বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বান ডাকা

উইকিসংকলন থেকে

বান ডাকা

 এদেশের অনেক নদীতে জোয়ার ভাঁটা দেখা যায়। চবিবশ ঘণ্টার ভিতর দুবার করিয়া সমুদ্রের জল বাড়ে আর কমে, তাহাকেই জোয়ার আর ভাঁটা বলা হয়। যে-সকল নদীর সঙ্গে সমুদ্রের যোগ আছে, সমুদ্রের জোয়ারের জল তাহাতে প্রবেশ করিয়া তাহার ভিতরেও জোয়ার ভাঁটা জন্মায়। তখন নদীর স্রোত কমিয়া যায়, অথবা একেবারে ফিরিয়াই যায়। কোনো কোনো নদীতে ‘বান’ ডাকে।

 ‘বান ডাকা’ কাহাকে বলে জান? সমুদ্রের জল নদীতে প্রবেশ করিবার সময় কখনো কখনো নদীর জলের চাইতে অনেকখানি উঁচু হইয়া আসে, ইহাকেই বলে ‘বান ডাকা’। বানের মুখে নৌকা পড়িলে ভারি মুস্কিল, সুতরাং ঐ সময়ে নৌকার মাঝিরা ভারি ব্যস্ত হয়। ঘাটে যে-সকল লোক স্নান করে, বান ডাকিবার সময় তাহারা তাড়াতাড়ি ডাঙ্গায় উঠিয়া আসে। দৈবাৎ দু-একজন সময়ে উঠিয়া আসিতে না পারিলে, যারপরনাই হাবুডুবু খায়। বান বেশি উঁচু হইয়া আসিলে, অনেক সময় তাহাতে পড়িয়া লোক মারা যায়।

 কলিকাতায় বান অনেক সময় পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু হইয়া আসে। এবারে শুনা গিয়াছিল যে, আর বারের চাইতে অনেকখানি উঁচু হইয়া বান আসিবে; নদীর ধারের বাঁধগুলি নাকি এইজন্য উঁচু করা হইয়াছিল। নদীর ধারের বড়-বড় অফিস, কারখানা, ডক্‌ ইত্যাদি রক্ষা করিবার জন্যও নাকি দেয়াল গাঁথা হইয়াছিল। বানের তামাশা দেখিবার জন্যও হাজার-হাজার লোক কাজকর্ম ফেলিয়া গঙ্গার ধারে গিয়া অপেক্ষা করিতেছিল, অনেক ফটোগ্রাফার ক্যামেরা খাটাইয়া প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু বান আসিল না।

 অমাবস্যা পূর্ণিমায় জোয়ার ভাঁটা খুব বেশি হয়, সাধারণত সেই সময়েই বান ডাকে। সকল অমাবস্যা পূর্ণিমাতেই যে বান ডাকে তাহা নহে, আবার নদীতে জোয়ার ভাঁটা থাকিলেই যে, সে নদীতে বান ডাকিবে তাহাও নহে।

 জোয়ারটি যেমন প্রবল, নদীর স্রোতও তেমনি প্রবল হওয়া চাই। নদীর মুখ যদি বেশ চওড়া থাকে, তবে সমুদ্রের জল তাহাতে অনেক পরিমাণে ঢুকিতে পায়। নদীর মুখে চড়া না থাকলে, এই জল ক্রমে নদীর জলের সঙ্গে মিশিয়া যায়। কিন্তু নদীর মুখে চড়া থাকিলে সে জল সেখানে সঞ্চয় হইয়া বললাভ করে।

 এই তিন বস্তু—নদীর স্রোত প্রবল থাকা, তাহার মুখ চওড়া থাকার দরুন সমুদ্রের জোয়ারের জল বেশি পরিমাণে প্রবেশ করা, আর চড়ায় বাধা পাইয়া সেই জল রাশিকৃত হওয়া—এক জায়গায় হইলেই জোয়ারের সময় নদী আর সমুদ্রে মধ্যে একটা তুমুল যুদ্ধের জোগাড় পাকিয়া আসে। তখন সমুদ্রের সেই রাশিকৃত জল চড়া ডিঙ্গাইয়া নদীর ভিতরে প্রবেশ করে। নদীর পরিসর ক্রমে যতই কমিয়া আসে, ততই এই জল ছাড়াইবার স্থান না পাইয়া উঁচু হইয়া উঠে, আর তাহার বেগও ক্রমে ততই বাডিতে থাকে। রেলের মতন বেগে সেই জল সোঁ সোঁ শব্দে অগ্রসর হয়, তাহার সামনে যে পড়ে, তাহার আর রক্ষা নাই।

 চীন দেশে সিন্‌-তাং-কিয়াং নামক একটি নদী আছে। তাহাতে বড় ভয়ানক বান ডাকে। বান আসিবার এক ঘণ্টা পূর্বে তাহার গর্জন শুনা যায়। নদীর জল হইতে বান বারো ফুট উঁচু হইয়া আসে! ঘণ্টায় চৌদ্দ মাইল তাহার বেগ হয়।

 চীন দেশের লোকেরা বানকে বড় ভয় করে। সিন্‌-তাং-কিয়াং নদীর বানের সম্বন্ধে তাহাদের দেশে একটি গল্প আছে। তাহারা বলে যে, প্রাচীন কালে তাহাদের দেশে একজন সেনাপতি ছিলেন, তাঁহার মতন যোদ্ধা কেহ ছিল না। তিনি এত যুদ্ধ জয় করিয়াছিলেন যে, তাহা দেখিয়া শেষটা স্বয়ং সম্রাটের মনে হিংসা হইল। এইজন্য সম্রাট তাঁহাকে গোপনে হত্যা করিয়া, শরীরটা সিন্‌-তাং-কিয়াং নদীতে ফেলিয়া দিলেন। সেই সেনাপতির প্রেতাত্মা আজও সে কথা ভুলিতে পারে নাই, তাই সে রাগের ভরে এক-এক-বার সমুদ্রের জল আনিয়া দেশ ডুবাইয়া দিতে চেষ্টা করে।

 সিন্‌-তাং-কিয়াং নদীর বান হয়তো পৃথিবীর মধ্যে সকলের চাইতে উঁচু হয়। কিন্তু ‘আমেজন’ নদীর বানের পরিসর পৃথিবীর মধ্যে সকলের চাইতে বেশি। সে দেশের লোকেরা এই নদীর বানকে বলে, ‘প্ররোরক’—অর্থাৎ ‘সর্বনেশে’। এই নামটি হইতে ব্যাপারটির কতক পরিচয় পাওয়া যাইতেছে।

উপেন্দ্র—১২১