উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/লড়াইয়ের বেলা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

লড়াইয়ের বেলা

 একটা ষণ্ডা আর একটা রোগা লোকে ঝগড়া হচ্ছে। ষণ্ডাটা বলল, “মারব তোকে একলাথি!” রোগাটা বলল, “আমার কি পা নেই?” ষণ্ডা বলল, “বটে? তোর পা দিয়ে তুই কি করবি?”রোগা বলল, “কেন? ছুটে পালাব!” তখন দুজনেরই খুব হাসি পেল, আর মিটমাট হয়ে গেল।

 তবে দেখা যাচ্ছে, সকলের বেলায় যুদ্ধের কায়দা এক রকম হয় না। একটা রোগা কুকুর আস্তাকুঁড়ে দাঁড়িয়ে এঁটো পাতা চাটছিল, এরমধ্যে একটা ষণ্ডা কুকুর এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তখন যে দুজনায় লড়াই হল, একটি ছেলে তার এইরকম বর্ণনা দিয়েছিল।—ষণ্ডাটা গলা ভার করে বলল, “কুছ্‌ হ্যা-া-া-া-া-য়?” রোগাটা খেঁকিয়ে বলল, “হে নাই!” অমনি ষণ্ডাটা আর কিছু না বলে রোগটার ঘাড় টিপে ধরল, আর তখন রোগাটা “হ্যায়! হ্যায়! হ্যায়! হ্যায়!” বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাতে লাগল। তোমরা যদি কেউ এরকম ঝগড়া স্বচক্ষে দেখে থাক, তবে বুঝতে পারবে, ছেলেটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছে।

 নিজেকে বাঁচিয়ে, দুষমনকে মার—এই হোল যুদ্ধের উত্তম কায়দা। মারতে না পার, নিদেন নিজেকে বাঁচিয়ে চল, এ কথাও মন্দ নয়। বেগতিক দেখলে ছুটে পালাবারও একটা দস্তুর আছে। অনেক জন্তু অনেকরকম কায়দা করে নিজেকে শক্রর হাত থেকে বাঁচায়।

 কচ্ছপের ক্ষমতা থাকলেও সে তার শক্রকে এমনি বিষম কামড়িয়ে ধরে যে সে কামড় ছাড়ানো বড়ই কঠিন হয়ে ওঠে। আর যখন তার ক্ষমতায় অতটা কুলায় না, তখন নিজের খোলার ভিতরে গলা হাত-পা সবগুটিয়ে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তখন অনেককেই সেই খোলার কাছে হার মানতে হয়।

 এ ফন্দিটা কচ্ছপ ছাড়া আরো কোনো কোনো জন্তুর জানা আছে। তাদের কারও গায়ে কাঁটা, কারও গায়ে শক্ত শক্ত আঁশ। শত্রু এলে তারা হাত পা গুটিয়ে, লেজ মুখ গুঁজে একটি গোলারমতো হয়ে যায়। তখন আর সহজে কেউ তাকে মারতে পারে না। কেন্নো যে টোকা দিলে টাকা হয়ে যায় তা তোমরা সকলেই দেখেছ।

 কোনো কোনো জানোয়ার এমন আছে, তারা ভালো করে না লুকিয়েই মনে করে ‘খুব লুকিয়েছি’। উটপাখি অনেক সময় লুকোতে হলে গাছের ঝোপে বা কোনো গর্তে মাথা ঢুকিয়ে থাকে— মনে করে কেউ বুঝি দেখতে পাচ্ছে না।

 গাঁধি পোকা দেখেছ? তাকে যদি ধরতে যাও তবে সে তার পিছনে থেকে এমনি ঝাঁঝালো একরকম রস ফুকে দিবে যে তার জ্বালায় তোমার চামড়ায় ফোস্কা পড়ে যায়।

 একরকম পোকা আছে, তাকে বলে (Bombardier Beetle) অর্থাৎ কামানবাজ পোকা। বড়-বড় পোকারা যখন তাকে তাড়া করে তখন সে একরকম নীল রঙের ধোঁয়া ছাড়তে থাকে তাতে শক্রর দম আটকে যায়।

 স্কাংক (Skunk) বলে একরকমের জন্তু আছে, তার কায়দাটাও অনেকটা এইরকমের। তার কাছেও একরকমের রস থাকে। সে রসে ঝাঁজ নাই, কিন্তু তার এমনি বিদঘুটে গন্ধ যে, সে গন্ধ নাকে গেলে ভুতকেও ‘বাপ্লেইস্ রে!’ বলে পালাতে হয়।

 শিয়ালেরও এইগোছের একটা বদনাম আছে। আমাদের একজন বুড়ো চাকর বলেছিল, “কুকুর শিয়ালের কি করবে? গন্ধে তার কাছে ঘেঁষতে পারলে তো? শিয়াল ভারি অসভ্য!”

