উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/জরৎকারু কথা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

জরৎকারু কথা

 জরৎকারু মুনি সর্বদাই কঠিন তপস্যায় ব্যস্ত থাকিতেন। বিবাহ বা সংসারের অন্য কোন কাজ করার ইচ্ছা তাঁহার একেবারেই ছিল না। তপস্যা করিয়া, আর তীর্থে স্নান করিয়া তিনি, পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ঘর বাড়ি তাহার কিছুই ছিল না, যেখানে রাত্রি হইত, সেইখানে নিদ্রা যাইতেন। এমন লোককে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করাইয়া দেওয়া কি সহজ কাজ? এ কাজ হওয়ার কোন উপায়ই ছিল না, যদি ইহার মধ্যে একটি আশ্চর্য ঘটনা না হইত। ঘটনাটি এই—জরৎকারু নানা স্থানে ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন দেখিলেন যে, একটা ভয়ঙ্কর অন্ধকার গর্তের মুখে, কয়েকটি নিতান্ত দীনহীন, রোগা, হাড্ডিসার মানুষ একগাছি খসখসের শিকড় ধরিয়া ঝুলিতেছে! উহাদের পা উপর দিকে, মাথা নীচের দিকে। একটা ইঁদুর ক্রমাগত সেই খসখসের শিকড় খানিকে কাটিয়া উহার একটি আঁশ মাত্র বাকি রাখিয়াছে। সেটুকু কাটা গেলেই বেচারারা গর্তের ভিতর পড়িয়া যাইবে। ইহাদিগকে দেখিয়া জরৎকারুর বড়ই দয়া হওয়াতে, তিনি বলিলেন, “আহা! আপনাদের অবস্থা দেখিয়া আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে! আপনারা কে? আর কি করিয়াই বা আপনাদের এমন কষ্টের অবস্থা হইল? আমি কি আপনাদের কোন উপকার করিতে পারি?”

 সেই লোকগুলি বলিলেন, “আমাদিগকে দেখিয়া তোমার দুঃখ হইয়াছে বটে, কিন্তু আমাদের দুঃখ দূর হওয়া বড় কঠিন দেখিতেছি। আমরা যাযাবর নামক ঋষি। আমরা কেহ কোন পাপ করি নাই, কেবল আমাদের বংশ-লোপ হওয়ার গতিক হওয়াতেই আমাদের এই দুর্দশা। আমাদের বংশে এখনো একটি লোক আছে, উহার নাম জরৎকারু! জরৎকারু বাঁচিয়া আছে বলিয়াই আমরা এখনো কোন মতে এই খসখসের শিকড়টুকু ধরিয়া টিকিয়া আছি, উহার মৃত্যু হইলে এই শিকড়টি ছিঁড়িয়া যাইবে, আর আমরাও এই গর্তের ভিতর পড়িয়া যাইব। সেই মূর্খ কেবল তপস্যা করিয়াই বেড়ায়; কিন্তু উহার তপস্যায় আমাদের কি ফল হইবে? তাহার চেয়ে সে যদি বিবাহ করিত, আর তাহার পুত্র পৌত্র হইত, তবে আমরা এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইতাম। বৎস, আমাদের দশা দেখিয়া তোমার দয়া হইয়াছে, তাই বলি, যদি সেই হতভাগার সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তবে দয়া করিয়া আমাদের কথা তাহাকে বলিও।”

 হায়, কি কষ্টের কথা! পূর্বপুরুষেরা এমন ভয়ানক কষ্টে পড়িয়াছেন, আর সেই কষ্টের কারণ জরৎকারু নিজে। এ কথা ভাবিয়া তিনি যার পর নাই দুঃখের সহিত কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “হে মহর্ষিগণ, আপনারা আমারই পূর্বপুরুষ। আমিই সেই দুরাত্মা হতভাগ্য জরৎকারু। আমার অপরাধের সীমা নাই। সেজন্য আমাকে উচিত শাস্তি দিন। আর বলুন, আমি কি করিব।”

 ইহাতে পূর্বপুরুষেরা বলিলেন, “তুমি বিবাহ কর।”

 জরৎকারু বলিলেন, “আচ্ছা, আমি বিবাহ করিব; কিন্তু ইহার মধ্যে দুইটি কথা আছে। মেয়েটির আমার নামে নাম হওয়া চাহি। আর বিবাহের পর স্ত্রীকে খাইতে দিতে পারিব না। ইহাতে যদি আমার বিবাহ জোটে, তবেই বিবাহ করিব, নচেৎ নহে।”

