বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/মাকড়সা ২

উইকিসংকলন থেকে

মাকড়সা

 ছেলেবেলায় অনেক সময় বড়রা আমাদের বলত, “মাকড়সা মেরো না, পাপ হবে।” “কেন পাপ হবে?” জিজ্ঞাসা করলে বলত, “জান? মাকড়সা আমাদের কত উপকার করে? মানুষ মরে গেলে যম রাজার সামনে তার বিচার হয়। তখন সংসারের যত সবাই এসে বলে, মানুষ ভারি দুষ্টু, মানুষ আমাদের বড্ড জ্বালাতন করে, খালি মাকড়সা বলে, মানুষ আবার কি করে? আমি এত বড় জাল পেতে রাখি, কই একটা মানুষকেও তো তাতে পড়তে দেখি না!”

 মাকড়সার জাল তোমরা সকলেই দেখেছ। কিন্তু ভালো করে দেখেছ কি? ভারি বুদ্ধি খাটিয়ে সে তার জালখানি তয়ের করে। জালের সরু সরু সূতাগুলি কেমন চমৎকারভাবে সাজানো থাকে তা সকলেই জান।

 আমি বলছি মাকড়সার জাল, কিন্তু মাকড়সা নাকি বলে সেটা তার বৈঠকখানা। “ওগো তুমি একটিবার আমার বৈঠকখানায় আসবে?” বলে সে নাকি মাছিকে ডাকে। বোকা মাছি যদি সে কথায় ভোলে তা হলেই সে মারা যায়। মাকড়সার পক্ষে সেটা বৈঠকখানা হতে পারে, কিন্তু মাছির পক্ষে সেটা জাল বৈ তো আর কিছুই নয়। সে জালে একটিবার পড়লে আর বেচারার পালাবার উপায় থাকে না।

 জালের সূতার গায়ে বিন্দু-বিন্দু আঠা থাকে, সেই আঠায় তখনি তাকে আটকে যেতে হয়, তার উপর আবার মাকড়সা ছুটে এসে দড়ি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ফেলে আর কামড়িয়ে অবশ করে দেয়।

 মাকড়সার মুখের চেহারা কি ভয়ংকর। দুপাশের দুটো কাঁটা দিয়ে শিকারকে চিমটি দিয়ে ধরে, অমনি সেই কাঁটার আগা দিয়ে একরকম বিষ বেরিয়ে তাকে অজ্ঞান করে দেয়। তার উপর আবার বেশ করে সূতা দিয়ে জড়িয়ে নিলে শিকারের আর নড়বার চড়বার জো-ই থাকে না। এই সূতা বড়ই আশ্চর্য জিনিস। মাকড়সার পিছনের দিকে গোরুর বাঁটের মতন বাঁট থাকে! সেই বাঁটের ভিতর থেকে আঠা বেরোয় সেই আঠায় হাওয়া লাগলেই তা শুকিয়ে সূতার মতো হয়ে যায়, তাই দিয়ে মাকড়সা জালও বোনে শিকারকেও বাঁধে।

 একজন সাহেব একটা মাকড়সার জাল ছিঁড়ে দিলেন, তখন মাকড়সা আর একটা জাল বুনল। এইরকম বার কতক করে দেখা গেল যে মাকড়সার বাঁটের আঠা ফুরিয়ে গেছে, সে আর জাল বুনতে পারে না। তখন থেকে তার ব্যবসা হল ডাকাতি, অথাৎ অন্য মাকড়সাকে তার জাল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সেটা দখল করে নেওয়া।

 মাকড়সার জাল না থাকলে তার শিকার ধরার পক্ষে একটু মুশকিল হয়। তখন মরবার ভান করে পড়ে থাকা, মাছি কাছে এলে ঝাঁ করে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়া, এইরকম সব ফন্দির দরকার হয়ে পড়ে। অনেক সময় মাকড়সা শুধু কট্‌মটিয়ে তাকালেই শিকারের ভেবাচাকা লেগে যায়। সে তো আর যেমন তেমন চাহনি নয়। চারটে, ছটা কারুর-বা আটটা আগুনপারা চোখ;সে চোখের নজরে পড়লে শিকার বেচারা আপন হতেই ঘুরে ফিরে এসে মাকড়সার মুখে পড়ে। তাকে তাড়িয়ে ধরবার দরকার হয় না।

 মাকড়সা যদি বাঘের মতো বড় হত, তবে তাকে দেখলে হয়তো আমাদেরও অনেকের ভেবাচেকা লেগে যেত। বাস্তবিক মাকড়সার চেহারা বাঘের চেহারার চেয়েও ভয়ানক। একে তো মুখের গড়নই বিকট, তাতে এর বড় দুই দাঁড়া, তার পেছনে ভয়ানক দাঁতের সার—এর উপর আবার এতগুলো চোখ ঝল্‌মল্‌ করছে। রোঁয়ায় ভরা আটটা পা, তাতে ধারালো নখ। এমন জানোয়ারের কাছে বাঘ আর কত ভয়ানক হবে?

