উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/তিমিঙ্গিল

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

তিমিঙ্গিল

 তিমিকে যে গিলে, সে তিমিঙ্গিল। আমাদের দেশের পুরাতন পণ্ডিতেরা বলিয়াছেন, যে “তিমি মাছ একশত যোজন (৮০০ মাইল) লম্বা; তিমিঙ্গিল সেই তিমিকে গিলে। তিমিঙ্গি লকে গিলে এমন মাছও আছে, তাহাকে বলে রাঘব।”

 তোমরা তো এ কথা হাসিয়াই উড়াইয়া দিবে। বাস্তবিক, আটশত মাইল লম্বা মাছের জায়গা সমুদ্রে ভিতরেও হইবে না, তাহাকে যাহারা গিলিবে, তাহদের জায়গা হওয়া তো পরের কথা। কিন্তু তাই বলিয়া এমন কথা মনে করিও না যে সেকালের লোকে তিমি দেখে নাই। আমাদের এই বঙ্গ সাগরেই তিমি আছে। এইরকম একটা জানোয়ারের দেহ অনেক বৎসর আগে আরাকানের নিকট পাওয়া গিয়াছিল, তাহার চোয়ালের হাড় দুখানি আমাদের যাদুঘরে এখনো দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের ‘বনের খবর’ যিনি লেখেন, তিনি একবার বৰ্মা যাইবার সময় একটা তিমি দেখিতে পাইযাছিলেন। রঘুবংশে লেখা আছে যে তিমিরা হাঁ করিয়া জীবজন্তু সুদ্ধ নদীর মুখের জল টানিয়া লয়, তারপর মুখ বন্ধ করিয়া মাথার ছিদ্র দিয়া সেই জল বাহির করিয়া দেয়। বাস্তবিকই তিমির মাথায় ছিদ্র আছে, সেই ছিদ্র দিয়া পিচকারীর মতো জল বাহির হয়।

 আসল কথাটা বোধহয় এই যে, সে কালের লোকেরা জাহাজে করিয়া সমুদ্রে যাইত আর তিমি দেখিতে পাইত। দেখিয়া তাহদের এমনি আশ্চর্য বোধ হইত যে, তাহাদের হিসাব করিবার অবসরই হইত না, জিনিসটা কতখানি বড়। ষাট হাত হইলে তাহারা হয়তো ভাবিত একহাজার হাত। ইহার উপরে হয়তো আবার দেশে ফিরিয়া গল্প করিবার সময় লোকের তাক লাগাইয়া দিবার ইচ্ছাও যে একটু না থাকিত এমন নহে, কাজেই হাজার হাতের জায়গায় দেখিতে দেখিতে দশহাজার হাত হইয়া যাইত। তারপর সেই গল্প শুনিয়া কবিরা যখন তাহার কথা লিখিতে বসিতেন, তখন তো বুঝিতেই পার।

 এমন ঘটনা সকল দেশেই ঘটিয়াছে। আরব্য উপন্যাসে সিন্ধ বাদের গল্প তোমরা পড়িয়াছ কি? তাহারা সমুদ্রের চড়ায় উঠিয়া রান্নার আয়োজন করিয়াছিল; জনিত না, যে সে চড়া নয় একটা মাছ। আগুনের তাত লাগিয়া মাছটা জলে ডুব দিল, আর সিন্ধ বাদ আর তাহার দলের লোকেরা সমুদ্রে হাবুডুবু খাইতে লাগিল।

 এ ত ঢের দিনের কথা, গত পৌনে দুইশত বৎসরের ভিতর একজন নরওয়ে দেশীয় পাদ্রি এইরূপ অদ্ভুত জানোয়ারের কথা লিখিয়া গিয়াছেন। সেই জানোয়ারের নাম নাকি ক্র্যাকেন (Kraken);সে ভাসিয়া উঠিলে নাকি আধমাইল চওড়া একটি ছোট্টখাট দ্বীপ হয়।

