উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/পরীক্ষিতের কথা

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

পরীক্ষিতের কথা

 জনমেজয় হস্তিনার রাজা পরীক্ষিতের পুত্র। মহারাজ পরীক্ষিৎ অভিমন্যুর পুত্র, এবং অর্জুনের নাতি ছিলেন। তাঁহার তুল্য গুণবান ধার্মিক রাজা অতি অল্পই ছিল। প্রজাদিগকে তিনি নিজের পুত্রের মত পালন করিতেন।

 যুদ্ধ-বিদ্যায় আর মৃগয়ায় (শিকারে) তাহার মতন কেহই ছিল না। বিশেষত মৃগয়া করিতে তিনি বড়ই ভালবাসিতেন। পরীক্ষিতের বাণ খাইয়া মৃগ আবার উঠিয়া পলাইয়াছে এমন কথা কখনো শোনা যায় নাই।

 কিন্তু যাহা আর কখনো ঘটে নাই, এমন ঘটনাও মাঝে মাঝে ঘটিয়া থাকে। একথার প্রমাণ এই যে, একদিন একটি হরিণ পরীক্ষিতের বাণ খাইয়া পলায়ন করিল। হরিণটি পলায়ন করাতে তিনি কিরূপ আশ্চর্য আর ব্যস্ত হইলেন, বুঝিতে পার। তিনি ঐ মৃগের পিছু পিছু ত্রিভুবন ঘুরিয়া বেড়াইলেন, কিন্তু কিছুতেই তাহাকে ধরিতে পারিলেন না। শেষে পিপাসায় আর পরিশ্রমে নিতান্ত কাতর হইয়া, তিনি এক গোচারণের মাঠে (অর্থাৎ যে মাঠে গরু চরান হয়) আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 সেখানে আসিয়া তিনি দেখিলেন যে, বাছুরেরা গরুর দুধ খাইবার সময়, তাহদের মুখ দিয়া যে ফেনা বাহির হয় একজন তপস্বী ক্রমাগত সেই ফেনা পান করিতেছেন। তাঁহাকে দেখিয়া রাজা বলিলেন, “হে ব্রাহ্মণ, আমি অভিমন্যুর পুত্র রাজা পরীক্ষিৎ। আমার বাণ খাইয়া একটি হরিণ পলায়ণ করিয়াছে উহা কোন দিকে গিয়াছে, আপনি দেখিয়াছেন কি?”

 সেই মুনি তখন মৌনব্রত (অর্থাৎ ‘কোন কথা কহিব না’ এইরূপ নিয়ম) লইয়াছিলেন। সুতরাং তিনি রাজার কথার উত্তর দিলেন না।

 একে ত হরিণটা পলাইয়া যাওয়াতে রাজার মন নিতান্তই খারাপ হইয়াছিল, তাহাতে ক্ষুধা পিপাসা আর পরিশ্রমে তিনি অতিশয় অস্থির ছিলেন, তাহার উপর আবার মুনিকে বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াও তিনি কোন উত্তর পাইলেন না। সুতরাং তখন তাহার রাগ হইবে, ইহা আশ্চর্য কি? তাই তিনি ধনুর আগায় করিয়া একটি মরা সাপ আনিয়া মুনির গলায় জড়াইয়া দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মুনি ইহাতে কিছুমাত্র রাগ করিলেন না। আর মৌনব্রতে থাকার দরুণ, তিনি রাজাকে কিছু বলিতেও পারিলেন না।

 মুনি রাগ করিলেন না দেখিয়া, বাজারও রাগ চলিয়া গেল। তখন তিনি দুঃখের সহিত রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলেন।

 আসিবার সময় রাজা যদি সাপটি ফেলিয়া দিয়া মুনির নিকট ক্ষমা চাহিতেন, কি অন্তত দুটি মিষ্ট কথাও তাঁহাকে বলিতেন, তবে বড়ই ভাল হইত। কিন্তু তিনি তাহার কিছুই করিলেন না। মুনি সেই অবস্থাতেই রহিয়া গেলেন।

 সেই মুনির নাম ছিল শমীক। তিনি অতি মহাশয় পুরুষ ছিলেন, তাহা ইহাতেই বুঝা যাইতেছে যে, এমন অপমান পাইয়াও তিনি পরীক্ষিৎকে শাপ দেন নাই। পরীক্ষিৎকে তিনি খুব ধার্মিক রাজা বলিয়া জানিতেন। তাই তিনি তাঁহাকে ক্ষমা করিলেন।

