উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আকাশের কথা : ৪

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

আকাশের কথাঃ ৪

 নক্ষত্রগুলিকে হঠাৎ দেখিলে মনে হয়, যেন উহাদের সংখ্যা নাই, কিন্তু একটু মনোযোগ করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবে যে, প্রথমে যত বেশি বলিয়া মনে হয়, বাস্তবিক তত বেশি নক্ষত্র আমরা দেখিতে পাইনা।

 শুধু চোখে যাহা দেখা যায়, তাহার কথাই বলিতেছি দূরবীন দিয়া যাহা দেখা যায়, তাহার কথা নহে। যাহাদের দৃষ্টি খুব প্রখর, তাহারও একবারে চার-পাঁচ হাজারের বেশি নক্ষত্র দেখিতে পায় না। চার-পাঁচ হাজার নক্ষত্র আর তেমন একটা বেশি কি? ইহাদিগকে গণিয়া, চিনিয়া, আঁকিয়া খাতায় লিখিয়া কবে শেষ করা হইয়াছে। একখানা সাধারণ বড় ম্যাপে গ্রামগুলি যেমন ঘেঁষাঘেঁষি থাকে, আকাশে নক্ষত্র সকলকে তাহার চাইতে বরং কম ঘেঁষাঘেঁষি দেখা যায়।

 আমাদের সূর্যও যে একটা নক্ষত্র, এ কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সূর্য আমাদের এত কাছে বলিয়াই তাহার এত সম্মান। কিন্তু ঐ নক্ষত্রগুলির ভিতরে এর চাইতে ঢের বড় বড় সূর্য আছে। উহাদের একটা আমাদের কাছে আসিলে, আমরা হয়তো পুড়িয়াই মরিতাম। আর, আমাদের সূর্য ঐ নক্ষত্রগুলির কাছে গেলে, হয়তো আমরা তাহাকে দেখিতেই পাইতাম না।

 জিনিস যত দূরে থাকে, ততই ছোট দেখায়। থালাখানাকে দূরে লইয়া গেলে, তাহা রেকাবীখানার মতন দেখায়। আরো দূরে নিলে হয়তো টাকাটির মতন দেখাইবে। এইরূপে তাহাকে যত দূরে লইয়া যাওয়া যায়, ততই সে ক্রমে আধুলিটির মতন, তারপর সিকিটি, তারপর দুয়ানিটি, তারপর আলপিনের মাথাটির মতন ছোট হইয়া, শেষে একেবারেই অদৃশ্য হইয়া যাইবে। এক ফুট চওড়া থালাখানাকে এক মাইল দূরে লইয়া গেলে, তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় না। মোটামুটি বলিতে গেলে, যে জিনিস যত লম্বা চওড়া, তাহার পাঁচ হাজার গুণ দূরে লইয়া গেলে, তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় না।

 ইহার মধ্যে একটা কথা আছে। এক ফুট চওড়া থালাখানিকে এক মাইল দূর হইতে দেখিতে পাইবে না;কিন্তু একটি উজ্জ্বল আলো জ্বলিলে তাহাকে এক মাইলের চাইতে ঢের বেশি দুর হইতেও দেখা যায়। তখন আমরা যে বাস্তবিকই আলোর শিখাটা অবধি দেখিতে পাই তাহা নহে; আমরা উহার ঝিকিমিকিটুকু মাত্র দেখি। আলোকের শিখাটি সে অদৃশ্য হইয়া যাইবে; তারপর যাহা দেখিব, সে কেবল উহার জ্যোতি-আসল জিনিসটা নহে।

 নক্ষত্রগুলিকেও আমরা এইরূপই দেখি। শুধু চোখে দেখিলে হয়তো অনেক সময় মনে ভ্রম হইতে পারে যে, বুঝিবা উহাদের একটা কোনরূপ চেহারা দেখা যাইতেছে। কিন্তু দূরবীন দিয়া দেখিলে, ঐ ভ্রমটুকু চলিয়া যায়। দূরবীন দিয়া উহাদের কোনোরূপ চেহারা দেখা যাওয়া দূরের কথা, বরং দুরবীন যত ভালো হয়, তাহা দিয়া তারাগুলিকে ততই ছোট দেখা যায়। আরো ছোট বোধ হইবে! ছোট বটে, কিন্তু বেশি উজ্জ্বল।

 কথাটা নিতান্ত সামান্য হইল না। এই-সকল নক্ষত্রকে যদি আমাদের সূর্যের সমান মনে করা যায়, তবে একবার ভাবিয়া দেখ দেখি, উহারা কত দূরে!

