উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/দুষ্ট হাঁস

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

দুষ্ট হাঁস

 সমুদ্রের ধারে এক ভারি দুষ্ট বুড়া হাঁস থাকিত। সে মুখে কেবলই মিষ্ট হাসি হাসিত, আর মনের ভিতরে দিন রাত খালি দুষ্ট ফন্দি আঁটিত।

 বুড়া হাঁস, তাহার গায়ে জোর নাই, ঠোঁটে ধার নাই। মাছ ধরিতে পারে না, পেট ভরিয়া খাইতে পায় না। সে দিন রাত বসিয়া ভাবে, “তাই ত, এখন করি কি?”

 তারপর একদিন সে কোথায় একখানি নামাবলীর টুকরা কুড়াইয়া পাইল। সেই নামাবলীর টুকরাখানি গায় দিয়া আর নাকের উপর সুন্দর ফোঁটা কাটিয়া বুড়া বলিল, “বাঃ! আমি কেমন ভট্‌চার্যি হইয়াছি!”

 সমুদ্রের জলে শত শত পাখি খেলা করিতেছিল। ভট্‌চার্যি সাজিয়া দুষ্ট হাঁস তাহাদের নিকট গিয়া বারবার বলিতে লাগিল, “দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা! বাছাসকল! ধর্ম কর, অধর্ম করিও না! দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা, দুগা!”

 তখন হইতে সে রোজ এমনি করে। তাহাতে পাখিদের তাহার উপর কি যে ভক্তি হইল, কি বলব। তাহারা তাহাকে হাঁস-ঠাকুর বলে, দেখিতে পাইলেই ছুটিয়া আসিয়া গড় করে, আর ভাল ভাল মাছ আনিয়া খাইতে দেয়।

 একদিন হাঁস-ঠাকুর তাহাদিগকে ডাকিয়া বলিল, “বাছাসকল! তোমরা তোমাদের ডিমগুলি ফেলিয়া জলে খেলা করিতে যাও, আর তাহা নষ্ট হইয়া যায়। এমন করিতে নাই। ডিমগুলি আমার কাছে রাখিয়া যাইও, আমি পাহারা দিব।”

 তখন হইতে তাহারা হাঁস-ঠাকুরের কাছে ডিম রাখিয়া জলে খেলা করিতে যায়। বেচারারা গণিতে জানে না, কাজেই ফিরিয়া আসিয়া যে কয়টি ডিম পায়, তাহাতেই খুসি থাকে। দুষ্ট হাঁস কিন্তু তাহারা জলে ডুব দিলেই এক-একটা করিয়া ডিম খায়।

 তারপর একদিন একটি পাখি কাঁদিতে কাঁদিতে অন্য পাখিদিগকে বলিল, “ভাই, আমার একটি ডিম ছিল, হাঁস-ঠাকুরের কাছে সেটি রাখিয়া আমি খেলা করিতে গিয়াছিলাম। হায়! আমার ডিমটি কি হইল? খেলা করিয়া আসিয়া ত আমি আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম।”

 এ কথা শুনিয়া আর পাখিরা বলিল, “তুমি বড় অসাবধানী এমন করিয়া কি ডিম হারাইতে আছে?”

 তারপর আর একদিন আর-একটি পাখি হাঁস-ঠাকুরের কাছে ডিম রাখিয়া খেলা করিতে গেল, ফিরিয়া আসিয়া আর তাহা পাইল না। কিন্তু এ কথা সে আর কাহাকেও বলিল না, পরদিন অন্য পাখিরা হাঁস-ঠাকুরের নিকট তাহাদের ডিম রাখিয়া খেলা করিতে গেল, কিন্তু এই পাখিটি সেদিন আর খেলা করিতে না গিয়া, একটি গর্তের ভিতর হইতে হাঁস-ঠাকুরকে পাহারা দিতে লাগিল।

 হাঁস-ঠাকুর নামাবলী গায় দিয়া আর নাকে ফোঁটা কাটিয়া বসিয়া আছে। আর কেবল বলিতেছে, “দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা!” তাহার চারিদিকে পাখিদের ডিম ছড়ান রহিয়াছে, দুর্গা, দুর্গা বলিতে বলিতে সে তাহার দিকেও এক-একবার তাকাইতেছে।

 ইহার মধ্যে জলের পাখিরা সকলে মিলিয়া একবার টুপ করিয়া ডুব মারিল। আর অমনি হাঁস-ঠাকুর খপ করিয়া একটি ডিম লইয়া মুখে পুরিল। তারপর সেটিকে গিলিয়া আবার খুব জোরের সহিত বলিতে লাগিল, “দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা।”

 সেই পাখিটির এ-সকলের কিছুই দেখিতে বাকি রহিল না। সেদিন রাত্রিতে তাহার নিকট এ কথা শুনিতে পাইয়া আটটা খুব ষণ্ডা আর ধারাল ঠোঁটওয়ালা পাখি বলিল, “কাল আমরা পাহারা দিব।”

 পরদিনও হাঁস-ঠাকুর সকলকে খেলা করিতে পাঠাইয়া তাহাদের ডিমের উপর পাহারা দিতে লাগিল। সে জানিত না যে তাহার উপর আবার আটটা পাখি পাহারা দিতেছে। তাই সেদিনও, জলের পাখিরা ডুব দেওয়া মাত্র যেই সে একটি ডিম খপ্ করিয়া মুখে পুরিয়াছে অমনি আটটা পাখি আটদিক হইতে আসিয়া ঠকাঠক শব্দে তাহার মাথায় ঠোকর মারিতে আরম্ভ করিয়াছে। সে ডিম আর হাঁস-ঠাকুরের গেলা হইল না। তাহার আগেই সেই আট পাখির ঠোকরের চোটে তিনি হাঁ করিয়া মরিয়া গেলেন।

 তখন একটা খুব গোলমাল হইল। তাহা শুনিয়া সকল পাখি তাড়াতাড়ি জল হইতে উঠিয়া আসিয়া দেখিল যে, হাঁস-ঠাকুর হাঁ করিয়া মরিয়া রহিয়াছেন, তাঁহার মুখের ভিতরে একটি গাং-শালিকের ডিম!

 যখন সকলেই বুঝিল, কি হইয়াছে।