উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/গরিলা
গরিলা
আফ্রিকা দেশে গরিলার বাড়ি। গরিলারা বনে থাকে। সে-সকল বনে মানুষের বড় একটা চলাফেরা নাই। সভ্য লোকেরা ত সে স্থানে যাইতে চাহেনই না, সে দেশবাসী অসভ্যেরাও গরিলার ভয়ে সেই-সকল বন হইতে দূরে থাকে। শ্রীরামচন্দ্রের সৈন্যদিগের মধ্যে হনুমান মহাশয় যেরূপ ছিলেন, সেদেশী জন্তুদের মধ্যে গরিলাও সেইরূপ। রামায়ণে হনুমানের কথা যাহা পরিয়াছি তাহাতে তাহার উপর একপ্রকার ভালো ভাবই জন্মিয়াছে। আমি অনেক সময় ভাবিয়া থাকি যে হনুমান এত বড় লোক (থুড়ি, বড় বাঁদর) ছিলেন, কিন্তু হনুমান বলিলে আমরা এত চটি কেন? এ বিষয় হনুমান বেচারার একটু বিশেষ দুর্ভাগ্যই ছিল বলিতে হইবে, নতুবা হনুমান খাইয়াছেন বলিয়া কলার মৌখিক আদর কমিল কেন? মৌখিক বলিতেছি, কারণ খাইতে দিলে কাহারো যত্নের ত্রুটি দেখা যায় না। যাহা হউক এ বিষয়টি আমার আলোচনার সামগ্রী নহে। আমি গরিলাদের কথা বলিতেছি, তোমরা তাহাতে মনোযোগ দেও। আমি বলিতেছিলাম হনুমান খুব মহাশয় ব্যাক্তি ছিলেন, কিন্তু গরিলা এত প্রধান জীব হইলেও তাহার আচার ব্যবহারগুলি ভালো নহে।
জাতিতে হুকু—নিবাস আফ্রিকা; এইদুই বিষয়ের মধ্যে বিশেষ আশাপ্রদ কিছুই নাই। এর পরেই চেহারা। এ বিষয়ে আমি আর অধিক কি বলিব! আমি এরূপ বলিতেছি না যে আমরা মানুষ, সুতরাং আমরা সুন্দর, আর গরিলা হুকু, সুতরাং সে কুৎসিত। সুন্দরই হউক আর কুৎসিতই হউক, দেখিতে যে অত্যন্ত ভয়ানক সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
গরিলা যে বনে বাস করে, সেই বনে একপ্রকার বাদাম জন্মে; এই বাদামই গরিলার প্রধান আহার। এই বাদাম এত শক্ত যে একটা হাতুড়ি দিয়া খুব জোরের সহিত ঘা না মারিলে তাহাকে ভাঙ্গা যায় না। ইহারই আধমণ ত্রিশ সের পরিমাণ অক্লেশে উদরস্থ করিয়া গরিলা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। এই বিষয়টি ভাবিলেই ইহাদের শরীরে যে কি ভয়ানক বল তাহা বুঝিতে পার। এরপর আবার তাহার স্বভাবটি। সেটি বাঘ ভল্লুকেরও অনুকরণের সামগ্রী। গরিলার দেশের লোকেরা তাহার নামেই ভয় পায়। ইহাদের উৎপাতের সম্বন্ধে বিস্তর গল্প বলা হইয়া থাকে। একবার নাকি একদল গরিলাতে আর সে দেশের কতকগুলি মানুষেতে একটা প্রকাণ্ড যুদ্ধ হইয়াছিল। যুদ্ধে গরিলারা জয়লাভ করিল এবং কতকগুলি মানুষকে ধরিয়া লইয়া গেল। কয়েকদিন পরে এই লোকগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিল; গরিলারা তাহাদের পায়ের আঙ্গুল ছিড়িয়া রাখিয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছে।
