উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মাকড়সা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

মাকড়সা

 অনেকে মাকড়সা মারাকে অবশ্য কর্তব্যকর্ম মনে করেন। ‘মাকড়সা মেরো না’ বলিলে তাঁহারা হয়তো চমকিয়া উঠেন। মাকড়সার পূর্বপুরুষ কেহ বড়লোক ছিল না, সুতরাং বেচারা আমাদের নিকট আদর পায় না।

 মাকড়সা দেখিতে অনেকটা কাঁকড়ার মতো। পিঁপড়ে প্রভৃতির সঙ্গেও কিছু সাদৃশ্য আছে। একটা গোল আঁক দিয়া তার চারিদিকে আটখানি পা বসাইয়া দিলেই মনে করিতে পার একটি কাঁকড়া হইল। কাঁকড়ার পেছনে আর একটি গোলাকার রেখা সংযুক্ত কর মাকড়সার কাছাকাছি যাইবে! মাকড়সার মাথায় বড় পাগড়ি থাকিলে পিঁপড়ে জাতীয় পোকার মতো দেখা যাইত—তবে ঠ্যাং দুখানা বেশি হইত। মাকড়সার মুখে ভয়ানক দুটি অস্ত্র; তার দু-একটি ‘চিটি খাইলে হয়তো বড় সুবিধা বোধ করিবেন না। এই দুইটিকে মাকড়সার সাঁড়াশী (দাঁত নয়) বলা যাইতে পারে। যুদ্ধ এবং শিকারের সময় এইগুলি কাজে আসে। মাথায় বড়-বড় দুটি চোখ। তার আশেপাশে’ খুঁজিলে ছোট ছোট আরো চার-পাঁচটি দেখিতে পাইবে। যদি জিজ্ঞাসা কর, “এত চোখ কেন?” আমি বলিব, “জানি না।”

 মাকড়সার নাম লইলেই তাহার জালের কথা মনে পড়ে। জালে দুই কাজই চলে; বাড়ি করিয়া থাকা হয়, শিকারেরও সাহায্য হয়। মাকড়সার পেটের উপর গোরুর বাঁটের মতো ছোট-ছোট কয়েকটি বাট আছে। এই বাটের মুখ দিয়া একপ্রকার আঠা বাহির হয়। তাহাই বাতাসে শক্ত হইয়া দড়ির কাজ করে। এই দড়ি দিয়া জাল তৈরি হয়। এর এক-একটা এত সরু যে চোখে দেখা যায় না, তবুও বড়-বড় মাকড়সা তাহাতে ঝুলিয়া থাকে। কোনো হতভাগ্য পোকা একবার যদি মাকড়সার জালে পড়িল তবে তাহার রক্ষার সম্ভবনা অল্পই থাকে। হুড়োহুড়ি যত বেশি করে ততই গোলমাল আরো বাড়িতে থাকে। শেষে নিরূপায় হইয়া পড়ে। জালওয়ালা এতক্ষণ মধ্য হইতে শান্তভাবে চাহিয়াছিল। যেই দেখিল জোগাড়টা পাকাপাকি হইয়াছে অমনি আস্তে আস্তে কাছে আসিল। দড়ি সঙ্গেই আছেচারিদিক উত্তমরূপে দেখিয়া অম্লান বদনে হতভাগ্যকে বাঁধিতে লাগিল। বাঁধা শেষ হইলে আহার। মাথা ছিড়িয়া শরীরের রস চুষিয়া লয়, আর কিছু খায় না; মাঝে মাঝে দুই-একটা বোলতা আসিয়া জালে পড়ে। তখন আমাদের ইনি মনে করেন আপদ গেলেই বাঁচি! বোলতা চড্‌পড্‌ করিয়া জালের খানিকটা ছিঁড়িয়া পালায়।

 জালের কোনো অংশ ছিড়িয়া গেলে ‘লোকটা’ যত্নপূর্বক তক্ষণাৎ তাহা মেরামত করিয়া রাখে। এক জাল অকর্মণ্য হইয়া গেলে আর-একটা করিয়া লয়। এরূপে দড়ির পুঁজি ফুরাইয়া যায়। তখন প্রতিবেশী কেহ থাকিলে তাহাকে তাড়াইয়া দিয়া তাহার জাল দখল করে। অনন্যর জাল নিকটে না থাকিলে কি করে? গোল্ডস্মিথ সাহেবের মনেও এই প্রশ্ন হইয়াছিল। তিনি একটা মাকড়সার পেছনে লাগিলেন। সে তাঁহার থাকিবার ঘরেই বাড়ি করিয়াছিল। তিনি তাহার সমস্ত জাল ভাঙ্গিয়া তাহাকে সেখান হইতে তাড়াইয়া দিলেন। সে বারবার জাল গড়িতে লাগিল, সাহেবও ভাঙ্গিতে ত্রুটি করিলেন না। একটা পোকার পেটে আর কত দড়ি