 এই বলিয়া জরৎকারু বিবাহের জন্য মেয়ে খুঁজিতে লাগিলেন। একে বুড়ো তাতে গরিব। স্ত্রীকে খাইতে পরিতে দিতে পরিবে না, কুঁড়ে ঘরখানি পর্যন্ত নাই, যে, তাহাতে নিয়া তাহাকে রাখিবে। এমন বরকে মেয়ে দিতে বোধহয় বাঘ ভালুকেও রাজি হয় না, মানুষ ত দূরের কথা। মুনি দেশ বিদেশে খুঁজিয়া হয়রান হইলেন, কোথাও মেয়ে পাইলেন না। তখন পূর্বপুরুষদের কথা মনে করিয়া, তাহার নিতান্ত কষ্ট হওয়াতে তিনি এক বনের ভিতর গিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি বলিলেন, “এখানে যদি কেহ থাক, তবে শোন। আমি যাযাবর বংশের তপস্বী, নাম জরৎকারু। পুর্বপুরুষদিগের আজ্ঞায় আমি বিবাহ করিতে চাহিতেছি। কিন্তু কিছুতেই কন্যা জুটিতেছে না। যদি তোমাদের কাহারও নিকট কন্যা থাকে, আর যদি তাহার আমার নামে নাম হয়, আর যদি আমায় টাকা না দিতে হয়, আর মেয়েকেও খাইতে পরিতে দিতে না হয়, তবে নিয়া আইস, আমি তাহাকে বিবাহ করিব।”

 এদিকে হইয়াছে কি—বাসুকির লোকেরা সেই তখন হইতেই জরৎকারুকে খুঁজিতেছে, কিন্তু এত দিন কোথাও তাঁহার দেখা পায় নাই। জরৎকারু যখন সেই বনের ভিতরে ঢুকিয়া কাঁদিতেছিলেন, তখন বাসুকির ঐ-সব লোকের কয়েকজন সেখানে ছিল। তাহারা তাঁহার কথা শুনিয়াই বলিল, ঐ রে সেই মুনি। ঐ শোন, সে বিবাহ করিতে চায়! শীঘ্র কর্তাকে খবর দিই গিয়া চল।”

 এই বলিয়া তাহারা বায়ুবেগে ছুটয়া গিয়া বাসুকিকে এই সংবাদ দিল। বাসুকিও সে সংবাদ পাওয়া-মাত্রই তাহার ভগিনীকে অতি সুন্দর পোশাকে এবং বহুমূল্য অলঙ্কার পরাইয়া জরৎকারুর নিকট উপস্থিত করিলেন। তাহাকে দেখিয়া জরৎকারু বলিলেন—

 “মহাশয়, ইঁহার নামটি কি?”

 বাসুকি বলিলেন, “ইঁহার নাম জরৎকারু।”

 জরৎকারু বলিলেন, “বেশ! কিন্তু আমি ত টাকাকড়ি দিতে পারিব না।”

 বাসুকি বলিলেন, “আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। আমি অমনিই মেয়ে দিতেছি।”

 জরৎকারু বলিলেন, “বেশ। বেশ! কিন্তু মেয়েকে খাইতে পরিতে দিবে কে? আমার ত কিছুই নাই।”

 বাসুকি বলিলেন, “তাহার জন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আমি ইহাকে চিরকাল ভরণ পোষণ করিব (খাওয়াইব পরাইব)।”

 জরৎকারু বলিলেন, “তবে ভাল, আমি ইহাকে বিবাহ করিব। কিন্তু যদি ইনি কখনো আমাকে অসন্তুষ্ট করেন, তবে আমি তখনই চলিয়া যাইব।” এইরূপ কথাবার্তার পর জরৎকারুর সহিত বাসুকির ভগিনীর বিবাহ হইল। ইহাদের পুত্রই আস্তিক, যিনি সর্পগণকে জনমেজয়ের যজ্ঞ হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন।

 আস্তিকের জন্মের কয়েকদিন আগে জরৎকারু তাহার স্ত্রীর উপর রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। বেচারীর কোন দোষ ছিল না। তিনি পরম যত্নে স্বামীর সেবা করিতেন।