সেদেশীয় লোকের বিশ্বাস যে গরিলারা এক কালে মানুষই ছিল। কালক্রমে তাহাদের আচার-ব্যবহার অধোগামী হওয়াতে তাহারা অসভ্যতা প্রাপ্ত হইয়া ঐরূপ ঘৃণাজনক আকার পাইয়াছে।
পুরুষ গরিলার হাতে অনেক সময় একটি ছোট মুগুর থাকে। সে দেশের লোকেরা বলে যে এই মুগুর লইয়া গরিলা হাতির সহিত যুদ্ধ করে। তোমরা মনে করিতে পার যে অতি নিরীহ ভালোমানুষ, তাহার সঙ্গে গরিলার শত্রুতা হইবার কি কারণ থাকিতে পারে? কারণ বিশেষ কিছুই নাই, কিন্তু গরিলা মনে করে যে এত বড় জানোয়ারের আহারের পর তাহার জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না। এই কারণেই সে হাতির উপর এত চটা। এই কারণেই সে হাতি দেখিবামাত্র লাঠি হাতে তাড়া করে। প্রাণপণে হাতির শুড়ের উপর একটি আঘাত করিলে আর দ্বিতীয় আঘাতের দরকার হয় না, হাতি ফ্যাঁ ফ্যাঁ শব্দ করিয়া পলায়ন করে।
সে দেশের লোকেরা হাতির হাড় খুঁজিতে মাঝে মাঝে বনে যায়। তখন তাহাদের একটি ভয় বড়ই প্রবল থাকে—পাছে জঙ্গলে কখনো একটা গরিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। গরিলা পথের ধারে গাছের পাতার ভিতরে লুকাইয়া থাকে। দৈবাৎ কোনো হতভাগ্য লোক যদি সেই পথ দিয়া যায়, তবে আর তাহার রক্ষা নাই। দুই পায়ে গাছের ডাল শক্ত করিয়া ধরিয়া মুহূর্তের মধ্যে হাত বাড়াইয়া তাহাকে গাছে তুলিয়া লয়, তাহার পরক্ষণেই দুই হাতে তাহাকে বেষ্টন করিয়া প্রচণ্ড বলের সহিত বুকের উপর চাপিয়া ধরে আর তাহার পাঁজর চুর্ণ করিয়া মাটিতে ফেলিয়া দেয়।
মাঝে মাঝে কেহ কেহ গরিলা মারিতে চেষ্টা করেন। এক গুলিতে যদি গরিলা মরিল, তবে ভালোই। কিন্তু যদি গুলি খাইয়াও তাহার শরীরে প্রাণ থাকে, তবেই বিপদ। এ সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনিতে পাওয়া যায়। একবার একটা গরিলা মরিবার সময় একটা বন্দুকের নল বাঁকাইয়া এবং দাঁতে চ্যাপ্টা করিয়া ফেলিয়াছিল।
দুশেলু নামক এক সাহেব গরিলার কথা শুনিয়া তাহাকে দেখিবার জন্য আফ্রিকায় গিয়াছিলেন, তিনি প্রকাণ্ড এক গ্রন্থে তাঁহার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। এই পুস্তকে অনেক আশ্চর্য আশ্চর্য গল্প লেখা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তোমাদিগকে তাহার দুই-একটার অধিক উপহার দিতে সাহস পাইতেছি না। উইনউড্রীড নামক এক সাহেব দুশেলুর কিছু পরে আফ্রিকায় গিয়াছিলেন। দুশেলুর কথাগুলি কত দূর সত্য তাহা জানিবার জন্য তিনি বিস্তর অনুসন্ধান করেন। দুশেলুর পুস্তকে যে-সকল লোকের উল্লেখ আছে, তিনি তাহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া, তাহাদের সহিত এ সম্বন্ধে অনেক আলাপ করেন;তাহাতে তিনি জানিতে পারিয়াছে যে, দুশেলুর সকল কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে। রীড সাহেব গরিলার সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছে তাহার কিয়দংশ অনুবাদ করিয়া তারপর গরিলা সম্বন্ধে দুই-একটি গল্প বলিয়া আমরা শেষ করিব।
