উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/নল ও দময়ন্তীর কথা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

নল ও দময়ন্তীর কথা

 বিদর্ভ দেশে ভীম নামে এক রাজা ছিলেন। দেশ বিদেশের লোকে তাঁহার গুণের কথা বলিত। ধনে, জনে, যশে, মানে, তাঁহার সুখের সীমা ছিল না। কিন্তু এক দুঃখে তাঁহার সকল সুখ মাটি হইয়া গিয়াছিল। সোনার সংসার দিয়া কি হইবে, যদি তাহা খালি পড়িয়া থাকিল? রাজা নিশ্বাস ফেলিতেন, আর বলিতেন, ‘হায়, আমার এ ধন কে খাইবে? আমার যে সন্তান নাই।

 একদিন মহামুনি দমন রাজার সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। রাজা রানী তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া, বসিতে সোনার আসন দিলেন। সুবাসিত জল দিয়া নিজ হাতে তাঁহার পা ধুইয়া দিলেন। তারপর মুক্তার ঝালর দেওয়া চন্দনের পাখা লইয়া দুজনে তাহাকে বাতাস করিতে লাগিলেন। মুনি সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, মহারাজা, তোমরা আমাকে যেমন খুশি করিলে, আমিও তোমাদের তেমনি সুখী করিব। আমার বরে তোমাদিগের একটি লক্ষ্মীর মতন কন্যা ও তিনটি পুত্র হইবে।

 বর দিয়া মুনি চলিয়া গেলেন, রাজাও মনে করিলেন, “এতদিনে যদি আমাদের দুঃখের শেষ হয়।

 তারপর ক্রমে রাজার তিনটি ছেলে আর একটি মেয়ে হইল। মুনির নাম ছিল দমন, সেই মনে করিয়া রাজা ছেলে তিনটির নাম দম, দান্ত, আর দমন, আর মেয়েটির নাম দময়ন্তী রাখিলেন।

 এতদিনে রাজার আঁধার ঘরে আলো জ্বলিল। ছেলে তিনটির যেমন রূপ, তেমনি গুণ। আর দময়ন্তীর কথা কি বলিব? দেহের মধ্যে যেমন প্রাণ, সেই রাজপুরীর মধ্যে তেমনি হইলেন দময়ন্তী। আকাশ হইতে দেবতারা তাঁহাকে দেখিয়া বলিতেন, ‘আহ, কি সুন্দর! রাজ্যের লোক তাঁহাকে দেখিলে মনে করিত, বুঝি নিজে লক্ষ্মী রাজার ঘরে জন্ম লইয়াছেন।

 দময়ন্তী যখন বড় হইলেন, তখন শত শত সখী আর দাসী তাঁহার সেবা করিতে লাগিল। রাজবাড়ির ভিতরে মেয়েদের বেড়াইবার বাগান ছিল। সেই বাগানে দময়ন্তী তাঁহার সখীদিগকে লইয়া রোজ বেড়াইতে যাইতেন। একদিন সেখানে গিয়া তিনি দেখিলেন, এক ঝাঁক সোনার হাঁস সেখানে খেলা করিতেছে।

 হাঁস দেখিয়া দময়ন্তী বলিলেন, ‘কি সুন্দর, কি সুন্দর! ওলো, তোরা দেখিস যেন পলায় না।’

 সখীরা সকলে হাঁস ধরিতে গেল, হাঁসগুলি তাহাদিগকে লইয়া বাগানের আর-এক পানে ছুটিয়া পলাইল। একটি হাঁস পিছনে পড়িয়াছিল, দময়ন্তী নিজেই তাহাকে ধরিতে গেলেন।

 তখন হাঁস বলিল, ‘তুমি যাঁহার যোগ্য রানী, আমি তাঁহার খবর জানি। রাজকন্যা! নলের কথা শুনিয়াছ?’

 দময়ন্তী বলিলেন, ‘তুই পাখি হইয়া কথা কহিতেছিস্, না জানি, তোর খবর কেমন আশ্চর্য। তুই যাঁহার নাম করিলি, সেই নল কে? তিনি কোথায় থাকেন?

 পাখি বলিল, ‘একটা দেশ আছে, তাহার নাম নিষধ। বীরসেনের পুত্র নল সেই দেশের রাজা। রাজকন্যা! এমন রাজার কথা আর কখনো শোন নাই। এমন সুন্দর মানুষ আর কখনো দেখ নাই। দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ, যক্ষ, সকলকেই দেখিয়াছি রূপে গুণে নলের সমান কেহই নহে। যেমন তুমি, তেমনি নল। তুমি যদি তাঁহার রানী হও, তবেই যথার্থ সুখের কথা হয়।’

 দময়ন্তী বলিলেন, ‘হাঁস, তোর কথা বড়ই মিষ্ট। এ কথা তুই নলকে বলিতে পারিস্?’

 হাঁস বলিল, ‘অবশই পারি। আমি এই চলিলাম।’ এই বলিয়া হাঁসের ঝাঁক হাসিতে হাসিতে নলরাজার দেশে উড়িয়া গেল। নল তখন রাজবাড়ির এক কোণে বাগানের ভিতরে নিরিবিলি বসিয়া দময়ন্তীর কথাই ভাবিতেছিলেন, এ কথা হাঁসেরা জানিত। ইহার কারণ এই যে, নলের সঙ্গেই তাহাদের আগে দেখা হইয়াছিল।

 নলের বাগানে তাহারা বেড়াইতে যায়, আর, নল তাহাদের একটাকে ধরিয়া ফেলেন। হাঁসটি ধরা পড়িয়া মিনতি করিয়া বলিল, ‘মহারাজ! আমাকে মারিবেন না, আমি আপনাকে দময়ন্তীর খবর আনিয়া দিব।’

 নল ইহার আগেই দময়ন্তীর কথা শুনিয়াছিলেন, আর বাগানে বসিয়া তাঁহারই কথা ভাবিতেছিলেন। হাঁসের কথা শুনিয়া তিনি তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। তারপর তাহারা দময়ন্তীর নিকট আসিয়া তাঁহাকে ফাঁকি দিয়া নলের কথা শুনাইয়া গেল।

 সে কথা শুনিয়া অবধি আবার দময়ন্তীর চোখে ঘুম নাই, মুখে হাসি নাই। অন্ন ব্যঞ্জন থালা সুদ্ধ তাঁহার সামনে অমনি পড়িয়া থাকে। দিনরাত তিনি কেবলই নলের কথা ভাবেন, আর কাঁদেন।

 রানী রাজার নিকট কাঁদিয়া বলিলেন, মায়ের আমার হইল কি? রাজা অনেকক্ষণ মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, “চল, স্বয়ম্বরের আয়োজন করিয়া উহার বিবাহ দিয়া দিই!

 তারপর দেশ বিদেশে রাজার নিকট সংবাদ গেল, দময়ন্তীর স্বয়ম্বর হইবে, সকলে আসুন। সে সংবাদ শুনিয়া আর কেহই ঘরে বসিয়া থাকিলেন না। দেখিতে দেখিতে রাজারাজড়ায় বিদর্ভ নগর ছাইয়া গেল। সৈন্যের কলরবে, হাতি ঘোড়ার ডাক, আর রথের শব্দে, লোকের কথাবার্তা কহা ভার হইয়া উঠিল।

 রাজারা সকলে স্বয়ম্বরে আসিয়াছে, তাই কয়েকদিনের জন্য তাঁহাদের ঝগড়া বিবাদ থামিয়া গিয়াছে, আর যুদ্ধও হয় না, তেমন ভাবে লোকও মরিয়া স্বর্গে যায় না। ইন্দ্র ভাবিলেন, ‘সে কি! যুদ্ধে মরিয়া মাসে মাসে এতগুলি লোক স্বর্গে আসে, এ মাসে ত সেরকম আসিল না। ইহার কারণ কি? সেখানে নারদ মুনি ছিলেন, তিনি বলিলেন, ‘দেবাজ, রাজারা সকলে দময়ন্তীর স্বয়ম্বরে গিয়াছেন, তাই এখন আর যুদ্ধ হয় না, লোকও অধিক মরে না।’

 নারদের কথা শুনিয়া স্বর্গের সকলে বলিল, “আমরাও দময়ন্তীর স্বয়ম্বব দেখিতে যাইব। তখনই দেবতারা সকলে নিজ নিজ বাহনে চড়িয়া পরম আনন্দে বিদর্ভ দেশে যাত্রা কবিলেন। বিদর্ভ দেশের কাছে আসিয়া তাহারা দেখিলেন যে, নিষধের রাজা নলও সেই পথে স্বয়ম্বরে যাইতেছে। নলকে দেখিয়া দেবতাদিগের বড়ই ভয় হইল। তাঁহাদের মনে হইল যে, রাজার মত সুন্দর লোক তাঁহাদের মধ্যে কেহই নাই। তখন, কেহ বলিলেন, তাই করি?’ কেহ বলিলেন, ‘চল! ফিবিয়া যাই!’ আবার কেহ কেহ মনে করিলেন, উহাকে ফাঁকি দিয়া আমাদের কাজ করাইয়া লই।” এই ভাবিয়া তাহাদের চারিজনে নলের নিকট গিয়া বলিলেন, “মহারাজ, তুমি অতিশয় ধার্মিক লোক, তোমাকে আমাদের একটি কাজ, করিয়া দিতে হইবে।

 দেবতাদিগকে দেখিয়া নল, ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া জোড়হাতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কে? আমাকে আপনাদের কি কাজ করিতে হইবে?

 দেবতাদের একজন বলিলেন, “আমি ইন্দ্র, ইনি অগ্নি, ইনি যম, আর ইনি বরুণ। আমরা দময়ন্তীকে পাইবার জন্য স্বয়ম্বরে চলিয়াছি। তুমি আমাদের দূত হইয়া দময়ন্তীর নিকটে গিয়া বলিবে, যেন তিনি আমাদের কোন একজনকে বিবাহ করেন।”

 নল বলিলেন, “ইহা কি সুবিচার হইল? আপনারাও দময়ন্তীর জন্য যাইতেছে, আমিও দময়ন্তীর জন্য যাইতেছি। আপনাদের কি উচিত, আমাকে দূত করিয়া পাঠান?”

 দেবতারা বলিলেন, “মহারাজ, তুমি ত বলিয়াছ, যে আজ্ঞা', এখন আবার কি করিয়া, না’ বলিবে? শীঘ্র যাও।”

 নল বলিলেন, “আচ্ছা, আমি নাহয় আপনাদের দূত হইলাম। কিন্তু আমি দময়ন্তীর কাছে কি করিয়া যাইব? তাহার আগেই ত প্রহরীরা আমাকে কাটিয়া ফেলিবে!”

 ইন্দ্র বলিলেন, “তোমার কোন ভয় নাই। প্রহরীরা তোমাকে দেখিতেই পাইবে না। তুমি অতি সহজে দময়ন্তীর নিকট যাইতে পারিবে।”

 একথায় নল দেবতাদিগকে প্রণাম করিয়া দময়ন্তীর নিকট যাত্রা করিলেন। তাহার দরজায় ঢাল তলোয়ার হাতে সিপাহীরা দাঁড়াইয়া ছিল, তিনি তাহাদের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলেন, কেহ তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। চাকর-চাকরানীরা তাঁহার চারিদিক দিয়া যাওয়া আসা করিতে লাগিল, কেহই বুঝিতে পারিল না যে, একজন লোক আসিয়াছে। শেষে যখন একেবারে দময়ন্তীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন দময়ন্তী আর তাঁহার সখীরা তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহারা মনে করিলেন, বুঝি কোন দেবতা আসিয়াছেন। তাই তাঁহারা তাঁহাকে নমস্কার করিয়া, হেঁট মুখে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না।

 তখন দময়ন্তীর মন বলিল, “ইনিই মহারাজা নল।’ এ কথা মনে হইবামাত্র তাঁহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, “মহারাজ কি করিয়া এখানে আসিলে? দরজায় যে পাহারা।”

 নল বলিলেন, “দেবতাদের বরে তোমার লোকেরা আমাকে দেখিতে পায় নাই। ইন্দ্র, যম, অগ্নি আব বরুণ আমাকে তাঁহাদের দূত করিয়া তোমার নিকট পাঠাইয়াছেন; তুমি তাঁহাদের মধ্যে একজনকে বরণ কর।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “মহারাজ, হাঁসের মুখে তোমার কথা শুনিয়াছিলাম, সেই হইতে তোমাকে ভালোবাসিয়াছি। তোমা ছাড়া আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিতে পারিব না। তুমি যদি আমাকে পরিত্যাগ কর, তবে আমি বিষ খাইয়া মরিব।”

 নল বলিলেন “রাজকুমারি, দেবতাদিগের পায়ের ধূলার সমানও আমি নহি। তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া আমাকে কেন বিবাহ করিতে চাহিতেছ? মনে করিয়া দেখ, ইঁহারা অসন্তুষ্ট হইলে কি না করিতে পারেন।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “দেবতাদিগের মহিমার অন্ত নাই; তাঁহাদিগকে নমস্কার করি! কিন্তু মহাবাজ, আমি সত্য বলিতেছি, তোমাকে ছাড়িয়া আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিতে পারিব না।”

 নল বলিলেন, “দময়ন্তি, আমিও তোমাকে বড়ই ভালোবাসি। কিন্তু যাঁহাদের দূত হইয়া আসিয়াছি, তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া নিজের কথা বলিলে আমার মহাপাপ হইবে।”

 দময়ন্তী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মহারাজ, তোমার কাজ ত তুমি ভালো মতই করিযাছ। ইহার পরেও যদি আমি ত্রিভূবনের সম্মুখে তোমার গলায় মালা দিই, তাহাতে তোমার কেন পাপ হইবে? মহাবাজ, তুমি সভায় আসিবে; আমি তোমাকেই বরণ করিব।”

 রাজা দেবতাদের নিকট চলিয়া আসিলেন। দেবতারা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, দময়ন্তী কি বলিল?”