 একদিন বিকাল বেলায় জরৎকারু মুনি নিদ্রা গেলেন ক্রমে সূর্যাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইল, সন্ধ্যাকালে উপাসনার (ভগবানের পূজার) সময় হইল, তথাপি মুনির ঘুম ভাঙ্গিল না। ইহাতে তাঁহার স্ত্রী ভাবিলেন, “এখন কি করি? ঘুম ভাঙ্গাইলে হয়ত ইঁহার রাগ হইবে, আর সন্ধ্যাপূজা না করা হইলে ইঁহার পাপ হইবে।” অনেক ভাবিয়া তিনি স্থির করিলেন, “যাহাতে ইঁহার পাপ হয়, এ-সব ঘটনা হইতে দেওয়া উচিত নহে, সুতরাং ইঁহাকে জাগানই কর্তব্য।” এই মনে করিয়া যেই তিনি মুনিকে আস্তে আস্তে জাগাইয়াছেন; অমনি মুনি রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “কি? আমাকে অপমান করিলে? এই আমি চলিলাম—আর এখানে কিছুতেই থাকিব না।”

 ইহাতে বাসুকির ভগিনী নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বিনয়ের সহিত বলিলেন, “ভগবন্, সূর্যাস্ত হইতেছিল, তাই সন্ধ্যাপূজার জন্য আপনাকে জাগাইয়াছিলাম। আপনাকে অপমান করিতে চাহি নাই।”

 জরৎকারু বলিলেন, “আমি ঘুমাইয়া থাকিতে কি সূর্যস্ত হইবার শক্তি আছে? কাজেই আমাকে জাগাইয়া আমার অপমান করিয়াছ। আমি আর এখানে থাকিব না।”

 এই বলিয়া মুনি সেখান হইতে চলিয়া গেলেন, তাহার স্ত্রীর চোখের জলের দিকে একবারও ফিরিয়া চাহিলেন না। ইহার কিছুদিন পরেই আস্তিকের জন্ম হইল! ছেলেটি দেখিতে দেবতার ন্যায় সুন্দর। আর তাহার এমন অসাধারণ বুদ্ধি যে, শিশুকালেই বেদ, পুরাণ সমস্ত পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিল। তাহাকে পাইয়া নাগগণের আর আনন্দের সীমা রহিল না। উহারা কত যত্নের সহিত যে তাহাকে পালন করিতে লাগিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না।

 এই সময়েই জনমেজয়ের যজ্ঞ আরম্ভ হয়। যজ্ঞের সকল আয়োজন প্রস্তুত, সকলে তাহা আরম্ভ করিতে যাইতেছেন, এমন সময় সেখানে একটি লোক আসিল; তাঁহার চোখ দুইটা ভারি লাল! লোকটি স্থপতি বিদ্যায় (অর্থাৎ ঘর বাড়ি প্রস্তুত বিষয়ে) বড়ই পণ্ডিত। সে খানিক এদিক, ওদিক দেখিয়া, তারপর বলিল, “যে সময়ে আর যে স্থানে তোমরা যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছ তাহাতে আমার বোধ হয়; তোমরা ইহা শেষ করিয়া উঠিতে পারিবে না; এক ব্রাহ্মণ আসিয়া ইহাতে বাধা দিবে।” ইহা শুনিয়া জনমেজয় তখনই দারোয়ানদিগকে আজ্ঞা দিলেন যে, “আমাকে না জানাইয়া কাহাকেও ঢুকিতে দিবে না।”

 তারপর যজ্ঞ আরম্ভ হইল। পুরোহিতেরা কালোরঙের ধুতি চাদর পরিয়া মন্ত্র পড়িতে পড়িতে, আগুনে ঘি ঢালিতে লাগিলেন, ধোঁয়ায় তাহাদের চোখ লাল হইয়া উঠিল। সর্পগণের নাম লইয়া অগ্নিতে আহুতি পড়িবামাত্র (ঘৃত ঢালা হইবামাত্র) তাহারা বুঝিল যে, আর প্রাণের আসা নাই। অল্পক্ষণ পরেই দেখা গেল যে, নানারকম সাপ আসিয়া আগুনে পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। বেচারারা ভয়ে অস্থির হইয়া, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে, বাঁচিবার জন্য কত চেষ্টাই করিতেছে, লেজ দিয়া আর মাথা দিয়া একজন আর একজনকে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিতেছে। আর ক্রমাগত আপনার লোকদিগের নাম লইয়া চিৎকার পূর্বক কত যে কাঁদিতেছে, তাহার ত কথাই নাই; কিন্তু কিছুতেই তাহারা রক্ষা পাইতেছে না। সাদা, হলদে, নীল, কালো, ছোট, বড়, মাঝারি, সকলরকমের সাপ হাজারে হাজারে আগুনে পুড়িয়া মরিল।

