উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/সাহসী বালক

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

নানা প্রসঙ্গ : ৩

সাহসী বালক

 একদিন আমরা স্কুলে যাইতেছি এমন সময় দেখিলাম আমাদের সহপাঠী একটি বালক নিকটস্থ মাঠের দিকে একটা গোরু লইয়া যাইতেছে। পথে একদল ছেলের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। ঐ দলের জ—ঠাট্টার বিষয় পাইলে কখনও ছাড়িত না। জ—বলিয়া উঠিল, ‘কিহে! দুধের দাম কত? বলি উ—তুমি কোন ঘাস খাও? গোরুর শিঙ্গে যে সোনাটুকু আছে তাহার দাম কত? ওহে, তোমরা দেখ! যদি নূতন ফ্যাশন্‌ দেখিত চাও তবে এই জুতা জোড়াটার পানে তাকাও।’

 উ— একটু হাসিয়া আমাদিগকে নমস্কার করিল, তারপর মাঠের চারিধারে যে বেড়া ছিল তাহার দরজা খুলিয়া গোরুটিকে ভিতরে দিল। তারপর দরজা বন্ধ করিয়া আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই স্কুলে আসিল। বিকালে স্কুলের ছুটির পর গোরুটিকে বাহির করিয়া লইয়া গেল, কোথায় নিল আমরা কেহই জানিতে পারিলাম না। দুই-তিন সপ্তাহ ধরিয়া সে রোজই এই কাজ করিতে লাগিল।

 এই স্কুলের ছেলেরা প্রায়ই ধনীর সন্তান। ইহাদের কতকগুলি আবার এমন মূর্খ ছিল যে, গোরু মাঠে লইয়া গিয়াছিল-বলিয়া উ-কে ঘৃণা করিত।

 ইহারা উ-র মনে কষ্ট দিবার জন্য নানারকম বিশ্রী কথা বলিত। উ-তাহাতে কিছুমাত্র বিরক্ত না হইয়া সে-সকল সহ্য করিত। একদিন জ-বলিল, “কিহে উ—তোমার বাবা কি তোমাকে গোয়ালা করিতে চাহিতেছেন নাকি?’

 উ—বলিল, ‘ক্ষতি কি?’

 ‘ক্ষতি কিছু নয়, তবে দেখো যেন কেঁড়ে ধুইয়া তাহাতে খুব বেশি জল রাখিয়া দিও না।’

 সকলে হাসিল। উ—কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া উত্তর করিল, ‘তার কোন ভয় নাই। আমি যদি কোনোদিন গোয়ালা হই, তবে খাঁটি ওজনে খাঁটি দুধ দিব।’

 এই কথাবার্তার পরদিন স্কুলের পরীক্ষার প্রাইজ দেওয়া হইল। তাহাতে নিকটবর্তী স্থান সকলের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। স্কুলের অধ্যক্ষ প্রাইজ দিলেন। উ— আর জ— উভয়েই খুব ভালো নম্বর পাইয়াছে, পড়াশুনায় তাহারা সমকক্ষ। পুরস্কার বিতরণ শেষ হইলে অধ্যক্ষ বলিলেন যে আর একটি পুরস্কার আছে, সেটি একটি সোনার মেডেল। এই পুরস্কারটি সচরাচর দেওয়া হয় না। ইহাতে অনেক টাকা লাগে বলিয়া যে দেওয়া হয় না

তাহা নহে, পুরস্কারের উপযুক্ত ছেলে পাওয়া যায় না বলিয়াই দেওয়া হয় না। পুরস্কারটি সৎসাহসের জন্য দেওয়া হইয়া থাকে। তিন বৎসর হইল প্রথম শ্রেণীর একটি ছেলে একটি গরিব বালিকাকে জল হইতে উঠাইয়া বাঁচাইয়াছিল, তাহাকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হইয়াছিল।

