাহার কাজ চালাইতে হয়, কাজেই সেটার চালনা খুব বেশি হয়। চালনার দ্বারা শক্তি বাড়ে।

 কোন জিনিসটা কিরূপ পরীক্ষা করিতে হইলে, তাহার উপর হাত বুলাইয়া দেখ। এইরূপ ক্রমাগত হাত বুলাইয়া তাহাদের স্পর্শ শক্তিটা আমাদের চাইতে অনেক প্রখর হয়। অন্ধকে মুখে হাত বুলাইয়া মানুষ চিনিতে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আমরা তাহাতে পারিনা, কারণ আমাদের স্পর্শ শক্তি তেমন চালনা হয় নাই। অক্ষর যদি কালিতে লেখা না হইয়া খোদা হয়, তবে অন্ধ তাহাতে হাত বুলাইয়া, সহজেই তাহার চেহারাটা মনে করিয়া লইতে পারে। অক্ষরগুলি খোদা না হইয়া, উঁচু হইলে আরো সুবিধা হয়।

 অন্ধদের পুস্তকের অক্ষর সব উঁচু-উঁচু। অন্ধরা তাহাতে হাত বুলাইয়া বেশ পড়িয়া যাইতে পারে। তবে আমরা যেমন ছোট-ছোট অক্ষর পড়িতে পারি, অন্ধেরা তাহা পারে না। তাহাদের খুব বড়-বড় অক্ষরের দরকার হয়। তোমাদের জন্যে যেমন ‘সখা ও সাথী’ বাহির হইয়াছে, অন্ধদের জন্য ইহারা ষোলো-সতেরো খানার মতন এক-একখানা ‘সখা ও সাথী’ বাহির করিলে, তবে ইহার সকল কথা তাহাতে ধরিত।

 অন্ধদের জন্য নানাপ্রকার লিখিবার প্রণালী বাহির হইয়াছে। মুন সাহেব সেগুলির দোষগুণ বিচার করিয়া, তার চাইতে অনেক সহজ উপায় স্থির করিয়াছেন। এই নূতন উপায়ে এখন বিস্তর ছাপা হইতেছে। তোমরা স্কুলে যতরকম বই পড়, তাহার সবই এখন অন্ধরা পড়িতে পারে—তোমাদের অঙ্ক, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, ইত্যাদি সব। অন্ধেরা ম্যাপ দেখে, ছবি দেখে, স্বরলিপি দেখিয়া গান শিখে, সব ঐরূপে উঁচু-উঁচু করিয়া লেখা। তোমরা চোখে দেখ, তাহারা হাত বুলাইয়া দেখে।

 অন্ধদের জন্য যে ছবি প্রস্তুত করা হয়, তাহা তোমাদের ছবির মতো নহে। তাহাদের কোনোরকম রঙ নাই, একটি কালো লাইন পর্যন্তও নাই। যাহারা জন্মান্ধ তাহারা তো কখনো রঙ দেখে নাই, সুতরাং তাহা যে কেমনতর তাহা তাহারা মনেও করিতে পারে না। এ সম্বন্ধে মুন সাহেব যে গল্প বলিয়াছেন, তাহা বলিয়া আমার এই প্রস্তাব শেষ করিব।

 লিখিবার সময়ে আমরা যেমন লাইনের পর লাইন বাম দিক হইতে আরম্ভ করিয়া ডাইনে শেষ করি, অন্ধদের তাহাতে ভারি অসুবিধা হয়। ওরূপ লেখা পড়িতে তাহারা সহজেই পথ হারাইয়া ফেলে। অন্ধদের লাইন একটি আমাদের লাইনের মতন বাম হইতে ডাইনে, তার পরেরটি পারসীর মতন ডান হইতে বামে, তার পরটি আবার বাম দিক হইতে ডাইনে, এইরূপ করিয়া লেখা হয়। এরূপ হইলে, যেখানে একটি লাইন শেষ হইল, সেইখানেই আরেকটি লাইনের গোড়া পাওয়া গেল, খুঁজিয়া বেড়াইবার আর দরকার হয় না। মুন সাহেবের সেই গল্প আমরা অন্ধদিগের কায়দায় লিখিতেছি। মুন সাহেব বলিতেছেন—

‘অন্ধ হইবার পূর্বে আমার কুড়ি বৎসর বয়স হইয়াছিল, তাই কোন কিরকম চেহারা বাড়ির, দেখাইত কেমন সব জন্তু মানুষ ছিল কেমন রঙটা ছিল, সবই আমার বেশ মন আছে; কিন্তু আমি একটি মেয়েকে জানিতাম, পা চারি ঘোড়ার যে করিত মনে সে। ছিল অন্ধ অবধিই জন্মিয়া সে তাহার দুটিতে ভর করিয়া সে চলে। আর দুটিকে আমাদের হাতের মতন, করিবার প্রস্তুত ছবি জন্য অন্ধদিগের হইতেই ইহা। রাখে তুলিয়া করিয়া কথা আমার মনে হয়। আমি আমাদের বই লেখার মতন করিয়া উঁচু মেয়েটি অন্ধ সেই। করিলাম প্রস্তুত ছবি বাড়ির একটি দিয়া লাইন প্রথমে মনে করিল সেটা একটা জন্তু, সে কিনা পৃথিবীর কোনো জিনিসই আর সঙ্গে তাহার কিন্তু। করিয়াছিল মনে ওরূপ তাই নাই দেখে কখনো একজন ছিলেন, তিনি অল্পদিন যাবৎ অন্ধ হইয়াছেন। তিনি ছবি খানির একটা এযে মেয়ে বোকা! লিজি উঠিলেন বলিয়া বুলাইয়াই হাত উপর বাড়ি, বেশ বড় বাড়ি।’

সখা ও সাথী—১৩০১