 কিন্তু শমীকের পুত্র শৃঙ্গী এত সহজ লোক ছিলেন না। এই ঘটনার সময়ে শৃঙ্গী তপস্যা করিতে গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময় কৃশ নামক এক ঋষিপুত্রের সহিত তাঁহার দেখা হইল। কৃশ শৃঙ্গীকে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “শৃঙ্গী, তোমার পিতার গলায় মরা সাপ জড়ান রহিয়াছে, আর তুমি ত দেখিতেছি তপস্বী বলিয়া বড়ই বাহাদুরি করিয়া বেড়াইতেছ।”

 পিতার এইরূপ অপমানের কথা শুনিয়া শৃঙ্গীর মনে বড়ই ক্লেশ হইল তিনি কৃশকে বিনয় করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৃশ, পিতার এমন অপমান কি করিয়া হইল?”

 কৃশ বলিলেন, “রাজা পরীক্ষিৎ তোমার পিতার গলায় মরা সাপ দিয়া গিয়াছেন।”

 এ কথায় শৃঙ্গী রাগে দুইচোখ লাল করিয়া বলিলেন, “আমার পিতা সেই দুষ্ট রাজার কি করিয়াছিলেন, সত্য করিয়া বল। আজ তোমাকে আমার তপস্যার বল দেখাইতেছি।”

 কৃশ তখন সকল কথাই খুলিয়া বলিলেন। তাহা শুনিয়া শৃঙ্গী রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে পরীক্ষিৎকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “যে দুষ্ট আমার পিতার গলায় মরা সাপ দিয়াছে, আজ হইতে সাত দিনের মধ্যে, তক্ষকের (একটা ভযানক সাপ) কামড়ে তাহার মৃত্যু হইবে।”

 এই বলিয়া শৃঙ্গী তাঁহার পিতার নিকট গিয়া দেখিলেন, সত্য সত্যই তাঁহার গলায় একটা মরা সাপ জড়ান রহিয়াছে। তখন তিনি কাদিতে কাঁদিতে তাঁহাকে বলিলেন, “বাবা দুরাত্মা পরীক্ষিৎ বিনা অপরাধে আপনার এমন অপমান করিল। তাই আমি তাহাকে শাপ দিয়াছি যে, সাত দিনের ভিতরে তাহাকে তক্ষকে খাইবে।”

 শৃঙ্গীর কথায় শমীক নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “বৎস, তুমি রাজাকে শাপ দিয়া বড় অন্যায় কাজ করিয়াছ। এমন ধার্মিক রাজা একটা অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিলেও তাহার অনিষ্ট করা উচিত নহে। আর আমরা হইতেছি তপস্বী, ক্ষমা করাই আমাদের ধর্ম। ক্রোধ করিলে ধর্মের হানি হয়। আমার মৌনব্রতের কথা জানিলে, রাজা কখনই এমন কাজ করিতেন না। আমরা তাঁহার আশ্রয়ে সুখে বাস করিয়া কত পুণ্য উপার্জন করিতেছি, এমন লোককে কি শাপ দিতে হয়?”

 কিন্তু আর দুঃখ করিয়া কি ফল হইবে? শৃঙ্গী শাপ দিয়া বসিয়াছেন, এখন আর পরীক্ষিতের রক্ষা নাই। তথাপি শমীক মনে করিলেন যে, অন্তত এই সংবাদ রাজাকে জানাইয়া তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিলে কিছু উপকার হইতে পারে। সুতরাং তিনি, গৌরমুখ নামক একজন শিষ্যকে দিয়া এই সংবাদ পরীক্ষিতের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

 গৌরমুখের নিকট সকল কথা শুনিয়া, পরীক্ষিতের বড়ই অনুতাপ হইল। কিন্তু তিনি নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়া তত দুঃখিত হইলেন না, যত সেই মুনির কথা ভাবিয়া হইলেন। তিনি কেবল ইহাই বলিতে লাগিলেন, “আমি তাঁহার এত অপমান করিলাম, তথাপি তিনি আমাকে ক্ষমা করিলেন! হায়! এমন মহাপুরুষের অপমান করিয়া আমি কি কুকর্মই করিয়াছি।”