 আমাদের সূর্য সাড়ে আটলক্ষ মাইলেরও বেশি চওড়া। এত বড় জিনিসটাকে অদৃশ্য করিতে হইলে, তাহাকে অন্তত চারিশত পঁচিশ কোটি মাইল দূরে লইয়া যাইতে হয়। এত দূরে লইয়া গেলে, শুধু চোখে তাহার খালি জ্যোতিটুকু ভিন্ন আর কিছুই দেখা যাইবে না। কিন্তু দূরবীন দিয়া দেখিলে তখনোও তাহাকে একটা মস্ত গোলার মতন দেখা যাইবে।

 ঐ নক্ষত্রগুলি এত দূরে যে, দূরবীন দিয়াও তাহাদিগকে কিছুমাত্র বড় দেখা যায় না। বড়বড় দুরবীনগুলি দূরের জিনিসকে তিনহাজার গুণ নিকটে আনিয়া দেখাইতে পারে, কিন্তু তাহারাও নক্ষত্রগুলিকে কিছুমাত্র লম্বা চওড়া দেখাইতে পারেনা। সুতরাং উহারা যে চারিশত পঁচিশ কোটি মাইলের অন্তত তিনহাজার গুণ বেশি দূরে, এ কথা স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে। কিন্তু বাস্তবিক, উহারা ইহার চাইতেও কত বেশি দূরে আছে, তাহা কে বলিতে পারে? যত দুর দেখা গিয়াছে তাহাতে উহারা যে ইহারও অনেক বেশি দূরে তাহাই প্রমাণ হয়।

 নক্ষত্রগুলি কত দূরে, তাহা মাপিবার চেষ্টা হইয়াছে। এরূপ প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে হইলে, ভয়ানক শক্ত শক্ত অঙ্ক কষিবার দরকার হয়। সে-সকল অঙ্কের কথা আমাদের বুঝিবার সাধ্য নাই, কিন্তু অঙ্ক কষিয়া কি ফল পাওয়া গেল, তাহা জানিতে ইচ্ছা হইতে পারে। যে তারাটা খুব কাছে—সেই যেখানে কিছুদিন আগে আমাদের চিঠি পাঠাইবার কথা হইতেছিল— সে তারাটাও সূর্যের চাইতে প্রায় ২৭১৪০০ দুই লক্ষ একাত্তর হাজার চারিশত গুণ দূরে। ইহার চাইতেও কাছে কোনো নক্ষত্র আছে কিনা, তাহা বলা যায় না। কিন্তু আর প্রায় সকল নক্ষত্রই ইহার চাইতে বেশি দূরে। অনেকগুলি নক্ষত্রই এত দূরে যে, তাহারা কত দূরে, তাহা এ পর্যন্ত কেহ অনুমানও করিতে পারে নাই।

 যে নক্ষত্রটাকে বেশি উজ্জ্বল দেখা যায়, আমরা হয়তো মনে করিতে পারি যে, তাহা আমাদের বেশি কাছে। কিন্তু ইহা ভুল। এ কথা যদি ঠিক হইত, তাহা হইলে সিরিয়স অন্যান্য সকল নক্ষত্রের চাইতে আমাদের বেশি নিকটে হইত। কিন্তু সূর্য আমাদের এখান হইতে যত দুরে, সিরিয়স্ তাহার চাইতে দশলক্ষ গুণ বেশি দূরে। আমাদের সূর্যকে ওখানে লইয়া গেলে, তাহার নিতান্তই দূরবস্থা হইত! সিরিয়সের মতন এত উজ্জ্বল তো তাহাকে দেখা যাইতই না, বরং তাহাকে নিতান্ত মিটমিটে একটা ছোট তারা বলিয়াই মনে হইত।

 সিরিয়স যে কত বড় সূর্য, এ কথা হইতে তাহা কতক বুঝা যাইতেছে। গণিয়া দেখ গিয়াছে যে, উহা সূর্যের চাইতে যেমন আকারে বড়, তেমনি আবার তুলনায় উজ্জলও অনেক বেশি। আমাদের সূর্যের মতন কুড়িটা সূর্য একসঙ্গে করিলে, সিরিয়সের মতন বড় একটা সূর্য হয়, কিন্তু আমাদের সূর্যের মতন আটচল্লিশটা সূর্যের কমে সিরিয়সের মতন আলো দিতে পারিবে না।

