উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/ডাক্তার ফ্রান্‌জ্‌ হারমান মূলার

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ডাক্তার ফ্রান্‌জ্‌ হারমান মূলার

 যাঁহার কথা আজ তোমাদিগকে বলিতে যাইতেছি, তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। বয়স ত্রিশের অধিক হয় নাই, কিন্তু এই অল্প বয়সেই তিনি একজন অতিশয় বিদ্বান এবং বিচক্ষণ লোক বলিয়া প্রশংসা লাভ করিয়াছিলেন। চিকিৎসায় তাঁহার খুবই সুখ্যাতি ছিল, কিন্তু তিনি যে গরীব দুঃখীদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করিতেন, সেজন্য সকলে তাঁহাকে আরও ভালবাসিত। শিক্ষকতারও তাঁহার যশ কম ছিল না।

 ভারতবর্ষে যখন প্লেগের আক্রমণ আরম্ভ হইল, তখন ভিয়েনার বৈজ্ঞানিক চতুষ্পাঠি হইতে একদল কৃতবিদ্য লোককে এই ব্যাধির সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার জন্য বোম্বাই পাঠান হয়। ডাক্তার মূলার এই দলের নেতা হইয়া তখন এদেশে আসেন। বোম্বাই শহরে ইঁহারা তিন মাস ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ডাক্তার মূলার এক হাজারেরও বেশি রোগীকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন। যেখানে প্লেগ সকলের চাইতে বেশি, সেইসকল জায়গা খুঁজিয়া বাহির করিয়া রোগীদিগকে দেখিতেন এবং তাহদের বেয়ারামের অবস্থা লিখিয়া রাখিতেন। এইরূপে তিন মাস প্লেগের সম্বন্ধে নানারূপ সংবাদ সংগ্রহ করিয়া ইঁহারা দেশে ফিরিলেন।

 যাইবার সময়ে ইঁহারা প্লেগের বীজ সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। সেই বীজ নানারূপ ইতর জন্তুর শরীরে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য বৈজ্ঞানিক চতুষ্পাঠি ডাক্তার মূলারের উপর ভার দিলেন। সেখানকার একটা বড় হাসপাতালের এক অংশে এই কার্যের জন্য স্থান নির্দেশ করা হইল। প্লেগের বীজের ন্যায় মারাত্মক জিনিস লইয়া কাজ করিতে হইলে যত রকম সতর্কতার প্রয়োজন হয়, তাহার সমস্তই অবলম্বিত হইয়াছিল।

 এই কার্যের জন্য যে ঘর নির্দিষ্ট ছিল তাহা ও ব্যবহৃত যন্ত্রাদি পরিষ্কার রাখা, এবং যে সকল জন্তুর শরীরে পরীক্ষা হইতেছিল তাহদের যত্ন করা, তাহদের খাঁচা পরিষ্কার করা, কোনটা মরিয়া গেলে তাহাকে পোড়াইয়া ফেলা—এইসকল কাজের জন্য বারিশ নামক এই ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হইল। এই কার্যে কিছুমাত্র অসতর্ক হইলে কিরূপ বিপদের আশঙ্কা তাহা বারিশকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছিল;বারিশও এক বৎসর পর্যন্ত সকলপ্রকার নিয়ম যথাসাধ্য পালন করিয়াছিল। এই এক বৎসরের মধ্যে কোনরূপ দুর্ঘটনা হয় নাই। কিন্তু ক্রমে সাহস বাড়িয়া যাওয়াতে বেচারা শেষে অসতর্ক হইয়া পড়িল। সে জানিত না, যে এইরূপ অসতর্কতার দরুন তাহার প্রাণ যাইবে।

 বার বার নিয়মভঙ্গ করাতে বারিশের প্লেগ হইল। ডাক্তার মূলার দিন রাত হাজির থাকিয়া তাহার চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। নিজের রোগীদিগকে অন্যের হাতে দিয়া এবং ছাত্রদিগকে পড়াইবার জন্য অন্যরূপ বন্দোবস্ত করিয়া, এমনকি একরকম নিজের খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করিয়া, তিনি বারিশের জন্য খাটিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাকে বাচাইতে পারিলেন না। চারিদিনের অসুখে বারিশ মারা গেল।

 বারিশের মৃতদেহ ছুঁইয়া পাছে অন্যের প্লেগ হয়, সেই ভয়ে তাহাকে কফিনে পুরিবার কাজটা মূলার আগাগোড়া নিজ হাতেই করিলেন। তারপর সেই ঘর ধুইয়া ফেলা, ঘরের জিনিসপত্র মাজা ঘসা ইত্যাদি সকল কাজ একাই শেষ করিলেন—পাছে অন্যকে করিতে দিলে তাহারও প্লেগ হয়। ডাক্তার মূলার ব্যতীত আর দুটি লোক (দুইজন শুশ্রুষাকারিণী) বারিশের শুশ্রুষা করিয়াছিল। বারিশের মৃত্যুর দুইদিন পরে ইহাদের একজনের প্লেগ হইল। বারিশের চিকিৎসা করিয়া ডাক্তার মূলার খুব ক্লাস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তথাপি তিনি বারিশকে যেমন যত্ন করিয়া চিকিৎসা করিয়াছিলেন,ইহাকেও তেমনি যত্ন করিয়া চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। রোগ পরীক্ষা করা, ঔষধ দেওয়া, উপদেশ আর মিষ্ট কথা দ্বারা সান্ত্বনা করা ইত্যাদিতে রাত্রির অধিকাংশ চলিয়া গেল; শেষ রাত্রিতে তাঁহার অতিশয় কাঁপনি ধরিল। তখন শীতকাল ছিল, সুতরাং প্রথমতঃ সেই কাঁপনিকে তিনি তত গ্রাহ্য করিলেন না। ঘরে ঢুকিবার সময় তাঁহার শরীর ভয়ানক দুর্বলবোধ হইতে লাগিল;তখন তাঁহার মনে একটু সন্দেহ হইল, বুঝিবা তাঁহারও প্লেগ হয়। এই সামান্য সন্দেহটুকুকে মন হইতে তাড়াইয়া দিয়া, তিনি তাহার পিতামাতার নিকট চিঠি লিখিতে বসিলেন। চিঠিতে এই কথাটিও লিখিলেন যে, “এমন গুরুতর সময়ে যদি রোগীকে পরিত্যাগ করে, তবে তাহার কাপুরুষতা হয়।” চিঠি শেষ করিয়া চেয়ার হইতে উঠিবার সময় তাহার মাথা ঘুরিয়া গেল। আরশীতে দেখিলেন যে, তাহার চেহারা বড়ই ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে। কিন্তু থার্মোমিটার দিয়া জ্বর পাইলেন না; সুতরাং আবার নিশ্চিন্ত হইয়া নিদ্রা গেলেন। পরদিন তাহার শরীরের অবস্থা আরও খারাপ বোধ হইল। এবারে নিজেকে বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া স্থির করিলেন যে, সম্ভবতঃ তাহার প্লেগই হইয়াছে, তবে আরো দু-একটা লক্ষণ দেখা না দিলে নিশ্চয় বলা যায় না।