 যাহা হউক, এই বিষম বিপদ হইতে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় আছে কি না, পরীক্ষিৎ তাহার কথা ভাবিতে ভুলিয়া গেলেন না। মন্ত্রীদিগকে লইয়া তিনি এ বিষয়ে অনেক পরামর্শ করিলেন। তারপর রাজ্যের বড়বড় রাজমিস্ত্রী-দিগকে ডাকিয়া আনা হইল। তাহারা খুব মজবুত একটা থাম খাড়া করিয়া, তাহার আগায়, রাজার থাকিবার জন্য পায়রার ঘরের মত (অবশ্য, তার চেয়ে ঢের বড়) একটি ঘর প্রস্তুত করিয়া দিল। সেই ঘরে রাজা বড় বড় রোজা আর বদ্যি আর রাশি রাশি ঔষধ লইয়া অতি সাবধানে বাস করিতে লাগিলেন। বিনা অনুমতিতে কাহারই তাঁহার নিকট যাইবার উপায় রহিল না। থামের চারিধারে দিনরাত হাতিয়ার বাঁধা সিপাইরা পাহারা দিতে লাগিল পিপীলিকারও সাধ্য ছিল না যে, তাহাদিগকে ফাঁকি দিয়া উপরে যায়।

 সেকালে কাশ্যপ নামক এক মুনি, সাপের বিষের অতি আশ্চর্যরকম চিকিৎসা জানিতেন। পরীক্ষিৎকে সাপে খাইবে এই সংবাদ শুনিয়া, তিনি মনে করিলেন, ‘ইঁহাকে বাঁচাইতে পারিলে আমি নিশ্চয়ই অনেক টাকা পুরস্কার পাইব।’ এই মনে করিয়া তিনি তাঁহার চিকিৎসা করিবার জনা হস্তিনায় যাত্রা করিয়াছেন, এমন সময়ে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সহিত তাঁহার দেখা হইল। এই ব্রাহ্মণ আর কেহ নহে, তক্ষকই ব্রাহ্মণের বেশ পরিয়া রাজাকে সংহার করিতে যাইতেছে।

 কাশ্যপকে দেখিয়া তক্ষক জিজ্ঞাসা করিল, “কি মুনিঠাকুর, এত তাড়াতাড়ি কোথায় চলিয়াছেন?”

 কাশ্যপ কহিলেন, “রাজা পরীক্ষিৎকে আজ তক্ষকে কামড়াইবে, আমি তাঁহাকে বাঁচাইতে যাইতেছি।”

 তক্ষক বলিল, “মহাশয়, আমি সেই তক্ষক। আপনি মিছামিছি এত পরিশ্রম কেন করিতেছেন? ঘরে ফিরিয়া যাউন। আমি কামড়াইলে আপনার সাধ্য নাই যে, তাহাকে রক্ষা করেন।”

 কাশ্যপ কহিলেন, “আমি নিশ্চয়ই তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিব, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”

 তক্ষক বলিল, “যদি আপনার এমন ক্ষমতাই থাকে তবে আমি এই বটগাছটাকে কামড়াইতেছি, ইহাকে বাঁচাইয়া দিন ত দেখি!”

 কাশ্যপ কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি কামড়াও ত!”  এ কথায় তক্ষক সেই বটগাছটাকে কামড়াইবামাত্র উহার শিকড় অবধি আগা পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল। কিন্তু কাশ্যপের মন্ত্রের কি আশ্চর্য গুণ, তাহাতে মুহূর্তের মধ্যে সেই ছাই হইতে প্রথমে একটু অঙ্কুর, তারপর দুটি পাতা এইরূপ করিয়া ক্রমে সেই প্রকাণ্ড বটগাছ যেমনটি ছিল তেমনটি অবিকল হইয়া দাঁড়াইল। সে সময়ে একটি ব্রাহ্মণ কাঠের জন্য সেই গাছে উঠিয়াছিলেন, গাছের সঙ্গে তিনিও ভস্ম হইয়া যান, আবার কাশ্যপের মন্ত্রে বাঁচিয়া উঠেন!

 বটগাছ বাঁচিতে দেখিয়া, তক্ষক অতিশয় আশ্চর্য হইয়া কাশ্যপকে বলিল, “আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা! আপনার অসাধ্য কিছুই নাই। কিন্তু আপনি কিসের জন্য পরীক্ষিৎকে বাঁচাইতে চাহিতেছেন?”

