উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/তিমি শিকার
তিমি শিকার
মেরুর নিকটে যে-সকল সাগর আছে, তাহাতে বিস্তর তিমি থাকে। তিমির তেলে বাতি জ্বলে, কাজেই সেটা ভারি দরকারি জিনিস। এই তেলের ব্যবসায়ে বৎসরে প্রায় এক কোটি টাকা লাভ হয়, সেই টাকার লোভে ঢের লোক জাহাজে করিয়া তিমি শিকার করিতে যায়।
এ কাজে বিপদ অনেক। একে তো সেই সকল সমুদ্রই খুব ভয়ানক স্থান। এই সেই দিন দুখানি খুব ভালো জাহাজ তিমি শিকারে গিয়াছিল, সেই দুখানিই খোয়া গিয়াছে। একখানি জাহাজ বরফের পাহাড়ের চাপনে ভাঙ্গিয়া যায়, তাহার কয়েকটি মাত্র লোক অতি কষ্টে রক্ষা পাইয়াছে; আর একটি জাহাজের যে কি হইয়াছে, তাহার কোনো ঠিকানাই নাই।
এ-সকল বিপদ তো আছেই; যতটা সম্ভব তাহার হাত এড়াইবার জন্য লোকে গ্রীষ্মকাল দেখিয়া এই কাজে বাহির হয়। কেননা গ্রীষ্মকালে বরফের ভয় কম থাকে। কিন্তু তিমির মতো এমন বিশাল একটা জন্তুকে মারিতে যাওয়ারই যে ভয়ংকর বিপদ, বরফের বিপদ তাহার চেয়ে বেশী নহে।
তিমিকে শীতের ভিতরে বাস করিতে হয়, কাজেই তাহার গায়ে গরম একটা কিছু না থাকিলে চলে না। উহার চামড়াই হইতেছে সেই গরম জিনিস। সে চামড়ার অধিকাংশই চর্বি, তাহার ভিতর দিয়া শীত প্রবেশ করিবার সাধ্য নাই। সমুদ্রের মাংসখেকো মাছেরা সেই চামড়া খাইতে যারপরনাই ভালোবাসে; তিমি পাইলেই তাহারা দলসুদ্ধ আসিয়া মহানন্দে তাহাকে খাইতে থাকে। তখন ডুব দিয়া একেবারে সমুদ্রের তলায় চলিয়া যাওয়া ভিন্ন আর বেচারার উপায় থাকে না। ছোট-ছোট মাছের নিতান্ত গভীর জলে যাইবার সাধ্য নাই, কাজেই সেইখানে গিয়া তিমি একটু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে।
কিন্তু সেই গভীর জলে আবার চিরকাল বসিয়া থাকিবার জো নাই, কেননা তাহার খোরাক যে ছোট-ছোট মাছ, তাহারা থাকে উপরে। ইহা ছাড়া, যদিও অনেকে তিমিকে মাছ বলে, তথাপি সে আসলে হাতি ঘোড়ার মতো জানোয়ার। মাছের রক্তের মতো উহার রক্ত ঠাণ্ডা নহে, কিন্তু হাতি ঘোড়ার রক্তের মতো গরম। শিশুকালে সে হাতি ঘোড়ার বাচ্চার মতো মায়ের দুধ খায়, আর, সেইটাই আসল কথা, হাতি ঘোড়ার মতো তাহারও নিশ্বাস ফেলা চাই। কাজেই আর কোনো কারণে না হউক শুধু নিশ্বাস ফেলিবার জন্যই শিশুর মতো তাহাকে বারবার উপরে আসিতে হয়।
তিমির নিশ্বাস ফেলা এক চমৎকার ব্যাপার। আমরা যেমন নাক দিয়া নিশ্বাস ফেলি, তিনি তাহা করে না; উহার শ্বাস প্রশ্বাসের ছিদ্রটি ঠিক মাথার উপরে, একটি ছোট ঢিপির আগায়। শ্বাস ফেলিবার সময় জল আর হাওয়া মিলিয়া সেই ছিদ্রের ভিতর দিয়া শোঁ শো শব্দে প্রকাণ্ড ফোয়ারা বাহির হয়, আর অমনি মাস্তুলের উপর হইতে শিকারীদের পাহারাওয়ালা “ঐ জল ফুকিতেছে।” বলিয়া চ্যাঁচায়। তখন যে খুব একটা হুলস্থূল পড়িয়া যায়, তাহা বুঝিতেছ।