 নল বলিলেন, “আমি আপনাদের কথা আমার সাধ্যমত বলিয়াছি। তথাপি দময়ন্তী বলিলেন, আমার গলাতেই মালা দিবেন। এখন আপনাদের যাহা ভালো মনে হয় করুন।”

 স্বয়ম্বরের শুভদিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সুন্দর সভাঘর আলো করিয়া দেবতা আর রাজাগণ, মাণিকের কাজ করা সোনার সিংহাসনে বসিলে, সে স্থানের শোভার আর সীমা রহিল না। তারপর সন্ধ্যার আকাশে যেমন চন্দ্র দেখা দেয়, দময়ন্তী স্নিগ্ধ উজ্জ্বল মনোহর বেশে সেইরূপ আসিয়া সভায় দাঁড়াইলেন। তখন ঘটকেরা মালা চন্দন পরিয়া, মধুর স্বরে অতি চমৎকার ভঙ্গিতে রাজাগণের পরিচয় দিতে আরম্ভ করিল। দময়ন্তী সকলের কথাই শুনিলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না, তিনি কেবল চারিদিক চাহিয়া দেখিতেছিলেন, নল কোথায়!

 নলকে খুঁজিতে খুঁজিতে তিনি দেখিলেন যে, পাঁচটি লোক সভায় বসিয়া আছেন। তাহাদিগকে দেখিতে ঠিক নলেরই মত। তিনি বুঝিতে পারিলেন, উঁহাদের মধ্যে একজন নল। আর চারিজন দেবতা। কিন্তু ইহার বেশি তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। তখন তিনি দুখানি হাত জোড় করিয়া দিয়া বলিলেন, “আমি নলকে ভালোবাসি আর মনে মনে তাহাকেই বরণ করিয়াছি। হে দেবতাগণ, আপনারা দয়া করিয়া তাহাকে দেখাইয়া দিন।”

 দময়ন্তীর কথায় দেবতাগণের মন গলিল। তখন তিনি দেখিতে পাইলেন, সেই পাঁচজনের মধ্যে চারিজন শূন্যে বসিয়া আছে। তাহাদের চোখে পলক নাই; শরীরে ঘাম নাই, ছায়া নাই। তিনি বুঝিলেন; এই চারিজন দেবতা, অপরটি নল। তখন তিনি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া অপার আনন্দের সহিত বরমাল্যখানি নলের গলায় পরাইয়া দিলেন। নল বলিলেন, “দময়ন্তি, যতদিন এই প্রাণ থাকিবে, ততদিন আমি তোমাকে ভালোবাসিব।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “আমার এই প্রাণ দিয়া তোমার সেবা করিব।” এদিকে দেবতারা আনন্দের সহিত বলিতেছেন, “বড়ই সুখের বিষয় হইল; যেমন কন্যা তেমনি বর মিলিল। রাজা মহাশয়েরা বলিতেছেন, “হায়! এত ক্লেশ করিয়া আসিলাম, আর অন্যে কন্যা লইয়া গেল!”

 যাহা হউক কন্যা যখন মোটেই একটি, তখন রাজা মহাশয়দিগের প্রত্যেকেরই কন্যা পাওয়ার ত কোন কথা ছিল না; দুঃখ করিলে কি হইবে? দেবতারা কেহই দুঃখ করেন নাই। এমন-কি, যাঁহারা ফাকি দিয়া দময়ন্তীকে পাইবার জন্য এত চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহারাই শেষে সন্তুষ্ট হইয়া নলকে বর দিতে লাগিলেন।

 ইন্দ্র বলিলেন, “তুমি স্বর্গে গিয়া পরম সুখে থাকিবে।”

 অগ্নি কহিলেন, “তুমি যাহাই রাঁধিবে তাহাই খাইতে অমৃতের মত হইবে।”,

 বরুণ কহিলেন, “তুমি ডাকিলেই আমি আসিব। আর এই মালা লও; ইহার ফুল কখনো শুকাইবে না।”

 তারপর মহাসমারোহে নল-দময়ন্তীর বিবাহ হইল। বিবাহের পরে সকলে নিজ নিজ দেশে চলিয়া গেলেন। নলও কিছুদিন বিদর্ভ দেশে থাকিয়া দময়ন্তীকে লইয়া মনের আনন্দে ঘরে ফিরিলেন।

 দেশে ফিরিয়া তাহাদের সময় কিছুদিন বড়ই সুখে কাটিল। প্রজারা দু'হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিতে করিতে বলিতে লাগিল, “না জানি কতই পুণ্য করিয়াছিলাম, তাই এমন রাজা রানী পাইলাম।” শত্রুরা অস্ত্র ফেলিয়া দিয়া বলিল, “মারিলেও নল, রাখিলেও নল, এমন কাজ আর করিব না।”

 ইহার উপর যখন তাহাদের ইন্দ্রসেন আর ইন্দ্রসেনা নামে একটি পুত্র আর একটি কন্যা হইল, তখন তাহাদের চাঁদমুখের দিকে তাকাইয়া তাহারা এই পৃথিবীতেই স্বর্গের সুখ পাইলেন।

 কিন্তু সংসারের সুখকে বিশ্বাস করিতে নাই। সুখ যখন আসে তখন সে দুঃখকে আড়ালে করিয়া আনিতে প্রায়ই ভোলে না। নলের সুখের শুরু হইতেই কলি নামে কুটিল দেবতা তাহার সর্বনাশের সুযোগ খুঁজিতে ছিল।

 সেই স্বয়ম্বরের দিন ইন্দ্র, যম, অগ্নি আর বরুণ স্বর্গে ফিরিয়া যাইবার সময় পথে কলি আর দ্বাপরের সঙ্গে তাহাদের দেখা হয়। কলিকে দেখিয়া ইন্দ্র বলিলেন, “কি হে কলি, কোথায় চলিয়াছ?”

 কলি বলি, “দময়ন্তীর স্বয়ম্বরে।”

 ইন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “হাঃ, হাঃ, হা—! স্বয়ম্বর শেষ হইয়া গিয়াছে। দময়ন্তী নলকে মালা দিয়াছেন।”

 এ কথা শুনিবামাত্র কলি ভ্রূকুটি করিয়া চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “বটে! আপনারা থাকিতে একটা মানুষকে মালা দিল? ইহার উচিত সাজা দিতে হইবে।”

 দেবতারা বলিলেন, “দময়ন্তীর দোষ নাই, আমরা তাহাকে অনুমতি দিয়াছি। নলের মতন বরকে মালা দিবে না ত কাহাকে দিবে? এমন লোককে শাপ দেওয়া নিতান্ত নিষ্ঠুর কাজ।”

 এই বলিয়া দেবতারা চলিয়া গেলে, কলি দ্বাপরকে বলিল, “দ্বাপর, তুমি কি বল? আমার ত রাগে গা জ্বলিয়া যাইতেছে। যেমন করিয়াই হউক, এই নলের ভিতরে ঢুকিয়া, তাহার সর্বনাশ করিতে হইবে। সে সময় তুমি আমায় সাহায্য করিবে কি না, বল?”

 দ্বাপর বলিল, “তাহা আর বলিতে! অবশ্য সাহায্য করিব।”

 এমনি যুক্তি হইল, এখন একটি ছিদ্র পাইলেই হয়। এ-সকল দুষ্ট দেবতা; পুণ্যবাণ লোকের শবীরে চট করিয়া প্রবেশ করিবার শক্তি ইহাদের নাই। কাজেই কলি নলের সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া দেখিতে লাগিল, তিনি কখনো কোন দোষ করেন কি না। এগার বৎসর ধরিয়া দুষ্ট কলি নলের পিছু পিছু ঘুরিল। এগার বৎসরের ভিতরে সে না পাইল, তাহার একটি কাজের খুঁত, বা একটি কথার ভুল। এগার বৎসর পরে একদিন তিনি সন্ধ্যা উপাসনার আগে পা ধুইতে ভুলিয়া যান, তাই তাহার শরীর অশুচি ছিল। এইটুকু ছিদ্র পাইবামাত্র বেয়ারামের বীজের মত, দুষ্ট কলি তাহার ভিতরে ঢুকিয়া গেল।

 এমনি ভাবে নলকে কাবু করিয়া, কলি নলের ভাই পুষ্করকে গিয়া বলিল, “চল তোমাকে রাজা করিয়া দিই গে।”

 পুষ্কর ভারি দুষ্ট আর নিতান্ত বোকা ছিল, তাই রাজা হওয়ার কথায় তাহার জিবে জল আসিল। সে তখনই লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “চল! কিন্তু কেমন করিয়া রাজা করিবে?”

 কলি বলিল, “কেন তুমি পাশা খেলিয়া নলকে হারাইয়া দিবে।”

 এ কথা শুনিয়াই পুষ্ক আবার ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল—সে পাশার ‘পও জানিত না। কিন্তু কলি বলিল, “ভয় কি? তোমায় কিছুই করিতে হইবে না। আমি তোমাকে জিতাইয়া দিব।”

 তখন পুষ্করের আনন্দ আর সাহস দেখে কে? সে অমনি নলের নিকট গিয়া উপস্থিত। তারপর যতক্ষণ না নল পাশা খেলিতে রাজি হইলেন, ততক্ষণ সে তাহাকে বিশ্রাম করিতে দিল না। খালি বলিল,

 “দাদা! এস, পাশা খেলিতে হইবে!”

 কাজেই আর কি করা যায়, পাশা খেলা আরম্ভ হইল।

 নলের মাথার ভিতরে কলি; পাশার ভিতরে কলি। নল এককথা বলিতে আর-এক কথা বলিয়া বসেন। দারুণ পাশা একরকম বলিতে আর-একরকম হইয়া যায়!

 দময়ন্তী দেখিলেন, সর্বনাশ, হইতে চলিয়াছে। সকলেই বুঝিল, রাজার আজ মাথার ঠিক নাই।

 পুরীময় হাহাকার পড়িয়া গেল। রাজা সোনা হারিয়াছেন, রূপা হরিয়াছেন, তথাপি তিনি থামেন না, বারণ করিতে গেলে কথা শোনেন না।

 সকলে পরামর্শ করিয়া সারথি বার্ষ্ণেয়কে পাঠাইল। সে দময়ন্তীর নিকট আসিয়া জোড়হাতে বলিল, “দেবি! পাত্রমিত্র সকলে মহারাজকে দেখিতে চাহে। দয়া করিয়া একটিবার তাহাকে বাহিরে পাঠান।”

 তখন দময়ন্তী কাঁদিতে কাঁদিতে রাজাকে বলিলেন, “মহারাজ তোমার পায়ে পড়ি, একবার উঠিয়া বাহিরে চল, সকলে তোমাকে দেখিতে চাহে।”

 কিন্তু রাজা তখন কলির হাতে, রানীর কথার উত্তর কে দিবে? দময়ন্তী যত কাদিলেন, তাহার কিছুই রাজার কানে গেল না। পাত্রমিত্রগণকে তাহার দর্শন না পাইয়া ফিরিতে হইল।

 এইরূপে নানারকমে বারবার চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই রাজার মতি ফিরান গেল না।

 দময়ন্তী বুঝিলেন, আর রক্ষা নাই, এখন ছেলেটি আর মেয়েটিকে রক্ষা করিতে পারিলে হয়।

 তাই তিনি সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাছা বার্ষ্ণেয়, রাজার যখন সময় ছিল, তখন তিনি তোমাদের অনেক করিয়াছে, এখন এই অসময়ে তাহার কিছু উপকার কর। আমাদের যাহা হইবার হইবে, কিন্তু ইন্দ্রসেন আর ইন্দ্রসেনার দুঃখ দেখিতে পারিব না। বাছা, তুমিই এই বিপদে আমার একমাত্র ভরসা। তুমি ইহাদের দুজনকে বিদর্ভ দেশে আমার পিতার নিকট লইয়া যাও। সেখানে তাহাদিগকে রাখিযা ইচ্ছা হয় সেখানে থাকিও, নাহয় অন্য কোথাও যাইও।”