 সে সময়ে সাপের চিৎকারে আর কোন শব্দই শুনিবার উপায় রহিল না, পোড়া সাপের গন্ধে সে স্থানে টিকিয়া থাকা ভার হইয়া উঠিল। হায়! মায়ের শাপ কি দারুণ শাপ!

 কিন্তু যাহার জন্য এত আয়োজন, সেই তক্ষক এতক্ষণ কি করিতেছিল? যজ্ঞের কথা শুনিবামাত্র আর সকলের আগে, উহারই প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল, সে তখনই নিতান্ত ব্যস্তভাবে ইন্দ্রের নিকট উপস্থিত হইয়া, হাঁপাইতে হাঁপাইতে জোড় হাতে বলিল, “দোহাই দেবরাজ! আমাকে রক্ষা করুন! জনমেজয় আমাকে পোড়াইয়া মারিবার আয়োজন করিতেছে।”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তোমার কোন ভয় নাই, তুমি আমার এইখানে থাক।”

 ইহাতে তক্ষক কতকটা নিশ্চিন্ত হইয়া ইন্দ্রের পুরীতেই বাস করিতে লাগিল।

 এদিকে ক্রমাগতই সাপ আসিয়া যজ্ঞের আগুনে পড়িতেছে। এইরূপে কয়েকঘণ্টার ভিতরেই অধিকাংশ সাপ মরিয়া গেল, অল্পই বাকি রহিল। সাপের রাজা বাসুকি এ-সকল ঘটনা দেখিয়া বার বার অজ্ঞান হইয়া যাইতে লাগিলেন। সাপেদের মধ্যে কেহ যে রক্ষা পাইবে এমন আশা তাঁহার রহিল না। তাঁহার কেবল ইহাই মনে হইতে লাগিল, “এইবার বুঝি আমার ডাক পড়ে।” এমন সময় তাঁহার আস্তিকের কথা মনে পড়িল।

 বাস্তবিক, আস্তিক যদি সর্পগণকে রক্ষা করিবার জন্যই জন্মিয়া থাকেন, তবে আর তাহার বিলম্ব করিবার সময় ছিল না। এই বেলা গিয়া একটা কিছু না করিলে, আর তাহার সে কার্য করিবার অবসরই থাকিত না। সুতরাং বাসুকি তাড়াতাড়ি তাহার ভগিনীকে ডাকিয়া বলিলেন, “আর দেখিতেছ কি বোন? শীঘ্র আস্তিককে ইহার উপায় করিতে বল!”

 এ কথায় বাসুকির ভগিনী তখনই আস্তিকের নিকট গিয়া বলিলেন, “বাছা, সর্বনাশ উপস্থিত! তুমি যে কার্যের জন্য জন্মিয়াছিলে, শীঘ্র তাহা না করিলে ত আর উপায় দেখিতেছি না!”

 ইহাতে আস্তিক একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “আমি কি কার্যের জন্য জন্মিয়াছি মা? বল, আমি এখনই তাহা করিতেছি।”

 তখন আস্তিকের মাতা তাঁহাকে কদ্রুর শাপের কথা, আর জনমেজয়ের যজ্ঞের কথা আর তাঁহার দ্বারা যে সেই যজ্ঞ বারণ হইবে সেই কথা, আগাগোড়া শুনাইলেন। তাহা শুনিয়া আস্তিক বাসুকির নিকট গিয়া বলিলেন, “মামা আপনি আর দুঃখ করিবেন না। এই আমি চলিলাম—যেমন করিয়াই হউক, সে যজ্ঞ আমি বারণ করিয়া আসিব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।”

 এই বলিয়া আস্তিক জনমেজয়ের যজ্ঞের স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বড় বড় মুনি ঋষিতে সে যজ্ঞস্থান পরিপূর্ণ ছিল। আর তাহার দরজায় যমদূতের মতন সিপাহী সকল ঢাল তলোয়ার হাতে পাহারা দিতেছিল। বালক আস্তিককে দেখিয়াই তাহারা ধমক দিয়া বলিল, “এইয়ো! কোথায় যাইতেছ?”