দুশেলু সাহেব নিম্নলিখিত গল্পটি বলিয়াছেন—আমরা একটা অন্ধকারময় উপত্যকার দিকে চলিলাম। গ্যাম্বো (দুশেলুর আফ্রিকা দেশীয় ভৃত্য) বলিয়াছিল, সেখানে শিকার (গরিলা) মিলিবে। আমাদের দলের লোকেরা পৃথক হইয়া চলিল। গ্যাম্বো আর আমি একত্র থাকিলাম। একজন সাহসী লোক একা একদিক-পানে চলিল, সে মনে করিয়াছিল সেই দিকে গেলে গরিলা পাওয়া যাইবে। অবশিষ্ট তিনজন অন্য-একদিকে চলিল। এইরূপে পৃথক হইয়া আমরা একঘণ্টা কাল ছিলাম, এমন সময়ে গ্যাম্বো আর আমি আমাদের অতি অল্প দূরে একটা বন্দুকের শব্দ শুনিলাম। তার পরক্ষণেই আর-একটা আওয়াজ হইল। আমরা অবিলম্বে সেই দিকে লক্ষ্য করিয়া চলিলাম;আমরা মনে করিয়াছিলাম যে, একটা মরা গরিলা দেখিতে পাইব। এই সময়ে ভয়ানক শব্দে বন প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। গ্যাম্বো অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া আমার বাহু ধরিল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি চলিতে লাগিলাম, মনে অত্যন্ত ভয় হইতে লাগিল। বেশি দূর যাইতে না যাইতেই দেখিলাম, আমরা যাহা ভয় করিতেছিলাম তাহাই
হইয়াছে। যে বেচারা সাহস করিয়া একাকী চলিয়া গিয়াছিল, তাহাকে সেই স্থানে পতিত দেখিলাম। তাহার রক্তে সেই স্থান ভাসিয়া যাইতেছিল। প্রথমে বোধ হইয়াছিল যেন তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহার নাড়িভুঁড়ি পেট ফাটিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছে। পাশেই বন্দুকটা পড়িয়া আছে-বন্দুকের কাঠের অংশটা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, নলটা চ্যাপ্টা হইয়া বাঁকিয়া গিয়াছে। গরিলার দাঁতের দাগ তাহাতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। আমরা তাহাকে তুলিলাম। আমার কাপড় ছিড়িয়া তাহার ঘায়ে পটি বাঁধিয়া দিলাম। একটু ব্রাণ্ডি খাইতে দিলে পর তাহার চৈতন্য হইল—অতি কষ্টে সে কথা কহিতে লাগিল। সে বলিল যে হঠাৎ সে গরিলাটার সামনে পড়িয়া গিয়াছিল; তখন সেটা পলাইতে চেষ্টা করে নাই। সেটা একটা মস্ত পুরুষ গরিলা; দেখিতে ভয়ানক হিংস্র বলিয়া বোধ হইল। জঙ্গলের সে স্থানটা অন্ধকার ছিল, বোধহয় অন্ধকারের জন্য তাহার লক্ষ্য ঠিক হয় নাই। সে বলিল যে সে খুব মনোযোগপূর্বক সন্ধান করিয়াছিল, এবং কেবলমাত্র আটফিট দূর হইতে গুলি করিয়াছিল। গুলিটা এক পাশে লাগিয়াছিল। গুলি খাইয়াই সেটা বুক চাপড়াইতে লাগিল