 রাণীর কথায় বার্ষ্ণেয় ছেলেটি আর মেয়েটিকে লইয়া, তখনই বিদর্ভ দেশে চলিয়া গেল। সেখানে তাহাদের দুজনকে, আর রথখানি আর ঘোড়াগুলিকে রাখিয়া, সে অযোধ্যায় গিয়া সেখানকার রাজা ঋতুপর্ণের নিকট কাজ লইল। ঋতুপর্ণের সারথি হইযা তাহাব ভাতকাপড়ের চিন্তা গেল বটে। কিন্তু মনের দুঃখ দূর আর হইল না।

 এদিকে নলের দুঃখের কথা আর কি বলিব। হারিতে হারিতে তিনি সর্বস্ব খোয়াইয়া ফকির হইয়া দময়ন্তীকে লইয়া পথে বাহির হইয়াছে! গায়ের চাদরখানি পর্যন্ত নাই। সঙ্গে একটি লোকও নাই। পুষ্কর পাশায় জিতিয়া, যত মুখে আসিয়াছে, ততই তাহাকে বিদ্রুপ করিয়াছে। শেষে সেই দুরাত্মা রাজ্যে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে, “যে নলের হইয়া কথা বলিবে, তাহাকে কাটিয়া ফেলিব।”

 কাজেই প্রজারা গোপনে কেবল চোখের জল ফেলে, কিন্তু রাজাকে দেখিলে কথা কয় না।

 নগরের কাছেই একটি বনের ভিতরে, কেবল জল খাইয়া,নল দময়ন্তী তিনদিন কাটাইলেন। তারপর দুজনে অতিকষ্টে, বনের ফল মূল খাইয়া জীবনধারণ করিতে লাগিলেন।

 এমন করিয়া কিছুদিন গেল। তারপর একদিন নল দেখিলেন, বনের ভিতর এক ঝাঁক পাখি চরিতেছে, তাহাদের পালক গুলি সোনার। আহা! নলের মনে সেই পাখিগুলি দেখিয়া কি আনন্দই হইল। তিনি ভাবিলেন, “পাখিগুলি মারিয়া খাইব, আর পালকগুলি বেচিয়া পয়সা পাইব।”

 এই ভাবিয়া তিনি লতা পাতায় শরীর উত্তমরূপে ঢাকিয়া, নিজের কাপড় খানি দিয়া সেই পাখি ধরিতে গেলেন, অমনি দুষ্ট পাখির দল খিল খিল করিয়া হাসিতে হাসিতে কাপড়খানি লইয়া উড়িয়া পলাইল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, “হাঃহাঃ! মহারাজ, চিনিতে পারিলে না? আমরা সেই পাশা! সব হারিয়া মনে করিয়াছিলে, বুঝি কাপড়খানি লইয়া পলাইবে? তা আমরা কাপড়খানি ছাড়িব কেন?”

 রাজা ভাবিলেন, ‘সময়ে সবই হয়,ইহার পর না জানি কি হইবে।’ ভাবিতে ভাবিতে তিনি দময়ন্তীর নিকট আসিয়া, তাহাকে বলিলেন, ‘দময়ন্তি, দুষ্টেরা আমার রাজ্য নিয়াছে, সর্বস্ব নিয়াছে। একখানিমাত্র কাপড় যে পরিয়াছিলাম, তাহাও তাহাদের সহ্য না হওয়াতে, আজ তাহাও লইয়া গেল! এখন আমি যাহা বলি শুন। দময়ন্তি, এই দেখ, কত পথ অবন্তী নগর ও ঋক্ষবান পর্বত হইয়া দক্ষিণ দেশে গিয়াছে। ঐ দেখ, বিন্ধ্য পর্বত, এই পায়োষ্ণী নদী। ঐ মুনিদিগের আশ্রম সকল দেখা যাইতেছে। এই পথে গেলে বিদর্ভ দেশে যাওয়া যায়; ঐ পথটি কোশলায় গিয়াছে।”

 বাজার কথায় দময়ন্তীর প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “মহারাজ, না জানি তুমি কি মনে ভাবিয়া এ-সকল কথা বলিতেছ! তোমাকে ছাড়িয়া আমি কোথায় যাইব? শাস্ত্রে বলিযাছে, স্ত্রীই সকল দুঃখের ঔষধ; মহারাজ, তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিও না।” রাজা বলিলেন, “দময়ন্তি, আমি প্রাণত্যাগ করিতে পারি, তথাপি তোমাকে ছাড়িতে পারি না। তুমি ভয় পাইতেছ কেন।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “তবে কি জন্য বিদর্ভ দেশের পথ দেখাইয়া দিতেছ? মহারাজ, আমার বড়ই ভয় হইতেছে। যদি যাইতে হয়, চল না, দুজনেই বিদর্ভ দেশে যাই। বাবা তোমাকে বুকে করিয়া বাখিবেন।”

 নল বলিলেন, “না দময়ন্তী, এই বেশে আত্মীয়গণের নিকট যাইতে আমি কিছুতেই পারিব না।”

 এই বলিযা তিনি বারবার মিষ্ট কথায় দময়ন্তীকে শান্ত করিতে লাগিলেন। তারপর ক্ষুধা তৃষ্ণায় নিতান্ত কাতর হইয়া বনের এক গভীর স্থানে দুজনেই বিশ্রাম করিতে বসিলেন, অল্পক্ষণের ভিতরেই দময়ন্তীর নিদ্রা আসিল। কিন্তু নলের প্রাণে যে দুঃখের আগুন জ্বলিতে ছিল, তাহাতে নিদ্রা কি করিয়া আসিবে! এই দুঃখের ভিতরে দুষ্ট কলি ক্রমাগতই তাহার ভিতর হইতে বলিতেছিল, “দময়ন্তীকে সঙ্গে সঙ্গে লইয়া কেন কষ্ট দিতেছ? চলিয়া যাও! চলিয়া যাও’ দময়ন্তী তাহার বাপের বাড়ি গিয়া সুখে থাকুক!"

 নল বলিলেন, “যাইব? না, মরিব? যদি যাই, এই বেশে কি করিয়া যাইব? দময়ন্তীর কাপড়ের আধখানা কাটিয়া পরিয়া যাই। কিন্তু কি দিয়া কাটিব?”

 এই কথা মনে হইতে না হইতেই তিনি দেখিলেন, সামনে একখানি তলোয়ার, পড়িয়া আছে! সকলই দুষ্ট কলির কাজ, কিন্তু নল তাহা বুঝতে পারিলেন না! তিনি সেই তলোয়ার দিয়া দময়ন্তীর কাপড়ের অর্ধেক কাটিয়া পরিলেন। তখন কলি ক্রমাগত বলিতে লাগিল, “চল! চল!” তিনি তাহার কথায় কয়েক পা চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাহার প্রাণের ভিতরে হায়, হায়! শব্দ উঠাতে আবার ফিরিয়া আসিলেন!

 এইরূপে কলি কতবার তাহাকে টানিল, কতবার তিনি আবার ফিরিলেন। একবার তাহার মনে হইল, হায়! আমার দময়ন্তীর এই দশা!’ একবার ভাবিলেন, ‘হায়! এই ভয়ংকর বনে আমার দময়ন্তী কি করিয়া থাকিবে?’ এমনি এক-এক কথা ভাবিয়া রাজা এক-একবার ফিরেন, আবার কলি তাহাকে টানিয়া লইয়া যায়। শেষে কলিরই জয় হইল, নল চোখের জলে ভাসিয়া বারবার দময়ন্তীর দিকে ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে পাগলের মত ছুটিয়া পলাইলেন।

 আহা, দময়ন্তীকে যে কি দুঃখের সাগরে ভাসাইয়া গেলেন, তাহা নলের তখন ভাবিয়া দেখিবার ক্ষমতা ছিল না। যখন দময়ন্তী জাগিয়া দেখিলেন, নল, নাই তখন যে তাহার কি কষ্ট হইল, আমার কি সাধ্য, তাহা বলিয়া বুঝাই! সে সময়ে তাহার দুঃখে বুঝি পাষাণও গলিয়া ছিল। তিনি পাগলিনীর ন্যায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া কাঁদিলেন;বারবার অজ্ঞান হইয়া আবার জ্ঞান হইলে ছটফট করিয়া কাঁদিলেন;সন্ধ্যাকালে ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হইয়া, নল যে তাহাকে খুঁজিবেন সে কথা ভাবিয়া আকুল হইয়া দিলেন। কাদিতে কাঁদিতে নলের শত্রুদিগের উপর তাহার রাগ হইল। তিনি তাহাদিগকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “যে আমার পতিকে এমন কষ্টে ফেলিয়াছে, ইহার চেয়েও অধিক কষ্ট তাহার হইবে।”

 বিপদ প্রায়ই একেলা আসে না। দময়ন্তী ব্যাকুল হইয়া বনের ভিতরে নলকে খুঁজিতেছেন, এমন সময়, এক ভীষণ অজগর তাহার লকলকে জিব বাহির করিতে করিতে তাহাকে খাইতে আসিল। এমন দুঃখের সময়ে মৃত্যু হইলে ত আরামের কথাই হয়। দময়ন্তী অজগর দেখিয়া ভয় পাইলেন না। কিন্তু তাহার মনে হইল, “হায়! এই ঘোর অরণ্যের ভিতরে আমাকে সাপে খাইয়াছে। এ কথা শুনিলে না জানি, নলের মনে কতই কষ্ট হইবে।”

 যখন আর কেহই থাকে না:তখনো ভগবান থাকেন। তিনি কৃপা করিলে নিতান্ত ঘোরতর বিপদ হইতেও মানুষকে রক্ষা করিতে পারেন। দময়ন্তী অজগর দেখিয়া জীবনের আশা একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছেন, এমন সময় এক ব্যাধ আসিয়া সাপটাকে মারিয়া ফেলিল।

 তারপর বনের ভিতরে চলিতে চলিতে দময়ন্তী দেখিলেন যে, একটা ভয়ঙ্কর সিংহ তাহার দিকে আসিতেছে। সিংহকে দেখিবামাত্র তিনি তাহার নিকটে গিয়া বলিলেন, “হে পশুরাজ! আমি মহারাজ ভীমের কন্যা, নলের পত্নী। আমার নাম দময়ন্তী। যদি তুমি নলকে দেখিয়া থাক, তবে তাহার সংবাদ দিয়া আমার প্রাণ রক্ষা কর;নচেৎ আমাকে ভক্ষণ করিয়া আমার দুঃখ দূর কর।”

 সিংহ তাহার কথার কোন উত্তর না দিয়াই চলিয়া গেল, তখন দময়ন্তী পর্বতকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে গিরিরাজ! তুমি কি আমার নলকে দেখিয়াছ?” হায় হায়! পর্বতও তাহার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না।

 এইরূপে দময়ন্তী পাগলিনীর বেশে মুনিদিগের আশ্রমে গিয়া উপস্থিত হইলেন। মুনিরা তাহাকে দেখিয়া স্নেহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! তুমি কি এই বনের দেবতা? কেন মা তুমি এমন করিয়া কাঁদিয়া ফিরিতেছ?”

 দময়ন্তী বলিলেন, “ওগো, আমি দেবতা নই! আমি মানুষ, অতি দীন দুঃখিনী;আপনাদের কৃপা ভিক্ষা করিতেছি। মুনিঠাকুর, আমি মহারাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তী। আমার স্বামীর কথা কি আপনারা শোনেন নাই? তিনি নিষধের রাজা। তাহার নাম নল। তাহার রূপ দেবতার মতন; তেজ সূর্যের মতন। ধর্ম আর সত্যের তিনি আশ্রয়। মুনিঠাকুর, আমি সেই নলের স্ত্রী; তাহাকে খুঁজিতে আপনাদের নিকটে উপস্থিত হইয়াছি। তিনি কি আপনাদের তপোবন আসিয়াছেন?”

 মুনিগণ বলিলেন, “মা তুমি স্থির হও! চক্ষের জল মুছ। আমরা নিশ্চয় বলিতেছি শীঘ্রই তোমার আর নলের দুঃখ দূর হইবে।”

 বলিতে বলিতে, আর সেখানে মুনিও নাই, আশ্রমও নাই। সকলই ভেল্কির মত আকাশে মিলাইয়া গেল। দময়ন্তী ভাবিলেন, “কি আশ্চর্য! আমি স্বপ্ন দেখিলাম?” চিন্তা করিতে করিতে তিনি এক নদীর তীরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, অনেকগুলি বণিক হাতি, ঘোড়া, উট, আর গাড়িতে করিয়া বিস্তর জিনিসপত্র লইয়া সেই নদী পার হইতেছে। দময়ন্তী সেই সওদাগরদিগের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, তাহারা তাহাকে দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেল। তাহাদের কেহ চিৎকার করিয়া উঠিল, কেহ ছুটিয়া পলাইল। কেহ তাহাকে পাগল মনে করিয়া বিদ্রুপ করিতে লাগিল। কেহ তাহাকে বনের দেবতা মনে করিয়া তাঁহার নিকট আশীর্বাদ চাহিতে আসিল; আবার কেহ কেহ তাহার অবস্থা দেখিয়া দয়া করিয়া তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল।

 দময়ন্তী তাহাদিগকে বলিলেন, “বাছাসকল, আমি মানুষ; রাজার মেয়ে, রাজার রাণী, নিষধের রাজা নল আমার স্বামী, আমি বনের ভিতরে তাহাকে হারাইয়া পাগলিনীর মত তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি! তোমরা কি তাহাকে দেখিয়াছ?”