 এই সিরিয়সের আবার একটা সঙ্গী আছে, সেটাও প্রায় সাতটা সূর্যের মতন বড়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উহার আলো নিতান্তই কম। এইজন্যই খুব ভালো দুরবীন না হইলে, উহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না। সূর্য হইতে পৃথিবী যত দূরে, সিরিয়স হইতে তাহার সাঁইত্রিশ গুণ দূরে থাকিয়া সিরিয়সের এই সঙ্গীটি তাহার চারিদিকে ঘুরিতেছে। আমাদের উনপঞ্চাশ বৎসরে উহার একটি বৎসর হয়। এই সঙ্গীটিকেসুদ্ধ সিরিয়স নিজে মিনিটে একহাজার মাইল করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে অথচ আমরা শুধু চোখে দেখিয়া উহাকে স্থিরই মনে করিতেছি।

 শুধু চোখে যাহা দেখা যায়, তাহার কথা বলিতে গিয়া, আমরা এমন সকল কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছি যে, তাহার খবর দূরবীন ভিন্ন পাওয়া যায় না। বাস্তবিক ইহার পূর্বে দূরবীনের কই কিছু বলা উচিত ছিল। তবে যে এখান এ সকল কথা উঠিল, তাহার কারণ এই যে, নক্ষত্রগুলির সম্বন্ধে কোনো কথা বলিবার সুযোগ আর যে হইবে, এমন বোধ হয় না। সুতরাং এ কথাগুলি বলিতে হইলে, এইখানেই বলা ভালো।

 সিরিয়সের যেমন একটি সঙ্গী আছে তেমনি আরো অনেক নক্ষত্রেরই আছে। কোনো কোনো স্থানে তিন-চারিটা নক্ষত্রকেও দল বাঁধিয়া ঘুরিতে দেখা যায়। ইহারা সকলেই সূর্য। ইহাদের সঙ্গে গ্রহ (অর্থাৎ, যেমন আমাদের পৃথিবী। গ্রহদের নিজের আলো নাই, সূর্যের নিকট হইতে আলো পায়, আর তাহার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়) আছে কিনা, তাহা বলা কঠিন। কারণ গ্রহ থাকিলেও এত দূরে তাহাদিগকে দেখা যাইবে না।

 নক্ষত্রগুলিকে একটু মনোযোগ দিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে যে, উহাদের সকলের রঙ একরূপ নহে। কোনোটা সাদা কোনোটা একটু লালচে। সিরিয়স খুব সামান্য একটু নীল মিশানো সাদা রঙের। রোহিণীর (Aldebaran) রঙ অনেকটা লাল! দূরবীন দিয়া অনেক রঙিন তারা দেখা যায়। লাল, নীল, সবুজ, হলদে, বেগুনি প্রায় সকল রঙের তারাই আছে। ইহাদের কোনো কোনোটার রঙ আবার বদলায় বলিয়া বোধ হয়। সিরিয়স এখন সাদা, কিন্তু প্রাচীনকালের এক পণ্ডিত ইহাকে আগুনের মতন লাল রঙের বলিয়াছেন।

 এখন তারাগুলির সম্বন্ধে আর একটা কথা বলিলেই, আমার আজকার কাজ শেষ হয়।

 জিনিস হইতে আলো আসিয়া আমাদের চক্ষে পড়িলেই, আমরা সেই জিনিস দেখিতে পাই। একটা ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করিয়া তাহাকে যদি অন্ধকার কর, আর সেই ঘরের দরজা বা দেয়ালের কোনো স্থানে যদি একটি শ্লেট-পেন্সিল ঢুকিবার মতো ছিদ্র থাকে, তবে সেই ছিদ্রের ভিতর দিয়া আলো আসিবে। এই ছিদ্রের সামনে এক খণ্ড সাদা কাগজ বা কাপড় ধরিলে দেখিবে যে, তাহাতে বাহিরের জিনিসের সুন্দর ছবি পড়িয়াছে। চক্ষের ভিতরেও এইরূপ করিয়া জিনিস হইতে আলো আসিয়া পড়ে, আর তার জন্যই আমরা সেই জিনিস দেখিতে পাই।

 এখন কথা হচ্ছে এই যে, একটা জিনিস হইতে আলো বাহির হয়, তারপর খানিক পথ চলিয়া, সেই আলো আমাদের চক্ষে পড়ে, এইরূপ করিতে তাহার সময় লাগে। যত বেশি পথ চলিতে হয়, তত বেশি সময় লাগে।