 সেই সময়ে তাহার অবস্থা এরূপ, যে তিনি ভাল করিয়া দাড়াইতে পারেন না। কিন্তু এই অবস্থাতেই তিনি তাহার রোগিনীকে দেখিতে চলিলেন। সেখানে ঘণ্টাখানেক থাকিয়া তাহার ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া শেষে যখন আর থাকা অসম্ভব হইল, তখন নিজের ঘরে ফিরিলেন। সেখানে আসিয়া নিজের অবস্থা পরীক্ষা করিয়া নিশ্চয় বুঝিলেন যে, তাহার প্লেগ হইয়াছে, আর র্তাহার জীবনের আশা নাই। তখন তিনি তাহার জানালার সারশিতে এইরূপ বিজ্ঞাপন টাঙ্গাইয়া দিলেন—

 “আমার প্লেগ নিউমোনিয়া হইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া আমার নিকট ডাক্তার পাঠাইবেন না; চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই যে আমার মৃত্যু হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”

 এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করিযা ডাক্তার মূলার নিজের রোগের অবস্থা লিখিতে আরম্ভ করিলেন। নিজে যেন ডাক্তার, রোগী যেন আর কেহ, এই রূপ করিয়া পরীক্ষা করেন আর লেখেন। নিজের কথা কিছু লিখিবার না থাকিলে বারিশের পীড়ার রিপোর্ট লেখেন। এই সমস্ত বিবরণ লেখা হইলে, আবার তাহা জানালায় টাঙ্গাইয়া দেওয়া হয়। একজন ধর্মযাজিকা র্তাহার শুশ্রুষা করিতে আসিয়াছেন, তিনি ভিন্ন অন্য কাহাকেও ঘরে ঢুকিতে দেওয়া হয় না।

 যখন আর নিজের লিখিবার ক্ষমতা রহিল না, তখন সেই শুশ্রষাকারিণী ধর্মযাজিকা দ্বারা লেখাইতে লাগিলেন। জিব আওড়াইয়া যাইতে লাগিল, তথাপি ডাক্তার মুলার ক্লান্ত হইলেন না। তিনি বলিলেন, “এগুলি লিখিয়া রাখিলে অন্য ডাক্তারদের কাজে আসিবে।” ক্রমে জ্ঞান লোপ পাইতে লাগিল। কিন্তু ইহার মধ্যে যখনই একটু জ্ঞান হইত, তখনই আবার রোগের অবস্থা লেখাইতেন।

 পক্‌ নামক একটি ডাক্তার তাহাকে চিকিৎসা করিতে আসিলে তিনি তাহাকে ঘরে ঢুকিতে দিতে চাহেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেন যে, “আরোগ্যের কোন আশা নাই, না হক আপনি নিজেকে বিপদে ফেলিতেছেন কেন?” যাহা হউক ডাক্তার পকই তাহার চিকিৎসা করিতে লাগিলেন।

 পত্র লেখাইলেন। সেই পত্রে এরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, তাহার মৃতদেহ যেন গোর না দিয়া পোড়াইয়া ফেলা হয়, কারণ পোড়াইলে অন্যের বেয়ারাম হইবার আশঙ্কা কম। আর তাহাতে এ কথাও লেখা ছিল, যে তিনি অনেক সময় পিতামাতার মনে ক্লেশ দিয়াছেন, তাহার অপরাধ যেন মার্জনা করেন।

 ডাক্তার পক্‌ আসিলেই মূলার সেই শুশ্রুষাকারিণীর খবর লইতেন, এবং আর কাহারও

উপেন্দ্র—১১৬ অসুখ করিয়াছে কিনা ব্যস্ততার সহিত জিজ্ঞাসা করিতেন।

 শেষ মুহূর্ত উপস্থিত হইলে নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে পাদ্রী ডাকাইয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু পাদ্রীকে ঘরে ঢুকিতে দেওয়া হয় নাই। তিনি সার্সী আঁটা জানালার বাহিরে থাকিয়াই ভগবানের নাম করিলেন।

 দুই দিনের অসুখেই এই পরদুঃখকাতর মহাত্মার মৃত্যু হইল। পরের জন্য আপনাকে বিসর্জন দিয়া ডাক্তার মূলার এই জগতে অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার শোকে আজ সহস্র হৃদয় ম্রিয়মাণ।