 সেই বণিকদিগের দলপতির নাম ছিল শুচি। সে দময়ন্তীর কথায় বিনয় করিয়া বলিল, “মা, আমরা ত নল নামে কাহাকেও দেখিতে পাই নাই। এই বনের ভিতরে বাঘ ভালুক অনেক আছে। কিন্তু মানুষ ত খালি তোমাকেই দেখিলাম।”

 এই বলিয়া বণিকের দল যাইতে প্রস্তুত হইলে, দময়ন্তী তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কোন দেশে যাইবে?”

 বণিকেরা বলিল, “আমরা চেদীর রাজা সুবাহুর নিকট যাইব।”

 এ কথা শুনিয়া দময়ন্তীও সেই সওদাগরদিগের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। তাহার মনে হইল যে, হয়ত বা পথে নলের সঙ্গে দেখা হইতে পারে। সওদাগরের দল সমস্ত দিন পথ চলিয়া একটা সুন্দর সরোবরেব ধারে উপস্থিত হইল। সবোবর দেখিয়া বণিকেরা বলিল, “কি সুন্দর স্থানটি। চল ভাই, ইহার ধারে বিশ্রাম করি।” এই বলিয়া তাহারা সরোবরের পশ্চিম ধারে একটি জায়গা দেখিয়া, সেইখানে রাত কাটাইবার আয়োজন করিল। হাতি ঘোড়া-গুলিকে গাছে বাধিয়া রাখিল। বহুদিন পথ চলিয়া সকলেরই অত্যন্ত পরিশ্রম হইয়াছিল, কাজেই তাহারা সকলে ঘুমাইয়া পড়িতে বেশি বিলম্ব হইল না।

 রাত দুপুর হইয়াছে, সকলে অচেতন হইয়া ঘুমাইতেছে, এমন সময় একদল বুনো হাতি সেই সরোবরে জল খাইতে আসিল। তাহারা তখন সদাগরদিগের পোষা হাতিগুলিকে দেখিতে পাইল, তখন আর তাহাদের রাগের সীমা রহিল না। তাহারা তৎক্ষণাৎ গভীর গর্জনে সেই পোষা হাতিগুলিকে তাড়া করিলে সেগুলি ভয়ে চিৎকার করিতে করিতে, হতভাগ্য সওদাগরদের উপর দিয়াই ছুটিয়া পলাইতে লাগিল। বেচারারা ভালো করিয়া বুঝিতেও পারিল না, কি হইয়াছে। তাহার পূর্বেই তাহাদের অধিকাংশ লোক হাতির পায়ের তলায় পড়িয়া পিষিয়া গেল।

 একদিকে এমন ভয়ানক বিপদ, অন্যদিকে বনে আগুন লাগিয়া প্রলয়কাণ্ড উপস্থিত। ধনরত্ন, জিনিসপত্র, যাহা কিছু ছিল, সে সর্বনেশে আগুন হইতে কিছুই রক্ষা পাইল না। হাতির পায়ে যাহা চূর্ণ হয় নাই; তাহা আগুনে পুড়িয়া শেষ হইল।

 এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের ভিতরে দময়ন্তী হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখিলেন যে সওদাগরদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকজনই বাঁচিয়া আছে, আর তাহাদের কেহ কেহ ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া তাঁহাকেই এই বিপদের কারণ মনে করিয়াছে। তাহারা বলিতেছে, “এই পাগলিনীকে জায়গা দিয়াই আমাদের সর্বনাশ হইল। এ নিশ্চয় কোন রাক্ষসী বা পিশাচী হইবে। চল উহাকে বধ করি।”

 সেখানে আর দু-চারজন ভালো বুদ্ধিমান লোক না থাকিলে, হয়ত সেদিন দময়ন্তীর প্রাণই যাইত! ভগবানের কৃপায় সেই সকল লোক তাহার পক্ষ হওয়াতে তিনি বাঁচিয়া গেলেন।

 রাত্রি প্রভাত হইলে, সেই কয়জন সওদাগর, যাহা কিছু জিনিস অবশিষ্ট ছিল তাহাই লইয়া, অতি কষ্টে কাদিতে কাদিতে সুবাহুর দেশে যাত্রা করিল। দময়ন্তীও তাহাদের সঙ্গে চলিলেন। তাহারা যখন সুবাহুর নগরে পৌছিল, তখন সন্ধ্যা কাল। শহরের ছেলেরা তখন পথে বেড়াইতে আর খেলা করিতে বাহির হইয়াছে। দুঃখিনী দময়ন্তীর মলিন ছেড়া কাপড়, ধূলায় ধূসর শরীর আর এলো চুল দেখিয়া তাহারা মনে করিল বুঝি পাগল, তাই তাহারা হাসিতে হাসিতে আসিয়া তাহার চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। দময়ন্তী যেদিকে যান, তাহারাও সেদিকে যায়। এমনি করিয়া তিনি রাজবাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেই সময়ে রাজার মা বায়ু সেবন করিবার জন্য ছাদে উঠিয়াছিলেন। সেইখান হইতে দময়ন্তীকে দেখিতে পাইয়াই, দয়ায় তাঁহার মন গলিয়া গেল। তিনি দাইকে বলিলেন, “আহা জানি কাহার বাছা গো! দুঃখিনীর মুখখানি দেখিলে প্রাণ কাঁদিয়া উঠে। যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী! ও দাই, শীঘ্র উহাকে আমার নিকট লইয়া আয়। ছেলেগুলি উহাকে বিরক্ত করিতেছে।”

 দাই তখনই ছেলের দলকে তাড়াইয়া দিয়া দময়ন্তীকে রাজমাতার নিকট লইয়া আসিল। রাজমাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা তুমি কে? তোমার স্বামীর নাম কি? আহা গায় একখানিও গহনা নাই, তবু দেখিতে কি সুন্দর! দুষ্ট ছেলের দল এত বিরক্ত করিতেছিল, তবু একটু রাগও করে নাই।”

 দময়ন্তী বলিলেন, “আমি ভদ্রঘরের মেয়ে, দুঃখে পড়তে সৈরিন্ধীর কাজ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি। আমার স্বামী পরম গুণবাণ, আর আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন, বিবাহের পর কয়েক বৎসর আমরা বড়ই সুখে ছিলাম, তারপর আমাদের কপাল ভাঙ্গিল। পাশায় রাজ্যধন সব হারাইয়া আমাকে লইয়া পতি বনবাসী হইলেন। এ হতভাগীর দুঃখের শেষ তাহাতেও হইল না, একদিন তিনি ঘুমের ভিতরে আমাকে ফেলিয়া কোথায় চলিয়া গেলেন, সেই অবধি পাগলিনীর মত তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি।”

 এই বলিয়া দময়ন্তী কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন, রাজমাতার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। তিনি তাহাকে বলিলেন, “বাছা, তুমি আমার নিকট থাক তোমার স্বামীর খোঁজ করাইয়া দিব। হয়ত বা ঘুরিতে ঘুরিতে তিনি নিজেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারেন।”

তারপর তিনি নিজের কন্যা সুনন্দাকে ডাকিয়া বলিলেন, “এই দেখ মা, তোমার জন্য কেমন সুন্দর একটি সখী পাইয়াছি। তোমরা দুজনেই এক বয়সী। এক সঙ্গে থাকিয়া তোমাদের সময় বেশ সুখে কাটিবে।”

 সুনন্দা একটিবার দময়ন্তীর মুখের দিকে তাকাইয়াই, ছুটিয়া গিয়া তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিলেন। তাহার পর হইতে আর সকল সময়েই দেখা যাইত যে, সুনন্দার একখানি হাত দময়ন্তীকে জড়াইয়া রহিয়াছে।

 এতদিন নল কি ভাবে ছিলেন?

 দময়ন্তীর নিকট হইতে পলায়ন করিয়া তিনি একটি অতি গভীর বনের ভিতরে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়া তিনি দেখিলেন, বনে ভয়ানক আগুন লাগিয়াছে, আর সেই আগুনের ভিতর কে যেন অতি কাতর স্বরে ডাকিয়া বলিতেছে, “হে মহারাজ নল, দয়া করিয়া আমাকে রক্ষা কর।”

 তিনি তৎক্ষণাৎ ‘ভয় নাই বলিয়া ছুটিয়া গিয়া দেখিলেন, একটি প্রকাণ্ড সাপ কুণ্ডলী করিয়া সেখানে পড়িয়া আছে। সাপটি তাহাকে দেখিয়া বিনয়ের সহিত বলিল, “মহারাজ, আমি কর্কোটক নামক নাগ; নারদের শাপে আমার চলিবার শক্তি গিয়াছে। আমি বহুকাল যাবৎ এইভাবে এইখানে পড়িয়া আছি তুমি আসিয়া আমাকে এখান হইতে সরাইলে তবে আমার শাপ দূর হইবার কথা। দোহাই মহারাজ, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমার উপকার করিব।” এই বলিয়া সাপটি আঙ্গুলের মতন ছোট হইয়া গেল, আর নল অতি সহজেই তাহাকে আগুনের ভিতর হইতে লইয়া আসিলেন। সেই স্বয়ম্বরের সময় হইতেই অগ্নি নলের উপর বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন তাই আগুনের শিখা তাহাকে দেখিয়াই দূরে চলিয়া গেল।

 এখন কর্কোটক নলকে বলিল, “মহারাজ এখন গণিয়া পা ফেলিতে ফেলিতে খানিক দূর চলিয়া যাও; তাহা হইলে আমি তোমার বিশেষ উপকার করিব।”

 সাপের কথায় নল গণিতে গণিতে দশ পা যাইবামাত্র সে কুট করিয়া তাহাকে কামড়াইয়া দিল। আর তৎক্ষণাৎ তাঁহার সেই দেবতার মতন সুন্দর চেহারা এমনি কালো আর কদাকার হইয়া গেল যে, কি বলিব।

 ইহাতে নল যার পর নাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এই বুঝি তোমার উপকার? তা সাপের উপকার এমনি হইবে না ত কেমন হইবে?”

 কর্কোটক বলিল, “মহারাজ বিচার করিয়া তবে আমাকে তিরস্কার কর। ভাবিয়া দেখ আমার কামড়ে তোমার দুটি মহৎ উপকার হইয়াছে। এক উপকার এই যে, পুষ্করের লোক এখন আর তোমাকে চিনিতে পারিবে না। আর-এক উপকার এই যে, যে দুষ্ট তোমার শরীরে ঢুকিয়া তোমাকে এমন কষ্ট দিতেছে, এখন হইতে সেই দুষ্ট আমার বিষে জ্বলিয়া পুড়িয়া নাকালের একশেষ হইবে। তাহার প্রমাণ দেখ, আমার বিষে তোমার কোন কষ্ট হইতেছে না। ইহাতেই বুঝিতে পারিবে, বিষের মজাটা সেই দুষ্টই ষোল আনা পাইতেছে। আমার এই কামড়ের পর আর অন্য কোন জন্তু তোমাকে কামড়াইতে পারিবে না, আর তোমার শত্রুরাও ক্রমে জব্দ হইয়া যাইবে।”

 তখন নল বলিলেন, “কর্কোটক, বাস্তবিকই তুমি আমাকে কামড়াইয়া যথার্থ বন্ধুর কাজ করিয়াছ।”

 কর্কোটক বলিল, “মহারাজ, তুমি এখন অযোধ্যা নগরে রাজা ঋতুপর্ণের নিকট চলিয়া যাও; সেখানে ‘বাহুক নামে পরিচয় দিয়া ঋতুপর্ণের সারথি হইবে। ঘোড়া চালাইবার কার্যে

উপেন্দ্র—৭০ এই পৃথিবীতে তোমার সমান আর কেহ নাই; তেমনি, পাশাখেলায় ঋতুপর্ণের মত এই পৃথিবীতে আর কেহই নাই। তুমি যদি ঘোড়া চালাইবার বিদ্যা তাহাকে শিখাইয়া দাও, তবে, তিনি নিশ্চয়ই তোমার উপর সন্তুষ্ট হইয়া তোমার সহিত বন্ধুতা করিবেন, আর খুব ভালো করিয়াই তোমাকে পাশা খেলা শিখাইবেন। সেই পাশার দ্বারা আবার তোমার রাজ্য ধন সকলই তুমি ফিরাইয়া আনিতে পারিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই তোমার মঙ্গল হউক! তুমি আর দুঃখ করিও না। যখন তোমার নিজের সেই সুন্দর রূপ আবার ফিরিয়া পাইতে ইচ্ছা হইবে, তখন এই কাপড় দুখানি পরিয়া আমাকে স্মরণ করিও।”