 আলো বড় ভয়ানক ছুটিয়া চলে। এত ছুটিয়া চলে যে, এই পৃথিবীর মধ্যে এক স্থান হইতে আর এক স্থানে যাইতে তাহার নিতান্তই কম সময় লাগে। তত কম সময়ে আমরা যন্ত্রের সাহায্যে ভিন্ন কোনো খবরই লইতে পারি না।

 কিন্তু খুব দূরের কথা যখন ধরা হয়, তখন দেখা যায় যে, তত দূরে আলো চলিয়া যাইবার সময়ের একটা বেশ মোটা হিসাব দাঁড়ায়।

 সূর্য হইতে আলো পৃথিবীতে আসিতে সাড়ে সাত মিনিট সময় লাগে। সূর্য যদি আগে থাকিত আর এখন হঠাৎ দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিত, তবে আমরা আরো সাড়ে সাত মিনিট পরে তাহাকে দেখিতে পাইতাম। এখন যদি হঠাৎ সূর্য নিবিয়া যায়, তবে আরো সাড়ে সাত মিনিট পর্যন্ত আমরা এই দুর্ঘটনার কোনো খবর পাইব না। এই মুহূর্তে আমরা সূর্যকে যেমন দেখিতেছি, তাহা তাহার সাড়ে সাত মিনিট আগেকার চেহারা।

 আলোক এক সেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশিহাজার তিনশত মাইল যায়। এইরূপ করিয়া সওয়া চার বৎসর চলিলে, তবে সে সকলের চাইতে কাছে তারা হইতে পৃথিবীতে পৌঁছাইতে পারিবে। ধ্রুবতারা হইতে পৃথিবীতে পৌঁছাইতে তাহার চুয়াল্লিশ বৎসর লাগে। এইরূপ, যে তারা যত দূরে, সেখানকার আলো পৃথিবীতে পৌঁছাইতে তত বেশি সময় চাই। এত দূরেও নিশ্চয় তারা আছে যে তাহার জন্মের সময় হইতে চলিতে আরম্ভ করিয়াও তাহার আলো এ পর্যন্ত পৃথিবীতে পৌঁছাইতে পারে নাই। আজ যদি সেই আলো আসিয়া এখানে পৌঁছয়, আর আমরা তাহাকে দেখিতে পাই, তবে মনে করিতে হইবে যে, এ তাহার আজিকার চেহারা নহে সেই সে যখন জন্মাইয়াছিল, তখনকার চেহারা।

 পৃথিবী যখন জন্মাইয়াছিল, তখন হইতেই তো তাহার আলো চারিদিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। উহার জন্মের সময় হইতে যে আলো রওয়ানা হইয়া গিয়াছিল, তাহা না জানি এত দিনে কোথায় গিয়া পৌছাইয়াছে। মনে কর, সেখানে বুদ্ধিমান জীব আছে, আর তাহাদের ভয়ংকর এক-একটা দূরবীন আছে সেই দূরবীন দিয়া যেন এই পৃথিবীর মানুষকে ঠিক একটা মানুষের মতনই বড় দেখা যায়। সেখানকার পণ্ডিতেরা দূরবীন দিয়া কিরকম পৃথিবী দেখিতে পাইতেছে? সেই তাহার জন্মের সময় পৃথিবী যেমন ছিল, তাহারা তাহাই দেখিতেছে। এখানকার এই নদনদী, পাহাড় পর্বত, দেশ গ্রাম, জাহাজ, রেল, এ-সকলের কিছুই তাহারা দেখিতেছে না। তাহারা হয়তো দেখিতেছে, একটা প্রকাণ্ড ধোঁয়াটে জিনিস, আর সেটা হয়তো ঐ সূর্যের মতন ধু ধু করিয়া জ্বলিতেছে!

 উহার চাইতে ঢের কাছে যদি কেহ সেইরূপ ভয়ংকর দূরবীনওয়ালা থাকে, সে হয়তো পৃথিবীকে ইথিয়োসরস, প্লীসিয়োসরস ইত্যাদি জন্তুতে পরিপূর্ণ দেখিবে!

 সূর্যে যদি তেমন কেহ থাকে, তবে সে হয়তো, তুমি জল খাবার খাইয়া আঁচাইতে যাইবার সময় দেখিবে যে, তুমি এই সবে খাইতে বসিতেছ।