আর ভয়ানক রাগিয়া তাহার দিকে আসিতে লাগিল। দৌড়িয়া পালানো তখন অসম্ভব, দশ পা যাইবার পূর্বেই তাহাকে ধরিয়া ফেলিবে। সে দাঁড়াইয়া রহিল, এবং যত শীঘ্র সম্ভব পুনরায় বন্দুক ভরিল। পুনরায় গুলি করিবার জন্য যেই সে বন্দুক উঠাইতেছিল, অমনি গরিলাটা তাহার হাত হইতে সেটাকে কাড়িয়া লইয়া ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। পড়িবার সময় সেটা ছুটিয়া গেল। তারপর ভয়ানক শব্দ করিয়া সেই জানোয়ারটা তাহার পেটে আঘাত করিল। সেই আঘাতেই পেট কাটিয়া নাড়িভুঁড়ির কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। রক্তাক্ত শরীরে সে মাটিতে পড়িয়া গেল। গরিলাটা তাহাকে ছাড়িয়া বন্দুকটা ধরিল ইহা দেখিয়া সে বেচারা মনে করিল যে বুঝি বন্দুক দিয়া তাহার মাথা ভাঙ্গিয়া দিবে। কিন্তু গরিলা বোধহয় সেটাকেও শত্রু মনে করিয়াছিল—সুতরাং সে তাহাকে দাঁতে চিবাইয়া চ্যাপ্টা করিয়া দিল।’
আর-এক স্থানে তিনি বলিয়াছেন—“আমরা নিঃশব্দে যাইতেছিলাম, হঠাৎ একটা শব্দ শুনিতে পাইলাম, আর তখনই একটা স্ত্রী-গরিলাকে দেখিলাম। একটি অতি শিশু গরিলা তাহার বুকে ঝুলিয়া দুধ খাইতেছে। মাতা তাহার পিঠ চাপড়াইতেছিল আর স্নেহের সহিত তাহাকে চাহিয়া দেখিতেছিল। দেখিয়া আমার এত ভালো বোধ হইল এবং আমার প্রাণে এত লাগিল যে, আমি সহসা গুলি করিতে চাহিলাম না। আমি ইতস্তত করিতেছি, এমন সময় আমার সঙ্গের একজন শিকারী তাহাকে গুলি করিয়া মারিয়া ফেলিল, সেটা অমনি পড়িয়া গেল। মাতা পড়িয়া গেলে ছানাটি তাহাকে জড়াইয়া ধরিল আর চিৎকার করিয়া তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিল। আমি সেই স্থানে গেলাম। আমাকে দেখিয়া বেচারা তাহার মায়ের বুকে মাথা লুকাইল। ছানাটি চলিতেও পারিত না; কামড়াইতেও শিখে নাই; সুতরাং আমরা সহজেই তাহাকে ধরিতে পারিলাম। আমি সেটিকে লইয়া চলিলাম; সঙ্গের লোকেরা তাহার মায়ের শরীরটা বাশেঁ করিয়া বহিয়া আনিল। যখন আমরা গ্রামে আসিলাম, তখন আর-এক দৃশ্য দেখা গেল। লোকেরা মরা গরিলাটাকে মাটিতে রাখিল, আমি ছানাটিকে কাছে রাখিলাম। তাহার মাকে দেখিবামাত্র সে হামাগুড়ি দিয়া তাহার কাছে গেল এবং দুধ খাইতে চেষ্টা করিল। দুধ না পাইয়া হয়তো মনে করিল যে একটা কিছু হইয়াছে।” তখন সে অতিশয় দুঃখের সহিত হু হু হু! বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, আমার প্রাণে বড়ই দুঃখ হইল। সে দুধ ছাড়া আর কিছুই খাইতে পারিত না, আমিও দুধের জোগাড় করিতে পারিলাম না। সুতরাং দুইদিন পরে বেচারা মরিয়া গেল।” পশুদের প্রতি কি নির্দয় ব্যবহার! পাঠকপাঠিকা শুনিয়া হয়ত তোমাদের মনে ঘৃণা জন্মিবারই কথা।