 এই বলিয়া কর্কোটক নলকে দুইখান কাপড় দিয়া, তাহার সম্মুখেই আকাশে মিলাইয়া গেল, আর, নল তাহাকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিয়া ঋতুপর্ণের দেশে যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌছাইতে তাঁহার দশদিন লাগিল।

 মহারাজ ঋতুপর্ণ পাত্রমিত্র-সমেত সভায় বসিয়া আছে, এমন সময় নল তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন—

 মহারাজ আমার নাম বাহুক। অশ্ব চালনায় আমার সমান লোক এই পৃথিবীতে কেহ কখনো দেখে নাই। ইহা ছাড়া অন্য সকল বিষয়েই আমার বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে। আপনার টাকার কষ্ট হইলে তাহার উপায় করিতে পারি, রন্ধনের কাজ অতি আশ্চর্যরকম করিতে পারি। ইহা ছাড়া বিশেষ কঠিন কোন কাজ উপস্থিত হইলে, অনেক সময় তাহাও করিতে পারি। আমাকে রাখিতে আজ্ঞা হউক।”

 ঋতুপর্ণ বলিলেন, “তোমাকে অসাধারণ গুণী লোক বলিয়া বোধ হইতেছে; বিশেষত তাড়াতাড়ি ঘোড়া চালাইবার আমার বড়ই শখ। তুমি মাসে দশ হাজার মোহর বেতন পাইবে; আমার নিকট থাক। এই বার্ষ্ণেয় আর জাবল তোমার কাজকর্ম করিবে।”

 ইহার পর হইতে ঋতুপর্ণের রাজ্যে নল বিশেষ সম্মানের সহিত বাস করিতে লাগিলেন। দিনের বেলায় কাজ করিতে করিতে দময়ন্তীর সেই মুখখানি তাহার ক্রমাগতই মনে পড়িত। সন্ধ্যাকালে অবসর হইবামাত্র তিনি প্রত্যহ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিতেন, “হায়! না জানি সে এখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হইয়া, এই হতভাগ্যের কথা ভাবিতে ভাবিতে কোথায় পড়িয়া আছে! না জানি কত কষ্টে তাহার অন্ন জুটিতেছে!”

 নল প্রত্যহ সন্ধ্যাকালে এই কথা বলেন, জাবল প্রত্যহ আশ্চর্য হইয়া তাহা শোনে, একদিন সে জিজ্ঞাসা করিল, “বাহুক, তুমি রোজ সন্ধ্যাকালে কাহার জন্য এমন করিয়া দুঃখ কর?

 নল বলিলেন, “ভাই, এক মূর্খের সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর মত স্ত্রী ছিল। বুদ্ধির দোষে সেই লক্ষ্মীকে ছাড়িয়া আসিয়া, এখন দারুণ দুঃখে হতভাগ্যের বুক ফাটিয়া যাইতেছে। সেই মুর্থই প্রত্যহ সেই লক্ষ্মীকে স্মরণ করিয়া এই কথা বলে।”

 এইরূপে ঋতুপর্ণের দেশে নলের দিন যাইতে লাগিল।

 নলের সারথি যখন তাহাদের ছেলেটি আর মেয়েটিকে লইয়া বিদর্ভদেশে উপস্থিত হয়, তাহার কিছুদিন পরেই মহারাজ ভীম শুনিতে পান যে, নল-দময়ন্তী রাজ্য ছাড়িয়া বনবাসী হইয়াছেন। তখন হইতেই তিনি বিশ্বাসী বুদ্ধিমান্ ব্রাহ্মণদিগকে অনেক টাকাকড়ি দিয়া দেশ বিদেশে পাঠাইয়া তাহাদিগকে খুঁজিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি সকলকে বলিয়া দিলেন, “উহাদিগকে এখানে আনিতে পারিলে ত বিশেষ পুরস্কার দিবই, উহাদের সংবাদ আনিতে পারিলেও এক হাজার গরু আর খুব বড় একখানি গ্রাম দিব।”

 সুতরাং ব্রাহ্মণদিগের যতদূর সাধ্য ছিল, তাহারা খুঁজিতে কোনরূপ ত্রুটি করিলেন না, কিন্তু একে একে তাহাদের প্রায় সকলেই নল-দময়ন্তীর কোন সন্ধান করিতে না পারিয়া, দুঃখের সহিত ফিরিয়া আসিলেন।

 ইহাদের মধ্যে সুদেব নামক একজন অতি বুদ্ধিমান্ লোক ছিলেন। তিনি নানা স্থানে ঘুরিতে ঘুরিতে, চেদী নগরে আসিয়া, রাজবাড়ীতে সুনন্দার সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখিতে পাইলেন। মেয়েটির বেশ অতি দীন হীন, মুখখানি মলিন, আর শরীর জীর্ণ শীর্ণ হইয়া অস্থি চর্মসার হইয়াছে। তথাপি তাহার মনে হইল, যেন সেই মুখখানি তিনি ইহার পূর্বে কোথায় দেখিয়াছে। তিনি সেইখানে দাঁড়াইয়া এক দৃষ্টে মেয়েটিকে দেখিতে লাগিলেন। যত দেখিলেন, ততই তাহার নিশ্চয় মনে হইল যে, এই মেয়েটিই দময়ন্তী। শেষে তিনি আর থাকিতে না পারিয়া দময়ন্তীর নিকটে গিয়া বলিলেন, “বৈদর্ভি (অর্থাৎ বিদর্ভদেশের রাজার মেয়ে) আমি আপনার ভ্রাতার প্রিয় বন্ধু; আমার নাম সুদেব। মহারাজ ভীমের আজ্ঞায় আপনাকে খুঁজিতে আসিয়াছি, আপনার পিতা, মাতা, ভাই, সন্তান, সকলেই ভালো আছে; কিন্তু আপনার জন্য দিনরাত কেবলই তাহাদের চক্ষের জল পড়ে!”

 সুদেবকে দেখিবামাত্র তাহাকে চিনিতে পারিয়া দময়ন্তী কঁদিয়া উঠিলেন। তারপর কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া, এক এক করিয়া পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু সকলের সংবাদ লইতে লাগিলেন।

 এদিকে সুনন্দা যখন দেখিলেন যে, দময়ন্তী কাঁদিতেছেন, তখন তিনিও কাঁদিতে কাদিতে তাহার মার নিকট গিয়া বলিলেন, “মা, এক ব্রাহ্মণ কোথা হইতে আসিয়া দময়ন্তীকে কি সংবাদ দিয়াছে, তাহা শুনিয়া দময়ন্তী কঁদিতেছেন।”

 এ কথায় রাজার মা তখনই সুদেবকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আপনি এই মেয়েটির পরিচয় জানেন বলিয়া বোধহয়। ইনি কে? কাহার কন্যা?”

 সুদেব কহিলেন, “মা, ইনি বিদর্ভরাজ মহাত্মা ভীমের কন্যা, ইহার নাম দময়ন্তী, বীরসেনের পুত্র মহারাজ নলের সহিত ইহার বিবাহ হয়। তারপর নল পাশায় রাজ্য হারাইয়া ইহাকে লইয়া দেশ ত্যাগ করেন সেই অবধি আমরা ইহাদিগকে খুঁজিয়া অস্থির হইয়াছি, কিন্তু এতদিন কোথাও ইহাদের সন্ধান পাই নাই। সমুদায় পৃথিবী ঘূরিবার পর আজ আপনার বাড়িতে এই মেয়েটিকে দেখিয়াই মনে হইল যে, ইনি দময়ন্তী; নহিলে এমন সুন্দর আর কে হইবে। ইহার দুটি ভ্রুর মাঝখানে একটি পদ্মের মতন জরুল আছে। মুখখানি মলিন হইয়া যাওয়াতে বোধ হয়, তাহা আপনাদের চক্ষে পড়ে নাই, কিন্তু আমি তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি।”

 সুনন্দা অমনি ভিজা গামছা আনিয়া, পরম যত্নে দময়ন্তীর কপালখানি ঘষিয়া পরিষ্কার করিলেন। তখন দেখা গেল যে, সত্য সত্যই ভূর মাঝখানে ঠিক পদ্মের আকৃতি একটি অতি সুন্দর জরুল রহিয়াছে। তাহা দেখিয়া রাজমাতা আর সুনন্দা দুজনেই দময়ন্তীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া অস্থির হইলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে রাজমাতা বলিলেন, “মাগো তুই এতদিন আমার বুকের এত কাছে ছিলি, তবু আমি তোকে চিনিতে পারি নাই। আমি যে মা তোর আপনার মাসী, আমার পিতার ঘরে তোকে হইতে দেখিয়াছি। তোর মা আর আমি দশার্ণ দেশের রাজা সুদামের মেয়ে। তোর মার বিবাহ হইল ভীমের সঙ্গে, আর আমাকে বাবা দিলেন এই অযোধ্যার রাজা বীরবাহুর হাতে। মা, তুই তোর আপনার ঘরে আসিয়াছিলি; এখানকার সকলই তোর।”

 তখন দময়ন্তী কাঁদিতে কাদিতে রাজমাতার পায়ের ধুলা লইয়া বলিলেন, “মা, আমিও আপনাকে চিনিতে পারি নাই, আপনিও আমাকে চিনিতে পারেন নাই। তবুও ত মা আপনার নিজের মেয়ের মতই যত্নে এতদিন আপনার আশ্রয়ে বাস করিয়াছি। সুনন্দা আমাকে যে স্নেহ দিয়াছে কোন্ ভাই বোন তাহার চেয়ে বেশি দিতে পারে! মাগো, এরপর এখানে থাকিলে আমার প্রাণে নিশ্চয় আরো সুখ হইত। কিন্তু এখন একটিবার বাবাকে আর খোকাখুকিকে দেখিবার জন্য আমার মন বড়ই অস্থির হইয়াছে। দয়া করিয়া আমাকে শীঘ্র বিদর্ভ নগরে পাঠাইয়া দিন।”

 রাজমাতা বলিলেন, “মা তুমি যথার্থই বলিয়াছ। আমার প্রাণ যদি তোমাকে দেখিয়া এমন করে, তবে না জানি তোমার বাপ মায়ের প্রাণ তোমার জন্য কি করিতেছে। মা, তুমি প্রস্তুত হও। আমি তোমাকে পাঠাইবার আয়োজন করিতেছি।

 রাজমাতার কথায় তখনই জরির সাজ দেওয়া হাতির দাঁতের পাল্কি প্রস্তুত হইয়া আসিল। পাগড়ি আঁটিয়া দশ হাজার সিপাহী তাহার সঙ্গে যাইবার জন্য ঢাল তলোয়ার বল্লম হাতে হাজির হইল।

 এদিকে সুনন্দা নিজ হাতে দময়ন্তীকে স্নান করাইয়া সাজা‍ইয়া প্রস্তুত করিয়াছে। পাল্কি আর লোকজন পথ খরচের সকল আয়োজন লইয়া উপস্থিত হইলে, তিনজনে মিলিয়া কিছুকাল কাঁদিলেন। তারপর দময়ন্তী তাহার মাসীমার পায়ের ধূলা লইলে, আব সুনন্দার গলা জড়াইয়া তাঁহাকে চুমো খাইলে, রাজমাতা ভক্তিভরে দেবতার নাম করিতে করিতে তাহাকে পাল্কিতে তুলিয়া দিলেন।

 দময়ন্তী বিদর্ভ দেশে পৌছিলে তাঁহার পিতা-মাতা আর আত্মীয়েবা কিরূপ আনন্দিত হইলেন, আর রাজা সুদেবকে তাহার আশার অধিক কত ধনরত্ন দিলেন, এ-সকল আমরা কল্পনা করিয়া লইতে পারি। দময়ন্তীও অবশ্য পিতামাতা আর সন্তান দুটিকে দেখিয়া ক্ষণকালের জন্য আনন্দিত হইলেন; কিন্তু তাহার পরেই আবার নলের চিন্তা আসিয়া, তাহার মুখের হাসি নিভাইয়া দিল! রাজা আর রাণী স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, নলের সন্ধান না করিতে পারিলে দময়ন্তীকে বাঁচান কঠিন হইবে।

 সুতরাং আবার ব্রাহ্মণগণ দেশ বিদেশে নলের সন্ধানে যাত্রা করিতে প্রস্তুত হইলেন। ব্রাহ্মণেরা দময়ন্তীর নিকট বিদায় লইতে আসিলে, দময়ন্তী তাহাদিগকে বলিয়া দিলেন, “আপনারা সকল দেশের পথে, ঘাটে, বাজারে, আর রাজসভায় এই কথা বারবার বলিবেন, “হে শঠ! বনের ভিতর ঘুমের মধ্যে দুঃখিনীকে ফেলিয়া কোথায় পলায়ন করিয়াছ? দুঃখিনী সেই আধখানি কাপড় পরিয়া কেবল তোমার জন্য চক্ষের জল ফেলিতেছে!” এ কথায় যদি কেহ কোন উত্তর দেন, তবে তিনি কে, কোথায় থাকেন, কি কেন, এ-সকল সংবাদ বিশেষ করিয়া জানিয়া আসিবেন।”