 অনেক মাছ আছে, তারা প্রায়ই পুকুর বা নদীর তলায় সঙ্গে মিশে থাকে। ধরতে গেলে সেখানকার জল এমনি ঘোলা করে দেয় যে তখন তাকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে আর সেই ফাঁকে সে সেখান থেকে চম্পট দেয়।

 সমুদ্রের ভিতরে অক্টোপাস বলে একরকম জানোয়ার আছে। ভগবান তাদের প্রত্যেককে একটি করে কালির থলে দিয়েছেন। বিপদের সময় সেই কালি ছড়িয়ে তারা জল ঘোলা করে দেয়। তখন আর তাদের পালাতে কোনো মুশকিল হয় না।

 টিকটিকি নিতান্ত ফাঁপরে পড়লে তার লেজটি ফেলে রেখে ছুট দেয়। লেজটি পড়েই লাফাতে থাকে, আর শক্রতা দেখে আশ্চর্য হয়ে টিকটিকির কথা ভুলে যায়। তার কিছুদিন পরেই টিকটিকির আরেকটা নতুন লেজ বেরয়।

 যাহোক পালানই তো আর যুদ্ধের একমাত্র উপায় নয়, আর সে উপায় কিছু জন্তুরা পছন্দও করে না। সে-সকল জস্তুর কথা বলা হল, তারাও নিজেদের ভিতরে খুবই তেজের সঙ্গে লড়াই করে থাকে। আর সে সময় তাদের অনেকরকম অদ্ভুত কায়দা খেলাতেও দেখা যায়।

 ছাগলে ছাগলে যখন লড়াই হয়, তখনকার কাণ্ডটা নিশ্চয় তোমরা সকলেই দেখেছ। কাজেই আর তার কথা বাড়িয়ে বলবার দরকার নাই। প্যাঁচার যুদ্ধের আয়োজনটি তার চেয়েও সরেশ। যুদ্ধের সময় কোমর বেঁধে উঠে দাঁড়াতে হয়, এই তো আমরা জানি। কিন্তু প্যাঁচা তা না করে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ছেলেবেলায় একবার আমি একটা আম গাছে উঠতে গিয়ে হঠাৎ একটা প্যাঁচার বাসা দেখতে পেলাম। বাসায় তিনটা ছানা ছিল, তারা সকলেই আমাকে দেখে মস্ত মস্ত হাঁ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি তো তাতে হেসেই অস্থির। সেখানে একজন বুড়ো মানুষ ছিলেন, তিনি তখন আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে ঐ হচ্ছে প্যাঁচার লড়াইয়ের কায়দা। ওদের গলা ছোট বলে ঠোঁট বাড়িয়ে ঠোকরাবার তেমন সুবিধা হয় না। কাজেই নখ দিয়ে লড়াই করতেই তারা বেশি ভালোবাসে, আর সে কাজটা চিৎ হয়ে করতে পারিলেই যুদ্ধটি জমাট হয়।

 মোরগের লড়াইও বেশ মজার। ঠিক ছোট কুস্তিওয়ালার মতো দুটো মোরগ এসে একপা বাড়িয়ে স্থির ভাবে সামনা সামনি হয়ে দাঁড়ায়, আর গলা নিচু করে প্রাণপণে চোখ রাঙ্গা রাঙ্গি করতে থাকে। হঠাৎ একবার দেখবে, দুজনেই উছলে উঠছে, আর গলা ফুলিয়ে বিষম ঠোকরাঠকরি জুড়ে দিয়েছে। দুজনের চেষ্টা কিসে শত্রুর ঘাড়ে কামড়ে ধরে তাকে জয় করবে। মোরগ দুটো বাচ্চা হলে, যুদ্ধ ততদূর গড়াবার আগেই হয়তো একটা বড় মোরগ ছুটে এসে তাদের ধমকিয়ে থামিয়ে দেয়।

 মাকড়সার আটটি পা। যুদ্ধের সময় সে তার চারটিতে ভর দিয়ে আর চার পা সুদ্ধ মাথাটি উচু করে ভয়ংকর মূর্তি ধরে দাঁড়ায়। তার আসল হাতিয়ার হচ্ছে তার মুখের কাছের ঐ সাঁড়াশী দুটি। চারটি পা তুলে ধরার মতলব এই যে, তা দিয়ে শক্রর চোট সামলাতে হবে। শক্র যদি তার দু-একটা ছিড়ে ফেলে, তাতেও ক্ষতি নাই, কেননা তার জায়গায় নুতন পা গজাতে বেশি দিন লাগবে না। গঙ্গা ফড়িং যুদ্ধের সময় এমনিভাবে সামনের পা উচু করে দাঁড়ায়।