 যা হোক আমি শুধু আষাঢ়ে গল্প বলিতে আসি নাই। আমি বলিতে চাই যে, সেকালের লোকেরা এত বেশি বাড়াইয়া বলিতে গিয়াই সব মাটি করিয়াছে নহিলে আমরা সহজেই বিশ্বাস করিতে পারিতাম যে তাহারা মাঝে মাঝে অতি বিশাল একটা জানোয়ার সমুদ্রে দেখিতে পাইত। তাহাব সবগুলিই একরকমের জন্তু না হইতে পারে, কিন্তু তাহার কোন কোনটা হয়ত তিমির চেয়ে বড় ছিল। সেইগুলিকেই হয়ত আমাদের দেশের সেকালের লোকেরা ‘তিমিঙ্গিল’, ‘রাঘব,’ ইত্যাদি নাম দিয়াছিল।

 এখনো মাঝে মাঝে ‘সাগরের সাপ’ (Sea Serpent) বলিয়া একটা বিশাল জন্তুর কথা শুনিতে পাওয়া যায়। মাসখানেক আগেও খবরের কাগজে পড়িয়াছিলাম যে এক জাহাজের লোকেরা আবার একটা সাগরের সাপ দেখিয়াছে। এ-সব কথা শুনিয়া কেহ বিশ্বাস করে কেহ হাসে। যাহা হউক ভালো ভালো লোকে এরূপ জন্তু দেখিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আসিয়া তাহার সংবাদ দিয়াছে, এ কথা সত্য। ইহাদের কথা যদি বিশ্বাস করিতে হয়, তবে

আমি বলি, সেই জন্তুই তিমিঙ্গিল।

 ১৮৭৫ সালে পলিন (Pauline) নামক একখানি জাহাজ ভারত সাগর দিয়া যাইতেছিল। একদিন সেই জাহাজের লোকেরা দেখিল যে, তিনটা বড়-বড় তিমি জাহাজ হইতে খানিক দূরে খেলা করিতেছে। সকলে জাহাজের উপর দাঁড়াইয়া সেই খেলা দেখিতেছে। এমন সময় ভয়ঙ্কর এক সাপ জলের ভিতর হইতে মাথা তুলিয়া সকলের বড় তিমিটাকে জড়াইয়া ফেলিল। তিমিটা প্রায় আশি ফুট লম্বা ছিল। সেই প্রকাণ্ড জানোয়ারের গায়ে দুই ফের দিয়া সাপটা তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছে, তিমিটা সমুদ্র তোলপাড় করিয়া ছাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু কিছুতেই পারিতেছে না। এক-একখানি করিয়া তিমির পাঁজরের হাড় মট্‌মট্‌ শব্দে ভাঙ্গিতে লাগিল, আর মনে হইতে লাগিল যেন ছোটখাট কামানের শব্দ হইতেছে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আর তিমিটার নড়িবার চড়িবার শক্তি রহিল না, তখন সাপটা তাহাকে লইয়া সমুদ্রে ডুব দিল।

 সেই জাহাজের লোকেরা এক ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট গিয়া এই ঘটনার সংবাদ দেয়, ম্যাজিস্ট্রেট তাহা লিখিয়া রাখেন।

 এরূপ জানোয়ার আরো অনেকে দেখিয়াছে, কিন্তু সেগুলি এত বড়ও নয়, আর তাহাদের কেহ তিমি ধরিয়াও খায় নাই। আর, এই-সকল জানোয়ারের চেহারার কথা যেমন শোনা যায়, তাহাতে সন্দেহ হয় যে ইহার সবগুলি হয়তো একরকমের জন্তু নহে। কেহ দেখিয়াছে সাপের মতো, কেহ দেখিয়াছে বান মাছের মতো, কেহ কেহ আবার দেখিয়াছে লম্বা গলাওয়ালা কুমিরের মতো।

 পূর্বেই বলিয়াছি, পণ্ডিতদের সকলে এ-সকল কথা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এমন ভালো ভালো পণ্ডিতও আছেন