বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মহারাজা সায়াজী রাও গাইকোয়াড়

উইকিসংকলন থেকে

মহারাজা সায়াজী রাও গাইকোয়াড়

 আজ তোমাদিগকে ভারতের এক স্বাধীন নৃপতির জীবনের কথা বলিব। (বর্তমান কালের আমাদের দেশে যে সমুদয় মহানুভব ব্যক্তি জীবিত আছে, ইনি তাঁহাদের মধ্যে একজন।) রাজ ঐশ্বর্যের মধ্যে প্রতিপালিত হইয়া ইনি যে প্রকার প্রকৃত মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বে অগ্রসর হইয়াছেন, সচরাচর তেমন দেখা যায় না। উপরে উপরে দেখিলে মনে হইতে পারে, যাহারা ধনৈশ্বর্যের মধ্যে বর্ধিত তাহাদের পক্ষে মহৎ জীবন লাভ করা সহজ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে ধনী অপেক্ষা দরিদ্র শ্রেণীর মধ্য হইতেই জগতের অধিকাংশ মহাজন উদ্ভূত হইয়া থাকেন। ইহার কারণ নির্দেশ করাও কঠিন নহে। সংগ্রামে বিপদে ও পরীক্ষায় মানব চরিত্রের গূঢ় শক্তি সকলের বিকাশ হয়। সম্পদের ক্রোড়ে যাঁহারা লালিত, প্রায়ই ভোগবিলাসের তরঙ্গে তাহাদের হৃদয়ের উচ্চ ভাবসকল ভাসিয়া যায়। সকল দেশেই ধনী ও সম্পদশালী লোকদের মধ্যে প্রকৃত মহত্ত্ব বিরল। বিশেষত ভারতবর্ষে ধন এবং মহত্ত্বের একত্র সমাবেশ অতি অল্পই দেখা যায়। বরোদার বর্তমান গাইকোয়াড় মহারাজা সায়াজী রাওয়ের জীবনে কিন্তু এই উভয়ের সুন্দর সম্মিলন হইযাছে। একদিকে তিনি যেমন রাজা, বংশগৌরবে অতি উচ্চস্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন, অপরদিকে জ্ঞানে তিনি তৃতীয় স্থানীয়। কিন্তু সেজন্য তাহার মহত্ত্ব নহে। তাহাব সমকক্ষ গুণে এবং চরিত্রের প্রভাবে তিনি সর্বজনপ্রিয়। ভারতের রাজন্যগণের মধ্যে এবং তাহার অপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী রাজা তো অনেকে আছে। আপন আপন রাজ্যের বাহিরে তাঁহাদিগের নাম অধিক শুনা যায় না। কিন্তু বরোদার মহারাজা সায়াজী রাও-এর নাম ভারতের সর্বত্র সুবিখ্যাত। সম্প্রতি তাঁহার রাজ্যারোহণের পঞ্চবিংশ বাৎসরিক উৎসব হইয়া গিয়াছে। তাহাতে সকল প্রদেশের লোক আনন্দ প্রকাশ কবিয়াছে। তিনি বাস্তবিকই আদর্শ নরপতি। বিধাতা তাহাকে যে উচ্চপদ দিয়াছেন, প্রচুর ধনৈশ্বর্য এবং শক্তি দিয়াছেন এ সমুদয়ই তিনি আপনার প্রজা এবং সমগ্র ভারতবাসীর কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করিয়াছেন। অন্যান্য রাজাদের ন্যায় ভোগবিলাসে, আমোদ প্রমোদে, আলস্য বা ইংরাজ রাজপুরুষদের তোষামোদে তাহার সময় অতিবাহিত হয় না। তিনি প্রতিদিন নিয়মিতরূপে, পাঠ আলোচনা, রাজকার্য পরিদর্শন এবং জনহিতকর কার্যে যাপন করেন। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন ও বিজ্ঞানে তিনি সুপণ্ডিত। তাঁহার মত বিচক্ষণ ব্যক্তি বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে কম আছে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিষয়ে তিনি বহু চিন্তা করিয়াছেন এ সকল বিষয়ে তিনি অনেক সময়ে বক্তৃতা করিয়া থাকেন। ভারতবাসিগণ তাহাকে আপনাদের একজন প্রধান নেতা বলিয়া মনে করেন। আর তিনিও আপনাকে একজন বলিয়া মনে করেন। তিনি অনেক সময়ে বলিয়াছে যে আমরা সকলেই এক ভারতমাতা সন্তান। তাঁহার বেশভূষায় বা ব্যবহারে, কোনোপ্রকার আড়ম্বর নাই। অতি সামান্য পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া সামান্য লোকের মতো তিনি সকলের সঙ্গে মিশিয়া থাকেন। তাহার আচরণে পদৈশ্বর্যজনিত গর্বের লেশমাত্র দৃষ্ট হয় না।