 ব্রাহ্মণেরা কত দেশে, কত বাজারে, কত সভায়, কত বনে, এই কথা চিৎকার করিয়া বলিলেন। লোকে তাহা শুনিয়া কত আশ্চর্য হই, কত বিদ্রুপ করিল, কিন্তু কথার উত্তর কেহ দিতে আসিল না। ক্রমে, একজন ছাড়া ব্রাহ্মণদিগের সকলেই ফিরিয়া আসিলেন।

 যে ব্রাহ্মণ তখনো ফিরেন নাই, তাহার নাম ছিল পর্ণাদ। অন্যেরা ফিরিবার পরেও, তিনি অনেকদিন ধরিয়া দেশে দেশে ঘুরিতে লাগিলেন। শেষে একদিন অযোধ্যায় ঋতুপর্ণের সভায় গিয়া, দময়ন্তীর ঐ কথাগুলি বলিলেন। সভায় কেহই তাহার কথার উত্তর দিল না, কিন্তু তিনি সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময়, রাজার বাহুক নামক সারথি চুপি চুপি তাহাকে ডাকিয়া একটা নির্জন স্থানে লইয়া গেল। লোকটি দেখিতে কুৎসিত, আর বেঁটে। তাহার হাত দুখানি সেই বেঁটে মানুষের পক্ষে নিতান্ত ছোট।

 বাহুক সেই ব্রাহ্মণকে নির্জনে লইয়া গিয়া বলিল, “নল নিতান্ত কষ্টের দশায় পাগলের মত হইয়া দময়ন্তীকে ছাড়িয়া যায়। তখন হইতেই তিনি দারুণ মনোদুঃখে কাল কাটাইতেছে। এমত অবস্থায় দময়ন্তী যেন তাহার উপর রাগ না করেন।”

 বাহুকের মুখে এ কথা শুনিয়া পর্ণাদ আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব করিলেন না। তিনি দিনরাত পথ চলিয়া, যত শীঘ্র সম্ভব, বিদর্ভ দেশে উপস্থিত হইয়াই, দময়ন্তীকে সকল কথা অবিকল বলিলেন। তাহা শুনিয়া দময়ন্তী পর্ণাদকে তাঁহার আশার অধিক ধনরত্ন দানে তুষ্ট করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর, আপনি আমার যে উপকার করিলেন, তাহার পুরস্কার আপনাকে আমি কি দিব? নল আসিলে, আপনি আরো ধন পাইবেন।”

 ব্রাহ্মণ যাহা পাইছিলেন তাহাতেই যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া দময়ন্তীকে আশীর্বাদ করিতে করিতে ঘরে চলিয়া গেলেন। তারপর দময়ন্তী তাহার মার নিকট গিয়া বলিলেন, “মা, সুদেবকে দিয়া আমি একটা কাজ করাইব; তুমি কিন্তু তাহা বাবাকে জানাইতে পারিবে না।”

 রানী এ কথায় সম্মত হইলে, তিনি তাঁহার সম্মুখে সুদেবকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, “ভাই সুদেব, তুমি ভিন্ন আর কেহ এ কাজ করিতে পারিবে না। তোমাকে ঋতুপর্ণ রাজার সভাতে যাইতে হইবে। সেখানে গিয়া তুমি বলিবে, “মহারাজ, কাল সকালে দময়ন্তীর আবার স্বয়ম্বর হইবে। আপনাদের যদি সেখানে যাইতে ইচ্ছা হয়, তবে আজ রাত্রির মধ্যেই যাহাতে বিদর্ভ দেশে গিয়া পৌছাইতে পারেন, তাহার উপায় করুন। কাল সূর্য উঠিলেই স্বয়ম্বরের কাজ শেষ হইয়া যাইবে।”

 এক রাত্রির মধ্যে অযোধ্যা হইতে বিদর্ভ দেশে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র নলেরই ছিল, পৃথিবীতে আর-একটি লোকেরও এ কাজ করিবার সাধ্য ছিল না। ঋতুপর্ণের ঐ বাহুক নামক সারথি যদি বাস্তবিকই নল হন, তবে তিনি একরাত্রির ভিতরেই ঋতুপর্ণকে বিদর্ভ নগরে আনিতে পারিবেন। ঋতুপর্ণ একরাত্রির ভিতরে বিদর্ভ দেশে পৌছাইতে পারিলে, নিশ্চয় বুঝা যাইবে যে, তাঁহার সারথির চেহারা যেমনই হউক, সে নল ভিন্ন আর কেহ নহে।

 দময়ন্তীর কথা শুনিয়া রাণী আর সুদেব দুজনেই তাহার বুদ্ধির প্রশংসা করিতে লাগিলেন। সুদেবের তখন এতই আনন্দ আর উৎসাহ হইল যে, তিনি সেই দণ্ডেই বায়ুবেগে অযোধ্যার পানে ছুটিয়া চলিলেন।

 সুদেবের নিকট দময়ন্তীর সংবাদ শুনিয়া, ঋতুপর্ণ তখনই বাহককে ডাকিয়া বলিলেন “বাহুক শুনিলাম, আবার নাকি দময়ন্তীর স্বয়ম্বর হইবে! আজ রাত্রির মধ্যে বিদর্ভ দেশে পৌছাইতে পারিলে, আমি সেই স্বয়ম্বরে উপস্থিত থাকিতে পারিব। এ কথায় তুমি কি বল?

 এক রাত্রির মধ্যে সেখানে পৌছাইতে পারিবে কি?”

 হায়, বেচারা বাহুক! রাজার কথায় সে উত্তর দিবে কি, তাঁহার সামনে স্থির হইয়া দাঁড়ানই তাহার পক্ষে নিতান্ত কঠিন হইল। তাহার মনে হইল, যেন তাহার বুকের ভিতর দশ জন লোকে হাম্বর (কামারদের প্রকাণ্ড হাতুড়ি) পিটিতে আরম্ভ করিয়াছে! মাথাটা যেন ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। নিতান্ত রাজার সামনে বলিয়া সে অনেক কষ্টে চোখের জল আর কান্না থামাইয়া রাখিল।

 যাহা হউক এভাবে অতি অল্প সময়ই গিয়াছিল। তাহার পরেই সে বুঝিতে পারিল যে, ‘দময়ন্তীর আবার স্বয়ম্বর হইবে, ইহা কখনই হইতে পারে না। আমার সন্ধান করিবার জন্যই সে এই কৌশল করিয়াছে!’ তখন সে রাজাকে বলিল, “হা ঁমহারাজ! আপনার অনুমতি হইলে, আমি একরাত্রির ভিতরেই মহারাজকে বিদর্ভ দেশে পৌছাইয়া দিতে পারি।”

 রাজা বলিলেন, “তবে শীঘ্র অশ্বশালায় গিয়া আটটি খুব ভালো ঘোড়া বাছিয়া আন। যেসে ঘোড়া এত তাড়াতাড়ি কিছুতেই যাইতে পারিবে না।”

 বাহুক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া চলিয়া গেল, আর খানিক বাদে আটটি রোগা-রোগা ঘোড়া লইয়া উপস্থিত হইল। রাজা বলিলেন, “ও কি ও! এ বেচারারা যে দেখিতেছি নিজের শরীর লইয়াই ভালো করিয়া চলিতে পারে না। এই ঘোড়া লইয়া তুমি একদিনে বিদর্ভ দেশে যাইবে, মনে করিয়াছ?

 বাহুক বলিল, “মহারাজ, যদি কোন ঘোড়া পারে, তবে এই-সকল ঘোড়াই আপনাকে বিদর্ভ দেশে লইয়া যাইতে পারিবে। আপনার কোন চিন্তা নাই। ইহারা পক্ষীবাজ ঘোড়া।”

 রাজা বলিলেন, “এ বিষয়ে তুমি আমাদের চেয়ে ঢের বেশি জান, তোমার যাহা ভালো মনে হয়, তাহাই কর।”

 রাজার কথায় নল ঘোড়াগুলিকে রথে জুতিলেন। তারপর রাজা বারবার তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে, নিতান্ত সন্দেহের সহিত রথে গিয়া চড়িলেন। অমনি ঘোড়াগুলি তাহার ভার সহিতে না পারিয়া মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া গেল। কিন্তু বাহুক তথাপি অন্য ঘোড়া লইল না। সেই ঘোড়াগুলিকে সে চাপড়াইয়া আর হাত বুলাইয়া শান্ত করিল, তারপর বার্ষ্ণেয়কে রথের পিছনে তুলিয়া সে রথ ছাড়িয়া দিল।

 যে ঘোড়া এইমাত্র লোকের ভার সহিতে না পারিয়া পড়িয়া গিয়াছিল, বাহুকের হাতে পড়িয়া সেই ঘোড়া এমনি তেজের সহিত রথ লইয়া ছুট দিল যে, রাজা ত দেখিয়া একেবারে অবাক। ক্রমে দেখা গেল যে, ঘোড়ার পা আর মাটি ছোঁয় না। দেখিতে দেখিতে তাহারা রথখানিকে সুদ্ধ শূন্যে উঠাইয়া লইয়া চলিল। ইহা দেখিয়া বার্ষ্ণেয় ভাবিল, “সামান্য একজন সারথির এমন অসাধারণ ক্ষমতা এ কথা ত কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। এ ব্যক্তি যদি এমন কদাকার আর বেঁটে না হইত, তবে নিশ্চয় মনে করিতাম, এ আমার প্রভু নল। তিনি ভিন্ন এই পৃথিবীতে আর কাহারো এমন ক্ষমতা নাই। অথচ এ ব্যক্তি যে নল নহে, এ কথা ত তাহার চেহারাতেই প্রমাণ হইতেছে, তবে কি ইনি কোন দেবতা?”

 রাজা বাহুকের ক্ষমতা দেখিয়া এতই আশ্চর্য হইয়াছে যে তাহার মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইতেছে না, কত নগর, কত বন, কত নদী, কত পর্বত যে তাহারা ইহারই মধ্যে পার হইয়াছেন তাহার লেখাজোখা নাই। হাওয়ার জোর এত হইয়াছে যে, তিনি তাহার চাদরখানিকে দুহাতে প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিয়াও গায়ে রাখিতে পারিতেছেনা। শেষে সে চাদর মহারাজের হাত হইতে একেবারেই ছুটিয়া চলিয়া গেল।

 রাজা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আরে, আরে! গেল, গেল! বাহুক! বার্ষ্ণেয়, থামো, থামো! আমার চাদর উড়িয়া গিয়াছে। শীঘ্র রথ থামাইয়া তাহা লইয়া আইস।”

 বাহুক বলিল, “মহারাজ, চাদর ও আর এখন আনা সম্ভব হইবে না; এতক্ষণে তাহা চারিক্রোশ পিছনে পড়িয়া গিয়াছে।”

 ইহাতে রাজা বাহুকের ক্ষমতার কথা ভাবিয়া যেমন আশ্চর্য হইলেন তেমনি তাহারও নিতান্ত ইচ্ছা হইল যে, নিজের ক্ষমতার কিছু পরিচয় দিয়া বাহুক কে আশ্চর্য করেন। তাই তিনি পথের ধারে একটা বহেড়া গাছ দেখিতে পাইয়া বাহুককে বলিলেন, “বাহুক, দেখ ত আমি কেমন গণিতে পারি, এই বহেড়া গাছে পাঁচ কোটি পাতা আর দুই হাজার পঁচানব্বইটি ফল আছে। আর উহার তলায় একশত একটি ফল পড়িয়া আছে।”

 বাহুক তখনই রথ থামাইয়া বলিল, “মহারাজের কথা যদি সত্য হয়, তবে মহারাজের এই ক্ষমতা নিতান্ত আশ্চর্য বলিতে হইবে। সুতরাং, এ কথার পরীক্ষা হওয়া আবশ্যক। আমি এখনই এই গাছটাকে কাটিয়া দেখিব।”

 ইহাতে রাজা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “বাহুক, এখন নহে। তাহা হইলে বড় বিলম্ব হইবে।” বাহুক বলিল, “মহারাজ একটু অপেক্ষা করুন; নাহয় বার্ষ্ণেয় মহারাজকে লইয়া বিদর্ভ দেশে যাউক।”

 রাজা আরো ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আরে না, না! তাহা কেমন করিয়া হইবে? তুমি ছাড়া আর কেহই এ কাজ করিতে পারিবেন না। সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাকে বিদর্ভ দেশে পৌঁছাইয়া দাও, তোমাকে খুশি করিব।”

 বাহুক বলিল, “মহারাজের কোন চিন্তা নাই;আমি গাছে পাতা আর ফল গণিয়া, মহারাজকে ঠিক পৌছাইয়া দিব।”