নৌকা প্রস্তুতই থাকে, আর থাকে হাজার হাজার হাত রশি বাঁধা বড়-বড় দেহাতি বল্লম। মুহূর্তের মধ্যে সেই সব-নৌকা নিঃশব্দে তীরের মতো ছুটিয়া বাহির হয়। শিকারী বল্লম হাতে নৌকার আগায় খাড়া থাকে আর সকলে প্রাণপণে দাঁড় টানে। তিমি এত বিপদের কথা কিছুই জানে না, ইহার মধ্যে বল্লমের বিষম খোঁচা লাগিয়া তাহার প্রাণ চমকাইয়া দেয়। অমনি সে সাগর তোলপাড় করিয়া সেই বল্লম সুদ্ধ ভয়ংকর বেগে তলার দিক পানে ছোটে। বল্লমের দড়ি হস্ হুস শব্দে খুলিতে থাকে। তখন যদি ক্রমাগত তাহাতে জল না ঢালা হয় তবে তাহা ভয়ানক তাতিয়া নৌকায় আগুন ধরিয়া যাইতে পারে। যদি কাহারও পা উহাতে জড়াইয়া যায়, তবে তখনি পাখানি কাটিয়া যাইবে, না হয় দড়ির টানে লোকটি চিরদিনের মতো জলের নিচে যাইবে। যদি নৌকায় দড়ি আটকাইয়া যায় তবে নৌকারও সেই দশা হইতে পারে। আর তিমি ডুব দিবার সময় যদি তাহার লেজের বাড়ি নৌকায় লাগে, তবে তো তাহার চুরমার হইয়া যাওয়া ধরা কথা।
দেখিতে দেখিতে তিমি একেবারে সমুদ্রের তলায় গিয়া উপস্থিত হয়, আর এতই বেগে গিয়া উপস্থিত হয় যে তলায় ঠেকিয়া মাঝে মাঝে তাহার মাথা কাটিয়াও যায়। কিন্তু সেখানে গিয়াও আর বেশিক্ষণ থাকিবার জো নাই, আবার নিশ্বাস ফেলিবার জন্য উপরে আসিতেই হয়। নিষ্ঠুর শিকারীরাও বল্লম লইয়া প্রস্তুত থাকে, তিমি ভাসিয়া উঠামাত্রই আর-একটি বল্লম তাহার গায়ে বিঁধাইয়া দেয়, কাজেই আবার বেচারা প্রাণের ভয়ে পাগল হইয়া তলার দিকে ছোটে।
এইরূপে একবার ভাসা, একবার ডোবা, আর ক্রমাগত বল্লমের খোঁচা খাওয়া, এমনি করিয়া বেচারা ক্রমেই কাহিল হইতে থাকে, ইহার পর তাহার মৃত্যু হইতেও আর বেশি দেরি হয় না। তখন তাহাকে টানিয়া জাহাজের কাছে আনিয়া ছুরি কোদাল দিয়া তাহার চামড়া কাটিয়া ফেলা হয়। সেই চামড়া টুকরো করিয়া পিপায় পোরা হইলে, আর একটি কাজ বাকি থাকে, তাহার কথা এখন কিছু বলা দরকার।
তিমি এত বড় জন্তু, কিন্তু তাহার গলার ছিদ্র নিতান্তই ছোট। পুঁটি বাটার চেয়ে বড় মাছ সে গিলিতে পারে না। সে হাঁ করিয়া মাছের ঝাঁক-সুদ্ধ জল মুখের ভিতরে টানিয়া নেয়, তারপর জলটুকু ছাড়িয়া দেয়, মাছ মুখের ভিতরে আটকা পড়ে। যে তিমি লোকে শিকার করিতে যায় তাহার দাঁত নাই, তাহার জায়গায় চিরুনীর মতো একটি জিনিস থাকে। সে চিরুনীর ফাঁক দিয়া মাছ গলে না, কিন্তু জল বাহির হইয়া যায়। এই চিরুনী যে জিনিসের তৈরি, তাহাই ‘কাচকড়া’। ইহা অনেক কাজে লাগে, কাজেই ইহাতেও ঢের লাভ হয়। তিমির চামড়া তুলিয়া লওয়া শেষ হইলে, এই কাচকড়ার চিরুনীটি কাটিয়া বাহির করারও নিতান্ত দরকার। সে কাজ হইয়া গেলে আর তিমিব শরীরটা দিয়া শিকারীদের কোনো প্রয়োজন থাকে না;কাজেই তাহারা তখন সেটাকে সমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়া অন্য শিকার খোঁজে। তারপর সেখানকার যত পাখি, যত মাছ, যত শেয়াল, যত ভাল্লুক সকলে আসিয়া মহানন্দে সেই দেহ ভোজন করে।
এই তিমি গ্রীনল্যাণ্ড দেশের নিকটে থাকে, তাই ইহার নাম “গ্রীনল্যাণ্ড তিমি”। ররকাল (Rorqual) বলিয়া ইহাদের চেয়ে বড় আর-এক রকমের তিমি আছে, কিন্তু তাহার এত চর্বি নেই, কাচকড়াও খুব কম। তাহাতে আবার উহার স্বভাবটাও হিংস্র, নৌকাসুদ্ধ কামড়াইয়া ধরিতে চায়। কাজেই ইহাকে শিকার করিতে লোকের তত উৎসাহ নাই।