 মুনি বলিলেন, “রাজাকে বাঁচাইলে অনেক টাকা পাইব, তাই আমি তাঁহাকে বাঁচাইতে চাহিতেছি।”

 এ কথায় তক্ষক বলিল, রাজাকে বাঁচাইলে যে অনেক টাকা পাইবেন, তাহা ত বুঝিলাম, কিন্তু যদি বাঁচাইতে না পারেন, তখন কেমনটি হইবে? আপনি মুনির শাপেব সঙ্গে যুঝিতে যাইতেছেন, সে জায়গায় আপনার মন্ত্র নাও খাটিতে পারে। তাহার চেয়ে এক কাজ করুন না! আপনার টাকা পাওয়া নিয়াই ত কথা—রাজার কাছে যাহা পাইতেন, আমিই আপনাকে সেই টাকাটা দিতেছি। তাহা লইয়া আপনি ঘরে চলিয়া যাউন, আপনার অনেক পরিশ্রম বাঁচিয়া যাইবে।”

 মুনির টাকাটারই দরকার ছিল, তাহার চেয়ে ভাল উদ্দেশ্য তাঁহার ছিল না। সুতরাং তিনি তক্ষকের কথায় বিশেষ সুবিধাই বোধ করিয়া, তাহার নিকট হইতে অনেক টাকা লইয়া আহ্লাদের সহিত ঘরে ফিরিলেন।

 এদিকে তক্ষক হস্তিনায় আসিয়া যখন দেখিল যে, পরীক্ষিৎকে সোজাসুজি গিয়া কামড়াইবার কোন উপায় নাই, তখন সে ইহার এক কৌশল স্থির করিল। তক্ষকেব কথায় কতকগুলি সাপ ব্রাহ্মণ সাজিয়া ফল, ফুল, কুশ আর জল হাতে হস্তিনায় আসিয়া বলিল যে, “আমরা রাজাকে আশীর্বাদ করিতে আসিয়াছি।”

 এ সময়ে রাজার যে আশীর্বাদের নিতান্তই প্রয়োজন ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সুতরাং এই-সকল ব্রাহ্মণের তাঁহার সাক্ষাৎ পাইতে কোন কষ্ট হইল না। কপট ব্রাহ্মণেরা রাজাকে কপট আশীর্বাদপূর্বক ফল দিয়া প্রস্থান করিল।

 উহারা চলিয়া গেল, রাজা অমাত্যগণকে লইয়া সেই-সকল ফল আহার করিবার আয়োজন করিলেন। রাজা একটি ফল হাতে লইয়া দেখিলেন যে, উহার ভিতর হইতে একটি অতিশয় ক্ষুদ্র কীট বাহির হইয়াছে। উহার শরীর তাম্রবর্ণ, চোখদুটি কাল কাল।

 মুনি বলিয়াছিলেন, সাতদিনের ভিতরে রাজার মৃত্যু হইবে। সেদিনকার সূর্য অস্ত গেলেই সেই সাত দিন পূর্ণ হয়, রাজারও বিপদ কাটিয়া যায়। সূর্যও তখন গাছের আড়ালে লুকাইতে আরম্ভ করিয়াছেন, অস্ত হইতে আর বিলম্ব নাই। ইহা দেখিয়া রাজার ভয় অনেকটা কমিয়া যাওয়াতে, তিনি তামাসা করিয়া বলিলেন, “এখন আর আমার বিষের ভয় নাই, এখন এই পোকাই তক্ষক হইয়া আমাকে কামড়াইতে আসুক! তাহ হইলে আমার শাপও কাটে, ব্রাহ্মণের কথাও থাকে।”  এই বলিয়া তিনি সেই পোকাটিকে নিজের গলায় রাখিয়া হাসিতে লাগিলেন। কিন্তু হায়! তাহার সেই হাসি অতি অল্পক্ষণের জন্যই দেখা দিয়াছিল। সেই পোকাই ছিল তক্ষক। রাজার হাসির সঙ্গে সঙ্গে সে নিজ মূর্তি ধারণ করিয়া ভীষণ গর্জনের সহিত তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল! তারপর কি হইল, আর বলিয়া কি হইবে?

 এই রূপে পরীক্ষিতের মৃত্যু হইলে, সকলে মিলিয়া তাহার শিশুপুত্র জনমেজয়কে হস্তিনার রাজা করিল।

 সে সময় হয়ত জনমেজয় এ-সকল ঘটনার অর্থ ভাল করিয়া বুঝিতে পারেন নাই। কিন্তু বড় হইয়া তিনি অনেক সময় এ বিষয়ের চিন্তা করিতেন। একদিন তিনি পাত্রমিত্র সমেত সভায় বসিয়া রাজ্যের কাজ দেখিতেছেন, এমন সময় উতঙ্ক নামক একটি মুনি আসিয়া তাহাকে বলিলেন, “মহারাজ! আসল কাজের কথা ভুলিয়া ছেলেমানুষের মতন, কেন সামান্য কাজে ব্যস্ত রহিয়াছেন?”

