উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/পুরাতন কথা : ২

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

পুরাতন কথাঃ ২

 বৃষ্টি হইলে নিচু জায়গায় জল দাঁড়ায়। বুদ্ধিমান গৃহস্থেরা উঠান উঁচু রাখেন, আর ছোটছোট নালা কাটিয়া জল সরিবার বন্দোবস্ত করেন। বৃষ্টির সময় ঐ-সকল নালা ছোট-ছোট নদীর আকার ধারণ করে, ছেলেবেলায় তাহাতে মোচার খোলার নৌকা ভাসাইয়া আমোদ দেখিয়াছি। উঠানের যত কিছু ধূলা, মাটি, খড় কুটা সকলেরই নমুনা বৃষ্টির জলের সঙ্গে ঐসকল নালা দিয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। নালার জল ভারি ঘোলা হইয়াছে। ঐ জল হয়তো একটা বড় গর্তে যাইয়া পড়িতেছে। গর্তের কাছে গেলে দেখিবে, সেখানে অনেক জল দাঁড়াইয়াছে। বৃষ্টি হইয়া গেলে ঐ জল থিতাইয়া ক্রমে পরিষ্কার হইবে, ক্রমাগত কয়েকদিন বৃষ্টি না হইলে শুষিয়া যাইবে। এখন যদি একবার ঐ গর্তের তলাটা পরীক্ষা করিয়া দেখ, তবে দেখিবে যে তলায় অতি মিহি মোলায়েম কাদা জমিয়াছে। ঐ কাদা উঠান হইতে আসিয়াছে। উঠান হইতে ভারী জিনিস যাহা কিছু আসিয়াছিল, তাহা ঐ কাদায় ঢাকা পড়িয়াছে।

 বর্ষাকালে নদীর জল বাড়ে। চৈত্র বৈশাখ মাসে ছোট নদীটি ঝির ঝির করিয়া কোনমতে দিনপাত করে। তাহার পরিষ্কার টলটলে জলটুকু দিন দিন শুকাইয়া যায়, দেখিলে দুঃখ হয়। বর্ষাকাল আসুক, দেখিবে তাহার আর সে অবস্থা নাই। তখন এ স্বচ্ছ জল থাকিবে না, দুরন্ত রাখাল বালকেরা তখন আর চৌপর দিন ধরিয়া স্নান করিতে থাকিবে না, তখনকার সেই দেশ ভাসানো ঘোলা জল আর তার বেগ দেখিলেই মনে একটা কুমির-কুমির ভাব আসে। এভাবেও কিছু আর চিরদিন যাইবে না। বর্ষা চলিয়া গেলে আবার নদীর পরিসর কমিতে থাকিবে। ঘোলা জল থিতাইয়া ক্রমে পরিষ্কার হইবে। নদীর দুই ধারে যে-সকল জায়গা ডুবিয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার একটু একটু করিয়া জাগিবে। এখন দেখিবে তাহাদের উপরেও অতি মিহি মোলায়েম কাদা জমিয়াছে; সাধারণ কথায় বলিবে, ‘পলি পড়িয়াছে।’

 উঠানের নালার জল যেমন গতে পডিয়াছিল, নদীর জলও তেমনি হয়তো সমুদ্রে পড়িতেছে। নদীর জলে কত জিনিস—কত গাছপালা, কত জন্তুর মৃত শরীর ভাসিয়া যায়, তাহাদেরও অনেকে সমুদ্রে যাইয়া পড়িতেছে। সেখানে কয়েকদিন ভাসিয়া তারপর তলাইয়া যাইতেছে। এইরূপে নদী যে-সব জায়গার ভিতর দিয়া আসিয়াছে, তাহদের কিছু কিছু নমুনা সমুদ্রের তলায় আসিয়া পড়িতেছে। প্রত্যেক বর্ষার ঘোলা জল হইতে পলি পড়িয়া আবার ইহাদিগকে ডাকিতেছে। এইরূপে এক-এক বৎসরের এক এক স্তর পলি আর সেই সকল স্তরের মাঝে নানানরকমের জিনিসের নমুনা জমিতেছে।

 জোয়ার-ভাঁটা অনেকেই দেখিয়াছ না দেখিয়া থাকিলেও তাহার বিষয় পড়িয়াছি। সমুদ্রের জল দিনে দুইবার করিয়া বাড়ে কমে, তাহাকেই আমরা জোয়ার-ভাঁটা বলি। সমুদ্রের সহিত যে-সকল নদীর সংযোগ আছে সেই সকল নদীতেও জোয়ার-ভাঁটা হয়। সমুদ্রের দিকে জল নদীর ভিতরে আসে। নদীতে তখন জল বাড়িতে থাকে, এবং দুধারের জমি অনেক দূর অবধি ডুবিয়া যায়। আবার ভাটার সময় জল সরিয়া আসে। জোয়ারে ডোবা জায়গাগুলি আবার ভাসিতে থাকে। তখন দেখা যায়, তাহদের উপরে পলি পড়িয়াছে। নদীর জল যত

অধিক ঘোলা হয়, এই পলি ততই পুরু হইয়া পড়ে, আর জোয়ার যত বেশি হয় নদীর দুপাশের জমি ততই দূর অবধি ডুবিয়া যায়৷

 অমাবস্যা পূর্ণিমায় যত জোয়ার হয়, অষ্টমীর দিন তাহার চাইতে অনেক কম হয়। অমাবস্যার দিন অনেক দূর অবধি ডুবিয়া পলি পড়িয়াছে। আবার পূর্ণিমা না আসিলে এত দূর জল আসিবে না। এর মধ্যে যদি বৃষ্টি না হয়, তবে এই পলি শুকাইয়া শক্ত হইয়া যাইবে। যখন এই পলি কোমল ছিল, তখন ইহার উপর দিয়া কত পশুপক্ষী চলিয়াছে, কত গাছের পাতা বাতাসে উড়িয়া আসিয়া ইহার উপরে পড়িয়াছে। মিহি কাদায় সেই সকল পশুপক্ষীর পা এবং সেই সকল পাতার অতি চমৎকার ছাঁচ রহিয়াছে। এর মধ্যে যদি দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি হইয়া থাকে, তবে প্রত্যেকটি ফোঁটার দাগ রহিয়াছে। একবার শুকাইতে পারিলেই এই সকল দাগ ও ছাঁচ চিরস্থায়ী হইয়া রহিল। পূর্ণিমার সময় ইহার উপর আবার একস্তর পলি পড়িবে, কিন্তু সে পলিতে এই সকল দাগের কোনো অনিষ্ট হইবে না। প্রতিদিন সকালে অনেক ঘরের মেঝেতে মাটির লেপ দেওয়া হয়। এই সকল লেপের স্তর একটির সঙ্গে আর একটিমিশিয়া যায় না। পুস্তকের পাতার মতো তাহারা পৃথক পৃথক থাকে। পলি পড়ার সম্বন্ধেও ঠিক তেমনি। এক স্তর পলি যদি শুকাইতে পাইল, তবে আর এক স্তর পলি তাহার উপরে পড়িলেও দুটি স্তর পৃথক পৃথক থাকিবে৷