 মাকড়সার খোলস দেখেছ? সাপে যেমন খোলস ছাড়ে, মাকড়সাও তেমনি খোলস ছাড়ে। ঘরের কোণে, দরজার পিছনে, এমনি সব জায়গায় অনেক সময় মাকড়সার খোলস দেখতে পাওয়া যায়। জিনিসটা অবিকল মাকড়সার মতো। হাত-পা, নাক-মুখ, নখ-দাঁত, এমন-কি, প্রত্যেকটি রোঁয়া অবধি তাতে বজায় আছে, খালি ভিতরে জিনিস নাই, হাতে নিয়ে দেখলে বোঝা যায় সেটা শুধু খোলা! আমাদের যেমন ভুঁড়ি বড় হয়ে গেলে জামা বদলাতে হয়, তেমন মাকড়সাকেও বাড়তে গেলে খোলস বদলাতে হয়। ডিম থেকে সে যখন বেরোয়, তখন একটি সর্ষের মতো ছোট্ট থাকে। ছোট বটে, কিন্তু দেখতে ঠিক তার মাবাপের মতো; চেহারার তফাৎ একটুও নাই। তারপর ক্রমে বড় হয় আর খোলস বদলায়।

 মাকড়সার মা-বাপের কথা বলতে হলে আর-একটা কথাও বলতে হয়। এদের মধ্যে গিল্পীটিই হচ্ছেন আসল কর্তা: কর্তামশাইকে তার কাছে নিতান্তই জড়সড় হয়ে জোড়হাতে

থাকতে হয়। গিন্নীর মরজি হলে হয়তো বা এক-আধবার কর্তার একটু খাতির করেন। কিন্তু তারপরে হয়তো দেখা যায় যে তিনি তাকে চিবিয়ে খেয়ে মুখ হাত ধুয়ে দিব্যি হাসিমুখে বসে পান চিবোচ্ছেন।

 আমার একটু ভুল হল। মাকড়সা চিবিয়ে খায় না, তারা শুধু চুষে রস খায়। ওদের ঐসব ধারালো দাঁত শুধু শিকারকে ধরে রাখার আর মারবার জন্য, তাতে খাবার কোনো সাহায্য হয় না। জিভ আছে, ঠোঁট আছে, তা দিয়ে রস চুষে খাওয়ার বেশ সুবিধা হয়।

 ছেলেবেলায় মাকড়সার হেঁয়ালী শোনা যেত, তাতে আছে, ‘ছয় পা আঠারো হাঁটু।’ মাকড়সার যে আটটা পা, তা তোমরা গুনে দেখলেই বুঝবে। যে ঐ হেঁয়ালীটী তয়ের করেছিল, সে হয়তো ছয় পা-ওয়ালা একটা মাকড়সা দেখেই করে থাকবে— সে মাকড়সার দুটো পা কোন কারণে ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেই লোকটি মাসখানেক বাদে আবার যদি সেই মাকড়সাটাকে দেখত, তবে দেখতে পেত সে তার সেই দুটো পা আবার গজিয়েছে। মাকড়সাদের পা ছিঁড়ে গেলে আবার পা হয়। আমার কিন্তু খুব সন্দেহ হয় যে সেই হেঁয়ালীওয়ালা কখনো মাকড়সা ভালো করে দেখেনি; যদি দেখত তবে আঠারো হাঁটু বলত না, কেননা মাকড়সার ষোলোটা বৈ হাঁটু নাই।

 মাকড়সানী একবারে প্রায় ছয়-সাতশো ডিম পাড়ে। তারপর সেই ডিমের চারিধারে কাপড়ের মতো ওয়াড় বুনে চমৎকার পুঁটুলি তয়ের করে। কেউ কেউ সেই পুঁটুলিটি সঙ্গে করে নিয়ে বেড়ায়, কেউ কেউ আবার কয়েকটি ছোট পুঁটুলি বানিয়ে তাদের শিকেয় ঝুলিয়ে বৈঠকখানায় রেখে দেয়। ছানাগুলি ডিম থেকে বেরিয়ে প্রথমে কিছুদিন এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। তারপর আর একটু বড় হলে তারা যে যার পথ দেখতে বেরোয়। তখন হতে আর কেউ কারও ধার ধারে না।