 রাজা আর কি করেন? বাহুকের আব্দার না রাখিলে তাহার কাজ হয় না। কাজেই তিনি তখন রাজি হইলেন। তখন বাহুক তাড়াতাড়ি রথ হইতে নামিয়া গাছটি কাটিয়া গণিয়া দেখিল রাজার কথাই ঠিক তাহাতে সে নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বলিল মহারাজ, আমি আপনাকে অশ্ব বিদ্যা (ঘোড়া চালাইবার বিদ্যা) শিখাইব, তাহার বদলে এই আশ্চর্য বিদ্যা আমাকে শিখাইতে হইবে।”

 অশ্ববিদ্যার কথা শুনিয়া রাজার আর আনন্দের সীমা রহিল না। তিনি তখনই বাহুককে দুই বিদ্যা শিখাইয়া দিলেন! একটি এই গণনাবিদ্যা আর একটি অক্ষবিদ্যা, অর্থাৎ পাশা বশ করিবার বিদ্যা।

 ঋতুপর্ণের নিকট হইতে নল অক্ষবিদ্যা শিখিবামাত্র, একটি আশ্চর্য ঘটনা হইল। কলি এতদিন পর্যন্ত, কর্কোটকের বিষে আর দময়ন্তী শাপে জ্বালাতন হইয়া অতিকষ্টে নলের শরীরে বাস করিতেছিল। এখন এই পবিত্র বিদ্যা তাহার দেহে প্রবেশ করাতে, দুষ্ট আর কিছুতেই সেখানে টিকিয়া থাকিতে পারিল না। সুতরাং সে তখনই কর্কোটকের বিষ বমি করিতে করিতে নলের শরীর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। নল তাহাকে দেখিবামাত্র বলিলেন, “তবে রে দুষ্ট, তুমি এতনি আমাকে এই কষ্ট দিয়াছ, তাহার প্রতিফল এই লও।” এই বলিয়া তিনি কলিকে শাপ দিতে প্রস্তুত হইলে, সে ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে হাত জোড় করিয়া কহিল, “মহারাজ, দময়ন্তীর শাপে, আর কর্কোটকের বিষে ইহার পূর্বেই আমার যথেষ্ট সাজা হইয়াছে। সুতরাং আপনি দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করুন। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে আপনার নাম লইবে, কখনো তাহার নিকট যাইব না।”

 এ কথায় নল দয়া করিয়া কলিকে ছাড়িয়া দিলে, দুষ্ট তাড়াতাড়ি সেই বহেড়া গাছের ভিতরে গিয়া লুকাইল। এ-সকল কথাবার্তা নলেতে আর কলিতে এমন ভাবে হইতেছিল যে বার্ষ্ণেয় আর ঋতুপর্ণ ইহার কিছুই জানিতে পারেন নাই। কলিকেও তাঁহারা দেখিতে পান নাই। তাঁহারা খালি বহেড়া গাছটাকে শুকাইয়া যাইতে দেখিলেন, কিন্তু এ কথা বুঝিতে পারিলেন না যে, কলি তাহার ভিতরে প্রবেশ করাতেই এরূপ হইয়াছে।

 নলকে কলি ছাড়িয়া গেলেও তাঁহার চেহারা অবশ্য বাহুকের মতই ছিল। আর ঠিক বাহুকের মত করিয়াই তিনি আবার ঘোড়ার রাশ ধরিয়া রথ চালাইতে লাগিলেন। পথে এত বিলম্ব হওয়ার পরেও তিনি সন্ধ্যার পূর্বেই রথ লইয়া বিদর্ভ দেশে পৌঁছিলেন।

 দূতগণ কুণ্ডিণপুরে (বিদর্ভদিগের রাজধানী) আসিয়া সংবাদ দিল যে, রাজা ঋতুপর্ণ আসিয়াছেন। তাহাতে ভীম একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “শীঘ্র তাঁহাকে আদরের সহিত এখানে লইয়া আইস।”

 ঋতুপর্ণও যে আশ্চর্য না হইলেন, এমন নহে। তিনি স্বয়ম্বরের সংবাদ পাইয়া আসিয়াছিলেন, কাজেই তাঁহার মনে হইয়াছিল যে, খুবই একটা ধুম-ধামের ব্যাপার দেখিতে পাইবেন। কিন্তু কুণ্ডিনপুরে পৌঁছিয়া তিনি একটা নিশানও দেখিতে বা একটা ঢোলের শব্দও শুনিতে পাইলেন না। তিনি নিতান্ত আশ্চর্য হইয়া ভাবিলেন, “তাই ত, বিষয় টা কি? স্বয়ম্বরের ত কোন আয়োজনই দেখিতে পাইতেছি না।”

 এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে তিনি রাজা ভীমের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে ভীম তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, কি নিমিত্ত আপনার শুভাগমন হইয়াছে?”

 এ কথায় তিনি ত বড়ই অপ্রস্তুত হইয়া গেলেন। স্বয়ম্বরের কোন আয়োজন নাই, একজন রাজাও আসেন নাই, একটি ব্রাহ্মণকেও দেখা যাইতেছে না; এমত অবস্থায় স্বয়ম্বরের কথা আর কি করিয়া বলেন? তাই তিনি থতমত খাইয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, “মহারাজ, আপনাকে দেখিতে আসিয়াছি।”

 নিকটের এত রাজাকে ফেলিয়া, এত পরিশ্রম করিয়া শতাধিক যোজন পার হইয়া ঋতুপর্ণ আসিয়াছেন কিনা —ভীমের সহিত দেখা করিতে! ভীমের মতন বুদ্ধিমান বুড়া রাজার এ কথা বিশ্বাস হইবে কেন? তিনি নিশ্চয় বুঝিলেন, ইহাব অন্য কোন-একটা মতলব আছে। কিন্তু এ কথা তিনি তাহাকে জানিতে দিলেন না। তিনি অল্প কাল তাঁহার সহিত মিষ্ট আলাপে কাটাইয়াই যত্ন পূর্বক তাহার আহার এবং বিশ্রামের আয়োজন করাইয়া দিলেন। ঋতুপর্ণও ভাবিলেন যে, বাঁচিলাম।

 বাহুক ততক্ষণে রথখানিকে রথশালায় রাখিয়া, ঘোড়াগুলিকে দলিয়া মলিয়া সুস্থ করিয়া, রথের ভিতরেই বিশ্রামের জোগাড় করিল।

 এতক্ষণ দময়ন্তী কি করিতেছিলেন? ঋতুপর্ণ আসিয়াছেন কিনা, তাহার সংবাদ যে তিনি বারবার বিশেষ করিয়া লইয়াছিলেন তাহাতে ত কোন সন্দেহই নাই। কেহ আসিয়া তাঁহার নিকট কোনরূপ সংবাদ দিবার পূর্বেই রথের শব্দ শুনিয়া তাঁহার মনে হইতেছিল যে, নল যখন রথ চালাইতেন, তখন ঠিক এমনি শব্দ হইত। তখন হইতেই তিনি নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া ঋতুপর্ণেব সারথিকে দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, কিন্তু হায় বাহুককে দেখিয়া তাঁহার প্রাণের সকল আশা চলিয়া গেল। এই কদাকাব পুরুষ নল, এ কথা কি বিশ্বাস হয়। দময়ন্তী একবার ভাবিলেন, হয়ত এ ব্যক্তি নল অথবা ঋতুপর্ণ কাহারো নিকট হইতে ঠিক নলের মত অশ্ববিদ্যা শিক্ষা কবিয়াছে। তাহাব পবেই তাঁহার মন যেন বলিল, এই বাহুকই নল, ইহার চালচলন ঠিক নলের মত।

 ভাবিয়া চিন্তিয়া দময়ন্তী স্থির করিলেন যে, এই বাহুকের সম্বন্ধে বিশেষ করিয়া সংবাদ লইতে হইবে। তারপর তিনি কেশিনী নাম্নী একটি বুদ্ধিমতী দাসীকে ডাকিয়া বলিলেন, “কেশিনী, ঐ যে কালো বেঁটে লোকটি রথের ভিতরে বসিয়া আছে, আমার মন বলিতেছে, উনিই নল। তুমি উহার নিকট গিয়া উহার পরিচয় জিজ্ঞাসা কর। নলকে খুঁজিবার জন্য ব্রাহ্মণদিগকে পাঠাইবার সময় আমি তাহাদিগকে যে কথাগুলি পথেঘাটে বলিতে বলিয়াছিলাম—কথায় কথাই সেই কথাগুলি উহাকে শুনাইবে, আর তাহাতে উনি কি বলেন, বেশ করিয়া মনে রাখিবে।”

 এ কথায় কেশিনী তখনই বাহুকের নিকট চলিয়া গেল, আর দময়ন্তী ছাতে উঠিয়া দেখিতে লাগিলেন।

 বাহুকের নিকট গিযা কেশিনী বলিল, “মহাশয়। আপনারা কি জন্য এখানে আসিয়াছেন, আর কখন অযোধ্যা হইতে যাত্রা করিয়াছিলেন, আমাদের দময়ন্তী এ-সকল কথা জানিতে চাহে।”

 বাহুক বলিল, “আমাদের রাজা আজ সকালে এক ব্রাহ্মণের নিকট শুনিয়া ছিলেন যে, কাল দময়ন্তীর স্বয়ম্বর হইবে। তিনি তখনই রথে পক্ষিরাজ ঘোড়া জুতিয়া এখানে আসিয়াছে। আমি তাঁহার সারথি।’

 কেশিনী বলিল, “আপনার সঙ্গে এই লোকটি কে?”

 বাহুক বলিল, “ইহাব নাম বার্ষ্ণেয়। ইনি আগে মহারাজ নলের সারথি ছিলেন, এখন ঋতুপর্ণের সারথির কাজ করেন।”

 কেশিনী বলিল, “এমন লোক থাকি রাজা আপনাকে কি জন্য সারথি করিয়াছেন?

 বাহুক বলিল, “আমি অশ্ববিদ্যা খুব ভালোরকম শিখিয়াছি। আর রাঁধিতেও বেশ পারি। তাই রাজা আমাকেও রাখিয়াছেন।”

 কেশিনী বলিল, “মহাশয়, আপনাদের এই বার্ষ্ণেয় কি নলের কোন সংবাদ জানেন?

 বাহুক বলিল, “নলের সংবাদ কেবল নলই জানেন, আর কেহই জানে না। বার্ষ্ণেয় তাহার সন্তান দুটিকে এখানে রাখিয়া গিয়াছিল, সে কেবল এইমাত্র বলিতে পারে।”

 কেশিনী বলিল, “আচ্ছা, মহাশয়, আমাদেব দেশের একটি ব্রাহ্মণ আপনাদের রাজসভায় গিয়া না কি একবার বলিয়াছিলেন, ‘হে শঠ, বনের ভিতবে দুঃখিনীকে ফেলিয়া কোথায় গেলে! দুঃখিনী তোমার জনা কাঁদিতেছে। অন্য কেহ না কি এ কথায় কিছু বলে নাই, কিন্তু আপনি এ কথার উত্তর দিয়াছিলেন। আপনি সেই ব্রাহ্মণকে কি বলিয়াছিলেন, তাহা শুনিতে দময়ন্তীর বড় ইচ্ছা হইয়াছে!"