 আস্তিক তাহাতে কিছুমাত্র ভয় না পাইয়া বলিলেন, “তোমাদের জয় হউক দারোয়ানজী। যজ্ঞটি যেমন জমকালো, তোমরা তাহার উপযুক্ত দারোয়ান। এমন সুন্দর যজ্ঞও কেহ দেখে নাই। তোমাদের দয়া হইলে আমি একটু তামাশা দেখিয়া আসি।”

 প্রশংসা শুনিয়া দারোয়ানেরা বড়ই খুশি হইল। তারপর আর তাহারা আস্তিককে ঢুকিতে দিতে আপত্তি করিল না।

 ভিতরে গিয়া আস্তিক জনমেজয়কে বলিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! আপনি এমন সুন্দর যজ্ঞ করিতেছেন যে, কি বলিব। মহারাজ! আমি প্রার্থনা করি, আমার বন্ধুগণের মঙ্গল হউক। প্রাচীনকালের অতি প্রসিদ্ধ রাজা আর মুনি ঋষিগণ যে-সকল মহা মহা যজ্ঞ করিয়াছিলেন, আপনার এই যজ্ঞও তেমনি হইয়াছে। মহারাজ! আমি প্রার্থনা করি আমার বন্ধুগণের মঙ্গল হউক। কত বড় বড় মুনিগণ আপনার যজ্ঞে কাজ করিতেছেন, ইঁহারা যে কত বড় পণ্ডিত, তাহা আমি বলিয়া শেষ করিতে পারি না। আর আপনি যে কিরূপ ধার্মিক রাজা, তাহা মনে করিলেই বড় সুখ হয়।”

 নিজের প্রশংসা শুনিলে, দেবতার মনও খুশি হয়। আর সেই প্রশংসা যদি আস্তিকের ন্যায় অপরূপ সুন্দর একটি বালকের সুমিষ্ট কথায় হয়, তবে তার উপর সন্তুষ্ট না হইয়া কেহই থাকিতে পারে না। সুতরাং জনমেজয় বলিলেন, “হে মুনিগণ, আপনাদের কি অনুমতি হয়? আমার ত ইচ্ছা হইতেছে যে, এই সুন্দর বালকটি যাহা চায়, তাহা তাহাকে দিয়া দেই।”

 তখন রাজা আস্তিকের বর দিতে গেলে, প্রধান মুনি একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “মহারাজ তক্ষক কিন্তু এখনো আসিল না।”

 তাহাতে জনমেজয় বলিলেন, “আপনারা তক্ষককে শীঘ্র উপস্থিত করিবার চেষ্টা করুন।”

 তখন, সেই লাল চোখওয়ালা লোকটি—যে বলিয়াছিল যে, এক ব্রাহ্মণ যজ্ঞে বাধা দিবে—বলিল, “মহারাজ তক্ষক ইন্দ্রের নিকট আশ্রয় লইয়াছে, তাই তাহাকে সহজে আনা যাইতেছে না।”

 মুনিরাও বলিলেন, “হ্যাঁ এ কথা ঠিক।”

 ইহাতে প্রধান মুনি ইন্দ্রের পূজা আরম্ভ করিলেন। তখন আর ইন্দ্র চুপ করিয়া স্বর্গে থাকিবেন কিরূপে? তাঁহাকে পূজার স্থানে যাত্রা করিতেই হইল। তক্ষক দেখিল মহা বিপদ! ইন্দ্রকে ছাড়িয়া যাইতেও ভরসা হয় না, তাঁহার সঙ্গে যাইতেও সাহস হয় না। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, সে ইন্দ্রের চাদরের ভিতরে লুকাইয়া রহিল।

 এদিকে রাজা জনমেজয় দেখিলেন যে, ইন্দ্রের আশ্রয় পাইয়া তক্ষক তাঁহাকে ফাঁকি দিতেছে। সুতরাং তিনি ক্রোধভরে মুনিদিগকে বলিলেন, “যদি ইন্দ্র তক্ষককে লুকাইয়া রাখেন, তবে তাঁহাকে সুদ্ধই দুষ্টকে পোড়াইয়া মারুন।”