থাকে! ভালোমানুষ নিরূপায় ভাবিয়া অগত্যা নিকটস্থ জাল দেখিতে গেল। জালের কর্তা ‘যুদ্ধং দেহি’ বলিয়া প্রচণ্ড লড়াই করিলেন। কিন্তু সাহেবের মাকড়সারই জয় হইল। সাহেব ইহা দেখিয়া ঘরের সমস্ত জাল ছিড়িয়া দিলেন। এবার বেচারা বড় বিপদে পড়িল। কিন্তু ছোট জন্তু বলিয়া বুদ্ধি কম নয়। সাহেবের কাগজপত্রের মধ্যেই বাড়ি করিল। ক্ষুধা হইলে এ জায়গায় মড়ার মতো পড়িয়া থাকিত, কোনো পোকা কাছে আসিলেই তাহাকে ধরিয়া ফেলিত।

 মাকড়সা খায় কি? এ কথায় উত্তর আমি তত সহজে দিতে পারিতেছি না। আমি এ পর্যন্ত এমন কিছু দেখি নাই যাহা পাইলে সে খুশি না হয়। জালে যাহাই পড়ক না, নড়িলে চড়িলেই হইল; কি পড়িয়াছে কে খোঁজ লয়? মশা মাছির ত কথাই নাই, ক্ষুধার সময় স্বজাতীয় দুই-একটি হইলেও চলে। কেহ কেহ ছোট-ছোট পাখি ধরিয়া খান।

 সকলের বড় যে মাকড়সা তাহার নাম ‘টরাণ্টুলা।’ এই জাতীয় মাকড়সাই নাকি পাখি ধরিয়া খায়। এক সাহেব একবার তিনটি টরাণ্টুলা সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনটিকেই এক খাঁচায় (খাঁচায় থাকিবার যোগ্যও বটে, এক-একটা যে বড়!) রাখা হইল। প্রথম প্রথম কয়েকদিন তাহারা কিছুই খাইল না। তারপর কয়েক খণ্ড মাংস চাটিয়া যেন তাহাদের ক্ষুধা বাড়িয়া গেল। তখন একটা আর দুইটাকে ধরিয়া খাইয়া ফেলিল। শেষটি আনিয়া সাহেব বিলাতের প্রাণীশালায় উপহার ছিলেন। সেখানে তাহাকে ছোট-ছোট ইঁদুর খাইতে দেওয়া হইত। প্রথম প্রথম ইঁদুরটির কিছুই ফেলা হইত না, শেষটা যেন টরাণ্টুলা মহাশয় বুঝিতে পারিলেন যে ইঁদুরের অভাব হইবে না। তখন থেকে কেবল মাথাটি খাইতে লাগিলেন।

 গায়ের কাপড় ময়লা হইলে আমারা ধোপার নিকট দিই। মাকড়সার ধোপা নাই, কিনতু সেও একটা খোলস পুরানো হইলে সেটাকে বদলাইয়া ফেলে। আমরা অনেক সময় দেখিয়াছ মরা মাকড়সাটা হাত পা কোঁকড়াইয়া জালে ঝুলিতেছে—বাস্তবিক হয়তো সেটা মাকড়সার খোলসমাত্র। এক-একটি খোলস এত পরিপাটি যে চিনিবার জো নাই। সুক্ষ্ম সূক্ষ্ম লোমগুলি পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাইতেছে।

 মাকড়সার বড় বুদ্ধি। একটি বাড়ির বারান্দায় একটা মাকড়সা জাল পাতিয়াছিল। বাতাস আসিলেই জালের নীচের দিকটা উঠিয়া আসিত;বেচারা বড় জ্বালাতন হইত। ভাবিয়াচিন্তিয়া সে একখানা ছোট লাঠি টানাটানি করিয়া লইয়া আসিল। বাসায় আসিবার সময় সেই লাঠিখানা জালে ঝুলাইয়া দিত; তাহাতে নঙ্গরের কাজ হইত।

 মাকড়সার জালে বড় পোকা পড়িলে দড়ি কাটিয়া তাহার যাইবার সহায়তা করে।

 একপ্রকার মাকড়সা আছে, তাহারা মাটিতে গর্ত খুড়িয়া ঘর বাঁধে। ভিতরে সাটিনের মতো মসৃণ। দেখিতে কাবুলী মেওয়া-ওয়ালাদের টুপির মতো ক্রমে সরু হইয়া গিয়াছে। একটি দরজাও আছে। দরজাটি মুখে এমন সুন্দরভাবে লাগে যে ভিতর হইতে ঠেলিয়া না দিলে খোলা যায় না। দরজার গায়ে ছোট-ছোট ছিদ্র আছে তাহাতে নখ দিয়া ভিতর হইতে ধরিয়া রাখে। দরজার বাহিরের দিকে মাটি মাখাইয়া এমন করিয়া রাখে যে সহসা চেনা যায় না।

 মাকড়সার প্রস্তাব আমরা শেষ করিলাম। ভরসা করি তোমরা আর মাকড়সা দেখিলেই মারিতে যাইবে না।