 মুনির কথা শুনিয়া জনমেজয় বলিলেন, “কেন, আমি ত রাজ্যের কাজ আমার সাধ্যমত করিতেছি। আপনি আর কোন্ কাজের কথা বলিতেছেন?”

 মুনি বলিলেন, “আমি যে কাজের কথা বলিতেছি, আর সকল কাজের আগে, তাহাই আপনার কাজ। দুরাত্মা তক্ষক যে আপনার পিতাকে বধ করিয়াছিল, তাহার প্রতিশোধ না লইয়া, আপনি আর কোন্ কাজের কথা ভাবিতেছেন? সেই দুষ্ট বিনা দোষে আপনার পিতার প্রাণনাশ করিয়াছিল।

 কাশ্যপ মহারাজকে বাঁচাইতে আসিতেছিলেন, পাপিষ্ঠ তাঁহাকে পথের মাঝখান হইতে ফিরাইয়া দিল। এই দুরাত্মাকে শাস্তি দিতে আর বিলম্ব করবেন না। শীঘ্র সর্পযজ্ঞের আয়োজন করিয়া, উহাকে তাহার আগুনে পোড়াইয়া মারুন। ইহাতে আমারও কাজ হইবে। আমি গুরুর জন্য দক্ষিণা আনিতে গিয়াছিলাম, পথে ঐ দুষ্ট আমাকে বড়ই কষ্ট দিয়াছে।”

 উতঙ্ককে তক্ষক কি কষ্ট দিয়াছিল, তাহা এখানে বলিয়া কাজ নাই। উহার নিকট পরীক্ষিতের কথা শুনিয়া জনমেজয় অমাত্যগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার পিতার মৃত্যু কিরূপে হইয়াছিল?”

 এ কথায় অমাত্যগণ পরীক্ষিতের মৃত্যুর সকল বৃত্তান্ত শুনাইলে, তিনি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া চোখের জল ফেলিলেন। তারপর তিনি ক্রোধভরে বলিলেন, “হে অমাত্যগণ, আমি যাহা বলিতেছি তাহা তোমরা শোন দুষ্ট তক্ষক যে আমার পিতার প্রাণ বধ করিয়াছিল, ইহার উচিত শাস্তি তাহাকে দিতেই হইবে।”

 তারপর তিনি ঋত্বিকগণকে (যে-সকল মুনি যজ্ঞ করেন) ডাকাইয়া বলিলেন, “দুরাত্মা তক্ষক আমার পিতাকে বধ করিয়াছিল, আমি তাহার প্রতিফল দিতে চাহি। আপনারা এমন কোন যজ্ঞের কথা জানেন কি না, যাহা দ্বারা আমি সেই দুষ্টকে ভাই বন্ধু সকল সুদ্ধ আগুনে পোড়াইয়া মারিতে পারি?”

 ঋত্বিকগণ বললেন, “মহারাজ। পুরাণে লেখা আছে যে, ঠিক আপনার এই কার্যের জন্যই বহুকাল পূর্বে, দেবতাগণ সপর্যজ্ঞ নামক একটা যজ্ঞের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন। ঐ যজ্ঞ করিলে নিশ্চয়ই তক্ষকের মৃত্যু হইবে।”

 একথা শুনিয়া জনমেজয় আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করিলেন না। তখনই যজ্ঞের আয়োজন আরম্ভ হইল, ঋত্বিকেরা যজ্ঞভূমি মাপিয়া প্রস্তুত করাইলেন। যজ্ঞের সকল সামগ্রী আনিয়া, সেই যজ্ঞভূমি পরিপূর্ণ করা হইল।

 সাপেরা এতদিন কি করিতেছিল? আমরা জানি যে, উহারা জরৎকারু মুনির সহিত বাসুকির ভগিনীর বিবাহ দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিল। তারপর কি হইল?

 তখন হইতেই তাহারা এ বিষয়ে বিস্তর চেষ্টা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল; কিন্তু নানা কারণে কাজটি তাহাদের নিকট বড়ই কঠিন বোধ হইল।