 রাজার কথায় মুনিগণ তক্ষকের নাম লইয়া অগ্নিতে আহুতি দিবামাত্র ইন্দ্রকে সুদ্ধই সে কাঁপিতে কাঁপিতে আকাশের ভিতর দিয়া আসিয়া দেখা দিল। তখন ইন্দ্র প্রাণের ভয়ে তক্ষককে ছাড়িয়া ব্যস্তভাবে প্রস্থান করিলে, তক্ষক ঘুরিতে ঘুরিতে ক্রমে যজ্ঞের আগুনের কাছে আসিতে লাগিল। তাহাতে ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, “মহারাজ, আর চিন্তা নাই। ঐ দেখুন তক্ষক চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে এদিকে আসিতেছে। এখন বালকটিকে বর দিতে পারেন।”

 তাহা শুনিয়া রাজা বলিলেন, “হে ব্রাহ্মণকুমার, এখন তুমি যাহা চাহ তাহাই দিব। বল তোমার কি বর চাই?”

 আস্তিক বলিলেন, “আমি এই বর চাহি যে, আপনার যজ্ঞ থামিয়া যাউক। আর যেন ইহার আগুনে পুড়িয়া সাপেদের মৃত্যু না হয়।”

 এ কথা শুনিয়াই ত রাজা চমকিয়া উঠিলেন। তাহাকে যদি হঠাৎ তক্ষকে কামড়াইত, তবুও বোধহয় তিনি এত চমকিয়া উঠিতেন না। তিনি নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “সেও কি হয়? ঠাকুর, আপনি আর কিছু প্রার্থনা করুন। টাকা কড়ি যত আপনার ইচ্ছা হয়, আমি আপনাকে দিতেছি, কিন্তু যজ্ঞ থামাইতে পারিব না।”

 আস্তিক বলিলেন, “আমি যাহা চাহি, তাহা যদি না পাইলাম, তবে টাকা কড়ি দিয়া কি করিব? আমি আমার মাতুলদিগকে বাঁচাইতে আসিয়াছি। টাকার জন্য আসি নাই।”

 তখন মুনিগণ বলিলেন, “মহারাজ, যখন দিবেন বলিয়াছেন, তখন এই বালক যাহা চাহিতেছেন তাহা ইহাকে দিতেই হইতেছে।”

 এদিকে তক্ষক আগুনের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। আর এক মুহূর্ত পরে পুড়িয়া মারা যাইবে। ইহা দেখিয়া আস্তিক চিৎকার পূর্বক তিনবার তাহাকে বলিলেন, “তিষ্ঠ! তিষ্ঠা! তিষ্ঠা!” (থামো! থামো! থামো!) তাহাতেই তক্ষক আর আগুনে না পড়িয়া কিছুকাল শূন্যে থামিয়া রহিল।

 ঠিক এই সময়ে ব্রাহ্মণদিগের কথায়, জনমেজয় আস্তিককে বর দিতে সম্মত হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা তবে যজ্ঞ থামুক! সর্পগণের ভয় দূর হউক।”

 এ কথায় তখনই যজ্ঞ থামিয়া গেল, তক্ষকেরও আর পুড়িয়া মরিতে হইল না। যাহারা যজ্ঞ দেখিতে আসিয়াছিল, তাহারা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া ‘জয় জয়’ শব্দে কোলাহল করিতে লাগিল। এইরূপে আস্তিক তাহার মাতুলদিগকে রক্ষা করিয়াছিলেন।

 আস্তিকের এই কার্যে সাপেরা প্রাণে বাঁচিয়া গেল। সুতরাং তাহারা যে সন্তুষ্ট হইল, এ কথা বলাই বাহুল্য। তাহারা বার বার বলিতে লাগিল, “বাছা, তুমি আমাদের প্রাণ রক্ষা করিয়াছ, বল আমরা কি করিয়া তোমাকে সন্তুষ্ট করিব।”

 আস্তিক বলিলেন, “আপনারা যদি আমার উপর সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে, আমার নাম যে লইবে, আপনারা আর তাহাকে হিংসা করিবেন না।”

 সাপেরা বলিল, “এখন হইতে যে তোমার নাম লইবে আমরা তাহার কোন অনিষ্ট করিব না। এ কথা যে অমান্য করিবে তাহার মাথা শিমূলের কলার মত ফাটিয়া যাইবে।”