 এ কথায় বেচারা বাহুকের চোখ ছল ছল করিতে লাগিল। সে অতি কষ্টে মনের দুঃখ গোপন করিয়া কেশিনীকে বলিল, “আমি বলিয়াছিলাম যে, নল নিতান্ত কষ্টের দশায় পাগলের মত হইয়া দময়ন্তীকে ছাড়িয়া যান। তখন হইতেই তিনি দারুণ মনোদুঃখে কাল কাটাইতেছেন। এমন অবস্থায় দময়ন্তী যেন তাহার উপর রাগ না করেন।”

 বলিতে বলিতে বেচারার মুখে আর কথা সরিল না, সে দুহাতে মুখ ঢাকিয়া একেবারে কাঁদিয়াই ফেলিল।

 এসকল কথা কেশিনীর মুখে শুনিয়া দময়ন্তীরও বড়ই কষ্ট হইল। কিন্তু তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির রাখিয়া বলিলেন, ‘কেশিনি, তুমি আবার যাও। তিনি কখন কি করেন বেশ ভালো করিয়া দেখিবে। তিনি আগুন চাহিলে আগুন আনিতে দিবে না। জল চাহিলে যাহাতে জল না পান, তাহা করিবে।”

 কেশিনী চলিয়া গেল। অনেকক্ষণ পরে সে নিতান্ত ব্যস্তভাবে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “এমন আশ্চর্য মানুষ ত আমি আর কখনো দেখি নাই! এতটুকু ছোট দরজা দিয়া ঢুকিবার সময়ও মাথা হেঁট করেন না। তিনি কাছে গেলেই দরজা আপনি বড় হইয়া যায়। খালি কলসীর দিকে তিনি একটিবার শুধু তাকাইলেই তাহা জলে ভরিয়া যায়। খড়ের গোছ হাতে করিয়া কি একটা কথা ভাবেন আর অমনি তাহা দপ করিয়া জ্বলিযা উঠে। আগুনের ভিতর তিনি হাত ঢুকাইয়া দিলেও তাহা পুড়ে না। জল অমনি তাহার ঘটিতে আসিয়া উপস্থিত হয়, গড়াইতে হয় না। ফুল হাতে লইয়া চটকাইতে লাগিলেন, সে ফুল নষ্ট না হইয়া আরো ভালো করিয়া ফুটিয়া উঠিল, আর তাহার ভিতর হইতে আরো চমৎকার গন্ধ বাহির হইতে লাগিল।”

 তখন দময়ন্তীর মন আনন্দে অধীর হইয়া উঠিল। তিনি নিশ্চয় বুঝিতে পারিলেন যে এই ব্যক্তির আকৃতি যেমনই হউক ইনি নল ভিন্ন আর কেহ নহেন। তথাপি তাহার মনে হইল যে, সকল সন্দেহ ভালো মত দূর করা উচিত। তাই তিনি কেশিনীকে বলিলেন, “কেশিনি, ইহার রাঁধা ব্যঞ্জন একটু খাইয়া দেখিতে পারিলে আমার মনের সকল সন্দেহ দূর হয়। তুমি আবার গিয়া উহার রাধা একটু ব্যঞ্জন চাহিয়া আন।”

 কেশিনী বাহুকের নিকট হইতে তাহার প্রস্তুত ব্যঞ্জন চাহিয়া আনিল। সে ব্যঞ্জন রাঁধিবার শক্তি আর কাহারই ছিল না।

 অনেক কষ্টে দময়ন্তী কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া মুখ ধুইলেন। তারপর ইন্দ্রসেন আর ইন্দ্রসেনাকে কেশিনীর হাতে দিয়া বলিলেন, “একটিবার তুমি ইহাদিগকে তাহার নিকট লইয়া যাও দেখি, তিনি ইহাদিগকে দেখিয়া কি করেন।”

 কেশিনী শিশু দুটিকে বাহুকের নিকট লইয়া যাইবামাত্র সে তাহাদিগকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া নিতান্ত আকুলভাবে কাঁদিতে লাগিল। কিন্তু পাছে তাহার কান্না দেখিয়া লোকে তাহাকে চিনিয়া ফেলে, তাই সে তাড়াতাড়ি সামলাইয়া গিয়া, কেশিনীকে বলিল, “আমার ঠিক এমনি দুটি খোকা খুকি ছিল, তাই ইহাদিগকে দেখিয়া আমার কান্না পাইতেছে। তুমি ইহাতে কিছু মনে করিও না। এখন তবে তুমি ইহাদিগকে লইয়া ঘরে যাও, আমার একটু কাজ কর্ম আছে।”

 বাহুকই যে নল এতক্ষণে আর দময়ন্তীর মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই রহিল না। তবে চেহারার এতটা তফাৎ কি করিয়া হইল এ কথায় মীমাংসা অবশ্য একবার দুজনের দেখা হইলে কি করিয়া হইবে? রাজা রানী এ-সকল কথা শুনিবামাত্র বাহুককে দময়ন্তীর নিকটে ডাকাইয়া আনিলেন। বেচারা আসিয়াই ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল, কোন কথা কহিতে পারিল না।

 দময়ন্তীও প্রথমে অনেক কাঁদিলেন; তারপর তিনি একটু শান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'বাহুক, তুমি কি এমন কোন ধার্মিক পুরুষের কথা জান, যিনি নিজের স্ত্রীকে ঘুমের মধ্যে বনের ভিতরে ফেলিয়া পলায়ন করিয়াছিলেন? দেবতাগণকে ফেলিয়া আমি তাহাকে বরণ করিয়াছিলাম; আমার কোন্ অপরাধে তিনি আমাকে ফেলিয়া গেলেন?” বলিতে বলিতে তাহার চোখ জলে ভরিয়া গেল; তিনি আর কথা কহিতে পারিলেন না।

 তখন নল বলিলেন, “দময়ন্তি, আমি কলির ছলনায় পাগলের মত হইয়া যাহা করিয়াছি, তাহার জন্য আমার উপর রাগ করিও না। এখন সেই দুষ্ট আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে কাজেই এরপর আর বোধহয় আমাদিগের দুঃখ দূর হইতে অধিক বিলম্ব নাই। আমি কেবল তোমাকে পাইবার জন্যই এখানে আসিয়াছি।”

 এরপর দুজনে অনেক কথাবার্তা হইল। তখন নলের সন্ধান করিবার জন্য দময়ন্তী যত চেষ্টা করিয়াছে, তাহার কিছুই নলের জানিতে বাকি রহিল না। দময়ন্তী দেশে বিদেশে লোক পাঠাইয়া নলকে খুঁজিয়াছেন; শেষে পর্ণাদের মুখে বাহুকের কথা শুনিয়া তিনি তাহার পরিচয় জানিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। বাহুক ঋতুপর্ণের সারথি সে যদি নল হয় তবে ঋতুপর্ণকে একদিনের ভিতরেই বিদর্ভ নগরে পৌছাইতে পারিবে। এই ভাবিয়া দময়ন্তী সুদেবকে দিয়া ঋতুপর্ণের ঋতুপর্ণের নিকট এমন সংবাদ পাঠাইলেন, যাহাতে একদিনের ভিতরেই তাহার বিদর্ভ নগরে পৌঁছাইবার দরকার হয়। ইহাতেই বাহুকের বিদর্ভ নগরে আসা হইল;নতুবা নল-দময়ীর আবার দেখা হইবার কোন উপায়ই ছিল না। এ-সকল কথার সমস্তই নল জানিতে পারিলেন; আর তাহাতে তাহার মনে বই আনন্দ হইল।

 এইরূপে তাঁহাদের দুঃখের দিন শেষ হইয়া গেল। তারপর নল সেই দুখানি কাপড় পরিয়া কর্কোটককে স্মরণ করিবামাত্র, তিনি তাহার নিজের সেই অপরূপ সুন্দর উজ্জল মূর্তি ফিরিয়া পাইলেন। তারপর সকলের মনে এমন সুখ হইল যে, তাহারা আর হাসিতে কুলাইতে না পারিয়া, ছেলেমানুষের মত কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

 এদিকে রানী রাজার নিকট ছুটিয়া গিয়া বলিতেছে, “ওগো, শীঘ্র একটি বার এস। দেখ আসিয়া, নল ফিরিয়া আসিয়াছে; আমাদের ঘরে আর আনন্দ ধরে না।”

 রাজা জোড়হাত মাথায় তুলিয়া স্বর্গের দিকে তাকাইলেন, তারপর বলিলেন, “আহা! বাঁচিয়া থাকুক, বাঁচিয়া থাকুক! আমি বুড়া মানুষ, এ সময়ে গিয়া তাহাদের সুখে বাধা দিব না। আজ তাহারা আনন্দ করুক, আর বিশ্রাম করুক, কাল গিয়া আমি তাহাদিগকে দেখিব।”

 পরদিন নল-দময়ন্তী যখন ভীমকে প্রণাম করিতে গেলেন, আর রাজ্যের সকলে এই সুখের সংবাদ জানিতে পারিল, তখন খুবই একটি আনন্দের ব্যাপার হইল—সে আর আমি কত বর্ণনা করিব! সারা দেশটার মধ্যে সকলেই হাসিমুখে ছুটাছুটি আর কোলাহল করিতেছিল; কেবল একটি লোক হাসিতে হাসিতে কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হইয়া মাথা চুলকাইতে ছিলেন।

 এ ব্যক্তি আর কেহ নহে—মহারাজ ঋতুপর্ণ। নিদ্রা হইতে উঠিয়াই তিনি শুনিতে পাইলেন যে, তাহার বাহুক নামক সারথিটিই মহারাজ নল, তিনি আবার তারা নিজ বেশ ধারণ করিয়া দময়ন্তীকে ফিরিয়া পাইয়াছে, এ কথা শুনিবামাত্র তাহার মনে হইল, “কি সর্বনাশ এত বড়লোক আমার সারথি হইয়াছিলেন, আর আমি তাহাকে চিনিতে পা্রি নাই! এমন মহাপুরুষকে দিন রাত কত আজ্ঞা করিয়াছি, আর হয়ত কতবার তাহার নিকট অপরাধীও হইয়াছি।”

 এ-সকল কথা ভাবিয়া ঋতুপর্ণের বড়ই লজ্জা হইল; আর নলকে দময়ন্তীকে ফিরিয়া পাওয়াতে, তাহার খুব আনন্দও হইল। শেষে তিনি নলকে ডাকাইয়া বলিলেন, “মহারাজ! আপনার সুখের সংবাদ শুনিয়া কত যে আনন্দিত হইলাম, তাহা মুখে প্রকাশ করিতে পারি না। আপনার নিকট না জানিয়া, হয়ত কত অপরাধ করিয়াছি। সে দোষ আমায় ক্ষমা করিতে হইবে।”

 নল বলিলেন, “সে কি মহারাজ! বিপদের সময় আমি আপনার আশ্রয়ে সুখে বাস করিতেছিলাম। আপনার আমার নিকট অপরাধ হওয়া দুরে থাকুক, বরং আমিই আপনার দয়ার ঋণ শোধ করিতে পারিব না। আপনার নিকট আমি আর এক বিষয়েও ঋণী আছি। আমি আপনাকে অশ্ববিদ্যা শিখাইব বলিয়াছিলাম, তাহা এ পর্যন্ত শিখান হয় নাই!"

 এ বলিয়া নল ঋতুপর্ণকে অশ্ববিদ্যা শিখাইয়া দিলে, ঋতুপর্ণ যার পর নাই আনন্দিত হইয়া অযোধ্যায় চলিয়া গেলেন। তারপর একটি মাস দেখিতে দেখিতে পরম সুখে কাটিয়া গেল। এক মাস পরে নল তাহার শ্বশুরকে বলিলেন, আপনার অনুমতি হইলে, এখন আমি দেশে গিয়া নিজের রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা দেখিতে চাহি।” এ কথায় ভীম অনেক আশীর্বাদ করিয়া তাকে বিদায় দিলেন।

 এতদিন নিষধে রাজত্ব করিয়া পুষ্করের মনে হইয়াছিল যে, চিরকালই এইরূপ রাষ্ট্র করিবে। সুতরাং নল যখন তাহার নিকট গিয়া বলিলেন, পুষ্কর, আইস, আর একবার পাশা খেলি, নাহয় দুজনে যুদ্ধ করি, তখন সে ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। যাহা হউক প্রথম বারে নলকে অতি সহজেই সে হারাইয়াছিল বলিয়া সে মনে করিল যে, এবারেও তেমনি সহজে তাহাকে হারাইয়া দিবে, কাজেই সে হাসিতে হাসিতে বলিল, “তুমি বুঝি বিদেশ হইতে অনেক ধন উপার্জন করিয়া আনিয়াছ! আচ্ছা তবে আর দেরি কেন, আন পাশা! এ টাকাও শীঘ্র আমারই হউক।”

 পাশা খেলা আরম্ভ হইল। এবারে আর কলি পুষ্করের সাহায্য করিতে আসিল না। কাজেই খেলার ফল কি হইল, সহজেই বুঝা যায়। নল তাহার সমস্ত রাজ্য ধনরত্ন ফিরিয়া পাইলেনই, শেষে পুষ্কর নিজের প্রাণ পর্যন্ত পণ রাখিয়াছিলেন, তাহাও তিনি জিতিয়া লইলেন। তখন পুষ্কর জীবনের আশা ছাড়িয়া দিয়া ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে, একবাব নলের দিকে, একবার দরজার দিকে তাকাইতে আরম্ভ করিলেন, নল বলিলেন, “ভয় নাই, পুষ্কর! হাজার হউক, তুমি আমার ভাই। আর, তুমি যাহা করিয়াছ, তাহাও নিজের বুদ্ধিতে কর নাই কলিই তোমাকে দিয়া সে কাজ করাইয়াছে। সুতরাং আমি তোমাকে ক্ষমা করিতেছি, তুমি নিশ্চিন্তে ঘরে যাও। আর তোমার নিজের যে ধন আমি জিতিয়াছি, তাহাও সঙ্গে লইয়া যাও। আশীর্বাদ করি, তুমি শত বৎসর বাঁচিয়া থাকিয়া পরম সুখে কাল যাপন কর।”

 এ কথায় পুষ্কর কাঁদিতে কাঁদিতে নলের পা জড়াইয়া ধরিল। ইহার পর আর সে কখনো নলের সহিত শত্রুতা করে নাই।

 তাবপর বিদর্ভ দেশে লোক গিয়া দময়ন্তী, ইন্দ্রসেন, আর ইন্দ্রসেনাকে লইয়া আসিল।

 তারপর কি হইল?—

 তারপর বড়ই আনন্দ হইল!