 অধ্যক্ষ তারপর উপস্থিত সকলের অনুমতি লইয়া একটি ছোট গল্প বলিলেন—

 ‘অনেক দিনের কথা নয়, কতকগুলি বালক রাস্তায় ঘুড়ি উড়াইতেছে, এমন সময় একটি ছেলে ঘোড়ায় চড়িয়া সেই স্থান দিয়া যাইতেছিল। ঘোড়াটা ভয় পাইয়া ছেলেটিকে ফেলিয়া দিল। তাহাতে সে এত আঘাত পাইল যে, কয়েক সপ্তাহ তাহাকে শয্যাগত থাকিতে হইল। যাহাদের জন্য এই বিপদ ঘটিল তাহারা কেহই আহত ছেলেটির সঙ্গে গেল না। কিন্তু একটি ছেলে দূর হইতে এই ঘটনা দেখিয়াছিল, সে যে কেবল আহত ছেলেটির সঙ্গে সঙ্গে গেল এমন নহে, শুশ্রুষা করিবার জন্য তাহার কাছে থাকিল।’

 ‘এই ছেলেটি শীঘ্রই জানিতে পারিল যে আহত বালকটি একটি গরিব বিধবার নাতি। বিধার এক গোরু আছে, সেই গোরুর দুধ বিক্রি করিয়া সে সংসার চালায়। বিধবা বৃদ্ধ এবং খোঁড়া, এই নাতিটি ছাড়া, তাহার গোরু মাঠে নিয়া যায় এমন লোক নাই। সেই নাতিটি আঘাত পাইয়া এখন অচল হইয়া পড়িয়াছে। বালক বলিল, ‘আপনার কোন চিন্তা নাই আমি আপনার গোরু মাঠে লইয়া যাইব।’

 কিন্তু এইখানেই তাহার সৎকার্যের শেষ হইল না। ঔষধের জন্য টাকার আবশ্যক হইল। বালক বলিল, ‘মা আমাকে বুট কিনিবার জন্য টাকা দিয়াছিলেন সম্প্রতি আমার বুট না কিনিলেও চলে।’ বিধবাটি বলিল, ‘তাহা হইতে পারে না। কিন্তু আমাদের ঘরে একজোড়া জুতা আছে। আমার নাতির জন্য কিনিয়াছিলাম, সে পরিতে পারে না। তুমি যদি এইগুলি কিন, তাহা হইলেই বেশ হয়।’ বালক সেই কুৎসিত জুতা জোড়া কিনিল এবং এখনো সে তাহা পরিতেছে।

 স্কুলের অন্যান্য ছেলেরা দেখিল যে একজন ছাত্র একটা গোরু লইয়া যাইতেছে, সুতরাং তাহার উপরে হাসি এবং বিদ্রুপ বর্ষণ হইতে লাগিল। তাহার গোরুর চামড়ার জুতা দুইটার উপর তাহাদিগের বিশেষ দৃষ্টি পড়িল। কিন্তু সে প্রফুল্ল চিত্তে বীরের ন্যায় সেই মোটা চামড়ার জুতা পরিয়া বিধবার গোরু চালাইতে লাগিল। অন্যেরা তাহাকে যে-সকল ঠাট্টা বিদ্রুপ করিতে লাগিল, এই সরল বালক সে কথা ভাবিলও না। ভালো কাজ করিতেছে, ইহা মনে করিয়াই সে সন্তুষ্ট থাকিল। গোরু চালাইবার কারণ তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিতে সে চেষ্টা করে নাই, কারণ সৎকার্য করিয়া গর্ব করাটা তাহার ভালো লাগিত না। ঘটনাক্রমে তাহার শিক্ষক কাল এ-সকল কথা জানিতে পারিয়াছেন।

 ‘এখন আমি আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, এই বালকের আচরণে কি আপনারা প্রকৃত বীরত্ব দেখিতে পান নাই? উ—বাবু তুমি ব্ল্যাক বোর্ডের পেছনে পলাইও না। বিদ্রুপের সময় তুমি ভয় পাও নাই, প্রশংসারকালে ভয় পাইলে কেন?

 উ—নত মুখে জড়সড় হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিতে লাগিল।

 সেই কুৎসিত জুতা দুইটা এখন তাহার পায়ে কেমন শোভা পাইল। তাহার মাথায় মুকুট দিলেও হয়তো তেমন সাজিত না। মেডেল তাহাকে দেওয়া হইল, সকলে আনন্দে উচ্চ

করতালি দিতে লাগিল। অন্যান্য যে-সকল ছেলেরা উ—কে বিদ্রুপ করিয়াছিল তাহারা এখন যারপরনাই লজ্জিত হইল, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া তাহার সহিত বন্ধুতা করিতে আসিল।