 আমাদের দেশের সকলপ্রকার জনহিতকর কার্যের সঙ্গে তাহার পূর্ণ সহানুভূতি আছে। এবং যাহা ভালো বুঝিয়াছেন, কাহারো দিকে দৃকপাত না করিয়া তিনি তাহা করিয়া যান। অনেকবার তিনি জাতীয় মহাসমিতিতে উপস্থিত হইয়াছিলেন। রাজন্যবর্গের কথা দূরে থাক, অনেক ক্ষুদ্র জমিদারেরা পর্যন্ত গবর্ণমেণ্টের ভয়ে অনেক সময়ে এইসকল সভায় উপস্থিত হইতে সাহস করেন না। অনেকে মনে করেন যে, গবর্ণমেণ্ট এজন্য তাহার প্রতি বিরক্ত। কিন্তু তিনি গবর্ণমেণ্টের অনুরাগ বিরাগ তুচ্ছ করিয়া প্রকাশ্যভাবে দেশের লোকের রাজনৈতিক আকাঙ্খার সমর্থন করিয়াছেন। এ দুর্ভাগ্য দেশের প্রধান শত্রু ভয়,“রাজভয়, লোকভয়, সমাজভয়ে দেশের লোক অস্থির। মহারাজা সায়াজীরাও ইহার কোনো ভয়ই গ্রাহ্য করেন নাই। তোমরা হয়তো মনে করিতে পার, রাজার আবার ভয় কি? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজাদেরই ভয়ের কারণ অধিক। বড় গাছেই বড় বাজ পড়ে। সামান্য লোকে যেসব কাজ করিলে কেহই কিছু বলে না, রাজা বা বড় লোকেরা তাহা করিলে সকলেরই দৃষ্টি তাহাতে আকৃষ্ট হয়। এই কারণে রাজা ও উচ্চপদস্থ লোকদিগকে সাবধানে চলিতে হয়। ভয়ের কারণ অধিক না থাকিলেও রাজাদের ভয় যে বেশি, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তাহার প্রমাণ, এই যে কোনো সৎসাহসের কার্যে তাহাদিগকে অগ্রসর দেখিতে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে মহারাজা সায়াজী রাও একমাত্র দৃষ্টান্তস্থল বলিলে অত্যুক্তি না। একদিকে তিনি যেমন রাজভয়কে তুচ্ছ কবি কংগ্রেস প্রভৃতি সাধারণ জনহিতকর কার্যে প্রকাশ্যভাবে যোগ দিয়াছেন, অপরদিকে তিনি সামাজিক ভয়ের মস্তকে পদাঘাত করিয়া সমুদ্রযাত্রা, বিদেশ ভ্রমণ প্রভৃতি সংস্কারে স্বয়ং দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন। মহারাজা সায়াজী রাও একাধিকবাব ইউবোপ এবং আমেরিকা গমন করিয়াছেন! অল্পদিন হইল তিনি মহারাণীকে সঙ্গে লইয়া আমেরিকা ভ্রমণ কবিধা আসিয়াছেন। প্রকাশ্য সভাতে ব্রাহ্মণ, শূদ্র, খৃস্টান, মুসলমান প্রভৃতি সকলের সঙ্গে বসিয়া আহার করিয়াছেন। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার, বিধবা বিবাহ প্রচলন, নিম্নশ্রেণীর লোেকদিগের অবস্থার উন্নতি প্রভৃতি সমাজ সংস্কারে তিনি অতিশয় উৎসাহী। তিনি বরোদা বাজো আইন দ্বারা বাল্যবিবাহ প্রথা দণ্ডনীয় করিয়াছেন। ইহাতে প্রজারা অনেক প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। বোধহয়, তিনি জনসাধারণের অপ্রিয়ও হইয়াছিলেন। কিন্তু লোকভয় অগ্রাহ্য করিয়া যাহা কল্যাণকর বোধ করিয়াছে তাহাই করিয়াছে। তাহাব সুশাসনে বরোদা রাজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি হইয়াছে। দেশে শিক্ষা বিস্তার, ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠা, শিল্প বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিয়া তিনি জনসাধারণের গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছে।

 অপরদিকে তাহার চরিত্র এবং পারিবারিক জীবন আদর্শস্থানীয়। সাধারণত যে সকল দুনীতি সম্পদশালী ব্যক্তিদিগের চরিত্র কলঙ্কিত করে, মহারাজা সায়াজী রাওয়ের চরিত্রে তাহার ছায়াও স্পর্শ করে নাই। তিনি আদর্শ স্বামী এবং আদর্শ পিতা। নিজে যেমন আড়ম্বরশূন্য কর্মশীল জীবন যাপন করিতেছে, পুত্র কন্যাদিগকেও সেইপ্রকার শিক্ষা দিতেছে। তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রিন্স ফতেসিংহ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়া এখন রাজকার্য শিক্ষা করিতেছে। দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স জয়সিংহ ইংলণ্ডের সুবিখ্যাত হ্যারো স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া সম্প্রতি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ লাভ করিয়াছে;তৃতীয় পুত্র প্রিন্স শিবাজী রাও বোম্বাই নগরীতে শিক্ষালাভ করিতেছে্ন। একমাত্র কন্যা রাজকুমারী ইন্দিরা বরোদার প্রিন্সেস স্কুলে শিক্ষার্থ প্রেরিত হইয়াছেন্ন। মহারাজা সায়াজী রাও আদর্শ জীবন যাপন করিতেছে। অতুল ঐশ্বর্যের প্রচুর শক্তি লাভ করিয়া, ভোগ বিলাসের সকল উপকরণ সত্ত্বেও যিনি নির্মল জীবন যাপন করিতে পারেন এবং রাজভয় লোভয় তুচ্ছকরিয়া একান্ত মনে কর্তব্যের পথে চলিতে পারেন, তিনি কি ধন্য নন? বরোদার গাইকোয়াড় মহারাজ সায়াজী রাও বর্তমান ভারতের গৌরব।


ছেলে সুবিমলকে লেখা বাবার চিঠি

লেখকের ইংরেজি হস্তাক্ষরের নমুনা